পরিশিষ্ট

বহ্নি-পতঙ্গ – ৪

চার

বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ফটকের দিকে যাইতে যাইতে গত রাত্রির কথা মনে পড়িল। ডাক্তার পালিতের উদ্বিগ্ন অনুসন্ধিৎসু চক্ষু শকুন্তলাকে অনুসরণ করিয়াছিল। তিনি অভিজ্ঞ ডাক্তার, অন্যের কাছে যাহা লক্ষণীয় নয়, তিনি তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার চোখে উদ্বেগ ও সংশয়ের ছায়া দেখিলাম কেন? কিসের উদ্বেগ?

ফটকের বাহিরে আসিয়া ডাক্তার নিজের মোটরে উঠিবার উপক্রম করিলেন, তারপর কি ভাবিয়া আমাদের কাছে ফিরিয়া আসিয়া পাণ্ডেজিকে বলিলেন, ‘আমার হাতেই দীপনারায়ণবাবুর মৃত্যু হয়েছে। আমাকে যদি আপনারা অ্যারেস্ট করতে চান আমার কিছু বলবার নেই। এখন আমি রুগী দেখতে চললাম। যখনই তলব করবেন থানায় হাজির হব।’

পাণ্ডেজি কিছু বলিলেন না, কেবল একটু হাসিলেন। ডাক্তার নড করিয়া মোটরে উঠিলেন এবং মোটর হাঁকাইয়া প্রস্থান করিলেন।

পাণ্ডেজি হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন, ‘এখনও সাড়ে দশটা বাজেনি। চলুন আমার বাসায়।’

আমরা মোটরে উঠিতে যাইতেছি এমন সময় আর একটি মোটর আসিয়া থামিল। পুরানো হাড়-নড়বড়ে মরিস গাড়ি, তাহা হইতে অবতরণ করিল নবীন ডাক্তার জগন্নাথ প্রসাদ। আমাদের দেখিয়া সে নাক-ঝাড়ার শব্দ করিল, তারপর পাণ্ডেজির দিকে ভ্রূভঙ্গ করিয়া বলিল, ‘সকালবেলা আপনি এখানে?’

জগন্নাথকে দেখিয়া পাণ্ডেজির মুখ গম্ভীর হইয়াছিল, তিন পালটা প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি এখানে?’

জগন্নাথ হাল্কা সুরে বলিল, ‘এদিক দিয়ে রুগী দেখতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দীপনারায়ণজিকে দেখে যাই। কেমন আছেন তিনি?’

পাণ্ডেজি হিম-কঠিন কণ্ঠে বলিলেন, ‘কেমন আছেন তিনি তা আপনি ভালভাবেই জানেন। ন্যাকামি করবার দরকার কি?’

ক্ষণেকের জন্য জগন্নাথ ডাক্তার থতমত খাইয়া গেল, তারপর অসভ্যের মত দাঁত বাহির করিয়া বলিল, ‘তাহলে যা শুনেছি তা সত্যি—পান্নালাল পালিত দীপবাবুকে ইন্‌জেকশন দিয়ে মেরেছে।’

পাণ্ডেজি অতি কষ্টে ধৈর্য রক্ষা করিয়া ধীর স্বরে কহিলেন, ‘দীপনারায়ণবাবু মারা গেছেন। কী করে মারা গেছেন তা আপনার জানবার দরকার নেই, আপনি এ বাড়ির ডাক্তার নন। এ বাড়ি এখন পুলিসের দখলে, আপনি ইন্সপেক্টর রতিকান্ত চৌধুরীর অনুমতি না নিয়ে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।’

জগন্নাথ একবার আমাদের দিকে ধৃষ্ট নেত্রপাত করিল, বলিল, ‘আপনিও দেখছি বাঙালীদের দলে ভিড়েছেন। তা ভিড়ুন, কিন্তু অসুখে পড়লে বাঙালী ডাক্তারের কাছে যাবেন না। দীপবাবুর দৃষ্টান্তটা মনে রাখবেন।’

পাণ্ডেজি উত্তর দিবার আগেই জগন্নাথ নিজের মোটরে গিয়া উঠিল এবং ঝড়্‌ঝড়্‌ শব্দ করিতে করিতে প্রস্থান করিল।

পাণ্ডেজিকে আগে কখনও রাগিতে দেখি নাই, এখন দেখিলাম তাঁহার গৌরবর্ণ মুখ রাগে রক্তাভ হইয়া উঠিয়াছে। তিনি গলার মধ্যে একটা অবরুদ্ধ শব্দ করিয়া গাড়িতে উঠিলেন। আমরাও উঠিলাম।

মিনিট দশেকের মধ্যে পাণ্ডেজির বাসায় পৌঁছানো গেল। পাণ্ডেজি চায়ের হুকুম দিলেন, কারণ পশ্চিমের শীতে চা-পানের কোনও নির্ধারিত সময় নাই। তারপর আমরা বসিবার ঘরে গিয়া অধিষ্ঠিত হইলাম। পাণ্ডেজি প্রশ্ন করিলেন, ‘কী মনে হল?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘খুনই বটে, আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। যিনি এই কার্যটি করেছেন তিনি অতি কৌশলী ব্যক্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দীপনারায়ণ সিংকে খুন করে কার লাভ?’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘লাভ একমাত্র দেবনারায়ণের। দীপনারায়ণ অপুত্রক মারা গেছেন, সুতরাং সব সম্পত্তিই এখন তার।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘অপুত্রক কিনা এখনও ঠিক বলা যায় না, শকুন্তলা দেবীর ছেলে হতে পারে। কিন্তু দেবনারায়ণ হয়তো খবরটা জানত না।’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘না জানাই সম্ভব। মৃত্যুর পূর্বে কেবল দীপনারায়ণ সিং বোধহয় খবরটা জানতে পেরেছিলেন।’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘তিনি জানতে পারলে কি চুপ করে থাকতেন? যাহোক, ধরা যাক তিনি জানতেন না, শকুন্তলা স্বামীকে বলেননি। তাহলে কথাটা দাঁড়াচ্ছে কী? দেবনারায়ণ সমস্ত সম্পত্তির লোভে খুড়োকে খুন করিয়েছে। নিজের হাতে এ কাজ করেনি, করবার মত বুদ্ধি তার নেই।’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘কাল রাত্রি সওয়া সাতটার সময় আমরা যখন দীপনারায়ণের বাড়িতে গিয়েছি তখন দেবনারায়ণ বাড়িতেই ছিল।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘অত বড় হাতির শরীর নিয়ে সে নিজে ডাক্তারখানায় যায়নি নিশ্চয়। কিন্তু অন্য কেউ যেতে পারে, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তার মোসাহেবরা—’

চা আসিল। ব্যোমকেশ পেয়ালায় একটি ক্ষুদ্র চুমুক দিয়া সিগারেট ধরাইল, কতকটা মানসিক জল্পনার সুরে বলিল, ‘কিন্তু দেবনারায়ণ যদি খুড়োর গঙ্গাযাত্রা না করিয়ে থাকে, তাহলে আর কে করতে পারে? কার লাভ?’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আর কারুর লাভ আছে বলে তো মনে হয় না। তবে ওই ব্যাটা ঘোড়া জগন্নাথের অসাধ্য কাজ নেই। বাঙালী ডাক্তারদের অপদস্থ করবার জন্যে ওরা সব পারে।’

ব্যোমকেশ হাসিল, ‘ঘোড়া জগন্নাথের ওপর আপনি ভীষণ চটে গেছেন। ওরা সব ছুঁচো-প্যাঁচা, খুন করার সাহস ওদের নেই। যে খুন করেছে তার চরিত্র অন্য রকম; সে মহা দুঃসাহসী অথচ কূটবুদ্ধি, শিক্ষিত অথচ নৃশংস; বিজ্ঞান জানে, ডাক্তারি বিদ্যেও আছে—’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘ঘোড়া জগন্নাথের সঙ্গে আপনার বর্ণনা খাসা মিলে যাচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঘোড়া জগন্নাথের মোটিভ খুব জোরালো নয়। অবশ্য তার যদি অন্য কোনও মোটিভ থাকে তাহলে আলাদা কথা। আচ্ছা, একটা কথা জিগ্যেস করি কিছু মনে করবেন না। শকুন্তলা দেবী সুন্দরী এবং আধুনিকা, পাটনা শহরে তাঁর অনুরাগী এডমায়ারার নিশ্চয় আছে?’

পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘তা আছে। শুনেছি রোজ সন্ধ্যেবেলা দু’চারজন পয়সাওয়ালা আধুনিক ছোকরা দীপনারায়ণের বাড়িতে আড্ডা জমাতো। ব্রিজ খেলা, চা-কেক খাওয়া, হাসি গল্প গান—এই সব চলত। ঘোড়া জগন্নাথ বড়মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসে, সেও ওদের দলে থাকত। তবে মাস ছয়েক আগে দীপনারায়ণ যখন অসুখে পড়লেন তখন ওদের আড্ডা ভেঙে গেল। দু’এক জন মাঝে মাঝে খোঁজ-খবর নিতে যেত। নর্মদাশঙ্কর—’

‘নর্মদাশঙ্কর কে?’

‘বড়মানুষের অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে। এলাহাবাদের লোক। বিহারে জমিদারী আছে। শুধু অকালকুষ্মাণ্ড নয়—পাজি। পুলিসের খাতায় নাম আছে। একবার শিকার করতে গিয়ে একটা দেহাতি মেয়েকে নিয়ে লোপাট হয়েছিল। ব্যাপার খুব ঘোরালো হয়ে উঠেছিল, তারপর মেয়ের বাপকে টাকাকড়ি দিয়ে মোকদ্দমা ফাঁসিয়ে দিলে—’

নর্মদাশঙ্কর দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে যাতায়াত করত?’

‘হ্যাঁ, নর্মদাশঙ্কর বাইরে খুব চোস্ত কেতা-দুরস্ত লোক, চেহারা ভাল, মিষ্টি কথা। কিন্তু আসলে পাজির পাঝাড়া।’—পাণ্ডেজি মুখের অরুচি-সূচক একটা ভঙ্গী করিলেন—‘স্ত্রী-স্বাধীনতা খুবই বাঞ্ছনীয় বস্তু, অসুবিধা এই যে ভদ্রবেশী লুচ্চাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না।’

‘হুঁ। শকুন্তলা দেবী কি এদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা করতেন?’

‘তা করতেন। কিন্তু তাঁর সত্যিকার বদনাম কখনও শুনিনি। যারা অত উঁচুতে নাগাল পেত তারা নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্করা করত, টিটকিরি দিত—এই পর্যন্ত।’

‘ওটা আমাদের স্বভাব—দ্রাক্ষাফল অতি বিস্বাদ ও অম্লরসে পরিপূর্ণ।’ ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল—‘এখন তাহলে ওঠা যাক। আপনি কি আর ওদিকে যাবেন?’

‘বিকেলবেলা যাব। আপনারাও যদি আসেন—’

‘নিশ্চয় যাব। বাড়ির লোকগুলিকে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখা দরকার।’