1 of 2

২৮. মেয়েদের ‘বড়’ হওয়া

নির্বাচিত কলাম মেয়েদের বড় হওয়া

মসজিদের গেটে এক ধরনের সাইনবোর্ড থাকে। দূর থেকে এতকাল ভেবেছি সাইনবোর্ডে নিশ্চয় লেখা ‘গরু ছাগলের প্রবেশ নিষেধ।’ আসলে তা নয়। একদিন কাছ থেকে দেখেছি ওতে লেখা–মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। সম্ভবত জন্তু ও মহিলাদের ব্যাপারেই যাবতীয় নিষেধ জারি হয়।

একটি ছোট্ট শহরে জন্ম আমার। শহরের কিনার ঘেঁষে চলে গেছে ক্ষীণাঙ্গী ব্ৰহ্মপুত্র। নদীতীরে কেটেছে আমার অপরূপ শৈশব। সারা বিকেল বালুর ঘর বানিয়ে সন্ধের মুখে সেই খেলাঘর ভেঙে বাড়ি ফিরেছি সবাই। তখন ন-দশ বছর বয়স, মা রান্না করছেন, হঠাৎ আদা নেই, লবণ নেই-বাড়ির কাছের দোকানে আমাকেই যেতে হত। সকালে মুড়ি খাব, দুপুরে তেঁতুল, বিকেলে বাদাম—সবই দৌড়ে দৌড়ে আমাকেই কিনতে যেতে হত। দিন যাচ্ছে, হঠাৎ একদিন কোনরকম কারণ ছাড়াই আমাকে মোড়ের দোকানে যাওয়া নিষেধ করা হল। কেন নিষেধ, কেন নিষেধ–খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, আর বড় হয়ে গেলে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। ঘরে বসে অবসর সময়ে ধর্মের বই পড়তে হয়, ঘরের টুকটাক কাজকর্ম করতে হয়। তখন থেকেই নিষেধ শুরু হল আমার ওপর। শুধু আমার কেন, তখন থেকেই নিষেধের লাল বৃত্ত আঁকা হয় প্রতিটি মেয়ের চারদিকে।

একটু একটু করে বড় হচ্ছি। জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নিষেধ, বিকেলে ছাদে ওঠা নিষেধ, কখনও কখনও আদা ছাড়া পিঁয়াজ ছাড়াই রান্না হচ্ছে তবু আমার মোড়ে যাওয়া নিষেধ। একদিন ঘরে পরবার জন্য দেখি আমার জন্য তিনটে পায়জামা তৈরি হচ্ছে। এত পায়জামা অথচ আমাকে না জানিয়েই, আমি আনন্দ এবং বিস্ময় দুইই প্রকাশ করলাম। মা বললেন তোমার জন্য আজ থেকে হাফপ্যান্ট নিষেধ। নিষেধ বাড়ছে। একদিন দুপুরে মা তার একটি শাড়িকে চার টুকরো করে এক টুকরো আমার দু’কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন, বললেন এখন থেকে ঘরে পরবে। অর্থাৎ আমাকে ওড়না পরতে হবে। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। মা নির্বিকার।

একবার রজঃস্রাবের সময় আমি কোরান শরীফ ছুঁয়েছিলাম বলে মা আমার গালে কষে দুটো চড় লাগালেন। বললেন–নাপাক শরীরে পবিত্র জিনিস ছুঁতে হয় না। মা প্রায়ই বলতেন কুকুর হচ্ছে নাপাক জিনিস। সেদিন বুঝলাম মেয়েরাও সময়ে নাপাক হয়।

আমাদের বাড়ির মাঠে ছিল আম, জাম, কাঠাল, পেয়ারার বিশাল বাগান। ছোটবেলায় গাছে চড়বার অদম্য এক শখ ছিল আমার। যতদিন শিশু ছিলাম ; গাছে ঝুলেছি, খেলা করেছি, সবাই মেনে নিয়েছে। যখন থেকে বড় হয়ে গেছি বলে মনে হল তখন থেকে আমার গাছে চড়া নিষেধ। মেয়েদের নাকি গাছে চড়তে নেই। মেয়েরা গাছে-চড়লে গাছ মরে যায়।

গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে মামাবাড়ি গিয়ে আমার ছোট মামার ঘরে একদিন ক্যাপস্টেন সিগারেটে দুটান দিয়েছিলাম, ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে বড়দের কিল-চাপড় থেকে আমার পিঠের কোনও অংশও বাদ পড়েনি। সকলে বললেন—মেয়েদের সিগারেট ছোঁয়া বারণ।

আমি যখন স্কুলে উপরের ক্লাসে পড়ি, এক সকালে স্কুলে যাবার পথে আমার হাতে একটি চিঠি গুজে দিয়েছিল সমবয়সী এক ছেলে। চিঠিতে লেখা আমাকে খুব ভাল লাগে তার। তাই প্রতিদিন সে সকাল বিকাল দাঁড়িয়ে থাকে পথে। আমার অভিভাবকবৃন্দ এর পরদিন থেকে আমার সঙ্গে বাড়তি একটি লোক দিলেন, সে আমাকে স্কুলে দিয়ে যায় আবার ছুটি হলে নিয়ে যায়। স্কুলে এক যাতায়াতে নিষেধ শুরু হল।

আমাদের কলেজে গগন নামে এক দারোয়ান ছিল। ছেলেদের কলেজ থেকে যে যখন ইচ্ছে ক্লাস করে রেরিয়ে আসত, আর আমাদের গগনচন্দ্র একটি টুল পেতে সারাদিন বসে থাকত গেটে, বেরোতে গেলেই বাধা দিত। অনুযোগ করতাম—আনন্দমোহন থেকে তো ছেলেরা বেরুচ্ছে! গগন বলত—মেয়েদের কলেজে ওই নিয়ম নেই। অর্থাৎ ভাল লাগুক না লাগুক দশটা থেকে পাঁচটা তাকে কলেজে বসে থাকতে হবে। গগন দারোয়ান এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। সে তার চাকরিজীবনে বিকেল পাঁচটার আগে কোনও কলেজ ছাত্রীকে গেটের বাইরে যেতে দেয়নি। সেও বুঝত মেয়েদের অত স্বাধীনতা থাকতে নেই—যখন ইচ্ছে বেরোবার, যখন ইচ্ছে ঢুকবার।

একবার বড় একটি গানের দল এসেছিল আমাদের শহরে। তখন আমিও বেশ বড়। বাড়িতে প্রস্তাব করলাম এই অনুষ্ঠানে আমি যাব। অনুষ্ঠানটি রাতে হবে বলে আমার যাবার অনুমতি মিলল না। কারণ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য একটি পুরুষ দরকার। কারণ সন্ধের পর নাকি এক কোনও মেয়ের ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

একদিন কী একটি বিষয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার তর্ক হচ্ছিল। দুজনের স্বর একসময় সপ্তমে ওঠে। কিন্তু অভিভাবক এসে আমাকেই প্রথম থামতে বললেন, কারণ আমি যে খুব অযৌক্তিক কথা বলেছি তা নয়—আমাকে থামাবার কারণ মেয়েদের অত উচ্চকণ্ঠ হতে নেই। যে কোনও আবেগ ও উত্তেজনার মাত্রা মেয়েদের কিছু কম থাকতে হয়। যে কোনও ব্যাপারেই মেয়েদের অধিক সংযত হতে হয়।

এক আত্মীয়ের কাছে কোনও এক দুপুরে তাস খেলা শিখেছিলাম। বাড়িতে মাঝে-মধ্যে যখন তাসের আসর বসত আমাকে ধারে-কাছে আসতে দেয়া হত না। অথচ এই খেলাটি আমি জানি এই দাবি জানালেও আমাকে কাছে আসতে দিত না কেউ। কারণ খেলাটি জানলেও এবং সকলের চেয়ে ভাল খেললেও আমি মেয়ে বলে আমাকে তাস খেলায় কেউ রাখত না। খেলাটি মেয়েদের জন্য নিষেধ। একবার আমাদের বাড়িতে আমার পরিচিত দুজন ছেলে বেড়াতে এসেছিল। ভদ্রতার খাতিরে দু’কাপ চা দেব ভেবেছিলাম, সম্ভব হয়নি কারণ ভেতর ঘরে তখন আমার অতিথি নিয়ে ঝড়ঝঞ্জা শুরু হয়ে গেছে—কারা এরা, কেন এসেছে, কি চায় ইত্যাদি প্রশ্নবাণে আমাকে আহত হতে হচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঠিক তার পরদিনই আমার দাদার দুই বান্ধবী যখন বাড়িতে এল বাবা নিজে বসে মেয়ে দু’জনের নাম জিজ্ঞেস করলেন, মা নিজ হাতে ডিমের হালুয়া রাধলেন। দাদার ঠোঁটের কিনারে একটি হাসির রেশ তিনদিন পর্যন্ত ঝুলে ছিল।

কি কি কাজ মেয়েদের জন্য নিষেধ, এবং কি কি নিষেধ নয় তার নির্ধারক কখনও মেয়ে নয়। সমাজপতি বলতে যাদের বোঝায় তারা পুরুষ। মেয়েরা যে কাজ করতে এগোয় অথবা পেছোয় সবই তাদের পছন্দ অনুযায়ী। তাদের পছন্দ হল না তো মেয়েরা মরল। সামাজিক নীতিবাক্যে মেয়েদের জন্য যত নিষেধ বর্তমান, তুলনায় পুরুষের জন্য শতকরা এক ভাগ নিষেধও নেই। ধর্মে মেয়েদের জন্য যত নিষেধের বাণী উচ্চারিত হয়েছে, কোনও পুরুষের জন্য তার সহস্ৰ ভাগের এক ভাগও উচ্চারিত হয়নি।

আমার কৈশোর ও তারুণ্য যে সব নিষেধের মধ্যে কেটেছে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত মেয়েই এইসব নিষেধের মুখোমুখি হয়। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মেয়েদের নিষেধের ধরন আলাদা। ধরন আলাদা হলেও নিষেধ নিষেধই। লোকে বলে তা পালন করা প্রতিটি মেয়ের নাকি ‘অবশ্য কর্তব্য’ ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *