গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৯. ষড়যন্ত্র

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – ষড়যন্ত্র

আয়ি বুড়ির কুটিরের কয়েক ঘর অন্তরে কোদণ্ড মিশ্রের গৃহ। ইহাও মাটির কুটির, খড়ের ছাউনি। গত বিশ বৎসর কোদণ্ড মিশ্র এই কুটিরে বাস করিতেছেন। তাঁহার স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নাই।

কোদণ্ড মিশ্রের কুটিরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। বদ্ধ দ্বারের অন্তরালে দুইজন বসিয়া মন্ত্রণা করিতেছেন; একজন স্বয়ং কোদণ্ড মিশ্র, অন্য ব্যক্তির নাম কোকবর্মা।

কোদণ্ড মিশ্রের সামান্য পরিচয় পূর্বে পাওয়া গিয়াছে। তিনি শশাঙ্কদেবের একজন মন্ত্রী ছিলেন। শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর পর মানবদেবের হ্রস্ব রাজত্বকালে মন্ত্রীদের মধ্যে প্রাধান্য লইয়া যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হইয়াছিল, কোদণ্ড মিশ্র তাহাতে জয়ী হইতে পারেন নাই; কুটিলতার যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া তিনি রাজসভা ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং এই নিভৃত দীন পল্লীতে আসিয়া বাস করিতেছিলেন।

তারপর ভাস্করবর্মা আসিয়া রাজ্য গ্রাস করিলেন; বিজয়ী মন্ত্রীরা নূতন রাজার কোপানলে ভস্মীভূত হইলেন। কেবল কোদণ্ড মিশ্র বাঁচিয়া গেলেন; ভাস্করবর্মা অবজ্ঞাভরে এই স্বয়ং নির্বাসিত মন্ত্রীকে গ্রাহ্য করিলেন না।

তদবধি বিশ বৎসর ধরিয়া কোদণ্ড মিশ্র নূতন রাজবংশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছেন। চাণক্য যেমন নন্দ বংশ ধবংস করিয়াছিলেন, তিনিও তেমনি বর্ম বংশ শেষ না করিয়া ছাড়িবেন না। ভাস্করবর্মার রাজ্যকালে তিনি সুবিধা করিতে পারেন নাই; কিন্তু এখন অগ্নিবর্মাকে পাইয়া আশা হইয়াছে শীঘ্রই তাঁহার চক্রান্ত ফলবান হইবে। সমস্তই প্রস্তুত, কেবল একটি বাধা; অগ্নিবর্মার পরিবর্তে সিংহাসনে বসিতে পারে এমন যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যাইতেছে না।

কোদণ্ড মিশ্রের বয়স এখন সত্তর। অস্থিচর্মসার ব্রাহ্মণ; তাঁহার জীবনে আর কোনও কাম্য নাই, স্বনির্বাচিত রাজাকে গৌড়ের সিংহাসনে বসাইয়া নিজে মন্ত্রিত্ব করিবেন এই সংকল্প লইয়া বাঁচিয়া আছেন।

আজ রাত্রে কোদন্ড মিশ্র যাহার সহিত মন্ত্রণা করিতেছেন সেই কোকবর্মা তাঁহার অপেক্ষা বয়সে অনেক ছোট। কোকবর্মার বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের অধিক নয়, কিন্তু আকৃতি দেখিয়া অধিক বয়স মনে হয়। মাংসল দেহ, কদাকার মুখে মসূরিকার চিহ্ন, চক্ষু দুটি কুঁচের মত রক্তবর্ণ। তাহার মুখ দেখিয়া ভেকের মুখ মনে পড়িয়া যায়।

কোকবর্মা গৌড়রাজ্যের একজন সেনাপতি। সে জাতিতে উগ্র, বর্ধমানভুক্তির এক মাণ্ডলিক। উগ্রগণ তৎকালে ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচিত ছিলেন, বাহুবল ও যুদ্ধে পরাক্রমের জন্য তাঁহাদের খ্যাতি ছিল। কোকবর্মা এই উগ্রগণের পরম্পরাগত অধিনায়ক। অগ্নিবর্মার যৌবরাজ্যকালে সে তাঁহার বয়স্য ছিল, গুপ্তব্যসনে সহযোগিতা করিত। তারপর অগ্নিবর্মা সিংহাসনে আরোহণ করিলে তাঁহার কৃপায় এবং উগ্রগণের অধিনায়কত্ব হেতু সেনাপতি পদ লাভ করিয়াছিল।

কিন্তু সেনাপতির গুরু দায়িত্বের প্রতি তাহার বিন্দুমাত্র নিষ্ঠা ছিল না। সে ঘোর নীচকর্মা ও বিবেকহীন পাষণ্ড। চাটুবৃত্তি যেমন তাহার প্রকৃতিসিদ্ধ ছিল তেমনি প্রয়োজন হইলে কৃতঘ্নতা করিতেও সে পশ্চাৎপদ ছিল না।

রানী শিখরিণীকে যেদিন সে প্রথম দেখিল সেদিন তাহার অন্তরে কদর্য লালসা উদ্রিক্ত হইয়াছিল। সেইদিন হইতে সে মনে মনে রাজার শত্রু হইয়াছিল।

রানী শিখরিণী তখন গুপ্ত প্রণয়লীলা আরম্ভ করিয়াছেন। সুতরাং কোকবর্মার আশা জন্মিল সেও বঞ্চিত হইবে না; সে দূতীর হস্তে রানীকে লিপি পাঠাইতে আরম্ভ করিল। কিন্তু কোনও ফল হইল না; রানী তাহার ন্যায় কুৎসিত পুরুষকে অনুগ্রহ করিতে সম্মত হইলেন না। কোকবর্মা অনেক চেষ্টা করিয়াও লালসা চরিতার্থ করিতে পারিল না। উপরন্তু তাহার প্রণয়পত্রগুলি রানীর হস্তে মারাত্মক অস্ত্র হইয়া রহিল।

এইভাবে ব্যর্থ ও লাঞ্ছিত হইয়া কোকবর্মার লিপ্সা আরও তীব্র হইয়া উঠিল। ছলে বলে যেমন করিয়া হোক রানীকে বশে আনিতে হইবে। কিন্তু শিখরিণী যতদিন রানীর পদে প্রতিষ্ঠিত আছে ততদিন তাহাকে লাভের আশা নাই। ধীরে ধীরে কোকবর্মা কোদণ্ড মিশ্রের ষড়যন্ত্র জালে জড়িত হইয়া পড়িল।

বর্তমানে কোকবর্মা ও কোদণ্ড মিশ্রের মধ্যে যে আলোচনা হইতেছে তাহা নূতন নয়, পূর্বে বহুবার হইয়া গিয়াছে। কোদণ্ড মিশ্র বলিতেছেন— ‘কোকবর্মা, তুমি রাজা হও। এমন সুযোগ আর পাবে না।’

কোকবর্মা ভেকমুণ্ড নাড়িয়া বলিল— ‘রাজা হতে চাই না, আমি শুধু রানীকে চাই।’

কোদণ্ড মিশ্র বলিলেন— ‘মূর্খ! রাজ্য পেলে সেই সঙ্গে রানীকেও পাবে। — দেখ, এখন কর্ণসুবর্ণে তোমার দু’হাজার উগ্র ছাড়া আর কোনও সৈন্য নেই, অন্য সব সেনাপতি সৈন্য নিয়ে দণ্ডভুক্তির সীমানা রক্ষা করছে, জয়নাগকে ঠেকিয়ে রেখেছে। এই সুযোগে তুমি সিংহাসনে বসলে কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারবে না।’

কোকবর্মা দ্রংষ্ট্রাবহুল হাসিয়া বলিল— ‘ঠাকুর, আপনার কথা শুনতে ভাল। কিন্তু এখন গৌড়ের সিংহাসনে বসা আর শূলে বসা একই কথা। জয়নাগ অতি ধূর্ত এবং কুটিল, সে একদিন না একদিন গৌড়রাজ্য গ্রাস করবেই।’

কোদণ্ড মিশ্র বলিলেন— ‘আমিও ধূর্ত এবং কুটিল, আমি কৌটিল্যের শিষ্য। আমি যতদিন মন্ত্রী আছি ততদিন জয়নাগ গৌড়ে দন্তস্ফুট করতে পারবে না।’

কোকবর্মা রূঢ়ভাবে বলিল— ‘কিন্তু আপনি আর কতদিন?— তারপর? আমার এখনও অনেকদিন বেঁচে থাকবার ইচ্ছা আছে, জীবন সম্ভোগ আমার পূর্ণ হয়নি।’

কোদণ্ড মিশ্র ক্রোধ দমন করিয়া বলিলেন— ‘তুমি অদূরদর্শীর মত কথা বলছ। রাজার মত জীবন সম্ভোগের সুযোগ আর কার আছে? আজ তুমি রানী শিখরিণীর জন্য লালায়িত, কাল তার প্রতি তোমার অরুচি হবে; নূতন সম্ভোগতৃষ্ণা জাগবে। এ সুযোগ ছেড় না কোকবর্মা। মানুষের জীবনে এমন সুযোগ একবারই আসে। সমস্ত প্রস্তুত। অগ্নিবর্মার অন্তরঙ্গ অর্জুনসেন তাকে মদন-রস খাইয়ে উন্মত্ত করে রেখেছে, আমার সঙ্কেত পেলেই তাকে বিষ খাওয়াবে। তুমি ইচ্ছা করলে কালই গৌড়ের রাজা হতে পার।’

কোকবর্মা কিন্তু ভিজিবার পাত্র নয়, দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘ঐটি হবে না। আমি অগ্নিবর্মাকে সিংহাসন থেকে নামাতে রাজী আছি, তার সিংহাসনে বসতে রাজী নই। আমার শেষ কথা শুনুন। অগ্নিবর্মার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয়, আমি আমার সৈন্য নিয়ে রাজপুরী দখল করব; রাজপুরীতে যা ধনরত্ন আছে লুঠ করব, রানীকে লুঠ করব, তারপর নিজের মণ্ডলে ফিরে যাব। ইতিমধ্যে আপনার যাকে ইচ্ছা রাজা করুন আমার আপত্তি নেই।’

কোদণ্ড মিশ্র হতাশভাবে বলিলেন— ‘কিন্তু রাজা পাব কোথায়? কে এমন আছে যাকে দেশের লোক রাজা বলে মেনে নেবে? সেনাপতিরা যাকে স্বীকার করবে? আজ যদি শশাঙ্কদেবের একটা বংশধর থাকত—’

শশাঙ্কদেবের বংশধর তখন ঠিক দ্বারের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। বদ্ধ দ্বারে টোকা পড়িল। কোকবর্মা চমকিয়া তরবারির উপর হাত রাখিল; কোদণ্ড মিশ্রও শঙ্কিতভাবে দ্বারের পানে চাহিল। তখন দ্বারে আবার করাঘাত পড়িল এবং আয়ি বুড়ির স্বর আসিল— ‘ঠাকুর, জেগে নাকি গো? একবার দোর খুলবে? আমি গঙ্গার আয়ি।’

কোদণ্ড মিশ্র অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন কিন্তু তাঁহার শঙ্কা সম্পূর্ণ দূর হইল না। কোকবর্মাকে তিনি নীরব অঙ্গুলি সঙ্কেতে ঘরের একটি কোণ দেখাইয়া দিলেন। কোণে দড়ি হইতে একটি কাপড় শুকাইতেছিল, কোকবর্মা তাহার পিছনে গিয়া লুকাইল। কোদণ্ড মিশ্র তখন দীপ হস্তে উঠিলেন, দ্বার খুলিয়া দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইলেন, বিরক্ত স্বরে বলিলেন— ‘এত রাত্রে তোমার আবার কী চাই গঙ্গার আয়ি?’

কিন্তু আয়ি বুড়িকে উত্তর দিতে হইল না, তৎপূর্বেই কোদণ্ড মিশ্রের দৃষ্টি বজ্রের উপর পড়িল। তিনি দ্রুত নিশ্বাস টানিয়া বলিয়া উঠিলেন— ‘কে? কে? কে তুমি?’

বজ্র এতক্ষণ আলোক চক্রের কিনারায় দাঁড়াইয়া ছিল, এখন কোদণ্ড মিশ্রের সম্মুখে আসিয়া শান্তস্বরে বলিল— ‘আপনি আর্য কোদণ্ড মিশ্র? শশাঙ্কদেবের মন্ত্রী ছিলেন?’

কোদণ্ড মিশ্র স্খলিত স্বরে বলিলেন— ‘হাঁ। তুমি—?’

বজ্র যুক্তকরে প্রণাম করিয়া বলিল— ‘আমার নাম বজ্রদেব।’

‘বজ্রদেব! তুমি কি—! না না, এখন কিছু বোলো না। এস, আমার ঘরে এস।’

কোদণ্ড মিশ্র হাত ধরিয়া বজ্রকে ঘরের মধ্যে টানিয়া লইলেন এবং দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। আয়ি বুড়ি কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর আপন মনে বিজ্‌বিজ্‌ করিয়া বকিতে বকিতে নিজ গৃহে ফিরিয়া গেল।

ঘরের মধ্যে কোদণ্ড মিশ্র কম্পিত হস্তে দীপদণ্ডে প্রদীপ রাখিলেন, দীর্ঘকাল সম্মোহিতের ন্যায় বজ্রের পানে চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন— ‘যদি বিশ বছর কেটে না যেত, বলতাম তুমি মানবদেব।’

বজ্র বলিল— ‘মানবদেব আমার পিতা।’

‘বৎস, উপবিষ্ট হও। তুমি দৈব প্রেরিত হয়ে এসেছ। তোমার নাম বজ্রদেব। বজ্রের মতই আমি তোমাকে ব্যবহার করব।’

উভয়ে উপবিষ্ট হইলেন। এতক্ষণে কোকবর্মা বস্ত্রের অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া আসিল। বজ্রকে কুটিল নেত্রে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল— ‘এ কে?’

কোদণ্ড মিশ্র উদ্দীপ্ত চক্ষে বলিলেন— ‘মানবদেবের পুত্র বজ্রদেব! কোকবর্মা, এতদিনে রাজা পাওয়া গেছে।’

কোকবর্মা বজ্রের প্রতি তির্যক কটাক্ষপাত করিয়া বলিল— ‘মানবদেবের পুত্র! মানবদেবের পুত্র ছিল না। হতে পারে এ ব্যক্তি তার দাসীপুত্র।’

বজ্র কোকবর্মার পানে চক্ষু তুলিল, স্থির দৃষ্টিতে তাহাকে বিদ্ধ করিয়া ধীর স্বরে কহিল— ‘আমার পিতার সঙ্গে আমার মাতার বিবাহ হয়েছিল।’

কোকবর্মা আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, কোদণ্ড মিশ্র বাধা দিয়া বলিলেন— ‘ও প্রসঙ্গ অবান্তর। তুমি নিঃসন্দেহে মানবদেবের পুত্র। শুধু তোমার আকৃতি নয়, তোমার বাহুর অঙ্গদ তার সাক্ষী। ও অঙ্গদ আমি চিনি। কর্ণসুবর্ণে এমন অনেক প্রাচীন লোক আছে যারা তোমাকে মানবদেবের পুত্র বলে চিনতে পারবে। আমাদের পক্ষে তাই যথেষ্ট। শশাঙ্কদেবের পৌত্রকে সিংহাসনে বসালে গৌড়দেশে কেউ আপত্তি করবে না।’

কোকবর্মা ঈষৎ মুখ-বিকৃতি করিয়া বলিল— ‘যাক রাষ্ট্রবিপ্লবের তাহলে আর কোনও বাধা নেই!’

কোদণ্ড মিশ্র বলিলেন— ‘না, আর বাধা নেই। কোকবর্মা, তুমি আজ ফিরে যাও। তোমার সৈন্যদের প্রস্তুত রেখো। ঠিক সময়ে আমি তোমাকে সংবাদ পাঠাব।’

‘ভাল। আমার পণ মনে আছে?’

‘আছে। তুমি যা চাও তাই পাবে! তোমার বাহুবলই নির্ভর।’

কোকবর্মা বিদায় লইল। খেয়াঘাটের অন্ধকারে তাহার ডিঙি বাঁধা ছিল। কোকবর্মা যাইবার সময় বজ্রের সুঠাম সুন্দর দেহের প্রতি একটা সামর্ষ ঈর্ষাবঙ্কিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গেল। সুদর্শন পুরুষ সে সহ্য করিতে পারিত না।

সে-রাত্রে বজ্র ও কোদণ্ড মিশ্র শয্যাগ্রহণ করিলেন না; প্রদীপের দুই পাশে বসিয়া সমস্ত রাত্রি কথা হইল। কোদণ্ড মিশ্র মাঝে মাঝে উঠিয়া প্রদীপের তৈল পূর্ণ করিয়া দিতে লাগিলেন।

বজ্র আপন জীবন-বৃত্তান্ত বলিল; গ্রামের জীবন, গ্রাম হইতে যাত্রা, শীলভদ্রের সহিত সাক্ষাৎ, কর্ণসুবর্ণে বাস, বহিত্রে অপহরণের দুশ্চেষ্টা, সমস্তই বিবৃত করিল। অপরপক্ষে কোদণ্ড মিশ্র তাঁহার বিংশবর্ষব্যাপী ষড়যন্ত্রের কাহিনী ব্যক্ত করিলেন। অবজ্ঞা, দৈন্য, বিফলতা তাঁহার সংকল্প টলাইতে পারে নাই। এতদিনে নিয়তির চক্র ঘুরিয়াছে, বর্মবংশের উচ্ছেদ করিয়া শশাঙ্কদেবের বংশধরকে গৌড়ের সিংহাসনে বসাইয়া তিনি ব্রত উদ্‌যাপন করিবেন।

বজ্র বৃদ্ধের আশা আকাঙক্ষার কথা শুনিল, কোনও আপত্তি করিল না। কাল প্রাতে সে যে গ্রামে ফিরিয়া যাইতে মনস্থ করিয়াছিল তাহা আর তাহার মনে রহিল না।

বাহিরে কাক কোকিলের ডাক শুনিয়া তাঁহাদের চৈতন্য হইল, রাত্রি শেষ হইয়াছে। কোদন্ড মিশ্র বজ্রের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘বৎস, যতদিন না রাজপুরী অধিকৃত হয় তুমি এখানেই থাক, কর্ণসুবর্ণে ফিরে যাবার প্রয়োজন নেই। আমার অনেক কাজ, অনেক লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে, কর্ণসুবর্ণে যেতে হবে। আমি গঙ্গার আয়িকে বলে দেব, সে তোমার সেবা-যত্ন করবে।’

বজ্র কুটিরের বাহিরে আসিয়া দেখিল, সম্মুখেই বিপুল-বিস্তার ভাগীরথী। পরপারের আকাশে সিন্দূরের রঙ ধরিয়াছে, এখনও সূর্যোদয় হয় নাই। স্রোতের মাঝখান দিয়া একটি হাঙ্গর-মুখ বহিত্র ভাসিয়া যাইতেছে, তাহার পিছনে আরও কয়েকটি বহিত্র। তাহারা সাগরে যাইতেছে।

বহিত্রগুলির পট্টপত্তনের উপর মানুষের চলাফেরা দেখা যাইতেছে। নাবিকেরা পাল তুলিতেছে; গুণবৃক্ষের শীর্ষে আড়কাঠের উপর বসিয়া দিশারু দিঙ্‌নির্ণয় করিতেছে।

বজ্র হাঙ্গর-মুখ বহিত্রটিকে চিনিল। কিন্তু উহার খোলের মধ্যে যে বিম্বাধর ও বটেশ্বর বন্দী আছে তাহা জানিতে পারিল না।