নীল সারসের পিছনে – কর্নেল সমগ্র ১১ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
(কর্নেলের জার্নাল থেকে)
সকালে ধারিয়া ফলস-এর কাছে একটা শিমুলের ডালে নীল সারস দম্পতিকে দেখেছিলুম। আমার ক্যামেরায় টেলিলেন্স পরানোর সময় দেয়নি ওরা। সহসা ডানা মেলে উত্তর-পূর্ব কোণে একটা টিলার মাথায় ঘন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল। এই সারস অধুনা দুর্লভ প্রজাতির। অনেক পক্ষিবিশারদ তো ঘোষণাই করে ফেলেছেন, এই প্রজাতির সারস কবে লুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই বাইনোকুলারে ওদের দেখে চমকে উঠেছিলুম। সেটাই সম্ভবত ক্যামেরায় টেলিলেন্স যুক্ত করতে দেরির কারণ। নিঃসংশয় না হয়ে কোনো কাজে পা বাড়ানো আমার স্বভাববিরোধী।
ঘন জঙ্গলে ঢাকা টিলাটা এখন অক্টোবর মাসে অতি দুর্গম। রাস্তার সমান্তরালে উত্তর দিকে এগিয়ে নগ্ন কঠিন গ্রানাইট শিলার খপ্পরে পড়ে গেছে। সেদিক থেকে এই টিলায় উঠে সারস দম্পতির অনুসন্ধান অসম্ভব। সামরিক জীবনের মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং এই বৃদ্ধ সময়ে কাজে লাগানো সম্ভব ছিল কি না বলতে পারছি না। কিন্তু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কোথায় পাব? ফেরার সময় বারবার থেমে বাইনোকুলারে এই বিরল প্রজাতির সারস দম্পতিকে আবিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। সত্যি বলতে কী, যখন ধরমপুরে আমার হোস্ট এবং বন্ধু অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়িতে ফিরে চলেছি, তখন ব্যর্থতা আর হতাশায় আমি প্রায় বিধ্বস্ত।
লাঞ্চের টেবিলে মিঃ রায়চৌধুরির সঙ্গে দেখা হল। তিনি বাইরে থেকে সদ্য। ফিরেছেন। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে তিনি আস্তে বললেন, কর্নেল সরকার কি অসুস্থ বোধ করছেন?
একটু হেসে বললুম, আপনার উবিগ্ন হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।
তাহলে অনেক হেঁটেছেন। পাহাড়ি রাস্তার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আসলে পলিটিকাল প্রবলেম এই অঞ্চলের উন্নতিতে বাধা দিচ্ছে।
অরিন্দম রায়চৌধুরী ধরমপুর বাঙালিটোলায় তিন পুরুষের অধিবাসী। রাজনীতি করেন। কাজেই লাঞ্চের সময় ঝাড়খণ্ডিদের রাজনীতির ভালো-মন্দ নিয়ে অনর্গল কথা বলছিলেন। এক ফাঁকে আমি নীল সারস দম্পতির কথা বললুম। ঘটনাটা শুনে তিনি খুব হাসলেন। তারপর বললেন, যৌবনে খুব শিকারের নেশা ছিল। বাঘ-ভালুকও মেরেছি। তবে পাখিই আমার আসল লক্ষ্য ছিল। আপনার মতো ছবি তোলার চেয়ে পাখির মাংসের স্বাদ নিয়ে বিস্তর এক্সপেরিমেন্ট করেছিলুম। আপনি বলছেন নীল সারসের কথা। ধারিয়া নদীর ফলস-এর প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর অববাহিকায় একটা বিশাল জলা আছে। অজস্র জলটুঙ্গি আছে। নৌকোয় চেপে সারস শিকার করেছি প্রচুর। মনে পড়ছে না নীল সারস দেখেছিলুম কি না। শিকারে আমার দুই সঙ্গী ছিল। রিট্রিভার জাতের একটা কুকুর রেক্সি। আর ফাগুলাল।
ফাগুলালের চেহারা শক্তসমর্থ। পাকা গোঁফ। কাঁচাপাকা কদমছাট চুল। তামাটে গায়ের রং। খাড়া নাক। রায়চৌধুরিসায়েবের হুকুমে বিকাল তিনটে নাগাদ সে আমার সঙ্গী হল। বিশেষ কথা, সে নীল সারস দম্পতিকে দেখেছে।
সঙ্গী হিসাবে তো বটেই, তা ছাড়া পাখি-জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং কৌতূহল থাকায় ফাগুলাল কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ঘনিষ্ঠ অনুচর হয়ে উঠেছিল। তারও তিনপুরুষ বাঙালি বাড়িতে কেটেছে বলে সে বাঙালির মতোই বাংলা বলতে পারে। সে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে-ভাবে হেঁটে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম, বহুকাল পরে সে তার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিকে যেন ফিরে পেয়েছে।
এবার ফাগুলালের নির্দেশে আমি দক্ষিণ ধারিয়া জলপ্রপাতের দিকে না গিয়ে একেবারে উলটোদিকে অর্থাৎ উত্তরে হেঁটে যাচ্ছিলুম। বহুবছর আগে এই রাস্তায় এলামেলো তাপ্পি দিয়ে ছোটো-বড়ো পাথর ফেলে হয়তো স্টিমরোলারে সমতল করা হয়েছে। এখন বছরের পর বছর বৃষ্টির জল তাপ্পিগুলিকে উঁচু-নিচু করে ফেলেছে। জিপ ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি চলা অসম্ভব। চড়াইয়ে ওঠার সময় মনে পড়ল, মিঃ চৌধুরি আমার প্রয়োজনে তাঁর জিপ গাড়িটা দিতে তৈরি ছিলেন। কিন্তু এখন আর পস্তে লাভ নেই। দুধারে উঁচু গাছের জঙ্গল এবং মাঝে মাঝে ফাগুলাল বাঁদিকে রাস্তার ধারে গিয়ে গাছের ফাঁকে সম্ভবত নীল সারস দম্পতিকে খুঁজছিল। তারপর রাস্তা হঠাৎ পশ্চিমে বাঁক নিল এবং আরও চড়াইয়ে ওঠার পর দেখলুম, আমরা দুটো টিলার মাঝখানে এসে পৌঁছেছি। ডানদিকে আর গাছ নেই। শুধু ঝোপঝাড় আর শীর্ষে নগ্ন গ্রানাইট শিলার স্তূপ। রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা বটগাছ দেখলুম। তার তলায় লম্বা একটা পাথর। পাথরটাতে বসে বিশ্রাম নিতে এবং চুরুট টানতে পেলে খুশি হতুম। কিন্তু সূর্য ঢলে পড়ছে আরও দূরে ঘন নীল শৈলশ্রেণীর দিকে, ওটা ছোটোনাগপুর। পর্বতমালার একটা রেঞ্জ।
ফাগুলাল তখন বাঁদিকের টিলার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার কয়েক পা পিছনে। বাঁদিকের টিলার গায়ে নানা আকার ও আয়তনের পাথর ছড়ানো। সেইসব পাথরের আনাচেকানাচে ঝোপঝাড় অজস্র। ফাগুলালের হাবভাব লক্ষ্য করে বাইনোকুলার তুলে নিলুম। ফাগুলাল আস্তে বলল, ওই যে পিপুলগাছ দেখছেন, হ্যাঁ–একেবারে পাহাড়ের মাথায়, দেখতে পাচ্ছেন তো স্যার?
বাইনোকুলারের ভিউপয়েন্টার নবটাকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে অ্যাডজাস্ট করে নিলুম। দূরত্বের সঙ্গে এবং পিপুলগাছের একটা অংশ চোখে পড়ল। বললুম, পিপুলগাছটার একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি।
ফাগুলাল ঘুরে আমাকে দেখে নিয়ে বলল, স্যার! আর একটু বাঁদিকে এই পাথরটার কাছে আসুন।
পাথরটাতে সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার তাগড়াই শরীর, তারও আয়তন কম নয়। সে অগত্যা নেমে আমাকে দাঁড়াবার জায়গা দিয়ে বলল, ধারিয়া ফলস-এর দিকে সারাদিন মানুষজন হইহল্লা করে। পাখিদুটো তাই এই পিপুলগাছে এসে বসে থাকে। একটু খুঁজে দেখুন স্যার।
আমার এই বাইনোকুলার এক কিলোমিটার দূরে কোনো খুদে জিনিস ডিটেলস দেখিয়ে দেয়। এখানে দূরত্ব প্রায় আড়াইশো মিটার। পিপুলগাছটার প্রতিটা পাতার শিরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পাখিদুটোকে দেখতে পাচ্ছি না।
ফাগুলাল জিজ্ঞেস করল, দেখতে পাচ্ছেন?
অমনি বাইনোকুলারের লেন্সে নীল সারস ধরা দিল। আসলে সূর্যের ছটা এবং পাশের একটা উঁচু হয়ে ওঠা পাতাভরা ডাল বাতাসে এপাশে-ওপাশে ঝাঁকুনি খাচ্ছিল বলেই সারসটার পক্ষে চমৎকার ক্যামোফ্লেজ হয়ে উঠেছিল।
খুঁটিয়ে তাকে দেখার পরে তার সঙ্গিনীকে খুঁজলুম। মিনিট পাঁচেক পরে সে আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এসে সঙ্গীকে সম্ভবত চুমু দিল। বললুম, ফাগুলাল! দুজনকেই পেয়ে গেছি। কিন্তু ওদের ছবি তুলতে চাই। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো।
দ্রুত ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে সাবধানে পা বাড়ালুম। পাহাড়-জঙ্গলে এলে আমি সেকেলে হান্টিং বুটের ধাঁচে তৈরি রবার সোলের বিশেষ ধরনের খাঁজকাটা জুতো পরি। এই জুতো মাউন্টেনিয়াররাও পরে। সূর্য টিলার ওপাশে নেমেছে বটে, কিন্তু পিপুলগাছে যথেষ্ট রোদ আছে। পিচ্ছিল ঢালু পাথরে ঝুঁকে ডানহাত রেখে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলুম। একটু পরে পিছনে ফাগুলালের সাড়া পেলুম। কখন সে কোনো গাছ বা ঝোঁপ থেকে একটা লাঠি তৈরি করে নিয়েছে। সে আস্তে বলল, স্যার। এই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে। আমাকে আগে যেতে দিন।
তখন নীল সারস দম্পতি আমাকে প্রায় উন্মাদ করে ফেলেছে। হাউন্মাদ শব্দটা ইচ্ছা করেই বলছি। সামরিক জীবনে বর্মার জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধে শত্রু পক্ষের দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যাওয়ার সময় একই উন্মাদনা পেয়ে বসত। আর তিরিশ মিটার এগিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে বসলেই আমার ক্যামেরায় সারস দম্পতি পরিষ্কার এসে যাবে। ফাগুলালকে এগোতে দিলুম না। তাকে মাথার টুপি খুলে ধরতে দিলুম।
তারপর সামনের ঝোপটার কাছে গেছি, হঠাৎ দেখি পাথরের উপর খানিকটা লাল ছোপ। বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলুম, এমনই লাল ছোপ নিচের দিক থেকে এগিয়ে এসেছে। ডাইনে একই লাল ছোপ উঠে গেছে চূড়ার দিকে। কোথাও লাল রেখাও চোখে পড়ল। তারপর ঝোপের একপাশে একপাটি স্লিপার। মেয়েদেরই স্লিপার। আর ঝোপের কাটায় আটকে আছে এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে দেখি, খয়েরি রঙের শাড়ির আঁচলের একটা অংশ।
পিছু ফিরে ফাগুলালের দিকে তাকালুম। সে নিষ্পলক চোখে স্লিপারটা দেখছে। আমি ঝোঁপ থেকে ছেঁড়া কাপড়টা খুলে নিয়ে পিঠে আটা কিটব্যাগের পিছনের খোপে ঢুকিয়ে রাখলুম। স্লিপারটাও তুলে নিয়ে সেখানে ঢোকালুম। তারপর ডানদিকে ঘুরে চূড়ার দিকে উঠতে উঠতে মাথার উপর শনশন শব্দ শুনে মুখ তুলেই দেখি, নীল সারস দম্পতি উত্তরে উড়ে চলে যাচ্ছে।
ফাগুলাল প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, স্যার! স্যার!
বললুম ফাগুলাল! আমার পিছনে এসো। মনে হচ্ছে, আমরা একটা সাংঘাতিক ঘটনার সামনে এসে গেছি।
চূড়ায় ওঠা কষ্টকর ছিল না। পাথরের খাঁজে পা রেখে মিনিট দশের মধ্যে ঘন ঝোঁপঝাড়ের সামনে পৌঁছে গেলুম। চূড়ার পুরোটাই উঁচু-নিচু গা আর ঝোপে ঢাকা। মাঝে মাঝে পাথর উঁচিয়ে আছে। লাল ছোপটা ঝোপে গিয়ে ঢুকেছে। ফাগুলাল বলল, কোনো জানোয়ার হতে পারে স্যার! এইসব পাহাড়ি জঙ্গলে এখনও বাঘ বা ভালুক আছে। চিতাবাঘও আছে। স্যার! আর এগাবেন না।
ততক্ষণে আমি ঝোপের ওধারে টাটকা খোঁড়া ঘাসের চাপড়া বসানো হাত, তিনেক লম্বা একটা জায়গা আবিষ্কার করে ফেলেছি। ফাগুলাল এসে উঁকি মেরে। দেখে কপাল চাপড়ে বলে উঠল, হায় রাম!
এরপর আমি বাইনোকুলারে টিলাপাহাড়ের নিচে এবং রাস্তার বাঁক খুঁটিয়ে দেখার পর তিনদিকে ঘুরে এলাকাটা দেখে নিলুম। এখান থেকে নিচের রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। কারণ দুধারের গাছপালা এখান থেকে রাস্তাটাকে আড়াল করছে না। কেউ আমাদের লক্ষ করছে না, এতে নিঃসংশয় হওয়ার পর বললুম, ফাগুলাল! চলো! আমরা রক্তের দাগ যেখান থেকে উঠে এসেছে, সেখানে যাই। সাবধান! এখানে নিচে থেকে ওঠার চেয়ে নামা তুত সহজ হবে না। বরং তুমি জুতো খুলে ফেলো!
ফাগুলাল বলল, না স্যার! আমার অসুবিধা হবে না। পাহাড়ি মুলুকের লোক আমি। তাছাড়া আমার সায়েবের সঙ্গে কত উঁচু পাহাড়ে ওঠা-নামা করেছি।
রক্তের দাগ অনুসরণ করে নামছিলুম। কিছুটা নামার পর একটুখানি চাতালমতো জায়গায় পৌঁছুলুম। সেখানে আর একপাটি স্লিপার পড়ে আছে। এটা রক্তমাখা। কিন্তু রক্ত শুকিয়ে গেছে। তারপর চোখে পড়ল, চাতালের উত্তরে ঝুঁকে থাকা ঝোপের ডগায় রক্ত মেখে আছে। তার মানে, চাতালে রক্তাক্ত মৃতদেহটা ওদিক থেকে তোলা হয়েছে বা টেনে আনা হয়েছে।
ওদিকে পাথর আর নেই। ঘাসের জঙ্গল। ফাগুলাল এগিয়ে এসে তার হাতের ডালটা দিয়ে ঘাসের জঙ্গলে আঘাত করতে করতে নেমে গেল। মৃতদেহ এই পথেই আনা হয়েছিল। ঘাস দুমড়ে গেছে। এখানে রক্তে ঘাস লাল হয়ে গেছে।
আমরা ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে উঁচু গাছের ভিতর রক্তের চিহ্ন হারিয়ে ফেললুম। গাছের তলায় ঘনছায়া বলেও নয়, টর্চ জ্বেলে খুঁজেও দেখলুম। কোথাও রক্তের ছোপ নেই। এ তো অদ্ভুত ব্যাপার! ইতস্তত টর্চের আলো ফেলে খুঁজতে খুঁজতে এবার চোখে পড়ল ভিজে মাটিতে লম্বালম্বি দুটো সমন্তরাল দাগ। ফাগুলালের কাছ থেকে এতক্ষণে টুপিটা চেয়ে নিলুম। স্যাঁতসেঁতে মাটি থেকে ঝাঁকে ঝাকে খুদে পোকা আমার টাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। দাড়িতেও যথেষ্ট উপদ্রব। আমি বেশি ঝুঁকেছিলাম মাটির দিকে, এটাই তাদের উপদ্রবের সুযোগ দিয়েছিল। ফাগুলাল বলল, চলুন, স্যার! বড় মশা এখানে।
বললুম মশা নয়। এগুলো একধরনের পোকা। চলো! রাস্তায় যাই।
রাস্তা এখান থেকে কিছুটা উত্তরে এগিয়ে পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে। ওই বাঁক দিয়ে আমরা দুটো টিলার মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছেছিলুম। এখন সূর্য টিলার পশ্চিমে নেমে গেছে। তাই এদিকে আলোর রং ধূসর। ফাগুলাল বলল, আপনাকে একটা কথা বলি স্যার।
বলো!
যা দেখে এলেন, তা নিয়ে আমার সায়েবের সঙ্গে আগে কথা বলা উচিত কাজ হবে। ধরমপুরে খুনখারাপি নতুন নয়। খামোখা কদিনের জন্য বেড়াতে এসে ঝামেলায় পড়বেন। আমিও পড়ব।
একটু হেসে বললুম, তোমার সায়েব কি এ কথা চেপে যেতে বলবেন?
আমার মনে হয় তা বলবেন। কেন জানেন স্যার? পুলিশ–ফাগুলাল হঠাৎ পিছু ফিরে কেউ আসছে কি না দেখে নিয়ে বলল, ধরমপুরে পুলিশ আমার সায়েবকে তো বটেই, বাঙালিটোলার সব বাঙালিকে ঝাড়খণ্ডিদের সাপোর্টার মনে করে। আপনি আগে তো এসেছেন। তখন বাঙালিটোলার সব হাবেলি বাঙালিদের ছিল। এখন দশটা হাবেলি কিনে নিয়েছে এদিক-সেদিক থেকে আসা বিহারী লোক।
তুমিও তো বিহারী লোক, ফাগুলাল।
ফাগুলাল হাসবার চেষ্টা করে বলল, আমি স্যার বাঙালি হয়ে গেছি।
কিছুক্ষণ পরে বাঙালিটোলার পিচরাস্তায় পৌঁছে ফাগুলাল চাপাস্বরে বলল, ধরমপুরের মেয়ে নয়, বাইরে থেকে আসা কোনো মেয়ে। এখানকার কেউ হলে জানতে পারতাম। কারও মেয়ে বা ওয়াইফ নিখোঁজ হলে হইচই শুরু হত। তাই বলছি, জুতোজড়ো আর ঘেঁড়া কাপড়টা আমাকে দিলে আমি কোথাও পুঁতে রেখে আসব। ধারিয়া নদীতে ফেলে দেওয়ারও ঝামেলা নেই।
তার কথায় কান দিলুম না। অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়ি, ফাগুলালের ভাষায় যা হাবেলি, বাঙালিটোলার শেষপ্রান্তে এবং উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। গেটে নেপালি দারোয়ান আছে। কমন নাম জঙ্গবাহাদুর। তার পরনে খাকি হাফপ্যান্ট-হাফশার্ট এবং কোমরের বেলটে চামড়ার কাপে ভরা কুকরি আছে। সে সেলাম করে গেটের একটা অংশ খুলে দিল। লনের দুপাশে ফুলগাছ, ঝাউ, ক্যাকটাস। মিঃ রায়চৌধুরি দোতলা পুরোনো বাড়ির দক্ষিণে ঘাসে ঢাকা মাটিতে পৌত্রের সঙ্গে রঙিন বল নিয়ে খেলা করছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ধরা পড়েছে? পড়া তো উচিত। ফাগুলাল যখন সঙ্গী।
বললুম, না মিঃ রায়চৌধুরি! ফাগুলাল ঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। আমারই দুর্ভাগ্য! কামরায় ওরা ধরা পড়ল না।
মিসেস রায়চৌধুরি পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে মালির সঙ্গে কথা বলছিলেন। মিঃ রায়চৌধুরি তার উদ্দেশে বললেন, তুমি তুতুনকে একটু দেখো। কর্নেলসায়েব ফিরেছেন।
আমার কাছে এসে তিনি বললেন, চলুন! পোর্টিকোর ছাদে গিয়ে বসি। ফাগুলাল! কর্নেলসায়েবের জন্য কফির ব্যবস্থা করো। আমিও খাব।
ফাগুলাল একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেল। হলঘরের ভিতর ঢুকে আমরা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলুম। সিঁড়িতে বিবর্ণ কার্পেট পাতা। ডাইনে ঘুরে একটা দরজা পেরিয়ে পোর্টিকোর ছাদ। ছাদে বেতের কয়েকটা চেয়ার ও টেবিল ছিল। আগে পিঠে আটা কিটব্যাগ খুলে পায়ের কাছে রাখলুম। তারপর টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে দাড়ি ঝাড়লুম। বললুম, জঙ্গলের স্যাঁতসেঁতে মাটিতে পোকার খুব উপদ্রব।
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, জঙ্গলে ঢুকেছিলেন কেন?
জোড়া টিলার বাঁদিকেরটায় উঠেছিলুম! নামার সময় সোজা নেমে এসেছি।
ডমরুপাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিল ফাগুলাল?
ওটা ডমরুপাহাড় নাকি?
মিঃ রায়চৌধুরি হাসলেন। নিচে থেকে লক্ষ করলে দুটো পাহাড়ের মাঝখানটায় ভজ বলে লোকে ডমরুপাহাড় বলে। আসলে ব্রিটিশ আমলে লম্বা পাহাড়টার মাঝখানটা কেটে রাস্তা করা হয়েছিল। ওই রাস্তায় পশ্চিমে মাইলপাঁচেক এগিয়ে গিয়ে নদীর অববাহিকায় সেই বিশাল জলা। ও! আপনাকে তো নিয়ে গিয়েছিলুম।
আমি কফির প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমার নার্ভ তখন নিঃসাড় হয়ে গেছে যেন। আমি ভাগ্য মানি না। কিন্তু এটাই আশ্চর্য ব্যাপার, এর আগেও নীল সারস দম্পতি দেখার পর ঠিক এমনি একটা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলুম। তবে মেয়েটাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে জেলেদের জালে তার মৃতদেহ আটকে যায়। এক্ষেত্রে কোনো মেয়েকে মেরে অত উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ফাগুলাল বলেছিল, ওই পাহাড়ে শঙ্খচুড় সাপের উপদ্রব আছে। কে এমন খুনি যে সাংঘাতিক বিষধর শঙ্খচূড় সাপেরও পরোয়া করে না!
কী কর্নেল সরকার? আপনাকে এবেলা ক্লান্ত বলব না, যেন ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে। আপনার মতো জলি মানুষকে এমন কখনও দেখিনি। সত্যই কি আপনি নীল সারসের ছবি তুলতে না পেরে তার কথার উপর বললুম, মিঃ রায়চৌধুরি! ধরমপুরের নাড়িনক্ষত্র আপনার জানা। সম্প্রতি কি কোনো মহিলা–এখনও বয়স অনুমান করতে পারিনি, যাইহোক, মহিলাই বলছি, নিখোঁজ হয়েছে বলে জানেন?
অরিন্দম রায়চৌধুরি একটু ঝুঁকে এলেন। মাই গড। আপনি কোনো ডেডবডি আবিষ্কার করেছেন?
ডেডবডি নয়। সম্ভবত তার কবর।
কোথায়? কোথায়?
ডমরুপাহাড়ে বাঁদিকের চূড়ায়। বডি সোজা টেনে তুলে নিয়ে গিয়ে কেউ পুঁতেছে। যে-পথে টেনে তুলেছে, সে পথে রক্তের দাগ স্পষ্ট। কাটাঝোপে খয়েরি রঙের শাড়ির আঁচলের একটু অংশ আর দুপাটি স্লিপার পেয়েছি। পুলিশকে এখনই জানানো দরকার।
মিঃ রায়চৌধুরি চশমা টেবিলে রেখে দুগালে দুটো হাত চেপে ধরে (এটা তাঁর একটা অভ্যাস) আস্তে বললেন, একটু ভাবতে দিন। কফি খাওয়ার পর কথা হবে। হা–ফাগুলাল কি দেখেছে?
–দেখেছে। সে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল।
–সে কী বলল আপনাকে?
চেপে যেতে বলল। অবশ্য আপনার সঙ্গে কথা বলার পর চেপে যেতে বলল।
–হুঁ। আগে কফি খেয়ে নিন। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।….
কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়েছি, অরিন্দম রায়চৌধুরি বললেন, একটা অনুরোধ কর্নেল সরকার!
বলুন!
ফাগুলালকে আমি মাইনাসে রেখে পুলিশকে খবর দিতে চাই।
অর্থাৎ ফাগুলাল আমার সঙ্গে ছিল না?
হ্যাঁ।
কেন?
সংক্ষেপে বলছি। এখানকার বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডি-বিরোধী বিহারীদের বিশেষ করে ব্যবসায়ী আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের অন্ধ বিদ্বেষ। আছে। এদিকে ফাগুলাল আমার মতো একজন বাঙালি রাজনীতিকের কর্মচারী বলেও নয়, তার পাহলোয়ান নামে বদনাম আছে। আমরা ঠাট্টা করে পালোয়ান বলি। ধরমপুর এবং সারা এলাকায় পাহলোয়ান বলতে আমরা যাদের দুবৃত্ত মস্তান বলি তা-ই। ফাগুলালের সাঙ্গপাঙ্গ আছে অচ্ছুত বা হরিজনদের মধ্যে। বিহারে জাত-পাতের দ্বন্দ্বের কথা আপনি জানেন। আশাকরি, আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন।
পেরেছি। কিন্তু–
আপনার কিন্তু আর আমার কিন্তু এক নয়। ফাগুলাল পাহলোয়ান বাঙালি আর ঝাড়খণ্ডিদের যোগাযোগের মিডিয়া হিসাবে দাগি। অচ্ছুত বলুন, কি হরিজন বলুন, কি দলিত বলুন, তার ঝাড়খণ্ডিদের গোপনে সমর্থন করে। তাই ফাগুলাল তাদের গার্জেন।
আমার ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছিল। বললুম মিঃ রায়চৌধুরি! একটা নিছক হত্যাকাণ্ডকে রাজনীতির আওতায় নিয়ে যাওয়ার অর্থ হয় না। আপনি তো জানেন, আমি
আবার আমার কথা থামিয়ে দিলেন মিঃ রায়চৌধুরি। হ্যাঁ, আপনি একটা হত্যাকাণ্ডের কিছু সূত্র পেয়েছেন। তাই আপনি আপনার মতো করে এগিয়ে যেতে চাইছেন। এতে আমার আপত্তির কী কারণ থাকতে পারে? বরং আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য করব। শুধু ফাগুলালকে আমি সরিয়ে নিতে চাইছি। কারণ সে আপনার নিছক সঙ্গী ছিল এবং পাখিদুটোর ঠিকানা জানত, এই ব্যাপারটা তুচ্ছ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এই কথাটা দাঁড়াবে : ফাগুলাল এবং একটি হত্যাকাণ্ড। তাকে পুলিশের সাহায্যে ফাঁসানোর সুযোগ পাবে ওরা।
মিঃ রায়চৌধুরির যুক্তি আমার বোধগম্য হল না, এমন নয়। হয়তো আমি ধরমপুরের সাম্প্রতিক অবস্থা জানি না। এবং এতবছর পরে তো নেহাত বহিরাগত বটেই। এই ভেবে বললুম, ঠিক আছে। বড়ো দেরি হয়ে গেল। সাড়ে ছটা বাজে। চলুন, আপনি পুলিশকে টেলিফোন করবেন। দরকার হলে আমিও কথা বলব।
ফাগুলাল দরজার পাশে বসে কথা শুনছিল। আমাদের দরজায় ঢোকার সময় উঠে দাঁড়াল। তার জোরে শ্বাস ছাড়ার শব্দ কানে এল।
দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে হেঁটে অরিন্দম রায়চৌধুরির স্টাডিতে ঢুকলুম। পাশেই আমার থাকার ঘর। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে ও পাখা চালিয়ে মিঃ রায়চৌধুরি টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করলেন। এখন ধরমপুরে টেলিফোনের অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ হয়েছে। তিনি রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, এনগেজড। আপনি বসুন। ততক্ষণ আমি পাইপ ধরিয়ে নিই। আপনার চুরুটের গন্ধ মনে পড়িয়ে দিল, এবেলা পাইপ টানার সুযোগ পাই নি। না– ব্যস্ততা নয়। আমার মিসেসের কঠোর নির্দেশ।
সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে বসে মিঃ রায়চৌধুরি তাঁর ধূমপানের ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং বাধা নিয়ে কথা বলতে বলতে পাইপ পরিষ্কার করলেন। তারপর তামাক পুরে বললেন, লাইটারটা কোথায় গেল? এই এক বদঅভ্যাস।
আমি লাইটার জ্বেলে ওঁর পাইপ ধরাতে সাহায্য করলুম। আমার ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছিল। মিঃ রায়চৌধুরি কি ইচ্ছা করেই গড়িমসি করছেন? এই ধরনের ঘটনায় বরাবর আমার অভ্যাস সোজা পুলিশের কাছে যাওয়া। কিংবা কাছাকাছি খোঁজ নিয়ে কারও টেলিফোন ব্যবহার। বাঙালিটোলার উত্তরে মিনিট দশেক হাঁটলেই টেলিফোন পেয়ে যেতুম। আসলে ফাগুলালের কথাবার্তা এবং আমার পুরোনো বন্ধুর প্রতি আনুগত্য, বিশেষ করে আমি যখন তার আতিথ্য সেবা-যত্নে আছি, এই সব কারণে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেল। আমার উদবেগ, অক্টোবরের যে কোনো সময় অতর্কিতে শুধু বৃষ্টি বা ঝোড়ো হাওয়া সহ বৃষ্টি এসে যেতে পারে এবং ডমরুপাহাড়ের রক্ত ধুয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এতে পুলিশের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার তদন্ত পদ্ধতির ক্ষতি হবে।
অরিন্দম রায়চৌধুরি পাইপ কামড়ে ধরে আবার রিসিভার তুললেন। ডায়াল করে এবার সাড়া পেলেন। হিন্দিতে বললেন, ওসি মিঃ সিংহ আছেন?
…………
আমি অরিন্দম রায়চৌধুরি বলছি! দিস ইজ আর্জেন্ট।
…………
মিঃ সিংহ! একটু মন দিয়ে শুনুন। আমার কলকাতার এক বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গতকাল এখানে বেড়াতে এসেছেন। তিনি একজন অর্নিথোলজিস্ট। আজ বিকালে ডমরুপাহাড়ের দক্ষিণ অংশের চূড়ায় সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন। ফিরে এসে উনি
…………
ওঁর মনে হয়েছে ওখানে একটা ডেডবডি পোঁতা আছে। আগে শুনুন! দুপাটি স্লিপার, কোনো মেয়েরই। ঝোপে খয়েরি রঙের শাড়ির একটু অংশ। রক্তের দাগ। এইসব দেখেই কর্নেল সরকারের সন্দেহ
…………
মিঃ রায়চৌধুরি মাউথপিসে হাত চাপ দিয়ে আমাকে বললেন, এই নতুন ওসি শ্যামসুন্দর সিংহ বড্ড বাজে লোক। রিসিভার কানে রেখে অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলে। দেখি ও কী করে। আমি বরং সি আইকে রিং করব। নাইস ম্যান। কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন। বাড়ি সাহেবগঞ্জে।…হ্যাঁ। বলুন মিঃ সিংহ।
…………
ঠিক আছে। আমি তাহলে কর্নেলসায়েবকে নিয়ে বেরোচ্ছি। ডমরুপাহাড়ের রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করব।
…………
হ্যাঁ। খোঁড়াখুঁড়ির জন্য লোকজন তো অবশ্যই দরকার। আপনি ব্যাপারটা বুঝেছেন তো? বাঁদিকের পাহাড়ের চূড়ায়–তার মানে একটা সিরিয়াস অ্যাডভেঞ্চার…ইউ আর রাইট মিঃ সিংহ।….।
রিসিভার রেখে অরিন্দম রায়চৌধুরি বললেন, কাজটা খুব সহজ হবে না। দিনে হলে অন্য কথা। আবার হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেলে কেলেঙ্কারি। তাই বললুম, সিরিয়াস অ্যাডভেঞ্চার। আচ্ছা কর্নেল সরকার! পুলিস ডেডবডি উদ্ধারের কাজটা কাল সকালে করলেও তো পারত।
বললুম, থানার অফিসার-ইন-চার্জ যখন কাজটা রাত্রেই করতে চাইছেন–
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, করতে চাইছেন মানে কী? বৃষ্টি এসে গেলে ওঁরা এরাতের মতো কিছু করবেন না।
ওসি তা-ই বললেন?
মুখে বলেননি। কিন্তু আমি তো পুলিশকে জানি। তার চেয়ে বড়ো কথা, কোনো মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে এমন খবর পুলিশের হাতে নেই।–
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম যদি সত্যিই বৃষ্টি আসে, বৃষ্টিতে পুলিশ ডেডবডি খুঁড়ে না তুললে খুনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। ডেডবডি ধারিয়া নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে পারে।
মিঃ রায়চৌধুরি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন এবং মাটিতে রক্তের দাগ তো থেকে যাবে।
বললুম, তাতে খুনিরই সুবিধা হবে। যতক্ষণ না কোনো মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর পুলিশ পাচ্ছে ততক্ষণ সে খুনের সব সূত্র নষ্ট করে ফেলার যথেষ্ট সময় পাবে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, আমি ডেডবতি দেখিনি। ওখানে কেউ কোনো মরা জানোয়ার পুঁতে রাখতেও পারে। দুটি স্লিপার আর একটুকরো ছেঁড়া আঁচল মানুষ খুনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ নয়। ধরুন, কেউ তাঁর সঙ্গিনীকে নিয়ে ডমরুপাহাড়ে উঠেছিল। নেমে আসার সময় জুতো পা থেকে খুলে গেছে। আঁচল কাঁটাঝোপে আটকে গিয়ে ছিঁড়েছে।
অরিন্দম রায়চৌধুরি হেসে ফেললেন। তারপর বারান্দায় গিয়ে আকাশ দেখতে থাকলেন। আমিও আকাশের অবস্থা দেখার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। এখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণে কয়েকটা উঁচু পাহাড় আকাশের কিছুটা আড়াল করেছে। পাহাড়গুলো বাঙালিটোলার কছাকাছি। বেলা আটটা না বাজলে এখান থেকে সূর্য দেখা যায় না।
একটু পরে মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, পুলিসের একটা অ্যাডভান্স পার্টি আসার কথা। এখনই বেরোতে হবে। আপনি কি পোশাক বদলাবেন?
বললুম, না।
তাহলে আপনি এগোন। লনে অপেক্ষা করুন গিয়ে। আমি পাজামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরে নিই…
লনে গিয়ে উত্তরে ফাগুলালের ঘরের দিকে তাকিয়েছিলুম। ফাগুলাল বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে খইনি ডলছে। তার বউ উনুনে রুটি সেঁকছে। ঘরের ভিতর একটা খাটিয়ায় বসে তার মেয়ে মুনিয়া স্কুলের পড়া তৈরি করছে, ফাগুলালের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড়ো ছেলে সুরেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। ধানবাদে চাকরি করে শুনেছি। ছোটো ছেলে রাকেশ ধরমপুর কলেজে পড়ে। মিঃ রায়চৌধুরি ফাগুলালের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ জুগিয়েছিলেন। ফাগুলালের কাছে শুনেছি, সুরেশ বিয়ে করেছে ধানবাদে। বছরে একবার আসে হোলির সময়। বাবা-মাকে টাকাকড়ি কদাচিৎ পাঠায়।
ফাগুলালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, ফাগুলাল ডমরুপাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে বলছিল। কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। শঙ্খচূড় সচরাচর জল থেকে বেশি দূরে বাস করতে চায় না। অন্তত তার বিচরণক্ষেত্রের সন্নিকটে একটি ডোবা থাকাও চাই।
অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা বা পরোক্ষ জ্ঞানের বাইরে অনেক কিছুই থাকতে পারে। পোর্টিকোর মাথায় উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। ঘড়ি দেখলুম, প্রায় আটটা বাজে। অরিন্দম রায়চৌধুরি এসে বাঁদিকে গ্যারেজে গিয়ে ঢুকলেন। পাশাপাশি দুটো গাড়ি রাখা আছে। একটা ফিয়াট। একটা জিপ। জিপগাড়িতে স্টার্টের শব্দে ফাগুলাল এদিকে তাকাল। ইঞ্জন গরম হওয়ার পর মিঃ রায়চৌধুরি লনে গাড়িটা আনলেন। এইসময় ফাগুলাল এসে আমাকে সেলাম দিল। মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ফাগুলাল! তুমি কিছু দেখনি। কর্নেলের সঙ্গে পাহাড়েও ওঠনি। দূর থেকে পাখি দেখিয়ে দিয়েছিলে শুধু। বুঝেছ?
হ্যাঁ স্যার! আপনারা কি পুলিশের সঙ্গে পাহাড়ে উঠবেন?
বৃষ্টি না হলে উঠব। কেন?
স্যার। আপনি তো জানেন ওই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে।
আমার সঙ্গে রাইফেল আছে। টর্চ আছে। আসুন কর্নেল সরকার।
জিপে ওঁর ডানপাশে বসে এতক্ষণে দেখলুম, উনি রাইফেলটা জিপের পিছনের সিটে রেখে লম্বা টর্চটা তার এবং আমার মাঝখানে সিটের উপর রাখলেন।
গাড়ির ওপাশে গিয়ে ফাগুলাল বলল, স্যার! একটু সাবধানে থাকবেন।
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ঠিক আছে। তুমি বাড়ির পিছন দিকে নজর রেখো।
জঙ্গবাহাদুর সেলাম করে গেট খুলে দিল। পিচের রাস্তাটা বাঁদিকে চলে গেছে ধারিয়া ফলস-এর পাশ দিয়ে দুমকার দিকে। ডাইনে অর্থাৎ উত্তরে গিয়ে ঢুকছে ধরমপুর বাজারে। মিনিট পাঁচেক পরে সেই পাহাড়ি রাস্তাটার মোড়ে পৌঁছে জিপ দাঁড় করালেন মিঃ রায়চৌধুরি। বললেন, পুলিশের ব্যাপার আমি জানি। দেখুন না তথাকথিত অ্যাডভান্স পার্টি কখন পৌঁছোয়।
তিনি রাইফেল আর টর্চ নিয়ে নামলেন। বাঙালিটোলায় স্ট্রিটলাইট নেই। চারদিকের অন্ধকার টর্চের আলোয় একবার ঝলসে দিয়ে মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, গুমোট গরম। বাতাস বন্ধ। আকাশ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
গাড়ি থেকে নেমে বলুলম, আমি একটা বড়ো ভুল করেছি মিঃ রায়চৌধুরি।
ভুল করেছেন? কী ভুল?
আমার এই কিটব্যাগে জঙ্গলনাইফ ছিল। জায়গাটা তা দিয়ে খুঁড়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল।
মিঃ রায়চৌধুরি হাসলেন। গতস্য শোচনা নাস্তি। তবে ন্যায়শাস্ত্রে আছে, পর্বতে ধোঁয়া দেখলে আগুন থাকাটা স্বতঃসিদ্ধ।
মিঃ রায়চৌধুরি! ন্যায়শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্বও আছে। যা প্রতীয়মান, তা বাস্তব নয়।
আপনি কি এতক্ষণে অবভাসতত্ত্বে পৌঁছোলেন।
একটা চুরুট ধরিয়ে বললুম, অবশ্য আমার ইনটুইশন সম্পর্কে আমি বিশ্বাসী। এটা অলৌকিক কোন বোধ নয়। দীর্ঘ সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা। আপনি তো শিকারি ছিলেন। জঙ্গলের মধ্যে কোথাও শব্দ শুনলে শব্দটার দূরত্ব এবং দিকনির্ণয় করতে পারতেন। শব্দটা কীসের তা-ও নিশ্চয় বুঝতে পারতেন। জঙ্গলযুদ্ধে আমার এই ট্রেনিংটা নিতে হয়েছিল।
এইসময় উত্তরে গাড়ির আলো দেখা গেল। মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ওরা আসছে।
দুমিনিটের মধ্যে পুলিশের জিপ এসে আমাদের কাছে থামল। জিপ থেকে একজন পুলিশ অফিসার বললেন, নমস্তে রায়চৌধুরিসাব!
নমস্তে মিঃ পাণ্ডে। ওসি মিঃ সিংহ আসবেন তো?
মিঃ পাণ্ডে বললেন, পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন।
অরিন্দম রায়চৌধুরি জিপে উঠে বললেন, চলুন। রাস্তার অবস্থা খারাপ। কিন্তু জিপের পক্ষে কোনো বাধা নয়।
আমি তার জিপে উঠে বসলুম। চড়াই এবং ছোটবড়ো পাথরের বাধা আগ্রাহ্য করে গাড়ি চড়াইয়ে উঠছিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আমার শরীর জানিয়ে দিচ্ছিল, তার মধ্যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে। মাথার পাশে একটা রড আঁকড়ে ধরেছিলুম। এঁকেবেঁকে গাড়ি হাড়ভাঙার মতো অদ্ভুত শব্দ করতে করতে অবশেষে সেই সমতল অংশে পৌঁছাল, যেখানে ডানদিকে বটগাছ এবং তলায়। লম্বাটে বেদির মতো পাথর। একটু পরে মিঃ পাণ্ডের জিপ উঠে এসে আমাদের বাঁ পাশে দাঁড়াল। আমরা ততক্ষণে নেমেছি। এবার মিঃ পাণ্ডে এবং আরও একজন অফিসার নামলেন। পিছনে দিক থেকে ছজন কনস্টেবল নামল। চারজন সশস্ত্র। দুজনের হাতে বেঁটে লাঠি। মিঃ রায়চৌধুরি টর্চের আলো নিচে ফেলে মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। রঘুনাথ পাণ্ডে অ্যাডিশনাল ওসি। তাঁর সঙ্গে এসেছে এস আই রণবীর দুবে।
জিপগাড়ি দুটোর কাছে পুলিশের ড্রাইভার এবং একজন আর্মড কনস্টেবল রইল। মিঃ পাণ্ডের একহাতে বেটন, অন্যহাতে স্পটলাইট। স্পটলাইটটা তিনি একজন কনস্টেবলকে দিয়ে আমাকে বললেন, আপনি আগে চলুন কর্নেল সরকার!
জোরালো স্পটলাইটের আলোয় ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চললুম। আমার পিছনে মিঃ রায়চৌধুরি এবং মিঃ পাণ্ডে। এখন রক্তের ছোপ লক্ষ করার। প্রশ্ন ওঠে না। প্রায় আধঘণ্টার দুর্গম অভিযান। ইতিমধ্যে শিশিরে পাথর কিছুটা পিচ্ছিল। সাবধান করে দিচ্ছিলুম, পাথরের খাঁজে পা ফেলতে হবে।
অবশেষে চূড়ার সেই ঝোপের সামনে যখন পৌঁছেলুম তখন, আমি ঘেমে গেছি। পিছনে একদল মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ অদ্ভুত লাগছিল। আমার টর্চ বের করে শিশিরে ভেজা ঝোপের একটা দিক সরিয়ে আলো ফেললুম। মিঃ রায়চৌধুরিও জোরালো টর্চের আলো ফেলে বললেন, মাই গড। পাণ্ডেজি। দেখছেন?
আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, ঘাসসুদ্ধ মাটির চাপড়া তেমনই চাপ-চাপ বসানো আছে। পুলিশের স্পটলাইটের আলোয় শুধু একপাশে কোনো জন্তুর নখের আঁচড় লক্ষ্য করলুম। জন্তুটা সবে মাটি সরাচ্ছিল। মানুষজনের সাড়া পেয়ে সরে গেছে।
আমি ভাবছিলুম, কিটব্যাগ থেকে জাঙ্গল-নাইফটা বের করে অন্তত ঝোপটা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলি। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, এই ঝোপেও যদি কোনে ব্লু থাকে, তা নষ্ট হয়ে যাবে। ফাগুলালের সঙ্গে এসে তখন ঝোপটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে ভুলে গিয়েছিলুম। উত্তেজনাই এর কারণ। সে মুহূর্তে আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করেছিল একটা পয়েন্ট। নিচে থেকে একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ তুলে এনে এখানে পুঁতে ফেলতে শারীরিক শক্তির দরকার। যদি একাধিক লোক মৃতদেহটা এনে থাকে, আলাদা কথা। কিন্তু ঝোপের পাশে মাটিটা বৃষ্টিতে নরম। ঘাসের উপর পায়ের ছাপ পড়া সম্ভব নয়। তবে ঘাস দেবে গেছে মৃতদেহেরই চাপে। দিনের রোদ ছাড়া পায়ের ছাপ খুঁজে বের করা। অসম্ভব। তখন রোদ ছিল না। আর এখন ঝোঁপ ঘিরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কোনো পায়ের ছাপ কাল দিনেরবেলায় আর খুঁজে বের করা যাবে না। আমাদের পায়ের ছাপে খুনি বা তার সহকারীদের পায়ের ছাপ হারিয়ে গেল।
স্পটলাইটটা যে কনস্টেবলের কাছে ছিল, সে বারবার পাহাড়ের চূড়ার ঝোঁপজঙ্গলের উপর থেকে ঢালু গায়ে আলো ফেলছিল। মিঃ পাণ্ডে কড়া ধমক দিলেন তাকে। স্পটলাইট নিভিয়ে কনস্টেবলটা মৃদূস্বরে বলল, শুনেছি ডমরুপাহাড়ে সাপের উপদ্রব আছে।
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি এই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে।
এবার আতঙ্কিত দুই, পুলিশ অফিসার বারবার টর্চ জ্বেলে আশেপাশে আলো ফেলতে থাকলেন। এস আই রণবীর দুবে অস্থির হয়ে বললেন, ওসিসাব লোকজন নিয়ে আসতে এত দেরি করছেন কেন?
মিনিট পাঁচেক পরে আমি কিটব্যাগ থেকে জাঙ্গল-নাইফ বের করে বললুম, ততক্ষণ আমি যতটা পারি, এই ঘাসের চাপড়াগুলো সরিয়ে ফেলি? মনে হচ্ছে কাজটা তত কঠিন হবে না।
অস্থির মিঃ পাণ্ডে বললেন, ঠিক আছে। কর্নেল সরকার। আপনি চেষ্টা করুন। কাজটা এগিয়ে থাক। রাম সিং! তুমি কর্নেলসাবকে সাহায্য করো।
কাজটা এত সহজ বলে ভাবিনি। জঙ্গলকাটার ছুরি ভাঁজ করা ছিল। খুলে স্ক্রু আঙুলের চাপে ঘুরিয়ে টাইট করলুম। প্রায় দশইঞ্চি ফলা ঘাসের চাপড়ার তলায় ঢুকিয়ে দিলুম। রাম সিং তার বেটন ভরে চাপড়া উলটে একটু তফাতে ফেলল। মিনিট দশেক পরে আমার ছুরির ডগায় রক্ত মেখে গেল। আরও পাঁচ মিনিটের মধ্যে রক্তাক্ত বিভীষিকা দেখা পাওয়া গেল। লাল গেরিমাটিমাখা দুমড়ে বসানো মৃতদেহটা দেখা দিল। খয়েরি শাড়ি, হাতকাটা ম্যাচিং ব্লাউজ ও সায়ার সঙ্গে সেঁটে থাকা মেয়ে শরীর। মাথার চুল গেরিমাটিতে লাল। আমি চুলগুলো টেনে ধরতেই মুখটা উঁচু হল। শ্বাসনালিকাটা একটি মেয়ে। মিঃ রায়চৌধুরি টর্চের আলো নিভিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, চেনা মনে হচ্ছে! হ্যাঁ–খুব চেনা। এক মিনিট। বলছি। জয়া! অবিনাশ কবিরাজ মশাইয়ের মেয়ে। বাট হোয়াই? অ্যান্ড হাউ…
.
রাত দশটা নাগাদ ফিরে পোশাক বদলে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিচে ডাইনিং ঘরে গেলুম। অরিন্দম রায়চৌধুরি বললেন, আমার কিছু খেতে ইচ্ছা। করছে না। আপনাকে সঙ্গ দেব শুধু।
একটু হেসে বললুম, একসময় আপনি দুর্ধর্ষ শিকারি ছিলেন। তারপর রাজনীতিক। একালের রাজনীতিতে খুনজখম ক্রমে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাছাড়া আপনি বিহার রাজ্যের রাজনীতিক।
কর্নেল সরকার। এটা রাজনৈতিক খুনজখমের ঘটনা নয়। কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের মেয়ে জয়া আমার মেয়ে অন্তরার বন্ধু। এ বাড়িতে তাকে কমবয়স থেকে দেখেছি। অন্তরার বিয়ের পর জয়া আমাকে বলেছিল, ওর একটা চাকরি দরকার। অন্তরা নেই বলে ওর নাকি সময় কাটছে না।
মিসেস সুষমা রায়চৌধুরি দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, বাজে কথা, তোমাকে এতদিন বলিনি। অন্তরা ওকে গার্ড দিত।
বুঝলাম না।
নরহরি ঠাকুর পরিবেশন করছিলেন। সুষমা তার দিকে চোখের একটা ইঙ্গিত করলেন। মিঃ রায়চৌধুরির সামনে একটা ডিশে লুচি-বেগুনভাজা রেখে নরহরি ঠাকুর বললেন, যে-যার কর্মফল ভুগবে। তুমি না খেয়ে কি তা আটকাতে পারবে অরু?
মিঃ রায়চৌধুরি অনিচ্ছার সঙ্গে খেতে শুরু করল। আমার তো প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। সুষমা বললেন, কবরেজমশাইকে কখন পুলিশ খবর দেবে, তাদের খেয়ালখুশি। তুমি ফাগুলালকে দিয়ে খবর পাঠালে পারতে।
এস আই দুবেজি খবর দিতে গেছেন। এতক্ষণ কবরেজমশাই পুলিশের জিপে চেপে থানায় চলে গেছেন।
সুষমা হঠাৎ বললেন, থাক ওসব কথা। চুপচাপ খেয়ে নাও। আমি দেখি, বাচ্চু ফিরল নাকি।
বাচ্চু এখনও ফেরেনি?
নটায় ফোন করেছিল। ফিরতে দেরি হবে। বলে সুষমা বেরিয়ে গেলেন।
জিজ্ঞেস করলুম, বাচ্চুর ব্যবসা কেমন চলছে?
মিঃ রায়চৌধুরি অন্যমনস্কভাবে বললেন, ভালো।
বাচ্চু কি রোজ রাত্রে বাড়ি ফেরে?
হ্যাঁ। মোটরসাইকেলে ওর একজন সঙ্গী থাকে। বডিগার্ড বলা চলে। এ বাড়ির কাছাকাছি তার বাড়ি।
বাঙালি?
হ্যাঁ। বাচ্চুর ট্রেডিং এজেন্সিতেই চাকরি করে। শচীন বোস নাম। খোকা বোস নামে ধরমপুরেও পরিচিত। মিঃ রায়চৌধুরি একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ফাগুলালের মতো সে-ও এক পালোয়ান।
নরহরি ঠাকুর ফোকলা মুখে হেসে বললেন, কর্নেলসায়েব! ধরমপুর এরিয়াতে পালোয়ানের ছড়াছড়ি। আমার ছোটোবেলায় ওদের অস্ত্র ছিল লাঠি। এখন সাংঘাতিক সব মেশিন। মেশিন বুঝলেন তো কর্নেলসায়েব?
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, নরহরিদা! কর্নেলসায়েব মেশিন বোঝেন। মনে। হচ্ছে তোমার সব আইটেম শেষ। তুমি এবার কফির জল গরম করো। ফাগুলালাকে দিয়ে কর্নেলসায়েবের ঘরে পাঠাবে।
খিদে সত্ত্বেও আমারও খাদ্যে রুচি কমে যাচ্ছিল। বারবার মনে পড়ছে মেয়েটার মুখ। বেসিনে হাত ধুয়ে হলঘর হয়ে দোতলায় উঠলুম। আমার পেছনে মিঃ রায়চৌধুরি। বললুম, আপনি আর কুকুর পোষেন না কেন?
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমারও ডন আর জনের কথা মনে পড়ে যায়। ডন একটা চিতাবাঘের পাল্লায় পড়েছিল। তাকে আর খুঁজে পাইনি। জনকে বাচ্চুর বিয়ের পর এক বন্ধুকে দান করেছিলুম। একমাস পরে বেচারা মারা যায়।
দান করেছিলেন কেন?
বউমার প্রচণ্ড ভয়। কুকুর সম্পর্কে ওর অদ্ভুত, ফোবিয়া আছে। তারপর আমার নাতি তুতুনের জন্য নিরীহ জাতের কুকুর আনলুম। নাম দিলুম মিক্কি। ইঞ্চি ছয়েক উঁচু। বাচ্চা কুকুর। দেখেই বউমা ফিট হয়ে গেল। তারপর আর কুকুর সম্পর্কে ভাবি না।
আমরা যখন দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটছি, তখন মোটর সাইকেলের শব্দে রাতের স্তব্ধতা চুরমার করতে করতে বাচ্চু মিঃ রায়চৌধুরির একমাত্র ছেলে অনির্বাণ ফিরল। আমার থাকার ঘরে ঢুকে মিঃ রায়চৌধুরি আলো জ্বেলে পাখা চালিয়ে দিলেন। বললুম, কিছুক্ষণ বারান্দায় বসি।
ঠিক বলেছেন।
দুজনে বসার পরই ঝিরঝিরিয়ে আকস্মিক বৃষ্টি এসে গেল। পরক্ষণেই মেঘের গর্জন। বললুম, ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় থাকার সময় বৃষ্টি এলে সমস্যা হত।
মিঃ রায়চৌধুরি পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাইপ আর তামাক বের করে টেবিলে রাখলেন। বললেন, কফি খেয়ে পাইপ টানব। আমার মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। এ একটা অকল্পনীয় ঘটনা। অবশ্য একটু সান্ত্বনা, আপনি এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। পুলিশ আপনাকে সহযোগিতা করবে, যদি আপনি নিজের পরিচয় জানান। তবে আমার মনে হয়, শিগগির আপনার আত্মপরিচয় দেওয়া ঠিক হবে না। শ্যামসুন্দর সিংহ লোকটাকে তো দেখলেন। নিজের সম্পর্কে লোকটার অদ্ভুত সব ধারণা আছে। জয়ার ডেডবডি উদ্ধারের কাজটা আপনি করে ফেলেছেন। এতেই ওর রিঅ্যাকশন হয়তো লক্ষ করেছেন!
বুঝলুম, অরিন্দম রায়চৌধুরি কথা বলে হাল্কা হতে চাইছেন। বৃষ্টিটা ক্রমে জোরালো হচ্ছিল। মেঘের গর্জনও মুহূর্মুহূ কানে তালা ধরানোর মতো। চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ। বারান্দায় বৃষ্টি বেঁকে এসে আঘাত করছিল। অগত্যা আমরা ঘরে গিয়ে বসলুম। তখনই ফাগুলাল কফির ট্রে নিয়ে এল।
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ফাগুলাল! তোমার বাচ্চুবাবু ঠিক সময়ে ফিরল। একটু দেরি করলেই বৃষ্টিতে ভিজে যেত।
ফাগুলাল, বলল, বাচ্চুবাবু টাউনেই কীভাবে খবর পেয়ে গেছে!
বল কী? তোমাকে বলল?
হ্যাঁ। বাচ্চুবাবুর দেমাগ খারাপ হয়ে গেছে মনে হল।
কেন? ওর এতে মাথাব্যথার কী আছে?
কী বলছেন স্যার? কবরেজমশাইয়ের মেয়ে একসময়ে এ বাড়ির মেয়ে ছিল।
কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম, এই বৃষ্টি আর কিছুক্ষণ চললে ধারিয়া নদীতে বন্যা হবে।
ফাগুলাল বলল, ধরমপুর উঁচু জায়গা স্যার। পুরো বাঙালিটোলা লম্বা একটা টিলাপাহাড়ের মাথা কেটে তৈরি হয়েছিল।
মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ঠিক আছে ফাগুলাল! তুমি তোমার বাচ্চুবাবুকে দেখো। বাচ্চু রোজ রাতে একটু ড্রিংক করে বাড়ি ফেরে। তাই আমাকে এড়িয়ে থাকে। ওর দেমাগ খারাপ মানে বউমার প্রবলেম।
বিকালে ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় একটা মৃতদেহ পোঁতা আছে জানার পর থেকে ফাগুলাল আমূল বদলে অন্যমানুষ হয়ে গেছে। একজন হাসিখুশি লোককে মুখ গোমড়া করে থাকতে দেখলে খারাপ লাগে। কিন্তু এখনও আমি তার এই অদ্ভুত রূপান্তরের কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
মিঃ রায়চৌধুরি আস্তে বললেন, আপনাকে বলা উচিত। কবরেজমশাই তাঁর মেয়ে জয়াকে আমার পুত্রবধূ করার অনুরোধ করেছিলেন। আমার মিসেস একথা শুনে খুব চটে গিয়েছিল।
চটে যাওয়ার কারণ ছিল?
সুষমা খুলে কিছু বলেনি। কিন্তু আমার ধারণা, জয়া একটু মেজাজি মেয়ে ছিল। বড্ড বেশি স্মার্ট। বাচ্চুকে তুই-তোকারি করত। কিন্তু অন্তরাকে তুমি বলত। আসলে জয়াকে বাড়ির বউমা বলে কল্পনা করা সুষমার পক্ষে হয়তো সম্ভব ছিল না। সুষমা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে।
আপনি বলেছিলেন জয়ার মা তার ছোটোবেলায় মারা গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ। ওর বিধবা পিসিমা ওকে মানুষ করেছিলেন। ভদ্রমহিলা দুবছর আগে মারা গেছেন।
জয়ার চাকরি সম্পর্কে বলুন!
এখানে খ্রিস্টান মিশন আদিবাসীদের জন্য একটা স্কুল করেছিল। ভালো স্কুল। ফাদার হ্যাঁরিংটনকে অনুরোধ করেছিলুম। আমার মেয়ে অন্তরা এবং জয়া দুজনেই খ্রিস্টান স্কুল-কলেজে পড়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম। বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা নেই। আমরা বাঙালিটোলায় বাংলা পড়ানোর জন্য প্রাইভেট নাইটস্কুল করেছিলুম।
জয়ার কি চাকরি হয়েছিল?
ফাদার হ্যাঁরিংটনের স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে টিচার হয়েছিল জয়া। শতিনেক টাকা মাইনে। আসলে খ্রিস্টান নানরাই পড়ান। তারপর কী কারণে জয়া চাকরি ছেড়েছিল, আমাকে বলেনি। সত্যি কথাটা হল, গত একবছর বিহার রাজ্যের রাজনীতিতে এমন জটিল টানাপোড়েন চলছে, আমি অন্য কিছুতে মন দেওয়ার সুযোগ পাইনি। এই দেখুন না! আপনাকে সঙ্গ দিতে পারছি না!
পাশের ঘরে মিঃ রায়চৌধুরির স্টাডিতে টেলিফোন বাজল। তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি উঠে এসে বারান্দা লক্ষ করলুম। বারান্দার অনেকটা ভিজে গেছে। বৃষ্টি সমানে ঝরছে। মিঃ রায়চৌধুরির স্টাডি খোলা ছিল। উনি ভিতরে ঢুকে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। আমি জানি, এটা ওঁর প্রাইভেট টেলিফোন। ওঁর শুধু ক্রমাগত হাঁ বলে যাওয়া কানে এল। ভিতরে এসে ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলুম। জয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড যেটুকু জানা গেল, ওই শোচনীয় পরিণামের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই। কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা না বলে এক পাও এগোতে পারব না হয়তো।
অরিন্দম রায়চৌধুরি এসে বললেন, পলিটিকাল মেসেজ। আমাকে কাল মর্নিংয়ে সরডিহা ছুটতে হবে। কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রকের প্রতিনিধিরা আসছেন। আমাদের পার্টির কিছু বক্তব্য আছে। আপনি ক্লান্ত। এবার শুয়ে পড়ুন। আমিও শুয়ে পড়ব। ভোরে উঠতে হবে।
আপনি কি জিপ চালিয়ে যাবেন?
নাঃ। যা বৃষ্টি হচ্ছে, রিস্ক নেব না। আপনার যদি জিপ গাড়ির দরকার হয়, বলে যাব ফাগুলালকে। ড্রাইভারকে বসিয়ে রেখে মাইনে দিচ্ছি। কোনো অসুবিধা হবে না। গুডনাইট!
গুডনাইট!
মিঃ রায়চৌধুরি স্টাডির দরজায় তালা এঁটে চলে গেলেন। বারান্দার মাঝামাঝি একটা বাল্ব জ্বলছে। উঁকি মেরে দেখলুম, বৃষ্টি কমেছে। ঘড়ি দেখলুম। রাত সওয়া এগারোটা। এখনই শুয়ে পড়া দরকার। বৃষ্টিটা আমার কাজের প্রচণ্ড ক্ষতি করল। কিন্তু কী আর করা যাবে?
শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ মিসেস সুষমা রায়চৌধুরির কথাটা মনে পড়ে গেল, তাঁর মেয়ে অন্তরা জয়াকে গার্ড দিত। কথাটা বলার সময় তিনি নরহরি ঠাকুরকে দেখিয়ে তার স্বামীকে চোখের ইঙ্গিতে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। গার্ড দিত মানে পাহারা দিত, এই আক্ষরিক অর্থ ধরা ঠিক নয়। জয়াকে অন্তরা কারও সম্পর্কে সতর্ক করত এটাই বোঝায়। কাল সুযোগমতো সুষমাদেবীর। সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে…
ভোর ছটায় উঠে অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরুলুম। জঙ্গবাহাদুরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলুম, অরিন্দম রায়চৌধুরি মিনিট পাঁচেক আগে নিচের রাস্তায় বাসে চেপেছেন। বাঙালিটোলার সামনে এই পিচরাস্তায় বাস যাতায়াত করে দিনে বার চারেক। এ বাড়ির সামনে বাসস্টপ নেই। কিন্তু মিঃ রায়চৌধুরিকে হাত তুলতে দেখলে বাসড্রাইভার তাঁর সম্মানে বাস থামাবে এটা ধরে নেওয়া যায়।
ফাগুলাল নিমের ডাল দাঁতে ঘষছিল। আমাকে বেরোতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে এসে গেল। বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব?
একটু হেসে বললুম, না। আমি কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করে আসি।
গতকাল ভোরে আমি অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরোনোর সময় ফাগুলাল আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আগ্রহ দেখায়নি। আজ দেখানোর কারণ ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। বাঁদিকে ঘুরতে গিয়ে ডাইনে উত্তরে ঘুরে হাঁটতে থাকলুম। ফাগুলালের কি নিভৃতে কিছু বলার ছিল?
থাকলেও প্রাতঃভ্রমণে একা যাওয়াই আমার অভ্যাস। কিছুটা এগিয়ে বাইনোকুলারে ডমরুপাহাড়ের বাঁদিকের চুড়ায় সেই অশ্বথগাছটা দেখার জন্য দাঁড়ালুম। এখান থেকে একটা নগ্ন পাথরের টিলার ডানদিকে তাকালে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্ব। অশ্বত্থ গাছটা কুয়াশায় ঢাকা দেখে আবার হাঁটতে শুরু করলুম। প্রায় আধঘণ্টা আস্তেসুস্থে হেঁটে সেই পাহাড়ি চড়াইয়ের মাথায় বটগাছটার তলায় পৌঁছলুম। বেদির মতো পাথরটা ভিজে আছে রাতের বৃষ্টিতে। তবে এখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। পূর্বে বাঙালিটোলার পিছনে উঁচু পাহাড়ের মাথায় রক্তচ্ছটা। উপরে মেঘের পাতলা স্তরের রংও রক্তিম।
কিছু না ভেবেই বাঁদিকে পাহাড়ের পাথরে খাঁজে পা রেখে সাবধানে চলতে থাকলুম। খাঁজগুলোতে কোথাও কোথাও বৃষ্টির জল জমে আছে। কোনাকুনি একটার পর একটা ঝোঁপ পেরিয়ে চড়ার প্রায় সমতল অংশে পৌঁছে গেলুম। ঝোঁপজঙ্গলে বৃষ্টির জল এখনও শুকোয়নি। গেরুয়া মাটি কাদা হয়ে আছে। সেই গর্তটায় জল জমেছে এবং জলের রং স্বভাবত ঈষৎ লাল। পাশ দিয়ে এগিয়ে একটা ভেজা পাথরে বসলুম। এই পাথরটা তত ভেজা নয়। উপরে একটা বেঁটে গাছের চ্যাপটা বড়ো বড়ো পাতার আচ্ছাদন আছে। শ্বাসপ্রশ্বাস। স্বাভাবিক হওয়ার পর একটা চুরুট ধরালুম। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে চারদিকটা দেখে নিচ্ছিলুম। এতক্ষণে সূর্যের আলো মেঘের ভিতর থেকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে এল, যদিও নিচে কুয়াশা এবং ধূসরতা।
সেই অশ্বত্থগাছটা এখান থেকে আন্দাজ তিরিশ মিটার দূরে। বাইনোকুলারে গাছটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলুম, যদি নীল সারস দম্পতির দৈবাৎ দেখা পাই। কিন্তু গাছে কোনো পাখি নেই। অবশ্য সারাক্ষণ অন্যান্য পাখির ডাকাডাকি শুনছিলুম। তাদের দেখতে পাচ্ছিলুম না।
আবার কিছু না ভেবেই ঝোপজঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দক্ষিণে অশ্বত্থাগাছটার দিকে এগিয়ে গেলুম। তারপর উঁচিয়ে থাকা একটা পাথরের পাশে হাত দুয়েক লম্বা হাতখানেক চওড়া জায়গায় বসানো ঘাসে ঢাকা মাটির চাপড়া আলগা বসানো আছে। দেখে থমকে দাঁড়ালুম। এখানেও কিছু পোঁতা আছে। দ্রুত জাঙ্গল নাইফ বের করে চাপড়াগুলো সরাতে থাকলাম। গেরুয়া কাদা দুহাতে মেখে যাচ্ছিল। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাদার ভিতর হাতড়ে একটা প্যান্ট, তারপর একটা সার্ট বেরোল। সার্টের সঙ্গে জড়ানো ছিল একটা ছইঞ্চি ফলার ক্ষুরধার ছুরি। চার ইঞ্চিরও বেশি হাড়ের বাঁট। গর্তে থাকায় প্যান্ট-সার্ট ছুরিতে রক্তের গাঢ় ছোপ চোখে পড়ল। কিটব্যাগ থেকে একটা পলিথিনের খালি থলে বের করে ছাইরঙা প্যান্ট, নীলচে সার্ট আর ছুরিটা ঠেসে ভরে দিলুম। তারপর থলেটা কিটব্যাগের পিছনের খোপে ঢুকিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালুম, তখন আমি উত্তেজনায় অস্থির। খুনির রক্তমাথা পোশাক আর মার্ডার উইপন পেয়ে গেছি।
একটা পাথরে বসে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালাম। তারপর মনে হল, এটাই স্বাভাবিক ছিল। সম্ভবত আমার অবচেতনায় এটা আবিষ্কারের তাগিদ ছিল। আমি এই ব্যাপারটাকেই ইনটুইশন বলে জানি! খুন করার পর খুনি রক্তাক্ত মৃতদেহ টেনে এনে পুঁতেছে। তারপর প্যান্ট-শার্টে রক্ত নিয়ে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। সে ঝুঁকি নেয়নি। আন্ডারওয়্যার আর গেঞ্জি পরা অবস্থায় চলে গেছে। মার্ডার উইপনওঁ পুঁতে রেখে গেছে। এই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপের গুজব থাকায় মৃতদেহ আর তার পোশাক সমেত ছুরিটা চূড়ায় পুঁতে রাখলে কারও এগুলো আবিষ্কারের সম্ভাবনা তো ছিলই না। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কিংবা এই বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেলের নীল সারস সম্পর্কে তীব্র আগ্রহ তার জানার কথা নয়। তাই এটা আকস্মিকতা বহির্ভূত ঘটনা। নীল সারস দম্পতি এই অশ্বথচূড়ায় আসে, ফাগুলাল তার মনিবের সঙ্গগুণে পাখি সম্পর্কে স্বভাব-আগ্রহী, এ-ও খুনির জানার কথা নয়। কাজেই আমার দিক থেকে জয়ার মৃতদেহ এবং খুনির ছুরিসমেত জামা-প্যান্ট আবিষ্কার দুইয়ে-দুইয়ে চার হওয়ার পরিণাম মাত্র।
এতক্ষণে রোদ ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছুল, যদিও নিচে পূর্বে বাঙালিটোলায় এখনও ধূসরতা আর কুয়াশা। আমি চূড়ার পশ্চিম ঢালের দিকে দ্রুত সরে গিয়েছিলুম নিজেকে আড়াল করার জন্য। কারণ খুনিকে কৌতূহলই ডমরুপাহাড়ের দিকে টেনে আনতে পারে, যখন কিনা গতরাতে তার ভিকটিমের মৃতদেহ পুলিশ আবিষ্কার করেছে। সে নিজের ভুল খতিয়ে দেখতে চাইবে এবং কোন্ ভুল। তাকে ধরিয়ে দেবে, যতটা সম্ভব তা খুঁজে বের করতে চাইবেই।
আনন্দে আবিষ্কার করলুম, পশ্চিমের ঢালে নিচে নেমে যাওয়া খুবই সহজ। ছোটো-বড়ো পাথরের মধ্যে ঢালু ঘাসে ঢাকা জমি। তার নিচে তরঙ্গায়িত প্রান্তর। বাইনোকুলারে ডাইনে উত্তর-পশ্চিমে কোণে ধারিয়া নদী এবং কাঠের সাঁকো আবছা ধূসরতা ও কুয়াশার মধ্যে ধরা পড়ল। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অববাহিকার জলাভূমিও অস্পষ্টভাবে ভেসে উঠল। পশ্চিমের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে আশা করলুম সত্যি কোনো শঙ্খচূড় সাপের সামনে পড়ব না।
তরঙ্গায়িত মাঠের মাটি অনুর্বর, কঠিন এবং গেরুয়া। কদাচিৎ পলাশের উঁচু নিচু গাছ আর প্রকাণ্ড সব পাথর। সেই রাস্তায় উঠে ডাইনে পূর্বে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে রোদ এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বটগাছের তলায় বেদিতে বসে একটু বিশ্রাম নেব এবং চিন্তাভাবনাও করা যাবে। হঠাৎ ডাইনে একটা লাল ফুল ভরা ঝোপের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। একটা প্রকাণ্ড প্রজাপতি বসে আছে। প্রায় মিনিট তিনেক লক্ষ করে চিনতে পারলুম। স্তিখোথালমা কামদেব (Stichopthalma Camadeva) গোত্র এবং প্রজাতি আমাথুসাই দি (Amathusiidae)। দুধারের ডানার দুটো করে অংশ। ঊর্ধ্বাংশে ডানার কিনারায় বিচিত্র কারুকার্য। খুব সাবধানে পিঠে আঁটা কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতি ধরা জাল টেনে বের করে এগিয়ে গেলুম। দূরত্ব ফুট দশেক মাত্র। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি চওড়া ডানা। ছবির মতো নিস্পন্দ। কিন্তু পাঁচফুট এগিয়েছি, প্রজাপতিটা উড়ে গেল উঁচুতে। দুর্লভ প্রজাতি নয় এবং আমার সংগ্রহে আছে, এটাই সান্ত্বনা। ঘুরে রাস্তার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি, বটতলায় পাথরে আমার বয়েসি এক ভদ্রলোক বসে আছেন। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, হাতে ছড়ি। মাথায় এলোমেলো সাদা চুল এবং মুখে আমার মতোই সাদা গোঁফদাড়ি।
কাছে গেলে তিনি ছড়িসুদ্ধ, হাত কপালে ঠেকিয়ে আস্তে বললেন, আপনি কি সেই কর্নেলসায়েব?
নমস্কার করে বললুম, হ্যাঁ। আপনি—
আমার নাম অবিনাশ ভট্টাচার্য। হতভাগিনী জয়ার বাবা….
একটু বিস্মিত হয়েছিলুম। কারণ কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের কণ্ঠস্বর মৃদু ও ভরাট। কিন্তু কণ্ঠস্বরে কোনো কম্পন ছিল না। তাকে ধীরস্থির এবং অবিচলিত মনে হয়েছিল। আমি যখনই বললুম, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলার জন্য গতরাত থেকে আগ্রহী, তিনি বললেন, পুলিশ আমাকে আপনার কথা বলেনি। আমি অরু–অরিন্দম রায়চৌধুরির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। গিয়ে শুনি, অরু ভোরের বাসে সরডিহা চলে গেছে। ফিরে আসার সময় ফাগুলাল আমাকে পিছু ডাকল। তারপর সব ঘটনা বলল। তখন আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলুম। ফাগুলাল বলল, আপনাকে সে ডমরুপাহাড়ের দিকে যেতে দেখেছে। আপনি সেখানে আবার নাকি সারস পাখির ছবি তোলার চেষ্টা করবেন।
বললুম, আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?
হ্যাঁ। আমার ইচ্ছা ছিল, পাহাড়ে উঠে দেখি আপনি কোথায় আছেন। আপনি আমাকে সেই গর্তটা দেখিয়ে দেবেন, যেখানে জয়াকে পোঁতা হয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ে ওঠার ক্ষমতা আমার নেই। পা দুটো ভীষণ কাঁপছিল।
অবিনাশবাবু উঠে দাঁড়ালেন। বললুম, জয়ার ডেডবডি মর্গে কখন ডেলিভারি দেবে?
তিনি পা বাড়িয়ে বললেন, দশটার পরে। আটটা বেজে গেছে হয়তো। ঘড়ি আছে আপনার কাছে।
ঘড়ি দেখে বললুম, আটটা দশ।
আপনার হাতে জামায় কাদা কেন?
হাতের কাদা ধুতে সেই গর্তটার কাছে ফিরে যাওয়ার ধৈর্য ছিল না। ঘাসে এবং গাছের পাতায় ঘষে যথাসাধ্য মুছে ছিলুম। বললুম, পাহাড়ের পশ্চিমটলে ভেজা গেরিমাটি আঁকড়ে ধরে নামতে হয়েছে। ফিরে গিয়ে ধুয়ে নেব।
ডমরুপাহাড়ে নাকি শঙ্খচূড় থাকে। অবিনাশ ভট্টাচার্য আপনমনে বললেন। তারপর বললেন, জয়া পরশু বিকালে পাটনা যাচ্ছে বলে বেরিয়েছিল। পাটনায় একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল গতকাল। অথচ
তিনি চুপ করে গেলেন। উতরাইয়ের পাথরের উপর ছড়ির ডগা ঠেকিয়ে তিনি সাবধানে নামছিলেন। বললুম, আপনি জয়ার ইন্টারভিউ লেটার দেখেছিলেন?
আমাকে দেখায়নি। তাকে অবিশ্বাস কখনও করিনি। তাই দেখতে চাইনি।
একটা প্রশ্ন করতে চাই। সঠির উত্তর আশা করছি।
বলুন!
জয়াকে এমন পৈশাচিকভাবে–হ্যাঁ, পৈশাচিকভাবেই বলছি–
জানোয়ারের মতো বলুন কর্নেলসায়েব। মুসলমান কসাইরা ওইভাবে খাসি কাটে দেখেছি।
তা-ই। জয়াকে এভাবে কারও খুন করার কি কোনো কারণ খুঁজে পেয়েছেন?
না। জয়া আমার মেয়ে। কিন্তু সত্যিই আমি তার আড়ালের জীবন সম্পর্কে কিছু জানি না।
জয়ার তাহলে একটা আড়ালের জীবনমানে, মালাদা বা গোপন জীবন। ছিল বলে মনে করেন?
সেই জীবন তো সকলেরই থাকে। আপনার বা আমারও আছে।
ঠিক বলেছেন। তবু দৈবাৎ কোনো আভাস পেয়ে থাকলে বলুন।
ইদানীং ওকে বড্ড অন্যমনস্ক মনে হত। যেন কোনো সমস্যায় পড়েছে। অথবা করার মতো কিছু কাজ পাচ্ছে না বলেই মনমরা হয়ে থাকছে। একটা কথা আপনাকে বলা উচিত। জয়া খুব জেদি মেয়ে ছিল। স্পষ্টবাদিনীও ছিল। ফাদার হ্যাঁরিংটনের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে মিশনের আদিবাসী স্কুলের চাকরি ছেড়েছিল।
আপনি কি ওর বিয়ের জন্য চেষ্টা করেছিলেন?
নভেম্বর মাসে ওর বয়স চব্বিশ পূর্ণ হত। কাজেই বিয়ের চেষ্টা গতবছর থেকে করছিলুম।
শুনলুম, আপনি অরিন্দম রায়চৌধুরির ছেলের সঙ্গে–
অবিনাশবাবু আমার কথার উপর বললেন, হ্যাঁ। অরু রাজি ছিল। অরুর মেয়ে অন্তরার সঙ্গে জয়ার বন্ধুত্ব ছিল। সবসময় তো অন্তরার সঙ্গেই কাটাত। অন্তরাই আমাকে বলেছিল, তার দাদার সঙ্গে জয়ার বিয়ে হলে সে খুশি হবে। সেই সাহসেই অরুকে কথাটা বলেছিলুম। কিন্তু অরুর বউ বেঁকে বসেছিল। তার বউমা নাকি ঠিক করাই আছে।
আপনি কি অন্যত্র বিয়ের কথা তুলেছিলেন?
আমার আর্থিক অবস্থা তত ভালো নয়। কবিরাজিতে পসার করতে পারিনি। দুজায়গায় চেষ্টা করেছিলুম। পাত্রপক্ষের দাবি মেটানো আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
জয়ার কী মনোভাব ছিল এ ব্যাপারে?
সে আমাকে বকাবকি করত। একদিন বলেছিল, সে কারও বউ হওয়ার জন্য বেঁচে নেই। হা–এটা আপনাকে বলা উচিত। গত সপ্তাহে বাজারে বাচ্চু আমাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। ওর ট্রেডিং এজেন্সি আছে। অরু বলেছে নিশ্চয়?
হ্যাঁ। তারপর কী হল বলুন।
বাচ্চু ওর কেবিনে আমাকে খুব খাতিরে করে বসাল। চা খাওয়াল। তারপর একটা অদ্ভুত কথা বলল।
কী অদ্ভুত কথা?
রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন অবিনাশবাবু। মুখ উঁচু করে যেন কী ভাবলেন। তারপর বললেন, এখানে বেঙ্গল ক্লাব আছে জানেন কি? একশো বারো বছরের ক্লাব। এখন আর সেই উৎসাহ কারও নেই। থিয়েটার বা ফাংশন হয় না। শুধু দুর্গাপুজো কালীপুজো– কী যেন বলছিলুম?
বাচ্চু কী অদ্ভুত কথা বলেছিল আপনাকে।
হ্যাঁ। বেঙ্গল ক্লাবের লাইব্রেরি আছে। হাজার দশেক বই আছে। রেগুলার কেউ যায় না। দেখাশোনা করারও লোক নেই। বাচ্চু বলল, জয়াকে লাইব্রেরির দায়িত্ব দিতে চায় সে। বাচ্চু সেক্রেটারি বেঙ্গল ক্লাবের। এখন যুবকদের কমিটি মেম্বার করা হয়েছে। প্যাট্রন হিসাবে বুড়ো-বুড়িরা–কিন্তু কেউ যায় না। যুবক যুবতীরা কোথায় যায় জানি না। বুড়োবুড়িরা টিভি দেখে। কমবয়েসিরা ওদিকে একটা মাঠে ক্রিকেট খেলে।
আপনি জয়ার কথা বলুন।
হ্যাঁ। বাচ্চু বলল, হাতখরচের জন্য জয়াকে শপাঁচেক দিতে পারবে। আমি খুশি হয়েছিলুম। ফিরে এসে জয়াকে বললুম। জয়াও খুশি হল। আজ কী বার যেন?
শনিবার।
সোমবার জয়া বাচ্চুর কাছে ক্লাবের চাবি নিয়ে এসেছিল। সোম মঙ্গল বুধ তিনদিন বিকাল চারটে থেকে রাত নটা পর্যন্ত জয়া ক্লাবের লাইব্রেরিতে কাজ করেছে। বাড়ি-বাড়ি খবর দিয়ে এসেছিল জয়া। কেউ-কেউ গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে এসেছে।
জয়া আপনাকে বলেছিল?
হ্যাঁ। তবে জয়া এ-ও বলেছিল, ক্লাবে বেশি লোকজন গিয়ে হইচই না করলে খামোখা আলো জ্বেলে একলা বসে থাকার মানে হয় না। বৃহস্পতিবার জয়া বলল, পাটনায় তার চাকরির ইন্টারভিউ এসেছে। বিকালের বাসে না গেলে শুক্রবার সকাল দশটায় ইন্টারভিউ দেওয়া যাবে না। পাটনায় ওর মাসি থাকে।
ক্লাবের চাবি ফেরত দিতে যায়নি জয়া?
অবিনাশবাবু পা বাড়িয়েছিলেন। আবার থেমে আমার দিকে তাকালেন— চাবি?
হ্যাঁ। ক্লাবের চাবি।
আমি তো জানি না। জয়া কিছু বলেনি। ধরমপুর থেকে পাটনার বাসে তাকে আপনি চাপতে দেখেছিলেন?
না। কী করে দেখব? ধরমপুর বাসস্ট্যান্ডে বাস ছাড়ে। জয়া বলেছিল, চারটেতে ছাড়ে। ছঘণ্টার জার্নি! ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল তিনটেতে। আমার বাড়িতে ওয়ালক্লক আছে। লক্ষ করেছিলুম।
খয়েরি রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ পরে বেরিয়েছিল জয়া?
অবিনাশ হাঁটতে থাকলেন। বললেন, আপনি তো দেখেছেন। ওর হাতে একটা ব্যাগ ছিল। ব্যাগটা কোথায় ফেলল জানি না। পুলিশকে বলেছি। ব্রাউন রঙের ব্যাগ। আজকাল–হ্যাঁ, আপনার পিঠে আটকানো আছে, ওইরকম সাইজ। একই জিনিস।
তিনি এবার একটু তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করছিলেন। বললুম, আপাতত একটা শেষ প্রশ্ন।
বলুন।
জয়ার স্যুটকেস, বিছানা বা জিনিসপত্র কি আপনি সার্চ করেছেন?
না তো। কেন?
দরকার আছে। আমার অনুরোধ পুলিশ নিজে থেকে সার্চ করতে না এলে আপনি পুলিশকে সার্চ করার কথা বলবেন না। আপনি এখনই বাড়ি গিয়ে ক্লাবের চাবি খুঁজে পেলে লুকিয়ে রাখুন। তারপর
লুকিয়ে রাখব?
হ্যাঁ। ক্লাবের চাবি কেউ চাইতে এলে বললেন, জানি না। প্লিজ অবিনাশবাবু। আমাকে আপনি একটু সহযোগিতা করলে আপনার মেয়ের খুনিকে আমি ধরিয়ে দেব।
অবিনাশবাবু আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। আস্তে বললেন–আপনি ধরিয়ে দেবেন?
পকেট থেকে আমার একটা নেমকার্ড ওঁকে দিলুম। তারপর বললুম, আপনি মানুষের আড়ালের জীবনের কথা বলছিলেন। আমার সেই গোপন জীবনের পরিচয় এখানে শুধু জানেন মিঃ অরিন্দম রায়চৌধুরি।
কার্ডটা চশমার কাছাকাছি ধরে বিড়বিড় করে পড়লেন অবিনাশবাবু : কর্নেল নীলাদ্রি সরকার (রিটায়ার্ড)। নেচারোলজিস্ট।……
কার্ডটা আপনি আপাতত কাউকে দেখাবেন না। যদি আমি কোনো কারণে জয়ার খুনিকে ধরতে আপাতত ব্যর্থ হই, পরে আপনি কিছু টের পেলে কলকাতায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সেইজন্যই কার্ডটা আপনাকে দিলুম। আর একটা কথা।
বলুন কর্নেলসায়েব।
জয়ার জিনিসপত্র সার্চ করা দরকার। সেই কাজটা আমি বিকালে করব। আশা করি, ততক্ষণে আপনি আপনার মেয়ের মৃতদেহের সৎকার করে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
কার্ডটা পাঞ্জাবির ভিতর পকেটে ঢুকিয়ে ছড়িসুদ্ধ হাত তুলে নমস্কার করলেন অবিনাশ ভট্টাচার্য। তারপর চলে গেলেন। তিনি পিচরাস্তায় কিছুটা দক্ষিণে এগিয়ে পূর্বে ঘুরলেন। গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন….
একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি ঘুরে চড়াইয়ের পথে হাঁটতে থাকলুম। গতকাল দিনশেষে বাঁদিকে যেখানে শালগাছের জঙ্গলে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে যে দুটো সমান্তরাল লম্বা দাগ দেখেছিলুম, সেখানে গিয়ে দাগদুটো দেখতে হবে। মনে আছে, যেখান দিয়ে ফাগুলালের সঙ্গে এই জঙ্গল থেকে বেরিয়েছিলুম, সেখানে একটা প্রকাণ্ড পাথর ঘিরে লতাপাতা সবুজ প গড়ে তুলেছিল। কিছুক্ষণ আগে সেটা লক্ষ করে গেছি। তাই চিনতে অসুবিধা হল না। কিন্তু রাতের বৃষ্টিতে মাটিটা কাদা হয়ে গেছে। গেরুয়া মাটির উপর পচা শালপাতার কালো রং মিশে আছে। জুতো পুরোটাই কাদায় বসে যাওয়ার উপক্রম হল। তখন পিছিয়ে এলুম। এখন রোদ পড়েছে শালবনে। চকরাবকরা আলোছায়ার নকশা আঁকা হয়েছে। ফুট পনেরো দূরত্বে বাইনোকুলার দুটো লাল। জলের সরু নালা দেখিয়ে দিল। কাল দাগদুটো ফুট ছয়েক লম্বা আর ইঞ্চি চারেক চওড়া মনে হয়েছিল। যাইহোক, দাগদুটো জলে ভরে গেলেও নষ্ট হয়নি।
একটু সরে এসে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালুম। ওই দাগদুটোর সঙ্গে জয়ার মৃতদেহের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পেলুম না। এদিকে চুরুটের স্বাদ কটু লাগছে। কফির জন্য মন অস্থির। অগত্যা ফিরে চললুম।…..
জঙ্গবাহাদুর সেলাম দিয়ে সম্ভবত আমার দুহাতে, শার্টে এবং জুতোয় কাদা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ফাগুলাল তার ঘরে থেকে এগিয়ে এসে সেলাম দিল। বলল, ডমরুপাহাড়ে চড়েছিলেন স্যার?
হ্যাঁ। ফাগুলাল। এখানেই কোথাও কাদা ধুয়ে নিতে চাই।
আসুন স্যার। চৌবাচ্চায় জল ভরা আছে।
গ্যারেজের পাশে একটা চৌবাচ্চা থেকে মগে জল ঢেলে দিল ফাগুলাল। যথাসম্ভব কাদা পরিষ্কার করে ফেললুম। দোতলার বারান্দায় তুতুনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুষমা রায়চৌধুরি। হাসতে হাসতে বললেন, নীল সারসের পাল্লায় পড়ে ছোটাছুটি করেছেন মনে হচ্ছে? পারলেন ছবি তুলতে?
বললুম না। খুব চতুর ওরা। আমাকে কাদায় হামাগুড়ি দিতে হয়েছে। এখন কফি ছাড়া দুঃখ দূর হবে না।
সুষমা হাঁক দিলেন, নরুদা কর্নেলসায়েব ফিরেছেন। কফি করো।
ফাগুলাল দোতলায় আমার ঘর পর্যন্ত অনুসরণ করল। সাবধানে কিটব্যাগ খুলে টেবিলের নিচে দেয়াল ঘেঁষে রেখে দিলুম। টুপি বাইনোকুলার আর ক্যামেরা টেবিলে রেখে পোশাক বদলাতে বাথরুমে ঢুকলুম। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে দাড়িতে এবং টাকের নিচে তিনদিকে চিরুনি চালিয়ে বেরুলুম। ফাগুলাল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, জামা জুতো প্যান্ট ভিজে গেছে। আমাকে দিন রোদে শুকোতে দিই।
বললুম জুতো শুকোনোর মতো রোদ বারান্দায় আছে। তুমি প্যান্ট-শার্ট নিয়ে যাও।
ফাগুলাল প্যান্ট-শার্ট নিয়ে আস্তে বলল, আপনি যাওয়ার পর কবরেজমশাই এসেছিলেন। আমার সায়েব নেই শুনে চলে যাচ্ছিলেন। খুব কষ্ট হচ্ছিল দেখে। আমি কাল বিকালের সব কথা বললুম। আপনার কথা বললুম। আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললুম।
দেখা হয়েছে ওঁর সঙ্গে। ভেঙে পড়েননি। মনে হল, শক্ত মনের মানুষ।
হ্যাঁ স্যার। বাবর ওইরকম। আমাকে হাসপাতালে যেতে বলে গেলেন। পাড়ার ছেলেরাও যাবে বলেছে। কিন্তু মেমসায়েব আমাকে যেতে বারণ করলেন।
মেমসায়েব! এখনও তুমি বাচ্চুর মাকে মেমসায়েব বলো দেখছি।
আমার হাসির উত্তরে ফাগুলাল বলল, অভ্যাস স্যার!
বাচ্চুবাবু বাজারে চলে গেছে?
হ্যাঁ। সাড়ে আটটায় যায়। বাড়ি কখন ফেরে, কাল রাতে দেখলেন।
ফাগুলালের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, আসল কথাটা এখনও বলা হয়নি। তাই বললুম, তুমি কি কিছু জানতে পেরেছ ফাগুলাল?
না স্যার! তবে বলে সে বারান্দার দিকটা দেখে নিল। খুব চাপাস্বরে বলল, একটা কথা স্যার! দয়া করে যেন কাউকেও বলবেন না। জয়াদিদিকে ছোটোবেলা থেকে এবাড়ির মেয়ে বলে মনে করি। তাই সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।
কথাটা বলো! এখনই নরহরি ঠাকুর কফি নিয়ে এসে যাবেন।
গত পরশু থেকে কালীপদ মালির খন্তা হারিয়ে গিয়েছিল। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করছিল। আজ সকালে খন্তা পাওয়া গেল উত্তর-পুব পাঁচিলের কাছে করবীগাছের তলায়।
খন্তা কী? কোদাল?
না স্যার। দুফুট লম্বা কাঠের হাতলের ডগায় চ্যাপটা লোহার পাত আঁটা। ওই দিয়ে মালি মাটি খোঁড়ে।
তুমি কি খন্তাটা দেখেছ? গেরিমাটি লেগে ছিল কি?
না। বৃষ্টিতে খন্তা ধুয়ে গেছে।
ফাগুলাল। মালির ভুল হয়নি তো?
কালীপদ বলছে, তারই ভুল। মনে ছিল না।
কিন্তু তুমি–
নরহরি ঠাকুরকে ট্রে হাতে আসতে দেখে ফাগুলাল কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম ঠুকে চলে গেল। ওর মুখে যে ছাপ দেখলুম, তা কবির ভাষায় বিপন্ন বিস্ময়। মনে মনে আশা করলুম, মালির ভুলই যেন সত্যি হয়।
বারান্দায় বসলুম। পাশের নিচু টেবিলে ট্রে রেখে নরহরি নমস্কার করে বললেন, এবেলা কতদূর ঘুরলেন কর্নেলসায়েব?
ডমরুপাহাড়ে চড়েছিলুম।
নরহরি ঠাকুর চমকে উঠে বললেন, আবার ওই অলক্ষুণে পাহাড়ে? স্যার! বাবা মহাদেবের হাতের ডমরু পড়ে পাথর হয়ে গেছে। সর্বনেশে জায়গা! শঙ্খচূড়ের বংশ ওখানে বাস করে। দেখবেন, কবরেজ মশাইয়ের মেয়েকে মেরে যে ওখানে পুঁতেছিল, শঙ্খচূড়ের দংশনে তার প্রাণ যাবে। আজ হোক কাল হোক– তার নিস্তার নেই।
বলে সরল বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ মানুষটি চলে গেলেন। কফিতে চুমুক দিলুম। ক্রমে নার্ভ চাঙ্গা হতে থাকল। কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে পলিথিন প্যাকে ভরা খুনির প্যান্ট-শার্ট সম্পর্কে ভাবতে থাকলুম। একটু পরে নিজের আচরণের প্রতি নিজেরই বিস্ময় লাগল। প্যান্ট-শার্টে গেরুয়া জলকাদা মেখে ছিল বলেই কি পকেটগুলো খুঁজে দেখার কথা মাথায় আসেনি?
তখনই উঠে কিটব্যাগের পিছনের খোপ থেকে পলিথিন প্যাকটা সাবধানে বের করে বাথরুমে ঢুকে গেলুম। দরজা এঁটে আলো জ্বেলে দিলুম। তারপর প্যান্ট আর শার্ট মেঝেয় রেখে পলিথিন প্যাকটা ট্যাপে ঝুলিয়ে রাখলুম। প্রথমে শার্টের বুকপকেটে হাত ভরে মনে হল, একটা ভাঁজ করা কাগজ আছে। ভিজে ভাঁজ সেঁটে যাওয়া কাগজটা কমোডের পিছনে ফ্ল্যাশের উপর রেখে দিলুম। ওটা শুকোনো দরকার। এবার পান্টের পাঁ পকেটে রুমাল বের করতে গিয়ে শক্ত কিছু আঙুলে ঠেকল। জিনিসটা বের করে দেখি রিং-এ ঝোলানো চারটে ছোটোবড়ো চাবি। মাথার ভিতরে যেন বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। বেঙ্গল ক্লাবঘরের চাবি কি? ডান পকেটে চেপ্টে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেটে আর একটা লাইটার ছিল। ফিলটার টিল্ড তিনটে সিগারেট দলা পাকিয়ে গেছে। এবার ছুরিটার বাঁটের খাঁজে খাঁজে জমে থাকা রক্তের চিহ্ন দেখে নিয়ে রুমাল, সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার আগের মতো ঢুকিয়ে শুধু চাবির গোছা ট্যাপের জলে ধুয়ে আমার রুমালে মুছে আমারই পাঞ্জাবির পকেটে রাখলুম। আগের মতো পলিথিনের প্যাকে প্যান্ট-শার্ট-ছুরি ভরে মেঝেটা ট্যাপের জলে ভালো করে ধুয়ে দিলুম। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে পলিপ্যাকটা আগের মতো কিটব্যাগের পিছনে ঢুকিয়ে রাখলুম। ভাজকরা চিঠিটা আপাতত ফ্ল্যাশের উপর থাকল। পরে দেখা যাবে। বাথরুমের দরজা সবে বন্ধ করেছি, ফাগুলাল দরজার সামনে এসে বলল, নিচের ঘরে আপনার ফোন এসেছে স্যার! থানার ফোন।….
আমার ঘরের জন্য অরিন্দম রায়চৌধুরি তালা-চাবি দিয়েছিলেন। দরজায় তালা এঁটে ফাগুলালের সঙ্গে নিচের হলঘরে গেলুম। সেকেলে আসবাবে সাজানো ঘরটা দেখেই বোঝা যায় শিকারির ঘর। দেয়ালে স্টাফ করে হরিণের মাথা অনেকগুলি। ইতস্তত স্টাফ করা চিতাবাঘ, বাঘ, একটা বুনো। কুকুরও।
রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই কেউ ইংরেজিতে বলল, ধরমপুর পুলিশ স্টেশন। আমি কি কর্নেল সরকারের সঙ্গে কথা বলছি?
–হ্যাঁ। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কে বলছেন?
–ওসি এস এন সিংহ!
–বলুন মিঃ সিংহ।
–মর্গের রিপোর্ট সম্পর্কে আপনি জানতে চেয়েছিলেন। খুন করার আগে মেয়েটাকে খুনি ধর্ষণ করেছিল। মৃতদেহের রাইগর মর্টিস শুরু হওয়ার আগে পুঁতে ফেলা হয়েছিল।
–খুনের সময় কি ডাক্তার অনুমান করেছেন?
–হ্যাঁ। আমার মর্গে লাশ জমা দেওয়ার অন্তত আটাশ ঘণ্টা আগে খুন হয়েছিল।
তা হলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছটা নাগাদ মেয়েটাকে খুন করা হয়েছে।
–হিসাব সেটাই দাঁড়াচ্ছে। তবে কি জানেন কর্নেল সরকার? অনেক কেসে আমি দেখেছি ডাক্তারের হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত সময়ের হিসাব মিলছে না। তাছাড়া ধরমপুর হাসপাতালের মর্গে আধুনিক কোনো পরীক্ষাব্যবস্থা নেই।
আপনি ঠিকই বলেছেন। বডির অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছিল। রাইগার মর্টিস বডি পুঁতে ফেলার আগেই শেষ হয়েছিল। কারণ বডি দুমড়ে ভেঙে–সম্ভবত কোদালের আঘাতে
কর্নেল সরকার। আপনার সঙ্গে আমি একমত। যাইহোক, আপনার জন্য একটা খবর আছে। পুলিশ সুপার মিঃ এ আর শর্মাকে মিঃ রায়চৌধুরি আপনার কথা জানিয়েছেন। সরডিহায় মিঃ শর্মা গেছেন। সরকারি বৈঠকে ভি. আই. পিরা আসবেন। মিঃ শৰ্মা আমাকে আপনার প্রকৃত পরিচয় দিয়েছেন। আমি আপনার সঙ্গে শিগগির দেখা করতে যাচ্ছি।
–আসুন, খুশি হব।
–মিঃ শর্মা আগামীকাল দুপুরে এখানে আসছেন। তিনি আপনাকে এই কথাটা জানাতে বলেছেন।
–সুসংবাদ। তো তদন্ত কতদূর এগোল বলুন মিঃ সিংহ!
–এই কেসের আই ও মিঃ দুবে। তিনি এখন বাইরে। ইতিমধ্যে আমি সি. আই. ডি ইন্সপেক্টার মিঃ রঘুবীর প্রসাদকে অনুরোধ করেছি। আর আপনি তো আছেন।
মনে হল শ্যামসুন্দর সিংহের শেষ কথাটায় প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ আছে। হাসতে হাসতে বললুম, আমি নিছক প্রকৃতিপ্রেমিক মিঃ সিংহ। প্রকৃতির রহস্যের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝে অপরাধ রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। আমি এখনও অ্যামেচার এ বিষয়ে।
–আমি আধঘণ্টার মধ্যে যাচ্ছি। নমস্তে!…
রিসিভার রেখে ফাগুলালকে বললুম, শিগগির আমার ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করো ফাগুলাল। বেরুব। ওসি সায়েব আসার আগেই আমি বেরুতে চাই। উনি এলে বলবে, খেয়ালি মানুষ। নীল সারস বাইনোকুলারে দেখেই পাগলের মতো বেরিয়ে গেছেন। উনি ফিরলে থানায় যেতে বলব।
ফাগুলাল অবাক হয়ে শুনছিল। সে কিচেনের দিকে চলে গেল। আমি দোতলায় আমার ঘরের দিকে চললুম। বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করলুম, পূর্বের ফুলবাগান এবং মন্দিরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মিসেস সুষমা রায়চৌধুরি তাঁর বউমার সঙ্গে চাপা গলায় কিছু আলোচনা করছেন। মন্দিরের বাঁদিকে খিড়কির দরজা। দরজার বাইরে একটা পুকুর আছে। আমাকে শিগগির ওই পথে নীল সারস দম্পতির অছিলায় বেরুতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমার উদ্দেশ্য ছিল ভাঁজকরা ভিজে কাগজটা যত শিগগির সম্ভব রোদে শুকিয়ে নিয়ে পাঠোদ্ধার। আকাশে শরৎকালের খণ্ডমেঘ মাঝে মাঝে রোদ আড়াল করছিল। একটা করে ভাজ শুকিয়ে খুলতে কয়েকঘণ্টা সময় লাগতে পারে। আমার তর সইছিল না। ওসি মিঃ সিংহ যে আমাকে তোয়াজের প্রলেপে ঢাকতে এবং নিজের কৃতিত্বের তালিকা শোনাতে আসছেন, এ বিষয়ে আমি নিঃসংশয়। এ আর শর্মা আমার বিশেষ পরিচিত এবং স্নেহভাজন। কাজেই তিনি আমার সম্পর্কে রং চড়িয়ে মিঃ সিংহকে আমার মর্যাদা রক্ষার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটা তার পক্ষে স্বাভাবিক। এই অবস্থায় শ্যামসুন্দর সিংহের বাগাড়ম্বর শুনে অমূল্য সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
কুড়ি মিনিটের মধ্যে খাওয়া সেরে এবং যথারীতি কফি পান করে সেজেগুজে নিচে গেলুম। ততক্ষণে শাশুড়ি-বউমা মন্দির থেকে ফিরে এসেছেন। ফাগুলাল আমাকে খিড়কির দরজা খুলে দিয়ে বলল, আপনার জুতোয় খুব শব্দ হচ্ছে। জুতো শুকোয়নি স্যার।
বললুম, ওই পুবের পাহাড়টার কী নাম যেন?
চণ্ডীপাহাড়।
ওখানে শুকিয়ে নেব। ওসি সায়েবকে বলবে আমি চণ্ডীপাহাড়ের দিকে পাগলের মতো ছুটে গেছি। তুমি বুদ্ধিমান ফাগুলাল আমার পাগলামির কথা হাসিমুখে যা ইচ্ছা শুনিয়ে দেবে।
ফাগুলাল হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু ওর গাম্ভীর্য কাল বিকাল থেকে একটুও চিড় খাচ্ছে না কেন? মালির খন্তা সম্পর্কে ওর সন্দেহ যা নির্দেশ করছে, তা সত্য না হলেই খুশি হব। তবে এ-ও ঠিক, কালীপদর ভুললামনের কিছু মজার কাহিনী আমাকে সুষমা দেবী শুনিয়েছেন।
পুকুড়পাড়ে আম-লিচুর বাগান। কয়েকটা তেজি এবং জমকালো চেহারার সফেদাগাছও দেখলুম। একপাড়ে সবজিখেত। আগাছার জঙ্গলও কম নেই। ওর ওধারে রুক্ষ মাটির পর চণ্ডীপাহাড় খাড়া পাঁচিলের মতো উঠে চুড়ার দিকে ঢালু হয়েছে। আমি পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে একটা পাথরের আড়ালে বসলুম। জুতোর ভিতরটা ভিজে থাকায় অন্য একজোড়া মোজা পরেছিলুম, তাও ভিজে গেছে। জুতো-মোজা খুলে রোদে শুকোতে দিলুম। তারপর বুকপকেট থেকে সেই ভাঁজকরা কাগজটা একটা পাথরের উপর রাখলুম। রোদ এখন উজ্জ্বল এবং তীব্র।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রোদের উত্তাপ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটু তফাতে একটা পলাশ গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলুম। তারপর বাইনোকুলারে পশ্চিমে বাঙালিটোলা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলুম। গাছপালার ফাঁকে পুরোনো আমলের বাড়িগুলি দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে জনহীন। বাইনোকুলার রেখে চুরুট টানতে মন দিলুম।
মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে কাগজটা দেখছিলুম। খালি পায়ে হাঁটা–বিশেষ করে কঠিন ও কঁকুরে মাটিতে কষ্টদায়ক। সামরিক জীবনের কথা মনে পড়ছিল। এমন মাটিতে খালি পায়ে হাঁটা এবং দৌড়ানো তখন আমার পক্ষে চ্যালেঞ্জ হিসাবে খুবই সুখপ্রদ ছিল।
প্রায় একঘণ্টা পরে জুতো-মোজা শুকিয়ে গেল। চিঠির প্রথম ভাঁজ, তারপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাঁজ খুলতে অসুবিধা হল না। চতুর্থ ভাঁজ খুললেই পুরোটা খোলা যাবে। কিন্তু লেখাগুলো ধেবড়ে গেছে। পাঠোদ্ধার হয়তো খুব কঠিন। হবে।
আরও আধঘণ্টা বাইনোকুলারে চারদিক খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কেটে গেল। উঠে গিয়ে চতুর্থ ভাজটা সাবধানে খুলে ফেললুম। খোলা জায়গায় বাতাস বইছে উত্তাল। ভাঁজগুলো ছিঁড়ে কোনোক্রমে আটকে আছে। ডটপেনের লেখা বাংলা হরফগুলো হিজিবিজি নকশার মতো দেখাচ্ছে। চিঠিটা বাতাসে টুকরো করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ভেবে পেটের কাছে রেখে আতসকাঁচ বের করলুম। কিন্তু পাঠোদ্ধার সত্যি কঠিন। আতসকাঁচ আর বাইনোকুলার চিঠিটার উপর চাপিয়ে রেখে কিটব্যাগে হাত ভরলুম। আমি এই ব্যাগটাকে কিটব্যাগ বলি বটে, কিন্তু এর মধ্যে সূঁচ-সুতো থেকে সব দরকারি জিনিস ঠাসা থাকে। আমার প্যাডটা বের করার পর আঠার টিউব বের করলুম। প্যাডের একটা পাতা ছিঁড়ে আঠা মাখিয়ে চিঠিটা সাবধানে সেঁটে দিলুম। এবার নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে আঠা শুকিয়ে চিঠির চারটে টুকরো সেঁটে গেল প্যাডের কাগজে। আবার আতসকাঁচের সাহায্য নিলুম। কিন্তু গেরুয়া ছোপে কালির রং ফিকে হয়ে মিশে গিয়ে চিঠিটা যেন সিন্ধুসভ্যতার লিপি হয়ে উঠেছে। আমি লাইন মেলানোর চেষ্টা ছেড়ে এলোমেলোভাবে হরফ উদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকলুম। অনেক চেষ্টার পর একটা হরফ চেনা গেল। সেটা ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটার বি। এই হরফটার ছাপ উপর এবং নিচের লাইনে ছাপ ফেলেছে। এ থেকে কি Bengal Club ধরে নেওয়া ঠিক হবে?
চিঠির কাগজটার আয়তন পাঁচ ইঞ্চি বাই ছইঞ্চি। তার মানে একটা স্লিপ। এই আয়তনের প্যাড সর্বত্র পাওয়া যায়। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা এগুলো ব্যবহাব করেন ফর্দ লেখার জন্য। সম্বোধনের শব্দটা কি জয়া? মনে হল জয়াই হবে। কিন্তু মনে হলে তো চলবে না।
আরও একটা চুরুট পুড়ে শেষ হয়ে গেল। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেল। কিন্তু মাথায় জেদ চেপেছে। আমার সেই ইনটুইশন বলছে, জয়া কারও চিঠি পেয়ে বেঙ্গল ক্লাবে গিয়েছিল। অথচ চিঠিতে শুধু ইংরেজি বি হরফ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কি ঠিক হবে?
সেই মুহূর্তে হঠাৎ মাথায় প্রশ্নটা এসে গেল। চাবির গোছা যদি সত্যি বেঙ্গল ক্লাবের হয়, তাহলে তো চিঠিটা ঠিকই আমি পড়তে পারছি। কেউ জয়াকে কোনো কারণ দেখিয়ে বেঙ্গল ক্লাবে ডেকেছিল।
চাবির গোছার সঙ্গে চিঠিটাকে মিলিয়ে নেওয়া যায়, যদি সত্যিই চাবিগুলো বেঙ্গল ক্লাবের হয়। চিঠিটা খুনি জীবিত বা মৃত জয়ার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে নিজের শার্টের পকেটে রেখেছিল। ছিঁড়ে ফেলতে ভুলে গিয়েছিল।
প্যাডের কাগজে আঁটা শুকনো চিঠিটা ভাঁজ করে বুকপকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালুম। ঘড়ি দেখলুম, সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। নাক বরাবর পশ্চিমে বাঙালিটোলার দিকে হেঁটে চললুম। মাঝেমাঝে বাইনোকুলারে দেখে নিচ্ছিলুম কেউ কোথাও আমাকে লক্ষ করছে কি না।
বেঙ্গল ক্লাবে পাঁচবছর আগে এক সন্ধ্যায় অরিন্দম রায়চৌধুরি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাঙালিটোলার মাঝামাঝি একটা একতলা বাড়ি। পিছন দিকে ব্যায়ামাগার দেখেছিলুম। ব্যায়ামাগারের উত্তরে একটা ঘরে থিয়েটারের স্টেজ এবং গোটানো দৃশ্যপট ছিল। পিছন দিক থেকে দেখলে এল প্যাটার্ন পাড়ি। পাশাপাশি দুটো পশ্চিমমুখী ঘর। পিছনে বারান্দা ছিল। একটা ঘর লাইব্রেরি। অন্য ঘরে মেঝেয় কার্পেট পেতে অনুষ্ঠান হত। ওই ঘরটা বেশ বড়ো।
একটু পরে মনে পড়ল, বাঙালিটোলার সামনে পিচরাস্তা থেকে একটা গলিপথে হেঁটে গিয়েছিলুম। দুধারে বাড়ির উঁচু পাঁচিল। তারপর একটুকরো খোলা জমির সামনে বেঙ্গল ক্লাব। ওই খোলা জমিতে থিয়েটারের স্টেজ গড়া হত।
একটা আমবাগানের ভিতরে ঢুকে মনে পড়ল, বেঙ্গল ক্লাব-এর উত্তরে এবং গলিপথটা বেরিয়ে এসে চলে গেছে পূর্বের মাঠের শেষে একটা আদিবাসী বস্তিতে। কিন্তু সেই সংকীর্ণ মেঠো রাস্তায় কেউ এদিকে আসছে না।
গলিপথে গিয়ে বেঙ্গল ক্লাবের পিছনে ব্যায়ামাগারে ঢুকলুম। জায়গাটায় ঘাস আর আগাছার মধ্যে মুগুর, ডাম্বেল, বার এইসব জিনিস অবহেলায় পড়ে আছে। পশ্চিমের ঘরদুটো ভিতর থেকে আটকানো আছে। ব্যায়ামাগারের উত্তরে ঘরটার বারান্দার একপাশে ভাঙা চেয়ারের স্তূপ। তার তলায় অনেকগুলো লম্বা ও বেঁটে বাঁশ। বাঁশগুলোতে আলকাতরা মাখানো হয়েছিল। জায়গায়-জায়গায়। কালো রং উঠে গেছে। নারকেল ছোবড়ার দড়ি কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে ভাঙা চেয়ারের স্থূপে।
ব্যায়ামাগারের উত্তরের ঘরটা তালাবন্ধ। দরজার সামনেটা কঁকা। বারান্দার ডানদিকে ছেঁড়া তেরপলের তলায় আরও অনেকগুলো বেঁটে বাঁশ কাত হয়ে পড়ে আছে। কিছু না ভেবেই আমি তেরপলের একটা কোণ ধরে টেনে সরিয়ে। দিলুম। এমন জায়গায় বিষধর সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই জুতোর ডগা দিয়ে বাঁশগুলোকে নাড়িয়ে দিলুম। কিন্তু কোনো সাপই ফণা তুলে ফোঁস করল না।
বাঁশগুলো আলকাতরা মাখানো। কিন্তু কালো রং ফিকে হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রং মুছে গিয়ে ঘূণ ধরেছে। ফুট ছয়েক লম্বা এই মোটা বাঁশগুলো সম্ভবত স্টেজের পাটাতন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হত। তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেয়াল ঘেঁষে রাখা দুটো মোটা বাঁশের একটু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল। জায়গায় জায়গায় রাঙামাটি মেখে আছে। মাথার ভিতরে যেন বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল।
বাঁশদুটো দুহাতে তুলতেই তলায় কয়েক গোছা নারকেল ছোবড়ার দড়ি দেখতে পেলুম। দড়িগুলো ভেজা এবং কাদার ছোপ লেগে আছে।
অমনি মনে পড়ে গেল ডমরুপাহাড়ের নিচে শালবনের মধ্যে দুটো লম্বা দাগের কথা। একটু ভুল করে ফেলেছি। দরজার সামনে বারান্দার ভোলা অংশটুকু লক্ষ করিনি। আমার জুতোর ছাপে পুরোটা ঢাকা পড়েছে। এবার প্যান্টের পকেট থেকে খুনির প্যান্টের পকেটে পাওয়া চাবির গোছা বের করলুম। তারপর দেখে এলুম গলিপথে কেউ আসছে কি না। তারপর আন্দাজ করে একটা চাবি ঢোকাতেই তালাটা খুলে গেল। দরজা খোলার পর টর্চ জ্বেলে কয়েকমুহূর্তে কিছু বুঝতে পারলুম না, আলো কীসের উপর পড়েছে। ডানদিকে একটা ছোটো স্যুইচ বোর্ড দেখামাত্র টিপলুম। আলো জ্বলে উঠল। থিয়েটারের স্টেজের তিনটে অংশ, আর কয়েকটা উইংস দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে। মেঝেয় সিন বা ড্রপসিন কেউ যেন বিছিয়ে রেখেছে। দরজা ভিতর থেকে ভিজিয়ে দিয়ে সিন, ড্রপসিন, তারপর কালো জীর্ণ স্ক্রিন তুলেই স্থির হয়ে দাঁড়ালুম।
মেঝেতে চাপ-চাপ জমাট রক্ত। স্ক্রিনেও রক্ত মেখে গেছে। আততায়ী নিশ্চিত ছিল, এই ঘর কেউ আর খুলবে না।
আলো নিভিয়ে দরজা একটু ফাঁক করে দেখে নিলুম গলিরাস্তা দিয়ে কিংবা উলটোদিক থেকে কেউ আসছে কি না। নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে তালা এঁটে চলে এলুম।
গলিরাস্তায় এসে বাইনোকুলারে পাখি দেখার ভান করতে করতে পিচরাস্তায় পৌঁছেলুম। রাস্তার ধারে ঘাসজমিতে একটা আদিবাসী ছেলে কয়েকটা গোরু চরাচ্ছিল। সে অবাক হয়ে আমাকে দেখতে থাকল। নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলুম। একটা কাজের মতো কাজ করতে পেরেছি বলে নয়, চিঠিতে লেখা ইংরেজি বি হরফ এবং চাবির গোছা আমাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছে। বলে।
দুটো বাঁশে জয়ার মৃতদেহ লম্বালম্বি বেঁধে গলিরাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল খুনি। রাতের বৃষ্টি দুটো বাঁশের রেখা ধুয়ে ফেলেছে। এখানেই পাহাড়ে ওঠার চড়াইরাস্তা শুরু হয়েছে। খুনি কষ্টসাধ্য কাজ না করে বাঁদিকে শালবনে ঢুকেছে। তারপর মৃতদেহ বয়ে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের নিচে বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর দুই পা ধরে টানতে টানতে চূড়ায় উঠেছে। তার গায়ের জোর আছে।
তার একটা খন্তা বা কোদাল দরকার ছিল। কিন্তু খন্তাসহ মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে কি আগেই মৃতদেহ পুঁতে ফেলার জায়গা ঠিক করে গর্ত খুঁড়ে রেখে এসেছিল?
আমার অঙ্ককষা হল না। ফাগুলালকে আসতে দেখলুম। সে সেলাম ঠুকে বলল, ওসিসায়েব এসে খাপ্পা হয়ে গেছেন।
বললুম, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
বাচ্চুবাবু ফোন করেছিলেন। কবরেজমশাইয়ের মেয়েকে শ্মশানে নিয়ে গেছে। বাচ্চুবাবুর যাওয়া হবে না। একটা কাজে আটকে পড়েছেন। আমাদের বাড়ির পক্ষ থেকে শ্মশানে একজনের থাকা দরকার। সায়েব থাকলে তিনিই যেতেন। মেমসায়েব আমাকে যেতে বললেন। তাই যাচ্ছি।
হ্যাঁ। যাও।
আপনি–বলে ফাগুলাল থেমে গেল। তারপর বলল, না, আপনি অতদূর কষ্ট করে কেন যাবেন? আপনার খাওয়ার টাইম হয়ে গেছে।
বলে সে চলে গেল। আমি সত্যিই তো, আমি গিয়ে কী করব? তাছাড়া আমার সামনে এখন বড়ো কাজ। একটু চিন্তাভাবনাও করা দরকার।…
দোতলার বারান্দায় মিসেস সুষমা রায়চৌধুরি আমাকে একটু বকে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, কী আশ্চর্য মানুষ আপনি। এই রোদ মাথায় করে চণ্ডীপাহাড়ে না উঠলেই চলত না? নীল সারসের পাল্লায় পড়ে আপনার সত্যি মাথার ঠিক নেই। আপনি চণ্ডীপাহাড়ে গেছেন শুনেই আমি মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে। এলুম। সিজন চেঞ্জের সময় এখন। তাছাড়া এই পাহাড়টার দুর্নাম আছে।
একটু হেসে বললুম, আপনার মতো শুভাকাঙ্ক্ষী থাকতে আমার কোনো অমঙ্গল হবে না।
ইস! আপনার সায়েবি রং পুড়ে কী হয়েছে আয়নায় দেখুন গে!
কলকাতা ফিরলেই সায়েবি রং ফিরে পাব মিসেস রায়চৌধুরি।
সুষমা রায়চৌধুরি আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চাপাস্বরে বললেন, আমার কেন যেন বড্ড ভয় হচ্ছে, কবরেজ বাচ্চুকে না ফাসায়।
বাচ্চুকে? কেন?
বাচ্চু জয়াকে বেঙ্গল ক্লাব আর লাইব্রেরি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিল। তা ছাড়া
উনি থেমে গেলে বললুম, তা ছাড়া?
বাচ্চুর সঙ্গে জয়ার একসময় একটু ইমোশনাল সম্পর্ক হয়েছিল। শিগগিরি বাচ্চুর বিয়ে দিয়েছিলুম। পরে বাচ্চু অবশ্য ওর প্রতি সিমপ্যাথিবশত সাহায্য করতে চেয়েছে। কিন্তু জয়া বাচ্চুকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। অন্তরা আমাকে একটু আভাস দিয়েছিল।
তালা খুলে ঘরে ঢুকে বললুম, আচ্ছা মিসেস রায়চৌধুরি, জয়াকে কারও খুন করার কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
সুষমা চাপাস্বরে বললেন, কেন? কোনো চেনা লোক তাকে রেপ করে খুন করেছে।…
.
ডাইনিং রুমে খাওয়ার টেবিলে বসে আবার কথাটা মিসেস সুষমা রায়চৌধুরির কাছে টেনে আনলুম। বললুম, আজকাল খুনোখুনির সঙ্গে নারীধর্ষণও সর্বত্র বেড়ে গেছে। কাজেই আপনার যুক্তি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার সঙ্গে আজ সকালে জয়ার বাবার দেখা হয়েছে।
সুষমা যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, আপনি কি কবরেজবাড়ি গিয়েছিলেন?
না পথে দেখা হয়েছিল। আমি যে তাঁর মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছি, উনি পুলিশসূত্রে জেনেছেন।
কী বললেন, উনি?
বললেন, জয়া পাটনায় চাকরির ইনটারভিউ দিতে বৃহস্পতিবার বেলা তিনটে নাগাদ বেরিয়েছিল। ধরমপুর বাসস্ট্যান্ডে চারটেতে পাটনার বাস ছাড়ে। রাত দশটায় পৌঁছায়। পাটনায় মাসির বাড়িতে রাত কাটিয়ে শুক্রবার জয়ার সকাল দশটায় ইনটারভিউ দেওয়ার কথা ছিল। এদিকে শুক্রবার বিকালে আমি ফাগুলালের সঙ্গে নীল সারসের ছবি তুলতে গিয়ে জয়ার লাশ উদ্ধার করেছি। ডাক্তারের মতে, জয়াকে খুন করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছটা নাগাদ। কিন্তু সময়টা বিকাল চারটে নাগাদ বলে আমার অনুমান।
সুষমা রায়চৌধুরি একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, জয়া তাহলে তার বাবাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। কবরেজমশাই কি আপনাকে বলেছেন পাটনায় কীসের ইনটারভিউ দিতে যাচ্ছিল জয়া? কোন্ অফিসে?
অবিনাশবাবু তা জানেন না। জয়া তাকে খুলে কিছু বলেনি।
সুষমা বাঁকা মুখে নিঃশব্দে হাসলেন। বললেন, জয়া খুব জটিল চরিত্রের মেয়ে ছিল। অন্তরার মতো ভোলা মনের ছিল না। আপনি জানেন কি, কবরেজমশাই বাচ্চুর সঙ্গে জয়ার বিয়ের প্রস্তাব তুলেছিলেন? আমার হাজব্যান্ড রাজি ছিলেন। আমি রাজি হইনি। বাচ্চু জয়াকে ট্যাকল করতে পারত না। আমিও পারতুম না।
কথাটা বলেই সুষমা রায়চৌধুরি হঠাৎ বেরিয়ে গেলেন। ঘুরে দেখলুম, দক্ষিণে পাঁচিলের কাছে একটা গাইগোরু গন্ধরাজ ফুলগাছের পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে। মালিবউ সুষমার ডাকে ছুটে গিয়ে গোরুর দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। গোরুটা কোথাও বাঁধা ছিল। দড়ি ছিঁড়ে চলে এসেছে। সুষমা বকাবকি করতে করতে মালিবউকে অনুসরণ করে মন্দিরের দিকে অদৃশ্য হলেন।
খাওয়ার পর হলঘরের ভিতর দিয়ে দোতলায় উঠলাম। পূর্বপ্রান্তে আমার ঘরের সামনে বারান্দা থেকে দেখলুম, খিড়কির দরজা খোলা এবং সেইপথে মালিবউ গোরুটাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুষমা খাপ্পা হয়ে বলছেন, দরজা কে খুলে রেখেছিল?
মালি কালীপদ পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল। সে ভেজা শরীরে দরজায় এসে কৈফিয়ত দিতে থাকল। আমি তালা খুলে ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে ইজিচেয়ারে বসলুম। চুরুট জ্বেলে চোখ বুজে চিন্তাভাবনায় ডুবে গেলুম।
কিছুক্ষণ পরে মনে হল, খুনির প্যান্ট-শার্ট ঝোঁকের মাথায় তুলে এনে ভুল করেছি। চিঠি, চাবিরগোছা, সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে প্যান্ট-শার্টটা গর্তে পুঁতে রেখে আসাই উচিত ছিল। ফিরে এসে থানায় ফোন করে খবর দেওয়া উচিত ছিল, আমি ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় আর একটা কবর দেখেছি। আইনবিরুদ্ধ কাজ করে ফেলেছি।
পরক্ষণে মনে হল, খুনি আড়াল থেকে লক্ষ করেনি তো, আমি তার প্যান্ট শার্ট খুঁড়ে বের করেছি? বাইনোকুলারে খুঁটিয়ে চারদিক দেখেছিলুম। কিন্তু কোনো ঝোপের আড়াল থেকে কেউ আমার দিকে লক্ষ রাখলে আমার তাকে দেখতে না-পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
এটা একটা আইনবিরোধী কাজ। পুলিশের দিক থেকে দেখলে অবশ্য এই কাজের সঙ্গত কৈফিয়ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের পক্ষে দেওয়া সঙ্গত হতে পারে, কেন না আগামীকাল পুলিশ সুপার মিঃ শর্মা এসে পড়বেন। কিন্তু আদালতে আমার বেসরকারি গোয়েন্দাগিরি গ্রাহ্য না হতেও পারে।
দুটো বাজলে আমি সেজেগুজে যথারীতি পিঠে কিটব্যাগ এঁটে গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে খিড়কির দরজায় গেলুম। দরজা ভেজানো ছিল। খুলেই দেখি কালীপদ পুকুরপাড়ে ঘাসজমিতে বসে বিড়ি টানছে। গাইগোরুটা খুঁটিতে লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা এবং গোরুটা ঘাস খাচ্ছে।
আমাকে দেখে কালীপদ বিড়ি ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে নমস্কার করল। তারপর বলল, স্যার কি আবার চণ্ডীপাহাড়ে যাচ্ছেন?
বললুম যাচ্ছি। তবে ওই মাঠে সকালে লালঘুঘুর ঝাঁক দেখেছিলুম। দেখি, ছবি তুলতে পারি কি না। তো তুমি এবেলা কি গোরু চরিয়েই কাটাবে? ফুলগাছে জল দেবে না?
কালীপদ হাসল। বলল, কাল রাতে যা বৃষ্টি হয়েছে, আর এক সপ্তাহ বৃষ্টি না হলেও জল লাগবে না।
বৃষ্টির পর খোঁড়াখুঁড়ি করলে মাটি জমাট হয় না। তুমি সিডবেড তৈরি করেছ দেখলুম।
আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল সকালে খুরপি হাতে কাজে লাগব।
তুমি খন্তা দিয়ে কী খোঁড়ো কালীপদ?
বুঝলেন না। সিডবেড তৈরির সময় খন্তা দিয়ে খুঁড়তে হয়। তারপর সার। ছড়িয়ে মাটি উলটে-পালটে গুঁড়ো করতে হয়।
তোমার খন্তা নাকি হারিয়ে গিয়েছিল? ফাগুলাল বলছিল।
কালীপদ গম্ভীরমুখে বলল, গত পরশু পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে–ওই যে দেখছেন, বেগুনখেতে খোঁড়াখুঁড়ি করে ওখানেই রেখেছিলুম। তারপর আনতে মনে ছিল না। কাল সকালে মনে পড়ল। কিন্তু বেগুনখেতে খন্তা নেই। কেউ বেগুন চুরি করে খন্তা নিয়ে পালিয়েছে।
কিন্তু পরে খুঁজে পেয়েছিলে শুনলাম। ফাগুলাল বলছিল।
হ্যাঁ স্যার। হঠাৎ দেখি, বাড়ির ভিতর করবীগাছের পিছনে পড়ে আছে। কালীপদ হাসল। কোনো বাড়ির ঝি-চাকরের কাজ। সায়েবকে বাঙালিটোলায় সবাই খাতির করে। মনিব দেখতে পেয়ে ধমকেছে। তখন পাঁচিলের ওপর দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমি স্যার কথাটা চেপে গেলুম। মেমসায়েবকে তো দেখছেন। খুব কড়া ধাতের মানুষ। বাইরে বেগুনখেতে খন্তা রেখে এসেছিলুম শুনলে খন্তার দাম মাইনে থেকে কেটে নিতেন।
তাই তুমি বলেছ, করবীগাছের কাছে রেখেছিলে–মনে ছিল না?
কালীপদ আবার হাসল। বলল, ফাগুলাল আমাকে বুদ্ধিটা দিয়েছিল। ফাগুলাল খুব চালাক লোক। তবে ভালোমানুষ। খুব ভালোমানুষ।
জিজ্ঞেস করলুম, ওই পাশের বাড়িটা কার কালীপদ?
ভানুডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারবাবু মারা গেছেন। ডাক্তারগিন্নি বেঁচে আছেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে। বড়ো ছেলে হাসপাতালে কাজ করে। ছোটো–
সহসা মেমসায়েব-এর আবির্ভাব খিড়কির দরজায়। কালী বলে ডেকেই তিনি আমাকে দেখতে পেলেন। বললেন, কর্নেলসায়েব আবার চণ্ডীপাহাড়ে যাচ্ছেন নাকি?
বললুম কাছাকাছি যাব। ওই পলাশগাছের কাছে মাঠের উপর লালঘুঘুর ঝক দেখেছিলুম। ছবি তোলার সুযোগ পাইনি। এবার গিয়ে দেখি।
সুষমা বললেন, দেখুন। কালী! বাড়ি আয়। কাজ আছে। তোর বউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মাঠে নেমে বাইনোকুলারে দেখে নিলুম, প্রয়াত ডাক্তারবাবুর বাড়ির পিছন থেকে ঝোপঝাড় আর উঁচু-নিচু গাছের জঙ্গল সেই আমবাগানের কাছে গিয়ে থেমে গেছে। আমবাগানের ভিতর কোনাকুনি পশ্চিম-উত্তরে এগিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছেছিলুম। তারপর বেঙ্গল ক্লাব।
কালীপদর খন্তা চুরি যাওয়ার ঘটনা যত গুরুত্বপূর্ণ হোক, আমাকে খুনির প্যান্ট-শার্টের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে পলাশগাছের কাছে পৌঁছেলুম। তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে একটা গর্ত আবিষ্কার করলুম। মাটিটা সেখানে ঢালু এবং ঢালের গায়ে গর্তটা শেয়ালের বলে মনে হল। বাইনোকুলারে পশ্চিমে বাঙালিটোলার দিকটা দেখে নিলুম। কালীর বউ গোরটার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। বাইনোকুলারে ওর ঠোঁট নড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
আমি ঢালের নিচে বসে কিটব্যাগের পিছন থেকে পলিপ্যাকটা বের করলুম। তারপর ভিজে প্যান্ট শার্ট ছুরিটা রেখে দলা পাকিয়ে গর্তে ভরে দিলুম। ঢালের নিচে রাতের বৃষ্টি স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। অজস্র রঙের কুচি পাথর ছড়িয়ে ছিল। সেগুলো তোলার জন্য রবারের দস্তানা দুহাতে পরে নিলুম। তারপর গর্তটা সেইসব খুদে পাথরে বুজিয়ে দিলুম। তারপর ইচ্ছা করেই শার্টের একটু অংশ টেনে চোখে পড়ার মতো করে ঝুলিয়ে দিলুম।
কিছুক্ষণ ক্যামেরাটা ধরে গুঁড়ি মেরে যেন লালঘুঘুদের ফোটো তুলছি, এইভাবে এগিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আর কী বিস্ময়কর ঘটনা! সত্যিই লালঘুঘুদের একটা ঝাক টাড় জমিটার পূর্বপ্রান্ত থেকে উড়ে গেল চণ্ডীপাহাড়ের দিকে!
একটু দেখে নিলে আঁকটা আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। এই প্রজাতির ঘুঘু এখন দুর্লভ হয়ে এসেছে।
কিন্তু কী আর করা যাবে! আমি উঁচু টাড় জমিতে উঠে কিছুক্ষণ চণ্ডীপাহাড়ের দিকে বাইনোকুলারে ঝকটা লক্ষ করতে থাকলুম। তারপর ঘুরে সোজা উত্তরে এগিয়ে মেঠো রাস্তায় পৌঁছোলুম। হাঁটতে হাঁটতে বেঙ্গল ক্লাবের পাশ দিয়ে নিচের পিচরাস্তা দিয়ে ধরমপুরের দিকে চললুম।
ক্রমে দুধারে নতুন-পুরনো বাড়ি, মানুষজন এবং তেরাস্তায় যানবাহনের ভিড় এসে গেল। একটা সাইকেল রিকশ ডেকে বললুম, পুলিসস্টেশন চলো! জলদি যানা পড়ে গা!
রিকশাওয়ালা আমাকে বিদেশী ট্যুরিস্ট ভেবে বলল, বিশ রুপৈয়া স্যার!
এবার বাংলায় বললুম, কী বলছ তুমি? থানা কুড়ি টাকা ভাড়া? রিকশওয়ালা অবাক হয়েছিল। এবার হাসল। বলল, ঠিক আছে সার! দশ টাকা তো দেবেন?
বললুম, ঠিক আছে। চলো!…
ওসি শ্যামসুন্দর সিংহ আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করে ইংরেজিতে বললেন, নীল সারসের ছবি তুলতে পেরেছেন, আশা করি?
না মিঃ সিংহ! গম্ভীর মুখে বললুম, নীল সারস দম্পতি সম্ভবত কোনো দেবদেবী।
কফি খান কর্নেল সরকার। মিঃ শৰ্মা আমাকে জানিয়েছেন, আপনি সবসময় কফি খান।
কফির হুকুম দিয়ে মিঃ সিংহ একটা ফাইলে সই করলেন। বললুম, কফি খেয়েই আপনাকে নিয়ে বেরুতে চাই। বললুম না নীল সারস দম্পতি কোনো দেবদেবী?
মিঃ সিংহ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। আপনি চণ্ডীপাহাড়ে গিয়েছিলেন শুনেছি। সেখানে কি আপনার কেসের আরও কোনো তথ্য পেয়েছেন?
চণ্ডীপাহাড়ে নয়। নিচের মাঠে একটা গর্তে কিছু পোঁতা আছে। নীল কাপড়ের একটু অংশ দেখা যাচ্ছিল। আমি খুঁড়িনি। কারণ এটা কোনো দুর্গমপাহাড়ের চূড়া নয় এবং সময়টা রাত্রিও নয়।
নীল কাপড়ের অংশ! আপনার কী ধারণা বলুন কর্নেল সরকার?
শার্টের অংশ মনে হয়েছে।
মিঃ সিংহ নিষ্পলক দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, খুনি মেয়েটিকে মারার পর তার প্রেমিককেও মেরে ওখানে পুঁতেছে। তা-ই কি?
জানি না। গিয়ে দেখবেন আপনারা।
একটু পরে কফি আর বিস্কুট এল। কফির স্বাদ যেমনই হোক, আমাকে চাঙ্গা করে। কফি খেয়ে চুরুট ধরিয়ে বললুম, সেখানে জিপগাড়ি সরাসরি গিয়ে পৌঁছোতে পারে।
ঘটনার এই অংশটুকু সংক্ষেপে বলছি। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মিঃ দুবে। খুনির রক্তমাখা ভিজে প্যান্ট-শার্ট এবং মার্ডার উইপন পেয়ে খুবই খুশি হয়ে বলেছিলেন, এবার খুনিকে ধরে ফেলতে আর একটা দিন সময় নিচ্ছি। শার্টটা বিদেশী। কিন্তু প্যান্টে স্থানীয় দরজির দোকানের স্টিকার সেলাই করা আছে। ওসি মিঃ সিংহ বলেছিলেন, কর্নেল সরকার নেচারোলজিস্ট। সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। কাজেই তার পক্ষে ভিকটিমের লাশ এবং খুনির পোশাক ইত্যাদি খুঁজে বের করা সম্ভব। তবে এইসব কাজ আকস্মিকতার পর্যায়ে পড়ে। পুলিশের পক্ষে এই পদ্ধতিতে তদন্ত করা সম্ভব নয়। কোনো সূত্র ধরেই পুলিশকে পা বাড়াতে হয়। তা সত্ত্বেও কর্নেল সরকার পুলিশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদের পাত্র। আমি ওঁদের বলিনি, ডমরুপাহাড়ে লাশ আর জামা-প্যান্ট খুনির পুঁতে রাখার কারণ, শঙ্খচূড় সাপের গুজব। সাপের ভয়ে ওই পাহাড়ে কেউ চড়ে না।
তখন বিকাল সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। পুলিশের জিপ থেকে আমি বাঙালিটোলার নিচের রাস্তায় নেমেছিলুম। হাঁটতে হাঁটতে অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলুম, ফাগুলাল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সে সেলাম দিল বলল, কালীপদর বউয়ের কাছে এইমাত্র শুনলুম, পুলিশের জিপগাড়ি পুবের মাঠে গিয়েছিল। আপনি তাদের সঙ্গে ছিলেন।
বললুম, তুমি শ্মশান থেকে কখন ফিরলে?
তিনটে নাগাদ ফিরেছি। স্নান করে খেয়ে কালীপদর বউয়ের কাছে কথাটা শুনলুম। ওদিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখলুম, পুলিশের জিপগাড়ি চলে গেছে। তারপর ভাবলুম, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো আপনাকে দেখতে পাব। পুলিশের জিপ থেকে আপনাকে নামতে দেখলুম। এখনও বেলা আছে। তাই ধরেই নিয়েছিলুম, আপনি আবার পাখিদুটোর খোঁজে ডমরুপাহাড়ে যাবেন।
কথাগুলো বলে ফাগুলাল খইনি ডলতে থাকল। বললুম, কবরেজমশাই ফিরেছেন?
ফিরেছেন। দুঃখ হচ্ছে, মানুষটা একেবারে বোবা হয়ে গেছেন। একটু ভেবে নিতে আমি ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় নীল সারস দম্পতিকে বাইনোকুলারে খুঁজে দেখার ভান করলুম। আগেই বলেছি, রাস্তার পশ্চিমে একটা টিলা এখান থেকে সেই অশ্বত্থাগাছটা দেখার পথে বাধা। কিন্তু সূর্য ঢলে পড়েছে টিলাটার দিকে। অশ্বত্থাগাছটা দেখা না গেলেও ডমরুপাহাড়ের কিয়দংশে রাস্তার ধারে উঁচু। শালবনের ফাঁক দিয়ে কয়েক মিনিট ধরে একটা লোককে দেখার চেষ্টা করলুম। সূর্যের ছটা বাইনোকুলারে প্রতিফলিত হওয়ায় লোকটার চেহারা কিছুতেই স্পষ্ট হল না। লোকটা সূর্যের ছটার মধ্যে কালো হয়ে ফুটে হারিয়ে গেল ডানদিকে। লোকটা তার জামা-প্যান্ট আনতে গিয়েছিল, এতে নিঃসংশয় হওয়া চলে। জামা প্যান্ট না পেয়ে সে এবার নিশ্চয় গা ঢাকা দেবে।
ফাগুলাল সাগ্রহে বলল, পাখিদুটো দেখতে পাচ্ছেন স্যার?
বাইনোকুলার নামিয়ে বললুম, ফাগুলাল। কবরেজমশাইয়ের সঙ্গে সকালে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তার বাড়ি যেতে চাই।
ফাগুলাল বলল, চলুন! ওঁর বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছি। আমাকে মেমসায়েব বাড়িতে থাকতে বলেছেন। কারণ সায়েব বাড়িতে নেই।
ঠিক আছে। চলো। বাড়িটা দেখিয়ে তুমি চলে আসবে।
ফাগুলালকে অনুসরণ করে যেদিক থেকে এসেছি সেইদিকে হেঁটে গেলুম। বেঙ্গল ক্লাবগামী সংকীর্ণ চড়াই রাস্তাটায় দুটো বাড়ির পর উঁচু ঘাসে ঢাকা একটুকরো জমির উপর পাশাপাশি দুটো আমলকীগাছ। ডানদিকে মাটিটা নিচু এবং পাথুরে। গতরাতে এখান দিয়ে বৃষ্টির জল নেমে যাওয়ার চিহ্ন চোখে পড়ল। ফাগুলাল বলল, ওই একতলা বাড়িটা। এই আমলকীগাছ দুটো দেখছেন, কবরেজমশাইয়ের নিজের হাতে লাগানো গাছ। শীতে আমলকী ফলে গাছ ভরে যায়। ওঁর উঠোনে একটা হরীতকীগাছও আছে দেখবেন।
আমি নিচু পাথুরে মাটির উপর এগিয়ে দেখলুম, উঁচু জমিতে ওঠার জন্য পাথরের চারটে ধাপ তৈরি করা আছে। ফাগুলাল চলে গেল। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলুম, একাংশ বারান্দা। আর বাড়ির সেই অংশের ছাদ থেকে বিবর্ণ একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসালয়। তার নিচে লেখা কবিরাজ শ্রী অবিনাশ ভট্টাচার্য আয়ুর্বেদশাস্ত্রী।
বারান্দার ডানদিকে বাড়ির পাশের একটা ঘর বেরিয়ে এসেছে। ওখানে একটা বন্ধ দরজা। বারান্দার সামনের দরজাটা খোলা। আমলকীগাছদুটো গাঢ় ছায়া ফেলেছে বারান্দায়। আমি খোলা দরজার সামনে দাঁড়াতেই সাড়া এল আসুন।
ঘরে জুতোসুদ্ধ ঢুকব কি না দ্বিধা ছিল। কিন্তু অবিনাশবাবু সামনে এসে বললেন, আপনাকে কষ্ট করে জুতো খুলতে হবে না। আসুন।
ভিতরে ঢুকে দেখলুম, ঘরটার প্রায় এক তৃতীয়াংশে কয়েকটা আলমারি এবং বাকিটা তক্তপোশের উপর গদিতে সাদা চাদর ঢাকা বসার জায়গা। কয়েকটা বালিশ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। দরজার সামনে খালি জায়গায় পা ঝুলিয়ে গদিতে বসলুম।
অবিনাশবাবু বললেন, আপনি জয়ার ঘর সার্চ করার কথা বলেছিলেন।
বললুম, আপনি নিজে কি সার্চ করেছেন?
না। আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলুম। বলে তিনি ভিতরের দরজা দিয়ে আমাকে ঢুকতে ইশারা করলেন। তারপর সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। পাখা ঘুরছিল। বন্ধ করলেন।
ওই দরজা দিয়ে ভিতরের বারান্দায় গেলুম। পাঁচিলঘেরা উঠোনের শেষপ্রান্তে হরীতকী গাছ দেখলুম। বেশ বড়ো উঠোন। তবে সবটাই উঠোন নয়। প্রায় অর্ধেকটা ভেষজ গাছ ও লতার মাচানে ঢাকা উত্তরে টালিছাওয়া রান্নাঘর। বারান্দার বাঁদিকে একটা দরজা ভেজানো ছিল। সেটা খুলে অবিনাশবাবু ভিতরে আলো জ্বালিয়ে এবং পাখা চালিয়ে দিলেন। একটা তক্তপোশে বিছানার উপর সুদৃশ্য বেডকভার। আধুনিক রুচিতে সাজানো ঘর। কিন্তু আসবাব তত দামি নয়। লেখাপড়ার টেবিল আর বইয়ের র্যাক। অবিনাশবাবু বললেন, আপনি দেখুন খুঁজে, যদি কোনো সূত্র পান। আমার বিশ্বাস, কিছু পাবেন না।
আমি টেবিলের ড্রয়ার টানতেই খুলে গেল। ড্রয়ারের ভিতরে পুরোনো জংধরা একটা লম্বা চাবি, সেফটিপিনের ছোট্ট খাপ, ক্লিপ, অনেকগুলো ডটপেন, একটা খুদে নোটবই, অচল রিস্টওয়াচ ইত্যাদি নাড়াচাড়ার ছলে বেঙ্গল ক্লাবের চাবির গোছা চালান করলুম। আগেই চাবির গোছা বের করে হাতে লুকিয়ে রেখেছিলুম।
অবিনাশবাবু জয়ার একটা বাঁধানো রঙিন ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁকে ডাকলুম। দেখুন তো এই চাবির গোছা এবাড়ির নাকি?
অবিনাশবাবু চাবির গোছা আমার হাত থেকে নিয়ে বলল, এই তো ক্লাবের চাবি। এবার আমি বুকপকেট থেকে আঠা দিয়ে জোড়া হিজিবিজি চিঠিটা বের করে তাকে দিয়ে বললুম, চিঠিটা পড়তে পারেন কি না দেখুন।
ফতুয়ার পকেট থেকে চশমা বের করে চিঠিটা দেখতে দেখতে তিনি বললেন কিছু পড়া যাচ্ছে না। কিন্তু চিঠির কাগজটা–
বলুন!
ছোট্ট প্যাডের কাগজ। বলে অবিনাশবাবু ফতুয়ার পকেট থেকে অবিকল একই সাইজের একটা চিঠি বের করে বললেন, অরুর ছেলে বাচ্চু আজ একটা লোকের হাতে শ্মশানে এটা পাঠিয়েছিল। একই কাগজ মনে হচ্ছে।
চিঠিটা নিয়ে দেখলুম, লেখা আছে :
শ্রদ্ধেয় জ্যাঠামশাই,
অনিবার্য কারণে জয়ার সৎকারের সময় উপস্থিত থাকতে পারলুম না। ক্ষমা করবেন। আমাদের বাড়ির পক্ষ থেকে ফাগুলাল যাবে। কিছু দরকার হলে তাকে বলবেন। ক্লাবের ছেলেদেরও বলা আছে। প্রণাম নেবেন।
–বাচ্চু।
এটা পড়ার পর অবিনাশবাবুর হাত থেকে হিজিবিজি চিঠিটা নিলুম। জয়ার টেবিলের সামনে বসে আতসকাঁচ বের করে বাচ্চুর হাতের লেখার ধাঁচের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে কি না পরীক্ষা করতে মন দিলুম।
অবিনাশবাবু বললেন, আমি এখন চা খাই। আপনার জন্যও চা, করি। আপনি আপনার কাজ করুন। কেমন?
কোনো জবাব দিলুম না। প্রায় দশমিনিট পরে অবিনাশ ভট্টাচার্য যখন দুকাপ চা হাতে ঘরে ঢুকলেন, তখন আমার মোটামুটি পাঠোদ্ধার শেষ। বাচ্চু জয়াকে যা লিখে পাঠিয়েছিল, তার সারমর্ম হল : পাটনা যাওয়ার আগে সে যেন প্যাকেটটাকে দেয়।
আনুমানিক পাঠ নয়। আতসকাঁচ আমাকে আগেও এমন হিজিবিজি পাঠোদ্ধারে সাহায্য করেছে। কিন্তু একই শর্তে। লেখকের অন্য একটা চিঠির সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু কাকে দিতে বলেছে, সেটা একেবারে কালিতে ধেবড়ে গেছে। কলকাতার লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে একটা প্রজেক্টার আছে। চাপচাপ কালির তলায় কোনো শব্দ থাকলে স্ক্রিনে তা ফুটে ওঠে। কেটেকুটে কালিতে ঢেকে দিলেও তলার শব্দটা পড়া যায়। ধরমপুর থানায় সেই আলোকসংশ্লেষণ যন্ত্র আশা করা যায় না।
অবিনাশবাবু মেয়ের বিছানায় বসে চা খাচ্ছিলেন। শুধু বললেন, একই কাগজ। একই কালি।
বললুম হ্যাঁ। এটা বাচ্চুর চিঠি। এবার মনে করে বলুন, বৃহস্পতিবার তিনটে নাগাদ জয়া যখন বেরুচ্ছিল, কেউ কি তাকে এই চিঠিটা দিতে এসেছিল?
অবিনাশবাবু বললেন, না। কেউ আসেনি।
আপনি কি মেয়েকে এগিয়ে দিতে বেরিয়েছিলেন?
না। ওই দরজাটা দেখছেন, ওটা খুললে বারান্দায় যাওয়া যায়। জয়া ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে পাশের ঘরে অভ্যাসমতো গড়িয়ে নিচ্ছিলুম।
আপনি কি আপনার কবিরাজি চিকিৎসার ঘরে শোন? রাত্রেও শোন?
হ্যাঁ। আর তো কোনো ঘর নেই। রোগী কদাচিৎ এলে বারান্দায় বসে চিকিৎসা করি। কিন্তু চিঠিতে কী লিখেছিল বাচ্ছ?
যে চিঠি এনেছিল, তার হাতে একটা প্যাকেট দিতে বলেছিল।
প্যাকেট? কিসের প্যাকেট?
জানি না। শুধু প্যাকেট লেখা আছে।
অবিনাশবাবু হঠাৎ একটু নড়ে উঠলেন। আস্তে বললেন, লাইব্রেরির কাজ পাওয়ার কয়েকদিন পরে জয়া আমাকে বলেছিল, বাচ্চু তার ব্যক্তিগত কারবারি কাজে বেঙ্গল ক্লাবকে ব্যবহার করছে। জয়ার ধারণা, কোনো বেআইনি কাজ। তাই সে
হঠাৎ চুপ করে গেলেন অবিনাশবাবু। আধকাপ চা খেয়ে আমি চুরুট ধরালুম। তারপর বললুম, বেঙ্গল ক্লাবের চাবি আপনি কোনো পুলিশ অফিসার ছাড়া কাউকে দেবেন না। চাবিটা এমন কোথাও লুকিয়ে রাখুন, কেউ যেন খুঁজে না পায়। কেউ চাবি চাইতে আসতেও পারে। বলবেন, জয়া আপনাকে চাবি দিয়ে যায়নি। যে চাইতে আসবে, সে যদি চেনা লোক হয়, তাহলে আমাকে তার নাম-ঠিকানা জানাবেন। আমি উঠি।
অবিনাশবাবু বললেন, আপনি এ-ঘর সার্চ করলেন না?
দরকার নেই। বাচ্চুর চিঠিটা আমি রাখলুম।
বেশ।
জয়ার ঘরের অন্য দরজা খুলে দিলেন অবিনাশবাবু। আমি বারান্দায় বেরুলে বললেন, একটা কথা মনে পড়ে গেল।
বলুন।
জয়া যাওয়ার সময় বলেছিল, বাজারে বাচ্চুকে ক্লাবের চাবি দিয়ে যাবে। পাটনা থেকে তার ফিরতে দেরি হতে পারে। অথচ চাবি তার টেবিলের ড্রয়ারে পাওয়া গেল।
জয়া সম্ভবত বাস ধরার জন্য তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে চাবিটা নিতে ভুলে গিয়েছিল। বলে আমি বারান্দা নেমে গেলুম। পিছু ফিরে অবিনাশবাবুকে একবার দেখলুম। বারান্দায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন।
আমার অঙ্ক কষা হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাচ্চুর গোপনীয় প্যাকেট নির্দেশমতো জয়া ক্লাবের পিছনে থিয়েটারের স্টেজের সরঞ্জামে ঠাসা ঘরে রেখেছিল। চিঠি পেয়ে সে সেই ঘরে ঢুকে প্যাকেট বের করছিল। তখনই পত্রবাহক এবং আততায়ী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জয়ার ঘরে বাঁধানো রঙিন ছবিতে দেখে এলুম, সে সুন্দরী ছিল। শুধু সুন্দরী বললে কিছু বোঝায় না। তার চেহারায় তথাকথিত সেক্সি মেয়েদের ছাপ ছিল।
পিচের রাস্তায় প্রাকসন্ধ্যার ধূসরতা। ডমরুপাহাড়ের উত্তর অংশে ঈষৎ রক্তিম আভা। সেই চড়াইয়ের মোড়ে একটু দাঁড়ালুম। চূড়ায় যে লোকটা উঠেছিল, সে যদি খুনি হয়, তা হলে হতাশা আর আতঙ্কে সে পালিয়ে এসে সম্ভবত গাঢাকা দিয়েছে।…
অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়ির গেটের দুই শীর্ষে উজ্জ্বল আলোর ডুম। জঙ্গবাহাদুর সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। পোর্টিকোর ছাদে মিসেস রায়চৌধুরি, তার বউমা ও তুতুনকে দেখলুম। ফাগুলাল এগিয়ে এসে সেলাম দিয়ে আস্তে বলল, কথা হল?
বললুম, হ্যাঁ। তুমি কফির ব্যবস্থা করো। আর শোনো আমি ফোন করতে চাই।
হলঘরে ফোন আছে। আলো আছে। ফোন করুন। আমি ঠাকুরমশাইকে দেখি, সন্ধ্যারতি শেষ করে কিচেনে ফিরেছেন নাকি।
পোর্টিকোর ছাদ থেকে মিসেস রায়চৌধুরি বললেন, আপনার নীল সারস দম্পতির খবর কী?
বললুম ওরা গা-ঢাকা দিয়েছে।…
হলঘরে ঢুকে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলুম। সাড়া এলে বললুম, ওসি মিঃ সিংহকে দিন।
হিন্দিতে প্রশ্ন এল কে আপনি?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
দয়া করে একটু ধরুন।
তারপর মিঃ সিংহের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কর্নেল সরকার। আনন্দ টেলার্স থেকে একটু আগে আই ও মিঃ দুবে রিং করেছিলেন। নাম পাওয়া গেছে। একটু অসুবিধা অবশ্য আছে।
তার গার্জেন শক্তিমান।
আপনি জানতে পেরেছেন?
হয়তো পেরেছি। আপাতত একটা কাজ করুন। কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়ে বেঙ্গল ক্লাবের চাবি চেয়ে নিন। ক্লাবের তিনটে ঘরই তন্নতন্ন করে সার্চ করুন। এটা খুব জরুরি।
একটু আভাস দিন।
স্বচক্ষে যা দেখার দেখতে পাবেন। আর শুনুন। লোকটাকে তার বাড়িতে আজ রাতে হয়তো পাবেন না। কাল পুলিশ সুপার মিঃ এ আর শর্মা আসা অবধি অপেক্ষা করুন। তারপর কথা হবে …
টেলিফোনের রিসিভার রেখে দেখি, ফাগুলাল দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বারান্দা ধরে আমার থাকার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলুম। ফাগুলাল আমাকে অনুসরণ করছিল। তালা খুলে আলো এবং পাখার সুইচ অন করে দিলুম। টুপি, কিটব্যাগ, বাইনোকুলার, ক্যামেরা রেখে ইজিচেয়ারে বসলুম।
ফাগুলাল আস্তে বলল, কফি আসছে। ততক্ষণে একটা কথা বলি স্যার!
বলো!
খুনি কে পুলিশ জানতে পেরেছে?
বলছে, পেরেছে। তাই পুলিশকে বললুম তাকে তার বাড়িতে পাওয়া যাবে না।
ক্লাবঘরে পুলিশকে যেতে বললেন কেন স্যার? ওখানে কী সার্চ করবে?
একটু হেসে বললুম, তুমি বুদ্ধিমান ফাগুলাল। তোমার কী ধারণা বলো?
ফাগুলাল বারান্দার বাঁদিকে ঘুরে কেউ আসছে কি না দেখে নিয়ে বলল, আমার সায়েবকে যেন বলবেন না স্যার! সায়েবও কিছু জানেন না। আমি শুধু জানি। মনে হচ্ছে, আপনিও জানতে পেরেছেন। বাচ্চুবাবুর আসল ব্যবসা নেশার জিনিস। কোকেন, আফিং, গাঁজা, চরস এইসব। আরও কী নাম আছে, মনে পড়ছে না। নেপাল থেকে আসে। বাংলাদেশ থেকে আসে। জঙ্গবাহাদুরের মামা রণবাহাদুর বাছুবাবুর এজেন্ট। মাঝে মাঝে সে এলে বাচ্চুবাবু দামি হোটেলে তার থাকার ব্যবস্থা করে। ধারিয়া নদীর ধারে আজকাল অনেক বড়ো বড়ো হোটেল হয়েছে।
তোমার কি মনে হয় ক্লাবঘরে বাচ্চুর সেইসব মাল লুকোনো আছে?
থাকতেও পারে। সায়েব বাড়িতে নেই। বাচ্চুবাবুর কিছু হলে মেমসায়েব আপনার উপর চটে যাবেন।
তোমার চিন্তার কারণ নেই, ফাগুলাল। বাচ্চুবাবু পুলিশের লক্ষ্য নয়। তার গোপন কারবারের কথা পুলিশ জানে না। কিংবা জেনেও কোনো কারণে চুপ করে আছে।
কিন্তু আমি জানি, ক্লাবঘরে ওইসব জিনিস বাচ্চুবাবু লুকিয়ে রাখে।
কবরেজমশাইয়ের মেয়েকে বাচ্চু ক্লাবঘর দেখাশোনার ভার দিয়েছিল, ওটা লোক দেখানো। ক্লাব রোজ খোলা থাকলে এবং লোকজন যাতায়াত করলে পুলিশের ইনফর্মাররা কিছু সন্দেহ করবে না। কথাটা বুঝলেন স্যার?
তুমি বুদ্ধিমান, ফাগুলাল। ঠিক ধরেছ। এবার একটা কথা শোনো। আমি কাল ভোরেই কলকাতা ফিরব। যদি সাড়ে ছটার বাস ধরতে পারি, ধারাগাঁও রেলস্টেশনে আটটা পাঁচের এক্সপ্রেস ট্রেন ধরতে পারব। পুলিশের কাজ পুলিশ করুক।
ফাগুলাল আরও গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল, আমিও জানতে পেরেছি, কবরেজমশাইয়ের মেয়েকে কে খুন করেছে। কিন্তু তাকে পুলিশ ধরবে না। ধরার সাহস পাবে না। সে–
ফাগুলাল হঠাৎ চুপ করল। বুঝলুম, ঠাকুরমশাই কফি আনছেন। একটু পরে। নরহরি ঠাকুর এসে বললেন, ফাগুলাল। তোমাকে অরুর গিন্নি ডাকছে। শিগগির যাও।
ফাগুলাল চলে গেল।
.
সেবার অক্টোবরে বিহারের ধরমপুরে বিরল প্রজাতির নীল সারস দম্পতি আমাকে একটি ভয়ংকর এবং শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করেছিল। সবিস্তারে সেই ঘটনার বিবরণ জার্নালে লিখে রাখলুম। এবার শেষের ঘটনা। লিখছি।
পরদিন ভোরে আমি কিন্তু সত্যিই ধরমপুরে গিয়ে ধারাগাঁও রেলস্টেশনগামী বাস ধরিনি। ধারিয়া নদী উত্তরে গঙ্গা থেকে বেরিয়ে ধরমপুরে পূর্বে বাঁক নিয়ে ধরমপুরের গা ঘেঁষে পশ্চিমে এগিয়েছে। তারপর একটা অববাহিকায় জলাভূমি রেখে দক্ষিণে ঘুরে ধারিয়া ফলস সৃষ্টি করেছে।
ধারিয়া নদীর তীরে ছোটো ছোটো টিলায় অনেক সুদৃশ্য হোটেল আছে। সুন্দর পরিবেশে অপেক্ষাকৃত কম খরচে হোটেল দ্য রিভারভিউ আমি বেছে নিয়েছিলুম। তারপর ওসি শ্যামসুন্দর সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিঃ রায়চৌধুরির বাড়ি থেকে চলে আসার কারণ জানিয়েছিলুম। মিঃ সিংহ বললেন, সুসংবাদ আছে কর্নেল সায়েব। তবে আপনি সব জেনেও আমাকে কিছু খুলে বলেননি কেন, জানি না।
–আমি তখন আমার পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে অতিথি ছিলুম। তাই মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
–যাইহোক যে-ঘরে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল—
–জানি। ক্লাবঘরে কি আপনারা আর কিছু পেয়েছেন?
–জয়ার একটা ব্যাগ লাইব্রেরি ঘরের টেবিলে পেয়েছি। দুটো বাঁশে ডেডবডির দুই হাত পা বেঁধে রাতের অন্ধকারে খুনি টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার রাতে। আপনার নির্দেশমতো কাল সন্ধ্যায় বাঁশদুটোর দাগ খুঁজে পেয়েছি। দুটো দাগ জলে ভরা ছিল। বাঁশদুটো ছফুট দুইঞ্চি। দাগের সঙ্গে দৈর্ঘ্য মিলে গেছে।
–খুনিকে ধরতে পেরেছেন কি?
–না। সে গা ঢাকা দিয়েছে। তাকে খোঁজা হচ্ছে।
–তাকে পেয়ে যাবেন আমার বন্ধু অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়িতে। আমার মনে হচ্ছে, মিঃ রায়চৌধুরি এখনও সরডিহা থেকে ফেরেননি। দেরি করবেন না। এখনই বাড়ির চারদিক ঘিরে রেখে বাড়িতে ঢুকে সার্চ করুন। বড়ো একটা পুলিশবাহিনী চাই।
আমি ধারাগাঁও থানা থেকে আরও পুলিশ ফোর্স আনার ব্যবস্থা করছি।
দেরি হয়ে যাবে। আপনার যা ফোর্স আছে, তাই যথেষ্ট। দরোয়ান গোঁয়ার। দরকার হলে অ্যারেস্ট করবেন।
আপনি কি নিশ্চিত কর্নেল সরকার?
নিশ্চিত। ওই বাড়ি খুনির পক্ষে দুর্ভেদ্য দুর্গ।
একমিনিট কর্নেল সরকার।
বলুন?
একটা পয়েন্ট এখনও পরিষ্কার হচ্ছে না। জয়া যাচ্ছিল পাটনা। হঠাৎ সে বেঙ্গল ক্লাবে গিয়ে ঢুকল কেন?
মিঃ রায়চৌধুরির ব্যবসায়ী পুত্র বাচ্চু জানতে পেরেছিল জয়া ইন্টারভিউ দিতে পাটনা যাবে। তাই খুনির হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে খুনির হাতে ক্লাবের পিছনের ঘরে লুকিয়ে রাখা একটা প্যাকেট দিতে বলেছিল বাচ্চু। সেই ঘরে ঢুকে খুনি জয়াকে একলা পেয়ে লোভ সম্বরণ করতে পারেনি।
প্যাকেট? প্যাকেট লুকিয়ে রাখার মানে কী?
পুলিশ সুপার মিঃ শর্মা এলে তার সঙ্গে এই হোটেলে চলে আসবেন। প্রমাণ দেখাব। মিঃ সিংহ! দেরি নয়। এখনই ফোর্স নিয়ে চলে যান। খিদে পেয়েছে। ব্রেকফাস্ট এসে গেছে।
.
ব্রেকফাস্টের পর আমি ধারিয়া নদীর তীরে বসে সময় কাটিয়েছিলুম। সাড়ে এগারোটায় ফিরে থানায় রিং করলুম। মিঃ সিংহ তখনই সাড়া দিয়ে বললেন, আপনাকে একটু আগে রিং করেছিলুম।
খবর বলুন।
খোকা বোসকে অ্যারেস্ট করেছি। সে দোতলায় পূর্বদিকের শেষ ঘরটায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল।
ওইঘরে আমি ছিলুম মিঃ সিংহ!
তাই বুঝি। শুয়োরের বাচ্চার কী খাতির! ওর বাবা নাকি ডাক্তার ছিলেন। মরে গিয়ে বেঁচেছেন। ওর দাদা বাইরে চাকরি করে। পুলিশ রেকর্ডে কিছু নেই। খোকা বোস ওরফে শচীন বোস এই অঞ্চলে খোকা পাহলোয়ান নামে কুখ্যাত। ওর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। বুঝতেই পারছেন মিঃ রায়চৌধুরি একজন রাজনীতিক। তার ছেলের নাকি বডিগার্ড। কর্নেল সরকার। ওকে পালানোর সুযোগ দেওয়ার ছলে গুলি করে মারতে পারলে আমি খুশি হতুম। জয়ার ফোটো কি আপনি দেখেছেন?
দেখেছি মিঃ সিংহ! আসলে জয়ার আত্মবিশ্বাস আর সাহসই তার শোচনীয় পরিণামের কারণ। রাখছি। আপনাকে অভিনন্দন মিঃ সিংহ!
না কর্নেল সরকার। আপনাকেই অভিনন্দন।
ফোন রেখে আমি আবার ধারিয়া নদীর তীরে গিয়ে বসলুম। চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করলুম, পাশেই রঙ্গনা ফুলের ঝোপে একটা প্রজাপতি বসে আছে। দেখেই চিনতে পারলুম। বিরল প্রজাতির নয়। কনিষ্ক কানাসে (Kaniska Canace) গোত্র প্রজাতির নাম নিমফালাইদি। ডানার প্রসার দুইঞ্চি। কালচে রং। দুডানার প্রান্তে কারুকার্য খচিত। তবু শরৎকালের রোদে কালচে রং মাঝে মাঝে বদলে রুপোলি হচ্ছে। থাক্। প্রজাপতি ধরার ইচ্ছা করছিল না। শুধু জয়ার রঙিন ছবিটা ভেসে উঠছিল মনে। নীল সারস দম্পতি সত্যিই কোনো দেব-দেবী।…
Leave a Reply