1 of 2

৩৩. সাতটি পয়েণ্ট

১. আমি ক’জন কমিউনিস্টকে চিনি তাঁরা ঘরের বউকে দুটো থালাবাসন আর শাড়ি-গয়নার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। প্রলেতারিয়েতের স্বাধীনতার কথা জোর গলায় বলে বেড়ান। আমি জানি না, তারা জানেন কি না যে লেনিন বলেছেন নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা না করে প্রলেতারিয়েত কখনও নিজেদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না।

২. কলকাতার এসটর হোটেল থেকে আমার এক বন্ধু অতসীকে ফোন করে বলেছিলাম–চলে এস। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শেক্সপিয়র সরণী। অতসী নানারকম কাজের কথা বলে আমার কাছে আসবার প্রসঙ্গটি সেদিন এড়িয়ে গেল। দিন পাঁচেক পর মুখ ফুটে বলেছে—আসলে বাসে চড়ে আমাদের অভ্যেস। আমরা ট্যাক্সি চড়ি না। ওতে ম্যালা পয়সা খরচা।

কলকাতার মোড়ে মোড়ে মেয়েরা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাসে বসে, দাঁড়িয়ে, ঝুলে তারা চলাফেরা করে। পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই মেয়েরা বাসে চড়ে নিজের গতিকে দ্রুত করে। পৃথিবীতে একটিই শুধু অসভ্য দেশ আছে যে দেশের বাস মেয়েদের নেয় না। ‘লেডিস নাই’ বলে অপেক্ষমাণ মেয়েদের চোখে মুখে ধুলো উড়িয়ে বাস চলে যায়। অচ্ছুৎ প্রাণীদের বাস নেয় না। নেয় না বলে তারা হেঁটে পার হয় মহাখালি থেকে রায়ের বাজার, গুলিস্তান থেকে মোহাম্মদপুর, কমলাপুর থেকে শ্যামলি। অচ্ছুৎদের পক্ষে কে কথা বলবে, কে মিনতি করে বলবে—নাও, এই পাপ গ্রহণ করে নিজেকে মহৎ করো। চারদিকে সামান্য হই হট্টগোলে বাস পুড়ছে। অচ্ছুৎদের বুকের ভেতর আগুন নেই বলে ওরা বাস পোড়াতে পারে না। বুকের ভেতর আগুন থাকলে শুধু বাস কেন, বাসের ভেতরকার লাটসাহেবদেরও পোড়ানো যেত।

৩. সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতার অর্থ এখন উল্টো বোঝে। নারীর গৃহে ফিরে যাওয়াকে তারা এতকাল পর যৌক্তিক ভাবছে। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা—যে প্রতিযোগিতা নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করবার একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম—সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকে তারা নারীর মুক্তি বলে রায় দিচ্ছে। মোহ মানুষকে কতটা অন্ধ করে, উন্মাদ এবং অবিবেচক করে—সোভিয়েতের এই অধঃপতন থেকে আমরা তা উপলব্ধি করি।

৪. পশ্চিমা নারী ও শিশুদের ইরাক থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ এরা অসহায়, অসহায় মানুষকে জিম্মি হিসেবে রাখা বীরত্বের লক্ষণ নয়। অসহায়দের ক্ষমা করে দিলে লোকে খুশি হয়। তাই সাদ্দাম হোসেন নারী ও শিশুদের নিরাপদে ঘরে পাঠিয়ে বিশ্ববাসীকে খুশি করেছেন।

নর্দমায় পড়ে থাকা পঙ্গু লোককে দয়া করে টেনে তুললে মহৎ কাজ করা হয়। আতুর খোঁড়াকে সময় সুযোগ মত সাহায্য করবার কথা ধর্মগ্রন্থও বলে। ‘লেডিস ফার্স্ট’ বলে একটি কথাও বেশ প্রচলিত। এর কারণ–অন্ধ ও পঙ্গু যেমন অসহায়, বৃদ্ধ ও শিশু যেমন অসহায়, সুস্থ সবল ‘লেডিস’কে সেই অসহায়ের কাতারে ফেলা হয়। তাকে সেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যা একজন পঙ্গুকে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের বাসে লেখা থাকে—মহিলা আসিলে সিট ছাড়িয়া দিবেন। যেন মহিলাদের পায়ে বল নেই, দাঁড়াবার শক্তি নেই। অনেকে সিট ছেড়ে দিয়ে দুর্বলকে রক্ষা করবার গৌরব বোধ করে। মহিলাদের এইসব তুচ্ছ সুবিধা দিয়ে সমাজ তাদের পঙ্গু বানাচ্ছে। আর যারা এই সুবিধা নিচ্ছে, তারা জানে না এইসব সুবিধার আড়ালে তারা নিজেদেরই অবলা-অসহায় জীব হিসেবে চিহ্নিত করে।

৫. প্লেটোর নারী অধিকারবাদ নিয়ে অনেকে চিৎকার করেন। তিনি নাকি নারী মুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। কিন্তু প্লেটোর এই সংলাপটি একেবারে ফেলনা নয় যে—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি, তাকে ধন্যবাদ–তিনি আমাকে মুক্ত পুরুষ করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করেননি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রীস স্ত্রীলোক ও ক্রীতদাসের মধ্যে কোনও পার্থক্য করেননি, প্লেটোও করেননি। Republic-এর Book v-এ তিনি নিচু মনের তুলনা দিতে গিয়ে বলেছেন—স্ত্রীলোকের মনের মতই নিচু। Meno [71 e, 73a] তে বলেছেন মেয়েদের কর্তব্য হল ভাল গৃহকর্ত্রী হওয়া আর স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে চলা। Laws [802 e]-এ বলেছেন—স্ত্রীজাতি নিরহঙ্কার এবং সকল অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে যেখানে পুরুষরা সাহসী এবং অহঙ্কারী। Timaeus [42e]-এ প্লেটো বলেছেন–মানব চরিত্র দুটো ভাগে বিভক্ত, উচ্চতর ভাগটি পুরুষ চরিত্র। তিনি আরও বলেছেন—দুষ্ট ও ভীত পুরুষ পরজন্মে নারী হয়ে জন্মায়।

৬. প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে ডায়রি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই ডায়রিগুলো একটিও আমার জন্য নয় বলে আমি সেগুলো ব্যবহার করতে পারি না। প্রতিটি ডায়রির Personal Memoranda-য় Blood group-এর চারটি ঘর থাকে Self, Wife, Child I, Child II, অর্থাৎ এই ডায়রিগুলো পুরুষের জন্য তৈরি। অথচ আমরা মেয়েরা–বোকা এবং নির্লজ্জ মেয়েরা বড় বড়াই করে ডায়রির পাতায় নিজের নাম লিখে ফেলি। অন্যের জিনিস ব্যবহার করবার অভ্যেস আমার নেই। আশা করি তাদেরও নেই, ব্যক্তিত্ব বলে সামান্য কিছু যাঁদের মধ্যে আছে।

৭. ১৬৬২ সালে মার্গারেট লুকাস নামের এক ওলন্দাজ নারী লিখেছিলেন–পুরুষ আমাদের বিরুদ্ধে দারুণ বিবেচনাহীন ও নিষ্ঠুর আচরণ করে, ওরা সব ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে কিন্তু আমাদের বেলায় অবরোধ সৃষ্টি করে। আমরা বাদুড় অথবা পেঁচার মত বেঁচে থাকি। পশুর মত ভারবাহী জীব যেন আমরা। আমরা প্রতিনিয়ত পোকামাকড়ের মত মৃত্যুবরণ করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *