1 of 2

৩৭. আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু

আসলেই কি নারীরাই নারীদের শত্রু

১. কিছু বোকা আছে, ওরা বলে মেয়েরাই মেয়েদের শক্র, কারণ বাঙালির বউ-শাশুড়ি বিবাদ দীর্ঘদিনের। শাশুড়িরা বউদের অত্যাচার করে সুখ পায়। আমরা ভেবে দেখতে পারি, কোনও নারী—সে যখন ছেলের বউ-এর শাশুড়ি হয় তখন সে উচ্চকণ্ঠ নাকি সে যখন মেয়ের জামাইয়ের শাশুড়ি হয়, তখন? মেয়ের বেলায় অবশ্যই সে বিনম্র এবং আপসকামি, কিন্তু ছেলের বেলায় ঠিক তার বিপরীত। কারণ মেয়েমাত্রই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার; বিয়ের মাধ্যমে ছেলের হাতে মেয়েকে ন্যস্ত করা, এবং ছেলের সংসার ও বংশ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করা দ্বারাই একটি মেয়ে পুরুষতন্ত্রের জালে আটকা পড়ে।

ছেলের বউ-এর শাশুড়ি যখন ছেলের বউ ছিল, একই নিগ্রহ সে ভোগ করেছে। ছেলেকে বিয়ে করানোর ফলে সে যদি ছেলে পক্ষের একজন প্রতিনিধি হয়, নিশ্চয় সে প্রতিনিধি, এবং ছেলে যেহেতু সঙ্গত কারণেই পুরুষতন্ত্রের ধারক, সে-ও অর্থাৎ ছেলের মাও পুরুষতন্ত্রের ধারক। এ কথা অনস্বীকার্য যে নারী নিজেই পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক।

অপরদিকে নিজের মেয়েকে যখন সে বিয়ে দেয়, পুরুষতন্ত্রের কাছে মেয়েকে সে অর্পণ করে, সে তখন পুরুষতন্ত্রের ধারক নয়। সে তখন নারীপক্ষ, নির্যাতিত নারীর প্রতিনিধি; তাই সে বিনত, অনুদ্ধত, শ্লীল, সংযত ও বশংবদ। ওদিকে মেয়ের শাশুড়ি আবার তারই মত দাপুটে, অপ্রসন্ন, অমর্ষপরায়ণ ও খড়গহস্ত—সে তার ছেলের বউ-এর কাছে যে চরিত্রে উপস্থিত।

তাই, নির্দ্বিধায় আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে নারী একই সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক। পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে নারীকে নারীর ওপর নির্যাতনের হাত প্রসারিত করতে হয়—একই নির্যাতন সে ভোগ করেছে, তার মেয়ে ভোগ করছে, এবং পুরুষতন্ত্র যখন তার হাতের মুঠোয়—সে আরেকজনকে ভোগ করাচ্ছে। এ হচ্ছে একটি আবর্ত। এই আবর্তের ভেতর মানুষের সঞ্চরণ। সময় এবং পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতন্ত্র দ্বারা নারী নানা কায়দায় আবর্তিত হয়।

সে যখন নারী, যে নারী পুরুষতন্ত্রের ধারক কেবল তখনই সে দ্বিতীয় কোনও নারীকে নিগ্ৰহ করবার পরিবেশে পতিত হয়, সে তখন পৃথক কোন নারী-অস্তিত্ব নয়। সে তখন পুরুষতন্ত্রের নির্জলা প্রতিনিধি ছাড়া একবিন্দু অন্য কিছু নয়। সে তখন সেই নারী, যে নারী পুরুষ অধিকৃত সমাজের শোষণ ও পীড়নের শিকার এক শরীর মাংসপিণ্ড মাত্র।

২. কিছু বোকা বলে, মোল্লারা যেমন বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহার পছন্দ করে না, তেমন পছন্দ করে না প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের কর্মীরাও। অতএব দু’পক্ষের মধ্যে পার্থক্য আর কি রইল।

মৌলবাদরা বলে নারীর স্থান ঘরে, সে সর্বদা পর্দার ভেতরে থাকবে, তার বাইরে এসে বিজ্ঞাপন করা বারণ। আমার সিদ্ধান্ত মোটেও তা নয়। আমি বলি নারীকে স্বাবলম্বী হতে, বলিষ্ঠ হতে, তার ব্যক্তিত্বকে প্রধান করতে। নারীর মনোমুগ্ধকর শরীর ব্যবহার করে বাহবা পাওয়ার পক্ষপাতি আমি নই; আমি চাই সে তার রূপ নয়, গুণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি নিশ্চয় বিজ্ঞাপনে নারীর অংশগ্রহণ অনুমোদন করি—কিছুতেই অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক অংশগ্রহণ নয়। কিন্তু মৌলবাদরা নারীকে উপার্জনক্ষম, স্বনির্ভর ও গতিময় দেখতে চায় না। তারা চায় বন্দিত্ব, অন্ধকারে আচ্ছন্ন সামাজিক গুহার ভেতরে তার বসবাস। তারা নারীর মুক্তি চায় না, চায় শৃঙ্খল। যেহেতু পুঁজিবাদিরা নারী-স্বাধীনতার নামে গোপনে নারীকেই পণ্য করে তোলে, নারীকে পণ্য করেই নারীকে শৃঙ্খলিত করে, নারীর কল্যাণকামিরা তাই বাজারের পণ্য বানাবার পুঁজিবাদি শৃঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করতে চায়। মৌলবাদিদের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা নারীকে আলোয় আসতে দেবে না, তারা নারীকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দেবে না। তলিয়ে দেখলে পুঁজিবাদি ও মৌলবাদির অন্তর্নিহিত সাযুজ্য বেশ ধরা পড়ে। পুঁজিবাদির নারীকে যে শৃঙ্খল পরায় তা রঙচঙে, বাহারি। আর মৌলবাদিদের শৃঙ্খল সূরা-কলমা পড়া, ফুঁ দেওয়া, ফ্যাকাসে। সাযুজ্য এই কারণে যে তারা উভয়ে একটি জিনিস দিয়েই নারীর জীবন শক্ত করে বাধে—তা ওই শৃঙ্খল।

আর আমি, আমি যদি সামান্যও নারীর কল্যাণ কামনা করে থাকি—আমি কোনও শৃঙ্খল চাই না। নারী যতদিন যাবতীয় শৃঙ্খল ছিড়ে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ যেমন ইচ্ছে ভোগ করবার অধিকার অর্জন না করে, ততদিন তাবৎ শৃঙ্খলবাদিদের জন্য আমি নিক্ষেপ করব ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *