৩.০১ গ্রামের নাম নিউ হ্যাম্পশায়ার

গডফাদার (ভলিউম-২)

তৃতীয় পর্ব

০১.

 গ্রামের নাম নিউ হ্যাম্পশায়ার। এই গ্রামের বৈশিষ্ট্য হলো নতুন কিছু একটা ঘটলেই সমস্ত ব্যাপারটা খুঁটিয়ে লক্ষ করার জন্যে জানালা দিয়ে উঁকি মারে মেয়েরা আর দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় দোকানীরা। অ্যাডামসদের বাড়ির সামনে নিউ ইয়র্কের নম্বর প্লেট লাগানো কার্লো মোটর গাড়িটা এসে থামতে না থামতেই গ্রামের সবাই জেনে গেল ব্যাপারটা।

কলেজে পড়া মেয়ে হলেও এখনও একটু গেঁয়ো টাইপের রয়ে গেছে কে অ্যাডামস, সে-ও তার শোবার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছে ব্যাপারটা কি।

পরীক্ষার পড়া বন্ধ করে নিচে নেমে এসে লাঞ্চ খাবার তোড়জোড় করছে, এই সময় চোখে পড়ল একটা গাড়ি আসছে। সেটা যখন ওদেরই বাড়ির সামনে ঘাস জমির পাশে থামল, একটুও বিস্মিত হলো না কে। লম্বা-চওড়া দুইজন লোক নামল গাড়িটা থেকে দুইজনেরই বলিষ্ঠ গড়ন, সিনেমার ভিলেনের মত চেহারা। একছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল কে, ওদের আগেই পৌঁছে গেল সদর দরজায়। ওরা নিশ্চয় মাইকেল অথবা তার বাড়ির কারও কাছ থেকে এসেছে বলে অনুমান করছে সে। আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ করিয়ে দেবার আগেই ওরা বাড়ির ভিতর ঢুকে তার মা-বাবার সাথে কথা বলতে শুরু করবে, তা সে চাইছে না। মইকেলের বন্ধু বান্ধব সম্পর্কে ও যে লজ্জিত, ব্যাপারটা তা নয়। মা বাবা আসলে নিউ ইংল্যাণ্ডবাসী সেকেলে ইয়াঙ্কি, এ-ধরনের লোকজনের সাথে মেয়ের পরিচয় হয় কি করে, সেটা তারা আদৌ বুঝতে চেষ্টা করবেন না।

কলিং বেল বাজতে শুরু করেছে, এই সময় দরজার সামনে পৌঁছুল কে। আমি খুলছি, চিৎকার করে কথাটা জানাল মাকে। তারপর দরজা খুলল।

কাছ থেকে আরও বিশালদেহী দেখাচ্ছে লোক দুজনকে। সিনেমার ভিলেনরা যেভাবে বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তল বের করে ঠিক সেভাবে ওদের একজন পকেটে হাত ঢোকাতে যাচ্ছে দেখে চমকে উঠল কে, দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শব্দ করে একটু নিঃশ্বাস বেরিয়ে পড়ল তার। পিস্তল নয়, ছোট্ট একটা চামড়ার কেস বের করল লোকটা, সেটা কে-র মুখের সামনে খুলে ধরল সে। একটা আইডেনটিটি কার্ড। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন ডিটেকটিভ আমি, জন ফিলিপস, ইঙ্গিতে সঙ্গীকে দেখাল সে, আমার সহকারী, ডিটেকটিভ সিরিয়ানি। আপনিই কি মিস অ্যাডামস?

উপর-নিচে একবারমাত্র মাথা ঝাঁকাল কে।

ভিতরে ঢুকে আপনার সাথে কথা বলতে পারি? বলল ফিলিপস। মাইকেল কর্লিয়নি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন আছে আমাদের।

একপাশে সরে এসে ওদেরকে ভিতরে ঢোকার জায়গা করে দিল কে। পথ দেখিয়ে পড়ার ঘরের দিকে যাচ্ছে, ছোট হলঘর থেকে ওদেরকে দেখে ফেললেন বাবা। কি হয়েছে রে, কে? জানতে চাইলেন তিনি।

মাথার চুল সব পেকে গেছে, মেদহীন গড়ন, ভদ্রলোকের চেহারায় নিখুঁত আভিজাত্যের ছাপ। এই এলাকার ব্যাপটিস্ট গির্জার একজন পাদ্রী তিনি, ধার্মিকদের মধ্যে তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রচুর খ্যাতি। কে আসলে তার বাবাকে ঠিক মত বুঝে উঠতে পারে না, বাবার কথা ভাবতে বসলে তার ব্যক্তিত্বের গভীরতা সম্পর্কে কেমন যেন ধাঁধা লাগে, তার মধ্যে আশ্চর্য একটা উদাস আর রহস্যময় কিছু আছে বলে মনে হয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে মনে কোন সন্দেহ নেই ওর, বাবা ওকে যথেষ্ট ভালবাসেন। তবে বাপ হিসেবে মেয়ের দিকে তেমন খেয়াল রাখেন না। পরস্পরের মধ্যে খুব একটা ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতা না থাকলেও বাবার উপর আস্থা রাখে সে। তাই কথাটা বলার সময় কোন সঙ্কোচ বোধ করল না, সহজভাবেইবলতে পারল, নিউ ইয়র্ক ডিটেকটিত ব্রাঞ্চের লোক এরা। আমার পরিচিত একটা ছেলে সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে এসেছেন।

ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিলেন মি. অ্যাডামস, একটুও অবাক হননি। বললেন, আমার পড়ার ঘরে গিয়ে বসতে পারি, নাকি?

আমরা কথা বলার সময় আপনার মেয়ে একা থাকলে ভাল হয়,মৃদু গলায় বলল ডিটেকটিভ ফিলিপস।

দেখুন, অত্যন্ত ভদ্রভাবেই বললেন মি: অ্যাডামস, সেটা বোধহয় কে-র ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে। মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি। কি, মা? সাথে আমি থাকলে ভাল হয়, নাকি ওদের সাথে একা একা কথা বলবি? আমি, অথবা তোর মা?

দ্রুত মাথা নেড়ে বলল কে, একাই বলব।

ডিটেকটিভ ফিলিপসের দিকে তাকালেন মি. অ্যাডামস। আপনারা আমার পড়ার ঘরে বসতে পারেন, মৃদু হেসে বললেন তিনি। তারপর জানতে চাইলেন, আপনারা কি লাঞ্চ খাবার সময় পর্যন্ত থাকবেন?

না-মাথা নেড়ে জানাল ডিটেকটিভ দুজন। পড়ার ঘরে ওদেরকে নিয়ে গিয়ে বসাল কে। নিজে সে বাবার চামড়া দিয়ে বাঁধানো প্রকাণ্ড চেয়ারটায় বসল। সোফার কিনারায় একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসেছে ওরা দুজন।

মিস অ্যাডামস, শুরু করল ডিটেকটিভ ফিলিপস, মাইকেল কর্লিয়নির সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছে আপনার, বা তার কাছ থেকে শেষ কবে খবর পেয়েছেন? গত তিন হপ্তার মধ্যে?

কে-কে সতর্ক করে দেবার জন্যে এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট। আজ থেকে তিন হপ্তা আগে বোস্টনের একটা খবরের কাগজ পড়ছিল সে, তাতে বিরাট হেডিং দিয়ে একটা খবর ছাপা হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের একজন পুলিশ ক্যাপটেন আর একজন ড্রাগ স্মাগলার ভার্সিল সলোযো খুন হয়েছে। রিপোর্টারের মন্তব্য ছিল, এই হত্যাকাণ্ড কর্লিয়নি পরিবারের সাথে অন্যান্য মাফিয়া পরিবারের দলীয় যুদ্ধের পরিণতি।

এদিকে-ওদিকে মাথা দোলাল কে। গত তিন হপ্তার মধ্যে? না। হাসপাতালে ওর বাবাকে দেখতে যাচ্ছে, সেই আমার সাথে ওর শেষ দেখা। সেটা বোধহয় হপ্তা তিনেকের আগের ঘটনা।

তা আমরা জানি, সহকারী ডিটেকটিভ গম্ভীর, কর্কশ কণ্ঠে বলল। তারপর আবার কবে দেখা হয়েছে?

হয়নি, বলল কে।

ডিটেকটিভ ফিলিপস নরম সুরে বলল, ওর সাথে যোগাযোগ হলে বা ওর কোন খবর পেলে আমাদেরকে যদি জানান, খুব উপকার হয়। মাইকেল কর্নিয়নিকে খুঁজছি আমরা, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আদায় করার ব্যাপারে। শুধু কর্তব্যের খাতিরে আপনাকে সাবধান করতে চাই–ওর সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখলে বিপদে জড়িয়ে পড়তে হবে আপনাকে। আর, কোন ব্যাপারে, কোন ভাবে ওকে যদি সাহায্য করেন, জেনেশুনে নিজের সর্বনাশই শুধু করা হবে।

শিরদাঁড়া খাড়া করে সোজা হয়ে বসল কে, জানতে চাইল, দরকার মনে করলে কেন ওকে সাহায্য করতে পারব না আমি? আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, ওকে সাহায্য করব না তো করব কাকে?

জবাব দিল সহকারী ডিটেকটিভ সিরিয়ানি, সে আপনার ইচ্ছা। কিন্তু ওকে সাহায্য করলে খুন করতে সহায়তা করেছেন, এই অভিযোগ আনা হতে পারে আপনার বিরুদ্ধে। আপনার হবু স্বামীকে আমরা কেন খুঁজছি, জানেন? নিউ ইয়র্কের একজন পুলিশ ক্যাপটেনকে খুন করেছে সে। শুধু তাই নয়, একই সাথে খুন করেছে। একজন ইনফর্মারকে। ক্যাপটেন সেই ইনফর্মারের সাথে বসে কথা বলছিল, এই সময় ওদেরকে গুলি করা হয়। গুলি যে মাইকেল কর্লিয়নি করেছে তা আমরা ভাল করেই জানি।

নিঃশব্দে হাসছে কে। এমন অকৃত্রিম অবিশ্বাসের হাসি, দেখে দুজন ডিটেকটিভই কেমন যেন দমে গেল। পাগল নাকি? বলল কে। এ-ধরনের কাজ মাইক কখনও করতেই পারে না। বাড়ির কোন বিষয় বা লোকদের সাথে ওর তো কোন সম্পর্কই নেই। ওর বোনের বিয়ের দিন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, নিজের চোখেই তো দেখলাম, বাড়ির লোকেরা অনাত্মীয়, পরের মত আচরণ করে ওর সাথে। আপনারা ভাবছেন তাহলে ও লুকিয়ে আছে কেন? এর সোজা কারণ আমি জানি। যা ঘটে গেছে তার সাথে জড়াবার কোন ইচ্ছা নেই ওর। সেজন্যেই চোখে পড়তে চাইছে না। আবার সেই অকৃত্রিম অবিশ্বাসের হাসিটা দেখা গেল কে-র মুখে। মাইককে গুণ্ডা বলে মনে করলে মস্ত ভুল করবেন আপনারা।•••হাসি পাচ্ছে। আমার। আপনাদের বা অন্য সবার চেয়ে ওকে ভাল করে চিনি আমি। মাইক যে কি ধরনের ভাল ছেলে তা আপনারা ওকে চেনেন না বলে বুঝতে পারবেন না। খুনের মত জঘন্য কাজ করা তো দূরের কথা, চিন্তা পর্যন্ত করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। আমি যত লোককে চিনি তাদের মধ্যে ওই সবচেয়ে বেশি আইন মেনে চলতে অভ্যস্ত। ওকে একটা মিথ্যে কথা পর্যন্ত বলতে শুনিনি কখনও।

কত দিনের পরিচয় আপনাদের? মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল ফিলিপস।

এক বছরের বেশি।

কথাটা শুনে ডিটেকটিভ দুজন মুচকি হাসল দেখে অবাক হলো কে।

কয়েকটা কথা আপনাকে জানানো দরকার, বলল ফিলিপস। হ্যাঁ, সে রাতে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওর বাবাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল ও। কি মনে করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন একজন পুলিশ ক্যাপটেনের সাথে তর্ক হয় ওর। ক্যাপটেন ওখানে তার একটা অফিশিয়াল কাজে গিয়েছিলেন। কথা কাটাকাটির মধ্যে মাইকেল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ফলে বেদম মার খেতে হয় ওকে। কয়েকটা দাঁত তো হারিয়েছেই, চোয়ালটাও ভেঙে গেছে। ওর বন্ধুরা ওকে কর্লিয়নিদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। পরদিন রাতে মার খাওয়ার প্রতিশোধ নেবার জন্যে পুলিশ ক্যাপটেনকে গুলি করে ও, ক্যাপটেন সেখানেই মারা যান। খুন করেই গা ঢাকা দিয়েছে মাইকেল, একেবারে মিলিয়ে গেছে বাতাসে। অসংখ্য ইনফর্মার আছে আমাদের, অগুনতি গোয়েন্দা আছে, তারা সবাই খবরাখবর সংগ্রহ করে একবাক্যে জানাচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র নায়ক মাইকেল কর্লিয়নি। তবে, স্বীকার করছি, আদালত গ্রাহ্য করবে এমন কোন নিচ্ছিদ্র প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যখন গুলি করা হয়, সেখানে একজন ওয়েটার উপস্থিত ছিল কিন্তু মাইকের ছবি দেখে চিনতে পারেনি সে। হয়তো সামনে থেকে দেখলে চিনতে পারবে। সলোমোর গাড়ির ড্রাইভারও কাছেপিঠে ছিল, কিন্তু সে ব্যাটার মুখ খোলানো যাচ্ছে না। তবে মাইকেল কলিয়ান অ্যারেস্ট হয়েছে শুনলেই সে হয়তো, মূর্খ খুলবে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট, এফ-বি-আই, আরও নানা প্রতিষ্ঠানের সব লোক গরুখোঁজা করছে ওকে। এখন পর্যন্ত ওর কোন হদিসই করতে পারিনি আমরা, তাই ভাবলাম আপনি কিছু জানালেও জানাতে পারেন।

আপনাদের একটা কথাও বিশ্বাস করি না, নিস্তেজ গলায় বলল কে। মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার। বুঝতে পারছে, মাইকের চোয়াল ভাঙার কথাটা মিথ্যে হতে পারে না। কিন্তু তাই বলে খুন? কখনও না! অসম্ভব!

মাইকেল কর্লিয়নি যদি আপনার সাথে যোগাযোগ করে, জানতে চাইল ফিলিপস, আপুনি আমাদেরকে জানাবেন কি?

দ্রুত এবং একরোখা ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কে–জানাবে না।

আপনারা একই কামরায় থাকতেন, রূঢ়, কর্কশ গলায় বলে উঠল সহকারী ডিটেকটিভ সিরিয়ানি, সে-খবর জানা আছে আমাদের। কাগজ-পত্র, সাক্ষী ইত্যাদি সব আছে হোটেলে। কথাটা যদি খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিই, আপনার মা-বাবার কেমন লাগবে? ভদ্র পরিবারের মেয়ে আপনি, একজন গুণ্ডার সাথে রাত কাটিয়েছেন, শুনে কারোরই ভাল ধারণা হবে না আপনার সম্পর্কে। নিজের সম্মান। যদি বাঁচাতে চান, সর কথা আমাদেরকে খুলে বলুন, তা না হলে এক্ষুণি আপনার বুড়ো বাপকে ডেকে সব কথা বলে দেব।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে কে। এধরনের হুমকি গুনতে হবে তা সে জীবনেও কল্পনা করেনি। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। দরজার দিকে এগোচ্ছে।

এক ঝটকায় খুলে ফেলল দরজাটা কে। দেখল, বৈঠকখানার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছেন বাবা। বাবা, এখানে একবার আসবে তুমি?

ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন মি. অ্যাডামস, মিষ্টি করে হাসলেন, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে পড়ার ঘরে চলে এলেন দরজার চৌকাঠ টপকেই একটা হাত দিয়ে মেয়ের পিঠটা জড়িয়ে ধরলেন তিনি, তাকিয়ে আছেন ডিটেকটিভদের দিকে। বললেন, হ্যাঁ, বলুন।

কে-র আচরণ দেখে দুজন ডিটেকটিভই থ হয়ে গেছে। ওরা কেউ কথাই বলতে পারছে না।

দিন! সিরিয়ানির দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠাণ্ডা আঁঝের সাথে বলল কে। সব কথা বলে দিন।

চেহারা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে সিরিয়ানির। বলল, মি. অ্যাডামস, কথাগুলো আমি আপনার মেয়ের ভালর জন্যেই বলছি। আপনার মেয়ে একটা গুণ্ডার সাথে মেলামেশা করেন। আমাদের বিশ্বাস, এই লোকটা একজন পুলিশ অফিসারকে খুন করেছে–আমি মিস কে-কে বলছি নোকটাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তিনি যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা না করেন, তাহলে হয়তো বিপদে জড়িয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু মুশকিল হলো, ব্যাপারটার গুরুত্ব উনি কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। আপনি কি ওকে একটু বোঝাবার চেষ্টা করে দেখবেন?

আপনাদের বক্তব্য আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, নরম গলায় বললেন মি. অ্যাডামস।

চিবুক উঁচু করে সিরিয়ানি বলল, আপনার মেয়ে আর ওই গুণ্ডা মাইকেল আজ এক বছর ধরে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও খোলামেলাভাবে মেলামেশা করছেন। আপনি চাইলে আমরা প্রমাণ দেখাতে পারব, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে হোটেলে থেকেছে ওরা। আবার বলছি আমি, মাইকেল কর্লিয়নিকেজো হচ্ছে একজন পুলিশ অফিসারকে খুনের সন্দেহে। খোঁজার ব্যাপারে আপনার মেয়ে আমাদেরকে সাহায্য করতে রাজী হচ্ছেন না। এই হলো ব্যাপার। আপনি অবিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু যা বলছি তা আমরা প্রমাণ করতে পারি।

আপনার সব কথা আমি অবিশ্বাস করছি না, মদ গলায় মি. অ্যাডামস বললেন, আমার মেয়ে যা করেছে তার জন্য গুরুতর বিপদ হতে পারে, আপনার এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

অবাক হয়ে বাবার দিকে চেয়ে আছে কে। সমস্ত ব্যাপারটা বাবা এত হালকা ভাবে নিতে পারছেন দেখে অবাক হয়ে গেছে সে।

যাই হোক, একটা বিষয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, দৃঢ়কণ্ঠে মি, অ্যাডামস বললেন, ছোকরা যদি এখানে তার চেহারা দেখায় সাথে সাথে এখানকার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেব আমি। আমার মেয়েও তাই করবে। কিছু যদি মনে না করেন, এখন আমাদের মাফ করতে হবে, খাবারঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

প্রচুর সৌজন্য দেখিয়ে ওদেরকে বিদায় করলেন তিনি। তারপর আস্তে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা। মেয়ের হাত ধরে বাড়িটার একেবারে পিছনে রান্নাঘরের দিকে তাকে নিয়ে চললেন। চল, মা, খাবার নিয়ে বসে আছে তোর মা।

রান্নাঘরে পৌঁছুবার আগেই নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে কে। কারণ আর কিছু নয়, দুর্ভাবনা থেকে নিষ্কৃতি, বাবার এমন নিঃশর্ত ভালবাসা।

রান্নাঘরে ঢুকল ওরা। মা যেন ওর কান্না দেখতেই পেলেন না, তাতে কে বুঝতে পারল বাবা নিশ্চয় তাকে ওই দুই গোয়েন্দার কথা আগেই বলে রেখেছেন। নিজের জায়গায় বসে পড়ল সে। কোন কথা না বলে খাবার পরিবেশন করছেন মা। খেতে শুরু করার আগে মাথা নিচু করে একটু প্রার্থনা করলেন বাবা।

মিসেস অ্যাডামস একটু বেঁটে। মোটাসোটা মানুষ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপড় পরেন। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ান। মাকে কখনও বিস্ত বেশবাসে দেখেনি কে। কিন্তু মেয়ের সাথে মায়ের ব্যবহারে সব সময়ই একটু কৌতূহলের অভাব দেখা যায়, কেমন যেন একটু দূরত্ব বজায় রাখেন। এখনও তাই করছেন। দেখ, কে, এত নাটক করিস না। কিসের এত ভাবনা, শুনি? ছেলেটা তো ডার্টমাথ থেকে পাস করেছে, এ ধরনের কোন নোংরামির মধ্যে ও যেতেই পারে না। অসম্ভব।

চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল কে? তুমি কি করে জানলে?

নির্বিকারভাবে মা বললেন, এখনও ছেলেমানুষ যারা তারা একটা ধোয়াটে ভাব সৃষ্টি করে নিজেদের ভারি চালাক মনে করে। মাইকেলের কথা আমরা অনেক দিন থেকেই জানি, কিন্তু তুই কিছু না বললে আমরা কথাটা তুলি কি করে?

কে জানতে চাইল, কিন্তু জানলে কি করে? বাবার দিকে এখনও তাকাতে পারছে না সে। বাবা যে জেনে গেছেন মাইকের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে ও। তাই কথাটার উত্তর দেবার সময়, বাবার মুখের হাসিটা দেখতে পেল না সে।

বুঝতেই পারছ, ওর চিঠি খুলেছিলাম আমরা।

স্তম্ভিত হয়ে গেল কে, তারপর রেগেমেগে ঝট করে এবার বাবার দিকে তাকাল সে। ভাবছে, বাবা যা করেছেন সে তো ওর নিজের অপরাধের চাইতেও জঘন্য। কিন্তু কথাটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। না, বাবা! তুমি চিঠি খোলোনি, খুলতে পারো না।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন বাবা। প্রথমে অনেক ভাবলাম, কোনটা বেশি মন্দ কাজ–তোমার চিঠি খোল, নাকি আমাদের একমাত্র সন্তান কোথায় কোন বিপদে পড়ছে সে বিষয়ে অজ্ঞ থাকা। উত্তরটা সহজ এবং সৎ।

সেদ্ধ মুরগিতে দুটো কামড় বসিয়ে মা বললেন, বয়সের তুলনায় তুই খুব কাঁচা। আমাদের জানা দরকার, অথচ ওর কথা নিজে থেকে কিছুতেই তুই বলবি না।

মাইকেল তার চিঠিতে কখনও ভালবাসার কথা লেখেনি ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করল কে। ওর নিজের লেখা কোন চিঠি মা-বাবা দেখেননি ভেবে একটা হাঁফও ছাড়ল। ওর কথা, ওদের বাড়ির কথা শুনে তোমরা আঁতকে উঠবে ভেবে ভয়ে বলিনি…

প্রফুল্ল কণ্ঠে বললেন মি. অ্যাডামস, আঁতকেই উঠেছিলাম। ভাল কথা, তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি তো মাইকেল?

মাথা নেড়ে কে বলল, ও কোন অপরাধ করতে পারে না।

 লক্ষ করল কে, মা-বাবা দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

নরম গলায় মি. অ্যাডামস বললেন, যদি অপরাধ করে না থাকে, অথচ কোন খোঁজ নেই, তার মানে হয়তো ওর আর কিছু হয়েছে।

কথাটা প্রথমে বুঝতে পারল না কে। তারপর টেবিল থেকে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে ছুটতে শুরু করল। নিজের ঘরে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা। বিছানায় আছড়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

.

তিনদিন পর। লং বীচে কর্লিয়নিদের উঠানের সামনে একটা ট্যাক্সি এসে থামল। সেটা থেকে নামল কে অ্যাডামস। ফোন করে এসেছে, ওরা জানে আসছে ও। টম হেগেনকে দরজার কাছে এগিয়ে আসতে দেখে একটু নিরাশ হলো কে। ও জানে, টম কিছু প্রকাশ করবে না।

বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে ওর হাতে এক গ্লাস শ্যাম্পেন দিল টম। কয়েকজন লোক এ-ঘর ও-ঘর করছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সনি নেই।

মাইক কোথায়, জানেন? সরাসরি প্রশ্ন করল কে। ওর সাথে কোথায় যোগাযোগ করতে পারি জানাতে পারেন আমাকে?

ও ভাল আছে, এটুকু জানি, মোলায়েম সুরে হেগেন বলল, তবে ঠিক এই মুহূর্তে কোথায় আছে তা বলতে পারি না। ক্যাপটেনের গুলি খাওয়ার কথা শুনে ওর ভয় হলো, ব্যাপারটার সাথে ওকে জড়িয়ে ফেলা হতে পারে। তাই ঠিক করল, নিখোঁজ হয়ে যাবে। মাস কয়েক পর যোগাযোগ করবে, এর বেশি কিছু বলে যায়নি আমাকে।

কথাগুলো সত্যি নয়, এবং বলাও হলো এমন ভাবে যেন কে সেটা ধরতে পারে।

ওই ক্যাপটেন কি সত্যি ওর চোয়াল ভেঙে দিয়েছিল? জানতে চাইল কে।

দুঃখের বিষয়, বলল টম, কথাটা সত্যি। তবে মাইক কোন দিনই প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়। পরের ঘটনাটার সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই, এটুকু নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি।

ব্যাগ খুলে একটা চিঠি বের করে কে বলল, ও যদি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করে, এই চিঠিটা ওকে দেবেন।

এদিকে-ওদিকে মাখা,নাড়ল হেগেন। পরে আপনি যদি আদালতে বলেন আমি চিঠি নিয়েছিলাম, তার মনে করা হবে, মাইক কোথায় আছে তা আমি জানতাম। আরেকটু অপেক্ষা করুন না কেন? মাইকই আপনার সাথে যোগাযোগ করবে।

পানীয়টুকু শেষ করে, বাড়ি যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল কে। হেগেন তাকে হল অবধি নিয়ে এল। কিন্তু দরজা খুলতেই, বাইরে থেকে একজন মহিলা এসে ঢুকলেন। মোটা, বেটে, পরনে কার্লো পোশাক। চিনতে পারল কে, মাইকেলের মা। কেমন আছেন, মিসেস কর্লিয়নি? হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে।

ও হো, তুমি তো মাইকের বান্ধবী, কথায় কড়া ইতালীয় টান, কে প্রায় বুঝতেই পারছে না কি বলছেন। মিষ্টি, ছোট্ট করে হাসলেন, তারপর জানতে চাইলেন, কিছু খাবে?

কে বলল, না। খাবার ইচ্ছা নেই ওর।

কিন্তু মিসেস কর্লিয়নি রেগেমেগে টম হেগেনের দিকে ফিরে তাকে ইতালীয় ভাষায় খানিকটা বকাবকি করলেন, বললেন, বেচারা মেয়েটাকে কিছু খেতে পর্যন্ত দাওনি, এ কেমন আক্কেল তোমার! কে-র হাত ধরে তাকে রান্নাঘরে নিয়ে এলেন তিনি।

একটু কফি আর তার সাথে কিছু খাও, তারপর কেউ তোমাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবে। তোমার মত একটা ভাল মেয়ে ট্রেনে করে একা ফিরবে, তা আমার পছন্দ নয়। কে-কে চেয়ারে বসিয়ে ব্যস্তভাবে রান্নাঘরের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। নিজের টুপি আর কোট খুলে একটা চেয়ারের ওপর ঝুলিয়ে রাখলেন। স্টোভের ওপর কফি ফুটছে।

মাইকের খোঁজ নিতে এসেছিলাম, ভয়ে ভয়ে কে বলল, ওর কোন খবর পাইনি। মি. হেগেন বলছেন, ও কোথায় আছে কেউ জানে না। কিছু দিন পর নাকি নিজেই ফিরে আসবে।

এর বেশি ওকে কিছু বলা যায় না, মা,হেগেন তাড়াতাড়ি বলল।

মিসেস কর্লিয়নি তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে টমকে প্রায় ভস্ম করে দিয়ে বললেন, কি করতে হবে না হবে, সে কি তুই আমাকে শিখাবি? আমার স্বামী পর্যন্ত সে-সুযোগ পায় না। যীশু তার ওপর দয়া করুন। বুকের ওপর কুশ আঁকলেন তিনি।

মি. কর্লিয়নি এখন কেমন আছেন? জানতে চাইল কে।

খুব ভাল আছেন,মিসেস কর্লিয়নি বললেন। বুড়ো হয়েছেন তো, বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। নইলে অমন ঘটনা ঘটতে দেন কখনও! হতাশ ভঙ্গিতে নিজের মাথায় টোকা দিলেন তিনি। তারপর কফি খাওয়া শেষ করে নিজের মেটে রঙের হাত দিয়ে কে-র একটা হাত ধরলেন, ধীরে ধীরে বললেন, মাইক তোমাকে চিঠি লিখবে না। তুমি তার কাছ থেকে কোন খবর আশা কোরো না। দু-তিন বছর তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। হয়তো তারও বেশি। তুমি ফিরে যাও, তারপর একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে করো, মা।

ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে কে বলল, এটা তাকে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?

বুড়ি ভদ্রমহিলা চিঠিটা নিয়ে কে-র গালে একটা আলতো চাপড় মেরে বললেন, নিশ্চয় পারব।

হেগেন আপত্তি করতে যাচ্ছে, কিন্তু ভদ্রমহিলা ইতালীয় ভাষায় চাচাতে শুরু করলেন। তারপর কে-কে দোরগোড়া অবধি পৌঁছে দিয়ে চট করে গালে একটা চুমো খেয়ে বললেন, মাইকের কথা ভুলে যেও। সে আর তোমার উপযুক্ত নয়।

বাইরে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে গাড়ি। সামনের সীটে বসে আছে দুজন লোক। কোন কথা না বলে ওকে একেবারে নিউ ইয়র্কে পৌঁছে দিয়ে গেল তারা। কে-ও কোন কথা বলল না। সে এখন একটা কথা মনের মধ্যে বনাবার চেষ্টা করছে: তার ভালবাসার মানুষটি একজন নৃশংস হত্যাকারী। যার মুখ থেকে এ-কথা বেরিয়েছে তার কথা অবিশ্বাস করা যায় না। কারণ, সে হলো মাইকের আপন মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *