1 of 2

২৭. মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র

নির্বাচিত কলাম – মহাভারতে নারীর অবনমনের চিত্র

মহাভারতের প্রথম অংশের সঙ্গে শেষ অংশের ব্যবধান অন্তত আটশ’ বছরের। এই দীর্ঘ সময়ের সামাজিক বিবর্তন-চিত্রও ওতে বেশ স্পষ্ট। আদি ক্ষত্রিয় কাহিনী রচনার পর কিছু নৈতিক কাহিনী রচিত হয় যা সার্বজনীন, শেষতম সংযোজনের কর্তা ভৃগুবংশীয় ঋষিরা। এটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে খ্যাত। নারীর অবনমনের চিত্র এই অংশে নগ্নরূপে উপস্থিত।

মহাভারতের এই অংশে খুব স্পষ্ট করে লেখা আছে নারী অশুভ, সমস্ত অমঙ্গলের হেতু, কন্যা দুঃখের (১/১৫৯/১১)। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন–নারীর চেয়ে অশুভতর আর কিছুই নেই। নারীর প্রতি পুরুষের কোনও স্নেহ মমতা থাকা উচিত নয় (১২/৪০/১)। পূর্বজন্মের পাপের ফলে এ জন্মে নারী হয়ে জন্মাতে হয় (৬/৩৩/৩২)। নারী সাপের মত, পুরুষের তাকে কখনোই বিশ্বাস করা উচিত নয় (৫/৩৭/২৯)। ত্রিভুবনে এমন কোনও নারীই নেই, যে স্বাধীনতা পাবার যোগ্য নয় (১২/২০/২০)। প্রজাপতির ইচ্ছা যে, নারী স্বাধীনতা পাবার যোগ্য নয় (১২/২০/১৪)। যে ছ’টি বস্তু এক মুহুর্তের অসতর্কতায় নষ্ট হয় তা হল–গাভি, সৈন্য, কৃষি, স্ত্রী, বিদ্যা এবং শূদ্রের সঙ্গে সম্বন্ধ (৫/৩৩/৯০) ।

মহাভারতে সতী ও কর্তব্যপরায়ণ নারীর প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারী জন্মের চূড়ান্ত চরিতার্থতা হচ্ছে সেবা ও শুশ্রুষায় স্বামীকে তুষ্ট করা এবং তার সন্তান ধারণ করা, বিশেষ করে পুত্রসন্তান। বিবাহিতা নারীর যশ, চরিত্র ও গুণ নষ্ট হয়ে যায়, যদি সে নারী দীর্ঘদিন পিতার বাড়ি কাটায় (১/৭৪/১২)। পিতার বাড়ি দীর্ঘদিন কাটালে নারী কলঙ্কিনী হয় (৫/৩৯/৮০)। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলেছেন—নারীর দ্বারা বংশ কলঙ্কিত হয় (১২/৪-৮)। কৃষ্ণ বলেছেন—নারী কলঙ্কিতা হলে বর্ণসংকর হয়, তার থেকে চূড়ান্ত সর্বনাশ হয় (৬/২৩/৪১)।

নারী যেন সুন্দরী, স্বাস্থ্যবান, গৃহকর্মে নিপুণ হয়। সে যেন স্বামীর জন্য, শ্বশুরকুলের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে এবং পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়, এবং সেই সন্তানের লালনপালন করে। নারীর কোনও পৃথক মন, পৃথক ব্যক্তিত্ব থাকতে নেই। মহাভারত আমাদের তো তা-ই বলে।

নারীর উপনয়ন হবার নিয়ম নেই। উপনয়ন হলে বিদ্যা অর্জন করতে হয়, নারীর বিদ্যা অর্জনের অধিকার নেই। নারীর জন্য বিবাহই হল উপনয়ন, পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস আর পতিসেবা হল বেদাধ্যয়ন (মনুসংহিতা ২/৬৭)।

মোদা কথা, নারীর কোনও অধিকার নেই শিক্ষা ও সম্পত্তিতে। নারী ব্যক্তি নয়, বস্তু এবং ভোগ্যবস্তু। তাই হাতি, হিরণ্য, রথ, অশ্ব, ভূমি ইত্যাদির সঙ্গে নারীও যোগ হয় দানের তালিকায়। এই দান চলে বিবাহে, শ্রাদ্ধে, বিজয়োৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে, যজ্ঞে ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে। নারী হচ্ছে প্রলোভন, নারীর কামবৃত্তি স্বভাবতই পুরুষের চেয়ে অধিক (১৩/৩৮)। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন—আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল, তারা তখন নারী সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করবার জন্য (১৩/৪২)।

নারী কেবল অমঙ্গলের জন্যই। এমন এক বিশ্বাস প্রচার করবার বড় এক দায়িত্ব নিয়েছে মহাভারত।

পাঁচ স্বামীকে তুমি কি করে তুষ্ট ও বশীভূত করেছ ? সত্যভামার এই প্রশ্নের উত্তরে দ্রৌপদী বলেছিল স্বামী এবং ভূত্যদের ভোজন শেষ না হলে আমি আহার করি না। স্নান শেষ না হলে আমি স্নান শেষ করি না। তিনি না বসলে আমি বসি না। স্বামীই দেবতা, স্বামীই গতি, আমি স্বামীদের চেয়ে বেশি শয়ন, ভোজন ও অলঙ্করণ করি না। শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করি না। সব সময় বশবর্তিনী হয়ে থাকি (২০/২৩/২৮/৩৫/৩৬)।

স্ত্রীর জন্য অন্য পুরুষের সঙ্গ নিষিদ্ধ করবার কারণ স্বামীর ঔরসজাত সন্তান-সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এই কামনা কী ভীষণ উৎকট ও উদগ্র হলে একথা বলা হয় যে—যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনও চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন করে না সে-ই ধর্মচারিণী (১২/১৪৬/৮৮)। পরপুরুষ তো নয়ই, প্রকৃতির আলো হাওয়াও যেন নারীর গায়ে না লাগে, নারীর জন্য এমনই অন্ধকার সংসার কূপকেই বলা হয়েছে সবচেয়ে পবিত্র।

নারীর বশবর্তিনী রূপ সকলে বেশ উপভোগ করে। কুকুর বা বেড়াল পোষ মানলে তাকে ঘরে স্থান দেওয়া হয়, একই রকম নারীকেও।

আসলে রামায়ণ মহাভারত সব গল্প শেষে একটি সিদ্ধান্তে এসে স্থির দাঁড়ায়—তা হল—ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি, স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *