পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ২৩

তেইশ

শেষ রাত্রির দিকে কলকাতায় ফিরিয়া পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিতে দেরি হইল। শয্যাত্যাগ করিয়া দেখিলাম আকাশ জলভারাক্রান্ত হইয়া আছে, আজও মেঘ কাটে নাই। বসিবার ঘরে গিয়া দেখি তক্তপোশের উপর ব্যোমকেশ ও আর একজন চায়ের পেয়ালা লইয়া বসিয়াছে। আমার আগমনে লোকটি ঘাড় ফিরাইয়া দন্ত বাহির করিল। দেখিলাম—বিকাশ।

আমিও তক্তপোশে গিয়া বসিলাম। বিকাশের মুখখানা বকাটে ধরনের কিন্তু তাহার দাঁত-খিঁচানো হাসিতে একটা আপন-করা ভাব আছে। তাহার বাচনভঙ্গীও অত্যন্ত সিধা ও বস্তুনিষ্ঠ। সে বলিল,—‘উনিশ নম্বরে গিয়ে জান্‌ কয়লা হয়ে গিয়েছে স্যার।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘কী দেখলেন শুনলেন বলুন।’

বিকাশ সক্ষোভে বলিল,—‘কি আর দেখব শুনব স্যার, একেবারে লঝ্‌ঝড় মাল, নাইন্‌টীন-ফিফটীন্‌ মডেল—’

ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি বলিল,—‘হ্যাঁ হ্যাঁ। বুঝেছি। ওখানে কি কি খবর পেলেন তাই বলুন।’

বিকাশ বলিল,—‘খবর কিস্‌সু নেই। ও বাড়িতে দুটো বস্তাপচা ইস্ত্রীলোক থাকে—’

‘দুটো!’ ব্যোমকেশের স্বর উত্তেজিত হইয়া উঠিল।

‘আজ্ঞে। বাড়িতে তিনটে ঘর আছে, কিন্তু ইস্ত্রীলোক থাকে দুটোই।’

‘ঠিক দেখেছেন, দুটোর বেশি নেই?’

বিকাশের আত্মসম্মানে আঘাত লাগিল,—‘দুটোর জায়গায় যদি আড়াইটে বেরোয় স্যার, আমার কান কেটে নেবেন। অমন ভুল বিকাশ দত্ত করবে না।’

‘না না, আপনি ঠিকই দেখেছেন। কিন্তু তৃতীয় ঘরে কি কেউ থাকে না, ঘরটা খোলা পড়ে থাকে?’

‘খোলা পড়ে থাকবে কেন স্যার, বাড়িওয়ালা ও-ঘরটা নিজের দখলে রেখেছে। মাঝে মাঝে আসে, তখন থাকে।’

‘ও—’ ব্যোমকেশ আবার নিস্তেজ হইয়া পড়িল।

তারপর বিকাশ আরও কয়েকটা খুচরা খবর দিল, কিন্তু তাহা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক এবং ছাপার অযোগ্য বলিয়া উহ্য রাখিলাম।

বিকাশ চলিয়া যাইবার পর প্রায় পনরো মিনিট ব্যোমকেশ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তারপর লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,—‘ব্যস্‌, প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। অজিত, তুমি নীচের ডাক্তারখানা থেকে কিছু ব্যান্ডেজ, কিছু তুলো আর একশিশি টিঞ্চার আয়োডিন কিনে আনো দেখি।’

অবাক হইয়া বলিলাম,—‘কি হবে ওসব?’

‘দরকার আছে। যাও, আমি ইতিমধ্যে কলোনীতে টেলিফোন করি।—হ্যাঁ, গোটা দুই বেশ পুরু খাম মনিহারী দোকান থেকে কিনে এনো।’ বলিয়া সে টেলিফোন তুলিয়া লইল।

আমি জামা পরিতে পরিতে শুনিলাম সে বলিতেছে,—‘হ্যালো,…..কে, বিজয়বাবু? একবার নেপালবাবুকে ফোনে ডেকে দেবেন? বিশেষ দরকার।…’

সওদা করিয়া ফিরিয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ টেলিফোনে বাক্যালাপ শেষ করিয়াছে, টেবিলে ঝুঁকিয়া বসিয়া দুইটি ফটোগ্রাফ দেখিতেছে।

ফটোগ্রাফ দুইটি সুনয়নার, রমেনবাবু যাহা দিয়াছিলেন। আমাকে দেখিয়া সে বলিল,—‘এবার মন দিয়ে শোনো।’—

দুটি খামে ফটো দুইটি পুরিয়া সযত্নে আঠা জুড়িতে জুড়িতে ব্যোমকেশ বলিল,—‘আমি কিছুদিন থেকে একটা দুর্দান্ত গুণ্ডাকে ধরবার চেষ্টা করছি। গুণ্ডা কাল রাত্রে বাদুড়বাগানের মোড়ে আমাকে ছুরি মেরে পালিয়েছে। আঘাত গুরুতর নয়, কিন্তু গুণ্ডা আমাকে ছাড়বে না, আবার চেষ্টা করবে। আমি তাকে আগে ধরব, কিম্বা সে আমাকে আগে মারবে, তা বলা যায় না। যদি সে আমাকে মারে তাহলে গোলাপ কলোনীর রহস্যটা রহস্যই থেকে যাবে। তাই আমি এক উপায় বার করেছি। এই দুটি খামে দুটি ফটো রেখে যাচ্ছি। একটি খাম নেপালবাবুকে দেব, অন্যটি ভুজঙ্গধরবাবুকে। আমি যদি দু’চার দিনের মধ্যে গুণ্ডার ছুরিতে মারা যাই তাহলে তাঁরা খাম খুলে দেখবেন আমি কাকে, কলোনীর হত্যা সম্পর্কে সন্দেহ করি। আর যদি গুণ্ডাকে ধরতে পারি তখন আমার অপঘাত-মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে; তখন আমি খাম দুটি ওঁদের কাছ থেকে ফেরত নেব এবং গোলাপ কলোনীর অনুসন্ধান যেমন চালাচ্ছি তেমনি চালাতে থাকব। বুঝতে পারলে?’

বলিলাম,—‘কিছু কিছু বুঝেছি। কিন্তু এই অভিনয়ের ফল কি হবে?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘ফল কিছুই হবে কি না এখনও জানি না। মা ফলেষু। নেপালবাবু বারোটার আগেই আসছেন। তুমি এই বেলা আমার হাতে ব্যাণ্ডেজটা বেঁধে দাও। আর, তোমাকে কি করতে হবে শোনো।’—

আমি তাহার বাঁ হাতের প্রগণ্ডে ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতে আরম্ভ করিলাম; টিঞ্চার আয়োডিনে তুলা ভিজাইয়া বেশ মোটা করিয়া তাগার মত পটি বাঁধিলাম; কামিজের আস্তিনে ব্যান্ডেজ ঢাকা দিয়া একফালি ন্যাকড়া দিয়া হাতটা গলা হইতে ঝুলাইয়া দিলাম। এই সঙ্গে ব্যোমকেশ আমার কর্তব্য সম্বন্ধে আমাকে উপদেশ দিল—

বেলা এগারোটার সময় দ্বারের কড়া নড়িল। আমি দ্বারের কাছে গিয়া সশঙ্ককণ্ঠে বলিলাম,—‘কে? আগে নাম বল তবে দোর খুলব।’

ওপার হইতে আওয়াজ আসিল,—‘আমি নেপাল গুপ্ত।’ সন্তর্পণে দ্বার একটু খুলিলাম; নেপালবাবু প্রবেশ করিলে আবার হুড়কা লাগাইয়া দিলাম।

নেপালবাবুর মুখ ভয় ও সংশয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল, তিনি বলিয়া উঠিলেন,—‘এ কি! মতলব কি আপনাদের?’

ব্যোমকেশ তক্তপোশের উপর বালিসে পিঠ দিয়া অর্ধশয়ান ছিল। ক্ষীণকণ্ঠে বলিল,—‘ভয় নেই, নেপালবাবু। এদিকে আসুন, সব বলছি।’

নেপালবাবু দ্বিধাজড়িত পদে ব্যোমকেশের পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ ফ্যাকাসে হাসি হাসিয়া বলিল,—‘বসুন। টেলিফোনে সব কথা বলিনি, পাছে জানাজানি হয়। আমাকে গুণ্ডারা ছুরি মেরেছে—’ কাল্পনিক গুণ্ডার নামে অজস্র মিথ্যা কথা বলিয়া শেষে কহিল,—‘আপনিই কলোনীর মধ্যে একমাত্র লোক, যার বুদ্ধির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। যদি আমার ভালমন্দ কিছু হয়, তাই এই খামখানা আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। আমার মৃত্যু-সংবাদ যদি পান, তখন খামখানা খুলে দেখবেন, কার ওপর আমার সন্দেহ বুঝতে পারবেন। তারপর যদি অনুসন্ধান চালান, অপরাধীকে ধরা শক্ত হবে না। আমি পুলিসকে আমার সন্দেহ জানিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু পুলিসের ওপর আমার বিশ্বাস নেই। ওরা সব ভণ্ডুল করে ফেলবে।’

শুনিতে শুনিতে নেপালবাবুর সংশয় শঙ্কা কাটিয়া গিয়াছিল, মুখে সদম্ভ প্রফুল্লতা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। তিনি খামখানা সযত্নে পকেটে রাখিয়া বলিলেন,—‘ভাববেন না, যদি আপনি মারা যান, আমি আছি। পুলিসকে দেখিয়ে দেব বৈজ্ঞানিক প্রথায় অনুসন্ধান কাকে বলে।’

দেখা গেল ইতিপূর্বে তিনি যে বিজয়কে আসামী বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, তাহা আর তাঁহার মনে নাই। বোধহয় বিজয়ের সহিত একটা বোঝাপড়া হইয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল,—‘কিন্তু একটা কথা, আমার মৃত্যু-সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত খাম খুলবেন না। গুণ্ডাটাকে যদি জেলে পুরতে পারি, তাহলে আর আমার প্রাণহানির ভয় থাকবে না; তখন কিন্তু খামখানি যেমন আছে তেমনি অবস্থায় আমাকে ফেরত দিতে হবে।’

নেপালবাবু একটু দুঃখিতভাবে শর্ত স্বীকার করিয়া লইলেন।

তিনি প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল, বলিল,—‘অজিত, পুঁটিরামকে বলে দাও এ বেলা কিছু খাব না।’

‘খাবে না কেন?’

‘ক্ষিদে নেই।’ বলিয়া সে একটু হাসিল।

আমি বেলা একটা নাগাদ আহারাদি শেষ করিয়া আসিলে ব্যোমকেশ বলিল,—‘এবার তুমি টেলিফোন কর।’

আমি কলোনীতে টেলিফোন করিলাম। বিজয় ফোন ধরিল। বলিলাম,—‘ভুজঙ্গধরবাবুকে একবারটি ডেকে দেবেন?’ ভুজঙ্গধরবাবু আসিলে বলিলাম,—‘ব্যোমকেশ অসুস্থ, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়। আপনি আসতে পারবেন?’

মুহূর্তকাল নীরব থাকিয়া তিনি বলিলেন,—‘নিশ্চয়। কখন আসব বলুন।’

‘চারটের সময় এলেই চলবে। কিন্তু কাউকে কোনও কথা বলবেন না। গোপনীয় ব্যাপার।’

‘আচ্ছা।’

চারটের কিছু আগেই ভুজঙ্গধরবাবু আসিলেন। দ্বারের সম্মুখে আগের মতই অভিনয় হইল। ভুজঙ্গধরবাবু চমকিত হইলেন, তারপর ব্যোমকেশের আহ্বানে তাহার পাশে গিয়া বসিলেন।

সমস্ত দিনের অনাহারে ব্যোমকেশের মুখ শুষ্ক। সে ভুজঙ্গধরবাবুকে গুণ্ডা কাহিনী শুনাইল। ভুজঙ্গধরবাবু তাহার নাড়ি দেখিলেন, বলিলেন,—‘একটু দুর্বল হয়েছেন। ও কিছু নয়।’

ব্যোমকেশ কেন সমস্ত দিন উপবাস করিয়া আছে বুঝিলাম। ডাক্তারের চোখে ধরা পড়িতে চায় না।

ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘যাক, আসল কথাটা কি বলুন।’ আজ তাঁহার আচার আচরণে চপলতা নাই; একটু গম্ভীর।

ব্যোমকেশ আসল কথা বলিল। ভুজঙ্গধর সমস্ত শুনিয়া এবং খামখানি একটু সন্দিগ্ধভাবে পকেটে রাখিয়া বলিলেন,—‘এ সব দিকে আমার মাথা খ্যালে না। যা হোক, যদি আপনার ভালমন্দ কিছু ঘটে—আশা করি সে রকম কিছু ঘটবে না—তখন যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনি বোধহয় এখনও নিঃসন্দেহ হতে পারেননি, তাই ঝেড়ে কাশছেন না। কেমন?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘হ্যাঁ। নিঃসন্দেহ হতে পারলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না, সটান পুলিসকে বলতাম—ঐ তোমার আসামী।’

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চা ও সিগারেট সেবন করিয়া ভুজঙ্গধরবাবু বিদায় লইলেন।

আমি জানালার ধারে দাঁড়াইয়া দেখিলাম, তিনি ট্রাম ধরিয়া শিয়ালদার দিকে চলিয়া গেলেন।

ব্যোমকেশ এবার গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বসিল, বলিল,—‘ম্যায় ভুখা হুঁ। —পুঁটিরাম!’