রাজুর পৃথিবী

রাজুর পৃথিবী

রাজুর চোখের সামনে ওর চেনা মানুষগুলো দিন দিন কেমন যেন বদলে যেতে লাগলো। বাবা আজকাল রাত করে বাড়ি ফেরেন। আপিসে নাকি কাজের চাপ পড়েছে। তার ওপর ছুটির পর দুটো টিউশনিও করতে হয়। ভাইয়া ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা বলে দিয়েছেন, পড়ে আর কাজ নেই। তার চেয়ে কোথাও একটা চাকরি জোটাতে পারলে সংসারের কাজে লাগবে। মেজো ভাইও আর কলেজে যায় না। বাবা বলেন মেজো ভাই নাকি পলিটিক্স করে। আর ওই করেই ও গোল্লায় গেছে। ওকে দিয়ে কিছু হবে না।

ভাইয়া আর মেজো ভাইকে বাবা যখন তখন শুয়োরের বাচ্চা আর কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেন। আজকাল বাবা মাকেও বকেন। রাজুর এসব ভালো লাগে না। শরীর খারাপ বলে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। শুধু কান্নার মতো কিছু যেন বুকের ভেতর গুমরে মরে।

অথচ রাজু দু’বছর আগে যুদ্ধের দিনগুলোতে বাবাকে দেখেছে, ভাইয়া আর মেজো ভাইর কথা বলতে গিয়ে আনন্দ আর গর্বে কি রকম ফেটে পড়তেন। ওরা দু’জনই যুদ্ধে গিয়েছিলো। নিয়মিত না হলেও বাবা ওদের খবর পেতেন। কখনো চিঠি আসতো, কখনো কারো মুখে শুনতেন, কখনো বা রাতের অন্ধকারে মেজো ভাই হঠাৎ করে হাজির হতেন। বাবা মাকে বলতেন, হবে না কেন বলো! আমার দাদা একবার এক সাদা চামড়ার সায়েবকে চড় মেরে একশ টাকা জরিমানা দিয়েছিলেন। আমার বাবা বিএ পাস করেও বৃটিশদের চাকরি করেননি। ছোট কাকা বোমা বানাতে গিয়ে মারা গেলেন। বিদ্রোহ আমাদের রক্তের কণায় কণায় মিশে আছে। খোকন আর মনি যদি যুদ্ধে না যেতো তাহলেই আমি অবাক হতাম।

যুদ্ধের ন’ মাস রাজুরা গ্রামের বাড়িতে ছিলো। দক্ষিণে ভাটির দেশে রাজুদের গ্রাম। শত্রুরা ওদিকে যেতে সাহস পেতো না। বাবা তখন মাকে শুধু বলতেন, চলো আমরাও ফ্রন্টে চলে যাই। খোকনদের ক্যাম্পে কাজের অভাব হবে না। মা রাজী হননি। গ্রামের বাড়ির জন্যে মা’র বড়ো বেশি রকম টান ছিলো। অসহযোগের দিনগুলোতে বাবাকে দেখে রাজুর মনে হতো–তার বুকের ভেতর বিদ্রোহ যেন আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে।

সেই বাবা একদিন রাতে খাবার টেবিলে বসে পলিটিক্স করা নিয়ে মেজো ভাইকে যা-তা বললেন। ভাইয়াকে বললেন, তোর লজ্জাও করে না এখনো একটা চাকরি জোটাতে পারিসনি? তোরা যুদ্ধ করেছিস না আমার মাথা করেছিস। যারা যুদ্ধ করেছে। তারা ঠিকই এদ্দিনে সব গুছিয়ে নিয়েছে।

ভাইয়া বললো, সবাই নয় বাবা, কেউ কেউ নিয়েছে। আপনি কি আমাদের হাইজ্যাকার হতে বলছেন?

মেজো ভাই হেসে বললো, আমরা হাইজ্যাকার হবার জন্যে যুদ্ধ করিনি বাবা।

বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, চোপ হারামজাদা! মুরোদ নেই এক ছটাক, তার ওপর লম্বা কথা! ওরে শুয়োরের দল, হাইজ্যাকার হতে গেলেও মুরোদ থাকতে হয়!

পাশের ঘর থেকে মা চাপা গলায় বললেন, আক্কেল বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে নাকি! ছেলেদের যতো বাজে কথা শোনানো হচ্ছে!

বাবা চড়া গলায় মাকে ধমক দিলেন, আমার কথার ভেতর নাক গলানো আমি পছন্দ করি না। তারপর বাবা কাশতে শুরু করলেন। ভাইয়া আর মেজো ভাইকে সামনে থেকে সরে যেতে ইশারা করলেন মা।

রাজু লক্ষ্য করেছে বাবা দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। শেষ রাতে বাবার কাশির শব্দে ওর ঘুম ভেঙে যায়। জানালার বাইরে কামিনী গাছের নিচে তখনো জমাট অন্ধকার। কাশতে কাশতে বাবার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বাবার বয়স এখনো পঞ্চাশ পেরোয়নি। অথচ ভেজাল বলে বাবা ওষুধ খাবেন না। রাজু জানে ওষুধের অনেক দাম।

মেজো ভাই প্রায় রাতেই বাড়ি ফেরে না। মা যদি কিছু বলেন, বাবা অমনি ধমক দিয়ে বলবেন জাহান্নামে গেছে। খবর্দার ওদের কোনো কথা আমাকে বলবে না।

কখনো মা মেজো ভাইকে বকতে বকতে কেঁদে ফেলেন। বলেন, পলিটিক্স আমাদের জন্যে নয়। যাদের খাওয়া পরার কোনো অভাব নেই ওরাই ওসব করে। আমাদের তো খেয়ে বাঁচতে হবে। ওসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?

মার কথা শুনে মেজো ভাই শুধু হাসে। বলে, তুমি যেভাবে বেঁচে আছো এটাকে বাঁচা বলে না মা। আমরা চাই সবাই ভালোভাবে বাঁচবে।

মা তবু কাঁদেন। কখনো পাড়ার কোন মহিলাকে বলেন, তিন বেলা রুটি খেয়ে কখনো কি থাকা যায়! উনি রুটি সহ্য করতে পারেন না, আমি মুখ দেখেই বুঝি। বলি এক বেলাইতো বাড়িতে খাও। দুটো ভাত খেলে কী হয়! আমরা না হয় রুটি খেলাম। উনি বলেন, কেরোসিন খুব সস্তা হয়ে গেছে নাকি! ভাত রুটি এতো কিছুর জোগান দেয়া যাবে না।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাজু ভাবে, দুই কামরার অন্ধকার স্যাঁতসেতে এই বাড়িটাকে যদি হঠাৎ একটা ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় তাহলে বেশ হয়। ওর ইচ্ছে করে বহু দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। রাজুদের গ্রামের বাড়ি সমুদ্রের কাছে। যখন ওরা গ্রামের বাড়িতে ছিলো, তখন গভীর রাতে রাজু সমুদ্রের গর্জন শুনতো। নারকেল আর সুপুরি গাছের ভেতর দিয়ে হু হু করে ভেসে আসতো সমুদ্রের সতেজ বাতাস। রাজুকে তখন কেউ সমুদ্রের তীরে নিয়ে যায়নি।

রাজু আজও সমুদ্র দেখেনি। দম বন্ধ করা বাড়িটার এক স্যাঁতসেতে কামরায় শুয়ে রাজু তার বুকের ভেতর সমুদ্রের গর্জন শোনে।

ঠিক এভাবেই রাজু মেজো ভাইর চোখে সমুদ্রের ছায়া দেখে। মেজো ভাই রাজুকে বলে, পৃথিবীটা অনেক বড়ো রাজু। এই বাড়িটা ছেড়ে, এই গলিটা ছেড়ে, এই শহরটা ছেড়ে বুকে সাহস নিয়ে বেরিয়ে পড়। দেখবি জীবনের পরিধি অনেক বড়ো হয়ে গেছে।

মেজো ভায়ের সব কথা রাজুর কাছে স্পষ্ট নয়। অনেকটা শেষ রাতের কুয়াশা ঢাকা সমুদ্রের মতো। সবটুকু বোঝা যায় না। তবু বোঝা যায়।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা মেজো ভাই হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো। বাবার শরীর ভালো নয় বলে দুপুরে আপিস থেকে চলে এসেছেন। মেজো ভাই ব্যস্ত গলায় বাবাকে বললো, এক্ষুণি একবার হাসপাতালে যেতে হবে বাবা।

মা আর্তনাদ করে উঠলেন–কেন?

মেজো ভাই তেমনি ব্যস্ত গলায় বললো, ভাইয়া অ্যাকসিডেন্ট করেছে।

বাবা মা দু’জনই মেজো ভাইর সঙ্গে হাসপাতালে গেলেন। রাজু অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে রইলো। দু’মাস ভাড়া বাকি পড়েছে বলে বাড়িওয়ালা ইলেকট্রিকের লাইন কেটে দিয়েছে।

নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হলো রাজুর। একবার মনে হলো কেউ যেন ওকে এক্ষুণি এসে বলবে, জলদি হাসপাতালে চলো রাজু। তোমার বাবা, মা, মেজো ভাই সবাই অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন।

অনেক রাতে বাবা আর মা বাড়ি ফিরলেন। রাজু শুয়েছিলো। ওর বুকের ভেতর কান্নার সমুদ্র জমছিলো। রাজু তখন সমুদ্রের গর্জন শুনছিলো। বাবা অন্ধকারে বারান্দায় বসে রইলেন। মা বিছানায় উপুড় হয়ে সারারাত কাঁদলেন ।

সকাল থেকে পাড়ার লোকজন আসতে শুরু করলো ওদের বাড়িতে। সন্ধ্যেবেলা। মেজোভাই ভাইয়ার লাশ নিয়ে ফিরলো। রাজু শুনলো, ভাইয়াকে হাইজ্যাকার মনে করে রাস্তায় পিটিয়ে মারা হয়েছে।

খুব ছোট বেলায় রাজুর মনে আছে ভাইয়া পাড়ার ছেলেদের নিয়ে দেয়াল পত্রিকা বের করতো। লাজুক হেসে মেজো ভাইকে ডেকে বলতো, মনি, শোন একটা কবিতা লিখেছি। বিকেলে ভাইয়া লিনা আপার সঙ্গে পার্কের রাধাচুড়ড়া গাছটার নিচে বসে গল্প করতো। রাজু অবাক হয়ে ভাবলো, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, খদ্দরের ঢোলা পায়জামা পাঞ্জাবি আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ভাইয়া কি করে হাইজ্যাকার হয়েছিলো।

ভাইয়াকে কবর দিয়ে এসে বাবা আরো বুড়ো হয়ে গেলেন। তার বুকের অসুখ বেড়ে গেলো। আরো বদমেজাজী হলেন। একদিন মাকে পর্যন্ত চড় মারলেন।

মা শুধু কাঁদেন। নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দেন। আর মেজো ভাই আরো ব্যস্ত হয়ে উঠলো। রাতে বাড়ি ফেরা আরো কমিয়ে দিলো।

রাজু ভাবে পুরোনো শহরের এই বন্ধ গলির অন্ধকার বাড়িটা থেকে সমুদ্র কি অনেক দূরে? আজকাল ওর শুধু সমুদ্রের গর্জন শুনতে ইচ্ছে করে।

মেজো ভাই যখন আসে তখন মনে হয় বাড়িতে এক ঝলক সমুদ্রের তাজা বাতাস ঢুকলো। একদিন মেজো ভাই রাজুকে বললো, চল রাজু, বেরিয়ে পড়ি। অনেক দূরে চলে যাই। আমরা সমুদ্রের তীরে সেই গ্রামে যাবো। একটু থেমে মেজো ভাই আপন মনে বললো, গ্রামগুলো সব ভেঙে যাচ্ছে।

রাজু ভয় পেলো–গ্রাম কেন ভেঙে যাচ্ছে মেজো ভাই?

মেজো ভাই একটু হাসলো। বললো, গ্রামের মানুষের কোনো সুখ নেই। ভাবছে শহরে এসে সুখে থাকবে। তাই গ্রাম উজাড় করে সব শহরে চলে আসছে। এসে ভিখিরির মতো শহরের দরজায় ঘুরছে। শহরে এসে গ্রামের তেজী মানুষগুলো অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।

কথা বলতে বলতে মেজো ভাই যেন সমুদ্রের তীরে হেঁটে বেড়ান। রাজু সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন শোনে। ঢেউগুলো বুকে এসে ভেঙে পড়ে।

তারপর একদিন বাবার চাকরি চলে গেলো। বহুদিন পর হাসতে হাসতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। মাকে বললেন, তোমাকে বলেছিলাম না, গেল মাসে আপিসের বড়ো সায়েবের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম। আজ বললো, আমার বিরুদ্ধে নাকি দালালীর অভিযোগ আছে। বলে বাবা হাসিতে ডুবে গেলেন। বললেন, অনেকগুলো ঘটনা আমরা একটু দেরিতে বুঝি। হাসতে হাসতে হঠাৎ তাঁর কাশি উঠলো। বাবা অতি কষ্টে কাশি চেপে বললেন, ভালোই হলো। আসলে চাকরি করা আমাদের ধাতে সয় না।

রাজুর মনে হলো তার চেনা পৃথিবীটা যেন আরো ছোট হয়ে আসছে। বাবার দাদা এক সায়েবকে চড় মেরেছিলেন, তাঁর বাবা বি এ পাশ করেও বৃটিশের চাকরি করেননি। তাঁর কাকা বোমা বানাতে গিয়ে মারা গেছেন। বাবা বলেন, ওদের রক্তে নাকি বিদ্রোহের বিষ রয়েছে। কেউ কোথাও সুস্থির হয়ে বসতে পারে না। ওদের কেউ নিয়মের ছকে পা

ফেলে চলতে শেখেনি।

ভাইয়া কবিতা ভালোবাসতো বলে ওকে সবাই এক ব্যস্ত বিকেলে খোলা রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেললো। মেজো ভাই দিনে বাড়ি ফিরতে ভয় পায়। মা অবিরাম কাঁদেন। আর বাবা সব জেনে, শুনে, বুঝে, হাসতে হাসতে বলেন ভালোই হলো।

বহুদিন হলো রাজু ইশকুলে যায় না। বেতন দিতে পারেনি বলে নাম কাটা গেছে। বাবা বলেন, জানা আছে ইশকুলে কেমন পড়া হয়।

রাজুর মনে আছে, সন্ধ্যেবেলা ইশকুলের গির্জায় ঘন্টা বাজাতো। আশ্চর্য এক বিষণ্ণতায় ঘন্টাগুলো থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বাতাসে হারিয়ে যেতো। অদ্ভুত সেই শব্দ রাজুকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে যেতে চাইতো।

গভীর রাতে বহুদূরে গির্জার সেই ঘন্টা শুনতে পায় রাজু। পাশের ঘরে বাবা মাকে গুণগুণ করে বলছিলেন, চলো, গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই। আর তো শহরে থাকার কোনো মানে হয় না। মাঝে মাঝে এসে ছেলেটার কবর দেখে যাবো।

গির্জার ঘড়িতে ঘন্টা বাজতেই থাকে। বাবার গলার স্বর ঘন্টার সেই গভীর শব্দের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। এক দুই করে রাজু ঘন্টাগুলো গোণার চেষ্টা করে।

তারপর একসময় সেই ঘন্টার শব্দ রাজুকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে যায়। আকাশে তখন রঙ ধরেছে। নারকেল আর সুপুরির বনে শোঁ শোঁ সমুদ্রের বাতাস।

মেজো ভায়ের হাত ধরে রাজু উদ্দাম এক সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে চলে দূরে, আরো দূরে।