ইনট্রারেড

ইনট্রারেড

বিজ্ঞান কলেজের দিলীপ পাঠক যেভাবে সুনীলের কাণ্ড-ভঙ্গিমার বর্ণনা করলেন, তাতে আমি না হেসে পারিনি। সুনীলের পক্ষে এমন কাজ অবিশ্বাস্য। বুঝলাম, দিলীপবাবু হয় ভুল দেখেছেন, নয়তো ভুল বুঝেছেন। আমার হাসিতে তিনি আহত হলেন মনে হল। বললেন, আপনি হাসছেন। আমার কাছেও ব্যাপারটা অদ্ভুত শুধু নয়, অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। তাই কাউকে কিছু না বলে সোজা আপনার কাছেই চলে এলাম। আপনি শুধু তার বন্ধু নন, একজন প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার মনে হয়, সুনীলবাবুর মাথায় একটু…

দিলীপবাবু উঠলেন। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি দেখেছেন বললেন, তাতে আর ওই একটু শব্দটা বসানো যায় না। ঠিক আছে, আমি আজই যাচ্ছি সুনীলের কাছে। বলা যায় না, এটা ওর গবেষণার কোনও প্রক্রিয়াও হতে পারে। না-মানুষিক ব্যাপার যখন।

দিলীপবাবু অবাক হয়ে বললেন, গবেষণা? ওইভাবে! একই রকম চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। তাঁর কথা আমাকেও বেশ চিন্তাতে ফেলল। ঘটনাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে উদৃবিগ্ন হওয়ার ব্যাপার যে, তাতে সন্দেহ নেই।

সুনীল আমার বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছি। কর্মক্ষেত্রেও তার সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। আমি মনোরোগের চিকিৎসক আর সুনীল একজন বিখ্যাত ফিজিয়ো সাইকোলজিস্ট। অর্থাৎ দু-জনেরই কারবার মানুষের মন নিয়ে। একটু ভুল বললাম। ইদানীং সুনীল তার কাজের পরিধিটা একটু বাড়িয়ে (বা নামিয়ে) পশুপাখিদের মন নিয়েও কাজ করার অপচেষ্টা করছে। আমি মনুষ্যেতর প্রাণী বললাম না। আমার এই মনুষ্যেতর শুনলে ও অপচেষ্টা শব্দটা শোনার মতোই রেগে যাবে। সে বলে, ইতর শব্দটা মূল অর্থ থেকে সরে এসে যে অর্থ প্রকাশ করে, সেটা মানুষের মধ্যেই বরং দেখা যায়। অমানুষ শব্দের মতোই। সে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের ব্যবহৃত না-মানুষ শব্দটাই পছন্দ করত। প্রকৃতই সে একজন না-মানুষপ্রেমী ছোটবেলা থেকেই।

সুনীল সেনগুপ্তর সঙ্গে আমার যে আবাল্য বন্ধুত্ব, এটা একটা অসাধারণ ব্যতিক্রম। কারণ, তার কোনও বন্ধুই নেই। এর কারণ, সেই ছোটবেলা থেকেই তার মুখে একটা গাম্ভীর্যের বর্ম আঁটা। স্কুলের সহপাঠীরা তার নাম দিয়েছিল, গোমড়াথেরিয়াম। শুনে ক্ষণেকের জন্যে ঠোঁটে একটু হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেত। সব জমায়েতে যোগ দিত, কিন্তু উচ্ছ্বাস ফুটত না কোনও কথাতেই। কলেজের প্রাণতোষ চৌধুরী বলত, কলকাতায় নাকি তিনটে জিনিস দেখা যায় না। এক, প্রতিবেশী এক দেশের কিছু পুরুষ অধিবাসীকে এ শহরে দেখা গেলেও তাদের স্ত্রীদের। দুই, বিশেষ একটি রাজ্যের লোকের মৃতদেহ। আর তিন, সুনীলের শব্দ-করা হাসি। প্রথম দুটি তথ্যের কোনও সত্যতা নেই জানলেও তৃতীয়টি নিয়ে মতভেদ হত না আমাদের মধ্যে। চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস ছবিটা আগাগোড়া গম্ভীর মুখে দেখে যেতে দেখেছি তাকে। সেই সুনীল যদি আজ এহেন…

দিলীপ পাঠকের আজকের প্রাতঃকালীন অভিজ্ঞতার কথাটা বলি। বিজ্ঞান কলেজের দিলীপবাবু গবেষণার কোনও এক কাজেই আজ সকালে সুনীলের কাছে গিয়েছিলেন। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। দরজার বেল বাজাতেই সুনীলের কুকুর লুসি খোলা জানলার কাছে ছুটে এসে নাক বের করে যথারীতি সগর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। দিলীপবাবু অপরিচিত লোক। অপরিচিত কোনও আগন্তুক এলে তাকে লাঙ্গুল আন্দোলনে স্বাগত জানানো লুসির প্রকৃতিতে নেই। যতক্ষণ না মনিব তাকে সংকেত জানাবে যে, আগন্তুক কোনও বিপজ্জনক ব্যক্তি নয়, ততক্ষণ সে ঘেউ ঘেউ করে যাবে। তারপরেও সে মনিবের ওপর পুরো ভরসা না রেখে একটু দূরে সন্দিগ্ধ সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকবে।

দিলীপবাবু সেরকমই আশা করেছিলেন। সুনীলবাবু এখনই এসে লুসিকে সামলাবেন, তারপর দরজা খুলে তাঁকে ভেতরে ডাকবেন। তার পরিবর্তে তিনি যা দেখলেন, তাতে তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। এ-ও কি সম্ভব! সুনীলবাবু এসে লুসির পাশে দাঁড়ালেন। তারপর অবিকল লুসির ভঙ্গিমায় জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দিলীপবাবুর দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে অদ্ভুত ও বীভৎস আওয়াজ করতে লাগলেন। দিলীপবাবু হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিই জানেন না। যখন সংবিৎ ফিরল, সেই বিমূঢ় অবস্থাতেই সটান চলে এলেন আমার কাছে।

আমার স্ত্রী দীপাকে ব্যাপারটা বললাম। সে-ও বিশ্বাস না করে প্রথমে হেসে উঠল। বলল, দ্যাখো, তোমার ওই দিলীপবাবুই তোমার কোনও পেশেন্ট কি না। নিজের জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে এসে অন্যের কথা বলছেন। তুমিই তো বলেছ, পাগলদের ওরকম সাইকোসিস থাকে। তারপর আবার কী ভেবে বলল, তবে সুনুদার অদৃষ্টে এরকম দুর্গতিই লেখা আছে। বিয়ে-থা করলেন না। রতনদাও দেশে গিয়েছে। সে দিন ফোনে বললেন। আর ও তো গিয়ে ফেরার নাম করে না। কোথায় খাওয়াদাওয়া করছেন, ঈশ্বর জানেন। ইদানীং আবার কুকুর-বেড়াল-গোরু নিয়ে নাকি পড়েছেন। হয়তো লুসির খাবারই ভাগ করে খাচ্ছেন। ভরতমুনির গল্প জানো তো? হরিণ নিয়ে থাকতে থাকতে শেষে পরের জন্মে হরিণই হলেন।

আমি হেসে বললাম, পরের জন্মের কথা পরে হবে। আগে ইহজন্মে সুনীলের অবস্থা তো দেখে আসি। দিলীপবাবুকে সাইকোসিস রোগী বলে তো মনে হল না। সেরকম বুঝলে বাইরে থেকে টেলিফোন করব। পরিতোষ যেন চেম্বার বন্ধ রাখে আজ। পেশেন্টদের ফোন করে দিক।

দীপার গার্হস্থ্য কাজের সহকারিণী অনিলের মা ঘর মুছতে মুছতে বোধহয় সবই শুনেছে। সে মহা উৎসাহে তার চিলাখালি গ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলে উঠল, কুকুরে কামড়ালি এমনটি হতি পারে, দাদাবাবু। আমাদের গাঁয়ের ননি হালদারকে পাগলা কুকুরে কামড়াইছিল। সে কিছুতেই ইনজিশন নিল না। কিছু দিন পর সে কুকুরের নাগাল ঘেউ ঘেউ করতি করতি মরে গেল। সবাই দ্যাখে, তার মুখ আর কান কেমন নম্বা নম্বা হয়ে গেছে।

আমি হেসে উঠে বললাম, হতি পারে। তবে চিলাখালিতে অনেকে পাগলা ছাগলের কামড় খেয়েছে শুনেছি।

অনিলের মা-র অবাক বড় বড় চোখের সামনে দিয়েই আমি সুনীলের বাড়ি রওনা হলাম।

সুনীলের বাড়িতে মাসখানেক আগে এক রবিবারে শেষ যে দিন গিয়েছিলাম, সে দিন তার মধ্যে একটা ভাবান্তর লক্ষ করেছিলাম ঠিকই। দরজা ভেজানো ছিল। বরাবরের মতো বেল বাজিয়ে দরজায় টোকা দিতে লুসি ছুটে এসে সশব্দে আপ্যায়ন জানিয়ে পিঠ দিয়ে ঠেলেই দরজা খুলে দিল। দরজায় টোকার শব্দে সে কী করে জানল যে, দরজার এপারে তার মনিবের বন্ধু দীপায়ন মৈত্র, সেটা আমার মতন মানুষের মনের ডাক্তারের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সুনীল হয়তো বলতে পারে।

ঘরে ঢুকে সুনীলকে দেখলাম, আমার দিকে একবার চেয়ে আয় বলেই গভীর মনোনিবেশ সহকারে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, পাঁচিলের ওপর তার পোষা বেড়াল হালুম বসে আছে ধ্যানরত অবস্থায়, সেদিকেই তার দৃষ্টি। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই সে বলল, আচ্ছা দিপু, হালুম এখন চোখ বুজে কী ভাবছে, বল তো? অতীতের স্মৃতিচারণ, না আগামী দিনের পরিকল্পনা? নাকি শুধুই চিন্তাশূন্য স্বপ্নহীন দিবানিদ্রা?

আমি হেসে বললাম, এই দুগ্ধমৎস্যবিরল দুনিয়ার কঠোর বাস্তবতার কথাও হতে পারে।

সুনীল মাথা নেড়ে গম্ভীর মুখে বলল, না না, ঠাট্টার কথা না। হালুমের মস্তিষ্কে কোশ যখন আছে, মানুষ চিনতে পারার স্মৃতিভাণ্ডারও যখন আছে, তখন স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বাইরেও কিছু চিন্তাভাবনা নিশ্চয় তৈরি হচ্ছে।

আমি একটু রেগেই উত্তর দিয়েছিলাম, দেখ সুনীল, মানুষের ডাক্তার হয়তো গোরু ছাগলের কিছুটা চিকিৎসা করতে পারে, কিন্তু মানুষের মনের ডাক্তারের ক্ষমতা নেই যে, তোর হালুম বা লুসির মনের হদিশ রাখে। তবে লুসির আমাকে দেখে আনন্দ হয়, সেটা জানি। ওর রাগ-দুঃখও আছে। তবে গতকাল কী হয়েছিল বা আগামীকাল তুই ওর জন্যে স্পেশাল কিছু আনবি কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে বলে মনে হয় না। করলেও সেটা জানা যাবে না।

সুনীল গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, সেই চেষ্টাই আমি করছি।

সে দিন তার সঙ্গে আড্ডা বা আলোচনা কিছুই জমল না। চেষ্টা করে দেখলাম। কিন্তু সে একেবারেই অন্যমনস্ক। তার দৃষ্টি একবার হালুমের আর একবার লুসির দিকে ঘুরছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, পশুপাখি, কুকুর-বেড়ালের জন্মগত সেই প্রবৃত্তি আছে, তার বাইরে কোনও আলাদা চিন্তা করার প্রতিভা নেই। ওই রাস্তার নেড়িকুত্তাটাকে তুই পুষলেও এই লুসির মতোই প্রভুভক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যেত। সব ট্রেনিং-এর ওপর। পুলিশ কুকুর দেখেছিস তো?

শুনেই সুনীল ঘুরে বসে বলল, আচ্ছা দিপু, বল তো, নেপচুন গ্রহে মানুষের মাথার আকৃতির কোনও পাহাড় আছে কি না?

আমি অবাক হয়ে বললাম, সে আমি কী করে বলব?

সুনীল ঠোঁটে হাসি এনে বলল, সেটাই বল। তুই জানিস না। তবে একদিন মানুষ হয়তো জানবে। তার জন্যে সেখানে যাওয়ার দরকার নেই। ওখানকার ছবি এখানে ধরা পড়বে। সেরকম লুসির চিন্তাও আমার কাছে ধরা দেবে ইনট্রারেড যন্ত্রের সাহায্যে।

ইনফ্রারেড? তা দিয়ে কী করে…

ইনফ্রারেড নয়, ইনট্রারেড। ইনটেলিজেন্স ট্রান্সমিশন অ্যান্ড রিসেপশন ডিভাইস-এর শর্ট ফর্ম, সংক্ষিপ্ত রূপ।

সুনীলের ভাবগতিক দেখে সেই যে চলে এসেছিলাম, এর মধ্যে আর যাইনি। আজ দিলীপবাবুর দেখা ঘটনা শুনে মনে একটা সন্দেহ আর ভয়ও দেখা দিল। স্কিজোফ্রেনিয়া? অনেক পণ্ডিত আর বিজ্ঞানীর এই অবস্থা আমি দেখেছি, শুনেছি। কখনও হতাশা বা মানসিক আঘাত থেকে, কখনও বিষক্রিয়া থেকে। কিছুটা বংশগতি, কিছুটা মানসিক দৃঢ়তার অভাব–অনেক কারণ মিলিয়েই এরকম হয়।

এইসব ভাবতে ভাবতে সুনীলের বাড়ির কাছে আসতেই ভিড় দেখে গাড়ি থামালাম। শুনলাম, কিছুক্ষণ আগেই প্রতিবেশীরা জানতে পেরেছেন, দিলীপবাবুর বিবৃতির মধ্যে এক ফোঁটাও মিথ্যে নেই। কতকগুলো ছোট ছেলে সুনীলের বাড়ির কাছে রবারের বল নিয়ে ক্রিকেট খেলছিল। তাদের বল সুনীলের জানলায় এসে লাগতে একটা ছেলে সেটা কুড়োতে আসে। সঙ্গে সঙ্গে লুসি আর সুনীল নিজে একই সঙ্গে নাকি জানলার গ্রিলে মুখ লাগিয়ে ভৌ ভৌ হৌ হৌ করতে থাকে। ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে তারা পালিয়ে গিয়ে বড়দের বলে। তখন সবাই এসে দ্যাখে এই ব্যাপার। সুনীল এমনিতেই কারও সঙ্গে মিশত না। নিজের কাজ নিয়েই থাকত। পাড়ার সবাই তাকে একজন শিক্ষিত দাম্ভিক বিজ্ঞানী হিসাবেই গণ্য করতেন। কিন্তু তার এ কী আচরণ! নিঃসন্দেহে তার…

প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক আমাকে বলার সময় কথা শেষ না করে তাঁর তর্জনীটা যেভাবে ক্লকওয়াইজ কপালের ওপর ঘোরালেন, তাতে তাঁদের সিদ্ধান্ত বুঝে নিতে অসুবিধে হল না আমার। চাক্ষুষ দেখলাম একটু পরেই। বাইরে এত লোকের ভিড় আর গোলমাল লুসির পছন্দ হল না বোধহয়। তাকে রাগত মূর্তিতে জানলায় দেখা গেল। প্রায় একই মুহূর্তে তার পাশে এসে দেখা দিল আমার আবাল্যপরিচিত মুখটি। কিন্তু তার চোখের এ দৃষ্টি আমার অপরিচিত। দু-জনে মিলে সমস্বরে অমানুষিক বা না-মানুষিক গর্জনে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। হঠাৎ লুসির দৃষ্টি আমার ওপর পড়ল। সে জানলা থেকে নেমে মহানন্দে দরজার দিকে ছুটে এল। সঙ্গে সুনীলও। কিন্তু দরজা খুলছে না কেন সুনীল? সে কি দরজা খোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে?

মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। সেলফোনে যোগাযোগ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আর নার্সিং হোমের লোকজন এসে গেল। দরজা ভাঙার পরে সবাইকে বাইরে দাঁড়াতে বলে আমি ভেতরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে লুসি লাফিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। তার দেখাদেখি সুনীলও যেভাবে লাফাতে লাগল, সেটা কলকাতার রাস্তায় বাঁদরওয়ালাদের খেলাতেই দেখা যেত। আমার এ সময় হঠাৎ অনিলের মা-র সেই অবৈজ্ঞানিক গল্পটাই মনে পড়ল। লুসির মতো সুনীলের জিবও বেরিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে একদিন তার মুখ আর কান দুটোও কি লম্বা হয়ে যাবে! একটি বিখ্যাত গল্পে মানুষের রাতারাতি সাপে পরিণত হওয়ায় কাণ্ডকারখানা নিঃসন্দেহে স্কিজোফ্রেনিয়ার চরম পরিণতি। মানসিকভাবে।

আমি লুসিকে নিয়ে বাড়ির বাইরে আসতে পেছন পেছন সুনীলও দু-হাতে দু-পায়ে ভর দিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বাইরে ছুটে এল। নার্সিং হোমের গাড়ি ও লোকজন প্রস্তুতই ছিল। সাবধানতার জন্যে ওদের হাতে তোয়ালে জড়িয়ে রাখতে বলেছিলাম। ওরা সুনীলকে পাঁজাকোলা করলেও সে ওদের কিন্তু কামড়াল না। আমার কোলে লুসির মতোই ওদের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল কেবল। লুসি কিছু করার আগেই ওরা গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। লুসি কী ভাবল, কে জানে! ভাবল, হয়তো মনিব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এটুকু বোধশক্তি ওর মস্তিষ্কে হয়তো আছে। আমি লুসিকে ধরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলাম। আমার বাংলা ভাষাতেই তাকে বললাম, সুনীল শিগগিরই এসে যাবে। তুমি লক্ষ্মী হয়ে একটু বাড়িতে থাকো। কিছু বিস্কুট আর জল দিলাম। সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে লাগল। মনে হল, বেচারি কাল থেকে খায়নি। সুনীল আর রতনদা ছাড়া একমাত্র আমার হাতে দেওয়া খাবারই সে খায়। নইলে অন্যের দেওয়া লোভনীয় খাবার খুঁকেও দেখবে না, অনাহারে মরে গেলেও। বেচারার কী যে হবে! লুসিকে। অনেক বুঝিয়ে তাকে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে নিজেও গাড়িতে নার্সিং হোমে রওনা দিলাম।

বাড়িতে ফোন করে প্রথমে জানতে চাইলাম, পরিতোষ তার কর্তব্য সম্পাদন করেছে কি না। দীপা হাঁইমাঁই করে ব্যাপারটা কী জানতে চাইল। আমি সংক্ষেপে শুধু বললাম, দিলীপবাবু আমার পেশেন্ট নন। বরং ভরতমুনি বা চিলাখালির ননি হালদারের কেস হলেও হতে পারে। নিজে জেনে পরে জানাব। এখন আর ফোন কোরো না।–এইটুকু বলেই ছেড়ে দিলাম। বুঝলাম, দীপা কৌতূহলে ছটফট করবে, কিন্তু চিকিৎসায় ব্যস্ত আছি জেনে ফোন করবে না। নার্সিং হোমে গিয়ে দেখি, সুনীলকে ঘিরে আমার শিক্ষক বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ঘোষাল ছাড়াও নিউরোলজিস্ট ডা. মুখার্জি এবং জুনিয়র ডাক্তার ও নার্সরা দাঁড়িয়ে। ডাক্তার ঘোষালের হাতে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। আমাকে দেখে স্যার বললেন, দীপায়ন, তোমার বন্ধুর টুপিটা খুলে দাও তো। সুনীলকে দেখি, বারবার উঠে বসছে আর শূন্যে মুখ ঘষছে। যেন সামনে একটা কিছু মুখ দিয়ে ঠেলার চেষ্টা করছে। এই অবস্থার মধ্যেও সুনীল তার টুপিটা পরতে ভোলেনি। তার কেশহীন মস্তক সে বাইরে বেরোনোর সময় টুপি দিয়ে ঢেকে রাখত। এটা তার একমাত্র দুর্বলতা। আমাদের রসিকতার উত্তরে সে বলত, স্টাইল। আগে দু-একজন ছাড়া ইংরেজ বিজ্ঞানীরা পরচুল পরত। তুই কী ভাবিস, সবার বাবরি চুল ছিল?

মনে হল, সুনীল এই অবস্থায় আসার আগেই টুপিটা পরেছিল। পরে সেটা খুলে ফেলার ক্ষমতা হরিয়ে ফেলেছে। আমি সুনীলের কাঁধে হাত রাখলেও সে ভ্রূক্ষেপ করল না। একই ভঙ্গিমায় গাল-মুখ-গলা দিয়ে শূন্যে আঘাত করতে লাগল। আমি তার টুপিটা খুলে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরোল একই সঙ্গে আমাদের সবাইয়ের মুখ থেকে। দেখলাম, সুনীলের কেশহীন মাথায় একটা স্টিলের হেডফোনের মতো জিনিসের সঙ্গে লাগানো আছে একটা অদ্ভুত যন্ত্র। ডাক্তার ঘোষাল তাঁর সিরিঞ্জে ওষুধ ভরা বন্ধ করে সেটাই খুলে ফেলতে লাগলেন। সবটা খুলতেই সুনীল নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। এবার ডা. ঘোষাল অন্য একটা ইনজেকশন দিতেই ও ঘুমিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ নার্সিং হোমে থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ মনে পড়ল, লুসিকে বাড়িতে তালাবন্ধ করে এসেছি। সে বেচারা হয়তো মনিবের এই অবস্থায় চলে যেতে দেখে একা একা দুর্ভাবনায় কেঁদেকেটে সারা হচ্ছে। হয়তো ভাবছে, আমিই তার দুর্দশার জন্য দায়ী। মনে হতেই হাসি পেল আমার। লুসি ভাবছে! সুনীল থাকলে কী বলত?

সুনীলের বাড়িতে পৌঁছোতেই দেখি সামনে মূর্তিমান রতনদা। পাশের বাড়ির একজন হাত-পা নেড়ে তাকে কত কী বোঝাচ্ছেন। আর তার চোখ-মুখের ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা কহনীয় নয়। আমাকে দেখেই প্রতিবেশী ভদ্রলোক আমাকে দেখিয়ে চুপ করে গেলেন। রতনদা হাউমাউ করে উঠতেই আমি তালা খুলে তাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। লুসি অভ্যর্থনা করেই একটু অবাক হয়ে গেল যেন। বেরিয়ে গেল সুনীল, আর ফিরে এল রতনদা! যা-ই হোক, রতনদাকে বুঝিয়ে দিলাম, এমন কিছু নয়, একটা ভুল ওষুধ খেয়ে ফেলাতে সুনীলের ওরকম একটু হয়েছিল। চারপাশে চেয়ে দেখলাম, সত্যিই কিছু ওষুধবিশুদ্ধ টেবিলে বা ড্রয়ারে আছে কি না। সেই সময় চোখে পড়ল একটা ডায়েরি। সুনীল তার গবেষণার কথা নিয়ে বাংলায় ডায়েরি লিখত জানি। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে লেখার মধ্যে ও ছিল না। কৌতূহলবশে তুলে নিলাম ডায়েরিটা। রতনদা ভেতর থেকে বলল, চা করছি। খেয়ে যেয়ো দীপদাদাবাবু।

কবে শেষ লিখেছে সুনীল? উলটোতেই চোখে পড়ল লেখা–ডারউইন বলেছেন, পশুদের মনের চিন্তাধারা জানতে আমরা অক্ষম। কিন্তু ডারউইনের সময় ডক্টর সুনীল সেনগুপ্তর ইনটেলিজেন্স ট্রান্সমিশন অ্যান্ড রিসেপশন ডিভাইস বা ইনট্রারেড আবিষ্কৃত হয়নি। প্রথমে লুসির মাথায় ট্রান্সমিটারটা লাগিয়ে দেব। তারপর আমার নিজের সেরিব্রাল কর্টেক্সে রিসিভারের দুটো পয়েন্ট ঠিকমতো জায়গায় চেপে বসিয়ে দেব। একটা আমার চিন্তাশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখবে। অন্যটা লুসির চিন্তার প্রেরকযন্ত্রের তরঙ্গকে গ্রহণ করে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে তরঙ্গায়িত করবে।

এটুকু পড়েই লুসির দিকে ভালো করে তাকালাম। তার মাথায় সত্যিই বাঁধা আছে চামড়ার বেল্টের সঙ্গে লাগানো চাকতির মতো যন্ত্র। এই গোলমালের মধ্যে সেটা নজর করিনি। লুসির মাথা থেকে খুলে ফেললাম সেটা। তারপর সুনীলের ঘর থেকেই ডক্টর ঘোষালকে ফোন করলাম। বললাম, তার জন্য অন্য কোনও ওষুধ বা থেরাপির ব্যবস্থা না করতে। তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে বললাম, আমি বিকেলেই যাচ্ছি। গিয়ে সব বলব। আশা করি, সুনীল ততক্ষণ ঘুমোবে।

বিকেলে নার্সিং হোমে হাজির হয়ে প্রথমেই ডাক্তার ঘোষালের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে সব কিছু বলে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া সুনীলের ডায়েরির অংশটুকু পড়ালাম। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে তিনি এমন ঘটনার সম্মুখীন প্রথম হলেন।

আমার অনুরোধে সুনীলের গবেষণার বিষয়টা গোপন রাখতে রাজি হলেন।

কিছুক্ষণ পরেই সুনীলের ঘুম ভাঙল। হঠাৎ এই পরিবেশে নিজেকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী, দিপু? আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম?

আমি হেসে বললাম, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন পুরোপুরি ফিট, কোনও চিন্তা নেই। তোর বাড়িতে চল, সব বলছি।

সুনীলের বাড়িতে ঢুকতেই দীর্ঘ অদর্শনের পর মনিবকে দেখে লুসি তো আনন্দে আটখানা। রতনদা হাউমাউ করে সুনীলকে আজেবাজে ওষুধ খাওয়া নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, সুনীল কাল থেকে কিছু খায়নি। তুমি খাওয়ার ব্যবস্থা করো, রতনদা। সুনীলের অগোচরে এক ফাঁকে তার ডায়েরিটা টেবিলে যথাস্থানে রেখে দিলাম।

একটু পরে ধীরেসুস্থে সুনীলকে সমস্ত ব্যাপারটা উদ্ঘাটিত করে বললাম। তার ডায়েরির কিছু অংশ পড়ার অপরাধ স্বীকার করলাম। সুনীল বলল, অনেক বিজ্ঞানীই এইরকম নিজের ওপর পরীক্ষা করে বিপদে পড়েছেন। একটা ভুল করেছিল সুনীল। সে ভুলে গিয়েছিল, তার নিজস্ব চিন্তাক্ষমতা লুপ্ত না করলে অন্যের চিন্তাতরঙ্গ তার মাথায় ঢুকবে না। অথবা ঢুকলে ওভারল্যাপিং হয়ে তার উন্মাদের অবস্থা হবে। তাই একটা যন্ত্রে নিজের চিন্তাশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করেছিল। কিন্তু যেহেতু তার মস্তিষ্ক ও কর্মক্ষমতা হুবহু তখন লুসির জেরক্স কপিতে পরিণত হয়েছিল, তার সেই অবস্থার বিবরণ লিখে রাখা তো দূরের কথা, তখন সে মনুষ্যদেহধারী এক নিরক্ষর না-মানুষ। আমি মনে মনে হাসলাম। দু-জনের বুদ্ধি ওভারল্যাপিং হলেই বা এর চাইতে বেশি কী উন্মাদ অবস্থা তার হত!

সুনীল হতাশ হয়ে বলল, কিছুই লাভ হল না। মানুষের চিন্তাক্ষমতা ফিরে পেয়ে ভুলে গিয়েছি সেই কুকুরপ্রাপ্তি অবস্থার কথা। একটা মুহূর্তও মনে পড়ছে না। কখন দিলীপবাবু এসেছিলেন, তুই এসেছিলি, নার্সিং হোমে নিয়ে গেলি–কিছুই মনে নেই। লুসির হয়তো মনে আছে। কী হয়েছিল রে লুসি? ডারউইনের কথাই কি ঠিক?

যন্ত্র ছাড়াই লুসি প্রভুর চিন্তাধারাকে বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। সে ভোক ডোক করে তার বক্তব্য পেশ করে দিল।

আমি হেসে বললাম, যাক গে। লুসি থাক তার মাথা নিয়ে। তোর ঘাড়ে একটা মাথাই থাক। ওসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। গিয়ে দিলীপবাবুকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসব। তিনি আমার কাছে না এলে প্রতিবেশীরা যে কী ব্যবস্থা নিত, বা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না হলে কী করুণ পরিণতি তোর ছিল, ভেবে আঁতকে উঠি।

দীপাকে অবশ্য সবই বলতে হল। তবে ওর সংস্কারমতো প্রতিজ্ঞা করালাম এটা গোপনই রাখতে। পরে একদিন আমার বাড়িতে চা খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল। দীপা হেসে বলল, আচ্ছা, নার্সিং হোমে সুনীলদার নাম কী লিখেছিলে? সুনীল সেনগুপ্ত, না লুসি সেনগুপ্ত?

আমি বললাম, শরীরের কাজকর্ম তো সুনীলেরই ছিল। দেহটাও ওর। অন্য আইডেন্টিটি…

আমার কথার মাঝখানেই দীপা হইহই করে বলে উঠল, বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প তো পড়েনি। তাতে বিক্রমাদিত্য বেতালের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, মস্তিষ্কের পরিচয়েই পরিচয়। খগম গল্পের মতো দেহ না পালটাতে পারে, তবুও সুনীলদাকে সুনীলদা ডাকতে তখন রাজি ছিলাম না।

আমি বললাম, তবে কী বলতে? লুসিদা?

দীপা বলল, তা কেন? দুটো মিলেই বলতাম–সুলুদা। শুনতে খারাপ? বিলু-মিলু যখন হতে পারে?

জীবনে বোধহয় এই প্রথম মন খুলে হেসে উঠল আমার বাল্যবন্ধু ড. সুনীল সেনগুপ্ত।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪১৩
এই গল্পটি সন্দেশ-এ প্রকাশিত সারমেয় গল্পের পরিমার্জিত রূপ।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইনট্রারেড
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

ইনট্রারেড

ইনট্রারেড

বিজ্ঞান কলেজের দিলীপ পাঠক যেভাবে সুনীলের কাণ্ড-ভঙ্গিমার বর্ণনা করলেন, তাতে আমি না হেসে পারিনি। সুনীলের পক্ষে এমন কাজ অবিশ্বাস্য। বুঝলাম, দিলীপবাবু হয় ভুল দেখেছেন, নয়তো ভুল বুঝেছেন। আমার হাসিতে তিনি আহত হলেন মনে হল। বললেন, আপনি হাসছেন। আমার কাছেও ব্যাপারটা অদ্ভুত শুধু নয়, অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। তাই কাউকে কিছু না বলে সোজা আপনার কাছেই চলে এলাম। আপনি শুধু তার বন্ধু নন, একজন প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার মনে হয়, সুনীলবাবুর মাথায় একটু…

দিলীপবাবু উঠলেন। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি দেখেছেন বললেন, তাতে আর ওই একটু শব্দটা বসানো যায় না। ঠিক আছে, আমি আজই যাচ্ছি সুনীলের কাছে। বলা যায় না, এটা ওর গবেষণার কোনও প্রক্রিয়াও হতে পারে। না-মানুষিক ব্যাপার যখন।

দিলীপবাবু অবাক হয়ে বললেন, গবেষণা? ওইভাবে! একই রকম চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। তাঁর কথা আমাকেও বেশ চিন্তাতে ফেলল। ঘটনাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে উদৃবিগ্ন হওয়ার ব্যাপার যে, তাতে সন্দেহ নেই।

সুনীল আমার বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছি। কর্মক্ষেত্রেও তার সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। আমি মনোরোগের চিকিৎসক আর সুনীল একজন বিখ্যাত ফিজিয়ো সাইকোলজিস্ট। অর্থাৎ দু-জনেরই কারবার মানুষের মন নিয়ে। একটু ভুল বললাম। ইদানীং সুনীল তার কাজের পরিধিটা একটু বাড়িয়ে (বা নামিয়ে) পশুপাখিদের মন নিয়েও কাজ করার অপচেষ্টা করছে। আমি মনুষ্যেতর প্রাণী বললাম না। আমার এই মনুষ্যেতর শুনলে ও অপচেষ্টা শব্দটা শোনার মতোই রেগে যাবে। সে বলে, ইতর শব্দটা মূল অর্থ থেকে সরে এসে যে অর্থ প্রকাশ করে, সেটা মানুষের মধ্যেই বরং দেখা যায়। অমানুষ শব্দের মতোই। সে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের ব্যবহৃত না-মানুষ শব্দটাই পছন্দ করত। প্রকৃতই সে একজন না-মানুষপ্রেমী ছোটবেলা থেকেই।

সুনীল সেনগুপ্তর সঙ্গে আমার যে আবাল্য বন্ধুত্ব, এটা একটা অসাধারণ ব্যতিক্রম। কারণ, তার কোনও বন্ধুই নেই। এর কারণ, সেই ছোটবেলা থেকেই তার মুখে একটা গাম্ভীর্যের বর্ম আঁটা। স্কুলের সহপাঠীরা তার নাম দিয়েছিল, গোমড়াথেরিয়াম। শুনে ক্ষণেকের জন্যে ঠোঁটে একটু হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেত। সব জমায়েতে যোগ দিত, কিন্তু উচ্ছ্বাস ফুটত না কোনও কথাতেই। কলেজের প্রাণতোষ চৌধুরী বলত, কলকাতায় নাকি তিনটে জিনিস দেখা যায় না। এক, প্রতিবেশী এক দেশের কিছু পুরুষ অধিবাসীকে এ শহরে দেখা গেলেও তাদের স্ত্রীদের। দুই, বিশেষ একটি রাজ্যের লোকের মৃতদেহ। আর তিন, সুনীলের শব্দ-করা হাসি। প্রথম দুটি তথ্যের কোনও সত্যতা নেই জানলেও তৃতীয়টি নিয়ে মতভেদ হত না আমাদের মধ্যে। চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস ছবিটা আগাগোড়া গম্ভীর মুখে দেখে যেতে দেখেছি তাকে। সেই সুনীল যদি আজ এহেন…

দিলীপ পাঠকের আজকের প্রাতঃকালীন অভিজ্ঞতার কথাটা বলি। বিজ্ঞান কলেজের দিলীপবাবু গবেষণার কোনও এক কাজেই আজ সকালে সুনীলের কাছে গিয়েছিলেন। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। দরজার বেল বাজাতেই সুনীলের কুকুর লুসি খোলা জানলার কাছে ছুটে এসে নাক বের করে যথারীতি সগর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। দিলীপবাবু অপরিচিত লোক। অপরিচিত কোনও আগন্তুক এলে তাকে লাঙ্গুল আন্দোলনে স্বাগত জানানো লুসির প্রকৃতিতে নেই। যতক্ষণ না মনিব তাকে সংকেত জানাবে যে, আগন্তুক কোনও বিপজ্জনক ব্যক্তি নয়, ততক্ষণ সে ঘেউ ঘেউ করে যাবে। তারপরেও সে মনিবের ওপর পুরো ভরসা না রেখে একটু দূরে সন্দিগ্ধ সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকবে।

দিলীপবাবু সেরকমই আশা করেছিলেন। সুনীলবাবু এখনই এসে লুসিকে সামলাবেন, তারপর দরজা খুলে তাঁকে ভেতরে ডাকবেন। তার পরিবর্তে তিনি যা দেখলেন, তাতে তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। এ-ও কি সম্ভব! সুনীলবাবু এসে লুসির পাশে দাঁড়ালেন। তারপর অবিকল লুসির ভঙ্গিমায় জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দিলীপবাবুর দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে অদ্ভুত ও বীভৎস আওয়াজ করতে লাগলেন। দিলীপবাবু হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিই জানেন না। যখন সংবিৎ ফিরল, সেই বিমূঢ় অবস্থাতেই সটান চলে এলেন আমার কাছে।

আমার স্ত্রী দীপাকে ব্যাপারটা বললাম। সে-ও বিশ্বাস না করে প্রথমে হেসে উঠল। বলল, দ্যাখো, তোমার ওই দিলীপবাবুই তোমার কোনও পেশেন্ট কি না। নিজের জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে এসে অন্যের কথা বলছেন। তুমিই তো বলেছ, পাগলদের ওরকম সাইকোসিস থাকে। তারপর আবার কী ভেবে বলল, তবে সুনুদার অদৃষ্টে এরকম দুর্গতিই লেখা আছে। বিয়ে-থা করলেন না। রতনদাও দেশে গিয়েছে। সে দিন ফোনে বললেন। আর ও তো গিয়ে ফেরার নাম করে না। কোথায় খাওয়াদাওয়া করছেন, ঈশ্বর জানেন। ইদানীং আবার কুকুর-বেড়াল-গোরু নিয়ে নাকি পড়েছেন। হয়তো লুসির খাবারই ভাগ করে খাচ্ছেন। ভরতমুনির গল্প জানো তো? হরিণ নিয়ে থাকতে থাকতে শেষে পরের জন্মে হরিণই হলেন।

আমি হেসে বললাম, পরের জন্মের কথা পরে হবে। আগে ইহজন্মে সুনীলের অবস্থা তো দেখে আসি। দিলীপবাবুকে সাইকোসিস রোগী বলে তো মনে হল না। সেরকম বুঝলে বাইরে থেকে টেলিফোন করব। পরিতোষ যেন চেম্বার বন্ধ রাখে আজ। পেশেন্টদের ফোন করে দিক।

দীপার গার্হস্থ্য কাজের সহকারিণী অনিলের মা ঘর মুছতে মুছতে বোধহয় সবই শুনেছে। সে মহা উৎসাহে তার চিলাখালি গ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলে উঠল, কুকুরে কামড়ালি এমনটি হতি পারে, দাদাবাবু। আমাদের গাঁয়ের ননি হালদারকে পাগলা কুকুরে কামড়াইছিল। সে কিছুতেই ইনজিশন নিল না। কিছু দিন পর সে কুকুরের নাগাল ঘেউ ঘেউ করতি করতি মরে গেল। সবাই দ্যাখে, তার মুখ আর কান কেমন নম্বা নম্বা হয়ে গেছে।

আমি হেসে উঠে বললাম, হতি পারে। তবে চিলাখালিতে অনেকে পাগলা ছাগলের কামড় খেয়েছে শুনেছি।

অনিলের মা-র অবাক বড় বড় চোখের সামনে দিয়েই আমি সুনীলের বাড়ি রওনা হলাম।

সুনীলের বাড়িতে মাসখানেক আগে এক রবিবারে শেষ যে দিন গিয়েছিলাম, সে দিন তার মধ্যে একটা ভাবান্তর লক্ষ করেছিলাম ঠিকই। দরজা ভেজানো ছিল। বরাবরের মতো বেল বাজিয়ে দরজায় টোকা দিতে লুসি ছুটে এসে সশব্দে আপ্যায়ন জানিয়ে পিঠ দিয়ে ঠেলেই দরজা খুলে দিল। দরজায় টোকার শব্দে সে কী করে জানল যে, দরজার এপারে তার মনিবের বন্ধু দীপায়ন মৈত্র, সেটা আমার মতন মানুষের মনের ডাক্তারের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সুনীল হয়তো বলতে পারে।

ঘরে ঢুকে সুনীলকে দেখলাম, আমার দিকে একবার চেয়ে আয় বলেই গভীর মনোনিবেশ সহকারে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, পাঁচিলের ওপর তার পোষা বেড়াল হালুম বসে আছে ধ্যানরত অবস্থায়, সেদিকেই তার দৃষ্টি। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই সে বলল, আচ্ছা দিপু, হালুম এখন চোখ বুজে কী ভাবছে, বল তো? অতীতের স্মৃতিচারণ, না আগামী দিনের পরিকল্পনা? নাকি শুধুই চিন্তাশূন্য স্বপ্নহীন দিবানিদ্রা?

আমি হেসে বললাম, এই দুগ্ধমৎস্যবিরল দুনিয়ার কঠোর বাস্তবতার কথাও হতে পারে।

সুনীল মাথা নেড়ে গম্ভীর মুখে বলল, না না, ঠাট্টার কথা না। হালুমের মস্তিষ্কে কোশ যখন আছে, মানুষ চিনতে পারার স্মৃতিভাণ্ডারও যখন আছে, তখন স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বাইরেও কিছু চিন্তাভাবনা নিশ্চয় তৈরি হচ্ছে।

আমি একটু রেগেই উত্তর দিয়েছিলাম, দেখ সুনীল, মানুষের ডাক্তার হয়তো গোরু ছাগলের কিছুটা চিকিৎসা করতে পারে, কিন্তু মানুষের মনের ডাক্তারের ক্ষমতা নেই যে, তোর হালুম বা লুসির মনের হদিশ রাখে। তবে লুসির আমাকে দেখে আনন্দ হয়, সেটা জানি। ওর রাগ-দুঃখও আছে। তবে গতকাল কী হয়েছিল বা আগামীকাল তুই ওর জন্যে স্পেশাল কিছু আনবি কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে বলে মনে হয় না। করলেও সেটা জানা যাবে না।

সুনীল গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, সেই চেষ্টাই আমি করছি।

সে দিন তার সঙ্গে আড্ডা বা আলোচনা কিছুই জমল না। চেষ্টা করে দেখলাম। কিন্তু সে একেবারেই অন্যমনস্ক। তার দৃষ্টি একবার হালুমের আর একবার লুসির দিকে ঘুরছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, পশুপাখি, কুকুর-বেড়ালের জন্মগত সেই প্রবৃত্তি আছে, তার বাইরে কোনও আলাদা চিন্তা করার প্রতিভা নেই। ওই রাস্তার নেড়িকুত্তাটাকে তুই পুষলেও এই লুসির মতোই প্রভুভক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যেত। সব ট্রেনিং-এর ওপর। পুলিশ কুকুর দেখেছিস তো?

শুনেই সুনীল ঘুরে বসে বলল, আচ্ছা দিপু, বল তো, নেপচুন গ্রহে মানুষের মাথার আকৃতির কোনও পাহাড় আছে কি না?

আমি অবাক হয়ে বললাম, সে আমি কী করে বলব?

সুনীল ঠোঁটে হাসি এনে বলল, সেটাই বল। তুই জানিস না। তবে একদিন মানুষ হয়তো জানবে। তার জন্যে সেখানে যাওয়ার দরকার নেই। ওখানকার ছবি এখানে ধরা পড়বে। সেরকম লুসির চিন্তাও আমার কাছে ধরা দেবে ইনট্রারেড যন্ত্রের সাহায্যে।

ইনফ্রারেড? তা দিয়ে কী করে…

ইনফ্রারেড নয়, ইনট্রারেড। ইনটেলিজেন্স ট্রান্সমিশন অ্যান্ড রিসেপশন ডিভাইস-এর শর্ট ফর্ম, সংক্ষিপ্ত রূপ।

সুনীলের ভাবগতিক দেখে সেই যে চলে এসেছিলাম, এর মধ্যে আর যাইনি। আজ দিলীপবাবুর দেখা ঘটনা শুনে মনে একটা সন্দেহ আর ভয়ও দেখা দিল। স্কিজোফ্রেনিয়া? অনেক পণ্ডিত আর বিজ্ঞানীর এই অবস্থা আমি দেখেছি, শুনেছি। কখনও হতাশা বা মানসিক আঘাত থেকে, কখনও বিষক্রিয়া থেকে। কিছুটা বংশগতি, কিছুটা মানসিক দৃঢ়তার অভাব–অনেক কারণ মিলিয়েই এরকম হয়।

এইসব ভাবতে ভাবতে সুনীলের বাড়ির কাছে আসতেই ভিড় দেখে গাড়ি থামালাম। শুনলাম, কিছুক্ষণ আগেই প্রতিবেশীরা জানতে পেরেছেন, দিলীপবাবুর বিবৃতির মধ্যে এক ফোঁটাও মিথ্যে নেই। কতকগুলো ছোট ছেলে সুনীলের বাড়ির কাছে রবারের বল নিয়ে ক্রিকেট খেলছিল। তাদের বল সুনীলের জানলায় এসে লাগতে একটা ছেলে সেটা কুড়োতে আসে। সঙ্গে সঙ্গে লুসি আর সুনীল নিজে একই সঙ্গে নাকি জানলার গ্রিলে মুখ লাগিয়ে ভৌ ভৌ হৌ হৌ করতে থাকে। ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে তারা পালিয়ে গিয়ে বড়দের বলে। তখন সবাই এসে দ্যাখে এই ব্যাপার। সুনীল এমনিতেই কারও সঙ্গে মিশত না। নিজের কাজ নিয়েই থাকত। পাড়ার সবাই তাকে একজন শিক্ষিত দাম্ভিক বিজ্ঞানী হিসাবেই গণ্য করতেন। কিন্তু তার এ কী আচরণ! নিঃসন্দেহে তার…

প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক আমাকে বলার সময় কথা শেষ না করে তাঁর তর্জনীটা যেভাবে ক্লকওয়াইজ কপালের ওপর ঘোরালেন, তাতে তাঁদের সিদ্ধান্ত বুঝে নিতে অসুবিধে হল না আমার। চাক্ষুষ দেখলাম একটু পরেই। বাইরে এত লোকের ভিড় আর গোলমাল লুসির পছন্দ হল না বোধহয়। তাকে রাগত মূর্তিতে জানলায় দেখা গেল। প্রায় একই মুহূর্তে তার পাশে এসে দেখা দিল আমার আবাল্যপরিচিত মুখটি। কিন্তু তার চোখের এ দৃষ্টি আমার অপরিচিত। দু-জনে মিলে সমস্বরে অমানুষিক বা না-মানুষিক গর্জনে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। হঠাৎ লুসির দৃষ্টি আমার ওপর পড়ল। সে জানলা থেকে নেমে মহানন্দে দরজার দিকে ছুটে এল। সঙ্গে সুনীলও। কিন্তু দরজা খুলছে না কেন সুনীল? সে কি দরজা খোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে?

মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। সেলফোনে যোগাযোগ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আর নার্সিং হোমের লোকজন এসে গেল। দরজা ভাঙার পরে সবাইকে বাইরে দাঁড়াতে বলে আমি ভেতরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে লুসি লাফিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। তার দেখাদেখি সুনীলও যেভাবে লাফাতে লাগল, সেটা কলকাতার রাস্তায় বাঁদরওয়ালাদের খেলাতেই দেখা যেত। আমার এ সময় হঠাৎ অনিলের মা-র সেই অবৈজ্ঞানিক গল্পটাই মনে পড়ল। লুসির মতো সুনীলের জিবও বেরিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে একদিন তার মুখ আর কান দুটোও কি লম্বা হয়ে যাবে! একটি বিখ্যাত গল্পে মানুষের রাতারাতি সাপে পরিণত হওয়ায় কাণ্ডকারখানা নিঃসন্দেহে স্কিজোফ্রেনিয়ার চরম পরিণতি। মানসিকভাবে।

আমি লুসিকে নিয়ে বাড়ির বাইরে আসতে পেছন পেছন সুনীলও দু-হাতে দু-পায়ে ভর দিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বাইরে ছুটে এল। নার্সিং হোমের গাড়ি ও লোকজন প্রস্তুতই ছিল। সাবধানতার জন্যে ওদের হাতে তোয়ালে জড়িয়ে রাখতে বলেছিলাম। ওরা সুনীলকে পাঁজাকোলা করলেও সে ওদের কিন্তু কামড়াল না। আমার কোলে লুসির মতোই ওদের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল কেবল। লুসি কিছু করার আগেই ওরা গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। লুসি কী ভাবল, কে জানে! ভাবল, হয়তো মনিব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এটুকু বোধশক্তি ওর মস্তিষ্কে হয়তো আছে। আমি লুসিকে ধরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলাম। আমার বাংলা ভাষাতেই তাকে বললাম, সুনীল শিগগিরই এসে যাবে। তুমি লক্ষ্মী হয়ে একটু বাড়িতে থাকো। কিছু বিস্কুট আর জল দিলাম। সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে লাগল। মনে হল, বেচারি কাল থেকে খায়নি। সুনীল আর রতনদা ছাড়া একমাত্র আমার হাতে দেওয়া খাবারই সে খায়। নইলে অন্যের দেওয়া লোভনীয় খাবার খুঁকেও দেখবে না, অনাহারে মরে গেলেও। বেচারার কী যে হবে! লুসিকে। অনেক বুঝিয়ে তাকে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে নিজেও গাড়িতে নার্সিং হোমে রওনা দিলাম।

বাড়িতে ফোন করে প্রথমে জানতে চাইলাম, পরিতোষ তার কর্তব্য সম্পাদন করেছে কি না। দীপা হাঁইমাঁই করে ব্যাপারটা কী জানতে চাইল। আমি সংক্ষেপে শুধু বললাম, দিলীপবাবু আমার পেশেন্ট নন। বরং ভরতমুনি বা চিলাখালির ননি হালদারের কেস হলেও হতে পারে। নিজে জেনে পরে জানাব। এখন আর ফোন কোরো না।–এইটুকু বলেই ছেড়ে দিলাম। বুঝলাম, দীপা কৌতূহলে ছটফট করবে, কিন্তু চিকিৎসায় ব্যস্ত আছি জেনে ফোন করবে না। নার্সিং হোমে গিয়ে দেখি, সুনীলকে ঘিরে আমার শিক্ষক বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ঘোষাল ছাড়াও নিউরোলজিস্ট ডা. মুখার্জি এবং জুনিয়র ডাক্তার ও নার্সরা দাঁড়িয়ে। ডাক্তার ঘোষালের হাতে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। আমাকে দেখে স্যার বললেন, দীপায়ন, তোমার বন্ধুর টুপিটা খুলে দাও তো। সুনীলকে দেখি, বারবার উঠে বসছে আর শূন্যে মুখ ঘষছে। যেন সামনে একটা কিছু মুখ দিয়ে ঠেলার চেষ্টা করছে। এই অবস্থার মধ্যেও সুনীল তার টুপিটা পরতে ভোলেনি। তার কেশহীন মস্তক সে বাইরে বেরোনোর সময় টুপি দিয়ে ঢেকে রাখত। এটা তার একমাত্র দুর্বলতা। আমাদের রসিকতার উত্তরে সে বলত, স্টাইল। আগে দু-একজন ছাড়া ইংরেজ বিজ্ঞানীরা পরচুল পরত। তুই কী ভাবিস, সবার বাবরি চুল ছিল?

মনে হল, সুনীল এই অবস্থায় আসার আগেই টুপিটা পরেছিল। পরে সেটা খুলে ফেলার ক্ষমতা হরিয়ে ফেলেছে। আমি সুনীলের কাঁধে হাত রাখলেও সে ভ্রূক্ষেপ করল না। একই ভঙ্গিমায় গাল-মুখ-গলা দিয়ে শূন্যে আঘাত করতে লাগল। আমি তার টুপিটা খুলে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরোল একই সঙ্গে আমাদের সবাইয়ের মুখ থেকে। দেখলাম, সুনীলের কেশহীন মাথায় একটা স্টিলের হেডফোনের মতো জিনিসের সঙ্গে লাগানো আছে একটা অদ্ভুত যন্ত্র। ডাক্তার ঘোষাল তাঁর সিরিঞ্জে ওষুধ ভরা বন্ধ করে সেটাই খুলে ফেলতে লাগলেন। সবটা খুলতেই সুনীল নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ল। এবার ডা. ঘোষাল অন্য একটা ইনজেকশন দিতেই ও ঘুমিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ নার্সিং হোমে থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ মনে পড়ল, লুসিকে বাড়িতে তালাবন্ধ করে এসেছি। সে বেচারা হয়তো মনিবের এই অবস্থায় চলে যেতে দেখে একা একা দুর্ভাবনায় কেঁদেকেটে সারা হচ্ছে। হয়তো ভাবছে, আমিই তার দুর্দশার জন্য দায়ী। মনে হতেই হাসি পেল আমার। লুসি ভাবছে! সুনীল থাকলে কী বলত?

সুনীলের বাড়িতে পৌঁছোতেই দেখি সামনে মূর্তিমান রতনদা। পাশের বাড়ির একজন হাত-পা নেড়ে তাকে কত কী বোঝাচ্ছেন। আর তার চোখ-মুখের ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা কহনীয় নয়। আমাকে দেখেই প্রতিবেশী ভদ্রলোক আমাকে দেখিয়ে চুপ করে গেলেন। রতনদা হাউমাউ করে উঠতেই আমি তালা খুলে তাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। লুসি অভ্যর্থনা করেই একটু অবাক হয়ে গেল যেন। বেরিয়ে গেল সুনীল, আর ফিরে এল রতনদা! যা-ই হোক, রতনদাকে বুঝিয়ে দিলাম, এমন কিছু নয়, একটা ভুল ওষুধ খেয়ে ফেলাতে সুনীলের ওরকম একটু হয়েছিল। চারপাশে চেয়ে দেখলাম, সত্যিই কিছু ওষুধবিশুদ্ধ টেবিলে বা ড্রয়ারে আছে কি না। সেই সময় চোখে পড়ল একটা ডায়েরি। সুনীল তার গবেষণার কথা নিয়ে বাংলায় ডায়েরি লিখত জানি। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে লেখার মধ্যে ও ছিল না। কৌতূহলবশে তুলে নিলাম ডায়েরিটা। রতনদা ভেতর থেকে বলল, চা করছি। খেয়ে যেয়ো দীপদাদাবাবু।

কবে শেষ লিখেছে সুনীল? উলটোতেই চোখে পড়ল লেখা–ডারউইন বলেছেন, পশুদের মনের চিন্তাধারা জানতে আমরা অক্ষম। কিন্তু ডারউইনের সময় ডক্টর সুনীল সেনগুপ্তর ইনটেলিজেন্স ট্রান্সমিশন অ্যান্ড রিসেপশন ডিভাইস বা ইনট্রারেড আবিষ্কৃত হয়নি। প্রথমে লুসির মাথায় ট্রান্সমিটারটা লাগিয়ে দেব। তারপর আমার নিজের সেরিব্রাল কর্টেক্সে রিসিভারের দুটো পয়েন্ট ঠিকমতো জায়গায় চেপে বসিয়ে দেব। একটা আমার চিন্তাশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখবে। অন্যটা লুসির চিন্তার প্রেরকযন্ত্রের তরঙ্গকে গ্রহণ করে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে তরঙ্গায়িত করবে।

এটুকু পড়েই লুসির দিকে ভালো করে তাকালাম। তার মাথায় সত্যিই বাঁধা আছে চামড়ার বেল্টের সঙ্গে লাগানো চাকতির মতো যন্ত্র। এই গোলমালের মধ্যে সেটা নজর করিনি। লুসির মাথা থেকে খুলে ফেললাম সেটা। তারপর সুনীলের ঘর থেকেই ডক্টর ঘোষালকে ফোন করলাম। বললাম, তার জন্য অন্য কোনও ওষুধ বা থেরাপির ব্যবস্থা না করতে। তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে বললাম, আমি বিকেলেই যাচ্ছি। গিয়ে সব বলব। আশা করি, সুনীল ততক্ষণ ঘুমোবে।

বিকেলে নার্সিং হোমে হাজির হয়ে প্রথমেই ডাক্তার ঘোষালের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে সব কিছু বলে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া সুনীলের ডায়েরির অংশটুকু পড়ালাম। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে তিনি এমন ঘটনার সম্মুখীন প্রথম হলেন।

আমার অনুরোধে সুনীলের গবেষণার বিষয়টা গোপন রাখতে রাজি হলেন।

কিছুক্ষণ পরেই সুনীলের ঘুম ভাঙল। হঠাৎ এই পরিবেশে নিজেকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী, দিপু? আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম?

আমি হেসে বললাম, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন পুরোপুরি ফিট, কোনও চিন্তা নেই। তোর বাড়িতে চল, সব বলছি।

সুনীলের বাড়িতে ঢুকতেই দীর্ঘ অদর্শনের পর মনিবকে দেখে লুসি তো আনন্দে আটখানা। রতনদা হাউমাউ করে সুনীলকে আজেবাজে ওষুধ খাওয়া নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, সুনীল কাল থেকে কিছু খায়নি। তুমি খাওয়ার ব্যবস্থা করো, রতনদা। সুনীলের অগোচরে এক ফাঁকে তার ডায়েরিটা টেবিলে যথাস্থানে রেখে দিলাম।

একটু পরে ধীরেসুস্থে সুনীলকে সমস্ত ব্যাপারটা উদ্ঘাটিত করে বললাম। তার ডায়েরির কিছু অংশ পড়ার অপরাধ স্বীকার করলাম। সুনীল বলল, অনেক বিজ্ঞানীই এইরকম নিজের ওপর পরীক্ষা করে বিপদে পড়েছেন। একটা ভুল করেছিল সুনীল। সে ভুলে গিয়েছিল, তার নিজস্ব চিন্তাক্ষমতা লুপ্ত না করলে অন্যের চিন্তাতরঙ্গ তার মাথায় ঢুকবে না। অথবা ঢুকলে ওভারল্যাপিং হয়ে তার উন্মাদের অবস্থা হবে। তাই একটা যন্ত্রে নিজের চিন্তাশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করেছিল। কিন্তু যেহেতু তার মস্তিষ্ক ও কর্মক্ষমতা হুবহু তখন লুসির জেরক্স কপিতে পরিণত হয়েছিল, তার সেই অবস্থার বিবরণ লিখে রাখা তো দূরের কথা, তখন সে মনুষ্যদেহধারী এক নিরক্ষর না-মানুষ। আমি মনে মনে হাসলাম। দু-জনের বুদ্ধি ওভারল্যাপিং হলেই বা এর চাইতে বেশি কী উন্মাদ অবস্থা তার হত!

সুনীল হতাশ হয়ে বলল, কিছুই লাভ হল না। মানুষের চিন্তাক্ষমতা ফিরে পেয়ে ভুলে গিয়েছি সেই কুকুরপ্রাপ্তি অবস্থার কথা। একটা মুহূর্তও মনে পড়ছে না। কখন দিলীপবাবু এসেছিলেন, তুই এসেছিলি, নার্সিং হোমে নিয়ে গেলি–কিছুই মনে নেই। লুসির হয়তো মনে আছে। কী হয়েছিল রে লুসি? ডারউইনের কথাই কি ঠিক?

যন্ত্র ছাড়াই লুসি প্রভুর চিন্তাধারাকে বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। সে ভোক ডোক করে তার বক্তব্য পেশ করে দিল।

আমি হেসে বললাম, যাক গে। লুসি থাক তার মাথা নিয়ে। তোর ঘাড়ে একটা মাথাই থাক। ওসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। গিয়ে দিলীপবাবুকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসব। তিনি আমার কাছে না এলে প্রতিবেশীরা যে কী ব্যবস্থা নিত, বা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না হলে কী করুণ পরিণতি তোর ছিল, ভেবে আঁতকে উঠি।

দীপাকে অবশ্য সবই বলতে হল। তবে ওর সংস্কারমতো প্রতিজ্ঞা করালাম এটা গোপনই রাখতে। পরে একদিন আমার বাড়িতে চা খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল। দীপা হেসে বলল, আচ্ছা, নার্সিং হোমে সুনীলদার নাম কী লিখেছিলে? সুনীল সেনগুপ্ত, না লুসি সেনগুপ্ত?

আমি বললাম, শরীরের কাজকর্ম তো সুনীলেরই ছিল। দেহটাও ওর। অন্য আইডেন্টিটি…

আমার কথার মাঝখানেই দীপা হইহই করে বলে উঠল, বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প তো পড়েনি। তাতে বিক্রমাদিত্য বেতালের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, মস্তিষ্কের পরিচয়েই পরিচয়। খগম গল্পের মতো দেহ না পালটাতে পারে, তবুও সুনীলদাকে সুনীলদা ডাকতে তখন রাজি ছিলাম না।

আমি বললাম, তবে কী বলতে? লুসিদা?

দীপা বলল, তা কেন? দুটো মিলেই বলতাম–সুলুদা। শুনতে খারাপ? বিলু-মিলু যখন হতে পারে?

জীবনে বোধহয় এই প্রথম মন খুলে হেসে উঠল আমার বাল্যবন্ধু ড. সুনীল সেনগুপ্ত।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪১৩
এই গল্পটি সন্দেশ-এ প্রকাশিত সারমেয় গল্পের পরিমার্জিত রূপ।]