১.৬ একফালি তাজা ইতালীয় রুটি

০৬.

ভোর।

একফালি তাজা ইতালীয় রুটি, পুরু এক টুকরো জোনোয়ার সসেজ, এক গ্লাস গ্রাপা এবং সবশেষে চীনামাটির জাগ ভর্তি ধুমায়িত কফি পান করে নাস্তা সারল ক্লেমেঞ্জা। ড্রেসিং গাডন আর লাল চামড়ার স্যাণ্ডেল পরে পায়চারি করছে সে, দিনের শুরুতেই আজকের কাজের কথাগুলো ভেবে নিচ্ছে। কাল রাতে সনি কর্লিয়নি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে পলি গাটোর ব্যাপারটা দেরি করা চলবে না। তার মানে আজই ব্যবস্থাটা করতে হবে।

বেশ একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে ক্লেমেঞ্জা। ওর অধীনে থেকে পলি গাটো বেঈমানী করেছে বলে নয়। যা ঘটেছে তার জন্যে একজন ক্যাপোরেজিমির বিচার বুদ্ধিকে দোষ দেয়া চলে না। পলি গাটোর অতীত সম্পর্কে সবাই জানে, তাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠেনি কখনও। সিসিলীয় পরিবারের ছেলে সে, একই পাড়ায় কর্লিয়নিদের ছেলেদের সাথে খেলাধুলো করে বড় হয়েছে, স্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া শিখেছে। কাজে নেবার আগে সব রকম ভাবে পরীক্ষাও করা হয়েছিল তাকে, কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল সে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে এই পরিবারের কাছ থেকে ভাল বোজগারের সুযোগও আদায় করে নিয়েছিল–ঈস্ট সাইডের জুয়া ব্যবসার অংশ পেত, ইউনিয়ন থেকেও টাকা নিত। নিয়মের বাইরে গায়ের জোর দেখিয়েও এখান সেখান থেকে টাকা খেত সে, জানত ক্লেমেঞ্জা। এতে তার দক্ষতাই প্রমাণ হয়েছে। এ-ধরনের ছোটখার্ট নিয়ম ভাঙাকে সজীব প্রাণচাঞ্চল্য বলেই মনে করত তারা। তাগড়া ঘোড়া যেমন তার লাগামের সাথে লড়ে। জোর করে টাকা তোলার সময় কখনও কোন হাঙ্গামার সৃষ্টি করেনি পলি। কেউ আহত হয়নি কখনও। যাই হোক, ছেলেছোকরাদের হাত লম্বা হলে সুবিধেই হয় তাতে। কাজে আগ্রহ বাড়ে। পলির ব্যাপারটা তাই ভাল চোখেই দেখা হয়েছে। কিন্তু সে যে বেঈমানী করে বসবে:ত কে ভেবেছিল!

পলি এখন কোন সমস্যা নয়। তার শাস্তির ব্যবস্থা করা দৈনন্দিন আর সব কাজের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ব্যবস্থাপনার বিষয়টা নিয়ে সমস্যায় পড়েছে ক্লেমেঞ্জা। নিচে থেকে কাকে টেনে তুলে পাটোর জায়গায় বসাবে সে? কে লাভ করবে পদোন্নতি?

কর্লিয়নি পরিবারে পদের বিশেষ গুরুত্ব আছে। সদ্য শূন্য পদটির নাম বাটন ম্যান। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ, যাকে তাকে এ পদে বসানো হয় না। শক্তি এবং বুদ্ধি তার থাকতেই হবে, হতে হবে অতি বিশ্বস্ত। মৌন থাকার সিসিলীয় মন্ত্র, যার নাম ওমের্তা; সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে তাকে, প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে গেলেও যে পুলিশের কাছে মুখ খুলবে না।

তারপর ভাবছে ক্লেমেঞ্জা, এই পদে যে আসবে তার আয়ের ব্যবস্থা কি করা হবে সেটাও একটা সমস্যা। ডনকে সে অনেকদিন থেকেই বলছে বাটন-ম্যানদের রোজগারের রাস্তা বড় করা দরকার, কিন্তু ডন সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছেন। পলি গাটোর রোজগার আরও বেশি হলে সলোহোর টোপ হয়তো গিলত না সে।

মনে মনে সম্ভাব্য তিনজন প্রার্থীর একটা তালিকা তৈরি করল ক্লেমেঞ্জা।

এনফোর্সার বলা হয় যে লোকটাকে তার কথা প্রথমে বিবেচনা করল ক্লেমেঞ্জা। হার্লেমের নিগ্রো পলিসি ব্যাঙ্কার-দের সাথে কাজ করে সে, শক্তিমান প্রকাণ্ডদেহী, সবার সাথে তার বলিবনা আছে–আবার তাদের মনে ভয় ঢোকাতেও তার জুড়ি নেই। কিন্তু আধঘণ্টা ভাবনাচিন্তা করে তালিকা থেকে তার নামটা কেটে দিল ক্লেমেঞ্জা। নিগ্রোদের সাথে বড় বেশি মাখামাখি করে লোকটা, তারমানে নিশ্চয়ই তার চরিত্রে কোথাও গলদ আছে। তাছাড়া, যে পদ থেকে তাকে তুলে আনা হবে সে পদের জন্যে উপযুক্ত লোক জোগাড় করাও কঠিন হবে।

দ্বিতীয় লোকটাকেই দেয়া যেতে পারে পলি গাটোর পদটি, প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ক্লেমেঞ্জা। প্রচণ্ড পরিশ্রমী লোক সে, সব কাজ নিপুণভাবে শেষ করে, সংগঠনের কাজে পাকা কর্মী। প্রথমদিকে বুকমেকারের চর ছিল সে, এখন কর্লিয়নিদের লাইসেন্স প্রাপ্ত মহাজনদের কাছ থেকে ডেলিঙ্কোয়েন্ট অর্থাৎ অবহেলিত অ্যাকাউন্ট সংগ্রহ করে। কিন্তু এখনও সে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদের যোগ্যতা অর্জন করেনি।

শেষ পর্যন্ত রকো ল্যাম্পনি নামে একজন লোককে নির্বাচন করল ক্লেমেঞ্জা। অল্পদিন হলো কর্লিয়নি পরিবারে যোগ দিয়ে হাতে কলমে কাজ শিখছে বটে, কিন্তু এরই মধ্যে কাজ দেখিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে সে। আফ্রিকাতে যুদ্ধ করে আহত হয়েছে লোকটা, সামরিক বাহিনী থেকে ছাড়া পেয়েছে উনিশশো তেতাল্লিশ সালে। আহত হবার ফলে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে, কিন্তু সে সময় অল্প বয়েসি লোকজনের খুব অভাব বলে বাধ্য হয়ে কাজে লাগিয়েছিল তাকে ক্লেমেঞ্জা। সেই ক্ষুদ্র পদ থেকে ধাপে ধাপে উঠে রকৌ ল্যাম্পনি আজ গোটা সংগঠনের পরিত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় গুণ ওর সূক্ষ্ম বিচার বোধ। অল্প দাম দিয়ে দামী জিনিস কেনার অদ্ভুত একটা প্রবণতা রয়েছে ওর। গায়ের জোর এবং হুমকি হলো ওর সেই অল্প দাম, এই দাম দিয়ে বড় বড় মুনাফা লাভের পক্ষপাতী ও। যে অপরাধ করলে সামান্য একটা জরিমানা অথবা বড়জোর ছয় মাসের জেল হতে পারে সে অপরাধ তেমন লাভজনক নয়, তাই গায়ের জোর বা হুমকি একেবারে না খাটালে নয় বলেই খাটায় ও। ওর বুদ্ধির এমনই গভীরতা যে এসব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভীত প্রদর্শন না করে অল্প অল্প ছোটখাটো ভয় দেখিয়ে কাজ উদ্ধার করে নেয়।

রকো ল্যাম্পনিকে নির্বাচিত করে ক্লেমেঞ্জা সিদ্ধান্ত নিল আজকের কাজটায় সে নিজে উপস্থিত থাকবে। এবং তাকে সাহায্য করবে রকো। নতুন একজন লোককে বাস্তব জ্ঞান দেবার উদ্দেশ্যে কাজের সময় সশরীরে সেখানে উপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়নি সে, সিদ্ধান্তটা নিয়েছে পলি গাটোর সাথে তার নিজের একটা হিসাব নিকাশ আছে বলে। শুধু কর্লিয়নি পরিবারের সাথে নয়, পলি গাটো ক্লেমেঞ্জার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সাংঘাতিক অপমানিত হয়েছে সে। এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়া দরকার।

আগেই পলি গাটোকে বলে রাখা হয়েছে সে যেন বেলা তিনটের সময় নিজের গাড়িতে তুলে নেয় ক্লেমেঞ্জাকে।

রকো ল্যাম্পনিকে ফোন করল ক্লেমেঞ্জা এবার। নিজের পরিচয় না দিয়ে শুধু বলল, কাজ আছে, আমার বাড়িতে এসো।

ঠিক আছে, বলল রকো। এই ভোরেও তার কণ্ঠস্বরে ঘুমের জড়তা বা বিস্ময়ের সুর নেই লক্ষ্য করে খুশি হলো ক্লেমেজা।

তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বলল ক্লেমেঞ্জা। তবে বেলা দুটোর পর আর দেরি করো না।

আবার সংক্ষিপ্ত ঠিক আছে ভেসে এল অপরপ্রান্ত থেকে। রিসিভার রেখে দিল ক্লেমেঞ্জা।

আরেকটা কাজের কথা মনে পড়ল তার। প্রাঙ্গণে টেসিওর দলের জায়গায় ওর দলের লোকেরা জায়গা নেবে। এ ব্যাপারে আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছে, সে নিজের লোকজনকে। তারা অন্তত দক্ষ, ঠিকঠাক পালন করবে নির্দেশ। সুতরাং এ কাজের ব্যাপারেও চিন্তার কিছু নেই।

ক্লেমেঞ্জা ঠিক করল ক্যাডিলাকটাকে ধোবে সে। খুব প্রিয় গাড়ি এটা তার। চলার সময় একটুও শব্দ করে না। গদিগুলো এত দামী আর আরামদায়ক যে দিনটা ভাল থাকলে গাড়িতে বসে ঘন্টাখানেক সময় কাটায় সে-বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে অনেক লোভনীয় সেটা। তারপর মনে পড়ল, বাবা বলতেন, গাধার গা ধুইয়ে দেবার সময় তার নাকি বুদ্ধি খুলত। কথাটা তার জন্যেও সত্যি। গাড়ি ধোবার সময় তারও বুদ্ধি খুলে যায়।

শীত সহ্য হয় না তার, গরম গ্যারেজে দাঁড়িয়ে কাজ করছে সে, আর চিন্তাভাবনা করছে। পলি ছুঁচোর মত চালাক, বাতাসে বিপদের গন্ধ পায়। এগোতে হবে খুব সাবধানে। তবে যতই শক্তিমান থোক, ডন বেঁচে আছেন শুনে নিশ্চয়ই ঘন্টায় ঘন্টায় প্যান্ট নষ্ট করে ফেলছে। গাধার পাছায় পিঁপড়েদের ভিড় জমলে সে যেমন ছটফট করে, এর অবস্থাও তাই হয়েছে।

রকোকে সাথে নেবার একটা অজুহাত দাঁড় করাতে হবে। তাছাড়া, তিনজনের একত্রে কোথাও যাবার একটা বিশ্বাসযোগ্য উদ্দেশ্য না দেখাতে পারলে সন্দেহ জাগবে তার মনে।

অবশ্য, এত ঝামেলায় না গিয়ে পলিকে আরও সহজে খুন করা যায়। নজরবন্দী রাখা হয়েছে, পালাতে পারবে না। কিন্তু সব কাজ নিয়ম ধরেই হওয়া চাই, এবং যার যা প্রাপ্য তাকে তা নিতেই হবে, রেহাই পাওয়া চলবে না।

ফিকে নীল রঙের ক্যাডিলাকটা ধুচ্ছে আর চিন্তা করছে সে, পলিকে কি কথা বলবে, কখন কি রকম হবে তার মুখের ভাব ইত্যাদি।

কথা বলবে কম, অসন্তুষ্ট হয়েছে এরকম একটা ভাব দেখাতে হবে। সন্দিগ্ধ স্বভাব গাটোর, বুদ্ধিটাও ধারাল, সদ্ভাব প্রকাশ করলেই সতর্ক হয়ে উঠবে। অন্যমনস্কতার ভান করে বিরক্তি দেখাতে হবে। কিন্তু রকোকে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যেতে পারে পলি। ড্রাইভিং সীটে হাতে হুইল নিয়ে বসে থাকা অবস্থায় এমনিতেই অসহায় মনে হবে নিজেকে তার, তার উপর রকো যদি মাথার পিছনে থাকে, ঘাবড়ে তো যাবেই পলি। তাহলে উপায়? সাথে আরেকজন লোক নিলে কেমন হয়? না। কারণ ভবিষ্যতের কথা কিছুই বলা যায় না। ভবিষ্যতে কে ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে না দেবে এখনও তা বলা যায় না। ওর জবানবন্দীর বিরুদ্ধে দুজন কথা বললে বিপদ গুরুতর আকার ধারণ করবে। না, আগের উপায়টাই ভাল।

আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া আছে, শাস্তিদানের ব্যাপারটা চেপে রাখা হবে না। অর্থাৎ, লাশটা খুঁজে পাওয়া যাবে।

লাশ লুকিয়ে ফেলার জন্যে সাধারণত নাগালের কাছে মহাসাগর অথবা নিউজার্সিতে পারিবারিক বন্ধু বান্ধবদের জমি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, বিশেষ কারণ দেখা দিলে নানান জটিল উপায় অবলম্বন করা হয়। কিন্তু পলি গাটোর লাশ গুম করা যাবে না দুটো কারণে। এক, তার লাশ দেখিয়ে সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকদের মনে ভয় ঢোকাতে হবে। দুই, শত্রুদেরকেও সতর্ক করা দরকার-কর্লিয়নিরা নির্বোধ এবং দুর্বল নয় এটা তাদেরকে বোঝাতে সাহায্য করবে লাশটা।

ধোঁয়া মোছর পর ঝকঝকে ক্যাডিলাকটাকে বিশালএকটা নীল রঙের ইস্পাতের তৈরি ডিমের মত দেখাচ্ছে। কাজের শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ একটা বুদ্ধি পেয়ে গেল ক্লেমেঞ্জা। সব সমস্যার চমৎকার একটা সমাধান বের করে ফেলেছে সে।

পরিবারগুলোর লড়াই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করলে সবাই তখন পরিচিত আবাসস্থল ছেড়ে গোপন ফ্ল্যাটে অস্থায়ী আস্তানা গাড়ে। সেই সব ফ্ল্যাটে সৈনিকরা তোষক বিছিয়ে রাতে শোয়। এই ব্যবস্থার অনেক সুবিধে আছে। সাধারণত বিশ্বস্ত, একজন কাঁপোরেজিমিই খুঁজে পেতে বের করে গোপন আস্তানা, সেখানে অনেকগুলো তোষকের ব্যবস্থা রাখা হয়। এই গোপন আস্তানা থেকে গা ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে সৈনিকরা হামলা চালায় শত্রুদের উপর। এখন ক্লেমেঞ্জা যদি গোপন আস্তানা খুঁজতে বেরোয়, সেটা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। আস্তানার জন্যে তোষক, আসবাব মোগাড় করার জন্যে তার সাথে লোক থাকা দরকার–সুতরাং গাটো আর রকোকে নিচ্ছে সে। আপন মনে হাসল ক্লেমেঞ্জা। কথাটা শুনেই অতি লোভী পলি ভাববে এই তথ্যের বিনিময়ে সলোযোর কাছ থেকে কত টাকা আদায় করা সম্ভব।

 ঠিক সময়ে এসে পৌঁছুল রকো ল্যাম্পনি। পূব কথা বলল তাকে ক্লেমেঞ্জা। বিস্ময়ে, কৃতজ্ঞতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রকোর মুখ। সমীহের সাথে ধন্যবাদ জানাল সে। তার কাধ চাপড়ে দিয়ে বলল ক্লেমেঞ্জা, আজ থেকে তোমার রোজগার কিছু বাড়বে। তবে এ-বিষয়ে এখন কোন আলোচনা নয়। বুঝতেই তো পারছ, হাতে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে আমাদের।

রকো জানাল, এসব ব্যাপারে সে ধৈর্য ধরতে জানে।

সেফ খুলে একটা পিস্তল বের করে রকোকে দিল ক্লেমেঞ্জা। পলির সাথে গাড়িতেই ফেলে রেখো এটা। সূত্র ধরে এর মালিককে খুঁজে বের করা সম্ভভ নয় কারও পক্ষে।

একটু পরই এল পলি গাটো। বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সে। পিছনে রকোকে নিয়ে গাড়ির কাছে হাজির হলো ক্লেমেঞ্জা। সামনের সীটে গাটোর পাশে, গম্ভীর মুখে বসল সে। বিরক্তির সাথে রিস্ট ওয়াচ দেখল একবার। ভাবটা এই রকম, পলি যেন আসতে দেরি করেছে।

ঘাড় ফিরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে ক্লেমেঞ্জার দিকে তাকিয়ে আছে পলি। পিছনের সীটে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ হতেই ভিউ মিররে তাকাল সে, রকো ল্যাম্পনিকে দেখেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠল। অন্য ধারে সরে বসো, রকো। তোমার মত লম্বা চওড়া লোক ওখানে বসলে ভিউ মিররে কিছুই দেখতে পাব না।

সুবোধ বালকের মত সরে আরেক ধারে বসল রকে।

সনিটার দ্বারা কিচ্ছু হবে না, বুঝলে? ঝাঁঝ মেশানো বিরক্তির সুরে বলল ক্লেমেঞ্জা। এত ভয় পেলে চলে নাকি। চিন্তা করো, এখুনি তোষক পাততে চাইছে সে। একটু বিরতি নিয়ে আবার মুখ খুলল সে, পলি, রকোকে সাথে নিয়ে নতুন আস্তানার জন্যে লোকজন, আসবাব সব যোগাড় করতে হবে তোমাকে। কবে নাগাদ বাকি সৈনিকরা এই আস্তানায় জড়ো হবার হুকুম পাবে তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। আস্তানার জন্যে ভাল কোন জায়গার সন্ধান জানো নাকি?

মুহূর্তের জন্যে চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠল পলির, তা লক্ষ করে মনে মনে হাল ক্লেমেঞ্জা।

চমৎকার ভান করে যাচ্ছে রকো। জানালা দিয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে সে।

ভেবে দেখি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল পলি।

গাড়ি চালাতে চালাতে ভাব, মেজাজ খারাপ করে বলল ক্লেমেঞ্জা। আজই আমি নিউইয়র্কে পৌঁছুতে চাই।

অপ্রয়োজনীয় একটা কথাও হলো না গাড়িতে। ওয়াশিংটন হাইটসের দিকে যেতে বলল পলিকে ক্লেমেঞ্জা। ওখানে কয়েকটা ফ্ল্যাট বাড়ি দেখে নিয়ে আর্থার এভিনিউয়ে চলে এল। পলিকে গাড়ি থামাতে বলল সে।

রকোকে গাড়িতে রেখে নেমে গেল ক্লেমেঞ্জা। পায়ে হেঁটে ভেরা মারিয়ে, রেস্তোরাঁয় এল। স্যালাড আর মাংস দিয়ে হালকা ডিনার খেলো, এই ফাঁকে পরিচিত দুচার জনের সাথে কিছু কথাও হলো তার। ঘণ্টাখানেক রেস্তোরাঁয় কাটিয়ে আবার পায়ে হেঁটে ফিরে এল আর্থার এভিনিউয়ে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

গাড়িতে চড়ে বলল ক্লেমেঞ্জা, বোঝো এবার। এখন বলছে লং বীচে ফিরে যেতে হবে। সনি মত বদলেছে, এ কাজ পরে করলেও চলবে। রকো, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবো নাকি?

মৃদু গলায় বলল রকো, কিন্তু আমার গাড়িটা যে আপনাদের ওখানে রেখে এসেছি।

তবে তো তোমাকে আমাদের সাথেই ফিরতে হয়।

লং বীচে ফিরছে ওরা। এবারও কথা বলছে না কেউ। শহরে ঢোকার ঠিক আগে ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে ছুটছে গাড়ি। হঠাৎ বলল ক্লেমেঞ্জা, গাড়ি দাঁড় করাও, পলি। পেচ্ছাব না করলেই নয়।

ক্যাপোরেজিমির মূত্রাশয়টা একটু বেয়াদব, জানে পলি, হঠাৎ করে সময়ে, অসময়ে প্রায়ই তার পানি শ্রাগ করার বেগ চাপে। রাস্তার একধারে নরম মাটির উপর গাড়ি থামাল সে। নেমে গেল ক্লেমেঞ্জা, একটা ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। সেখানে সে প্রস্রাবও করল। তারপর ফিরে এসে গাড়ির দরজা খুলে চট করে রাস্তার এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলল, এবার মারো।

পিস্তলের আওয়াজটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মত শোনাল। সামনের দিকে লাফ দিল পলি, হুমড়ি খেয়ে পড়ল স্টিয়ারিং হুইলের উপর, সেখান থেকে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল সীটের উপর, তারপর কাত হয়ে গেল একদিকে। দ্রুত পিছিয়ে গেছে ক্লেমেঞ্জা, গায়ে যাতে খুলির কুচি বা রক্তের ছিটে না লাগে।

পিছনের সীটে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে নিচে নামল রকো। হাতের পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ঝোঁপের দিকে। তারপর ক্লেমেঞ্জার পিছু পিছু গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ানো একটা গাড়িতে চড়ে বসল।

সীটের নিচে হাত দিতেই চাবিটা পেল রকো। স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল সে।

ক্লেমেঞ্জাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে অন্য পথে ফিরে আসছে রকো। জেনিস বীচ কজওয়ে ধরে মেরিক শহরে পৌঁছল সে, ওখান থেকে মেডোরুক পার্কওয়ে ধরে সোজা ছুটল নর্দার্ন স্টেট পার্কওয়ের দিকে। বাক নিয়ে লং আইল্যান্ড এক্সপ্রেস ওয়েতে পড়ল সে, হোয়াইট স্টোন ব্রিজ পেরোল, তারপর ব্রঙ্কস হয়ে সোজা ম্যানহাটনের নিজের আস্তানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *