1 of 2

৪৪. ভিন্ন এক সমাজে নারীরা

ভিন্ন এক সমাজে নারীরা

১.

২৮-১১-৯০

–গত রাতে বি-বি-সি কী বলেছে?

—আমি ঠিক জানি না। দাঁড়া, কামালকে জিজ্ঞেস করি।

–কেন, খবরের সময় কোথায় ছিলি?

—কাজের কি শেষ আছে, সামনে সুহৃদের পরীক্ষা।

—তোদের বাড়ির কাছে দুটো ছেলে গুলি খেয়েছে শুনলাম!

–কী জানি, কামাল জানে বোধহয়।

–গুলির শব্দ পাসনি?

—ঠিক খেয়াল করিনি। তবে গতকাল না পরশু বোধহয় খুব শব্দ হচ্ছিল।

–কিসের শব্দ? বন্দুক, পিস্তল, ককটেল, পটকা? কিসের?

—আমার ভাসুর বলছিলেন…

—কি বলছিলেন?

–ঠিক মনে নেই।

—কারা গুলি করেছে? পুলিশ না কি সরকারি সন্ত্রাস বাহিনী?

–তাও জানি না।

–তুই জানিস কী বকুল?

–দেখ এসব আমি খবর রাখব কখন? আমার সংসার আছে না?

–সংসার থাকলে জানা যায় না তোর ঘরের কাছে কোন দুটো ছেলে মরে গেল, কারা মরল, কেন মরল? কোথায় গুলি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, দেশে কারফিউ কেন?

বকুল, আমার বান্ধবী। বকুলের মেধা ও মনন তার স্বামী কামালের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির খবর রাখবার দায়িত্ব কামালের। বকুলের নয়। বকুল ঘর গোছায়, বকুল ছেলেকে স্কুলে নেয়, বকুলের ছেলের পরীক্ষা সামনে। বকুল তার ছেলেকে ইংরেজি রাইম মুখস্থ করায়। বকুলের বাড়ির পাশ দিয়ে তখন মিছিল যায়, ছাত্রদের মিছিল। সেই মিছিলে গুলি হয়। বকুল তখন পায়েস রান্না করে। বকুল তখন স্বাদ বাড়াবার জন্য পায়েসে কিছু এলাচ ও কিসমিস দেয়।

২৯-১১-৯০ সকাল

—কারফিউ-এ আছ কেমন?

—আর ব’লো না, ফ্রিজ একেবারে খালি।

—তোমাদের ওদিকে কোনও ঘটনা ঘটছে?

—কী আর ঘটবে, সকালে মুদি দোকানের ঝাঁপি খুলে ডিম এনেছি দুহালি।

—বড় রাস্তায় কিছু দেখেছ? মিছিল, পুলিশ, ছাত্র ঐক্যের ছেলেপিলেদের?

–ডিম কি আমি কিনেছি যে দেখব? গেছে কাজের মেয়ে।

—বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকছ। ওখানকার পরিস্থিতি…

–সবার একই অবস্থা। আমার মত। আমাদের ফ্ল্যাটে মিসেস আলম ছাড়া আর কারও ফ্রিজে মাছ মাংস নেই।

—হলগুলোর কি অবস্থা? রোকেয়া হলে শুনেছি কিছু মেয়ে থেকে গেছে?

—হুমায়ুন দেখছি এসব নিয়ে টিচারদের সঙ্গে আলাপ করছে। আমি আলাপে ছিলাম না।

—তো, ভালই আছ, তুমি, কী বল?

—যে খারাপ এলাকায় থাকি, কখন কী হয়, দোয়া করো।

আমার এই বোনের নাম মমতা। মমতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে খারাপ এলাকা বলে। মমতা অপেক্ষা করছে কারফিউ ভাঙবার। কারফিউ ভাঙলেই সে ঝুড়ি ভরে বাজার করবে। কাটাবাছা করবে, রান্না চড়াবে। দেশ রসাতলে গেলে মমতা কী করবে আমি জিজ্ঞেস করিনি। সম্ভবত তখনও সে হুমায়ুনের কাছে জিজ্ঞেস করবে তার কী করা উচিত।

২৯-১১-৯০ সন্ধে

—আপনার ছোট ভাই তো সেই মিছিলে ছিল যে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়ছে?

—হ্যাঁ ভাই, কী আর বলব। এত বারণ করি এসবে যেতে। এসব মিছিল, মিটিং-এ গিয়ে কোনও লাভ আছে, বল? আববা-আম্মা কেঁদে কেটে আকুল।

–কেন?

–ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেল!

–ছোটটি করছে কী, রত্না! ওকে দিন না!

–এই দিচ্ছি।

–কেমন আছ?

—সারাদিন ভি-সি-আর-এ ছবি দেখেছি, কী মজা!

—টি-ভি-ও তো খোলা তাই না?

—টি-ভি-অলারা কিসব খেলাফেলা দেখাচ্ছে, ছাই। কাম সেপ্টেম্বর দেখেছ? রক হাডসন কি সুইট না গো? কেন যে মরে গেল!

–সামনে তোমার পরীক্ষা না?

—আরে পরীক্ষা হবে না। পুরো ডিসেম্বর তো স্কুল বন্ধ। ইস্ আজ যদি আফজাল-সুবর্ণার একটা নাটক হত!

এরা আমার আত্মীয়। এই মেয়েরা। এরা এভাবেই বড় হয়ে উঠছে। এভাবে গা বাঁচিয়ে এবং তুচ্ছ আমোদ-আহ্লাদে।

৩০-১১-৯০

–কিগো মেয়ে, হল ত্যাগ করেছ?

—না করে উপায় আছে?

—বাড়ি যাবে কবে?

—কারফিউ ভাঙলেই আর এক মুহুর্ত দেরি নয়।

—কেন ঢাকায় থেকে যাও। মামার বাড়ি। অসুবিধা কী?

–না ভাই, দেশে যে গণ্ডগোল।

–তুমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের মেয়ে। তোমার গণ্ডগোলে ভয় কেন?

—কী যে বলছেন দিদি। রুমের মধ্যে আয়াতুল কুরসি পড়ে দিন কাটিয়েছি।

—মিছিলে যাওনি।

—মাথা খারাপ?

—সূর্যসেন-মোহসিন হলের ঘটনার সময় কোথায় ছিলে?

–রুমে |

–বের হওনি কেন?

–ওই যুদ্ধক্ষেত্রে?

—কেন যুদ্ধক্ষেত্রে তো ক্লাসের ছেলেরাই ছিল, তোমার বন্ধুরাই—তবে?

—যদি কিছু হত?

—‘যদি কিছু’ তো ওদের বেলায়ও ঘটতে পারত।

—ছেলেরা এদিক ওদিক দৌড়-টোর দিতে পারে।

—মেয়েদের কি হাত-পা ভাঙা?

এই মেয়ের নাম দীনা। ইউনিভার্সিটির চৌকস মেয়ে। এই মেয়ে মিছিলকে ভয় পায়। বাইরে আন্দোলন, বাইরে সংঘর্ষ, বাইরে এক-সমুদ্র বিপদের মধ্যে ডুব-সাঁতার দিচ্ছে সচেতন মানুষ, আর দেশের শিক্ষিত মেয়েরা নিজেদের বিপদ এড়াতে ঘরে বসে আয়াতুল কুরসি পড়ছে।

 

২.

গত ১-১২-৯০ তারিখে তিন জোটের যৌথ আহ্বান ও নির্দেশাবলি প্রচারিত হয়েছে। ওই নির্দেশাবলির এগারো নম্বরে লেখা—বীর ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, নারীসমাজ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিসেবী, টি.ভি ও বেতার শিল্পী ও কলাকুশলী এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের গৃহীত সকল আন্দোলনের কর্মসূচী সফল করুন।

নারী কি সাংবাদিক নয়, চিকিৎসক নয়? নারী কি শিক্ষক হয় না? আইনজীবী হয় না? প্রকৌশলী, সংস্কৃতিসেবী, বা টি.ভি বেতারের শিল্পী নয় তারা? তবে আলাদা করে নারীসমাজ লিখবার কারণ কি? নারীকে সকল সমাজ থেকে দূরে নিক্ষেপ করবার উদ্দেশ্য কী? যদি বলি, এই পৃথক হওয়ার কারণেই নারী মিছিলে নামে না। গুলিবিদ্ধ হয় না, আন্দোলনের খবর রাখে না, নারী ভয়ে পিছু হটে, ভি.সি.আরে ছবি দেখে পার করে বিক্ষোভের উত্তপ্ত দিন।

নারী ভিন্ন এক সমাজে চিহ্নিত হবে কেন, যে সমাজ কোনও পেশাকে নয়, লিঙ্গকে চিহ্নিত করে? নারী যদি এভাবেই নিক্ষিপ্ত হয়, তবে এর চেয়ে ঢের ভাল তার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *