• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৯. বাসায় ফিরিতে দেরি হইল

লাইব্রেরি » শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ব্যোমকেশ সমগ্র (ব্যোমকেশ বক্সী) » ১৪. আদিম রিপু - ব্যোমকেশ বক্সী - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ০৯. বাসায় ফিরিতে দেরি হইল

বাসায় ফিরিতে দেরি হইল। রাত্রি সাড়ে তিনটা হইতে বেলা সাড়ে আটটা পর্যন্ত কোন দিক দিয়া কাটিয়া গিয়াছে জানিতে পারি নাই।

ফিরিয়া আসিয়াই ব্যোমকেশ খবরের কাগজ লইয়া বসিয়া গেল। আমি কয়েকবার অনাদি-প্ৰসঙ্গ আলোচনার চেষ্টা করিলাম‌, কিন্তু সে গায়ে মাখিল না। একবার অন্যমনস্কভাবে চোখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ?

আমি রাগ করিয়া নিরুত্তর হইলাম। কুক্ষণে খোকাকে একখানি আবোল-তাবোল কিনিয়া দিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ বইখানি মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে এবং সময়ে অসময়ে আবৃত্তি করিয়া শুনাইতেছে।

গত রাত্রে নিদ্রায় ঘাটতি পড়িয়াছিল‌, দুপুরবেলা তাহা পূরণ করিয়া লইলাম। বৈকালের চা পান করিতে বসিয়া ব্যোমকেশ নিজেই কথা পাড়িল‌, ‘কেষ্টবাবুর এখনও দেখা নেই। মনে হচ্ছে সবাই গা এলিয়ে দিয়েছে।’

বলিলাম‌, ‘কেষ্টবাবুর যখন গলায় কাঁটা বিঁধেছিল‌, তখন ছুটে এসেছিল। এখন বোধহয় কাঁটা বেরিয়ে গেছে তাই গা-ঢাকা দিয়েছে।’

‘তাই হবে। কিন্তু ওরা যদি না আসে‌, আমিই বা কি করতে পারি। কেসটা বেশ রহস্যময়–’

‘কে খুন করেছে এখনও বুঝতে পারনি?’

‘উহু। কিন্তু যেই করুক‌, খুব ভেবেচিন্তে আটঘটি বেঁধে করেছে। কালীপুজোর রাত্তির‌, চতুর্দিকে বোমা ফাটার শব্দ‌, তার মধ্যে একটি বন্দুকের আওয়াজ। প্ল্যান করে খুন না করলে এমন যোগাযোগ হয় না।’

‘কে এমন গ্ল্যান করতে পারে?’

‘কে না করতে পারে। সকলেরই স্বার্থ রয়েছে‌, সকলেরই সুযোগ রয়েছে।’

‘সকলে কারা?’

‘একে একে ধর। প্রথমে ধর নিমাই নিতাই। খুড়ো পুষ্যিপুত্তুর নিলেই খুড়োর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যায়‌, অতএব খুড়োকে পুষ্যিপুতুর নেবার আগেই সরানো দরকার। নিমাই নিতাইয়ের মধ্যে একজন শ্ৰীকান্ত হোটেলের চুড়োয় আড্ডা গাড়ল‌, বন্দুক নিয়ে ওৎ পেতে রইল। কালীপুজের রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে বন্দুকের গুলি ছুটিল। খুড়ো কুপোকাৎ। কাম ফতে।’

‘তাহলে ভাইপোরাই খুন করেছে‌, অন্য কারুর ওপর সন্দেহের কারণ নেই।’

‘কারণ যথেষ্ট আছে। শ্ৰীকান্ত হোটেলের তেতলার ঘরে রাইফেলের গুলি এল কোথ’। থেকে? ওই ঘর থেকে বন্দুক ছোঁড়া হয়েছিল এটা একটা অনুমান বটে‌, কিন্তু অনিবার্য অনুমান নয়। ভেবে দেখ‌, অনাদি হালদার ব্যালকনিতে যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল‌, ঠিক তার পেছনেই দরজা। পিছন থেকে গুড়ি মেরে এসে কেউ যদি তাকে গুলি করে‌, তাহলে গুলিটা তার শরীর কুঁড়ে শ্ৰীকান্ত হোটেলের তেতলার ঘরের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকবে এবং দেয়ালে আটকে যাবে।’

‘সম্ভব বটে। কিন্তু গোড়াতেই তো গলদ। অনাদি হালদারের বাসায় সে ছাড়া আর কেউ ছিল না‌, দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ ছিল। তাছাড়া আর একটা কথা‌, গুলিটা অনাদি হালদারের বুকের দিক দিয়ে ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বেরিয়েছিল, না পিঠের দিক দিয়ে ঢুকে বুকের দিক দিয়ে বেরিয়েছিল?’

‘সেটা পোস্ট-মর্টেম না হওয়া পর্যন্ত জানা যাবে না। কিন্তু যেদিক দিয়েই গুলি ঢুকুক‌, ব্যালকনিতে গুলিটা পাওয়া যায়নি। তা থেকে অনুমান করা অন্যায় হবে না যে‌, বাসার ভিতর দিক থেকেই অনাদি হালদারকে গুলি করা হয়েছে।’

‘আচ্ছা‌, তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক যে‌, বাসার ভিতর থেকেই কেউ গুলি চালিয়েছে। কিন্তু লোকটা কে?’

‘সেইটেই আসল প্রশ্ন। দেখা যাক কার স্বাৰ্থ আছে। কেষ্ট দাসের কোনও স্বার্থ আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। কিন্তু লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত এবং পাজি‌, হয়তো দোষ কাটাবার জন্যেই শেষ রাত্রে আমার কাছে ছুটে এসেছিল। সুতরাং তাকেও বাদ দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় হল ননীবালা দেবী। ‘

‘ননীবালা?’

‘ননীবালা দেবীটি জবরদস্ত মহিলা। পালিত পুত্রের প্রতি তাঁর স্নেহ খাঁটি মাতৃস্নেহের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। তিনি জানতেন না যে প্ৰভাতের পোষ্যপুত্র গ্রহণের ব্যাপারে আইনঘটিত খুঁত আছে। সুতরাং তিনি ভাবতে পারেন যে অনাদি হালদারকে সরাতে পারলেই প্রভাত সম্পত্তি পাবে। এবং তাকে মারবার চেষ্টা আর কেউ করবে না। তোমার মনে আছে কিনা জানি না‌, ননীবালা যেদিন দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন‌, সেদিন আমি বলেছিলাম‌, অনাদি হালদারের মৃত্যুতে অনেকের সুবিধে হতে পারে। হয়তো সেই কথাটাই ননীবালার প্রাণে গেথে গিয়েছিল।’

‘কিন্তু–মেয়েমানুষ বন্দুক চালাবে?’

‘কোন চালাবে না? বন্দুক চালানোর মধ্যে শক্তটা কোনখানে? হারমোনিয়াম যেমন টিপলেই সুকুর‌, কৰ্ম্মক তেমনি টিপলেই গুলি বোঝায়। ওর চেয়ে কুমড়ো-ছেচকি রাঁধা ঢের বেশি কঠিন কাজ।’

‘কিন্তু ননীবালা তো ‘জয় মা কালী দেখছিলেন।’

‘তিনি ‘জয় মা কালী’ দেখতে গিয়েছিলেন‌, কিন্তু সারাক্ষণ প্রেক্ষাগৃহে ছিলেন‌, তার প্রমাণ কৈ? তাঁর সঙ্গে পরিচিত কেউ ছিল না‌, হয়তো ছবি আরম্ভ হবার পর তিনি অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়েছিলেন‌, তারপর কাজকর্ম সেরে আবার গিয়ে বসেছিলেন।’

‘তিনি বন্দুক কোথায় পেলেন?’

‘হায় মুর্খ! বাঁটুল সদারের মত গণ্ডাগণ্ডা  গুণ্ডা যেখানে চোরাই বন্দুক পাচার করবার জন্যে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে‌, সেখানে বন্দুকের অভাব? পাঁচ টাকা খরচ করলে বন্দুক ভাড়া পাওয়া যায়।’

‘হুঁ। তারপর?’

‘তারপর প্রভাত। প্ৰভাত অবশ্য জানত যে সে অনাদি হালদারের পুষ্যিপুত্তুর নয়‌, কিন্তু তার অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তার নিজস্ব দোকান আছে‌, অনাদি হালদার মরে গেলেও তার মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। সে ভাবতে পারে অনাদি হালদারের মৃত্যুর পর তার ভাইপোরা আর তার কোনও অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে না। ভাইপোদের হাত থেকে নিজের প্ৰাণ বাঁচাবার জন্যেই হয়তো সে অনাদি হালদারকে মেরেছে।’

‘এটা খুব জোরালো মোটিভ তুমি মনে করা?’

‘খুব জোরালো মোটিভ না হতে পারে‌, কিন্তু তিল কুড়িয়ে তাল হয়। প্ৰভাত একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল‌, অনাদি হালদার সে সম্বন্ধ ভেঙে দেয়। এটাও সামান্য মোটিভ নয়।’

আমি হাসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হেসো না। তোমার কাছে যা তুচ্ছ‌, অন্যের কাছে তা পর্বতপ্ৰমাণ হতে পারে। কখনও প্রেমে পড়নি‌, প্রেম কি বস্তু জান না। প্রেমের জন্যে মানুষ খুন করতে পারে, ফাঁসি যেতে পারে, সর্বস্ব খোয়াতে পারে—‘

‘আচ্ছা‌, আচ্ছা‌, মেনে নিলাম প্ৰভাতও খুন করতে পারে।’

‘তবে একটা কথা আছে। প্রভাত সারাক্ষণ তার দোকানে ছিল‌, দোকানের দরজায় গুর্খা দরোয়ান ছিল। তার এই অ্যালিবাই যদি পাকা হয়—‘

‘পাকা হওয়াই সম্ভব। প্ৰভাত এমন মিথ্যে কথা বলবে না। যা সহজেই ধরা যায়। তারপর বল। ‘

‘তারপর ন্যাপা।’ ব্যোমকেশ পকেট হইতে কুড়াইয়া পাওয়া চাবিটি বাহির করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিল‌, ‘দুটো খবর নিশ্চয়ভাবে জানা দরকার : এটা অনাদি হালদারের চাবি কিনা এবং এটা গলিতে কে ফেলেছিল।’

বলিলাম‌, ন্যাপার ওপরই তোমার সন্দেহ‌, কেমন? মনে করা যাক‌, এটা অনাদি হালদারের আলমারির চাবি এবং ন্যাপা এটা গলিতে ফেলেছিল। তাতে কী প্ৰমাণ হয়?’

‘প্ৰমাণ হয়তো কিছুই হয় না‌, কিন্তু ন্যাপার ওপর সন্দেহ হয়। আলমারিতে হয়তো অনেক নগদ টাকা ছিল–’

এ আবার এক নূতন সম্ভাবনা। প্রশ্ন করিলাম‌, ‘দাঁড়ালো কি? আসামী কে? নিমাই নিতাই? কেষ্টবাবু? ননীবালা? প্ৰভাত? ন্যাপা? না আর কেউ?’

‘আর একজন হতে পারে।’

‘আবার কে?’

‘বাঁটুল সর্দার।’

‘বাঁটুল! সে কেন অনাদি হালদারকে খুব করবে?’

‘প্রাণরক্ষার ওজুহাতে চাঁদা আদায় করা বাঁটুলের পেশা। অনাদি হালদার চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেছিল। তার দেখাদেখি যদি অন্য সকলে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে? তাই অনাদি হালদারকে শাস্তি দেওয়া দরকার‌, তার পরিণাম দেখে আর সকলে শায়েস্তা থাকবে।’

পুঁটিরাম আসিয়া চায়ের পেয়ালা তুলিয়া লইয়া গেল। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল‌, ‘বাঁশি বনে ডোম কানা। শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী করে রেখে করে ফেলি।’

দুইজনে নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। ঘড়িতে যখন সওয়া চারটে‌, তখন দ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল।

দ্বার খুলিয়া দেখিলাম কেষ্টবাবু। শেষ পর্যন্ত কেষ্টবাবু আসিয়াছেন। কিন্তু এ কেষ্টবাবু সকালবেলার ভয়বিমূঢ় মদ্যবিহ্বল কেষ্টবাবু নয়‌, চটপটে স্মার্ট কেষ্টবাবু। গায়ে ধোপদূরস্ত জামাকাপড়‌, দস্তুর মুখে আত্মপ্রসন্ন মৃদুমন্দ হাসি। মানুষটা যেন আগাগোড়া বদলাইয়া গিয়াছে।

তিনি ব্যোমকেশের সম্মুখের চেয়ারে উপবিষ্ট হইলেন। ব্যোমকেশ চাবিটি হাতে তুলিয়া ধরিয়া নিবিষ্ট মনে নিরীক্ষণ করিতেছিল‌, চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘খবর কি? পুলিস এসেছিল?’

কেষ্টবাবু চাবিটি দেখিলেন, কিন্তু তাঁহার মুখে-চোখে কোনও প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পাইল না। প্রশ্নের উত্তরে তিনি মুখে চটকার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘এগারোটার সময় এসেছিল। কী রামরাজত্বে বাস করছি আমরা।‘

চাবি পকেটে রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তারপর কি হল?’

‘কি আর হবে। দারোগী সকলকে হুমকি দিলে, অনাদির আলমারিটা খুলে দেখলে, একগোছা নোট ছিল পকেটে পুরলে, তারপর লাশ তুলে নিয়ে চলে গেল।‘

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গুম হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আপনাদের কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে না?’

‘কাল রাত্রে কে কোথায় ছিলাম জিজ্ঞেস করেছিল, আর কিছু নয়। একছত্র লিখেও নিলে না। দুম দুম করে এল, দুম দুম করে চলে গেল।‘

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক, অনাদি হালদারের বেশ সদগতি হল। কে মেরেছে তা জানা যাবে না, পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ভালই হল, আপনাদের ভুগতে হবে না।‘

কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘ভাল যাদের হবার তাদের হল, আমার আর কি ভাল হল, ব্যোমকেশবাবু? আমাকে বেশিদিন ওখানে টিকতে হবে না।’

‘কেন?’

‘ননীবালা পেছনে লেগেছে, আমাকে তাড়াতে চায়। এখন তো আর অনাদি নেই, মাগীর বিক্রম বেড়েছে। দেখুন না, বেরুবার সময় বললাম, এক পেয়ালা চা করে দেবে? তা মুখ-ঝামটা দিয়ে উঠল, চা-টা এখন হবে না, দোকানে গিয়ে চা খাওগে।‘

ক্ষণেক নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে আপনি এখন কি করবেন মনে করেছেন?’

‘কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কাজকর্ম তো আর এ-বয়সে পোষাবে না।’ বলিয়া কেষ্টবাবু দুই সারি দাঁত বাহির করিয়া হাসিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার বয়স এমন কী বেশি হয়েছে।–কাজ করবার বয়স যায়নি।’

‘কাজ করার অভ্যোস ছেড়ে গেছে, ব্যোমকেশবাবু। হ্যা হ্যা, আচ্ছা, আজ উঠি তাহলে।‘ বলিয়া তিনি গাত্ৰোত্থান করিলেন।

‘বসুন, বসুন, চা খেয়ে যান।‘

কেষ্টবাবু আবার বসিয়া পড়লেন। ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে ডাকিয়া চা ও জলখাবার আনিতে কেষ্টবাবু হৃষ্টমুখে বলিলেন, “আপনি ভদ্রলোক, তাই দরদ বুঝলেন। সবাই কি বোঝে? দুনিয়া স্বার্থপর, গলা টিপে না ধরলে কেউ কিছু দেয় না। অনাদি যে আমাকে একেবারে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে—‘ তিনি ব্যোমকেশের পানে আড়নয়নে চাহিলেন, ‘চা খুবই ভাল জিনিস, তবে কি জানেন, আমার একটা বদঅভ্যোস হয়ে গেছে, বিকেলবেলার দিকে শুধু চায়ে আর মৌতাত জমে না।‘ বলিয়া হ্যা হ্যা করিয়া হাসিলেন।

ইঙ্গিতটা ব্যোমকেশ এড়াইয়া গেল। বলিল, ‘পুলিস ছাড়া আর কেউ এসেছিল নাকি? নিমাই নিতাই?’

কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘নিমাই নিতাই আর আসেনি। তবে গুরুদত্ত সিং এসে খানিকটা চেঁচামেচি করে গেল।’

‘গুরুদত্ত সিং, কনট্রাকটর—‘

‘হ্যাঁ। পুলিস চলে যাবার পরই সে এসে হাজির। চেঁচাতে লাগল, আমি পঞ্চাশ হাজার টাকার কাজ করেছি, মোটে ত্ৰিশ হাজার পেয়েছি, আজ অনাদি হালদার দশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল, সে মরে গেছে, এখন কে দেবে টাকা। আমি বললাম, বাপু, কে টাকা দেবে তা আমরা কি জানি। অনাদির ওয়ারিশের কাছে যাও, থানায় যাও, আদালতে যাও, এখান থেকে বিদেয় হও। যেতে কি চায়? অনেক কষ্টে বিদেয় করলাম।’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল‌, ‘অনাদি হালদার কনট্রাকটরকে আজ দশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল.কাল ছিল ব্যাঙ্ক-হলিডে‌, তার মানে পরশু ব্যাঙ্ক থেকে টাকা এনে রেখেছিল‌, অর্থাৎ–‘

কেষ্টবাবু বলিলেন‌, ‘ব্যাঙ্ক থেকে?’

‘হ্যাঁ‌, ব্যাঙ্ক থেকে ছাড়া অত টকা কোথা থেকে আসবে?’

কেষ্টবাবু সুর পাল্টাইয়া বলিলেন‌, ‘তা তো বটেই। আমি ওসব কিছু জানি না। আদার ব্যাপারী, হ্যা হ্যা—‘

ব্যোমকেশ তখন বলিল‌, ‘ওকথা থাক। আপনি ওদের ঘরের লোক‌, নাড়ির খবর রাখেন‌, কে খুন করেছে আন্দাজ করতে পারেন না?’

কেষ্টবাবু কিয়াৎকোল নতনেত্ৰে থাকিয়া চোখ তুলিলেন‌, ‘আপনাকে ধৰ্ম্মকথা বলব‌, বাড়ির কেউ এ-কাজ করেনি।’

‘কারুর ওপর আপনার সন্দেহ হয় না?’

‘সন্দেহ সকলের ওপরেই হয়‌, কিন্তু বিশ্বাস হয় না। এ ওই ভাইপো দুটোর কাজ। ভেবে দেখুন‌, বাড়ির লোকের অন্যদিকে মেরে লাভ কি? সকলেই ছিল অনাদির অন্নদাস। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে‌, দুদিন বাদে হাঁড়ি চড়বে না।’

‘হাঁড়ি চড়বে না কেন? নৃপেন মাইনের চাকর ছিল‌, সে অন্যত্র চাকরি খুঁজে নেবে। আর প্ৰভাত? তার তো দোকান রয়েছে।’

‘দোকান থাকবে কি? ভাইপোরা মোকদ্দমা করে কেড়ে নেবে।’

‘যদি কেড়েও নেয়‌, তবু ওদের অন্নাভাব হবে না। প্ৰভাত আর কিছু না পারুক‌, দপ্তরীর কাজ করে নিজের পেট চালাতে পারবে।’

‘দপ্তরীর কাজ।’ কেষ্টবাবু চকিতে চোখ তুলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন।

‘আপনি জানেন না? প্ৰভাত দপ্তরীর কাজ জানে‌, ছেলেবেলায় দপ্তরীর দোকানে কাজ শিখেছে।’

পুঁটিরাম চা ও জলখাবার লইয়া আসিল। কেষ্টবাবু জলখাবারের রেকবি তুলিয়া লইয়া আহারে মন দিলেন‌, কিন্তু তাঁহার চক্ষু দু’টি অন্তর্নিবিষ্ট হইয়া রহিল। একবার শুধু অস্ফুট স্বরে বলিলেন‌, ‘কি আশ্চর্য! আমি জানতাম না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না-জানা আর আশ্চর্য কী! দপ্তরীর কাজ এমন কিছু মহৎ কাজ নয় যে কেউ ঢাক পেটাবে।’

কেষ্টবাবু একবার ধূর্ত চক্ষু তুলিয়া বলিলেন‌, ‘তা বটে।’

পানাহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ তাঁহাকে সিগারেট দিয়া বলিল‌, ‘আজ সকালে আপনি বলেছিলেন‌, অনাদি হালদারের সব গুপ্তকথা। আপনি জানেন‌, ইচ্ছে করলে তাঁকে ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারেন—‘

কেষ্টবাবু ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, ‘গুপ্তকথা! না না‌, আমি অনাদির গুপ্তকথা কেখেকে জািনব? মদের মুখে কি বলেছিলাম তার কি কোনও মনে হয়? আচ্ছা‌, আজ চললাম‌, অসংখ্য ধন্যবাদ।’ তিনি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন।

ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল‌, ‘শুনুন‌, কেষ্টবাবু-তিনি দ্বারের কাছে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন‌, ‘গুপ্তকথা না বলতে চান না বলবেন‌, আমার বেশি আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ রাত্তিরে এখানে খাওয়া-দাওয়া করতে তো দোষ নেই। ওখানে হয়তো আজ। আপনার খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হবে—‘

কেষ্টবাবু সাগ্রহে দুই পা অগ্রসর হইয়া আসিলেন‌, ‘খাওয়া-দাওয়া—!’

‘হাঁ। আপনার খাতিরে আজ না-হয় একটু তরল পদার্থের ব্যবস্থা করা যাবে।’

‘সত্যি বলছেন। আপনারও। তাহলে অভ্যোস আছে। মোদ দিদিমণি না জানতে পারে‌, কেমন? হ্যা হ্যা। ক’টার সময় আসব বলুন।’

‘সন্ধ্যের পরই আসবেন। আমাকে বোধহয় একবার বেরুতে হবে। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন‌, যদি ফিরতে দেরি হয় চাকরি আপনাকে বসাবে।’

‘বেশ বেশ‌, আমি সন্ধ্যার পরই আসিব।’ দ্ৰংষ্ট্রাবিকট হাস্য করিতে করিতে তিনি প্ৰস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ আমার প্রতি চোখ নাচাইয়া বলিল‌, ‘সাদা চোখে কেষ্ট দাস কিছু বলবে না। —অজিত‌, তুমি শুড়ি বাড়ি যাও‌, একটি পাঁট বোতল কিনে নিয়ে এস। নাসিক হুইস্কি হলেই চলবে। এদিকে আমি পুঁটিরামকে তালিম দিয়ে রাখছি।’

Share on FacebookShare on TwitterShare on WhatsAppShare on TelegramShare on SMS
Category: ১৪. আদিম রিপু - ব্যোমকেশ বক্সী - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৮. বৃদ্ধ ষষ্ঠীবাবু
পরবর্তী:
১০. পুঁটিরামকে তালিম »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑