লালটু

লালটু

আমার প্রতিবেশী কৌটিল্য সেনগুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মচারী। তাঁর এক অদ্ভুত শখের নেশা বা হবি আছে, যেটা আমরা, তাঁর অতিপরিচিত লোক ছাড়া অনেকেই জানে না। তিনি ঢাক পিটিয়ে সবাইকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেন না। তাঁর লেখাপড়ার টেবিলে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহৃত যে পাথরটা আছে, কিংবা তাঁর অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের তলায় বা বারান্দার গাছের টবের মাটির ওপর যেসব পাথরের টুকরো আছে, তাদের প্রত্যেকেরই একটা ইতিহাস আছে, যেটা তিনি ছাড়া অন্য কেউ মনে রাখতেও পারবে না। টেবিলের ওপর সুদৃশ্য পেপারওয়েটের বদলে ওইসব ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো দেখে মন্তব্য করতে তিনি আমাকে সে দিনই প্রথম জানালেন তাঁর হবির কথা।

জীবনে তো অনেক জায়গায় ঘুরলাম এই দেশে। বাইরেও গিয়েছি। নিকট আত্মীয়স্বজনও গিয়েছেন। আমার আর তাঁদের সংগ্রহ করা এইসব পাথর। যেমন, ওই পাথরটা মিশরের পিরামিডের পাশে পড়ে ছিল। একই পাথরে পিরামিড তৈরি। কয়েক হাজার বছর আগে হয়তো ওই বাড়তি টুকরোটা ভেঙে ফেলে দিয়েছিল কোনও শ্রমিক। এনেছিল আমার জামাই। এটা সেরকমই কুতুব মিনার এলাকায় পড়ে-থাকা একটা পাথর। আমিই এনেছি। ওই ছোট্ট টুকরোটা দক্ষিণ মেরু থেকে এনেছে আমার ভাইঝি। সে দলের সঙ্গে কুমেরু অঞ্চলে গিয়েছিল, সে তো আপনি জানেন। সব পাথরেরই এরকম একটা ইতিহাস আছে।

গল্পে-পড়া বাতিকবাবু নামে একজনের কথা আমার মনে পড়ল। সেটা অবশ্য একটু লোমহর্ষক ব্যাপার ছিল। আমি কৌটিল্যবাবুকে বললাম, আপনি এইভাবে খোলামেলা ছড়িয়ে রেখেছেন, এগুলো তো চুরি হয়ে যাবে। তিনি হেসে বললেন, না। এগুলো সেরকম মহামূল্য কিছু না। ব্যক্তিগত স্মারক ছাড়া বাইরের লোকের কাছে এর কোনও মূল্যই নেই। তা ছাড়া, তারা তো এগুলোর ইতিবৃত্তও জানে না।

প্রায় ছুটির দিনেই আমাদের দুজনের গল্পগুজব হত। তিনি তাঁর নানা স্থানে ভ্রমণের আর চাকরিজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প করতেন। আমি তো কলকাতার বদ্ধ জীব। মাঝে মাঝে যেসব ভ্রমণে গিয়েছি, সেগুলো অনেকেই ছুটি নিয়ে পরিকল্পনা করে টিকিট সংরক্ষণ করে বা ভাড়া-করা দূরপাল্লার বাসের মাধ্যমে করে থাকে। সেটা যেন বৈচিত্র্যহীন মাপা জলে স্নান। যে-কোনও ভ্রমণের বইয়েই পাওয়া যাবে, আমার কাছে নতুন কিছু শুনতে আসবে না কেউ।

একদিন সকালে হঠাৎ একটা পাথর হাতে কৌটিল্যবাবু প্রায় হন্তদন্ত হয়েই আমার বাড়ি এলেন। বললেন, পতঞ্জলিবাবু, গত রাত্তিরে এক অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। এই পাথরটাকে তো আপনি দেখেছেন। এটা মানস সরোবরের ধারে কুড়িয়ে পাওয়া একটা মসৃণ পাথরের টুকরো। অনেকদিন থেকেই টেবিলে আছে। আমি রাত্রে ওই ঘরেই শুই। রাত্তিরে আলো নেবালে কিছুক্ষণ চকচক করে পাথরটা। তারপরে আর করে না। গতকাল রাত্তিরে কিন্তু সারারাত ধরেই জ্বলজ্বল করেছে। আলো জ্বালাতেই কিন্তু যেমনকে তেমন। সারারাত ঘুমোতেই পারিনি। ব্যাপারটা কী, আমি বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কালই কেন এটা একটা আলোর মতন জ্বলতে লাগল! আপনি কী করতে বলেন, পতঞ্জলিবাবু? আরেক রাত্তির দেখব?

আমি পাথরটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না। আমার মতো একজন অবৈজ্ঞানিকের মনে একটু ভয়ও দেখা দিল–হঠাৎ তেজস্ক্রিয়-টিয় হয়ে যায়নি তো? খুব তো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম।

আমি তাঁকে আরেক রাত্তির দেখতে বলে পাথরটা ফেরত দিলাম। পরদিনও তিনি সেইরকম উদ্ভ্রান্তভাবে এলেন। পাথরটা অবশ্য আনেননি।

আমি তাঁকে বললাম, আমার পরিচিত একটি ছেলে আছে, সাত্যকি। বিজ্ঞানে গবেষণা করে দেশ-বিদেশে খুব খ্যাতি পেয়েছে। কাছেই থাকে। চলুন, তার কাছে যাই।

সাত্যকি বাড়িতেই ছিল। অপরিচিত একজনের সঙ্গে আমাকে আসতে দেখে সে একটু অবাক হল। তাকে মানস সরোবরের পাথরটা দেখিয়ে সব বললাম। সে ওটা নিয়ে কী সব পরীক্ষা করে বলল, এটা একটা ফসফরেসেন্ট পাথর। বাংলায় বলা হয়, অনুপ্ৰভ। আলো নিবিয়ে দেওয়ার পরে কিছুক্ষণ জ্বলজ্বল করতে পারে। কিন্তু আপনি বলছেন, পরশু রাত্তির থেকে হঠাৎ সারারাত ধরে জ্বলছে। তবে কি ঘরে অন্য কোনও রশ্মি আসছে? আচ্ছা কৌটিল্যকাকা, আপনি পরশু দিন ঘরে কি অন্য কোনও জিনিস রেখেছেন?

কৌটিল্যবাবু একটু ভেবে হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এইভাবে বললেন, হ্যাঁ, টেবিলে একটা জিনিস রেখেছি বটে। তবে খুবই সাধারণ একটা বস্তু –একটা ছোট শক্ত খেলার বল। বিকেলে ছাদে জলের ট্যাংকটা খুলে ওষুধ দিতে যাওয়ার সময় একটা কালো বল এসে পড়ল জলে। পাশের বাড়ির দুরন্ত ছেলেটার কাণ্ড। ভাগ্যি ভালো যে মাথায় লাগেনি। আমি ওটা টেবিলে রেখে দিয়েছি। এখনও চাইতে আসেনি। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।

সাত্যকি বলল, বলটা এবার দেখে আসতে পারি? আপনার আসার দরকার নেই, আমিই যাব। কাকাবাবুর বাড়ি তো চিনিই। কাকাবাবুকে নিয়েই যাব।

আমারও একটা আগ্রহ জাগল। কৌটিল্যবাবুর সঙ্গে সরাসরি তাঁর বাড়িতেই চলে এলাম কালো বলটা দেখতে। অবশ্য বলের সঙ্গে পাথরের কী সম্পর্ক, সেটা আমার মাথায় ঢুকল না। এ যেন হাঁটু দিয়ে রক্ত পড়ে, চোখ গেল রে বাবা!

আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই কৌটিল্যবাবু হতভম্ব। টেবিল থেকে বলটা উধাও! তবে কি তাঁর নাতি বিলটু নিমেছে? বিলটুর খোঁজ শুরু করতেই ছাদ থেকে তার চিলচিৎকার শুনতে পেলাম। আমরা দুজনেই ছুটে ছাদে চলে এলাম। দেখি, বিলটুর পাশেই বলটা পড়ে আছে। বিলটু বলল, বলের মধ্যে নাকি একটা লাল হঁদুর ছিল। তার হাতের ওপর দিয়ে পালিয়ে গেল।

ছাদের এদিকটা পরিষ্কার নয়। বিলটুর প্যান্টে ধুলো-মাখা। জামায় আরশোলার পাখা আটকে আছে। তাকে ঝেড়েঝুড়ে কোলে তুলে কৌটিল্যবাবু নীচে নেমে এলেন। আমিও বলটা হাতে নিয়ে তার পেছন পেছন এলাম। বলটাতে দেখলাম, একটা ফাটল ধরেছে।

সাত্যকি বিকেলেই এসে হাজির। তাকে বলটা দিতে সে ওটা অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। ফাটলের মধ্যে একটা ছোট্ট টর্চ দিয়ে আলো ফেলল। তারপর তার ব্যাগ থেকে একটা যন্ত্র বের করে বলটার যেন বুক পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, আশ্চর্য!

আমরা উদগ্রীব হয়ে তার কথা শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

সাত্যকি বলটাকে টেবিলের ওপর রেখে সেটার দিকে ঝুঁকে পড়ে যেন আপন মনেই বলতে লাগল, এটা বল নয়, কাকাবাবু। এটা কী, তা শুনলে তাজ্জব বনে যাবেন। বস্তুটা হচ্ছে খুব ছোট্ট একটা মহাকাশযান। এটার গা থেকে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি বেরোচ্ছে। তাই এটার রং বলতে পারেন অতিবেগুনি, কালো নয়। কিন্তু ওই রং আমাদের চোখে অদৃশ্য। তাই আমরা মহাকাশযানটাকে কালোই দেখি। কিন্তু আপনার মানস সরোবরের পাথরকে এটা উদ্ভাসিত করেছে।

আমরা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ মুখে কোনও কথাই সরল না। হঠাৎ কৌটিল্যবাবু বলে উঠলেন, তবে বিলটু যে ইঁদুরটাকে দেখেছিল, সেটা কি–

সাত্যকি হেসে বলল, বাচ্চা ছেলের কাছে ইঁদুর মনে হয়েছে। তবে মনে হয়, সেটি অজানা গ্রহের এক বুদ্ধিমান জীব। আমরা তাকে মানুষই বলতে পারি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার কি ইঁদুরের মতন আকার হতে পারে?

সাত্যকি উত্তর দিল, কাকাবাবু, বিলটুর হাতের ওপর দিয়ে পাঁচ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের একটা পৃথিবীর মানুষ ছুটে গেলেও সে সেটাকে ইঁদুরই ভাববে। তবে লাল রংটা হয়তো ঠিকই দেখেছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানী, শিল্পী ও দার্শনিকরা অন্য গ্রহের সবচাইতে বুদ্ধিমান জীবের যে দৈহিক গঠন কল্পনা করেছেন, সেটা মানুষের মতনই–কিছু উদ্ভট কল্পবিজ্ঞানের গল্পে ছাড়া। প্রকৃতি যে মনুষ্যাকৃতি দিয়েছে, তার চাইতে সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ আমরা কল্পনা করতে পারিনি। মানুষ শারীরিক ও ইন্দ্রিয়শক্তির দিক থেকে কোনও-না-কোনও প্রাণীর থেকে পিছিয়ে আছে। তার দৃষ্টিশক্তি শকুন-প্যাঁচার করুণার উদ্রেক করবে, ঘ্রাণশক্তিতে হাতি-কুকুরের কাছে নস্যি, শ্রবণশক্তিতে বেড়াল-কুকুর এগিয়ে, সাপ-মাছও মানুষের চাইতে স্পর্শকাতর। তবুও সে এগিয়ে তার বুদ্ধিতে আর তার শারীরিক সামঞ্জস্যে–যে শরীরে শিং নেই, নখ নেই, কাউকে যে কাটে না।

আমি বললাম, সেই পলাতক বুদ্ধিমান জীবটি নিশ্চয় বুদ্ধি খাঁটিয়ে কোনও নিরাপদ জায়গায় আছে। সুযোগ পেলেই নিজ গ্রহে ফিরে যাবে।

সাত্যকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সন্দেহ আছে, কাকাবাবু। মানুষ যত বুদ্ধিমান হয়েছে, যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া সে তত অসহায় হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া, আমরা জানি না তার আয়ুষ্কাল কত। জানি না, এই পৃথিবীর পরিবেশে কতক্ষণ সে টিকতে পারবে, যদি না তার গ্রহের আবহাওয়া-পরিবেশের সঙ্গে পৃথিবীর সাদৃশ্য থাকে–একটু চুপ করে থেকে সাত্যকি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল, যদি অনুমতি দেন, আমি কি এই মিনি মহাকাশযানটা কিছু দিনের জন্যে রাখতে পারি?

কৌটিল্যবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়। তুমি যদি কিছু উদ্ভাবন করতে পারো, সে তো আমাদেরই গৌরব। তারপর হেসে বললেন, বলা যায় না, তেমন কিছু আবিষ্কার হলে সাত্যকি সোমের নামের সঙ্গে এই দুই অবিজ্ঞানীর নামও যুক্ত হতে পারে।

সাত্যকি সেই বলটা নিয়ে চলে গেল। আমিও বাড়ি চলে এলাম।

পরদিন চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ হাতে সকালটাকে উপভোগ করছি। পায়ের কাছে মেঝেতে হালুম দু-পায়ে দাঁড়িয়ে আর দু-পায়ে বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তার প্রাপ্য বিস্কুটের টুকরোর অপেক্ষায়। হঠাৎ সে ফাঁস করে শোকেসটার দিকে তেড়ে গেল। আমি চেয়ে দেখি, শোকেসের কাচের ভেতরে একটা ছোট্ট লাল পুতুল। কাচের পাল্লায় একটু ফাঁক, তাতে হালুমের থাবা ঢুকলেও পাল্লাটাকে সরিয়ে পুতুলের নাগাল পাচ্ছে না। পুতুলটা নড়ে উঠতেই আমি ছুটে হালুমকে সরিয়ে দিলাম। সন্দেহ নেই একটুও, সেই গ্রহের জীব। ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি পাল্লার কাঁচটা সরিয়ে জীবটিকে অভয়ের ভঙ্গিতে বললাম, মাভৈঃ! কী বুঝল কে জানে। ওটাকে ধরে আমি ওপরের তাকে রেখে দিলাম, যাতে বেড়ালের নজরে না পড়ে। জীবটি কি কিছু খায়? একটা বিস্কুট আর ছোট্ট একটা খেলনা বাটিতে কিছু জলও রেখে দিলাম। এবারে সে বোধহয় বুঝতে পারল যে, আমার কোনও বদ মতলব নেই। সে আমার কাছে এল। মনে হল, তার গায়ের লাল রংটা কোনও আবরণের রং। হয়তো মহাকাশচারীর পোশাক। সেটা শরীরের সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গিয়েছে যে, চলতে-ফিরতে-দৌড়তে কোনও অসুবিধা হয় না। কী দিয়ে পোশাকটা তৈরি, তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা আমার কম্ম নয়। সাত্যকি বলতে পারবে। হ্যাঁ–আমি স্থির করলাম, জীবটিকে সাত্যকির কাছেই নিয়ে যাব। কৌটিল্যবাবুকে সঙ্গে নেব অবশ্যই। বাড়িতে এখনই কিছু ভাঙব না, নইলে এমনই হইচই লেগে যাবে যে, পাড়া-প্রতিবেশীর জানতে আর বাকি থাকবে না। আর তার ফলে জীবটিরই জীবনসংশয় হবে।

সারা দুপুর সবার নজর থেকে কায়দা করে জীবটিকে আগলে রাখলাম। দেখলাম, সে বিস্কুট ঠুকরেছে। হয়তো জলও খেয়েছে। বিকেলে বেরুবার আগে বাড়িতে শুধু বললাম, কৌটিল্যবাবুর সঙ্গে সাত্যকির কাছে যাচ্ছি। যেতে যেতে ভাবলাম, কৌটিল্যবাবুকেও সাবধান করে দেব, একেবারে সাত্যকির সঙ্গে দেখা করার পরেই যেন ব্যাপারটা বাড়িতে বলেন।

রাতুলবাবুকে (প্রত্যেকবার জীবটি বলার চাইতে একটা নামই দিয়ে দিলাম আমি) পকেটে পুরতে কোনও অসুবিধা হল না। সে-ও বুঝতে পেরেছে, আমি তার ক্ষতি করব না। আকারে বৃহৎ হলেও পৃথিবীর মানুষ আমি যে রাক্ষসশ্রেণিভুক্ত নই, সেটা হয়তো সহজ বুদ্ধিতে সে ধরতে পেরেছে। কৌটিল্যবাবুকে দেখাতেই মনে হল, তিনি মাথা ঘুরে পড়বেন। নিজেকে সামলে নিতেই আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে সাবধান করে দিলাম। আগে সাত্যকির কাছে যাই, তারপরে

কৌটিল্যবাবু যেন কুকুরের বাচ্চাকে আদর করছেন, এইভাবে রাতুলের কাছে গিয়ে চুকচুক শব্দ করতে লাগলেন। সন্দেহ নেই, বুঝতে পারলে রাতুল অপমানে আরও লাল হয়ে যেত। রাতুল নামটা কৌটিল্যবাবুর পছন্দ হল না। তিনি বললেন, লালটু। তাঁর নাতির নামের সঙ্গে মিল বলেই হয়তো। আমারও তাতে আপত্তি নেই।

টেলিফোন করেই গিয়েছিলাম সাত্যকিকে লালটুর ব্যাপার জানিয়ে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম, সাত্যকি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাদের তার গবেষণাগারে নিয়ে গেল। লালটুকে একটা থালার ওপর দাঁড় করিয়ে তাকে পরীক্ষা করতে লাগল। লালটুও লক্ষ্মী ছেলের মতন দাঁড়িয়ে তার কুতকুতে চোখ দুটো দিয়ে সব কিছু দেখতে লাগল।

সাত্যকি বলল, দেখেছেন এর আকৃতি? অবিকল মানুষের মতো। আবার পরে আছে। মহাকাশযাত্রীর পোশাকও। তবে পোশাকটা কী থেকে তৈরি জানি না। বিস্কুট যখন খেয়েছে, তখন ওদের খাদ্যও বোধহয় আমাদের মতোই প্রধানত চারটি মৌল উপাদানের যৌগ। এবার দেখা যাক, ওদের ভাষা কীরকম।

কৌটিল্যবাবু বললেন, দ্যাখো, দ্যাখো, লালটু মুখ খুলে কী যেন বলার চেষ্টা করছে!

সাত্যকি একটা যন্ত্রে কান লাগিয়ে বলল, হ্যাঁ। বলার চেষ্টা করছে না, বলছে। তবে আলট্রাসনিক ধ্বনি, আমরা খালি কানে শুনতে পাচ্ছি না। দেখি তো, অডিয়ো-ফ্রিকোয়েন্সি কনভার্টার লাগিয়ে।

যন্ত্রটা লাগাতেই একটু পরে সরু মেয়েলি গলায় কতকগুলো শব্দ শোনা গেল–অর্ক গাখা উকাঙ ঘ..

সাত্যকি বলল, লালটু কথা বলার সময় জিব ব্যবহার করে না। অথবা ওর জিব নেই। তাই স্বরবর্ণ আর ক-বর্গেই সব বলছে। কিন্তু কী বলছে সে?

সাত্যকি তার এএফসি যন্ত্রে নিজের কণ্ঠস্বরকে আলট্রাসনিকে পরিবর্তিত করে বিশুদ্ধ বাংলায় লালটুকে যা জিজ্ঞেস করল, সেটা বঙ্কিম উপন্যাসের নায়িকার প্রশ্নবাক্যপথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?

আমরা দুজন হেসে উঠলাম। অবশ্য লালটু তা শুনতে পেল না। সে শুনল সাত্যকির প্রশ্ন। কী বুঝল, সে-ই জানে। কিন্তু সে চুপ করে কথাটা শুনল, তারপর বলে উঠল, আখা, আখা, কক–

সাত্যকি আমাদের দিকে ফিরে বলল, বলতে পারছি না, লালটু পৃথিবীতে নামার জন্যই এসেছিল, না দিক্‌ভ্রষ্ট হয়ে নেমেছে। প্রথমটা হলে জলের ট্যাংকে পড়ত না। তার মহাকাশযান পৃথিবীকে ঘিরে পাক খেতে খেতে নেমে এসেছে একটু একটু করে, নইলে পৃথিবীর আকর্ষণে বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেত উল্কার মতো। কিন্তু সে যদি সমুদ্রে পড়ত?

সাত্যকি আমাদের দিকে চেয়ে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, দু-একটা দিন একে আমার কাছে রাখবেন আপনারা? যদি কিছু জানতে পারি চেষ্টা করে। অন্য বিজ্ঞানীদের হাতে পড়লে তারা কিন্তু একে গিনিপিগ বানিয়ে ফেলবে। মেরে ফেলে এর দেহ ব্যবচ্ছেদ করবে। সাধারণ মানুষের হাতে পড়লেও একই পরিণতি। আপনারা কি তা-ই চান?

আমাদের দুজনেরই লালটুর ওপর একটু বাৎসল্যস্নেহ জন্মে গিয়েছিল এর মধ্যেই। আমরা আঁতকে উঠে একমত হয়ে সাত্যকিকেই উলটে অনুরোধ করলাম তার কাছেই লালটুকে রেখে দিতে। আমরা এখন কাউকে কিছু বলব না।

কৌটিল্যবাবু তাঁর তর্জনীটা আলতোভাবে লালটুর ধুতনিতে চুঁইয়ে যেই বললেন, চলি, দাদুভাই। সাত্যকি হেসে বলল, ওদের আয়ুষ্কাল কত জানি না। হয়তো আপনার দাদুর বয়সিও হতে পারে সে। সামান্য রেশমের মতো চুল থাকলেও দাড়িগোঁফ গজায় না এদের। যন্ত্রে সেরকম কোনও গ্রন্থি নজরে পড়ল না।

কৌটিল্যবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সাত্যকি, লালটু কি তার গ্রহে ফিরতে পারবে?

সাত্যকি উদাসভাবে বলল, জানি না। ওর মহাকাশযানটা মনে হয় ভালোই আছে। কিন্তু জন্মস্থানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে কি না, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, ফিরতে পারলেও কোন অবস্থায় তার গ্রহকে দেখবে, সেটাও বলা সম্ভব নয়। দেখি, ওর কাছ থেকে কিছু জানতে পারি কি না। আপাতত এই লালটুই আমার গবেষণা। বলে হাসল তরুণ বিজ্ঞানী সাত্যকি নোম।

পরদিন সকালে সাত্যকির বাড়িতে যাওয়ামাত্র সাত্যকি বলল, বেশ কিছু তথ্য জেনেছি, কাকাবাবু। একটা কাগজে লেখার ভঙ্গি করে তার কাছে সেটা রাখলাম। লালটু মহাকাশযান থেকে একটা ছোট্ট যন্ত্র এনে কাগজের ওপর রাখল। দেখলাম, পেনসিল বা কলম নয়। কারণ লালটুরা আঙুলকে দিয়ে পরিশ্রম করায় না। যন্ত্রটাতে বোতাম টিপেই সে তরতর করে লিখে চলল। অবশ্য আতশকাঁচ ছাড়া সে লেখা বুঝতে পারবেন না। লালটু উচ্চারণ করে তাদের বর্ণমালা বলতে বলতে সেগুলো লিখল। দেখলাম, তাদের বর্ণমালার সংখ্যা খুব কম। সেগুলোকে পারমুটেশন-কম্বিনেশন করেই লক্ষ লক্ষ শব্দ তৈরি করে ওরা। ওদের সংখ্যা কেমন জানেন? দশমিক প্রথার বদলে দ্বাদশিক প্রথা ওদের জগতে।

আমি অবাক হয়ে বলি, সেটা আবার কী?

সাত্যকি বলল, পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যার নিয়ম এক। এক থেকে নয়, আর শূন্য এই দিয়েই সব সংখ্যা। একের পর শূন্য এসে দশ হল। লালটুদের গ্রহে কিন্তু এক থেকে এগারো পর্যন্ত এক অঙ্কের। তারপরে একে শূন্য দিয়ে হল বারো–এইভাবে।

আমার তো মাথা গুলিয়ে গেল।

সাত্যকি বলল, কিছু শব্দও শিখেছি। যেমন, অক্ক মানে আমি। ঘক মানে আসা এইসব। মনে হয়, এবার অল্প দিনের মধ্যেই অনেক কিছু জেনে যাব। আশা করি, তখন কেউ এর ক্ষতি করবে না।

এইভাবে ক-দিনের মধ্যেই জানলাম, ওদের হাসিকান্না, সুখ-দুঃখ আছে পৃথিবীর মানুষের মতোই। পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে কত দিন লাগে, সেটা এই ক-দিনের গতি দেখেই সে তার কম্পিউটারে কষে ফেলেছে। তাদের গড় আয়ু সেরকম আবর্তনের প্রায় দেড় হাজার। অর্থাৎ দেড় হাজার বছর। শুনে কৌটিল্যবাবু আমার কানে কানে বললেন, সে দিন দাদুভাই বলাটা তাঁর ঠিক হয়নি। সম্বোধনটাকে যদিও উলটোভাবে ধরে নিয়ে লালটুকে দাদু হিসেবে নেওয়া যায়, কিন্তু থুতনি ধরে আদর করাটা–ছি ছি ছি!

ক্রমে জানলাম, লালটুর গ্রহের নাম ওদের ভাষায় গাখখা। এরকম অসংখ্য ভাষা আছে সেই গ্রহে। আছে অসংখ্য শ্রেণির প্রাণী। গাছও। আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য আছে এবং সে জন্যেই সে এখানে এসে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বেঁচে আছে। তবে সেখানে মানুষের আকার তার মতোই বালখিল্য। এক মিটার উঁচু তাদের বনস্পতি যেগুলোকে আমরা হয়তো বনসাই বলব। কিন্তু পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র-নদী এগুলোর আকার পৃথিবীর তুলনায় খুব হেরফের হবে না। বহু কোটি ক্ষুদ্রাকার মানুষের বাসযোগ্য সেই গাখা, অথচ তাদের সংখ্যা সীমিত। তাই ওদের কোনও অভাব নেই। নেই মানসিক, নৈতিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা। জলে-বাতাসে দূষণ নেই। তাদের মাউন্ট এভারেস্টে কোনও মানুষ আরোহণ করে উঠতে পারেনি, হয়তো পারবেও না। অন্যভাবে উঠেছে। সাঁতরে নদী পার হওয়াও তাদের কাছে সমুদ্রলঙ্ঘন। কারণ নদীর পরপরই খালি চোখে তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।

শেষে লালটু মানুষের মতোই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছে–এসবই সে যখন গাখা ছেড়ে এসেছিল, সেই সময়কার কথা। পৃথিবীর হিসাবে কয়েক লক্ষ বছর আগে।

এসব জানিয়ে কাচের বাক্সের মধ্যে বসে-থাকা লালটুর দিকে তাকিয়ে সাত্যকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তবে জানেন কাকাবাবু, কৌটিল্যকাকা, ক-দিন থেকে লালটুর মনটা ভালো যাচ্ছে না। আগের মতন সে আর বেশি কথা বলে না। বলে, গাখার কথা, তার অতীতকালের প্রিয়জনদের কথা ভেবে মন কেমন করছে। লালটুর মতো তো তাদের আয়ুবৃদ্ধি আটকে থাকেনি!

এটা অবশ্য আমরাও একটু অনুমান করতে পেরেছি। আমাদের দেখে তো কিছু দিন আগে পর্যন্ত চেনা বন্ধুর মতো অনেক কথা বলে যেত, যা যন্ত্রের সাহায্যে শুনে সাত্যকি তরজমা করে দিত যতটা সম্ভব। আমাদের দুজনের নামকরণ করেছিল ওদের দুই উপগ্রহের নামে। সাত্যকি হেসে বলেছিল, সোজা বাংলায় যার অর্থ–মানিকজোড়। তা মহা-মহা-প্রদাদু এরকম একটু-আধটু ঠাট্টা করতেই পারেন।

মাঝে কৌটিল্যবাবু অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমারও কিছু দিন লালটুকে দেখতে যাওয়া হয়নি। একদিন টেলিফোনে সাত্যকিকে জানালাম, এবার লালটুর সঙ্গে পৃথিবীর লোজনের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই উচিত। মনে হয়, এরপর বিজ্ঞানীরা ওকে উত্ত্যক্ত করবেন না। সাত্যকি কিন্তু এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। সে বলল, আর ক-দিন যাক। লালটু একটু অসুস্থ বোধ করছে। বোধহয় পৃথিবীর বাতাসের দূষণ ওর সহ্য হচ্ছে না, যদিও যতটা সম্ভব দূষণমুক্ত কাচের বাক্সে তাকে রাখা হয়েছে।

সে দিন ছিল আশ্বিন মাসের এক রবিবার। আমি আর কৌটিল্যবাবু সাত্যকির কাছে গিয়ে দেখি, সে টেবিলে দু-হাতের ওপর মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছে। এক হাতে সন্না দিয়ে একটি অভ্রের টুকরো ধরা। আমাদের দেখে সেটা একটা ছোট্ট কৌটোর মধ্যে রেখে বলল, লালটু চলে গিয়েছে।

অ্যাঁ! কোথায়? দু-জনেই সমস্বরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম।

 সাত্যকি সেভাবেই ধীরে ধীরে বলল, গন্তব্য তো তার গাখা গ্রহে। তবে জানি না, তার পথের শেষ কোথায়। ক-দিন থেকেই মুষড়ে পড়েছিল। এদিকে এখানে চারপাশের পরিবেশে কেমন একটা সাজো সাজো ভাব। বাগানের শিউলি গাছ ফুলে ভরে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সকালের রোদে সোনা। ফাঁকা জমিতে কীভাবে শরতে খবর পেয়ে সাদা কাশ মাথা তুলে তার অমল ধবল আন্দোলনের ইনফ্রাসোনিক ধ্বনিতে শরতের আগমনি গাইছে। এই পরিবেশে ওর নিঃসঙ্গতা দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে উঠল। রাত্তিরে মহাকাশযান বলটাকে ছাদে নিয়ে এলাম। লালটু আমার মনোভাব বুঝতে পারল। সে আনন্দে সেখানে ছুটে এল। আমার হাতের তালুতে উঠে সে আলট্রাসনিক তরঙ্গে সুর তুলে বলে উঠল–গিগা। না, এটা ওদের ভাষা নয়। বাংলা শব্দ–বিদায়! সে আমার কাছে কিছু বাংলাও শিখেছিল। তারপর সে মহাকাশযানে ঢুকে একবার বেরিয়ে এল। তারপর আবার ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই বলটা ছুটে চলে গেল আকাশের অসীমে।

আমরা চুপ। একটু পরে আমি বললাম, ভালোই করেছ সাত্যকি। ওর কোনও ক্ষতি হলে গাখা গ্রহের কাছে দায়ী থাকতাম আমরা তিনজনই।

কৌটিল্যবাবু বললেন, পৃথিবীর কোনও স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে গেল না সে?

 সাত্যকি বলল, হ্যাঁ, আমি দিয়েছি। একটা মানুষের ছবি।

আমি বললাম, একটি পুরুষ ও একটি নারীর ছবি এর আগেও তো ভিন্ন জগতে পাঠানোর চেষ্টা হয়েছে। সেরকমই কি কিছু

সাত্যকি বলল, না। এটি একজন পুরুষেরই ছবি–সমগ্র মানবজগতের প্রতিনিধি হিসাবে। প্রথম যে মানুষটির মধ্যে আমরা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, মনুষ্যত্ব ও বিপ্লবী চিন্তার পরিচয় পেয়েছি, তাঁরই একটি ধ্যানমূর্তির ছবি।

কৌটিল্যবাবু বললেন, তুমি কার কথা বলছ?

সাত্যকি হেসে আবৃত্তি করল, শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য। প্রথম আদর্শ মানব হিসাবে তাঁর কথাই মনে পড়ল।

আমি বললাম, সে কিছু দিয়ে যায়নি? অবশ্য মহাকাশযানে কী-ই বা দেওয়ার মতো থাকবে?

সাত্যকি সেই ছোট্ট কৌটোটা খুলে বলল, হ্যাঁ, সে-ও দিয়েছে। তবে খালি চোখ কিছু বুঝতে পারবেন না। একটু দাঁড়ান, ম্যাগনিফায়িং প্রোজেক্টরে ছবি পর্দায় দেখাচ্ছি।

কিছুক্ষণের মধ্যে সাদা ফাইবার গ্লাসের বোর্ডে ফুটে উঠল অনেকগুলি নানান আকারের দেবদূতের ছবি।

একটা লাঠি দিয়ে তার মধ্যে একজনের দিকে নির্দেশ করে সাত্যকি বলল, এটি হলেন আমাদের লালটুর দাদু। এগুলো তার পরিবারের লোকজন।

আমি বললাম, কিন্তু এরা তো দেখছি পরির মতো পাখনাওয়ালা। লালটুও। কিন্তু আমরা তো লালটুর পিঠে কোনও পাখনা দেখিনি!

সাত্যকি প্রোজেক্টর বন্ধ করে দিয়ে বলল, হাঁ। লালটুরও ছিল। এদিক থেকে পৃথিবীর মানুষের তুলনায় একটু তফাত, একটু সুবিধে ওদের আছে। লালটুর পাখনাটা খোয়া গিয়েছে পৃথিবীতে এসে। খুবই পলকা। আবার গজাতে আমাদের হিসেবে প্রায় দশ বছর লাগবে। ওদের পৃথিবীতে এটা কোনও সময়ই নয়। যা-ই হোক, পৃথিবীতে এসে তার একমাত্র ক্ষতি এটাই।

কিন্তু কোথায় গেল সে দুটো! দু-জনেই বিস্ময়ভরা প্রশ্ন করে ফেলি।

সাত্যকি উদাসভাবে বলল, হয়তো মহাকাশযান থেকে প্রাণভয়ে ছুটে বেরোতে গিয়ে বিলটুর হাতের ধাক্কা লেগে খসে যেতে পারে। আমাদের কাছে খুবই হালকা-পলকা জিনিস। একটা আরশোলার পাখার মতো বই তো নয়।

[শুকতারা, শারদীয়া ১৪০৫]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লালটু
গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

লালটু

লালটু

আমার প্রতিবেশী কৌটিল্য সেনগুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মচারী। তাঁর এক অদ্ভুত শখের নেশা বা হবি আছে, যেটা আমরা, তাঁর অতিপরিচিত লোক ছাড়া অনেকেই জানে না। তিনি ঢাক পিটিয়ে সবাইকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেন না। তাঁর লেখাপড়ার টেবিলে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহৃত যে পাথরটা আছে, কিংবা তাঁর অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের তলায় বা বারান্দার গাছের টবের মাটির ওপর যেসব পাথরের টুকরো আছে, তাদের প্রত্যেকেরই একটা ইতিহাস আছে, যেটা তিনি ছাড়া অন্য কেউ মনে রাখতেও পারবে না। টেবিলের ওপর সুদৃশ্য পেপারওয়েটের বদলে ওইসব ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো দেখে মন্তব্য করতে তিনি আমাকে সে দিনই প্রথম জানালেন তাঁর হবির কথা।

জীবনে তো অনেক জায়গায় ঘুরলাম এই দেশে। বাইরেও গিয়েছি। নিকট আত্মীয়স্বজনও গিয়েছেন। আমার আর তাঁদের সংগ্রহ করা এইসব পাথর। যেমন, ওই পাথরটা মিশরের পিরামিডের পাশে পড়ে ছিল। একই পাথরে পিরামিড তৈরি। কয়েক হাজার বছর আগে হয়তো ওই বাড়তি টুকরোটা ভেঙে ফেলে দিয়েছিল কোনও শ্রমিক। এনেছিল আমার জামাই। এটা সেরকমই কুতুব মিনার এলাকায় পড়ে-থাকা একটা পাথর। আমিই এনেছি। ওই ছোট্ট টুকরোটা দক্ষিণ মেরু থেকে এনেছে আমার ভাইঝি। সে দলের সঙ্গে কুমেরু অঞ্চলে গিয়েছিল, সে তো আপনি জানেন। সব পাথরেরই এরকম একটা ইতিহাস আছে।

গল্পে-পড়া বাতিকবাবু নামে একজনের কথা আমার মনে পড়ল। সেটা অবশ্য একটু লোমহর্ষক ব্যাপার ছিল। আমি কৌটিল্যবাবুকে বললাম, আপনি এইভাবে খোলামেলা ছড়িয়ে রেখেছেন, এগুলো তো চুরি হয়ে যাবে। তিনি হেসে বললেন, না। এগুলো সেরকম মহামূল্য কিছু না। ব্যক্তিগত স্মারক ছাড়া বাইরের লোকের কাছে এর কোনও মূল্যই নেই। তা ছাড়া, তারা তো এগুলোর ইতিবৃত্তও জানে না।

প্রায় ছুটির দিনেই আমাদের দুজনের গল্পগুজব হত। তিনি তাঁর নানা স্থানে ভ্রমণের আর চাকরিজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প করতেন। আমি তো কলকাতার বদ্ধ জীব। মাঝে মাঝে যেসব ভ্রমণে গিয়েছি, সেগুলো অনেকেই ছুটি নিয়ে পরিকল্পনা করে টিকিট সংরক্ষণ করে বা ভাড়া-করা দূরপাল্লার বাসের মাধ্যমে করে থাকে। সেটা যেন বৈচিত্র্যহীন মাপা জলে স্নান। যে-কোনও ভ্রমণের বইয়েই পাওয়া যাবে, আমার কাছে নতুন কিছু শুনতে আসবে না কেউ।

একদিন সকালে হঠাৎ একটা পাথর হাতে কৌটিল্যবাবু প্রায় হন্তদন্ত হয়েই আমার বাড়ি এলেন। বললেন, পতঞ্জলিবাবু, গত রাত্তিরে এক অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। এই পাথরটাকে তো আপনি দেখেছেন। এটা মানস সরোবরের ধারে কুড়িয়ে পাওয়া একটা মসৃণ পাথরের টুকরো। অনেকদিন থেকেই টেবিলে আছে। আমি রাত্রে ওই ঘরেই শুই। রাত্তিরে আলো নেবালে কিছুক্ষণ চকচক করে পাথরটা। তারপরে আর করে না। গতকাল রাত্তিরে কিন্তু সারারাত ধরেই জ্বলজ্বল করেছে। আলো জ্বালাতেই কিন্তু যেমনকে তেমন। সারারাত ঘুমোতেই পারিনি। ব্যাপারটা কী, আমি বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কালই কেন এটা একটা আলোর মতন জ্বলতে লাগল! আপনি কী করতে বলেন, পতঞ্জলিবাবু? আরেক রাত্তির দেখব?

আমি পাথরটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না। আমার মতো একজন অবৈজ্ঞানিকের মনে একটু ভয়ও দেখা দিল–হঠাৎ তেজস্ক্রিয়-টিয় হয়ে যায়নি তো? খুব তো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম।

আমি তাঁকে আরেক রাত্তির দেখতে বলে পাথরটা ফেরত দিলাম। পরদিনও তিনি সেইরকম উদ্ভ্রান্তভাবে এলেন। পাথরটা অবশ্য আনেননি।

আমি তাঁকে বললাম, আমার পরিচিত একটি ছেলে আছে, সাত্যকি। বিজ্ঞানে গবেষণা করে দেশ-বিদেশে খুব খ্যাতি পেয়েছে। কাছেই থাকে। চলুন, তার কাছে যাই।

সাত্যকি বাড়িতেই ছিল। অপরিচিত একজনের সঙ্গে আমাকে আসতে দেখে সে একটু অবাক হল। তাকে মানস সরোবরের পাথরটা দেখিয়ে সব বললাম। সে ওটা নিয়ে কী সব পরীক্ষা করে বলল, এটা একটা ফসফরেসেন্ট পাথর। বাংলায় বলা হয়, অনুপ্ৰভ। আলো নিবিয়ে দেওয়ার পরে কিছুক্ষণ জ্বলজ্বল করতে পারে। কিন্তু আপনি বলছেন, পরশু রাত্তির থেকে হঠাৎ সারারাত ধরে জ্বলছে। তবে কি ঘরে অন্য কোনও রশ্মি আসছে? আচ্ছা কৌটিল্যকাকা, আপনি পরশু দিন ঘরে কি অন্য কোনও জিনিস রেখেছেন?

কৌটিল্যবাবু একটু ভেবে হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এইভাবে বললেন, হ্যাঁ, টেবিলে একটা জিনিস রেখেছি বটে। তবে খুবই সাধারণ একটা বস্তু –একটা ছোট শক্ত খেলার বল। বিকেলে ছাদে জলের ট্যাংকটা খুলে ওষুধ দিতে যাওয়ার সময় একটা কালো বল এসে পড়ল জলে। পাশের বাড়ির দুরন্ত ছেলেটার কাণ্ড। ভাগ্যি ভালো যে মাথায় লাগেনি। আমি ওটা টেবিলে রেখে দিয়েছি। এখনও চাইতে আসেনি। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।

সাত্যকি বলল, বলটা এবার দেখে আসতে পারি? আপনার আসার দরকার নেই, আমিই যাব। কাকাবাবুর বাড়ি তো চিনিই। কাকাবাবুকে নিয়েই যাব।

আমারও একটা আগ্রহ জাগল। কৌটিল্যবাবুর সঙ্গে সরাসরি তাঁর বাড়িতেই চলে এলাম কালো বলটা দেখতে। অবশ্য বলের সঙ্গে পাথরের কী সম্পর্ক, সেটা আমার মাথায় ঢুকল না। এ যেন হাঁটু দিয়ে রক্ত পড়ে, চোখ গেল রে বাবা!

আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই কৌটিল্যবাবু হতভম্ব। টেবিল থেকে বলটা উধাও! তবে কি তাঁর নাতি বিলটু নিমেছে? বিলটুর খোঁজ শুরু করতেই ছাদ থেকে তার চিলচিৎকার শুনতে পেলাম। আমরা দুজনেই ছুটে ছাদে চলে এলাম। দেখি, বিলটুর পাশেই বলটা পড়ে আছে। বিলটু বলল, বলের মধ্যে নাকি একটা লাল হঁদুর ছিল। তার হাতের ওপর দিয়ে পালিয়ে গেল।

ছাদের এদিকটা পরিষ্কার নয়। বিলটুর প্যান্টে ধুলো-মাখা। জামায় আরশোলার পাখা আটকে আছে। তাকে ঝেড়েঝুড়ে কোলে তুলে কৌটিল্যবাবু নীচে নেমে এলেন। আমিও বলটা হাতে নিয়ে তার পেছন পেছন এলাম। বলটাতে দেখলাম, একটা ফাটল ধরেছে।

সাত্যকি বিকেলেই এসে হাজির। তাকে বলটা দিতে সে ওটা অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। ফাটলের মধ্যে একটা ছোট্ট টর্চ দিয়ে আলো ফেলল। তারপর তার ব্যাগ থেকে একটা যন্ত্র বের করে বলটার যেন বুক পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, আশ্চর্য!

আমরা উদগ্রীব হয়ে তার কথা শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

সাত্যকি বলটাকে টেবিলের ওপর রেখে সেটার দিকে ঝুঁকে পড়ে যেন আপন মনেই বলতে লাগল, এটা বল নয়, কাকাবাবু। এটা কী, তা শুনলে তাজ্জব বনে যাবেন। বস্তুটা হচ্ছে খুব ছোট্ট একটা মহাকাশযান। এটার গা থেকে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি বেরোচ্ছে। তাই এটার রং বলতে পারেন অতিবেগুনি, কালো নয়। কিন্তু ওই রং আমাদের চোখে অদৃশ্য। তাই আমরা মহাকাশযানটাকে কালোই দেখি। কিন্তু আপনার মানস সরোবরের পাথরকে এটা উদ্ভাসিত করেছে।

আমরা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ মুখে কোনও কথাই সরল না। হঠাৎ কৌটিল্যবাবু বলে উঠলেন, তবে বিলটু যে ইঁদুরটাকে দেখেছিল, সেটা কি–

সাত্যকি হেসে বলল, বাচ্চা ছেলের কাছে ইঁদুর মনে হয়েছে। তবে মনে হয়, সেটি অজানা গ্রহের এক বুদ্ধিমান জীব। আমরা তাকে মানুষই বলতে পারি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার কি ইঁদুরের মতন আকার হতে পারে?

সাত্যকি উত্তর দিল, কাকাবাবু, বিলটুর হাতের ওপর দিয়ে পাঁচ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের একটা পৃথিবীর মানুষ ছুটে গেলেও সে সেটাকে ইঁদুরই ভাববে। তবে লাল রংটা হয়তো ঠিকই দেখেছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানী, শিল্পী ও দার্শনিকরা অন্য গ্রহের সবচাইতে বুদ্ধিমান জীবের যে দৈহিক গঠন কল্পনা করেছেন, সেটা মানুষের মতনই–কিছু উদ্ভট কল্পবিজ্ঞানের গল্পে ছাড়া। প্রকৃতি যে মনুষ্যাকৃতি দিয়েছে, তার চাইতে সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ আমরা কল্পনা করতে পারিনি। মানুষ শারীরিক ও ইন্দ্রিয়শক্তির দিক থেকে কোনও-না-কোনও প্রাণীর থেকে পিছিয়ে আছে। তার দৃষ্টিশক্তি শকুন-প্যাঁচার করুণার উদ্রেক করবে, ঘ্রাণশক্তিতে হাতি-কুকুরের কাছে নস্যি, শ্রবণশক্তিতে বেড়াল-কুকুর এগিয়ে, সাপ-মাছও মানুষের চাইতে স্পর্শকাতর। তবুও সে এগিয়ে তার বুদ্ধিতে আর তার শারীরিক সামঞ্জস্যে–যে শরীরে শিং নেই, নখ নেই, কাউকে যে কাটে না।

আমি বললাম, সেই পলাতক বুদ্ধিমান জীবটি নিশ্চয় বুদ্ধি খাঁটিয়ে কোনও নিরাপদ জায়গায় আছে। সুযোগ পেলেই নিজ গ্রহে ফিরে যাবে।

সাত্যকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সন্দেহ আছে, কাকাবাবু। মানুষ যত বুদ্ধিমান হয়েছে, যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া সে তত অসহায় হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া, আমরা জানি না তার আয়ুষ্কাল কত। জানি না, এই পৃথিবীর পরিবেশে কতক্ষণ সে টিকতে পারবে, যদি না তার গ্রহের আবহাওয়া-পরিবেশের সঙ্গে পৃথিবীর সাদৃশ্য থাকে–একটু চুপ করে থেকে সাত্যকি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল, যদি অনুমতি দেন, আমি কি এই মিনি মহাকাশযানটা কিছু দিনের জন্যে রাখতে পারি?

কৌটিল্যবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়। তুমি যদি কিছু উদ্ভাবন করতে পারো, সে তো আমাদেরই গৌরব। তারপর হেসে বললেন, বলা যায় না, তেমন কিছু আবিষ্কার হলে সাত্যকি সোমের নামের সঙ্গে এই দুই অবিজ্ঞানীর নামও যুক্ত হতে পারে।

সাত্যকি সেই বলটা নিয়ে চলে গেল। আমিও বাড়ি চলে এলাম।

পরদিন চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ হাতে সকালটাকে উপভোগ করছি। পায়ের কাছে মেঝেতে হালুম দু-পায়ে দাঁড়িয়ে আর দু-পায়ে বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তার প্রাপ্য বিস্কুটের টুকরোর অপেক্ষায়। হঠাৎ সে ফাঁস করে শোকেসটার দিকে তেড়ে গেল। আমি চেয়ে দেখি, শোকেসের কাচের ভেতরে একটা ছোট্ট লাল পুতুল। কাচের পাল্লায় একটু ফাঁক, তাতে হালুমের থাবা ঢুকলেও পাল্লাটাকে সরিয়ে পুতুলের নাগাল পাচ্ছে না। পুতুলটা নড়ে উঠতেই আমি ছুটে হালুমকে সরিয়ে দিলাম। সন্দেহ নেই একটুও, সেই গ্রহের জীব। ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি পাল্লার কাঁচটা সরিয়ে জীবটিকে অভয়ের ভঙ্গিতে বললাম, মাভৈঃ! কী বুঝল কে জানে। ওটাকে ধরে আমি ওপরের তাকে রেখে দিলাম, যাতে বেড়ালের নজরে না পড়ে। জীবটি কি কিছু খায়? একটা বিস্কুট আর ছোট্ট একটা খেলনা বাটিতে কিছু জলও রেখে দিলাম। এবারে সে বোধহয় বুঝতে পারল যে, আমার কোনও বদ মতলব নেই। সে আমার কাছে এল। মনে হল, তার গায়ের লাল রংটা কোনও আবরণের রং। হয়তো মহাকাশচারীর পোশাক। সেটা শরীরের সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গিয়েছে যে, চলতে-ফিরতে-দৌড়তে কোনও অসুবিধা হয় না। কী দিয়ে পোশাকটা তৈরি, তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা আমার কম্ম নয়। সাত্যকি বলতে পারবে। হ্যাঁ–আমি স্থির করলাম, জীবটিকে সাত্যকির কাছেই নিয়ে যাব। কৌটিল্যবাবুকে সঙ্গে নেব অবশ্যই। বাড়িতে এখনই কিছু ভাঙব না, নইলে এমনই হইচই লেগে যাবে যে, পাড়া-প্রতিবেশীর জানতে আর বাকি থাকবে না। আর তার ফলে জীবটিরই জীবনসংশয় হবে।

সারা দুপুর সবার নজর থেকে কায়দা করে জীবটিকে আগলে রাখলাম। দেখলাম, সে বিস্কুট ঠুকরেছে। হয়তো জলও খেয়েছে। বিকেলে বেরুবার আগে বাড়িতে শুধু বললাম, কৌটিল্যবাবুর সঙ্গে সাত্যকির কাছে যাচ্ছি। যেতে যেতে ভাবলাম, কৌটিল্যবাবুকেও সাবধান করে দেব, একেবারে সাত্যকির সঙ্গে দেখা করার পরেই যেন ব্যাপারটা বাড়িতে বলেন।

রাতুলবাবুকে (প্রত্যেকবার জীবটি বলার চাইতে একটা নামই দিয়ে দিলাম আমি) পকেটে পুরতে কোনও অসুবিধা হল না। সে-ও বুঝতে পেরেছে, আমি তার ক্ষতি করব না। আকারে বৃহৎ হলেও পৃথিবীর মানুষ আমি যে রাক্ষসশ্রেণিভুক্ত নই, সেটা হয়তো সহজ বুদ্ধিতে সে ধরতে পেরেছে। কৌটিল্যবাবুকে দেখাতেই মনে হল, তিনি মাথা ঘুরে পড়বেন। নিজেকে সামলে নিতেই আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে সাবধান করে দিলাম। আগে সাত্যকির কাছে যাই, তারপরে

কৌটিল্যবাবু যেন কুকুরের বাচ্চাকে আদর করছেন, এইভাবে রাতুলের কাছে গিয়ে চুকচুক শব্দ করতে লাগলেন। সন্দেহ নেই, বুঝতে পারলে রাতুল অপমানে আরও লাল হয়ে যেত। রাতুল নামটা কৌটিল্যবাবুর পছন্দ হল না। তিনি বললেন, লালটু। তাঁর নাতির নামের সঙ্গে মিল বলেই হয়তো। আমারও তাতে আপত্তি নেই।

টেলিফোন করেই গিয়েছিলাম সাত্যকিকে লালটুর ব্যাপার জানিয়ে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম, সাত্যকি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাদের তার গবেষণাগারে নিয়ে গেল। লালটুকে একটা থালার ওপর দাঁড় করিয়ে তাকে পরীক্ষা করতে লাগল। লালটুও লক্ষ্মী ছেলের মতন দাঁড়িয়ে তার কুতকুতে চোখ দুটো দিয়ে সব কিছু দেখতে লাগল।

সাত্যকি বলল, দেখেছেন এর আকৃতি? অবিকল মানুষের মতো। আবার পরে আছে। মহাকাশযাত্রীর পোশাকও। তবে পোশাকটা কী থেকে তৈরি জানি না। বিস্কুট যখন খেয়েছে, তখন ওদের খাদ্যও বোধহয় আমাদের মতোই প্রধানত চারটি মৌল উপাদানের যৌগ। এবার দেখা যাক, ওদের ভাষা কীরকম।

কৌটিল্যবাবু বললেন, দ্যাখো, দ্যাখো, লালটু মুখ খুলে কী যেন বলার চেষ্টা করছে!

সাত্যকি একটা যন্ত্রে কান লাগিয়ে বলল, হ্যাঁ। বলার চেষ্টা করছে না, বলছে। তবে আলট্রাসনিক ধ্বনি, আমরা খালি কানে শুনতে পাচ্ছি না। দেখি তো, অডিয়ো-ফ্রিকোয়েন্সি কনভার্টার লাগিয়ে।

যন্ত্রটা লাগাতেই একটু পরে সরু মেয়েলি গলায় কতকগুলো শব্দ শোনা গেল–অর্ক গাখা উকাঙ ঘ..

সাত্যকি বলল, লালটু কথা বলার সময় জিব ব্যবহার করে না। অথবা ওর জিব নেই। তাই স্বরবর্ণ আর ক-বর্গেই সব বলছে। কিন্তু কী বলছে সে?

সাত্যকি তার এএফসি যন্ত্রে নিজের কণ্ঠস্বরকে আলট্রাসনিকে পরিবর্তিত করে বিশুদ্ধ বাংলায় লালটুকে যা জিজ্ঞেস করল, সেটা বঙ্কিম উপন্যাসের নায়িকার প্রশ্নবাক্যপথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?

আমরা দুজন হেসে উঠলাম। অবশ্য লালটু তা শুনতে পেল না। সে শুনল সাত্যকির প্রশ্ন। কী বুঝল, সে-ই জানে। কিন্তু সে চুপ করে কথাটা শুনল, তারপর বলে উঠল, আখা, আখা, কক–

সাত্যকি আমাদের দিকে ফিরে বলল, বলতে পারছি না, লালটু পৃথিবীতে নামার জন্যই এসেছিল, না দিক্‌ভ্রষ্ট হয়ে নেমেছে। প্রথমটা হলে জলের ট্যাংকে পড়ত না। তার মহাকাশযান পৃথিবীকে ঘিরে পাক খেতে খেতে নেমে এসেছে একটু একটু করে, নইলে পৃথিবীর আকর্ষণে বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেত উল্কার মতো। কিন্তু সে যদি সমুদ্রে পড়ত?

সাত্যকি আমাদের দিকে চেয়ে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, দু-একটা দিন একে আমার কাছে রাখবেন আপনারা? যদি কিছু জানতে পারি চেষ্টা করে। অন্য বিজ্ঞানীদের হাতে পড়লে তারা কিন্তু একে গিনিপিগ বানিয়ে ফেলবে। মেরে ফেলে এর দেহ ব্যবচ্ছেদ করবে। সাধারণ মানুষের হাতে পড়লেও একই পরিণতি। আপনারা কি তা-ই চান?

আমাদের দুজনেরই লালটুর ওপর একটু বাৎসল্যস্নেহ জন্মে গিয়েছিল এর মধ্যেই। আমরা আঁতকে উঠে একমত হয়ে সাত্যকিকেই উলটে অনুরোধ করলাম তার কাছেই লালটুকে রেখে দিতে। আমরা এখন কাউকে কিছু বলব না।

কৌটিল্যবাবু তাঁর তর্জনীটা আলতোভাবে লালটুর ধুতনিতে চুঁইয়ে যেই বললেন, চলি, দাদুভাই। সাত্যকি হেসে বলল, ওদের আয়ুষ্কাল কত জানি না। হয়তো আপনার দাদুর বয়সিও হতে পারে সে। সামান্য রেশমের মতো চুল থাকলেও দাড়িগোঁফ গজায় না এদের। যন্ত্রে সেরকম কোনও গ্রন্থি নজরে পড়ল না।

কৌটিল্যবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সাত্যকি, লালটু কি তার গ্রহে ফিরতে পারবে?

সাত্যকি উদাসভাবে বলল, জানি না। ওর মহাকাশযানটা মনে হয় ভালোই আছে। কিন্তু জন্মস্থানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে কি না, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, ফিরতে পারলেও কোন অবস্থায় তার গ্রহকে দেখবে, সেটাও বলা সম্ভব নয়। দেখি, ওর কাছ থেকে কিছু জানতে পারি কি না। আপাতত এই লালটুই আমার গবেষণা। বলে হাসল তরুণ বিজ্ঞানী সাত্যকি নোম।

পরদিন সকালে সাত্যকির বাড়িতে যাওয়ামাত্র সাত্যকি বলল, বেশ কিছু তথ্য জেনেছি, কাকাবাবু। একটা কাগজে লেখার ভঙ্গি করে তার কাছে সেটা রাখলাম। লালটু মহাকাশযান থেকে একটা ছোট্ট যন্ত্র এনে কাগজের ওপর রাখল। দেখলাম, পেনসিল বা কলম নয়। কারণ লালটুরা আঙুলকে দিয়ে পরিশ্রম করায় না। যন্ত্রটাতে বোতাম টিপেই সে তরতর করে লিখে চলল। অবশ্য আতশকাঁচ ছাড়া সে লেখা বুঝতে পারবেন না। লালটু উচ্চারণ করে তাদের বর্ণমালা বলতে বলতে সেগুলো লিখল। দেখলাম, তাদের বর্ণমালার সংখ্যা খুব কম। সেগুলোকে পারমুটেশন-কম্বিনেশন করেই লক্ষ লক্ষ শব্দ তৈরি করে ওরা। ওদের সংখ্যা কেমন জানেন? দশমিক প্রথার বদলে দ্বাদশিক প্রথা ওদের জগতে।

আমি অবাক হয়ে বলি, সেটা আবার কী?

সাত্যকি বলল, পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যার নিয়ম এক। এক থেকে নয়, আর শূন্য এই দিয়েই সব সংখ্যা। একের পর শূন্য এসে দশ হল। লালটুদের গ্রহে কিন্তু এক থেকে এগারো পর্যন্ত এক অঙ্কের। তারপরে একে শূন্য দিয়ে হল বারো–এইভাবে।

আমার তো মাথা গুলিয়ে গেল।

সাত্যকি বলল, কিছু শব্দও শিখেছি। যেমন, অক্ক মানে আমি। ঘক মানে আসা এইসব। মনে হয়, এবার অল্প দিনের মধ্যেই অনেক কিছু জেনে যাব। আশা করি, তখন কেউ এর ক্ষতি করবে না।

এইভাবে ক-দিনের মধ্যেই জানলাম, ওদের হাসিকান্না, সুখ-দুঃখ আছে পৃথিবীর মানুষের মতোই। পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে কত দিন লাগে, সেটা এই ক-দিনের গতি দেখেই সে তার কম্পিউটারে কষে ফেলেছে। তাদের গড় আয়ু সেরকম আবর্তনের প্রায় দেড় হাজার। অর্থাৎ দেড় হাজার বছর। শুনে কৌটিল্যবাবু আমার কানে কানে বললেন, সে দিন দাদুভাই বলাটা তাঁর ঠিক হয়নি। সম্বোধনটাকে যদিও উলটোভাবে ধরে নিয়ে লালটুকে দাদু হিসেবে নেওয়া যায়, কিন্তু থুতনি ধরে আদর করাটা–ছি ছি ছি!

ক্রমে জানলাম, লালটুর গ্রহের নাম ওদের ভাষায় গাখখা। এরকম অসংখ্য ভাষা আছে সেই গ্রহে। আছে অসংখ্য শ্রেণির প্রাণী। গাছও। আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য আছে এবং সে জন্যেই সে এখানে এসে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বেঁচে আছে। তবে সেখানে মানুষের আকার তার মতোই বালখিল্য। এক মিটার উঁচু তাদের বনস্পতি যেগুলোকে আমরা হয়তো বনসাই বলব। কিন্তু পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র-নদী এগুলোর আকার পৃথিবীর তুলনায় খুব হেরফের হবে না। বহু কোটি ক্ষুদ্রাকার মানুষের বাসযোগ্য সেই গাখা, অথচ তাদের সংখ্যা সীমিত। তাই ওদের কোনও অভাব নেই। নেই মানসিক, নৈতিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা। জলে-বাতাসে দূষণ নেই। তাদের মাউন্ট এভারেস্টে কোনও মানুষ আরোহণ করে উঠতে পারেনি, হয়তো পারবেও না। অন্যভাবে উঠেছে। সাঁতরে নদী পার হওয়াও তাদের কাছে সমুদ্রলঙ্ঘন। কারণ নদীর পরপরই খালি চোখে তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।

শেষে লালটু মানুষের মতোই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছে–এসবই সে যখন গাখা ছেড়ে এসেছিল, সেই সময়কার কথা। পৃথিবীর হিসাবে কয়েক লক্ষ বছর আগে।

এসব জানিয়ে কাচের বাক্সের মধ্যে বসে-থাকা লালটুর দিকে তাকিয়ে সাত্যকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তবে জানেন কাকাবাবু, কৌটিল্যকাকা, ক-দিন থেকে লালটুর মনটা ভালো যাচ্ছে না। আগের মতন সে আর বেশি কথা বলে না। বলে, গাখার কথা, তার অতীতকালের প্রিয়জনদের কথা ভেবে মন কেমন করছে। লালটুর মতো তো তাদের আয়ুবৃদ্ধি আটকে থাকেনি!

এটা অবশ্য আমরাও একটু অনুমান করতে পেরেছি। আমাদের দেখে তো কিছু দিন আগে পর্যন্ত চেনা বন্ধুর মতো অনেক কথা বলে যেত, যা যন্ত্রের সাহায্যে শুনে সাত্যকি তরজমা করে দিত যতটা সম্ভব। আমাদের দুজনের নামকরণ করেছিল ওদের দুই উপগ্রহের নামে। সাত্যকি হেসে বলেছিল, সোজা বাংলায় যার অর্থ–মানিকজোড়। তা মহা-মহা-প্রদাদু এরকম একটু-আধটু ঠাট্টা করতেই পারেন।

মাঝে কৌটিল্যবাবু অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমারও কিছু দিন লালটুকে দেখতে যাওয়া হয়নি। একদিন টেলিফোনে সাত্যকিকে জানালাম, এবার লালটুর সঙ্গে পৃথিবীর লোজনের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই উচিত। মনে হয়, এরপর বিজ্ঞানীরা ওকে উত্ত্যক্ত করবেন না। সাত্যকি কিন্তু এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। সে বলল, আর ক-দিন যাক। লালটু একটু অসুস্থ বোধ করছে। বোধহয় পৃথিবীর বাতাসের দূষণ ওর সহ্য হচ্ছে না, যদিও যতটা সম্ভব দূষণমুক্ত কাচের বাক্সে তাকে রাখা হয়েছে।

সে দিন ছিল আশ্বিন মাসের এক রবিবার। আমি আর কৌটিল্যবাবু সাত্যকির কাছে গিয়ে দেখি, সে টেবিলে দু-হাতের ওপর মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছে। এক হাতে সন্না দিয়ে একটি অভ্রের টুকরো ধরা। আমাদের দেখে সেটা একটা ছোট্ট কৌটোর মধ্যে রেখে বলল, লালটু চলে গিয়েছে।

অ্যাঁ! কোথায়? দু-জনেই সমস্বরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম।

 সাত্যকি সেভাবেই ধীরে ধীরে বলল, গন্তব্য তো তার গাখা গ্রহে। তবে জানি না, তার পথের শেষ কোথায়। ক-দিন থেকেই মুষড়ে পড়েছিল। এদিকে এখানে চারপাশের পরিবেশে কেমন একটা সাজো সাজো ভাব। বাগানের শিউলি গাছ ফুলে ভরে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সকালের রোদে সোনা। ফাঁকা জমিতে কীভাবে শরতে খবর পেয়ে সাদা কাশ মাথা তুলে তার অমল ধবল আন্দোলনের ইনফ্রাসোনিক ধ্বনিতে শরতের আগমনি গাইছে। এই পরিবেশে ওর নিঃসঙ্গতা দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে উঠল। রাত্তিরে মহাকাশযান বলটাকে ছাদে নিয়ে এলাম। লালটু আমার মনোভাব বুঝতে পারল। সে আনন্দে সেখানে ছুটে এল। আমার হাতের তালুতে উঠে সে আলট্রাসনিক তরঙ্গে সুর তুলে বলে উঠল–গিগা। না, এটা ওদের ভাষা নয়। বাংলা শব্দ–বিদায়! সে আমার কাছে কিছু বাংলাও শিখেছিল। তারপর সে মহাকাশযানে ঢুকে একবার বেরিয়ে এল। তারপর আবার ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই বলটা ছুটে চলে গেল আকাশের অসীমে।

আমরা চুপ। একটু পরে আমি বললাম, ভালোই করেছ সাত্যকি। ওর কোনও ক্ষতি হলে গাখা গ্রহের কাছে দায়ী থাকতাম আমরা তিনজনই।

কৌটিল্যবাবু বললেন, পৃথিবীর কোনও স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে গেল না সে?

 সাত্যকি বলল, হ্যাঁ, আমি দিয়েছি। একটা মানুষের ছবি।

আমি বললাম, একটি পুরুষ ও একটি নারীর ছবি এর আগেও তো ভিন্ন জগতে পাঠানোর চেষ্টা হয়েছে। সেরকমই কি কিছু

সাত্যকি বলল, না। এটি একজন পুরুষেরই ছবি–সমগ্র মানবজগতের প্রতিনিধি হিসাবে। প্রথম যে মানুষটির মধ্যে আমরা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, মনুষ্যত্ব ও বিপ্লবী চিন্তার পরিচয় পেয়েছি, তাঁরই একটি ধ্যানমূর্তির ছবি।

কৌটিল্যবাবু বললেন, তুমি কার কথা বলছ?

সাত্যকি হেসে আবৃত্তি করল, শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য। প্রথম আদর্শ মানব হিসাবে তাঁর কথাই মনে পড়ল।

আমি বললাম, সে কিছু দিয়ে যায়নি? অবশ্য মহাকাশযানে কী-ই বা দেওয়ার মতো থাকবে?

সাত্যকি সেই ছোট্ট কৌটোটা খুলে বলল, হ্যাঁ, সে-ও দিয়েছে। তবে খালি চোখ কিছু বুঝতে পারবেন না। একটু দাঁড়ান, ম্যাগনিফায়িং প্রোজেক্টরে ছবি পর্দায় দেখাচ্ছি।

কিছুক্ষণের মধ্যে সাদা ফাইবার গ্লাসের বোর্ডে ফুটে উঠল অনেকগুলি নানান আকারের দেবদূতের ছবি।

একটা লাঠি দিয়ে তার মধ্যে একজনের দিকে নির্দেশ করে সাত্যকি বলল, এটি হলেন আমাদের লালটুর দাদু। এগুলো তার পরিবারের লোকজন।

আমি বললাম, কিন্তু এরা তো দেখছি পরির মতো পাখনাওয়ালা। লালটুও। কিন্তু আমরা তো লালটুর পিঠে কোনও পাখনা দেখিনি!

সাত্যকি প্রোজেক্টর বন্ধ করে দিয়ে বলল, হাঁ। লালটুরও ছিল। এদিক থেকে পৃথিবীর মানুষের তুলনায় একটু তফাত, একটু সুবিধে ওদের আছে। লালটুর পাখনাটা খোয়া গিয়েছে পৃথিবীতে এসে। খুবই পলকা। আবার গজাতে আমাদের হিসেবে প্রায় দশ বছর লাগবে। ওদের পৃথিবীতে এটা কোনও সময়ই নয়। যা-ই হোক, পৃথিবীতে এসে তার একমাত্র ক্ষতি এটাই।

কিন্তু কোথায় গেল সে দুটো! দু-জনেই বিস্ময়ভরা প্রশ্ন করে ফেলি।

সাত্যকি উদাসভাবে বলল, হয়তো মহাকাশযান থেকে প্রাণভয়ে ছুটে বেরোতে গিয়ে বিলটুর হাতের ধাক্কা লেগে খসে যেতে পারে। আমাদের কাছে খুবই হালকা-পলকা জিনিস। একটা আরশোলার পাখার মতো বই তো নয়। [শুকতারা, শারদীয়া ১৪০৫]