1 of 2

৩৪. শুধু নারীর জন্য কিছু শব্দ

১. ‘মেয়েছেলে’ শব্দটি বাঙালি গৃহস্থঘরের বহু ব্যবহৃত একটি শব্দ। মেয়েছেলে মানে নিতান্তই মেয়ে। তাহলে ‘মেয়ে’ শব্দের সঙ্গে ‘ছেলে’ শব্দটি জুড়ে দেবার তাৎপর্য কি ? তবে কি এই ধরে নিতে হয় যে ছেলের পিঠে ভর ছাড়া মেয়ে নামক মানুষ তো নয়ই ‘মেয়ে’ নামক শব্দও ঠিক দাঁড়াতে পারে না। কিছু একটার ঠেকা না হলে তার চলে না। দুর্বল চারাগাছকে যেমন একটি বাশের কঞ্চি হলেও সোজা রাখে।

‘ছেলেপিলে’ বা ‘ছেলেপুলে’ অর্থ ছোট ছেলেমেয়ে, সন্তান-সন্ততি। ‘ছেলেমানুষ’ মানে অল্পবয়স্ক, অপরিণত বুদ্ধি এমন কেউ–সে ছেলে বা মেয়ে যে কেউ হতে পারে। আর ‘ছেলেমানুষী’, ‘ছেলেমো’ বা ‘ছেলেমি’ বলতে বালসুলভ আচরণ বোঝায়। ‘ছেলেধরা’ কেবল ছেলেই ধরে না, মেয়েও ধরে। ছেলেভুলানো ছড়া বা গল্পে ছেলেমেয়ে দু’জনই আকৃষ্ট হয়। ‘ছেলেবেলা’—মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের বাল্যকাল বা শৈশব। ‘ছেলেখেলা’ও উভয়ের বাল্যক্রীড়া। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই যখন জড়িত, তখন শব্দে কেবল ‘ছেলে’র প্রাধান্য কেন?

জগতে মেয়েরা এত নগণ্য যে দৈনন্দিন শব্দ-ব্যবহারে ‘মেয়ে’ উল্লেখেও মানুষের কার্পণ্য হয়।

২. ‘অসূর্যম্পশ্যা’ শব্দটি নারীর জন্য বাঁধা। অসূর্যম্পশা শব্দের অর্থ সূর্যকে পর্যন্ত দেখতে পায় না এমন। পুরুষ কখনও অসূর্যম্পশ্যা হয় না। কারণ তারা আলোর মানুষ, আর যারা অন্ধকারের, যারা নারী—তাদের রোদ স্পর্শ করবার বিধান নেই। যেহেতু সূর্য উজ্জ্বল, যেহেতু সূর্য প্রখর এবং প্রচণ্ড, তাই সে পুরুষ—আর পুরুষ-সূর্যের আলো নারীর শরীর ছুঁয়ে দিলে নারীর নারীত্ব কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়। নারীত্ব যত বেশি ঘরের খিল এঁটে, অন্ধকারে মুখ বুজে পড়ে রইবে—তত সে ফুটবে ভাল।

পুরুষেরা পুরুষের জন্য ‘অসূর্যম্পশ্যা’ শব্দ তৈরি করেনি। করেনি, কারণ এই শব্দের কারণে কখন আবার ঘরবন্দি হতে হয় বলা যায় না। তাছাড়া তারা নিজেরা সূর্যের যত কাছাকাছি হবে, শক্তিকে যত নাগালের ভেতর আনবে তত তাদের বীরত্ব বেশি। আর নারী অন্ধকার খুপরিতে বড় হলে উত্তরোত্তর নারীত্ব বৃদ্ধি পায়। নারী এই ধারণা ধারণ করে নিজের নারীত্ব বাড়াচ্ছে। বিষ যদি একবার মধুর লাগে, সে বিষ খাবেই। নারীত্বওয়ালা নারীকে পুরুষেরা বাহবা দেয়। এই বাহবা কার না মধুর লাগে।

‘অনাঘ্ৰাতা’ শব্দটিও নারীর জন্য নির্ধারিত। নারীকে ফুলের মত ভাবা হয়, ফুল দেখতে সুন্দর, রঙিন, পাপড়ি ও রেণুর সমাহার। নারীকেও তেমনি সুন্দর ও রঙিন হতে হয়, বিভিন্ন রূপ ও গুণের সমাহার হতে হয়। তাই পুরুষের খুব শখ এমন এক নারীফুলের, যে ফুলের ঘ্রাণ কেউ নেয়নি। সে একাই ফুলটির ঘ্রাণ নেবে, তার রেণু মাখবে গায়ে, পাপড়িগুলো একটি একটি করে ছিঁড়বে—এও এক ভয়ঙ্কর আনন্দ পুরুষের! ‘অনাঘ্ৰাত’ শব্দের অর্থ ঘ্রাণ লওয়া ও ভোগ করা হয়নি এমন। পুরুষ ভোগের জিনিস নয়, ভোগের জিনিস নারী। অনাঘ্ৰাত বা অনাঘ্ৰাতা শব্দটি পুরুষের জন্য খাটে না। খাটে নারীর জন্য। তাই ‘অনাঘ্ৰাতা’ শব্দটি আভিধানিক স্বীকৃতি তো পেয়েছেই, পুরুষ-প্রিয়তাও বেশ পেয়েছে।

৩. ভাঙা বাসনে নাকি বেশিদিন মানুষ ভাত খেতে চায় না। এই প্রবাদ বাক্যটি বাসন এবং ভাতের চেয়ে নারী এবং সতীত্বের দিকে বেশি ইঙ্গিত করে। এই ভাঙা –নারীর হাত, পা, চোয়াল ইত্যাদি ভাঙা নয়। নারীর ভাঙা আবার অন্য রকম। সতীত্ব বলে একটি জিনিস আছে মেয়েদের, সেটি যাদের আছে, তারাই কেবল আস্ত, বাকিরা ভাঙা। মেয়েরা হচ্ছে বাসনের মত, পুরুষেরা নারীকে ব্যবহার করেই যাবতীয় আহার গ্রহণ করে। বাসনটি যত চকচকে হবে, খেতে তত আনন্দ। সতীত্ব হচ্ছে বাসন প্রস্তুতের কাচামাল, সতীত্ব ভাল হলে বাসন মজবুত, সতীত্ব নেই তো বাসনও ভাঙ। খেতেও মজা নেই।

তাই পুরুষের খাবার-দাবারে মজা জোগাবার জন্য নারীকে ঝকঝকে, মসৃণ ও অভঙ্গুর পাত্র হতে হয়। সম্প্রতি একটি টিভি নাটকে বেশ রসিয়ে বলা হল ‘ভাঙা বাসনে মানুষ বেশিদিন খেতে চায় না’—এদেশের প্রগতিশীল পুরুষেরা এ জাতীয় আদিম ও কুৎসিত প্রবাদ জোগাড় করে রেডিও টিভি-তে প্রচার করছেন (প্রবাদের প্রতি কোনও প্রতিবাদ ছাড়াই) মানুষকে আরও বেশি অশিক্ষিত ও কদাকার বানাবার জন্য।

Leave a Reply to Bitosh Gain Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *