অন্ধ বিভীষিকা – কর্নেল সমগ্র ১১ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১. সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে আটটা
খোঁজা কবরখানার পাহারাওলা ইয়াকুব খাঁ যখন দেউড়ির ঘণ্টা ঘড়িতে মগরেব ঘোষণা করছিল, তখনই সবুজ রঙের গাড়িটা এল। এসে সামনের ফাঁকা ঘাসের জমিতে দাঁড়িয়ে গেল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যার আবছায়া গায়ে ছুঁতে না। ছুঁতেই পোকামাকড়গুলো ঘুম থেকে জেগে একটা ঘুমঘুম আচ্ছন্নতার জাল বুনতে থাকল। আলোহীন নির্জন এই জায়গায় দ্রুত সাড়া পড়ে যাচ্ছিল যথাবিহিত সব অলীক উপদ্রবের। আড়াইশো বছরের পুরনো চরিত্রেরা এবার নিজের হাড় খুঁজে বেড়াবে এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। এবং বুড়ো পাহারাওলা ইয়াকুব খাঁ মাঝে মাঝে খাঁটিয়া থেকে চকিত হয়ে চেঁচাবে—কৌন হ্যায় রে শালালোক? ভাগ, ভাগ্! অবশ্য তার ছোরি বিবি, সিতারার মতে–সবই বুঢঢাকা খোয়াব। বৃদ্ধের স্বপ্ন!
গাড়িটা দেখে অবাক হয়েছিল ইয়াকুব। সচরাচর মুর্শিদাবাদ শহরের একটেরে বসতিহীন ঘন জঙ্গলের এই অখ্যাত খোঁজা কবরখানায় কোন ট্যুরিস্ট আসে না। তারা সবাই অদূরে কাটরা মসজিদ আর মুর্শিদকুলি খাঁর কবরটা দেখেই চলে যায়। কোন স্থানীয় গাইডও এই কবরখানা দর্শনীয় তালিকায় রাখে না।…তো উও হ্যায় মুখসুদাবাদ নবাব বাহাদুরোকা পেয়ারা ইয়ার ঔর গোলাম লোগোঁকা গোরবহৎ মামুলী! এবং ইয়াকুব ক্ষোভে-দুঃখে আফসোসে ছটফট করে। গাইড লোকগুলো তার অকারণ দুশমন হয়ে জন্মেছে। তার ন্যায্য হক বা পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে ওরা। ট্যুরিস্টরা সবখানেই পাহারাওলা বা সেবকদের পয়সা বখশিশ দেয়। বেশ কামায় অনেকে। জাফরাগঞ্জের ওদিকে ইয়াকুব খার এক ভাই আছে। সে তিনটে সাইকেল রিকশার মালিক হয়েছে। ইয়াকুবের কিছু হল না। আগে নবাব বাহাদুরদের রবরবা দু-চারবার পালাপরবে দরবারে সেলাম দিতে গেলে অনেক ইনাম-বখশিশ মিলত। টাকা পোশাক-আশাক আর উৎকৃষ্ট খাবারদাবার পেত। ইংরাজ চলে যাবার পরও কিছুদিন এরকম সুখ ছিল ইয়াকুবের। তারপর দিনে দিনে অবস্থা বহুৎ খারাপ হয়ে গেল। খাস মোতিঝিল প্যালেসই এখন পড়োপড়ো দশা–দেয়ালে ফাটল। লনের বিদেশী ফুল-ফলের গাছগুলো মুড়িয়ে যাচ্ছে গরুর পাল। দরবারখানার বাইরে দেয়ালের আয়নাটা হয়েছে ঝাপসা। ইয়াকুব সেলাম বাজাতে গিয়ে কতবার তার দাড়ি ঠিকঠাক করে নিয়েছে ওটার সামনে। মেঝের দামী নকশাকাটা পাথরগুলো আর নেই। শ্যাওলা আমরুল আর ঘাসের ছবি আঁকছে সবখানে কালান্তক আসমানের মৃত্যুদূত আজরাইল। কেল্লাবাড়ির পাঁচিল ধসেছে। সুরম্য বাগিচা, ফোয়ারা, মীনাবাজার বিলকুল খতম। হারেমের স্কুপে জঙ্গল। সেখানে দিনদুপুরে শেয়াল ডাকে। সাপের খোলস পড়ে থাকে। আর তারই এখানে-ওখানে কিছু কিছু জায়গা সাফ করে টুটাফাটা পুরনো ঘর কিংবা টালির খোপড়ি বানিয়ে বাস করছে নবাবী খানদানের বিষণ্ণ এবং দেমাগী কিছু পরিবার। স্তূপের আগাছায় শুকোতে দেওয়া রঙিন শালোয়ার কিংবা শাড়ি হালকা হাওয়ায় কাঁপতে থাকে। কখনো কোন নবাবনন্দিনী গাছের ছায়ায় বসে দুপুরবেলাটা ভরিয়ে দেয় সেলাইকলের চাপা গরগর শব্দে। কোন ভাঙা ঘরের ভিতর থেকে মধ্যরাতে কে গেয়ে ওঠে দরবারী কিংবা মালকোষ। বর্ষার রাতে কোন ঘরের কোনায় জড়োসড়ো বসে থাকে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে মধ্যবয়সিনী রূপসী বেগমসাহেবা প্রবাসী স্বামী এলাহাবাদে রেলের কেরানি। অভিশাপলানৎ দেয় ঈশ্বর ও মৃত্যুকে, স্বামীকে। হঠাৎ কোথায় সেই কেল্লাবাড়ির মধ্যে হুড়মুড় করে ধসে পড়ে কোন পুরনো ঘর। অনেককালের এক মাতাল নীলাভ জ্যোৎস্নার স্মৃতি, কিছু চটুল হাসি আর ঘুঙুরের শব্দ, কিছু সেতারের ধ্বনি সমেত কাঁপতে কাঁপতে বিদ্যুতের মতো মিলিয়ে যায় সময়ের কালো জোব্বার ভিতর।
হ্যাঁ–কালো জোব্বা। ইয়াকুব খাঁ মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে। আস্তে আস্তে সেই কালো জোব্বা তার দিকেও এগিয়ে আসছে। এই খোঁজা কবরখানায় তার কালো ছায়া অনেক আগেই পড়ে গেছে। এখন তার পালা। নবাবী এস্টেটের পরিচালক বোর্ড ইয়াকুবের মৃত্যুর দিন গুনছে। এই লোকটি খতম হলেই আর হয়তো কোন পাহারাওলা বা খাদেম (সেবক) রাখা হবে না। এই কবরগুলো এমন কিছু প্রচণ্ড ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করছে না!
সত্যিই করছে না। একবার একজন একলা খামখেয়ালি ট্যুরিস্ট এখানে কিভাবে ছিটকে এসে পড়েছিল। ইয়াকুবের সে কী আনন্দ! …আইয়ে, আইয়ে হুজুর মেহেরবান! দেখিয়ে–পয়লা ইয়ে হ্যায় খোজা নবাব ইসমত-উ-দ্দৌলা কা গোর। উও খোজা নবাব খানখানান রহমত বখসকা। উও খোঁজা বান্দা আমিরুদ্দীন জাহাবাজ…! কিন্তু তাকে হতাশ করে কেটে পড়েছিল ট্যুরিস্ট। এসব আজেবাজে লোকের কবর দেখে কী হবে।
তো কবর ছাড়া আর কী দেখবার আছে মুর্শিদাবাদে! সবখানে শুধু কবর– যত পা বাড়াও কবরে হোঁচট খেয়ে পড়ো। এখানে শুধু মৃত্যুর স্বাদ আর গন্ধ, রূপ আর স্পর্শ। তো হুজুর মেহেরবান, মউতকো ভি সমঝনে পড়ে গা মৃত্যুকেও বুঝতে হয়। না–এ মৃত্যু কোন ব্যক্তির নয়, জনপদ ও জাতির জীবনকে সময়ের এই ধূসর আবছা আয়নার অবলোকন করা চাই, তবেই জানা যায় জীবন কী, কতদূর তার বিস্তৃতি আর শক্তি।…..
গাড়িটা দেখতে দেখতে মনে মনে এমনতরো কিছু বাৎচিৎ চালিয়ে যাচ্ছিল ইয়াকুব খাঁ। তার মধ্যে একটা ছটফটানি অসম্ভব আশা নিয়ে জেগে উঠছিল। আজ এতদিনে এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টি-হাওয়ার আসন্নদুর্যোগে, তার বরাত কি খুলে গেল? লেকিন-আফসোস! কোন হ্যাঁজাগ আলো নেই। একটা খুবই পুরনো একচোখা কেরোসিন লানটিন আছে মাত্র। আলো খুবই কম হবে। তবে এই হয়তো দেখনেওয়ালা সমঝদার মানুষের পক্ষে যথেষ্টই। উঠোনে কিছু বড়ো ফলগাছ আছে তাদের তলায় মোট উনিশটি কবর। তিনদিকে উঁচু ফাটা দেয়াল। একদিকে একটা দোতলা দালানবাড়ি–ওপরে নিচে বারোটা ঘর। সব ঘরই পড়ো পড়ো, দেয়ালে গাছপালার শেকড়, বুনো জানোয়ার আর পাখপাখালির নাদি, আবর্জনা, কোনটারই দরজা-জানলায় কপাট নেই–সব লোপাট; কেবল নিচের একটা ঘরে ইয়াকুব তার বউ নিয়ে থাকে–সেটাই মোটামুটি ভালো। এই বাড়িটার লাগোয়া একটা ছোট্ট মসজিদ আছে–যার গম্বুজ ফাটা, মেঝেয় ইয়াকুব লকড়ি সংগ্রহ করে রেখেছে। তার পিছনে গভীর একটা ছোট্ট পুকুর চারদিকে পাঁচিল আর জঙ্গল, ঘাটের পাথুরে সিঁড়ির দেউড়ির পাঁচিল। সিতারা তার ছোকরি বিবি এখানে ইচ্ছেমতো গা খুলে গোসল করে। জলের রঙ ঘন। সবুজ। সেই সবুজ জলের ধারে বসে সিতারা মৃদু সুগন্ধি সাবান মাখে। কখনও সরু ছিপ ফেলে ল্যাটা মাছ ধরে কোন কোন বিকেলে। ইয়াকুব তখন ছাগলের জন্যে জঙ্গলে জামপাতা আনতে গেছে।…
তো ইয়াকুব গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে হুজুর মেহেরবানদের নেমে আসার প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু কয়েক মিনিট কেটে গেল, তবু কেউ নামল না দেখে তার কষ্ট হল। বোঝা গেছে। এবার বাইরে বাইরে জায়গাটা দেখেই কেটে পড়বে নির্ঘাত।
ইয়াকুব আরও এগিয়ে গাড়ির কাছে গেল। তখন শুনল, বাবুসায়েবরা নিজেদের মধ্যে বাৎচিৎ করছেন। দুটি জওয়ান লড়কীও দেখতে পেল সে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হয়তো তাই ওঁরা কেউ নামছেন না। ইয়াকুব আবার সেলাম দিয়ে বলল, কুছু অসুবিধা হবে না হুজুর বারাণ্ডা হ্যায় আচ্ছা। সেখানে দাঁড়ালে সবকুছ সা-সাফ নজর হবে। আইয়ে, নবাব বাহাদুরোঁকা পেয়ারা খোঁজা লোগোকো গোরস্তান হ্যায়।…
গাড়িটা স্টেশন ওয়াগন। যে গাড়ি চালিয়ে এসেছে, সে যে নেহাত ড্রাইভার নয়, বোঝা যাচ্ছিল। খুব চমৎকার একটা আজগুবি ঐতিহাসিক গল্প দ্রুত বানিয়ে নিয়েছে ইয়াকুব খাঁ। সুযোগ পেলেই ঝেড়ে দেবে এবং ভাল বখশিস আদায় করে ছাড়বে। ইয়াকুব তার দিকে এগিয়ে ফের সেলাম করল।
…কুছু তকলিফ হবে না সাহাব। আসুন, বান্দা ইয়াকুব খাঁ জিম্মাদার আছে।
স্টিয়ারিঙে কনুই রেখে চুরুট টানছিল বাবুসায়েবটি–সে সকৌতুকে হাসল।..শান্ত! এ বুড়ো নির্ঘাত একটা মারাত্মক গল্প ঝাড়বার তালে আছে। ভঙ্গিটা দেখেই ধরে ফেলেছি, বুঝলে?
পিছনের সিট থেকে গোঁফদাড়িওয়ালা একটি যুবক বলল, গেঁথে নিন সোমনাথদা–একটা রিয়েল লাইফ চরিত্র।
তার পাশের যুবকটির গোঁফ এবং একরাশ চুল আছে। সে বলল, ক্যামেরা আপনার পেন বলছিলেন দাদা!
সামনের সিটে দুটি মেয়ের একজন বলল, ওকে হিরো করলে স্মিতাদি কি রাগ করবেন?
সবাই হেসে উঠল। তার পাশের যুবতীটি বলল, আমি কি নায়িকা নাকি? সোমদা বলুন–আমার মতো পেঁচী খেদির রোলটা কী রেখেছেন!
পিছনের গোঁফদাড়িওয়ালা ছেলেটি বলল, কিছুই রাখেননি। এ ছবির কোন স্ক্রিপ্ট নেই। তাই না সোমনাথদা?
ওদের সোমনাথদা জবাব দিল না। ভুরু কুঁচকে কবরখানার উঁচু দেউড়িটা দেখতে থাকল। ফো ছেলেটি বলল, স্ক্রিপ্ট একটা আছে–তবে মনে। দাদা এটাই কি আমাদের ডেস্টিনেশান তাহলে?
উঁ? বলে সোমনাথ মুখ ফেরাল। তাকে অন্যমনস্ক দেখাল।
আমাদের কি এখানেই রাত কাটাতে হবে?
ইয়াকুব খাঁ ঝাঁপিয়ে এল অমনি। .কুছু তকলিফ হবে না হুজুর। অনেক ঘর আছে। লেকিন–হামি সব সাফা করে দেব। দেখিয়ে না, আসমান বিলকুল বুরা বাত বলছে। মালুম হচ্ছে, রাতমে বহুৎ বরষাবে। আইয়ে আপলোক, সব বধ্বস্ত, হয়ে যাবে।
তার আগ্রহ দেখে শান্ত নামে যুবকটি বলল, সায়ন্তনবাবু, লোকটার মনে হচ্ছে প্রচণ্ড খিদে। ওর চোখদুটো দেখুন!
সায়ন্তন দেখে নিয়ে বলল, স্বাভাবিক। …বলে সে দেউড়ির দিকটা লক্ষ্য করতে থাকল। তারপর হাঁসফাঁস করে চাপা গলায় বলল, দাদা! সোমনাথদা! · আপনার হবু নায়িকা! দেখুন, দেখুন!
সিতারা দেউড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। আবছায়া আর মৃদু বৃষ্টির মধ্যেও তার ডোরাকাটা তাঁতের শাড়িটা জ্বলজ্বল করছে, কারণ দূরে গঙ্গাপারের আকাশে তখনও সূর্যের ফেলেযাওয়া কিছু লালচে ছটা ছিল–যা ঝলসে দিচ্ছিল সিতারাকেও।
ইয়াকুব পিছনে ঘুরে ওকে দেখে নিয়ে কড়াস্বরে বলল, যাও। জলদি, লানটিন জ্বালাকে লে আও। তামাশা দেখনেকা টাইম নেহী জি!
সিতারা অমনি সরে গেল। স্মিতা হেসে বলল, ভারি বাধ্য মেয়ে তো। বুড়োর মেয়ে হবে।
পিছন থেকে শান্ত বলল, বাজি। ওর বউ।
স্মিতা বলল, বাজি। হতেই পারে না–মেয়ে। এই শ্রীলেখাদি, চুপ করে আছেন কেন? সায় দিন!
শ্রীলেখা বলল, বউ হতেও পারে।
ইয়াকুব গোমড়ামুখে শুনছিল। এবার বলল, জী মেমসাব, উও আমার বহুবিবি আছে। উনকী দাদা শহরে আস্তাবল বস্তিতে হেকিমসাব আছে–দাওয়াই দেতা বেমারিকা। বহুৎ বড় খান্দান হ্যায় মেমসাব। উওভি নবাব খান্দান হ্যায়। কালেকটার সাহাবকা পাশ মাহিনা-মাহিনা তনখা মিলতা থাবহুৎ দিন আগে। বছর সালমে একদফা নজরানাভি মিলতা ঔর কালেকটার সাহাব, জী হাঁ–খোদ কালেকটার উস রোজ সেলামভি দে। মেরা বহুকী দাদা বড়া আদমী থা। আজ…
শান্ত বলল, উরে ব্বাস! তাহলে তো নবানন্দিনী নিয়ে ঘর করছে বুড়ো।
সবাই হাসল। স্মিতা বলল, বাঃ, চমৎকার! সোমদা, নায়িকা পেয়ে গেলেন।
শ্রীলেখা বলল, বুড়ো সে চান্স দিলে তো? আবার সবাই হেসে উঠল। সেই সময়ে সোমনাথ গাড়ি স্টার্ট দিল। ইয়াকুব দুঃখিত মুখে একপাশে সরে দাঁড়াল। কিন্তু গাড়িটা দেখা গেল একেবারে খোলা দেউড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। কাঞ্চনগাছের তলায় গিয়ে সেটা থামলে ইয়াকুব এক দৌড়ে সেখানে হাজির হল। যদিও এটা বে-আইনি, এবং গোরস্তানের আত্মাদের পক্ষে অসম্মানজনক, তবু ইয়াকুবের এ একটা অযাচিত সৌভাগ্য। সে সতর্কতার দরুন ভাঙাচোরা বিশাল কবাট দুটো টেনে বন্ধ করে আবার সেলাম দিয়ে বলল, আইয়ে মেহেরবান। হামরা বারাণ্ডাপর বইঠিয়ে-খাঁটিয়া হ্যায়। সিঅরা! সিতারা! …সে ডাকতে ডাকতে তিনটে কবর ডিঙিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সেখানে দেশলাই জ্বালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল তার ছোকরি বহু সিতারা।…
এক ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে। বৃষ্টিও বেড়েছে। কাঞ্চনতলায় গাড়িটার ওপর একটা ছেঁড়াখোঁড়া তেরপল চাপিয়ে দিয়েছে ইয়াকুব। এবং তার ঘরের লাগোয়া মোটামুটি চওড়া ঘরটা সাফ করে ফেলেছে। সিতারাও তাকে একাজে মদত দিয়েছে। তারপর সোমনাথের দল নিজেদের বিশাল শতরঞ্জি বিছিয়ে আরাম করে বসেছে। কোণে একটা হারিকেন আর স্টোভ জ্বলছে। চায়ের জল। বসানো হয়েছে। জিনিসপত্র যা-কিছু লাগে, সবই ওরা সঙ্গে এনেছিল।
সোমনাথ তার আইডিয়া নিয়ে কথা বলছিল। সেটা খুব স্পষ্ট কিছু নয় অবশ্য। বলছিল, আসলে এ বিষয়ের কোন পূর্বনির্ধারিত স্ক্রিপ্ট সম্ভবই নয়। কারণ, বিষয় হচ্ছে–সময়। না–অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলতে যে পর্ব বিন্যাসের ব্যাপারটা বুঝি, মোটেও তা নয়। আমার এ সময় অবজেকটিভ সম্পূর্ণ ব্যক্তিনিরপেক্ষ। শান্ত, তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। জানো তো আইনস্টাইন বলেছেন সময়ের অতীত-ভবিষ্যৎ কিছু নেই এ নিখিল বিশ্বলোকে সময় চিরবর্তমান একটা সত্তা।…
এসব পণ্ডিতী আলাপে অবশ্য শান্তর কান নেই। সে আলতো দৃষ্টিতে বার বার শ্রীলেখাকে দেখে নিচ্ছিল। আজ সকাল অব্দি এই বিবাহিতা ভদ্রমহিলাকে দেখেনি কিংবা কোনরকম জানাশোনাও ছিল না। সোমনাথের ফ্ল্যাটে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়ে তারপর আলাপ হয়েছে। তার একটু অবাক লেগেছিল তখন। ভদ্রমহিলার স্বামী নাকি একটা ঘড়ি সারানো দোকানের মিস্তিরি–সেই যারা এক চোখে ঠুলি পরে ঝুঁকে বসে থাকে ঘরের কোনায়! এ খবর শান্তকে দিয়েছে সায়ন্তন। সায়ন্তন এখন হাঁ করে সোমনাথের বিষয় গিলছে। সায়ন্তন গুল ঝেড়েছে কি না কে জানে! শান্ত দেখেছিল, শ্রীলেখার সঙ্গে সায়ন্তনেরও আগে আলাপ ছিল না–তার মতোই।
গোলগাল পুতুলগড়ন মেয়ে শ্রীলেখা! নতুন বিয়ে হয়েছে বলেই মনে হয়। চেহারায় তেলকালিমাখা আবর্তনের ছাপ নেইনতুন টায়ারের স্ফীতি ও টানটান নিটোলতা আছে। যেন প্রচণ্ড গড়িয়ে যেতে তৈরি।
শান্তর মনে হচ্ছিল শ্রীলেখা প্রেমে ও সংসারে যুগপৎ পটীয়সী। অবশ্য সোমনাথ ভট্টের ফিল্ম ইউনিটে তাকে বিস্ময়কর বৈষম্য লাগে। সোমনাথ কী জাদু জানে! এর আগে নাকি তার একটা বাণিজ্যফিল্ম কোন আদার ব্যাপারীর হাতে হারিকেন দিয়ে ছেড়েছিল। তারপর একটা ডকুমেন্টারিতে দারুণ কেল্লা জেতে। তৃতীয় অবদান একটা শর্ট ছবিকার ছোটগল্পের বস্তুরূপ। নাম হয় প্রচুর। বিদেশে কোন জাঁদরেল সিনেক্লাব পিঠ চাপড়ে দেয়। তারপর সোমনাথ ভট্ট ঘোষণা করে–আমার ক্যামেরাই আমার কলম। কিন্তু তার হাতে শ্রীলেখার মতো রীতিমতো গৃহস্থ ভদ্রমহিলা এসে পড়াটা আশ্চর্য লাগে। মেয়েটি নির্ঘাত অ্যামবিশাস!
একটু আগে সিতারাকে উপলক্ষ করে জনান্তিকে শান্ত সায়ন্তনকে বলেছে, কোথাও বোকাবোকা শুদ্ধতা দেখলে আমার আলকাতরা ধেবড়ে দিতে ইচ্ছে করে! সে ইচ্ছে এখন শ্রীলেখাকে ঘিরে ছটফট করছে। অন্তত ওই টলটলে টানটান মুখটা, পুরু ভুরু, ভাসা ভাসা দৃষ্টি!
ইয়াকুব সামনে নেই কিন্তু অনুভব করা যায় ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে। হয়তো দরজার ওপাশে তার ঘরের বারান্দায়, কিংবা চৌকাঠের ওপাশে। নির্জন কারখানায় এই বৃষ্টির রাতে মানুষ পেয়ে সে ভারি খুশি। শান্ত অন্ধকারের ভিতর তাকে একবার খুঁজল।
শ্রীলেখাই রান্নার যোগাড় করছিল। খুব নিষ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তার মধ্যে। সোমনাথ অনর্গল কথা বলছে–তার চুরুট নিভে গেছে। এবং হাতদুটো পলেস্তারা চটে যাওয়া আড়াইশো বছরের দেয়ালে লম্বা ছায়া দোলাচ্ছে।…শান্ত, তুমি কিছু শুনছ না! কিন্তু এটা খুব ইম্পরট্যান্ট। তোমার রোল খুঁড়ে বের করতে হবে। ..সোমনাথ বলে উঠল।
শান্ত একটু হেসে ইংরেজিতে বলল, জাস্ট ডিগ ইন।
সোমনাথ বলল, তুমি নিশ্চয় মাকড়সা দেখেছ শান্ত?
কে জানে! বলে শান্ত একটা সিগারেট ধরাল।
সায়েন্সের বইতে আলবৎ দেখেছো! …সোমনাথ বিরক্ত হয়ে বলল। মাকড়সার জাল…
শান্ত বলল, আমি বায়োলজি পড়িনি সোমনাথদা। ফিজিকস।
তখন সোমনাথ হাসল। …ঠিক আছে। তোমাকে কাল সকালে আমি ব্যাপারটা দেখাব। যাক গে শোন। এক বেলার জন্যে পথ ফাঁকা পেলেই মাকড়সা জাল বুনে দেয় পথে ঠিক তেমনি প্রকৃতি–তুমি পা তুললেই সেই ফাঁকে সে তুলি বুলিয়ে ঝট করে ঘাস বা গাছের ছবি এঁকে ফেলে। বুঝতে পারছ? সায়ন্তন, পোভড়াবাড়ি আমরা সবাই এখন দেখছি। আমরা এখন তার মধ্যে রয়েছি। এখন কথা হল, সময়ের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটা বিশ্লেষণ করলে আমরা সাংখ্যদর্শনে ফিরে যাই।
সায়ন্তন মেধাবী ছাত্রের গলায় বলল, প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্ব।
চমৎকার!…সোমনাথ নিভন্ত চুরুট জ্বালাতে ব্যস্ত হল।
শান্ত উঠে দাঁড়াল।
স্মিতা বলল, কোথায় যাচ্ছেন? বাইরে?
সোমনাথ বলল, টর্চ নাও। ইয়াকুব, ইয়াকুব!
ইয়াকুবের আওয়াজ এল তক্ষুনি–জি হুজুর!
ইয়াপর ল্যাট্রিন হ্যায়?
জি সাব?
মানে-টাট্টিউট্টিকা কোই বন্দোবস্ত হ্যায়?
ইয়াকুব আবির্ভূত হল। …নেহী মেহেরবান! বাহারমে বহৎ জায়গা হ্যায়। সাফ জমিন হায়, সাব! হাম বদনামে পানি ভর দে। ঠারিয়ে!
সবাই হাসল। স্মিতা চোখ ঠারল শ্রীলেখার দিকে। শ্রীলেখাও চোখের ভাষায় জবাব দিল। ইয়াকুব শান্তকে বলল, চলিয়ে সাব–খিড়কিকা উধার হাম দেখা দেতা! লেকিনবরসাতমে…হুজুর, ঠারিয়ে। ছাতি লাতা হ্যায়। সে লাফ দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
শান্ত বলল, কবরের ভূতগুলো ঘাড় মুচড়ে দেবেনয় তো… সে থেমে গেল এবং হাসল।
শ্রীলেখা অপ্রসবিত অশ্লীলতার আঁচ পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল চায়ের কাপের দিকে। স্মিতা অবশ্য নির্লজ্জ ফিকফিক হাসতে লাগল। সোমনাথ সস্নেহে বলল, শান্তর মধ্যে পরিমিতিবোধ আছে ভীষণ। শান্ত, বেশিদুরে যেও না কিন্তু। আমি এনেছি তোমাদের–আমার একটা দায়িত্ব আছে, মনে রেখো।
শান্ত টর্চ হাতে বেরোল। বাইরে ইয়াকুবের গলা শোনা গেল-লিজিয়ে– ছাতি ঔর বদনা। হাম ভি সাথ-সাথ যাতা আপকা।
শান্ত বলল, না বাবা তুমি চুপচাপ ওদের কথা শোন গিয়ে। কপাল খুলে যাবে। চাই কি হিরো হয়ে যাবে, বুঝেছ? সমঝতা, হিরো কেয়া চিজ হ্যায়?
জি–ইয়ে ঠিক নেহী। আপনি কুছু চিনবেন না সাব। হামি দেখিয়ে দেবে।
মলো ছাই! তুমি শুধু বলে দাও কোনদিকে যাব- ব্যস। আর ওই বদনাটদনা রাখো। দরকার নেই। সোমনাথদা, বুড়োকে ডেকে নিন তো! বড্ড জ্বালাচ্ছে!
সোমনাথ ডাকল, ইয়াকুব! তুম ইধার আও।
ইয়াকুব অভিমানে সরে এল। তারপর বদনাটা অন্ধকারে সিতারা নিঃশব্দে তুলে নিচ্ছেল।
শান্ত চমকে উঠেছিল। বলল, কে?
আমি।
নির্ভুল বাংলা উচ্চারণ শুনে শান্ত অন্ধকার বারান্দার দিকে টর্চ জ্বালল– জেনেশুনেই। সিতারার পিছনটা দেখতে পেল সে দরজায় তারপর একবার ঘুরল। তখন শান্তর বুকে আচমকা এক ঝলক গরম রক্ত ছিটকে উঠেই তক্ষুণি, দারুণ ঠাণ্ডা হয়ে পড়ল। সিতারা হেসে উঠল। যেন বাজারের হাসি-ফুল ও ফলে, পোশাকে, জিনিসপত্রে, সাদা নিয়ন আলোয় ঝলসে ওঠা। কাকে কি ভেবেছিল! কিন্তু..থাক। পরে ভাবা যাবে।
বুক ঢিপঢিপ করতে থাকল কতক্ষণ। সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকল। সামনে সাদাপাথরের একসার কবর একপাশে সরু একফালি ঘাসেঢাকা পথ। পথের দুধারে দিশি ফুলের গাছ। তারপর কাঞ্চনতলায় গাড়িটা সামনে পড়ল। সে গাড়ির পিছনে গিয়ে সস্নেহে মৃদু চাপড় মেরে চাপাস্বরে বলল, হ্যাল্লো, হাউ, ডু ডু? গাড়ির পাশ কাটিয়ে সে উঁচু দেয়ালের ধারে ধারে চলতে থাকল। ডাইনে সার-সার সাদা ধু ধু কবর। একেবারে শেষে পাঁচিলের বাঁকের কাছে একটা খিড়কি দেখল। খিড়কিটা খুলতে গিয়ে সে পিছন ফিরে দালান বাড়িটার দিকে তাকাল। তারপর দ্বিতীয়বার চমকালো দোতলার কোণের ঘরে একপলকের জন্য একটুকরো লাল আগুন–পরক্ষণেই গাঢ় অন্ধকারে আবার ঢেকে গেল। বাড়িটা। সিগারেট খাচ্ছে কেউ? কে সে? ভূতের ভয় শান্তর নেই। কিন্তু এতক্ষণে মনে হল, হঠাৎ কবরখানাটা দারুণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। অলৌকিক অদৃশ্যেরা ফিসফিস করছে পিছনে। বৃষ্টির শব্দের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্রের চাপা শব্দ এই অন্ধকার রাতটাকে রহস্যের সমুদ্রে টালমাটাল নৌকোর মতো দোলাতে শুরু করেছে। তার মাথার ওপর বর্ণবিহীন ছাতাটা মনে হচ্ছে ফুলে ওঠা ভারি পাল–যার ওপর একটা বাঁদর চড়ে বসেছে যেন। হ্যাঁ, একটা বাঁদর! এই অনুভূতি ক্রমশ চেপে ধরল তাকে। উঁচু পাথুরে দেয়াল আর গাছপালা জুড়ে। পালে পালে বাঁদর ছোটাছুটি করছে আর তার ছাতার ওপর ডিগবাজি খাচ্ছে– এই অলীক উপদ্রবের সকৌতুক ভীতি তাকে কিছু হাসাল এবং শিহরিত করল। পা বাড়িয়ে সে ভাবল–এসব কিছু না, স্রেফ নিজেরই বদমাইসি। দোতলার ওই জ্বলজ্বলে আলোটুকুও। আবার একটা সিগারেট জ্বালাল শান্ত। খিড়কিটা আর খুলতে ইচ্ছে হল না। দাঁড়িয়ে ওখানেই সামান্য জৈব নিয়মটুকু পালন করল। এবং ধরে নিল যে চারপাশের অলীক প্রাণীদের এতে যথেষ্ট অপমান ও শায়েস্তা করা হল!
শান্ত ফিরে এসে প্রকাণ্ড কাঞ্চনগাছটার নিচে দাঁড়াল–তাদের গাড়ির পাশে। টর্চের আলোয় দেখল একটা লম্বাচওড়া অসাধারণ কবরের মাথায় গাছটা গজিয়েছে। চমৎকার একটা বেদির মত জায়গা। সে একটুখানি বসার লোভ সামলাতে পারল না। ছাতার ছাদে মোটাসোটা ফোঁটার শব্দ, গাছের পাতা থেকে। পিছলেপড়া বৃষ্টির। মসৃণ কবরের বেদি যথেষ্ট ভিজে এবং প্যান্ট নিশ্চিতভাবে আন্ডারউয়ার সমেত সংক্রামিত হচ্ছে। তবু বসে মৌজ করে সিগারেট টানতে থাকল সে এবং নিচে যে খোঁজা ভদ্রলোকের অসন্তুষ্ট পুরনো শরীর আছে, তার সম্পর্কে কিছু কল্পনা করতে চেষ্টা করল।
সেই সময় মনে হল, খুব কাছে এসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ জ্বালবার সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় সিতারা বলে উঠল, বন্ধ করুন। সিতারা প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে টর্চটা নিভিয়ে ফেলার তাড়া দিয়েছে।
শান্ত একহাতে তাকে টানল। লাম্পট্যে নয়, স্বাভাবিক কৌতুকেই। মেয়েটির সম্পর্কে তার কৌতূহল বেড়ে গেছে।
সিতারা আস্তে বলল, আঃ ছাড়ুন! একটা কথা বলতে এলুম।
শান্ত ছেড়ে দিল তক্ষুনি। …বলল, তুমি তো দিব্যি বাংলা বলতে পারো দেখছি!
সিতারা যেন হাঁফাচ্ছিল। …ওসব পরে। একটা কথা শুনুন–আপনারা এখানে থাকবেন না। শহরে চলে যান–অনেক হোটেল আছে। আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি।
শান্ত অবাক হয়ে বলল, থাকব না! কেন?
অত বলার ফুরসৎ নেই। থাকলে বিপদ হতে পারে। ..বলেই সিতারা সাঁৎ করে মিশে গেল অন্ধকারে।… ..
.
শান্তকে গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকতে দেখে সোমনাথ বলল, এত দেরি হল! ভাবলুম, ভূতে ঘাড় মটকে দিল নাকি! সে জোরে হাসতে লাগল। অন্যেরাও।
সায়ন্তন বলল, খুব বৃষ্টি হচ্ছে–তাই না শান্তবাবু?
শান্ত জবাব দিল, তেমন কিছু না। তারপর বসে পড়ল।
শ্রীলেখা বলল, আপনার চা-টা ঢেকে রেখেছি। দেখুন জুড়িয়ে গেছে নাকি!
কাপটা টেনে নিয়ে শান্ত চুমুক দিল। তারপর বলল, খুব গরম আমি খাই না।
সায়ন্তন উঠে দাঁড়িয়েছে। …এবার আমি একবার ঘুরে আসি। ..বলে সে ছাতাটা নিয়ে বেরলো। ইয়াকুব তাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, সোমনাথ মৃদু হেসে হাত নেড়ে নিবৃত্ত করল। ইয়াকুব বসে পড়ল ফের। তার দুচোখে প্রচুর আনন্দ চকচক করছে।
সোমনাথ বলল, হ্যাঁ–শ্রীলেখা, যা বলছিলুম। হরর ত্রাস সম্পর্কে। আমার পয়েন্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ত্রাসের উদ্ভব হয় কখন? যখন নিজেরই, বানানো বস্তু কিংবা রূপের সঙ্গে নিজের সচেতন যোগসূত্রটা হারিয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিই..
সেই মুহূর্তে সায়ন্তন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বলল, দাদা, সোমনাথদা! এ। বাড়িতে কী একটা ব্যাপার আছে!
একটুখানি চুপচাপ হয়ে পড়ার পর প্রথমে সোমনাথের হাসি। শ্রীলেখা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ইয়াকুবও।
সায়ন্তন চাপা গলায় বলল, এই বুড়োটা বলল, এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না। কিন্তু এইমাত্র, দেখলুম ওপরের ঘরে কে সিগারেট খাচ্ছে!
শান্তও গম্ভীরভাবে বলল, হ্যাঁ–আমিও দেখেছি।
ইয়াকুব লাফিয়ে উঠল–সিগ্রেট পিতা হ্যায়? আজীববড়া আজীব বাত। হুজুর। আপনোক নীচা কামরা সব তো দেখ লিয়া–বিলকুল জংলী ঔর টুটাফাটা! উপরমেভি এইসা হ্যায়! আইয়ে, দেখ লিজিয়ে!
বলে দৌড়ে সে বেরলো। বাইরে তার চ্যাঁচামেচি শোনা গেল–সিতারা! অ্যাই সিতারা! কঁহা হ্যায় তু?
সিতারার গলাও শোনা গেল।..চিল্লাও মাৎ জি। আদমীনা পাজামা।
সোমনাথ হেসে বলল, কে ওপরের ঘরে সিগারেট খাচ্ছে, তাই নিয়ে– আমাদের মাথাব্যথার কারণ নেই সায়ন্তন। চুপ করে বসো। শ্রীলেখা, খিচুড়ি চাপাও লক্ষ্মীটি। স্মিতা, ওকে ভাই একটু সাহায্য করো। শান্ত, আমার আইডিয়াটা শোন–এখন পুরোটা ধরে ফেলেছি। কাল সকালে আশা করি রোদ্দুর ফুটবে। তখন কাজে লেগে যাব। সোমনাথ আবার হেলান দিল দেয়ালে। চুরুটটা নিভে যাচ্ছিল–জোরে জোরে টেনে উজ্জ্বল করতে ব্যস্ত হল।
সায়ন্তন বসল। বিমর্ষভাবে বলল, কে জানে, চোর-ডাকাতের আড্ডায় পড়া গেল নাকি।
সোমনাথ বলল নেবেটা কী? ক্যামেরা? চোর-ডাকাত কামেরা নেবে না।
.
২. রাত নটা থেকে এগারোটা
সায়ন্তনের মধ্যে একটা সহজাত জেদ আছে, যা তার গুরুতর ভয়ের সময়েও নিপুণভাবে কাজ করে। সে ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল। অবশ্য ভয়ে নয়– অস্বস্তিতে। বাড়িটা মনে হচ্ছিল একটা ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি এবং কোথাও ওঁৎ পেতে আছে এক মারাত্মক খুনী–যাকে বরং বলা যায়, হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক।
অবশ্য তার এই ধারণার পিছনে সোমনাথের সম্ভাব্য ছবির বিষয় কাজ। করছে, এমনও হতে পারে। সোমনাথ এবার একটা অদ্ভুত ছবির থিম নিয়েছে– প্রকৃতি ও সময়। উভয় শক্তির সংঘর্ষে নাকি যে ফেনিল উদ্বেল পরিস্থিতি, তার নাম ত্রাস–হরর। ব্যাপারটা ভারি জটিল। সায়ন্তনের মাথায় ঢোকেনি। সায়ন্তন। জেনেছে, সকালে রোদ্দুর ফুটলে কোথাও এখানে ফাটা নির্জন দেয়ালের ব্যাকগ্রাউন্ডে তাকে কিছু একটা করতে হবে, এবং সোমনাথ ক্যামেরা ধরবে। সায়ন্তন অবশ্য জানে না, সে হিরো কি না। যেমন স্মিতা বা শ্রীলেখাও জানে না কে নায়িকা। আসলে কেউ কিছু জানে না–পরিচালক সোমনাথ ভট্টও না।
সায়ন্তন শ্রীলেখা ও স্মিতার দিকে তাকাল। আজ সকালেই পরস্পর পরিচিত হয়েছে। সবাই। চার জায়গার চারটি যুবক-যুবতী বেছে কুড়িয়ে একখানে জড়ো করেছে শ্রীভট্ট। তাদের দিয়ে স্পষ্ট কী করাবে ঠিক নেই। তাই প্রচুর থ্রিল অনুভব করছিল সবাই। কিন্তু এখন–অন্তত সায়ন্তন ছবির ব্যাপারটা আর আমল দিতে চাইছে না। তার খালি মনে হচ্ছে, একটা বীভৎস খুন ঘটবে। যে কোন সময়–এই পুরনো ভাঙাবাড়ির সিঁড়িতে আততায়ীর চাপা পায়ের শব্দ। শব্দ তার মগজের ধূসর ভাঁজে ঘুনপোকার মতো কুরে খাচ্ছে।
সহজাত জেদটা হঠাৎ সায়ন্তনের চুল ধরে নাড়া দিল। সে হাত বাড়িয়ে টর্চটা নিয়ে কাকেও কোন কথা না বলে বেরোল। একবার তন্নতন্ন খোঁজা, দরকার। এমনও হতে পারে, আর কেউ না–নিরুক্তই তাকে এখান অব্দি অনুসরণ করে এসেছে কলকাতা থেকে। ওকে কিছু বিশ্বাস নেই। শাশ্বতাঁকে সে নাকি পাগলের মতো কোন সময় ভালবাসত। শাশ্বতীর সঙ্গে কী কারণে তার বিয়ে হয়নি। কিন্তু তবু ওকে সে রাহুগ্রাসে আটকে রাখতে চাইত–এসব শাশ্বতীরই বর্ণনা। যাই হোক, শাশ্বতীর এখন তো দিব্যি অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বামী ভালো রোজগার করে। একটা গাড়িও আছে। অফিসের এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টে ভদ্রলোক স্ত্রীকে নিয়ে মজাসে দিল্লী-বোম্বে ঘোরে। বিয়ের পর একদিন এক সুযোগে হাসতে হাসতে সায়ন্তন বলেছিল, তুমি মুসলমান তা বলে দিয়েছি নিরুক্তকে। নিরুক্ত তো খেপে গেছে-সাবধান!
সায়ন্তন মুসলমান–তা সোমনাথ এবং এরা কেউ জানে না। জানলে কি কিছু ক্ষতি হত? ওলোটপালট হয়ে যেত সব? অথচ কী একটা হয় সায়ন্তনের অদ্ভুত ভীতি কিংবা অস্বস্তি; যেন তক্ষুনি সে সব ব্যাপারে ব্যর্থ হয়ে যাবে কিংবা কেউ তাকে আমল দেবে না। মাঝে মাঝে নিজের এই ছদ্মবেশের দীনতম হীনম্মন্যতা তার কাছে স্পষ্ট হয়। সে ঠিক করে ফেলে, এই হিন্দুত্বের পোশাকটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়া দরকার। কিন্তু শেষঅব্দি দেখতে পায়, পরিচিতিটা মোটামুটি বেশ অনেকখানি ব্যাপ্ত হয়েছে–তাই এখন কিছু করতে গেলে হয়তো দারুণ ওলটপালট হয়ে যাবে।
আলিপুর এলাকা ছেড়েছে তিন বছর আগে। তারপর থেকে এই সায়ন্তন। গুপ্ত নাম এবং হিন্দুত্বের ছদ্মবেশ। মাঝে মাঝে মেদিনীপুরে নিজের বাড়িতে, চলে যায় এবং টাকাপয়সা নিয়ে আসে। ওর বাড়িতে সবাই জানে, ফরিদ কলকাতায় থেকে এম. এ. পড়ছে। চূড়ান্ত মিথ্যে। ফরিদ মধ্য কলকাতায় একটা একঘরা ফ্ল্যাট নিয়ে হোটেলে খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ফিল্মি দুনিয়ায় এবং চেহারা ও ব্যক্তিত্বের সুযোগে দুচারটে প্রেম করতে পারছে বলা বাহুল্য, প্রেমিকারা হিন্দু এবং ওকে সায়ন্তন গুপ্ত বলেই জানে। ফরিদ ওরফে সায়ন্তন ফিল্মে হিরো হতে চায়। যদিও মাঝে মাঝে নিজের কাছে এটা ভাঁড়ামির মতো লাগে, সে এড়িয়ে যায়। কারণ, বস্তুত ছবির জগতেই তার মানসিক বিচরণ অবিশ্রান্ত–সে নিরন্তর পর্দায় রহস্যময় প্রতিফলনে নিজেকে ছড়িয়ে রাখে। শাশ্বতীর সঙ্গে প্রেম। প্রগাঢ় হলে সে একদিন খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছিল নিজের পরিচয়। শাশ্বতী। হেসে খুন যাকে বলে! পরে অবশ্য ভীষণ রেগে গিয়েছিল–সেটাও ওর মুসলমানত্বের দরুন নয়, সঠিক পরিচিতি গোপন করার জন্যে। যাই হোক, তবু চালিয়ে যেতে পারত শাশ্বতী আসলে তাকে ভালবেসেছিল নিশ্চয়; কিন্তু সরে আসতে হল নিরুক্তর শাসানিতে। এখানেও শেষ হতে পারত সব–হয়নি, শাশ্বতী নিরুক্তকে সব বলে দিয়েছিল। শাশ্বতীর মধ্যে ধর্মবোধটোধ আদতে নেই-ই; সে একালের গল্পের তরলমতি ছেলে-মেয়েদের একজন–যারা খেলার বেঁকে ব্যাঙের ওপর ঢিল ছুঁড়ে মারছিল। শাশ্বতীর কৌতুকবোধ সায়ন্তনরূপী ফরিদের বিপদের মেঘ ভাসিয়ে আনার পক্ষে যথেষ্ট। নিরুক্তটা জন্মখুনী। অনেক রাজনৈতিক খুনজখমে সে হাত পাকিয়েছে। ফের বাসা বদলাতে হয়েছিল সায়ন্তনকে। এদিকে নিরুক্ত হঠাৎ পুলিসের পাল্লায় পড়ে যায়। কিছুকাল স্বস্তিতে কাটানো গিয়েছিল। সম্প্রতি কদিন আগে কাগজে যে বন্দীমুক্তির খবর বেরিয়েছে, তাতে নিরুক্ত ত্রিপাঠীর নাম দেখা গেছে। সায়ন্তন বাসা থেকে খুব কম বেরিয়েছে গত কদিন যাবৎ। হঠাৎ এই সোমনাথ ভট্টের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যায় এবং এই যোগাযোগ ঘটে। এখন প্রথম প্রশ্ন : সোমনাথ কি নিরুক্তকে, চেনে? জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। অবশ্য, এও ঠিক–চিনলে সায়ন্তনের আসল পরিচিতি সোমনাথ টের পেত এবং তাকে সোজা বলত। সোমনাথ খুব। স্পষ্টভাষী মানুষ। সুতরাং এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন : নিরুক্তের সঙ্গে বাকি কজনের পরিচয় আছে কি না? থাকতে পারেনাও পারে। থাকলে কিছু যায়-আসে না। এরা কেউ তো সকাল অব্দি জানত না ইউনিটে কে-কে যাচ্ছে। এরপর তৃতীয় প্রশ্ন : নিরুক্ত কি কোন উপায়ে টের পেয়ে তাকে গোপনে অনুসরণ করেছে? এর জবাব হল–তা কেন করবে? নিরুক্ত হয়তো ভুলেই গেছে শাশ্বতীর কথা। তার কথাও। তাছাড়া, গোপনে চুপিচুপি অনুসরণ করার পাত্র নিরুক্ত নয়। সে সোজা সামনে দাঁড়াবে। চার্জ করে বসবে। শাশ্বতীর জাত মেরেছে!
সায়ন্তন বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজের এইসব ভাবনার মুখোমুখি হল এবং শেষে একটু হাসল। যা ভাবছে, তা হাস্যকর, উদ্ভট, অলীক। কোনরকমে যুক্তির ধোপে টেকে না। অথচ, এও সত্য যে সে নিরুক্তর প্রতি একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক মনে রেখেছে। সেটা অহেতুক হোক, যাই হোক–কিন্তু আছে। তার চমক সে প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছে। তার মানে, নিরুক্তর আততায়ী ইমেজটা অন্তত এখন এই ভুতুড়ে কারখানায় বৃষ্টির রাতে বার বার ভেসে উঠছে–সেটা যত অবাস্তবই হোক।
সায়ন্তন, টর্চ জ্বেলে সিঁড়ি খুঁজল। দেখতে পেল। সিঁড়িটা সঙ্কীর্ণ–পাথরের ধাপ। সেকালে এমন সরু আর ঘোরালো সিঁড়ি করার একটি কারণই থাকতে পারে–সে হচ্ছে : দুশমনের আক্রমণ রোখা। সায়ন্তন সিঁড়িতে পা বাড়াতেই দারুণ চমকে উঠল। কে তার পিঠ ছুঁয়েছে এবং ফিসফিস করে উঠেছে–কোথায় যাচ্ছেন?
চকিতে ঘুরে টর্চ ফেলল সে। সিতারা!
ওপরে ইয়াকুব গজগজ করছে শোনা গেল। তারপর তার একচোখা লণ্ঠনের ছটা দেখা গেল। সিতারা সঙ্গে সঙ্গে সরে তার ঘরে গিয়ে ঢুকল।
সায়ন্তন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েকমুহূর্ত। তারপর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে যেতেই ইয়াকুবের মুখোমুখি হল। ইয়াকুব বলল, কোই চুটিভি নেহী দেখা হুজুর! বিলকুল খালি হ্যায়-ঔর জঞ্জাল! আইয়ে–আপভি দেখ লিজিয়ে।
.
শান্তকে হঠাৎ আবার বেরোতে দেখে সোমনাথ বলল কোথায় যাচ্ছ?
শান্ত জবাব দিল, দেখি, সায়ন্তনবাবু কী করছেন!
অন্ধকার। যেও না-টর্চ নেই আর!
স্মিতা আর শ্রীলেখা লক্ষ্য করছিল। স্মিতা হাসল, শ্রীলেখা গম্ভীর। শান্ত কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেল। সোমনাথ চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকল।
শান্ত বারান্দায় গিয়ে দেখল সিতারা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে টিমটিমে একটা লম্ফ জ্বলছে। শান্ত সকৌতুকে বলল, তারপর সিতারা বেগম!
সিতারা কেমন হাসল–আলো তার পেছনে বলে হাসির ভাবার্থ স্পষ্ট নয়। শান্ত তার কাছে গেল। …বিপদটা কিসের বলো তা বেগম সাহেবা, শুনি!
সিতারা ভুরু কুঁচকে বলল, ঠাট্টা আমি পছন্দ করিনে।
তুমি রহস্যময়ী, সিতারা!
সিতারা একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনারা কে? কেন এসেছেন এ ভুতুড়ে বাড়িতে?
সিনেমার ছবি তুলতে।
এখানে কী ছবি তুলবেন? শিগগির চলে যান এখান থেকে।
কেন? সেটাই জানতে এলুম।
এটা গোরস্থান। শয়তানের আড্ডা।
শয়তান! সে আবার কী! ..শান্ত হেসে উঠল। …ভূতপ্রেত?
থেকে দেখুন, শয়তান কী।
সিতারা, তুমি বাংলা বলতে পারো। আমার অবাক লাগছে কিন্তু! তোমার স্বামী তো খাঁটি অবাঙালি! ব্যাপারটা কী বলো তো?
ব্যাপার আবার কী? আমরা বাংলা, খোট্টাই উর্দু–দুটোতেই কথা বলি। বুড়ো এখন খান্দানী দেখাচ্ছে আপনাদের সামনে–তাই।
কী কাণ্ড! ইয়াকুব বাংলা বলতে পারে?
খুব। চেপে ধরুন না, বলবে। …সিতারা আবার হাসল। …এই লালবাগে আমরা সাতপুরুষ ধরে বাস করছি।
বাঃ। আচ্ছা সিতারা, তুমি তখন আমাকে দেখে হাসলে কেন?
এমনি।
উ হু। এমনি কেউ হাসে না।
আমি হাসি। আমার অভ্যেস।
সিতারা, ইয়ে–তোমার এই লোকটার সঙ্গে বিয়ে হল কেন?
সিতারা মুখ নামাল।
লজ্জা হচ্ছে বুঝি?
সিতারা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, বরাত। তাছাড়া কী বলব?
সিতারা, তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।
সিতারা ওর মুখের দিকে তাকাল। একটু হাসল। …আমাকে অনেকের ভালো লাগে। ওটা কোন কথা নয়; বাবু।
যাক গে, এর সঙ্গে তোমার বিয়ে হল কেন?
আমাদের খান্দানে বরের অভাব, তাই। বাঙালি মুসলিম খান্দানে তো আমাদের মেয়ে দেয় না। দেখবেন, কত মেয়ে বুড়ী হয়ে মরে গেল, বর জোটেনি। আমার বরাত, বাবু।
এই জঙ্গলে গোরস্থানে তোমার খারাপ লাগে না, সিতারা?
লাগে তো। কী করব?
শান্ত মুচকি হেসে বলল, তোমার চেহারা তো সুন্দর। সিনেমায় নামবে? চেষ্টা করতে পারি।
সিতারা চাপা হাসল। ..সিনেমা আমি প্রায়ই দেখি। আমার বুড়ো সেদিকে খুব ভালো। কিন্তু হঠাৎ সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। …বুড়ো আসছে। আপনি চলে যান বাবু! বলে সে ঘরের ভিতর চলে গেল। বাঁশপাতার কপাট দুটো ঠেলে দিল দরজায়।
শান্ত সিঁড়ির কাছে গেল। আলোর ছটা আসছে। তারপর ইয়াকুব একচোখা আলো ফেলল ওর ওপর। … কোই নেই হ্যায়, সাব। বিলকুল খালি।
ইয়াকুব, ও-বাবু কোথায়?
ইয়াকুব সিঁড়ির মাঝামাঝি বাঁকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে ডাকল–হুজুর!
সায়ন্তনের সাড়া এল না।
ইয়াকুব বলল, উপরমে রহ্ গিয়া। আপভি যানা শাকতা, সাব। যাইয়ে।
শান্ত হঠাৎ কয়েকধাপ উঠে ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠল– ইয়াকুব, তুমি তো বাংলায় কথা বলতে পারো। বলছ না কেন?
ইয়াকুব ভড়কে গেল। কাচুমাচু মুখে বলল, থোড়াসা হুজুর–থোড়া পারি।
চালাকী করো না। খুব ভালোই পারো।
জী নেই–নেহী! কৌন বোলা হুজুর?
শান্ত ওর হাতটা আরও চেপে ধরে একটু মোচড় দিল। …বুড়ো, তুমি ভারি সেয়ানা। বলো, বাংলা বলো!
ইয়াকুব বিকৃতমুখে বলল, আঃ, ছোড় দিজিয়ে-ছেড়ে দিন। এ ক্যায়সা তামাশা, সাব?
শান্ত আরও মোচড় দিল।…তোমাকে ছাড়ছিনে খাঁ সাহেব। বলো, বাংলায় কিছু বলো! ওসব খান্দানী ছাড়োদিকি চাঁদ!
ইয়াকুব ককিয়ে উঠল–আরে বাপ রে বাপ! জান মার দিয়া রে! আপ আদমী আছে, না পাগলা হুজুর? আঃ হা হা! হুজুর, এ বড়াহুজুর! …সে চ্যাঁচাতে থাকল এবার।
সিতারা এল সঙ্গে সঙ্গে। …এ কী করছেন আপনি? ছাড়ুন ওকে, ছাড়ুন বলছি! ওসব আদিখ্যেতা কলকাতায় গিয়ে করবেন। আমি তখনই বুড়োকে বললুম, এসব আপদ বিদেয় করো–শুনলে না! এসব মাকালফল আমি চিনিনে? ঢঙ করবার জায়গা পায় না সব–বেরিয়ে পড়েছে দিগ্বিজয় করতে।…
ইয়াকুবকে ছেড়ে দিয়ে শান্ত ওপরে যেতে যেতে নিচে সোমনাথের কণ্ঠস্বর শুনল। সোমনাথ বলছে, কী হয়েছে ইয়াকুব? ইয়াকুব হাউমাউ করে কী সব বলতে লাগল।
শান্ত ওপরে গিয়ে হোঁচট খেল ইটকাঠের জঞ্জালে। তারপর সাবধানে ঠাহর করে পা বাড়াল। দরজা-জানালা সব খাঁ-খাঁ করছে। বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছে। সে ডাকল–সায়ন্তনবাবু, সায়ন্তবাবু।
কোন সাড়া পেল না। তখন হাত বাড়িয়ে সামনেটা দেখে নিতে নিতে সে এগোল। ডাইনে থামওলা বারান্দা। দরজা দিয়ে বারান্দায় যেতেই সে দেখল সায়ন্তন টর্চ জ্বেলে মেঝেয় কী লক্ষ্য করছে। শান্ত বলল, কী দেখছেন সায়ন্তনবাবু?
সায়ন্তন চমকে উঠল। তারপর শান্তকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে বলল, সিগারেটের ছাই খুঁজছি।
শান্ত হেসে বলল। …পেলেন?
নাঃ। সায়ন্তন টর্চের আলো নিচে কবরগুলোর ওপর ফেলে বলল, কিন্তু আশ্চর্য, আমি ঠিকই দেখেছিলুম।
আমিও।
কে হতে পারে, ভাবুন তো লোকটা?
শান্ত চাপা গলায় বলল, হয়তো সিতারা বেগমের প্রেমিক।
দুজনেই হাসতে লাগল। তারপর শান্ত বলল, মেয়েটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল, জানেন? বলছিল, এখানে থাকলে বিপদ হবে।
সে কী!
যাই হোক। ব্যাপারটা দেখা যাক্, কী ঘটতে পারে।
না দেখেও তো উপায় নেই। মাথার ওপর ছাদ পাওয়া গেছে বৃষ্টির রাতে। এই যথেষ্ট।
সায়ন্তনবাবু, আপনি কখনো মারামারি করেছেন?
কেন, কেন?
করেছেন কি না বলুন না!
সায়ন্তন একটু চুপ করে থেকে বলল, একবার-খুব ছেলেবেলায়। কেন?
প্রেম নিশ্চয় অনেক করেছেন?
হ্যাঁ–না, মানে.. গলা শুকিয়ে গেল সায়ন্তনের।
করেছেন।
এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন শান্তবাবু?
এমনি। কোন উদ্দেশ্য নেই। শান্ত সিগারেট বের করে জ্বালল। তারপর প্যাকেটটা এগিয়ে দিল সায়ন্তনের দিকে। …স্যরি! অভ্যাস। নিন।
সায়ন্তন টর্চ নিভিয়ে সিগারেট নিল। জ্বালল। তারপর বলল, কাল যদি রোদ্দুর না ফোটে, সোমনাথদা কি এখানেই থেকে যাবেন?
কে জানে! তবে অনন্তকাল থাকার জন্য কেউ নিশ্চয়ই আসেনি।
বৃষ্টি কমে যাচ্ছে কিন্তু।
বাঃ! বলেই শান্ত হঠাৎ পিছনে ঘুরল। … টর্চ জ্বালুন তো?
তক্ষুনি টর্চ জ্বালল সায়ন্তন। কেউ নেই। বলল, কী?
যেন পায়ের শব্দ শুনলুম।
ভুতুড়ে বাড়িতে এমন হয়। ছেড়ে দিন। চলুন, নিচে যাই। খুব খিদে পেয়েছে।
দুজনে একটা ঘরের ভিতর দিয়ে সিঁড়ির কাছে এল। সেই সময় শান্ত বলল, শ্রীলেখা ঘড়িমিস্তিরির বউ কেমন করে জানলেন?
সায়ন্তন জবাব দিল, যেন তাই মনে হয়েছিল। সে অস্ফুট হাসল।
স্মিতাকে দেখে কী মনে হয়েছিল?
ব্রিলিয়ান্ট?
মহিলাটি নাচতে পারেন সম্ভবত। হাঁটার ভঙ্গিটি লক্ষ্য করবেন
আপনি বড় অদ্ভুত সায়ন্তনবাবু।
কেন?
আমাকে দেখে কী মনে হয়েছে, আগে বলুন।
খুব বড় ঘরের ছেলে।
তোয়াজ করছেন।
না–আমি গন্ধ পাচ্ছি!
ফুঃ! আমার বাবা ছিলেন ফুড-কেরানি–সুইসাইড করে মারা যান।
সে কী!
আমার মা আমাকে মাসির কাছে রেখে চলে যান, আর আসেননি।
সাবধানে নামুন–এখানটা ভাঙা। গর্ত আছে।
সায়ন্তনবাবু, আপনি কে?
সিঁড়ির শেষ ধাপে টর্চ নিভে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। ফের জ্বলল।
সায়ন্তন বলল, আমি–আমি আবার কে? বেকারবাউন্ডুলে। ফিল্মে নামার সখ আছে। পরক্ষণে পা বাড়াতেই সে আছাড় খেল।
শান্ত কাছে এসে হাত ধরে তুলল ওকে। ..খুব লাগল নাকি?
সায়ন্তন হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। নার্ভাস গলায় বলল, নাঃ।
.
সোমনাথের সব ব্যবস্থা নিখুঁত। খিচুড়ি-ডিমসেদ্ধ, পাঁচজনে এলোমেলো কথা বলতে বলতে খেল। শ্রীলেখার রান্নার প্রশংসা হল প্রচুর। তারপর বারান্দায় ইয়াকুবের রাখা বালতির জলে নিজের নিজের হালকা রঙিন প্লেটগুলো ধুতে আরো আধঘণ্টা সময় লেগে গেল। ইয়াকুব থামের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে অভিমান ও দুঃখের গাম্ভীর্য আছে। শান্ত ধুয়ে উঠলে পালা শেষ হয়েছে। এবং অমনি ইয়াকুব সরে গেছে। শান্ত দেখে নিয়েছে ওঘরে সিতারা খাঁটিয়ায় শুয়ে পড়েছে কখন।
জলটা ইঁদারার–কিন্তু উৎকৃষ্ট। ইয়াকুব জানিয়েছে, এ জলে রুচি না হলে আধমাইল দূরে রাস্তার ধারে একটা গ্রামের বারোয়ারি টিউবেল থেকে সে জল আনতে রাজি আছে। কিন্তু সোমনাথ তাকে যেতে দেয়নি। প্রথমে সন্দিগ্ধতা ছিল, জলপানের পর অবশ্য কেটে গেছে।
এদিকে ততক্ষণে অভাবিত কারণে বৃষ্টি বন্ধ। আকাশে নক্ষত্র ফুটছে।
স্মিতা হঠাৎ বলল, আমরা কে কোথায় শোব?
সোমনাথ বলল, একবার একজাগায় আদিবাসীদের শোওয়া দেখেছিলুম। মাঝখানে একটা কাল্পনিক বৃত্ত এবং তার পরিধিরেখায় মাথা রেখে চারদিকে সব চক্রবৎ শুয়ে থাকে ওরা। বলে সে শতরঞ্জিতে আঁকবার চেষ্টা করল। শ্রীলেখা বলল, বুঝেছি। সে মন্দ হবে না।
শান্ত বলল, কিন্তু ঘুমের ঘোরে আমার হাত ছোঁড়া অভ্যেস আছে যে, হয়তো চুল কিংবা কানের রিঙে-সিরিয়াসলি বলছি–আঙুল আটকে যাবে।
সবাই হাসল। স্মিতা বলল, বরং আমরা ওদিকটায় শুচ্ছি। আপনারা দরজার কাছটায় শোন।
সায়ন্তন বলল, কিন্তু দরজা-জানলা তো হাট করে খোলা!
সোমনাথ ততক্ষণে ঠাহর করে বলল, তাই তো! কপাটচৌকাট কিছু নেই যে! ইয়াকুব ইয়াকুব!
ইয়াকুব আসার আগে শান্ত বলল, মশাও লাগতে পারে!
সবাই ওর দিকে তাকাল। সোমনাথ ফের ডাকল, ইয়াকুব!
ইয়াকুব খেতে বসেছিল এতক্ষণে। এঁটো হাতেই দৌড়ে এল, হুজুর মেহেরবান!
দরজা-জানলা আটকানোর কোন ব্যবস্থা আছে?
ইয়াকুব একটু ভেবে বলল, চটের পর্দা আছে হুজুর। থোড়াসে সবুর কিজিয়ে। দেতা।
সে চলে গেলে সোমনাথ একটা বেতের বাকসো টেনে নিল। ..পেরেক হাতুড়ি সব আছে। কোন অসুবিধে হবে না।
শান্ত বলল, কিন্তু ঘরে যে ভেন্টিলেটার নেই! আমার দম আটকাবে দাদা।
চটের পর্দার ওপর কেমন চমৎকার ভেন্টিলেটার বানিয়ে দেব দেখবে। বলে সোমনাথ উঠে দাঁড়াল। পেরেক পোঁতার সম্ভাবনা লক্ষ্য করতে থাকল।
ইয়াকুব কয়েক মিনিট পরেই তিনটে চট এনে দিল। দুটো দরজা আর। একটা ছোট্ট জানলার পক্ষে তা যথেষ্ট। তিনজন পুরুষ যথেষ্ট পরিশ্রম করে কাজটা সেরে ফেলল।
সোমনাথ ঘড়ি দেখে বলল, পৌনে এগারোটা, এবার শোওয়া যেতে। পারে। সকাল সকাল উঠতে হবে। প্রচুর রোদ পেয়ে যাব মনে হচ্ছে।
শ্রীলেখা স্মিতার দিকে চোখ টিপে বলল, আমরা দুজনে একবার বাইরে যাব। টর্চটা দিন সোমনাথদা।
সোমনাথ উঠে দাঁড়াল…চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।
স্মিতা মুচকি হাসল।..আপনি বারান্দায় দাঁড়ান–তাহলেই যথেষ্ট।
সায়ন্তন বলল, গাড়িটার পাশে চলে যান। পাঁচিলের ধারে।
দুটি মেয়ে হাসতে হাসতে বেরোল। সোমনাথও। সোমনাথ থামের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা টর্চ জ্বেলে পাশাপাশি চলে গেল। তারপর গাড়ির আড়ালে অদৃশ্য হল। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার। দৃষ্টি মোটামুটি চলে যায়। হঠাৎ সোমনাথের মনে হল, তার পিছনে কে এসে দাঁড়িয়েছে। চকিতে ঘুরল সে। বারান্দা অন্ধকার। ইয়াকুবের ঘরের দরজা বন্ধ। সোমনাথ তক্ষুনি পকেট থেকে দেশলাই বের করতে গিয়ে দেখল, নেই। দেশলাইটা ঘরে। সে অস্ফুট স্বরে বলল, কে?
ঘরের ভিতর থেকে সায়ন্তনের সাড়া এল–কী হল সোমদা?
সোমনাথ মুহূর্তে শক্ত হল। জবাব দিল, কিছু না।
আরো লম্বা পায়ে সময় এগোল। শ্রীলেখারা ফিরছে না। চাপা কথাবার্তা ভেসে আসছে ওদের। এবং আবার সোমনাথের মনে হল, এবার ঠিক তার মাথার ওপর ছাদে ধুপধুপ শব্দ হচ্ছে। মুখ তুলতে না তুলতে শব্দটা থেমে গেল। তখন চুল খাড়া হল সোমনাথের। গায়ে কাঁটা দিল। সে তবু শক্ত থাকার চেষ্টা করছিল। কারণ, তার মনে হচ্ছিল–এই ত্রাস অমূলক। সে বাইরের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছে এই অন্ধকারের দুরুন।
কতক্ষণ পরে শ্রীলেখারা ফিরল।
ঘরে তিনজনে ঢুকলে স্মিতা বলল, জানেন সোমনাথদা? ওঁরা ঠিকই বলেছিলেন। এ বাড়ির ওপর তলায় কে যেন লুকিয়ে আছে।
সোমনাথ শুধু শুকনো হাসল।
শ্রীলেখা বলল, স্পষ্ট কিছু দেখিনি–তবে ওপরের বারান্দায় যেন কে দাঁড়িয়ে ছিল। সাহস করে টর্চের আলো ফেলতে পারলুম না। কী জানি, কী দেখব!
স্মিতা বলল, আমি কিন্তু প্রথমে দেখে শ্রীলেখাদিকে বললুম।
সায়ন্তন বলল, কিন্তু আমরা তো তন্নতন্ন খুঁজে এসেছি–কিছু নেই!
শান্ত বলল, পিছনের দিকে সিঁড়ি থাকতে পারে।
সোমনাথ চুরুট ধরিয়ে বলল, মুশকিল! এটাই বড্ড মুশকিল মানে সমস্যা, আমার ক্যামেরায় এখন কোন কাজ করা যাবে না। আলো না হলে…যাক গে। তোমার শোও। আমি জেগে রইলুম আপাতত। শান্ত, জাস্ট দুটোয় তোমার জাগার পালা।
.
৩. রাত বারোটা থেকে দুটো
সোমনাথ শ্রীলেখার কাঁধে আঙুল রেখে ঠেলল। শ্রীলেখা–আশ্চর্য, ঘুমোয়নি, জেগেই ছিল। চোখ খুলল। চমকের ছাপ আছে দৃষ্টিতে। পরমুহূর্তে সে অস্ফুট স্বরে বলল, কী সোমনাথদা?
সোমনাথ বলল, কথা আছে। একবার বাইরে আসবে?
শ্রীলেখা উঠে গেল। …কী ব্যাপার?
এস–বাইরেই বলব।…বলে সোমনাথ টর্চ নিয়ে বেরলো। যাবার সময়ে হারিকেনের মৃদু বাতিটা আরো কমিয়ে দিয়ে গেল।
শ্রীলেখা তার পিছন পিছন এল।
আকাশ পরিষ্কার। অজস্র নক্ষত্র ঝকমক করছে। কবরখানার গাছ থেকে টুপটাপ জল ঝরছে তখনও। সোমনাথ গাড়ির চাবি এনেছিল। পিছনের দিকে ঢুকে ডাকল–এখানে এসে বসো।
…ওরা বেরিয়ে গেলে শান্ত চোখ খুলল। সে দেখল, স্মিতা যেন এইমাত্র চোখ বুজল। শুধু সায়ন্তনের নাক ডাকছে। আলো খুব কম। একচিলতে ছটা সাপের মতো স্মিতার মুখে পড়েছে।
শান্ত একটা সিগারেট ধরাল। তারপর চাপা হেসে ডাকল, স্মিতা, ঘুমোলেন?
স্মিতা সাড়া দিল–না। বাইরে গিয়ে ঘুম আসে না আমার।
আমারও।
একটু চুপচাপ থাকার পর স্মিত হেসে বলল, ওঁরা বাইরে কী কথা বলতে গেলেন?
হ্যাঁ।
একবার ভাবুন তো– কী কথা!
প্রেমভালোবাসা নয় নিশ্চয়!
আপনি বড্ড দুর্মুখ!
শান্ত খসখসে গলায় হাসল। একটু পরে বলল, স্মিতা, আপনি নাচতে জানেন?
একটু-একটু। কেন?
ভীষণ ভয়ের মধ্যে আপনি নাচতে পারেন?
ভীষণ ভয়? ভেবে দেখিনি। কিসের ভয়?
শত্রুর।
হিন্দী ফিল্মে শত্রুর চাবুকের ভয়ে নাচতে দেখেছি।
ধরুন, ফিল্মে নয় বাস্তব। আপনি হলে নাচতেন?
ক্ষতি কী?
স্মিতা, আপনি কে?
স্মিতা চমকে মুখ খুলল। …তার মানে?
শান্ত দাড়ি চুলকে বলল, সায়ন্তবাবু প্রচণ্ড ঘুমোচ্ছেন দেখছি। জেব্রার মুখে গোঁফ থাকলে এবং জেব্রারা ঘুমোলে হয়তো এমনি দেখায়। …একটু হেসে সে ফের বলল, আমাকে ঘুমোলে নাকি ভোদড় দেখায়। একজন বলছিল। দীঘার বালিয়াড়িতে একবার ঘুমিয়ে পড়েছিলুম গল্প করতে করতে। রাতটা ছিল জ্যোৎস্নার।
স্মিতা বলল, আপনি অদ্ভুত!
শান্ত এবার উঠে বসল।–ওই মেয়েটা বুড়োর বউ, বলছিল যে এখানে থাকলে আমাদের বিপদ হবে শয়তানের হাতে। শয়তান সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে স্মিতা?
স্মিতাও উঠে বসল। চুল সামনে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, একটা সিংহের নাম ছিল নাকি শয়তান। সেই শুনে আমার কেবল সিংহের কথাই মনে হয়।
স্মিতা, ধরুন–হঠাৎ এ বাড়িটা ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে।
এই! যা তা বলবেন না।–স্মিতা ছাদের দিকে সংশয়াকুল চোখে তাকাল। ফের বলল, বুডোর বউ বলছিল? ওর কোন অসুবিধে হয়েছে হয়তো আমরা এসে পড়ায়! এসব টাইপের মেয়েরা কী হয়, আমি জানি!
হঠাৎ শান্ত চমকে উঠে তাকাল দরজার দিকে। চটটা টানটান হয়ে টাঙানো আছে। যেন একবার কেঁপে উঠেছিল। কে খুলতে চাইছিল ভিতরে আসার জন্যে–এই রকম মনে হয়েছে। শান্ত হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে একটু তুলে ফাঁক করল। তারপর বলল, কে?
তারপর বেরিয়ে গেল।
স্মিতা বলল, কোথায় যাচ্ছেন, ও শান্তবাবু? বারান্দায় থামের কাছে শান্ত দাঁড়িয়ে আছে দেখল। স্মিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকাল। চারদিকে সামনে কবরগুলো রাতের এক অলৌকিক ছটায় ধবধব করছে। কাঞ্চনতলায় গাড়ির ভিতর থেকে খুব চাপা ফিসফিস কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ডাইনেবাঁয়ে বড়ো বড়ো থামের দিকে তাকাল স্মিতা। যে-কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে ওখানে। তারপর আচমকা তার মনে হল, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার প্রশ্বাস। এসে কানের দিকে লাগল। সে অমনি শান্তর দিকে এগিয়ে তার পিঠটা ছুঁল। শান্ত প্রচণ্ড চমক খেয়ে বলল, কে?
আমি!
স্মিতা।
ঘরে একা থাকতে পারলুম না। ও ভদ্রলোক তো ঘুমোচ্ছেন?
আকাশ পরিষ্কার। বেশ লাগছে। আমার সঙ্গে ওপরের বারান্দায় যাবেন, স্মিত?
ওপরে? কেন?
ভাল লাগবে। জানেন? আমার একপাল পোষা বাঁদর আছে। এখন এখানে তাদের ছেড়ে দিয়ে তারিয়ে-তারিয়ে ছুটোছুটি দেখা যায়। আসুন না।
স্মিতা হেসে উঠল। শান্ত তার হাত ধরে টানল। সিঁড়ি লক্ষ্য করে এগলো দুজনে।…
.
গাড়ির ভিতর থেকে শ্রীলেখা গুম হয়ে বেরিয়ে এল। সোমনাথ চাপা গলায় একবার বলল, খুব ভুল করছ, শ্রীলেখা।
শ্রীলেখা কোন জবাব দিল না। সে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। সোমনাথ তাকে এমন একটা প্রস্তাব দেবে, সে কল্পনাও করেনি। তার সারা শরীর অবশ হয়ে পড়েছিল। একমুহূর্ত তবু একটু ইতস্তত করে সে পা বাড়াল। সামনে বারান্দায় ওঠার পথে তিনটে কবর। তার ধারে সঙ্কীর্ণ পথে পা ফেলে যেতে কয়েকবার ঠোক্কর খেতে হল। বারান্দায় ওঠার সময় আচমকা এতক্ষণে কবরের ভূতের ভয় পেয়ে বসল তাকে। তখন সে পড়ি-কি-মরি করে ছুটে চটের পর্দা তুলে ঘরে ঢুকে পড়ল।
একটু অবাক হল শ্রীলেখা। একা সায়ন্তন ঘুমোচ্ছে। নিজের বিছানায় বসে বুকের কাপুনি থামাতে মন দিল। তারপর ধুপ করে শুয়ে পড়ল। তখন কান্না পেল তার। চুপিচুপি কাঁদতে থাকল সে। আগে সবটা স্পষ্ট জানলে সোমনাথের ইউনিটে. কক্ষনো আসত না সে! উঃ, কী সাংঘাতিক কথা! কাজ নেই আর, ফিল্মের অভিনেত্রী হয়ে। কখন সকাল হবে, সে অকুতোভয়ে কেটে পড়বে এখান থেকে।
শ্রীলেখার মনে হল, সোমনাথের ইউনিটে আরও অনেক আজগুবি ও মারাত্মক ব্যাপার আছে। শান্তবাবু আর স্মিতা, দেখা যাচ্ছে, এই সুযোগে কোথাও গিয়ে প্রেমালাপ করছে। প্রেমালাপ ছাড়া কী? সবই খাপছাড়া লাগছে। শান্তবাবুর সঙ্গে স্মিতার নাকি আজ সকাল-অব্দি পরিচয় ছিল না! ইউনিটের প্রত্যেকটা লোক মিথ্যেবাদী!
শ্রীলেখা একসময় সামলে নিল। সোমনাথের মনে কী ছিল, আগে যদি জানত! সেই আক্ষেপটা অবশেষে রয়ে গেল এবং ঘুমোতে দিল না তাকে। সে চোখ বুজে রইল।
হারিকেনটা খুব মৃদুভাবে জ্বলছিল–শ্রীলেখার মাথার দিকে একেবারে ঘরের এক কোনায়! হঠাৎ সেটা নিভে গেছে কখন, সে টের পায়নি। কারণ একবার চোখ খুলে শ্রীলেখা দেখল, ঘর অন্ধকার এবার তার ভয়টা বেড়ে গেল। সে অস্ফুটকণ্ঠে ডাকল, শান্তবাবু!
কোন সাড়া পেল না। সায়ন্তনের নাক ডাকছে যথারীতি। স্মিতা এলে সে জানতে পারত এবং তার পাশেই স্মিতার শোবার কথা তাহলে সোমনাথই নিভিয়েছে এসে। যেহেতু শ্রীলেখা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, সেও নিশ্চয় শ্রীলেখার ওপর রেগে আছে–তাই সাড়া দিচ্ছে না। শ্রীলেখা এবিষয়ে মনে মনে নিশ্চিত হল। সেইসময় তার মনে হল, ঘরে একটা অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। কাগজপত্র নড়াচড়ার খসখস শব্দ। হয়তো সোমনাথ কিছু করছে। শ্রীলেখা একটু অস্বস্তি নিয়েই পাশ ফিরে শুল। ঘুমোবার চেষ্টা করল।
সেই সময় সায়ন্তনের নাকডাকাটা থেমে গেল। তার একটু পরে সে ঘুম থেকে জেগে ওঠার সাড়া টের পেল শ্রীলেখা। হ্যাঁ, সিগারেট জ্বালল সায়ন্তন। দেশলাইয়ের আলো এতো চকিত আর দ্রুত যে ঘরের ভিতর কিছু স্পষ্ট দেখা গেল না। শ্রীলেখা আস্তে ডাকল সায়ন্তনবাবু!
সায়ন্তন জবাব দিল কে স্মিতা?
না।
স্যরি, আপনি শ্রীলেখাদি। এখনও গলা শুনে বোঝা মুশকিল আমার পক্ষে। …সায়ন্তন হাসল একটু।
আপনি তো ভীষণ ঘুমোতে পারেন দেখছি!
আমি? আমি ঘুমিয়েছি?
আজ্ঞে না। নাক ডাকাচ্ছিলেন।
তাই বুঝি! কটা বাজল? …বলে সিগারেটের আগুনে ঘড়ি দেখে নিল সায়ন্তন। …একটা চল্লিশ! তাহলে নির্ঘাত ঘুমিয়েছি। কোন মানে হয় না! একটা রাত আনায়াসে সবাই জেগে কাটাতে পারতুম! তাই না শ্রীলেখাদি?
হারিকেনটা জ্বালুন না!
থাক। কারো ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। …বলে সায়ন্তন অন্ধকারে উঠে। বসল। …একবার বাইরে যেতুম। টর্চটা…থাক্। দেশলাই যথেষ্ট।
হারিকেন জ্বেলে নিন বরং।
উঁহু, না না। থাক্।
সায়ন্তনবাবু, আরেকবার দেশলাই জ্বালুন তাহলে।
কেন বলুন তো?
জ্বালুন না।
সায়ন অগত্যা দেশলাই জ্বালল। সেই আলোয় দুজনে দ্রুত ঘরের ভিতরটা দেখে নিল। তারপর দুজনেই অবাক হল। ঘরে কেউ নেই। সায়ন বলল, আরে! এঁরা সব গেলেন কোথায়?
শ্রীলেখা প্রথমে গম্ভীর হয়ে বলল, ভূতের কাছে আড্ডা দিতে। পরে একটু হেসে বলল, সোমদা গাড়িতে গিয়ে শুয়েছে মনে হচ্ছে। আর শান্তবাবু স্মিতা…
সায়ন্তন এগিয়ে হারিকেন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, শান্তবাবু আর স্মিত?
কোথাও গল্প করছেন।
আশ্চর্য তো!..বলে সায়ন্তন বেরিয়ে গেল।
শ্রীলেখা উপুড় হয়ে তাকিয়ে রইল হারিকেনটার দিকে। ব্যাগটা বালিশ করেছে। ঘাড়ে ব্যথা করার পক্ষে যথেষ্টই। না–এসব কোন সম্ভাবনাই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তার মাথায় আসেনি। ভেবেছিল, কোন হোটেল টোটেলে মোটামুটি ভাল বন্দোবস্ত হবে রাতে থাকার জন্যে। অনেক লোক ভিড় করবে। আরও সব বিচিত্র ব্যাপার তার মাথায় এসেছিল সোমনাথের গাড়িতে ওঠার সময়। যাক গে, তাও সওয়া যায়। কিন্তু সোমনাথ এ কী প্রস্তাব দিল তাকে? যত ভাবল সে, তত শোকে-দুঃখে ফুলে উঠল। সকাল হতে দেরি। হনহন করে চলে যাবে সবার চোখের সামনে দিয়ে। তার সেই থিয়েটারের অভিনয়ই ভালো।
সময় যেন যেতে চায় না। থেমে রয়েছে। কেউ আসছে না। আবার ভয় করতে থাকল। এই পোড়ো কবরখানায় ভূত না থেকে পারেই না। সে তখন। বিড়বিড় করে ছেলেবেলায় শেখা একটা ভূত তাড়ানো মন্ত্র আওড়াতে থাকল।
শান্ত আর স্মিতা ওপরের বারান্দায় থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শান্ত ওকে সেই অলীক বাঁদরগুলোর গতিবিধি বর্ণনা করছিল। স্মিতা হাসতে গিয়েও ভয় পাচ্ছিল। একসময় স্মিতার মনে হল, সে সত্যি যেন অজস্র বাঁদর দেখছে। বাঁদরগুলো কবরখানার তিনদিকের উঁচু পাঁচিলে, পাঁচিলের ধারের বড় গাছগুলো থেকে নিঃশব্দে লাফিয়ে পড়ছিল–ছোটাছুটি করছিল। তারা কবরগুলোর ওপরও নেমে পড়েছিল দলেদলে। তাদের কোন-কোনটা শান্তভাবে চুপচাপ কবরের ওপর বসে রইল, কোনটা দৌড়াদৌড়ি করল। শান্ত সিগারেট টেনেছে, কোন কথা বলেনি এবং স্মিতা এইভাবে বিস্ময়ে-ভয়ে-কিছুটা কৌতুকে বাঁদরবাজি দেখেছে। এক সময় স্মিতার মনে হল, একটা বাঁদর বেশ বড়োসড়ো, উঁচু, কবরখানার শেষ দিকটায় ঘুরঘুর করছে।
সে অস্ফুটকণ্ঠে বলে উঠল, ওটা কী?
শান্ত বলল, কই?
শান্ত অন্ধকারে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। সেই সময়ে স্মিতা বলল, নাঃ, আমারই চোখের ভুল হয়তো। আর তো দেখতে পাচ্ছি না।
তারপরই সে দ্রুত ঘুরে বলল, কে? কে ওখানে?
শান্ত হেসে উঠল।…আপনি ভূতের পাল্লায় পড়ে গেছেন নির্ঘাত! যান, আপনার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। আরে! ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন! স্মিতা!
স্মিতা কিন্তু কথা কানে না নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার পিছন দিকে। পরক্ষণে সিতারার অস্ফুট সাড়া এল, আঃ, ছাড়ুন, ছাড়ুন। আমি
স্মিতা হেসে উঠল।..তা অমন করে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আশ্চর্য মেয়ে তো!
শান্ত বলল কে? রহস্যময়ী বেগমসাহেবা! কী ব্যাপার?
সিতারা বলল, আপনারা কী করছেন দেখতে এলুম।
শান্ত বলল, বাঃ কী দেখলেন সিতারাবেগম?
সিতারা হঠাৎ দ্রুত চলে গেল–অন্ধকারে ওর চোখ সম্ভবত সব দেখতে পায়। স্মিতা বলল, মেয়েটা ছিটগ্রস্তা। প্রথমে দেখেই সেইরকম মনে হয়েছিল। তাই না শান্তবাবু?
শান্ত বলল, কে জানে! কিন্তু আমাকে ও ভয় দেখাচ্ছিল তখন।
ভয়! কী ভয় দেখাচ্ছিল?
এখানে থাকলে বিপদ হবে
সে কী?
স্মিতা, চলুন–আমরা নেমে যাই। এবার শুয়ে পড়া যাক।
চলুন।
সিঁড়িতে সাবধানে দুজনে নেমে আসার পর নিচের বারান্দা থেকে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। ইয়াকুবের ঘরে একটা লম্ফ জ্বলছে। বিছানায় ইয়াকুব নেই। আর সায়ন্তন উঁকি দিচ্ছে দরজার পাশ থেকে। এদের পায়ের শব্দে সে চমকে উঠল। কাছে এসে অপ্রস্তুত হেসে সে বলল, জল তেষ্টা পেয়েছিল– তাই ভাবলুম, বুড়োকে ডাকি। কিন্তু দরজা হাট করে খোলা। ঘরে কেউ নেই। এরা সব গেল কোথায়?
ভূতের সঙ্গে মিটিঙ করতে। বলে শান্ত এগলো। তার সঙ্গে ওরা দুজনও।
নিজেদের ঘরের সামনে যখন গেছে, সোমনাথের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল কবরখানা থেকে স্মিতা শুনে যাও! তারপর টর্চ জ্বলে উঠল।
স্মিতা সেই আলোয় সাবধানে কবরের পাশ দিয়ে সোমনাথের কাছে চলে গেল।
এরা দুজনে চটের পর্দা তুলে ঘরে ঢুকে পড়ল।
শ্রীলেখা ঘুমিয়ে পড়েছে কি না বোঝা যাচ্ছিল না। সায়ন্তন গিয়ে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। সোমনাথের পাশে শান্তর শোবার জায়গা। শান্ত বিছানায় বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ তার চোখ চলে গেল দরজায় টাঙানো চটের পর্দার নিচে। কী একটা ভাজকরা কাগজ পড়ে রয়েছে। যখন এ ঘরে প্রথম তারা ঢোকে, তখন যা অবস্থা ছিল, এমন কোন কাগজ পড়ে থাকার কথা নয়। অতএব এটা নির্ঘাত তাদের কারো কীভাবে পড়ে গেছে।
শান্ত কাগজটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলে সায়ন্তন পাশ ফিরে বলল, কী?
কী জানি! একটা কাগজ–ভাঁজ করা।
সায়ন্তন বলল, কারো পড়ে গেছে তাহলে! চিঠি?
শান্ত কাগজটা খুলে পড়ছিল। পড়তে-পড়তে বলল, নাঃ–আমাদের কারো নয়। খুব পুরনো নোটপেপারকী সব হিস্টরিক্যাল ব্যাপার!
হিস্টরিক্যাল–ঐতিহাসিক?
হ্যাঁ। একজামিনের খাতার কাগজ মনে হচ্ছে।
কী কাণ্ড!
শান্ত কাগজটা হাতে নিয়ে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। ফেলবে ভাবল–কিন্তু শেষ অব্দি ফেলল না। সায়ন্তনের অজান্তে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর শুয়ে পড়ল। পায়ের ওপর পা তুলে নাচাতে থাকল সে।
একটু পরে স্মিতা হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকল। শান্ত মুখ তুলে অস্পষ্ট আলোয় দেখল, তার মুখ গম্ভীর, চোখ ছলছল, নাসারন্ধ্র কঁপছে। শান্ত বলল, কী হল?
কিছু না। বলে স্মিতা ধুপ করে শুয়ে পড়ল।
পরমুহূর্তে শ্রীলেখার খিকখিক হাসির শব্দ শোনা গেল। শান্ত আর সায়ন্তন দুজনেই মাথা তুলল। সায়ন্তন বলল, কী ব্যাপার হঠাৎ? হাসছেন যে?
শ্রীলেখা বলল, কিছু না। এমনি।
শান্ত বলল, তাহলে ঘুমোন। ডিসটার্ব করবেন না, প্লিজ। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
শ্রীলেখা দমে গিয়ে বলল, কটা বাজল সায়ন্তনবাবু?
সায়ন্তন ঘড়ি দেখে বলল, কাটায়-কাঁটায় দুটো। কিন্তু সোমনাথদা একা কী করছেন? গিয়ে দেখে আসব নাকি?
শান্ত বলল, থাক্। আমাদের ডিরেক্টর মশায় তার স্ক্রিপ্ট ভাবছেন, ওঁকে ঘাঁটাবেন না।
ঠিক সেই মুহূর্তে সোমনাথের আওয়াজ এল বাইরে থেকে–শান্ত! সায়ন্তন। তোমরা শিগগির এদিকে এসো তো!
সোমনাথের কণ্ঠস্বরে একটা ভয়ার্ত চিৎকার। শান্ত আর সায়ন্তন হুড়মুড় করে উঠে বেরিয়ে গেল। শ্রীলেখা আর স্মিতাও উঠে বসল। পরস্পরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ওরা। অজ্ঞাত ত্রাসে। দুজনেই থরথর কেঁপে উঠল।…
শান্তরা এক দৌড়ে বারান্দা থেকে নামল। সোমনাথ গাড়ির কাছে নেই– খানিকটা দূরে কবরখানার শেষপ্রান্তে তার টর্চ জ্বলছে। শান্ত চেঁচিয়ে বলল, সোমনাথদা! সোমনাথদা!
সোমনাথ ডাকল, এখানে চলে এসো!
দুজনে কবরগুলো ডিঙিয়ে গিয়ে যা দেখল, স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। একটা কবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে পাহারাওলা ইয়াকুব খাঁ। পাশে একটা শাবল। সবাই ধরাধরি করে চিত করে শোয়াতেই দেখা গেল, তার ঠোঁটের দুধারে চাপচাপ ফেনা। এবং তার গা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। সায়ন্তন নাড়ি দেখে নিয়ে বলল, নির্ঘাত মারা গেছে!
সোমনাথ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, সিতারা, সিতারাবিবি।
কিন্তু কোন সাড়া নেই। সায়ন্তন একটু এগিয়ে ডাকল শ্রীলেখাদি! স্মিতা! আপনারা আলো নিয়ে আসুন শিগগির!
দরজার চটের পর্দা সরিয়ে বারান্দায় হারিকেন হাতে আসতে দেখা গেল ওদের। মাঝামাঝি আসার পর হঠাৎ শ্রীলেখা চেঁচিয়ে উঠল, সোমদা! সোমদা! সিতারা এখানে পড়ে আছে।
শান্ত, সায়ন্তন দৌড়ে ওদের কাছে চলে গেল। সোমনাথ ইয়াকুবের দেহের কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
অবিকল একই ভঙ্গিতে সিতারাও একটা কবরের ওপর পড়ে রয়েছে। দুকষায় তেমনি চাপচাপ ফেনা। তেমনি ঠাণ্ডা গা। বিস্ফারিত চোখ। মুখে যন্ত্রণার স্পষ্ট চিহ্ন! শিউরে উঠল সবাই। সায়ন্তন অভিজ্ঞ মুখে নাড়ি দেখে বলল, এও মারা গেছে।
সোমনাথ এগিয়ে এল ওদের কাছে। তার মুখ থমথমে গম্ভীর। ভাঙা গলায় বলল, কী অদ্ভুত ব্যাপার। আমি তো মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছিনে। স্মিতার সঙ্গে কথা বলার পর স্মিতা চলে গেল, আমি গেলুম খিড়কিটার দিকে–জাস্ট। টু অ্যাটেনড় দি ইয়ে–আর হঠাৎ দেখি–থেমে গেল সোমনাথ।
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল ওরা। তারপর শান্ত বলল, কিন্তু আমরা সম্ভবত খুব বিপদের মুখে পড়ে গেছি, সোমনাথদা।
সোমনাথ কী ভাবতে ভাবতে বলল, কিসের বিপদ?..
পুলিসের। শান্ত জবাব দিল।…এখনই থানায় খবর দিয়ে আসা দরকার।
ঠিক বলেছ! সোমনাথ পা বাড়াল।…তোমরা বরং ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকো। কেউ বেরিয়ো না। আমি গাড়ি নিয়ে থানায় যাচ্ছি। আমি না আসা অব্দি কিন্তু কেউ বাইরে থেকো না। সাবধান! তোমাদের সব কিছুর দায়িত্ব আমার ওপরে। একটা কিছু হলে… কথা অসমাপ্ত রেখেই দৌড়ে সোমনাথ গাড়ির কাছে গেল।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে আবার ভাবল, দেউড়ির দরজাটা খুলতে হবে যে! শান্ত!
শান্ত গিয়ে হুড়কো তুলে বিশাল কপাট দুটো দুপাশে টেনে সরাল। গাড়ি পিছু হটে বেরলো। তারপর বাইরে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল সোমনাথ। কতক্ষণ ধরে তার গাড়ির শব্দ শোনা যেতে থাকল।
কপাট দুটো বন্ধ না করে ফিরে এল শান্ত। ততক্ষণে ওরা সবাই বারান্দায় চলে গেছে। নীলচে মুখ, ভীত, হতবুদ্ধি কয়েকটি যুবক-যুবতী। ঘরে ঢুকে শান্ত বলল, কিছু বুঝতে পারছিনে! আগাগোড়া সবটা কেমন হেঁয়ালি! তাছাড়া আমার যা মনে হল, ওরা দুজনেই যেন সাংঘাতিক কিছু দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে হার্টফেল করেছে। আপনার কী মনে হয় সায়ন্তনবাবু?
ঠিক তাই। ভয়-টয় পেয়েছিল।
স্মিতা খুব আস্তে বলল, একটু আগেই তো সিতারা ওপরে গিয়েছিল। কেন?
শান্ত সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, বুড়োটা শাবল নিয়ে কী করতে গিয়েছিল ওখানে? গুপ্তধন খুঁড়তে।
সায়ন্তন বলল, এ ভুতুড়ে বাড়িতে সবই সম্ভব।
শ্রীলেখা ম্লান হাসল।…সবই ভাগ্য। ফিল্ম-টিল্ম সব শিকেয় তুলে দিয়ে পালাতে হবে। এখানটা ছাড়া আর লোকেশন ছিল না?
আবার কতক্ষণ চুপ করে থাকল ওরা। পুলিস এলে তো নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে সেই অস্বস্তিতে প্রত্যেকে অস্থির হয়ে পড়েছে। বাইরে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। কোন হাওয়ার শব্দও আর নেই। আর, ক্রমশ মনে হচ্ছে এই পোড়ো বাড়িটা আস্তে আস্তে জ্যান্ত হয়ে উঠছে। দেয়ালে আলো আঁধারে একটা করে জিভ বেরোচ্ছে ক্রমশ–সবাইকে চাটতে আসছে জিভগুলো লকলক করছে। লালা ঝরছে আর গভীর তলদেশে একটা চাপা রুদ্ধ আক্রোশ থরথর করে কাঁপয়ে দিচ্ছে ঐতিহাসিক দালানটাকে। এই অনুভূতি সবার মনেই এল।
এবং সেই সময় শান্তর সেই কুড়িয়ে পাওয়া কাগজের কয়েকটা ইংরেজি লাইন মনে পড়ে গেল–যার বাংলা মানে দাঁড়ায়ঃ
..হে আলমপানা! তুমি আমাকে ধনদৌলত ইনাম প্রচুর দিয়েছ, কিন্তু তবু আমার মনের মধ্যে লোভের শয়তান নিরন্তর ফোঁসফোঁস করছে। এই নিয়ে তুমি আমাকে কবরে পাঠাতে চাও? তার চেয়ে বরং যদি ইনাম দিতে কোন সুন্দরীর একটুকরো হাড়, আমি পরম শান্তিতে ঘুমোতে পারতুম।…
.
৪. কর্নেল নীলাদ্রি সরকার
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ব্রেকফাস্ট খেতে-খেতে ফোনটা ধরলেন …কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।
নমস্কার কর্নেল! আমি জয়ন্ত বলছি। না–আপনার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত নই।
কর্নেল বললেন, মানে জয়ন্ত চ্যাটার্জি? লালবাজার?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি এখন কোথাও বেরোচ্ছেন না তো?
বেরোব না কী বলছ? দশটা পঁয়ত্রিশে আমার গাড়ি। প্রতাপগড় ঘুরতে যাচ্ছি।
কর্নেল, প্রতাপগড়ের বদলে মুর্শিদাবাদ চলুন বরং।
পাগল! এই তো সেদিন–মানে গত ফেব্রুয়ারিতে মুর্শিদাবাদ ঘুরে এলুম। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে জয়ন্ত? সেখানে কবর ছাড়া আর দেখবার কী আছে? এ বয়সে কবর দেখলেই ভয় করে–পা দুটো পিছলে যাবার চান্স আছে যে কোন মুহূর্তে। হাঃ হাঃ হাঃ!
কর্নেল, প্লিজ! কবরেই চলুন আপাতত। আমি…
কবরে যেতে বলছ?
প্লিজ, আবার একবার মুর্শিদাবাদ চলুন। হ্যাঁ।
কেন?
ফোনে বলা যাবে না। আপনি এখনই আপনার ট্রাভেল এজেন্টকে বলে দিন–প্রতাপগড় ক্যানসেল করে মুর্শিদাবাদের ব্যবস্থা করুক! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
বিরস মুখে ফোন ছেড়ে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার অন্যমনস্কভাবে বুকে একবার ক্রুস আঁকলেন। আর ব্রেকফাস্টের স্বাদ পেলেন না। মিসেস অ্যারাথুন একপট কফি রেখে গিয়েছিল একটু আগে। আস্তে আস্তে কফিটা খেতে থাকলেন। অনেকদিন থেকে ইচ্ছে প্রতাপগড় যাবার। যাওয়া হচ্ছিল না নানা কারণে। অবশেষে যদি বা ব্যবস্থা হল, শেষমুহূর্তে লালবাজার ইনটেলিজেন্সের জয়ন্ত চ্যাটার্জি সব ভণ্ডুল করে দিল।
অবশ্য, কর্নেল ইচ্ছে করলেই চ্যাটার্জিকে ভণ্ডুল করতে পারেন। সামরিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার নীলাদ্রি সরকার এখন পুরো স্বাধীন। কেউ তাঁকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে পারে না। কিন্তু মুর্শিদাবাদ এবং কবর এই শব্দ দুটো তাকে খুব ভিতর থেকে আঘাত করেছে। জয়ন্তর কথায় কী একটা রহস্যের আভাসও আছে, যা তাঁকে চারদিক থেকে টেনে ধরে বসিয়ে দিয়েছে। দেখা যাক্ তবে এক্ষুনি হুট করে পর্যটনসূচি তাই বলে তিনি বাতিল করছেন না। আগে সব ঠাণ্ডা মাথায় শুনবেন। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবেন।
মাত্র দশ মিনিট বাদে ষষ্ঠীচরণ এসে খবর দিল, দুজন পুলিস অফিসার বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছেন।
কর্নেল আস্তে আস্তে বাইরের ঘরে গেলেন। মুখটা বিরস–তাই গম্ভীর ছিল। কিন্তু জয়ন্তর পাশে অন্য অফিসারটিকে দেখে তার গাম্ভীর্য মুহূর্তে চলে গেল। খুশি হয়ে বললেন, আরে, আরে! মিঃ সত্যজিৎ গুপ্ত যে! নমস্কার, নমস্কার। কেমন আছেন? আপনিই তাহলে মুর্শিদাবাদের কবর বয়ে এনে লালবাজারে জয়ন্তর কাঁধে চাপিয়েছেন? বাঃ বাঃ!
ওঁরা হেসে উঠলেন। মিঃ গুপ্ত বললেন, আর বলবেন না স্যার! এবার স্বয়ং নবাব এস্টেটের ট্রাস্টিবোর্ডের কেস। মিনিস্টার পর্যায়ে এসে চাপ দিয়েছে। আর চাকরি তো রইলই না–মুখ দেখানোর উপায়ও নেই নিজের কাছে। অথচ একদিক থেকে কেসটা খুব পরিষ্কার–একেবারে জলের মতো।
জয়ন্ত চ্যাটার্জি নিঃশব্দে একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন কর্নেলের দিকে। কর্নেল সেটা একবার খুলে ও উল্টে দেখে রেখে দিলেন। বললেন; আগে মুখে বলুন মিঃ গুপ্ত।
সত্যজিৎ গুপ্ত বললেন, শহরের বাইরে কাটরা মসজিদ এলাকায় জঙ্গলের মধ্যে একটা খোঁজা গোরস্তান আছে।
হ্যাঁ, আছে। দেখেছি।
দিন সাতেক আগে একরাত্রে সেই গোরস্তানের বুড়ো পাহারাওলা আর তার যুবতী বউকে দুজায়গায় দুটো কবরের ওপর মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
কিসে মারা যায় ওরা?
পোস্টমর্টেমে কিছু পাওয়া যায়নি। তাই শেষ অব্দি ডাক্তারি রিপোর্টে বলা হয় যে আচমকা কিছু দেখে ভয় পেয়ে দুজনে মারা গেছে। ভয় পেয়ে মৃত্যুর যে সব সাধারণ লক্ষণ থাকে, দুটো দেহে অবিকল তাই সব রয়েছে। হার্টফেল।
তারপর?
একটা কবর ছিল একেবারে শেষদিকে উঁচু পাঁচিলের প্রায় গায়ে। তার চারদিকে ফুলের গাছ রয়েছে ঘন। সেই কবরটাকে কেউ খুঁড়ে রেখেছে। মানে, ওপরের পাথর সরিয়ে খুঁড়েছে। আর তার তলায় যে লাশটা রয়েছে, প্রায় আড়াইশো বছর আগের লাশ। কিছু হাড়গোড় আর কাপড়-চোপড় মাত্র তাও হাত দিলে গুঁড়ো হয়ে যায়। লাশটার মাথার দিকে একটা চৌকো চিহ্ন স্পষ্ট। দুবর্গফুট জায়গায় কোন ভারি বাকসো বসানো ছিল নিশ্চয়। সেটা নেই। এর ফলেই ধারণা করা হয়েছে যে কেউ বাকসোটা সরিয়েছে এবং তার মধ্যে নিশ্চয় মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল।
তার মানে সোনা-দানা?
জয়ন্ত চ্যাটার্জি হেসে বললেন, হীরেমোতি বলুন বরং।
কর্নেল বললেন, রাইট, রাইট। তা, কারো পায়ের চিহ্ন নেই?
মিঃ গুপ্ত জবাব দিলেন, কবরের তলায় নেই। ওপরে সবটাই পাথর। পরদিন সকালে প্রচণ্ড একপশলা বৃষ্টিতে যা ছিল ধুয়ে গেছে। তবে কবরের পাথর, মাটি যা কিছু খোঁড়া হয়েছে, সব লাশের মাথার আর পায়ের দিকে জড়ো করা আছে। যে বাকসোটা তুলেছে, সে দুদিকে দুপা রেখে কাজ করেছে। এবং আগেই বললুম, সেই জায়গাগুলো মসৃণ পাথর। কাজেই ট্রাস্টিবোর্ডের ধারণা যে কোন ধনবান নবাব উপাধিধারী খোঁজার ওই কবরে প্রচুর ধনরত্ন ছিল, সেই উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড। তবে বোর্ডের আরজি হচ্ছে, ওই ধনরত্ন উদ্ধার করতে হবে। হত্যাকাণ্ডের কিনারা করাটা গৌণ।
কিন্তু হত্যাকাণ্ড বলছেন কেন? মর্গের রিপোর্ট তো উল্টো বলছে।
গোয়েন্দা অফিসার সত্যজিৎ গুপ্ত একটু চুপ করে থেকে বললেন, রিপোর্ট তাই বলছে। কিন্তু পাহারাওলা আর তার স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে কবরের ধনরত্ন চুরির যোগসূত্র নেই–তাই বা বলি কোন যুক্তিতে? প্রায় একই সময়ে দুটো ব্যাপার ঘটেছে। কাজেই…।
পুলিসের কাছে খবর গেল কীভাবে? কখন? কে দিল?
হ্যাঁ–সেটা বলা হয়নি। ওই রাত্রেই এক ভদ্রলোক তিনি একজন সিনেমা পরিচালক, নাম মিঃ সোমনাথ ভট্ট…
হ্যাঁ। সোমনাথ ভট্টের একটা ডকুমেন্টারি আমি দেখেছিলুম যেন।
মিঃ ভট্ট তার ইউনিট নিয়ে খোঁজা গোরস্তানের লোকেশনে ছবি তুলতে যান। ভদ্রলোক ওই দুর্ঘটনার রাত্রে সেখানে বৃষ্টির জন্যও বটে–আবার খুব ভোরে নিরুপদ্রবে কাজ শুরু করবেন বলে গোরস্তানের একটা ঘরে ছিলেন। সঙ্গে ইউনিট বলতে দুজন যুবক, দুটি যুবতী। মিঃ ভট্ট থানায় খবর দেন তক্ষুনি–মানে রাত তখন ঠিক দুটো পঁয়তাল্লিশ। সঙ্গে তার নিজের স্টেশনওয়াগন গাড়ি ছিল। সব ডিটেলস এই ফাইলে পাবেন। আকস্মিক যোগাযোগ নিশ্চয়। ওঁদের খুঁটিনাটি জিজ্ঞেসপত্র করে যা জানা গেছে, শুটিঙ-এর সময় ভিড় হতে পারে এই ভয়েই ওঁরা ওখানে গিয়েছিলেন। তাছাড়া মিঃ ভট্টের ছবির ব্যাপারে যা জানা গেছে ওঁর মতো পরিচালকের পক্ষে সেটা খুবই স্বাভাবিক। ওঁ কোন লিখিত স্ক্রিপ্ট থাকে না–তা ফিল্মমহলে তদন্ত করে জানা গেছে। আর–মাকস্মিক যোগাযোগ বলছি, আরও একটি কারণে। মিঃ ভট্টর এই নতুন ছবিতে সেক্সের প্রাধান্য থাকার কথা ছিল। তাই ভিড় এড়াতে চাওয়া ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক। এবং সেজন্যেই ওই লোকেশন বেছেছিলেন। পৌঁছেছিলেনও সবার অজান্তে সন্ধ্যাবেলায়। মিঃ গুপ্ত সিগারেট জ্বেলে ধোঁয়ার রিং পাকাতে ব্যস্ত হলেন।
কর্নেল জয়ন্ত চ্যাটার্জির উদ্দেশে বললেন, তা আমাকে কি সেই ধনরত্ন উদ্ধার করে দিতে হবে, জয়ন্ত?
জয়ন্ত চ্যাটার্জি হেসে বললেন, কী করতে হবে আপনাকে–আমি কিছু জানি না। শুধু এটুকু জানি যে ঐতিহাসিক জায়গা সম্পর্কে আপনার যেমন দুর্দান্ত নেশা আছে, তেমনি খুব সাধারণ নিরীহ মানুষ বেমক্কা খুন হলে আপনার। সেখানে প্রচণ্ড সহানুভূতি।
কফি খাও তোমরা। ততক্ষণ আমি ফাইলে চোখ বুলিয়ে নি।
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে গিয়ে ওঁৎ পেতে রইল যথারীতি।
একটু পরে মুখ তুলে কর্নেল বললেন, তোমাদের এই খুন কথাটা আমার বড় বিশ্রী লাগছে। মর্গের রিপোর্টে এটা জোর গলায় অস্বীকার করছে যে কোন দৈহিক আঘাতের ফলে ওরা মারা গেছে।
সত্যজিৎ গুপ্ত বললেন, কী দেখে ভয় পেতে পারে তাহলে?
সেটা বলা কঠিন। অন্তত যদি মর্গের রিপোর্ট কারেক্ট বলে মানি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এই রিপোর্টেই কিছু–থাক্ গে।..বলে কর্নেল উঠলেন।…জয়ন্ত, ফাইলটা রাখলে আপত্তি আছে?
মোটেও না। ওটা সব ডুপ্লিকেট কপিতে ভরতি। বরাবর রাখতে পারেন।
ঠিক আছে। আমার আর প্রতাপগড়ে যাওয়া কোনদিনই হবে না!.কর্নেল গজগজ করে বললেন।…মিঃ গুপ্ত, আমি বিকেলের মধ্যে আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলব। আপনি আজ কলকাতায় আছেন তো?
সত্যজিৎ গুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে সঙ্গে না নিয়ে আমি মুর্শিদাবাদে ফিরছিনে স্যার।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, দেখা যাক।
জয়ন্তবাবুরা চলে যাবার আধঘণ্টা পরে কর্নেলের যখন একদফা ফাইলের কাগজগুলো পড়া শেষ হয়েছে, সেই সময় ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, বাবামশাই! কারা দেখা করতে এসেছে।
একটু পরে কর্নেল ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলেন দুটি যুবক-যুবতী বসে আছে। তাকে দেখে ওরা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। কর্নেল বললেন, বসুন বসুন। বাই এনি চান্স মিঃ সোমনাথ ভট্টের ফিল্ম-ইউনিটে নিশ্চয় আপনারা দুজনে ছিলেন–মানে মুর্শিদাবাদ খোঁজা গোরস্তানের লোকেশানে?
শান্ত-স্মিতা দুজনে অবাক হয়ে পরস্পর তাকাতাকি করল। তারপর শান্ত বলল, আপনি আমাদের চেনেন?
বললুম–বাই এনি চান্স।
চান্স নয়, ফ্যাক্ট। বলে শান্ত একটু হাসল।..কিন্তু কী আশ্চর্য!..
আশ্চর্য কিছু নয়। একটু আগে কেসের ফাইলটা আমার কাছে এসেছে।
শান্ত উৎসাহিত হয়ে বলল, এতো ভারি আশ্চর্য যোগাযোগ।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান। গোটা কেসটাই যেন দাঁড়িয়ে আছে। কতকগুলো আশ্চর্য যোগাযোগের ওপর। যাক গে, এবার আপনাদের নাম বলুন।
শান্ত বলল, আমি শান্তশীল রায়চৌধুরী। থাকি পাইকপাড়ায়। ইনি…
স্মিতা বলল, আমি শুচিস্মিতা বসু। বেলেঘাটায় থাকি।
কর্নেল বললেন, এবার বলুন, আমাকে আপনারা চিনলেন কীভাবে?
শান্ত কিছু বলার আগে স্মিতা বলতে থাকল, গতবছর সম্ভবত শীতের সময় খবরের কাগজে মুর্শিদাবাদ প্যালেস হোটেলের মার্ডার কেসটার খবর বেরিয়েছিল। আমার আবার খবরের কাগজ পড়ার ভীষণ বাতিক। তাছাড়া ক্রাইম ফিকশান। পড়াও একটা হবি। তাই মনে মনে আপনি আমার হিরো ছিলেন।…
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, হিরো হবার পক্ষে আমার বয়স অত্যন্ত অনুপযুক্ত।
স্মিতা সলজ্জ হাসল। শান্ত বলল, স্মিতা আমাকে কলকাতা ফেরার পথে আপনার কথা বলে। আপনার ঠিকানা খুঁজতে ভীষণ হন্যে হয়েছি। নয়তো তক্ষুনি আসতাম আপনার কাছে। হঠাৎ কাল আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে একটা বড় কাগজের রিপোর্টার। তাকে বলতেই সে প্রতিশ্রুতি দিল। তারপর রাতের মধ্যে আপনার বর্তমান ঠিকানাটাও যোগাড় করে দিল। তারপর আজ সকালে গেলুম ওঁর বাড়ি। তারপর দুজনে সোজা চলে এলুম।
কর্নেল বললেন, ভালো, এবার বলুন, কেন আমার কাছে এসেছেন?
শান্ত বলল, জানেন কর্নেল? আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে বেশ অদ্ভুত লেগেছিল। ইউনিটের পরিচালক সোমনাথবাবু আর আমরা চারজন : সবাই পরস্পর অপরিচিত। মাত্র লোকেশনে যাবার সময় সকালে সোমনাথবাবুর ফ্ল্যাটে আমাদের আলাপ হয়েছে। কিন্তু প্রথমেই আমার একটু খুঁতখুঁতে ভাব পেয়ে বসে। কেন–সেটা স্পষ্ট বোঝাতে পারব না। খালি মনে হচ্ছিল, কী একটা ঘটতে যাচ্ছে–যা অনিবার্য। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। অথচ এর নির্দিষ্ট কোন প্রত্যক্ষ কারণ দেখতে পাচ্ছিলুম না।
প্রথমে বলুন, মিঃ ভট্টের সঙ্গে আলাপ বা যোগাযোগ হল কী ভাবে?
শান্ত পকেট থেকে একটা কাটিং বের করে কর্নেলের হাতে দিল। কর্নেল পড়ে দেখলেন। ছোট্ট বিজ্ঞাপন। একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী ছবিতে অভিনয় করার জন্য সুদর্শন যুবক-যুবতী আবশ্যক। ফটোসহ লিখুন। বক্স নম্বর ৪৪৮০১; দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা।
কর্নেল বললেন, আপনি ফটো পাঠিয়ে লিখলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তারপরই টাইপ করা ইংরিজি চিঠি এল। তাতে লেখা ছিল : সতেরই জুলাই সকালে একেবারে তৈরি হয়ে চলে আসুন বাইরে যাবার জন্যে। এই সেই চিঠিটা।
কর্নেল দেখলেন স্বাক্ষরটা পড়া যায় না–আঁকাবাঁকা জটিল রেখা কিছু। বললেন, তারপর?
নির্দিষ্ট ঠিকানায় এসে দেখি, পরিচালক আর কেউ নন সোমনাথ ভট্ট। আমি ওঁর ছবি দেখিনিকাগজে খুব পণ্ডিতি আলোচনা পড়েছিলুম। খুব সফিটিকেটেড ব্যাপার। আমার মনে ভীষণ আগ্রহ ছিল ওঁর প্রতি। আর খুলে বলাই ভালো, কমার্শিয়াল ছবি আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। বরং ইনটেলেকচুয়াল কিছু হলে নেশা ধরে যায়। তার ফলে মিঃ ভট্টের ছবিতে নামবার সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
স্মিতা বলল, আমিও বিজ্ঞাপন দেখে ফটো পাঠাই। আমাকেও একইভাবে যেতে লেখা হয়…হুবহু একই চিঠি। তারপর গিয়ে দেখি, পরিচালক আর কেউ নন, সোমনাথ ভট্ট। বার দুই তার আগে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। একবার একটা ফাংশনের শেষে উনি নিজের পরিচয় দিয়ে নিজে থেকে এসে আলাপ করেছিলেন। তারপর একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। নিজে থেকেই বলেছিলেন, আমাকে চান্স দেবেন–যদি নতুন ছবি করেন। কাজেই, সতেরই জুলাই সকালে গিয়ে দেখলুম, উনিই সেই পরিচালক।
শান্ত বলল, আপনি আমাদের তুমি বললে খুশি হব।
কর্নেল বললেন, বেশ। তোমরা সোমনাথ ভট্ট সম্পর্কেই যেন বেশি জোর দিয়ে কথা বলছ। কেন, সেটা কিন্তু স্পষ্ট হল না। আমি পুলিসের ফাইল। দেখলুম, সোমনাথবাবু পুরো ক্লিন। ইনটেলেকচুয়াল মহলে খ্যাতিমান পরিচালক। সরকারের নানা দপ্তরের জন্যে কিছু ডকুমেন্টারি ছবি করে দিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে–শান্ত, তুমিই বলো, কোন নির্দিষ্ট ব্যাপারের দরুন তুমি আমার কাছে। আসার কথা ভেবেছ?
শান্ত বলল, না। সোমনাথবাবু সম্পর্কে আমার জোর দিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু আমি এখনও সেই অস্বস্তিতে ভুগছি। তবে স্পষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছি নে, তখন ওকথা থাক্। আপাতত আপনি এই কাগজটা দেখুন। এটা আমি খুনের রাতে আমাদের ঘরের দরজায় কুড়িয়ে পেয়েছিলুম।
কর্নেল কাগজটা দেখলেন। লাইনটানা সাদা কাগজে আঁকাবাঁকা হরফে ইংরেজিতে লেখা। দেখলে মনে হয়, খুব তাড়াতাড়ি লেখা কোন ছাত্রের পরীক্ষাপত্রের একটা পাতা। সবটা পড়ে কর্নেল মুখ তুলে বললেন, এটা তুমি পুলিসকে জানাওনি দেখছি।
শান্ত বলল, জানাইনি–কারণ ওটার কোন গুরুত্বই দিইনি।
কিন্তু ওটা কাছে রেখে দিয়েছিলে?
অপ্রস্তুত হেসে শান্ত বলল, আসলে ওটা যখন পকেটে রাখি, তখন অব্দি আমার মধ্যে সেই অস্বস্তিটা কাজ করছিল। তারপর দুর্ঘটনা যখন সত্যি ঘটে গেল, ওটার কথা ভুলে গেলুম। একটুও মনে ছিল না। হঠাৎ প্যান্টটা কাঁচতে গিয়ে–মানে, কলকাতা ফেরার পরেই, মনে পড়ে গেল। তখনও ওটার গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু স্মিতা পরে যখন…
কিন্তু তবু ওটা ফেলে দাওনি।
শান্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, কর্নেল, আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। নিজের অনেক আচরণের অর্থ নিজের কাছেই স্পষ্ট হয় না। যেমন ধরুন, খুব চেনা লোককেও হঠাৎ কখনও কখনও ভীষণ অচেনা লাগে! তার। ফলে বোকার মতো তাকে তার পরিচয়, চেয়ে বসি। পরে লজ্জা পাই। আমি ভীষণ অন্যমনস্ক মানুষ, কর্নেল!
স্মিতা নড়ে উঠল।…হ্যাঁ হ্যাঁ। সে রাতে যখন শান্ত আর আমি কবরখানার দালানের ওপরতলায় যাচ্ছিলুম, হঠাৎ শান্ত আমাকে বলে বসল–আপনি কে? জানেন কর্নেল, আমি কী চমকে গিয়েছিলুম?
কর্নেল বললেন, তোমাদের ইউনিটে এমন প্রশ্ন আর কাকেও করেছিলে শান্ত? স্মরণ করতে পারো?।
শান্ত একটু ভেবে জবাব দিল, ঠিক মনে পড়ছে না। কেন, কর্নেল?
এমনি। যাক গে, তোমরা কফি খেতে-খেতে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
ষষ্ঠী ট্রে রেখে ওদের দুজনকে দেখতে-দেখতে বেরিয়ে গেল।
কর্নেল বললেন, পুলিসের ফাইলে তোমাদের প্রত্যেকের জবানবন্দি বা সাক্ষ্য আছে। তোমরা আর কী গোপন করেছ?
স্মিতা বলল, দালানের ওপরতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট কাকেও দেখেছিলুম। শান্ত বলেছিল, ওর নাকি অনেক পোষা বাঁদর আছে–অন্ধকার কবরখানায় ছেড়ে দেবে। বলে হাসতে লাগল সে।
কর্নেল বললেন, বাঁদর!
শান্ত বলল, ও আমার একটা হবি। সত্যিকার বাঁদর না–নিতান্ত কাল্পনিক। যখন কিছু ভালো লাগে না, মনে অস্বস্তি থাকে–সে দিন বা রাত যখনই হোক, কল্পনায় অজস্র বাঁদর নিয়ে খেলা করি। ওদের ছেড়ে দিয়ে ছুটোছুটি দেখি। গণ্যমান্য লোক রাস্তায় যেতে দেখলেই তার কাঁধে… সে হাসতে লাগল।
হঠাৎ স্মিতা বলল, আরেকটা ব্যাপার পুলিসকে বলি নি। বলতে লজ্জা। পেয়েছিলুম। জানি না, তা কোন কাজে লাগবে কি না।
লাগতে পারে বলো। কর্নেল কী ভাবতে-ভাবতে বললেন।
মিঃ ভট্ট আমাকে বাইরে তার গাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব বিশ্রি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন!
ফিল্ম সংক্রান্ত?
হ্যাঁ–ফিল্ম সংক্রান্ত। তবে… মুখ নিচু করল স্মিতা।
শান্ত বলল, উদ্ভট লজ্জা তোমার, স্মিতা। আমি বলে দিচ্ছি কর্নেল। ওকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হিরোর সঙ্গে সেক্সয়াল ব্যাপারে লিপ্ত হতে হবে বলেছিলেন মিঃ ভট্ট। সেই দৃশ্য তিনি ক্যামেরায় তুলবেন।
হিরো কে?
তখনও ঠিক ছিল না। আমরা তো মোটে দুজন ছিলুম। যে-কোন একজনকে সম্ভবত হিরো করতেন মিঃ ভট্ট। আগে থেকে কোন প্ল্যান ছিল না ওঁর। কোন লিখিত কাহিনী বা স্ক্রিপ্ট–কিছু না।
জানি। ক্যামেরা ওঁর কলম। তা তুমি রাজি হয়েছিলে স্মিতা?
স্মিতা জোরে মাথা দোলাল।
সেটাই স্বাভাবিক। তারপর?
শান্ত বলল, একই প্রস্তাব উনি শ্রীলেখাকেও দিয়েছিলেন। তিনিও রাজি হননি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আবার আমরা মিঃ ভট্টের প্রতি সন্দেহের বোঝা চাপাচ্ছি। কিন্তু পুলিস রিপোর্ট বলছে, মিঃ ভট্ট–যাকে বলে, খুব ঝরঝরে পরিষ্কার-মানে ক্লিন। কোনো পিছনের কালো চিহ্ন নেই। খ্যাতিমান, শিক্ষিত, অভিজাতবংশীয় মানুষ। একটু খামখেয়ালি–এই যা। প্রতিভাবান শিল্পীরা। খামখেয়ালি না হওয়াটাই সন্দেহজনক।–বলে কর্নেল একটু হাসলেন।
শান্ত বলল, না কর্নেল, ওঁকে সন্দেহ করছি না। আমি অনেক ভেবেছি ভেবে শুধু মনে হয়েছে, ফিল্ম ইউনিট নিয়ে ওই লোকেশনে যাবার পরই অমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটল–সে কি নিতান্ত আকস্মিক যোগাযোগ?
কেন একথা তোমার মনে হচ্ছে?
ওই কাগজটা আমাদের আস্তানায় পড়ে থাকার পর থেকেই মনে হচ্ছে। কথাটা। তাছাড়া বলেছি, আমার একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ছিল।
এখানে ফেরার পর মিঃ ভট্টের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়েছে তোমাদের?
হ্যাঁ। উনি দুদিন আগে আবার কোথায় একটা লোকেশন দেখতে গেছেন। বলেছেন, ফের আমাদেরই নিয়ে যাবেন।
তুমি যাবে?
যাব বই কি।
স্মিতা?
স্মিতা প্রবল মাথা দুলিয়ে বলল, মোটেও না। ফিল্মে নামার সখ মিটে গেছে আমার।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা। এবার বলো, শান্ত, সে রাতে আর এমন কিছু দেখেছিলে–যা পুলিসকে বলনি?
শান্ত বলল, যা সব দেখেছিলুম, তা ভালই জানি–আমারই মাথার উদ্ভট চিন্তার ফসল। যেমন ধরুন, সব সময় মনে হচ্ছিল পিছনে কে এসে দাঁড়াল। কিংবা কী যেন ঘটতে চলেছে ষড়যন্ত্র হচ্ছে…এইসব। তাছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনে।
ওপরতলায় কাকে সিগারেট খেতে দেখেছিলে–তোমাদের সবাই অবশ্য তা দেখেছে, রিপোর্টে দেখলুম। কিন্তু কথা হচ্ছে–তাহলে এটা পরিষ্কার যে ওই সময় বাইরের কেউ সেখানে ছিল। তোমার কী মত, শান্ত? নিশ্চয় সবাই একসঙ্গে একই কল্পনা করে না।
শান্ত বলল, আমি ভেবেছিলাম–সিতারার কোন প্রেমিক।
তাহলে অনায়াসে আমরা পুলিসের মতই তার ঘাড়ে সব দায় চাপাতে পারি।
কেন? সিতারার প্রেমিক সিতারাকে খুন করবে কেন? শান্ত বলল।
কবরের ধনরত্ন চুরি করাই আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল। তাই…
শান্ত বাধা দিয়ে বলল, সিতারাকে আপনি দেখেননি কর্নেল। ওর যে প্রেমিক, সে কবরের ধনরত্নের চেয়ে দামী ধনরত্নের মালিক।
কর্নেল হেসে বললেন, তুমি খুব ভাবপ্রবণ ছেলে। সুন্দরীদের চেয়ে ধনরত্ন এখনও পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষের পরম কাম্যবস্তু। স্মিতা, আশা করি এ মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হবে না। শান্তর পাওয়া কাগজে অবশ্য উল্টো কথা লেখা আছে। কিন্তু মাইন্ড দ্যাট–এ ভাষণ কার, এখনও আমরা জানি না।
শান্ত বলল, কার হতে পারে?
কোন খোজার।
শান্তর চোখ উজ্জ্বল হল। উত্তেজিত মনে হল তাকে। কিন্তু তক্ষুনি আবার সে স্বভাববশে ঠাণ্ডা হয়ে পড়ল। বলল, কর্নেল, আপনি একটা অন্ধকার জায়গায় আলো ফেলছেন মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় এই কাগজটা কোন পুরনো বই বা দলিল-টলিলের কপি?
তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, শান্ত। আমারও তাই মনে হচ্ছে।
স্মিতা বলল, কর্নেল, শ্রীলেখাদিকে আসতে বলব আপনার কাছে?
আসতে বলার দরকার নেই। আমি নিজেই যাব। ওঁদেরও আমার দরকার।
শান্ত বলল, কিন্তু আমার মনে হয়–শ্রীলেখাকে পেলেও সায়ন্তনবাবুকে খুঁজে পাবেন না।
কেন? ওঁর ঠিকানা তো পুলিসের কাছে আছে।
গিয়ে দেখবেন, বাসা বদলেছে।
সে কী? কেন?
শান্ত হঠাৎ হেসে ফেলল।–সায়ন্তন ভীষণ ভীতু ছেলে। তবে সেজন্যে নয়–আসলে ফিল্মে নামবার জন্যে ও ওই ছদ্মনাম নিয়েছে। ওর আসল নাম হচ্ছে, ফরিদ আমেদ।
স্মিতা বলল, ভ্যাট! আমি বাজি রাখব–ও কখনো ফরিদ আমেদ নয়। হতেই পারে না। ওর চেহারা…
কর্নেল হাত তুলে বললেন, চেহারায় আমাদের ধর্মসম্প্রদায়ের কোন পরিচয় থাকে না স্মিতা!
শান্ত হাসতে হাসতে বলল, স্মিতাদের প্রেমভালোবাসা পাবার পক্ষে ওই নামটা খুব হোপফুল। এবং স্মিতা ভুরু কুঁচকে নিঃশব্দে শাসালে কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন।
পরক্ষণে ফের গম্ভীর হয়ে বললেন, এবার কাজের কথায় আসা যাক।…
.
৫. আজব সুর্মা ও বাঁদর পর্ব
মুর্শিদাবাদ পৌঁছতে রাত হয়েছিল। তখন খোঁজা গোরস্তানে যাওয়া নিরর্থক। কর্নেল আগেই নবাবী মহাফেজখানায় পুরনো দলিল আর বইপত্তর দেখার অনুমতি যোগাড় করে রেখেছিলেন। ট্রাস্টি বোর্ডের এক ভদ্রলোকের সাহায্যে সেই রাতেই তিনি মহাফেজখানায় গেলেন। বিশেষ ব্যবস্থা মতো মহাফেজখানার জিম্মাদার তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এই জিম্মাদার ভদ্রলোক নবাব বংশীয়। ঐতিহাসিক বিষয়ে মোটামুটি ওয়াকিবহাল। কর্নেল তাকে খোজা নবাব উপাধিধারীদের কোন রেকর্ড থাকলে দেখাতে অনুরোধ জানালেন। জিম্মাদার একটা কাঠের বিরাট বাকসো থেকে কতকগুলো মোটা কেতাব বের করলেন।
পাতা উল্টে কর্নেল দেখলেন, সবই উর্দু-ফারসিভাষায় লেখা। জিম্মাদারের সাহায্যে খোঁজা গোরস্তানে কার কার কবর আছে, নোট করার পর তিনি বললেন, কোন ইংরেজি কেতাব নেই? কিংবা কোন ইংরেজি দলিল-দস্তাবেজ?
জিম্মাদারের নাম নবাব মীর্জা আসমত খাঁ। বয়স প্রায় পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। সাদা ঢিলে আচকান পরনে, চুড়িদার পাজামা, মাথায় গোল টুপি। খুব অমায়িক হাসি মুখে লেগে রয়েছে। শীর্ণতার দরুন একটু কুঁজো হয়ে কর্নেলের কথা শুনে মৃদু হেসে বললেন, আংরেজি! সায়েব, খোঁজা লোগোকো আমলমে আংরেজিকা কই জরুরৎ নেহি থা।
কর্নেল বললেন, ঠিক, ঠিক। কিন্তু মীর্জাসায়েব, খোজা নবাব জরজিশ বেন্নার কিছু ইতিহাস আমার যে চাই-ই।
মীর্জাসায়েব একটু ভেবে ভাঙা বাংলায় বললেন, যার গোর থেকে খাজানা। চুরি হোয়েসে?
জি হ্যাঁ, মীর্জাসায়েব!
আচ্ছা, আচ্ছা। হাম হুঁড়কে দেতা। ঠারিয়ে।..বলে মীর্জাসায়েব বাকসোর ভিতর ঝুঁকে কতকগুলো বই বের করলেন। ঘরে যে বাল্ব জ্বলছে, তার আলো প্রখর নয়। চোখের কাছে ধরে একটার পর একটা জীর্ণ পোকায় কাটা কেতাবগুলো তিনি দেখতে আর একপাশে রাখতে লাগলেন। কর্নেল তার পাশে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী হয়ে লক্ষ্য করছিলেন।
সমস্ত বই দেখা হয়ে গেলে মীর্জাসায়েব চিন্তিত মুখে ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে কাকে ডাকলেন, ইউনুস! আবে ইউনুস আলি! ইধার আ জলদি।
বেয়ারার পোশাক পরা একটা ফো লোক দৌড়ে এল দরজার বাইরে থেকে। সেলাম দিয়ে বলল, বোলিয়ে নবাবসাব?
ইউনুস, আগলা মাহিনামে কালকাত্তাসে এক সাব আয়া, তেরা খ্যাল। হ্যায়?
জী হাঁ জরুর। তো উসকো সাথ এক ঔরৎভি থী। উও ঔরৎ বাহার মে বৈঠকী থী। ঘুমকর সব দেখ রহী থী। ঔর সাব কেতাব পড়তা।
মীর্জাসায়েব কর্নেলের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্নমুখে যা বললেন, তার মোদ্দা। কথা এই :
গত মাসের মাঝামাঝি কলকাতা থেকে এক ভদ্রলোকে আসেন সস্ত্রীক। কীভাবে অনুমতি যোগাড় করে মহাফেজখানায় ঢোকেন। মীর্জা তাকে ঘুরে-ঘুরে যখন সব ঐতিহাসিক কেতাব আর দলিলপত্রের বিরাট সংগ্রহশালা দেখাচ্ছে, হঠাৎ ভদ্রলোক বলেন, খোজা নবাবদের সম্পর্কে তিনি একটি বই লিখছেন। কিছু উপকরণ দরকার। মীর্জাসায়েব যদি তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন, সাধ্যমত বখশিশ দেবেন। বখশিশ কথাটা অপমানজনক। কিন্তু যে জামানা পড়েছে, প্রবল প্রতাপান্বিত শাসকবংশের এক হতভাগ্য সন্তান মীর্জাসায়েবকে মাত্র মাসিক ষাটটি টাকার চাকরি করতে হচ্ছে। বাড়িতে অনেক পুষ্যি। কেল্লাবাড়ির ভিতর বস্তিবাড়ির মতো একটা কুঁড়েঘরে ঠাসাঠাসি বাস করতে হচ্ছে। কী করা যায়। অগত্যা তিনি রাজি হন। প্রায় চারঘণ্টাব্যাপী সেই অথর ভদ্রলোককে তিনি খোঁজাদের সম্পর্কে অনেক ফারসী বই ঘেঁটে তথ্য অনুবাদ করে দেন। ভদ্রলোক বাঙালি–কিন্তু ইংরিজিতেই সব টুকছিলেন। বিকেল হয়ে যায়। তখন ভদ্রলোক চলে যান। তারপর কেতাব-দলিলপত্র বাকসে ভরে যথারীতি তালা আটকান মীর্জাসায়েব। তারপর আজ অব্দি খোলেননি। কিন্তু অবাক কাণ্ড, খোজা নবাব জরজিশ বেন্নার নিজের হাতে লেখা ফারসী। রোজনামচাটি গেল কোথায়? কেতাবটির মধ্যে চমৎকার কতকগুলো বয়েৎ বা পদ্য ছিল জরজিশ বেন্নার রচিত। কয়েকটা মুখেমুখে অনুবাদ করেছিলেন মীর্জাসায়েব। ভদ্রলোক তার ইংরেজি করে টুকছিলেন–মীর্জাসায়েব লক্ষ্য করছিলেন। মোটামুটি ইংরিজি জানেন বলে এসব টের পাচ্ছিলেন।
কর্নেলের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। কিন্তু হঠাৎ সেই আগন্তুক ভদ্রলোক– তিনি যেই হোন, খোঁজাদের সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠলেন কেন? এও কি নিতান্ত আকস্মিক যোগাযোগ? যদি ধরা যায়, তার সঙ্গে খোঁজা জরজিশের কবরের গুপ্তধন চুরির বা পাহারাওলা দম্পতির হত্যার কোন যোগাযোগ থাকে–তাহলে প্রশ্ন ওঠে : খোঁজাদের কারো কবরে গুপ্তধন আছেই–এ তথ্য আগে না জানা থাকলে তিনি কেন মহাফেজখানায় দলিল খুঁজতে আসবেন? এবং সেটাই মূল প্রশ্ন : তিনি কীভাবে কার কাছে জানলেন যে ওখানে কবরে গুপ্তধন আছে?
কর্নেল বললেন, সেই ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা কোথায় পাব বলতে পারেন?
মীর্জাসায়েব ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তাঁর মুখের অমায়িক হাসিটি মিলিয়ে গেছে। চাপা গলায় আর্তস্বরে বললেন, সাব, আব ম্যায় ক্যা করু? মেরা নোকরি খা লেগা জরুর! বালবাচ্চাকো ক্যায়সে বাঁচাউঙ্গা হাম?
কর্নেল বললেন, মীর্জাসায়েব, আমার পরামর্শ শুনুন। কেতাব চুরির ব্যাপারটা আপনি এক্ষুনি পুলিশ আর ট্রাস্টি বোর্ডকে জানিয়ে দিন। আসুন, আপনাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি।
মীর্জাসায়েব খুব ভালো করে তালা আটকে কাঁপতে কাঁপতে কর্নেলের সঙ্গে বেরোলেন। তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। থানার অফিসার-ইন-চার্জ মিঃ ভদ্র কর্নেলের পরিচিত। সেখানে মীর্জাসায়েবের ডায়েরি লেখানোর পর ভদ্রলোক মনমরা হয়ে চলে গেলেন। কর্নেল ফোন করলেন ট্রাস্টি বোর্ডের সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে–যিনি মহাফেজখানায় যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন।
ভদ্রলোক নবাববংশীয় কেউ নন। স্থানীয় মানুষ এবং মিউনিসিপ্যালিটির সদস্য। পেশায় উকিল। বাড়িতে ফোন থাকায় সুবিধে হয়েছিল যোগাযোগ করার। কর্নেল বললেন, হ্যালো মিঃ আচার্য! নমস্কার। এইমাত্র মহাফেজখানা থেকে ফিরলুম।
কোন সূত্র পেলেন স্যার?
সামান্য। আচ্ছা মিঃ আচার্য, গত মাসের মাঝামাঝি কাকেও কি মহাফেজখানা দর্শনের অনুমতিপত্র দিয়েছিলেন?
একটু ভেবে মিঃ অবনী আচার্য বললেন, কাকে যেন দিয়েছিলুম। খাতাপত্র না দেখে বলা মুশকিল স্যার। বুঝতেই পারছেন–সবসময় মামলা আইন-কানুন। নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয়। অবশ্য মহাফেজখানার অনুমতি সচরাচর আমরা কাকেও দিই না। তবে ব্যতিক্রম অর্থাৎ স্পেশাল কেস সবক্ষেত্রেই থাকে। কর্নেল, প্লিজ–একমিনিট। ধরে থাকুন।
একটু পরে মিঃ আচার্য বললেন, পেয়েছি। দিয়েছিলুম। নাম শুনলেই চিনতে পারবেন স্যার। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ দীননাথ হোড়। নবাবী আমলের বাংলার ইতিহাস নতুন করে লেখার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থা ওঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সে-সব কাগজপত্র অবশ্য উনি সঙ্গে এনেছিলেন। জনৈক মন্ত্রীর সুপারিশও ছিল। তবে ওঁর মতো প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে ওসব আমি খুঁটিয়ে দেখার দরকার মনে করিনি–জাস্ট অ্যাট এ গ্ল্যান্স দেখেছিলুম। কিন্তু কেন একথা জানতে চাইছেন কর্নেল?
খোজা নবাব জরজিশ বেন্নার রোজনামচা অর্থাৎ ডাইরিটি চুরি গেছে।
সে কী! সে কী!
শুনুন প্লিজ! এর জন্যে হঠাৎ বেচারা জিম্মাদারের ওপর ক্রুদ্ধ হবেন না। সম্ভবত ব্যাপারটা ওঁর অজান্তে ঘটেছে।
কী সর্বনাশ!
মীর্জাসায়েব কেমন লোক, মিঃ আচার্য?
ভেরি ভেরি অনেস্ট অ্যান্ড জেন্টলম্যান। ধর্মভীরু। খুব সিনসিয়ার প্রকৃতির।
অ্যান্ড এ ভেরি সিম্পল ম্যান। ওঁর সরলতার সুযোগ নিয়েছে কেউ।
কে নিতে পারে সুযোগ? আর কাকেও তো অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর মহাফেজখানায় যাবার একটিমাত্র পথ। সে-পথে তিন জায়গায় তিনটি রীতিমতো অফিস পেরিয়ে অর্থাৎ তিনটি জায়গায় একাধিক লোকের চেকিং-এর পর, ঢুকতে দেওয়া হয়। তা আশা করি লক্ষ্য করেছেন।
না। কারণ, আমি অসময়ে গেছি। তখন তিনটি অফিসেই কেউ ছিল না।
স্যরি। তাই তো। আমার ভুলো মন স্যার। আইন আমাকে খেল!
মিঃ আচার্য, আগে কখনও ডঃ দীননাথ হোড়কে আপনি দেখেছিলেন?
না তো! না না হ্যাঁ, দেখেছিলুম। খবরের কাগজের ছবিতে।
চেহারাটা মনে ছিল?
আবছা ছিল।
সেই ভদ্রলোককে ডঃ হোড় মনে হয়েছিল কি?
দেখুন কর্নেল, খুব মিলিয়ে অবশ্য দেখার কথা ভাবিনি। কারণ, ওইসব কাগজপত্র, সুপারিশ ওঁর সঙ্গে ছিল। তাছাড়া, উনি নিজে পরিচয় দিলেন যখন–আর অবিশ্বাস করার মতো অভদ্রতা আমার মাথায় আসেনি। স্যার, আফটার অল…আমি তো পুলিস নই যে সব সময় সন্দেহ রাখব মনে!
কিন্তু আপনি আইনের কারবারী।
স্যার, সব সময় আইন নিয়ে থাকা কি..।
কিন্তু আপনি বলছিলেন, আইন আপনাকে খেল!
কর্নেল, আপনি আশা করি রসিকতাই করছেন?
মিঃ আচার্য, আপনি, মহাফেজখানার মতো একটা ভীষণ মূল্যবান জায়গার অনুমতিপত্র দেবার অধিকারী। আপনার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
কেন স্যার? কেন স্যার?
ডঃ হোড় কি একা ছিলেন?
না–সস্ত্রীক!
ডঃ হোড়ের স্ত্রীর বয়স অনুমান করতে পারেন?
স্ত্রীলোকের বয়স অনুমান করা কি আমার পক্ষে সম্ভব কর্নেল? তা–ত্রিশ বত্রিশ হতে পারে–এইটুকুই বলা যায়।
চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন?
ছিপছিপে গড়ন–বেশ সুন্দরীই বটে। চোখে চশমা ছিল। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হলে যা হয়–খুব চঞ্চল আর সৌখিন মনে হচ্ছিল।
ঠিক আছে। বিরক্ত করার জন্যে কিছু মনে করবেন না আশা করি।
কী যে বলেন স্যার। আমি সামান্য জনসেবক মাত্র।
মিঃ ভদ্রর দিকে তাকিয়ে কর্নেল ফোন রেখে বললেন, ডঃ দীননাথ হোড় তিনমাস আগে রাশিয়া গেছে। বিশ্ব-ঐতিহাসিকদের একটা সেমিনার উপলক্ষে। এখন উনি ইংলন্ডে আছেন। এরপর ফের রাশিয়া হয়ে সামনে সেপ্টেম্বরের শেষে ফেরার কথা।
কী কাণ্ড! মিঃ ভদ্র বললেন।–তাহলে সেই ভদ্রলোক জাল পণ্ডিত?
ঠিক তাই।
কিন্তু তিনিই বা খোঁজাদের ব্যাপারে উৎসাহী হলেন কেন? কোত্থেকে জানলেন যে…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, সে প্রশ্নই তো আমার মূল প্রশ্ন। অন্তত খোঁজা গোরস্তানে কোন কবরে গুপ্তধন আছে, এ খবর কীভাবে সে পেল?
আচ্ছা কর্নেল, ইয়াকুব খান পাহারাওলা পুরুষানুক্রমে ওখানে বাস করছিল। ধরুন, এমনও হতে পারে–এ বিষয়ে সে কিছু জানত।
কর্নেল হাসলেন। কিন্তু তার কাছে আর কোন খবর তো জানা যাচ্ছে না। এমন কি তার বিবির কাছেও না।
সেই সময় ফোন বেজে উঠল। মিঃ ভদ্র ফোনটা ধরে বেশ জোরে কথা বলছিলেন–হ্যালো! হা-মুর্শিদাবাদ কোতয়ালি। কে? জয়ন্তবাবু? আমি ভদ্র বলছি। না–গুপ্ত বহরমপুরে আছেন–সকালে আসবেন। কর্নেল? হ্যাঁ–আছেন। এখানেই আছেন। যা বাবাঃ! বলছি প্যালেস হোটেলে নয়–এখানেই আছেন। দিচ্ছি।
কর্নেলের দিকে ফোনটা এগিয়ে মিঃ ভদ্র বললেন, লালবাজার থেকে ট্রাঙ্ককল। জয়ন্ত চ্যাটার্জি।
কর্নেল ফোন ধরে বললেন, হ্যালো জয়ন্ত। হঠাৎ কী ব্যাপার?
প্যালেস হোটেলে একবার চেষ্টা করেছি ঘণ্টাখানেক আগে। ম্যানেজার বলল, এসেই বেরিয়েছেন। একবার ভাবলুম ভদ্রর কাছে একটা রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে দিই–পরে ট্রাঙ্ককলই করে ফেললুম।
বেশ করেছ, বলো।
সোমনাথ ভট্টের গাড়ি নিয়ে সমস্যায় পড়া গেছে।
তার মানে?
সোমনাথ ভট্ট আজ পুলিসে জানিয়েছেন–তাঁর গাড়িটা গ্যারেজে আটকে রেখে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে পাচ্ছেন না।
সে কী! তিনি গাড়ি নিয়ে যাননি সঙ্গে?
না। একা গিয়েছিলেন প্রতাপগড়ে লোকেশন দেখতে।
কী আপদ! প্রতাপগড়? আমি যেখানে যাচ্ছিলুম?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু তার চেয়ে যেটা জরুরী খবর, সেটা এবার শুনুন। সোমনাথবাবু প্রতাপগড় যান তেরই জুলাই–দা আনলাকি থারটিন। গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওখানে এক আত্মীয়বাড়ি ছিলেন বরাবর। ফিরেছেন চব্বিশে জুলাই-আজ সন্ধ্যায়।
বলো কী।
যে সোমনাথ ভট্ট মুর্শিদাবাদ যান, তিনি জাল সোমনাথ।
আমরা এখানে আরেক জাল ডঃ দীননাথ হোড়ের খবর পেলুম। তিনি নবাবী মহাফেজখানার একখানি কেতাব হাতিয়েছেন। ডিটেল্স পরে বলবখন। এখন তোমার সোমনাথ ভট্টের খবর বলো।
আসল মিঃ ভট্ট পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দা নন। থাকেন হীরেন বোস রোডে। ফ্ল্যাটের নিচের তলায় গ্যারেজ আছে। গাড়ি আটকে রেখে গিয়েছিলেন। কাকেও কিছু বলে যাননি গাড়ির ব্যাপারে। বাড়িতে কোন দরোয়ানও নেই। নিচের তলায় গ্যারেজের পাশে একটা ঘরে একটি গরিব অ্যাংলো পরিবার থাকে। পুরনো ভাড়াটে। বাড়িটা যখন একতলা ছিল, তখন থেকেই তারা আছে। বাড়িওলা তাড়াতে না পেরে তাদের ওপর একটা দায়িত্ব চাপিয়ে রেখেছে। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা তিনবার করে পাম্প চালিয়ে ছাদের ট্যাঙ্কে জল তোলবার। গ্যারেজ আছে চারটে! চারটেতেই গাড়ি থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার। চারটে গাড়িরই কোন ড্রাইভার নেই। মালিকরা নিজেরা চালান। অ্যাংলো ভদ্রলোককে কেউ কেউ বলেন অবশ্য রাত্রে গ্যারেজগুলো লক্ষ্য রাখার জন্যে। কিন্তু তার দায় কিসের? সে বেদম মদ খেয়ে বউ ঠ্যাঙায়। তারপর দুজনে কান্নাকাটি করে ঘুমোয়। এসব গরিব ফ্যামিলিতে যা হয়ে থাকে।
তারপর?
অ্যাংলো ভদ্রলোক আর তার বউ বলে, ষোল জুলাই সন্ধ্যা অব্দি গাড়িটা তারা দেখেছিল। তারপর আর দ্যাখেনি। ভেবেছিল মিঃ ভট্ট ফিরে এসে নিয়ে গেছেন কোথাও। মাঝে মাঝে উনি কিছুদিন ধরে গাড়ি নিয়ে বাইরে কাটান– ওরা দেখেছে। অন্য ফ্ল্যাটেরও সবাই দেখেছে। তাই কারো মনে কোন সন্দেহ হয়নি।
জাল ভট্টসায়েব কলকাতা ফেরেন কবে? কখন?
উনিশে জুলাই সকালবেলা। মুর্শিদাবাদ থানা থেকে ওঁদের জেরা করে ছাড়তে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। গাড়িতে শান্ত, সায়ন্তন, শ্রীলেখা আর। স্মিতা ছিলেন। ওদের সবাইকে শ্যামবাজার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।
শান্তর সঙ্গে আবার জাল ভট্টর দেখা হয়েছিল, তুমি জানো?
একটু আগে শান্তর কাছে গিয়েছিলুম। শুনলুম।
গাড়িটার জন্যে তোমরা নিশ্চয় সবখানে লক্ষ্য রেখেছ?
তা আর বলতে?
ঠিক আছে জয়ন্ত। ছাড়ছি। সময় মতো ডেভেলপমেন্টগুলো জানিও। আপাতত–আমি অবশ্য পাহারাওলা দম্পতির মৃত্যুর কারণ খুঁজতে একটু ব্যস্ত থাকব। উইশ ইউ গুড লাক। ছাড়লুম।…
.
সকালে কর্নেল মিঃ ভদ্রকে নিয়ে পায়ে হেঁটে শহর ছাড়িয়ে একটা বড় রাস্তায় পৌঁছলেন। খোঁজা গোরস্তান মোটামুটি তার পরিচিত জায়গা। পাহারাওলা দম্পতির মৃত্যুর পর ট্রাস্টি বোর্ড এবং পুলিসের কড়া পাহারা মোতায়েন করা হয়েছে। আর কোন্ কবরে যে গুপ্তধন নেই, তা কে বলতে পারে? কর্নেল পৌঁছে দেখলেন বাইরের ছোট্ট মাঠে একটা সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর তাঁবু পড়েছে। ফটকের কাছে দুজন দরোয়ান, আর দুজন কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। মিঃ ভদ্রর হুকুমে ওরা গেট খুলে দিল।
কর্নেল প্রথমে গেলেন সেই গুপ্তধনের কবরটার কাছে। কবরটায় আবার পাথরের কবাট চাপা দেওয়া হয়েছে। ফাটলগুলো সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করাও হয়েছে। খোজা নবাব জরজিশ বেন্নার ফারসি অক্ষরে পরিচিত লেখা ফলকটা রয়েছে যথাস্থানে। কর্নেল খুঁটিয়ে কবরের চারপাশে লক্ষ্য করলেন। কিন্তু তেমন কিছু নজরে এল না। বললেন, মিঃ ভদ্র, ইয়াকুব খাঁ কোথায় মরে পড়েছিল– সেই জায়গাটা একটু দেখতে চাই।
মিঃ ভদ্র বেন্নার কবর থেকে প্রায় পাঁচ মিটার দক্ষিণে একটি কবরের কাছে এসে বললেন, এখানে।
কর্নেল সেখানে বসে পড়লেন। এ কবরটা সাদা পাথরের। মাথার কাছে যথারীতি ফরাসি লিপিতে মৃতের পরিচয় রয়েছে। হঠাৎ কর্নেলের চোখে পড়ল, কবরের মাথার দিকে স্ক্রিপ্টটার তলায় একটা ঢ্যারা চিহ্ন রয়েছে। খুব ছোট্ট চিহ্ন। সহজে চোখে পড়ে না। কোন ছুঁচলো জিনিস দিয়ে চিহ্নটা খোদাই করা হয়েছে।
কর্নেল মিঃ ভদ্রকে কিছু বললেন না সে সম্পর্কে। গতরাত্রে মহাফেজ খানায় গিয়ে জিম্মাদারের কাছে কবর ও মৃত খোঁজাদের বিষয়ে যে নোট নিয়েছিলেন, পকেট থেকে বের করে মিলিয়ে দেখলেন। পরক্ষণে অবাক হয়ে গেলেন। তৃতীয় সারির এই চতুর্থ কবরটি খোজা নবাব দ্বিতীয় জরজিশ বেন্নার!
তার মনে পড়ল, ইয়াকুব খাঁর পাশে একটা শাবল পড়েছিল। তাহলে কি সে-রাতে ইয়াকুব নিজেই দ্বিতীয় জরজিশ বেন্নার কবর খুঁড়তে এসেছিল? কবরের খাঁজে খাঁজে প্রচুর শ্যাওলা আর আবর্জনা জমে রয়েছে। কর্নেল সেগুলো সরাতেই তার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হল। এক জায়গায় শক্ত পাথরের জোড়ের মুখে শাবলের দাঁতের দাগ খুব স্পষ্ট।
মিঃ ভদ্র সেটা দেখতে পেয়ে শুধু বললেন, আরে, কী কাণ্ড!
কর্নেল চিন্তিত মুখে বললেন, সম্ভবত ইয়াকুব খাঁ এই কবর খুঁড়তে এসেই কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে হার্টফেল করে। মর্গের রিপোর্ট যদি নির্ভুল হয়, তাহলে এই সিদ্ধান্তই সঠিক বলে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু আজীবন যে কবরখানায় কাটিয়েছে, সে এমন কী দেখে ভয় পেতে পারে? যাক গে, চলুন–এবার সিতারা বিবি যেখানে পড়ে ছিল সে জায়গাটা দেখি।
সিতারা পড়েছিল দক্ষিণের দালানটার খুব কাছে। শেষ তিনটি কবরের মাঝামাঝি জায়গায়। কর্নেল খুব খুঁটিয়ে দেখলেন। কিন্তু তেমন কিছু খুঁজে পেলেন না।
এবার দুজনে ইয়াকুব খাঁর ঘরে গেলেন। ঘরে জিনিসপত্র বিশেষ কিছু নেই– কিছু হাঁড়ি ও বাসনপত্র, বাঁশের আলনায় কিছু কাপড়-চোপড়, খাঁটিয়ার নিচে একটা তোরঙ্গ। পুলিস সব সেদিনই তন্ন তন্ন খুঁজে দেখেছে কিছু সূত্র যদি মেলে, পায়নি। তারপর সিল দিয়ে তালা আটকে দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা অফিসার মিঃ গুপ্তর নির্দেশে। কর্নেল প্রত্যেকটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, ইয়াকুব বা তার বউয়ের এসব জিনিসপত্র কেউ দাবি করতে আসেনি?
মিঃ ভদ্র বললেন, একজন দরখাস্ত করেছে। সিতারার দাদা। সে লোকটা আবার নবাববংশীয়। ভীষণ গরিব। হেকিমি চিকিৎসা করে সংসার চালায়। থাকে আস্তাবল এলাকার একটা বস্তিতে। আমরা তদন্ত শেষ না হলে জিনিসগুলো ওকে দিতে পারব না–জানিয়ে দিয়েছি।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে একটা তাকে শিশি-বোতলগুলো দেখছিলেন। একটা সুরমাদানি তুলে নিয়ে বললেন, খান্দানি মুসলিমদের মধ্যে এখনও চোখে সুরমা লাগানোর রেওয়াজ প্রচুর। লক্ষ্ণৌ অঞ্চলে দেখেছি। এরাও লাগাতে দেখছি!
মিঃ ভদ্র হেসে বললেন, হ্যাঁ। ইয়াকুব আর তার বউয়ের চোখেও সুরমা দেওয়া ছিল। মর্গের রিপোর্টে উল্লেখ আছে, নিশ্চয় দেখেছেন?
দেখেছি। আমি জানি, অনেকে শুতে যাবার আগে চোখে পুরু করে সুরমা লাগিয়ে নেয়। এতে নাকি সুনিদ্রা হয়। আমার এক মুসলিম বাবুর্চি ছিল। তাকে তো প্রতিরাতে শোবার সময় দেখতুম, বিছানায় বসে আয়না নিয়ে চোখে সুরমা লাগাচ্ছে!
কর্নেল একটু হেসে সুর্মাদানিটা পকেটে ভরে নিলেন। তারপর কাঞ্চনফুলের গাছটার দিকে চললেন। মিঃ ভদ্র সকৌতুকে বললেন, কর্নেল কি সুরমা লাগাবেন চোখে!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, আমার সুনিদ্রার খুব দরকার।
গাছটার তলায় একদিকে কবর, অন্যদিকে মাটির চত্বর। কাদায় গাড়ির চাকার দাগ রয়েছে। কর্নেল সেখানটা লক্ষ্য করছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, আচ্ছা মিঃ ভদ্র, এদিকে ভীষণ বাঁদরের উপদ্রব আছে–তাই না?
মিঃ ভদ্র বললেন, না বাঁদর কোথায়? হনুমান। প্রচুর হনুমান দেখতে পাওয়া যায় এ অঞ্চলে। কেন স্যার?
কর্নেল এক জায়গার মাটি লক্ষ্য করে বললেন, ওগুলো কি হনুমানের পায়ের দাগ?
মিঃ ভদ্র কয়েকমুহূর্ত দেখার পর বললেন, হ্যাঁ–সেই রকমই? মনে হচ্ছে।
কর্নেল হেসে উঠলেন। কিন্তু কোন কথা বললেন না।
মিঃ ভদ্র কৌতূহলী হয়ে বললেন, হঠাৎ হাসলেন যে কর্নেল?
শান্ত নামে সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ল।
কী কথা বলুন তো?
তার মাথায় নাকি অনেক পোষা বাঁদর আছে। মাঝে মাঝে ছেড়ে দিয়ে মজা উপভোগ করে সে। সতেরই জুলাই রাতে ও সেগুলো এই গোরস্তানে ছেড়ে দিয়েছিল অন্ধকারে। বুঝুন কাণ্ড।
মিঃ ভদ্র বিস্মিত হয়ে বললেন, অদ্ভুত তো?
হ্যাঁ–শান্ত ছেলেটিই আসলে অদ্ভুত! আমার ধারণা ও এখনও অনেক কথা আমাদের বলেনি–যা আমাদের ভীষণ কাজে লাগতে পারে।
তাহলে তো ওকে ফের…
কর্নেল হাত তুলে বললেন, আমি ওকে আসতে বলে এসেছি। আজ বিকেলের ট্রেনেই এসে পড়বে।
আরো কিছুক্ষণ দেখাশোনা করে দুজনে বেরোলেন। বাইরে এসে কর্নেল বললেন, এবার আপনি নিজের জায়গায় এগোন মিঃ ভদ্র। আমি একটা রিকশা করে একটা বিশেষ জায়গায় যেতে চাই।
মিঃ ভদ্র জিপ আনেননি। বড়রাস্তায় গিয়ে দুজনে দুটো আলাদা রাস্তায় বাঁক নিয়ে শহরে ঢুকলেন।
কর্নেল গেলেন আস্তাবল নামক বস্তি এলাকায়। আগে ওখানে বাংলা বিহার-ওড়িশার শাসনকর্তাদের বিশাল ঘোড়াশালা ছিল। এখন কোথাও-কোথাও দুএকটা পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। অজস্র খোলার ঘর গড়ে উঠেছে। খোট্টাই উর্দুভাষীরা ওখানে বাস করে। অনেক খুঁজে সিতারা বিবির সেই হেকিম ভাইয়ের বাড়ি পাওয়া গেল। বাড়িটার দেয়াল মাটির। একটা ছোট্ট ঘরের মাথায় সাইনবোর্ড রয়েছে। ভিতরে তাকে ও তক্তাপোশে অজস্র হেকিমি ওষুধের শিশিবোতল আর বয়েম। ছেঁড়া-খোঁড়া একটা খুব পুরনো গালিচার ওপর বসে এক দাড়িওলা জোব্বাধারী ভদ্রলোক আলবোলায় ধূমপান করছিলেন। কর্নেলকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল দুহাত সামনে ছড়িয়ে একটু ঝুঁকে (নবাব বংশের ব্যক্তিবর্গের প্রতি যে রীতিতে কুর্নিশ জানাতে হয়) সেলাম করে চোস্ত উর্দুতে বললেন, হুজুর নবাবসায়েবের দরবারে বান্দা এক আজব ব্যাধির চিকিৎসার জন্যে সুদূর কলকাতা থেকে হাজির হয়েছে।
হেকিম বিনয়ে গলে বললেন, আসন গ্রহণ করুন, জনাব।
ভ্যাপসা কুচ্ছিত গন্ধের সঙ্গে তামাকের সুগন্ধ অস্বস্তির সৃষ্টি করছিল।
কর্নেল বললেন, একদিন হুজুর নবাববংশীয়দের সামনে ইংরেজরাও কেঁচো হয়ে থাকত। আজ নাফরমান যুগের পাপী বেমারিতে সব সৌভাগ্য কবরে চলে গেছে। তাহলেও মানীর ইজ্জত কখনও নষ্ট হবার নয়। সে হল কিনা হীরেমোতির জেল্লা। অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে।
হেকিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিকই বলেছেন জনাব। আপনি পণ্ডিত ব্যক্তি।
ইত্যাদি প্রচুর কথাবার্তার পর কর্নেল বললেন, আমার এক ভাই কিছুদিন আগে আপনার কাছে এসেছিল। সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিল। নিশ্চয় মনে আছে হুজুর হেকিমসায়েবের–তো, তাদের মুখে আপনার গুণপনা শুনে আমি আসতে বাধ্য হলুম। আমার একেবারে ঘুম হয় না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে খুব অশান্তি আর হজমের গোলমাল হয়। শুনলুম আপনার কাছে কী সুর্মা পাওয়া যায়…
পলকে হেকিমসায়েবের মুখের ভাব বদলে গেল। সাপের মত ফোঁস করে ফণা তুললেন!…কৌন বোলা? কে বলেছে আপনাকে? ইয়ে বিলকুল ঝুট বাত। এরকম কোন সুর্মা আমি বানাই না। এক্ষুনি চলে যান আপনি। দিগির আর জায়গা পাননি?
কর্নেল হতভম্ব হবার ভান করে তক্ষুনি কেটে পড়লেন। দ্রুত একটা রিকশা চেপে থানার দিকে এগোলেন। ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলেন সিতারার দাদার কাছে। কর্নেলের অনুমানে ভুল হয়নি।
মিঃ ভদ্র আর মিঃ গুপ্ত থানায় গল্প করছিলেন। কর্নেল হেকিমের ব্যাপারটা বলার পর শেষে বললেন, ডঃ ফিরোলভের একটা বই পড়েছিলুম। তার নাম দেশে দেশে প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতি। সেখানে এক সুরমার কথা ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের হেকিমরা এই সুরমা বানাতে জানতেন। কতকটা সাম্প্রতিক এল এস ডির মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত। হ্যালুসিনেশান দেখা যেত। দৃষ্ট বস্তুর আয়তন অসম্ভব বেড়ে গেছে দেখতে পেত সুর্মা ব্যবহারকারী। আমার ধারণা, ইয়াকুব ও তার বউয়ের মৃত্যুর কারণ এই সুর্মা। কিন্তু নিছক হ্যালুসিনেশান দেখে কেউ মারা পড়েছে, এটা নির্ভর করে তার মানসিক অবস্থার ওপর। যাই হোক, আরো কিছু প্রমাণ আমার দরকার। আমি এখন শান্তর জন্যে অপেক্ষা করছি।
মিঃ গুপ্ত বললেন, রঞ্জিতবাবু একটু আগে রেডিও মেসেজ পাঠিয়েছেন। মিঃ সোমনাথ ভট্টের গাড়িটা পাওয়া গেছে বি টি রোডের ধারে। গাড়ির পিছনের খোলে বাঁদরজাতীয় জীবের কিছু লোম পাওয়া গেছে। সেটাই আশ্চর্য।
মিঃ ভদ্রের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বললেন, কী মনে হচ্ছে, মিঃ ভদ্র?
ব্রিলিয়ান্ট স্যার।
এখন শুধু শান্তর পথ চাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। তারপর চুরুট ধরালেন।
.
৬. কর্নেলের প্রকল্প
থানার সামনে শান্ত প্রতীক্ষা করছিল কর্নেলের। কর্নেল তাকে দেখে খুশি হলেন।এসে গেছ দেখছি! কিন্তু রাস্তায় কেন? আমি এদের তোমার কথা বলে রেখেছিলুম-পরিচয় দাওনি নিশ্চয়?
শান্ত হেসে বলল, রক্ষে করুন কর্নেল! ওসব থানা-পুলিস থেকে আমি সবসময় দূরে-দূরে অবস্থান করতে চাই।
কর্নেল ওর হাত ধরে টানলেন।…রাইট, রাইট। চলো আমরা গঙ্গার ধারে নিরিবিলিতে গিয়ে বসি। তোমার অবশ্য বিশ্রাম দরকার। কারণ ছ-সাত ঘণ্টার জার্নিতে তোমার প্রচুর ক্লান্তি স্বাভাবিক। তবে হাতে সময় এত কম! আগে কথা বলার পর সে ব্যবস্থা হবে। প্যালেস হোটেলের সুরঞ্জনকে খবর পাঠিয়েছিলুম সকালে। বিকেলের মধ্যে একটা রুম পেয়ে যাচ্ছি। দুজনে সেখানে গিয়েই থাকা যাবে বরং। বুঝলে শান্ত, থানা-পুলিস থেকে আমিও তোমার মতো দূরে অবস্থান করতে ভালবাসি। কিন্তু হয়ে ওঠে কই?
দুজনে কিছুদূর হাঁটার পর বাজার ছাড়িয়ে বাঁদিকে ঘুরে কেল্লাপ্রাঙ্গণে ঢুকলেন। তারপর নির্জন একটা জায়গা দেখে গঙ্গার ধারে বসলেন।
শান্ত বলল, আমি জানতুম, আপনি আমাকে ডাকবেন।
কর্নেল হাসলেন। …তাই বুঝি? কেন ডাকব ভেবেছিলে?
সেই হ্যালুসিনেশান–অর্থাৎ রাতের মায়ার ব্যাপারে কিছু আপনি সন্দেহ। করছেন, তা তখনই টের পেয়েছিলুম।
তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, শান্ত।
কর্নেল, আপনার সন্দেহ সত্য। আমি সোমনাথবাবুর গাড়িতে একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাক না হলে সে-রাতে অত অস্থির হতুম না। স্টেশন ওয়াগন গাড়ির পিছনটায় সাধারণ গাড়ির মতো খোল বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল–তার কারণ নিশ্চয় আউটডোর শুটিং-এর জন্য দরকারি আসবাবপত্র বইবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমার প্রথম অবাক লাগল, যখন দেখলুম প্রায় সব আসবাবই গাড়ির ভিতরে ঠাসা হয়েছে। সোমনাথবাবুকে যখন বললুম, বসার অসুবিধে না করে এগুলো পিছনের খোলে রাখলেই তো ভালো হত–তখন উনি জবাব দিলেন, চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না কদিন থেকে। আমি বললুম, চেষ্টা করলে আমি খোলের ডালাটা খুলতে পারি হয়তো–অমনি উনি শশব্যস্ত আপত্তি করলেন। তখনকার মতো ব্যাপারটা ধামাচাপা রইল। কিন্তু আমার ওই এক অভ্যেস, কিছু মাথায় ঢুকলে আর স্বস্তি পাইনে। পথে একজায়গায় চা খেতে ওরা সবাই নেমে গেল। আমি একটু দেরি করে বেরোলুম। রাস্তার ধারে একটা কারখানার দেয়ালের পাশে গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল। সটান এসে পিছনে খোলের হ্যাঁন্ডেলটা জোরে মোচড় দিতেই খুলে গেল। ঢাকনাটা একটু তুলেছি, পিছন থেকে সোমনাথবাবু ধমকে উঠলেন–আঃ, কী হচ্ছে শান্ত!..রেখে দিলুম। কিন্তু যা দেখবার দেখা হয়ে গেছে।
নির্ঘাত ওর মধ্যে একটা বাঁদর ছিল?
শান্ত কর্নেলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি জানেন?
হ্যাঁ। তারপর কী হল বলো?
সোমনাথবাবুকে কথাটা বললুম। তার ছবিতে বাঁদরের কোন ভূমিকা আছে নাকি? উনি কিছু উদ্ভট তত্ত্ব আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে শেষে বললেন, এ ব্যাপারটা সায়ন্তন-স্মিতা-শ্রীলেখাকে যেন জানানো না হয়। কারণ–ওঁর সেই তত্ত্বের ভাষায়–একজন আধুনিক মানুষ আচম্বিতে তার পূর্বপুরুষের এক বিশেষ প্রজাতির মুখোমুখি হয়ে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করে, সেটাই তাঁর ছবিতে অন্যতম বিষয় হয়ে থাকবে। আগে থেকে যদি জানা থাকে যে এবার দৃশ্যে একটা বাঁদরের উপস্থিতি আছে তাহলে তো পাত্র-পাত্রীরা তৈরি হয়ে রইল অভিনয় করার জন্যে। সোমনাথ তাঁর ছবিতে অভিনয় চান না, চান বাস্তবের প্রত্যক্ষতা। যাই হোক, আমিও চেপে গেলুম। কিন্তু সারাক্ষণ অস্বস্তি বাড়তে থাকল। শেষে এক অদ্ভুত খেয়াল চেপে বসল মাথায়। সবখানে বাঁদর দেখতে থাকলুম কল্পনায়।…শান্ত হাসতে লাগল।
কর্নেল বললেন, হুম! কিন্তু এই জাল সোমনাথের আসল উদ্দেশ্য কী, তুমি কি অনুমান করেছিলে কিছু–নাকি করনি?
কিছুই মাথায় আসছিল না। পরে যখন সিতারা আমাকে বিপদ হবে বলে ভয় দেখাতে লাগল, তখন মনে হল–সোমনাথ যা কিছু করতে যাচ্ছেন, এবং তা যাই হোক, ওই মেয়েটা সব যেন জানে।
আমারও তাই ধারণা। ওর দাদা–হেকিমসায়েবকে পুলিস শিগগির গ্রেপ্তার করছে। দেখা যাক্, জেরায় কী বেরোয়।…কর্নেল একটু ভেবে ফের বললেন– আচ্ছা শান্ত, তুমি আমাকে বলেছিলে যে কলকাতা ফেরার পর আবার জাল সোমনাথ ভট্টের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে…।
শান্ত বাধা দিয়ে বলল, ওটা আমার রসিকতা! আসলে সেই আগের ঠিকানায় গিয়ে দেখি ঘরে তালা ঝুলছে।
তুমি বড্ড মিস-লিড করো, শান্ত!
শান্ত কর্নেলের অনুযোগ মেনে নিয়ে বলল, আমি দুঃখিত কর্নেল। ও আমার বড় বাজে অভ্যেস।
ঠিক আছে। এবার ওঠা যাক।
কর্নেল সন্দিগ্ধভাবে বললেন, এও সেই বড় বাজে অভ্যাস নয় তো?
শান্ত হেসে বলল, না। সায়ন্তনকে হঠাৎ কাল রাস্তার ভিড়ে আবিষ্কার করলুম। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে গা ঢাকা দিচ্ছিল। ধরে ফেললুম।
তারপর?
সায়ন্তন আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল। কবরখানার সেই ঘরটায় যখন ও ঘুমের ভান করে নাক ডাকাচ্ছিল, তখন টের পায় কে আলো নিবিয়ে দিল। তারপর খসখস শব্দ হচ্ছিল। সায়ন্তন ভেবেছিল সোমনাথবাবু এসে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই দরজার চটের পর্দা তুলে কে বেরিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারে। সেইসময় একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে নাকে। আর তক্ষুনি ওর মনে পড়ে, এই গন্ধটা সিতারা বেগমের কাছে টের পেয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। তাই শেষ অব্দি সায়ন্তন বেরিয়ে গিয়ে সিতারার ঘরের দরজায় উঁকি দিচ্ছিল।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, সিতারা সোমনাথের ব্যাগ থেকে কিছু চুরি করতে এসেছিল! কী জিনিস?
আমি তার একটুকরো দরজার কাছে পেয়েছিলুম–আপনাকে সেটা দিয়েছিও।
সেই ইতিহাস লেখা কাগজটা!
তার মানে সিতারা জানত সোমনাথ আসলে কি এবং কেন এসেছে।
কিন্তু ওসব কাগজপত্র চুরি করল কেন সিতারা?
হয়তো কোন কবরে গুপ্তধন আছে–তার হদিস এতেই লেখা ছিল।
তোমার অনুমানে যুক্তি আছে।…বলে কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর ফের বললেন, সোমনাথ শ্রীলেখা আর স্মিতাকে নগ্ন হয়ে সেক্সয়াল দৃশ্যে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এর কারণ কী থাকতে পারে?
খুব সোজা। আসলে এসেছে তো গুপ্তধন হাতাতে। কেউ কিছু টের পাবার। আগেই খুব ভোরে পালানো দরকার। ছবি না তুলে চলে গেলে আমাদের পাছে কিছু সন্দেহ হয়–আর সন্দেহ তো ছিলই আমার প্রতি, সোমনাথ ওই প্রস্তাবটা একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে ভেবেছিল। কারণ, কোন ভদ্র শিক্ষিতা মেয়েই ওই উদ্ভট প্রস্তাবে সম্মত হতে পারে না।
কর্নেল ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু সেই বাঁদরটা কী হল?
শান্ত একটু হাসল।…বলছি। তার আগে একটা ব্যাপার ভাবার আছে, কর্নেল। সোমনাথের মাথায় ইয়াকুব বা সিতারাকে খুন করার প্ল্যান কিন্তু আগে ছিল না। আমার ধারণা, ওটা আকস্মিক ঘটনা। সোমনাথ ভাবেইনি যে পরিস্থিতি অমন হবে।
সোমনাথ নিজের হাতে খুন করেনি–এটা ঠিকই। প্রথমে মর্গের রিপোর্ট বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন করি। তোমাকে পরে বলবখন। সে নিজেও ভাবেনি যে ওরা ভয় পেয়ে প্রাণে মারা যাবে।
শান্ত চমকে উঠে বলল, ভয়!
হ্যাঁ ভয়। যুক্তিহীন ভয়–একটা অন্ধ বিভীষিকা! সেই প্রচণ্ডতম হরর বা ত্রাসের প্রতিক্রিয়া কতদূর গড়াতে পারে তোমাদের সোমনাথ ভট্ট অনুমানও করতে পারেনি! সে ভেবেছিল, ভয় পেয়ে ওরা ভূত দেখছে ভেবে তার কাজে ঘাঁটাতে সাহস পাবে না। দৌড়ে নিজের ঘরে পালিয়ে যাবে।
তাতে রিস্ক ছিল, কর্নেল! ভয় পেয়ে চাঁচামেচি করলে আমরা বেরিয়ে আসতুম। তখন সোমনাথের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হত।
শান্ত, যে-মানুষ স্বপ্নের মধ্যে ভয় পায়–তার কী অবস্থা ঘটে নিশ্চয় জানো? তাকে বোবায় ধরে। সে প্রচণ্ড চাচাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কণ্ঠস্বর ফোটে না। ইয়াকুব আর সিতারা সে-রাতে যা কিছু করেছে, সব স্বপ্নের মধ্যে অবচেতনার তাগিদে করেছে। দুজনেই অবসেসানের মধ্যে ছিল। এখানে মনস্তত্ত্বের প্রসঙ্গ অপরিহার্য। দীর্ঘকাল অবচেতনায় পোষা কোন ইচ্ছা স্বপ্নের মধ্যে প্রতাঁকে প্রকাশ পেয়ে আত্মচরিতার্থতা সাধন করে।
শান্ত হাসতে হাসতে বলল, আপনি ক্লাসরুমের লেকচার দিচ্ছেন কর্নেল স্যার?
বিষয়টি সেরকমই, শান্ত। একটু পণ্ডিতি ব্যাপার।
বেশ, বলুন।
ইয়াকুব যেভাবে হোক জানত যে খোঁজা জরজিশ বেন্নার কবরে গুপ্তধন আছে। সুতরাং ধরে নিচ্ছি–সিতারাও জানত। এখন ওই নামের খোঁজা ছিল দুজন। দ্বিতীয় জরজিশ বেন্নার কবরের স্ক্রিপ্টে একটা ঢ্যারা কেটে চিহ্ন দিয়ে রেখেছিল ইয়াকুব এবং সুযোগ খুঁজছিল। যে লোকটা সারাজীবন কবরখানায় কাটাচ্ছে, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার জ্ঞান স্বভাবত নগণ্য। যে কোন সময় সে ওই কবর খুঁড়ে গুপ্তধন চুরি করে পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু পারেনি তার কারণ–গুপ্তধন নিয়ে কীভাবে সামলাবে, জানত না। তাই সে সুযোগ খুঁজছিল। আমার ধারণা, তখন তার স্ত্রী তাকে একটা মতলব দেয়। মতলবটা হল, তার হেকিমদাদার শরণাপন্ন হওয়া। এই হেকিম ভদ্রলোক সম্ভবত উপযুক্ত পার্টি হিসেবে তোমাদের ভট্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যোগাযোগ করে–কিন্তু নিশ্চয় তাকে সবকিছু খুলে ঠিক-ঠিকানার হদিস দেয়নি। এতে জাল সোমনাথের লোভ বেড়ে যায় এবং সে ঠিক করে যে ওদের ফাঁকি দিয়েই সে একা গুপ্তধন আত্মসাৎ করবে। ডঃ দীননাথ হোড় সেজে নবাবী মহাফেজখানার দলিল হাতানোর কারণ কিন্তু এটাই।
কর্নেলকে চুপ করতে দেখে শান্ত বলল, তারপর?
হেকিমসায়েব তার ভগ্নীপতি ইয়াকুব বা বোন সিতারাকে শুধু বলে থাকবে যে পার্টি ঠিক হয়েছে কিন্তু কে সেই পার্টি বা কখন আসবে তা বলেনি। কারণ, তখনও কোন চূড়ান্ত ফয়সালা নিশ্চয় হয়নি। এদিকে ডঃ হোড় সেজে খোঁজাদের দলিল চুরি করার পর চোরমশায় পড়ে গেছে ধাঁধায়। কোন্ কবরে গুপ্তধন আছে, হেকিম তা বলেনি তাকে। দলিলপত্রে সে আভাস পেল যে খোঁজা জরজিশ বেন্নার কবরেই গুপ্তধন থাকা সম্ভব। কিন্তু জরজিশ বেন্না যে দুজন! তখন অগত্যা সে ফের হেকিমের কাছে গেল–ভাবল হেকিমকে বেশি পাওনার লোভ দেখালে যেভাবে হোক প্রকৃত কবরটা চিনিয়ে দেবে। কিন্তু হেকিম বেচারাও জানত না কোষ্টা সেই আসল কবর। লোভে হেকিম তখন ভগ্নীপতি আর বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেও ওদের সঙ্গে চালাকি করতে চেয়েছিল। লোভ তখন তাকে পুরো গ্রাস করেছে। গুপ্তধনের মোটা অংশ তাকে জাল সোমনাথ ওরফে জাল দীননাথ হোড় দিতে চেয়েছে।…শান্ত, আমার অনুমান, হেকিম ওদের বোকার মতো বলে ফেলেছিল যে পার্টি খোঁজাদের দলিল হাতিয়ে জানতে পেরেছে দুটো কবরের মধ্যে যে-কোন একটায় গুপ্তধন আছে–কাজেই ওরা যদি এক্ষুনি আসল কবরটা না চিনিয়ে দেয়, বিপদ হতে পারে। সিতারাকে বুদ্ধিমতী বলেই আমার ধারণা। সে দাদার উদ্দেশ্য টের পেয়ে গিয়েছিল। বলাই বাহুল্য, এর ফলে ওদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়ে থাকবে। হেকিম, রেগে বাড়ি ফিরে যায়। যে রিকশায় হেকিম এসেছিল এবং ফিরে গিয়েছিল–সেই রিকশাওয়ালার কাছে আমি যা বিবরণ পেয়েছি, তার যুক্তিতেই এ প্রকল্প আমি সাজিয়েছি, শান্ত। রিকশাওয়ালা বলেছে, আসবার সময় হেকিমসায়েবকে খুব চঞ্চল দেখাচ্ছিল–ফেরার সময় সে রাগে টগবগ করে ফুটছিল যেন। ঝগড়াঝাটির আবছা আওয়াজও রিকশাওয়ালা শুনেছিল। যাইহোক, ফিরে গিয়ে সে এক মতলব করে। পার্টিকে মতলবটা জানিয়েও দ্যায়। কী সে মতলব? শান্ত, এটাই এ ঘটনার ভাইটাল অংশ। সেই বিভীষিকার দৈত্যকে সৃষ্টি করা।
খুলে বলুন, কর্নেল।
হেকিম এক রকম সুর্মা তৈরি করতে জানে। তা চোখে লাগালে মানুষের স্নায়ু আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। চোখে সব অদ্ভুত ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে থাকে। সে যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। পার্টিকে সে এই সুর্মার কথা বলে। ইয়াকুব সিতারা শুতে যাবার আগে সুর্মা ব্যবহার করে। পার্টি কবরখানায় কোন ছলে গিয়ে যদি রাত্রিবাস করতে পারে, তাহলে কোন সুযোগে ওদের সুর্মাদানিটার মধ্যে এই ভয়ঙ্কর সুর্মা ঢেলে রেখে দেবে। ইয়াকুব-সিতারা এই সুর্মা পরার আধঘণ্টার মধ্যে স্বপ্নাচ্ছন্ন বিভীষিকার রাজত্বে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এখানে শর্ত আছে। এই সুর্মার ফলে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটে? দৃশ্যমান বস্তুর আয়তন বিদঘুঁটে হয়ে বেড়ে যায়–যার দরুন মানুষ অনেক অসম্ভব ব্যাপার দেখতে পায়। তাই। জাল সোমনাথ আর হেকিম মিলে ঠিক করল যে ওদের ভয় পাইয়ে চুপ করিয়ে রাখতে একটা জীবন্ত বাঁদর খুব কাজ দেবে। বাঁদরটা ওদের চোখে অতিকায় দৈত্যের মতন দেখাবে–যা মানুষের অভিজ্ঞতায় নেই। অর্থাৎ জাল সোমনাথ আর হেকিমের কবর খুঁড়ে গুপ্তধন হাতানোর সময় যদি দৈবাৎ ওরা এসে পড়ে, বাঁদরটা ছেড়ে দেওয়া হবে।
শান্ত বলল, আপনার প্রকল্পটি চমৎকার। ছাদের ঘরে তাহলে আমরা হেকিমকেই সিগারেট খেতে দেখেছিলুম!
হ্যাঁ। তবে সিগারেট নয়–বিড়ি। বলে কর্নেল পকেট থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করে খুললেন। তিনটে আধপোড়া বিড়ি রয়েছে তাতে।…এগুলো সকালে কবরখানার দোতলায় কুড়িয়ে পেয়েছি। তবে বেচারা হেকিম শেষ অব্দি ঘটনার পরিণতিতে বাকসো-টাকসো সোমনাথের কাছে ফেলেই কেটে পড়ে।
তারপর?
তারপর আর কী! কবর হেকিমই খুঁড়ছিল–আর সোমনাথ বাঁদরটা নিয়ে তৈরি ছিল। এদিকে ইয়াকুব প্রথমে সন্ধ্যাবেলায় তোমাদের পার্টিকে কোন সন্দেহই কিন্তু করেনি। করেছিল বুদ্ধিমতী সিতারা। পরে কোন একসময় সে স্বামীকে তার সন্দেহের কথা বলে থাকবে। যার ফলে ইয়াকুবের মাথায় ছিল যে। রাত গম্ভীর হলে সে আগেভাগে গুপ্তধনটা হাতাবে–সিতারা থাকবে পাহারায়। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট নয়। ইয়াকুব-সিতারা তাহলে সুর্মা পরল কেন? তোমার কী মনে হয় শান্ত?
কী মুশকিল! প্রতিরাতে শুতে যাবার সময় যেমন সুর্মা পরার অভ্যাস, তেমনি পরেছিল। এখানে কোন গোলমেলে ব্যাপার নেই, কর্নেল। ধরুন, শুতে যাবার সময় আমার জল খাওয়ার অভ্যেস আছে। গভীর রাতে চুরি করতে যাবার মতলব আছে বলে কি আমার জল খেতে এবং লোক দেখানো শুতে যাওয়া মানা?
রাইট, রাইট। কর্নেল মাথা দোলালেন।…এখন সে রাতের ঘটনাটা লক্ষ্য করো। তোমাদের সাক্ষ্যপ্রমাণের হিসেবে জোর দিয়ে বলা যায় রাত দুটোর কাছাকাছি ওরা ভয় পেয়ে মারা যায়। তাহলে তোমার সিদ্ধান্তই ঠিক। ওরা যথারীতি সুর্মা পরে শুতে গিয়েছিল যথাসময়ে। তারপর সুযোগ বুঝে মতলব হাসিল করতে বেরিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার–তখন তারা দুজনেই সেই সুর্মার গুণে প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিল না। তবে আগেই বলেছি, অবচেতনায় দীর্ঘকাল ধরে ঢ্যারা চিহ্নিত কবরটার অস্তিত্ব ইয়াকুবের মনে ছিল। তাই স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থাতেও কবরটার কাছে পৌঁছতে তার ভুল হয়নি। কিন্তু তখনই তার সামনে এসে দাঁড়ায় বাঁদরটা। অতিকায় সেই প্রাণীকে দেখেই সে প্রচণ্ড আতঙ্কে মারা যায়। সিতারা অদূরে পাহারা দিচ্ছিল স্বামীকে। সেও একই দশায় পড়ে যায়। সুর্মার গুণে তাদের দুজনের স্নায়ু দুর্বল ছিল, হার্টের অবস্থাও ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য। এই সুর্মা খুব মারাত্মক জিনিস।
কিন্তু কর্নেল, কবরটা খোঁড়া হয়েছে, তার তলায় বাকসোর ছাপ রয়েছে– তার মানে, গুপ্তধন ওই কবরেই ছিল। ইয়াকুব যেটা খুঁড়তে আসছিল, সেটায় নিশ্চয় কিছু নেই তাহলে!
এটা এখনও রহস্য। খোঁজা জরজিশ বেন্না নামে দুজন লোক ছিল। ইয়াকুব অতকাল ধরে, বলতে গেলে বংশপরম্পরায় ওই গোরস্তানের প্রহরী। তার জানায় ভুল হবে বলে মনে হয় না। খোঁজাদের দলিলগুলোও বেহাত। এখন দুটো প্রমাণ দুদিক থেকে পেলে এর মীমাংসা হয়। প্রথমটা অসম্ভব দ্বিতীয় বেন্নার কবর খোঁড়ার অনুমতি ট্রাস্টি বোর্ড কদাচ দেবেন না। দ্বিতীয়টা হচ্ছে–চোর বামাল সমেত ধরা পড়া। তাহলে বোঝা যায় বাকসোটায় সত্যি কী ছিল।
পিছন থেকে মিঃ সত্যজিৎ গুপ্ত বলে উঠলেন–কিচ্ছু না। ওটা ভুয়ো গুপ্তধনের বাকসো কর্নেল। চোর বামালসমেত ধরা পড়েছে কলকাতার একটা হোটেলে। বাকসো ভরতি ঝুটা রঙিন পাথর!
দুজনে ঘুরে বসল। কর্নেল বললেন, আসুন, আসুন মিঃ গুপ্ত। এতক্ষণ আমি শান্তকে আমার প্রকল্পটা শোনাচ্ছিলুম। চোর ধরা পড়েছে? বামালসমেত? ঝুটা মণিমুক্তো? বাঃ বাঃ! কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন।
মিঃ গুপ্ত বললেন, আপনাকে খুঁজছি কতক্ষণ। পরে শুনলুম এদিকে, এসেছেন। যাক্ গে, চলুন। মিসেস ভদ্র কর্নেলকে এক পেয়ালা কফি না খাওয়াতে পারলে স্বস্তি পাচ্ছেন না।
.
পরদিন সকালে সেই সুর্মার বিশ্লেষণী রিপোর্ট পাওয়া গেল। স্পেশাল মেসেঞ্জার মারফত পাঠানো হয়েছে। ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞরা সুর্মাগুলো পরীক্ষা করে তার মধ্যে সাংঘাতিক একটা জিনিস পেয়েছেন তার নাম এলিমেল। একজাতীয় ব্যাঙের ছাতায় প্রচুর এলিমেল পাওয়া যায়। বেশি পরিমাণে রক্তে গেলে হার্ট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এর সবচাইতে ক্রিয়াশীলতা প্রকট হয় চোখের স্নায়ুতে। প্রাচীন আরবীয় চিকিৎসকরা এর ব্যবহার জানতেন। পরিমিত প্রয়োগে অন্ধতা সারাতে এ ওষুধ অব্যর্থ। অপরিমিত প্রয়োগে চোখের স্বাভাবিক কাজকর্ম গুরুতরভাবে বদলে যায়। সেইসঙ্গে মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। পরিণামে হার্ট আক্রান্ত হয়।
রিপোর্ট পড়ার পরে কর্নেল বললেন, মিঃ ভদ্র, শান্ত আমাকে বলেছে– কলকাতা ফেরার সময় জাল সোমনাথের সেই বাঁদরটা আর সে দেখতে পায়নি। আমার ধারণা, বাঁদরটা এখনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কোথাও কবরখানার আশেপাশে কিংবা এলাকার মধ্যেই।
একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে বলল, কী আশ্চর্য! গতকাল বিকেলে ডিউটির সময় কবরখানায় যখন ছিলুম, একটা বাঁদরকেই তাহলে দেখেছিলুম পাশের বটগাছটায়! আরে! আমি ওটাকে হনুমান ভেবেছিলুম! এলাকায় হনুমানের উৎপাত প্রচণ্ড।
মিঃ ভদ্র বললেন, তরফদার, গণেশ আর তুমি তাহলে একবার যাও। ডিউটি রেজিস্টার নিয়ে এস। আর শোন, নহবৎখানার ওখানে একটা লোক আছে–লালু নামবাঁদর নিয়ে ম্যাজিক দ্যাখায়। চেনেনা?
হ্যাঁ স্যার।
ওকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
যদি না থাকে স্যার? এখন তো ওর বাড়ি থাকার কথা নয়!
অত যদি টদি আমি বুঝিনে। বাঁদরটা চাই–ব্যস!
ওরা চলে গেল। কর্নেল বললেন, হেকিমসায়েবের রাতের খবর কী? বেরোল কিছু?
মিঃ ভদ্র একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন। কর্নেল পড়ে দেখে বললেন, শান্ত, আমার প্রকল্পে এতটুকু ভুল নেই। যা যা বলেছি, হেকিমসায়েবের জবানবন্দিতে সব মিলে যাচ্ছে। বাই দা বাই, মিঃ গুপ্ত, খোঁজাদের সেই দলিলটা উদ্ধার করতে পারেননি?
মিঃ গুপ্ত বললেন, আলবৎ পেরেছি স্যার। স্টার হোটেলের ঘরে জাল ডঃ হোড় ওরফে জাল সোমনাথ ভট্ট ওরফে কুখ্যাত স্মাগলার গোপাল অধিকারী। সবে বাকসোটা ভেঙেছে এবং ভেঙেই চক্ষু ছানাবড়া করেছে মণিমুক্তোর জেল্লা দেখে, তখনই পুলিস দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। ওগুলো বুটো–স্রেফ পাথর, বেচারা এখনও জানে না। ওর ফোলিও ব্যাগে দলিলগুলোও পাওয়া যায়।
কর্নেল বললেন, কিন্তু সিতারা যে কপিগুলো সে-রাতে চুরি করে, তার একটা পাতা আমরা পেয়েছি। বাকিগুলো কী হল?
পাওয়া গেছে। একটা ঝোঁপের মধ্যে পড়ে ছিল। কিন্তু সিতারা ওগুলো চুরি করতে গেল কেন?
কর্নেল বললেন, সে-রাতে অন্তত শুতে যাবার স্বাভাবিক সময় দশটা থেকে। এগারোটার পর সিতারা যা কিছু করেছে, স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় করেছে। অনেকে স্বপ্নের ঘোরে নিজের জিনিস নিজেই চুরি করে। আমি একটা কেস জানি। ভদ্রলোক নিজেই স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় রাতে নিজের জামাকাপড় বাগানে পুঁতে আসতেন। তারপর সকালে হইচই লাগিয়ে চাকরদের মারধর করতেন। এর পিছনে যে সাইকলজি আছে, তা বিচিত্র। তবে আমাদের প্রসঙ্গ হচ্ছে সিতারা। সিতারার অবচেতনে সেই দলিলের ব্যাপারটা ছিল–তাই স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় যুক্তিহীনভাবে সে ওগুলো চুরি করতে গিয়েছিল। এছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা হতে পারে না।…বলে কর্নেল মৃদু হেসে চুরুট ধরিয়ে শান্তর উদ্দেশে বললেন, তাহলে শান্ত, এবার চলো তোমার ডিরেকটার মশায়ের সঙ্গে দেখা করা যাক। সওয়া দশটায় ট্রেন। শেয়ালদা পৌঁছব প্রায় সওয়া চারটে নাগাদ। তারপর সোজা লালবাজারে চলে যাব আমরা।… :
.
গোপাল অধিকারীর ধরা পড়ার পেছনে স্মিতার অবদান আছে জেনে কর্নেল যেমন অবাক হলেন, শান্তও তেমনি।
কর্নেল আর শান্ত লালবাজার থেকে সোজা স্মিতার বাড়ি হাজির হলেন। স্মিতা একটু বিব্রত হল। বাসায় অতিথিদের আপ্যায়ন করার মতো যথেষ্ট জায়গা নেই। সেটা টের পেয়ে কর্নেল বললেন, চলো–বরং আমরা কোথাও পার্কে গিয়ে বসি।
তিনজনে কিছুদূর এসে একটা পার্কে নির্জন জায়গা খুঁজে বসল! তখন কর্নেল বললেন, তোমার মুখে গোপাল অধিকারীর ধরা পড়ার ঘটনা শুনতে চাই, স্মিতা। সেজন্যেই এসেছি। তোমাকে ডেকেই পাঠাতুম আমার বাসায়। কিন্তু এত দেরি করার ধৈর্য আর নেই।
তখন বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশ আজ পরিষ্কার। স্মিতা একটু হেসে বলল, শান্ত আর আমি প্রথমে ঠিক করেছিলুম, জাল সোমনাথবাবুর সেই বাসাটার ওপর নজর রাখব। তারপর…
কর্নেল বললেন, সি দা ফান এগেন! শান্ত আমাকে এটা বলেনি।
শান্ত কিছু বলল না। স্মিতা বলল, শান্তর অনেক ব্যাপার রহস্যময়। এই দেখুন না, দুজনে, বাসাটা ওয়াচ করব ঠিক হল–আমরা হাজির হলুম কথামতো। তারপর আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আসছি বলে সে উধাও। আমি কী বিশ্রী অবস্থায় পড়ে গেলুম। রাস্তার ধারে অমন করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! লোকেই বা কী ভাববে! চলে আসব ভাবছি, হঠাৎ দেখি আমার চেনা একটি মেয়ে সামনের একটা বাড়ি থেকে বেরোল। সে আমাকে দেখেই দৌড়ে এল। তাদের বাসায় নিয়ে গেল। দোতলায় বাসা। ওখান থেকে গোপাল অধিকারীর ঘরের জানলা আর বাড়ির নিচটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ ওখানে থাকিই বা কীভাবে? মাথায় একটা মতলব এল। শিখা ততক্ষণে আমাকে গান গাইবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে। আমি সুযোগটা নিলুম। দুপুর অব্দি একটার পর একটা গান গেয়ে চললুম। ওদের বাড়ির সবাই তখন গানে পাগল হয়ে উঠেছে। সে-বেলা আর আসতেই দিল না। খাওয়া-দাওয়া হল। তারপর ঘুমের ভান করে শিখার বিছানায় গড়িয়ে পড়লুম। কিন্তু সারাক্ষণ চোখ রেখেছিলুম আসল জায়গায়। বেলা তখন তিনটে–আবার গানের আসর বসল। শিখারা খুব গান-পাগলা ফ্যামিলি। এদিকে শান্তর পাত্তা নেই। বুঝুন কাণ্ড!
শান্ত বলল, আমিও তখন এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে তার বাড়ি সারাদিন আড্ডা দিচ্ছি।
অদ্ভুত ছেলে!..স্মিতা বলল।..সন্ধে অব্দি কাটিয়ে চলে আসতে হল। কোন কাজ হল না। কিন্তু শিখাকে বুদ্ধি করে বলে এসেছিলুম, ওই বাসাটার দিকে লক্ষ্য রাখতে। যদি জানলা খোলা দ্যাখে তো আমাকে তক্ষুনি একটা ফোন করে। আমাদের নিচের তলায় ডাক্তারবাবুর ফোন আছে। খুব খাতির আছে ওঁর সঙ্গে। ফোন এলেই খবর পেয়ে যাব। তা পরদিন আর শান্তর পাত্তা নেই। ওর বাসায় গেলুম। শুনলুম, বাইরে গেছে শুটিঙে! বাড়ির লোককে ও কী ঠকায়!
শান্ত একটু হাসল।..আমি কর্নেলের ডাকে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলুম।
পরদিন দুপুরে–মানে গতকাল শিখার ফোন পেলুম। সে ভদ্রলোক এসে গেছেন বাসায়। তক্ষুনি হাজির হলুম। ডিরেকটর মশাই আমাকে দেখে খুব খুশি হবার ভান করল। বলল, মিছিমিছি মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পরিশ্রম হল–তোমাদের গোঁয়ার্তুমিতে অমন ছবির থিমটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না!..এরপর যা হল– তা বলতে লজ্জা করছে কর্নেল।
কর্নেল বললেন, তুমি নিশ্চয় ওর সঙ্গে প্রেমিকার অভিনয় করলে!
স্মিতা জবাব দিল–হু।
নিশ্চয় গোপালচন্দ্র তোমার প্রেমে পড়ে গেল।
হু-উ।
তারপর তোমাকে প্রস্তাব দিল হোটেলে দুজনে একসঙ্গে গিয়ে মৌজ করতে।
দিল।
তখন ওর সঙ্গে স্টার হোটেলে চলে গেলে?
গেলুম।
এবং কোন ছলে বেরিয়ে পুলিসকে ফোন করলে?
স্মিতা মুখ তুলে বলল, আপনি তো সবই জানেন!
কর্নেল একটু হেসে বললেন, সেইজন্যেই শান্তর তোমার সঙ্গে থাকা ভুল হত। শান্ত খুব বুদ্ধিমান ছেলে।
স্মিতা বলল, হ্যাঁ-বুদ্ধির ঢেঁকি! শুধু অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতে ওস্তাদ!
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।…তোমরা বসো। আমি এক্ষুনি আসছি। একটা জরুরী ফোন সেরে আসি–দেখি কোথায় পাই। আমি না ফেরা অব্দি যেও না কিন্তু।
কর্নেল মাঠ পেরিয়ে চলে গেলেন। তার টাক চকচক করতে করতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
তখন শান্ত গম্ভীরভাবে ডাকল, স্মিতা?
বলো।
গোপাল অধিকারীর সঙ্গে লাভ-মেকিং কদ্দুর গড়িয়েছিল?
যাঃ! শুধু অদ্ভুত কথা ছাড়া আর কিছুই নেই।
একটুকু ছোঁওয়া লাগে একটুকু গান শুনি!
স্মিতা ওর পিঠে কিল মেরে বসল।
শান্ত বলল, শালা গোপলা ফাঁসিতে মরলে অক্ষয় স্বর্গ পাবে, স্মিতা।
আর তুমি কী পাবে?
হয়তো নরক।
আবার অদ্ভুত কথা!
হু, এখনই যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে, স্মিতা।
তাহলে আমি তোমাকে ছুঁই!…স্মিতা ওর ঘাড়ে হাত রাখল।
হু, বড় আরাম লাগছে। ঘুম পাচ্ছে।
শুয়ে পড়ো না!
তোমার পায়ে মাথা রাখতে দেবে?
বোকা, বোকা! এক্কেবারে হাবাকান্ত! মেয়েদের পায়ে মাথা রাখতে চায় ভ্যাট!
মানে ইয়ে, ঠিক পায়ে নয় ঊরুদেশে।
না, না! কর্নেল এসে পড়বেন।
ও বুড়োকে তুমি চেনো না। ও আর ফিরছে না।
তাহলে–ঠিক আছে! আঃ, এত চাপে না! তোমার মাথার ওজন কত টন?
শান্ত অস্ফুট কণ্ঠে বলল, হে আলমপানা! তার চেয়ে আমার কবরে দিতে যদি সুন্দরীদের একটুকরো হাড়, আমি অনন্ত সুখে ঘুমোতে পারতুম।
Leave a Reply