দশম পরিচ্ছেদ – শবরের আতিথ্য
বনের অভ্যন্তর সর্বত্র সমতল নয়, কোথাও কোথাও বৃহৎ পাথরের স্তূপ মাটি ঠেলিয়া মাথা তুলিয়াছে। দূর হইতে দেখিলে মনে হয়, বহু পুরাকালে একদল দৈত্য কালো কালো পাথর সংগ্রহ করিয়া দুর্গরচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিল, তারপর কি কারণে পাথরগুলাকে হুণ্ডমুণ্ড ফেলিয়া চলিয়া গিয়াছে। এইরূপ একটি প্রস্তরস্তূপের মধ্যে কচ্ছুর নির্জন গুহাগৃহ। এখানে অন্য কোনও মানুষের বসতি নাই।
শুষ্ক শিলাকীর্ণ ভূমি, কিন্তু পাষাণপুঞ্জের ভিতর হইতে জলের একটি ক্ষীণ প্রস্রবণ নির্গত হইয়াছে। এই জলধারার দুই পাশে একটু হরিদাভা, দুই চারিটি গাছ। গাছগুলি বন্য গাছ নয়; বন এই স্থানটিকে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া আছে কিন্তু শিলাব্যূহ ভেদ করিতে পারে নাই। যে গাছগুলি জলধারার পাশে জন্মিয়াছে সেগুলি ফলের গাছ; কদলী, জাম্বুরা, কামরাঙা, ডালিম, শ্রীফল। তাছাড়া ওষধি জাতীয় উদ্ভিদ ও কন্দ আছে, শিম্বি ও পুতিকা লতা আছে। এগুলি কচ্ছুর দুই বধূ রত্তি ও মিত্তির দ্বারা লালিত।
রত্তি ও মিত্তি দুই সতীন, কিন্তু দু’জনের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য ভালবাসা। দেখিতেও দুটিকে প্রায় একরকম, যেন একজোড়া সুঠাম সুন্দর হরিণশিশু। কৃষ্ণসারের ন্যায় আয়ত কোমল চক্ষু, অজিনের ন্যায় উজ্জ্বল কৃষ্ণ দেহবর্ণ; দেহে অটুট নিটোল যৌবন। বেশবাসও এক প্রকার; কটিতটে বল্কলের আচ্ছাদন, বক্ষ নিরাবরণ, গলায় গুঞ্জার মালা, চুলে সিন্দূরবর্ণ বনকুসুমের নর্মভূষা।
সেদিন প্রদোষকালে রত্তি ও মিত্তি গুহার সম্মুখে জলপ্রণালীর বহমান ধারায় পা ডুবাইয়া বসিয়া ছিল। আকাশে শুক্লপক্ষের আধখানা চাঁদ ফুটি ফুটি করিতেছে; দিনের শব্দ থামিয়া গিয়াছে, রাত্রির শব্দ এখনও আরম্ভ হয় নাই। দুই শবর যুবতী নীড়ের পাখির মত অস্ফুট ভাষণে দুটি একটি কথা বলিতেছিল, কিন্তু তাহাদের চক্ষু ঘুরিয়া ফিরিয়া বনের কিনারায় সঞ্চরণ করিতেছিল। কচ্ছুর ফিরিবার সময় হইয়াছে।
বনের ভিতরে চুচুর ডাক শুনা গেল। কিন্তু চুচুর ডাক স্বাভাবিক নয়, তাহাতে উত্তেজনা ও আতঙ্কের সঙ্কেত মিশ্রিত রহিয়াছে। রত্তি ও মিত্তি চকিত সশঙ্ক দৃষ্টি বিনিময় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, বনের আড়াল হইতে চুচু তীরবেগে বাহির হইয়া আসিল। তাহার পশ্চাতে এক দীর্ঘকায় গৌরকান্তি যুবক কচ্ছুকে কাঁধে লইয়া ছুটিয়া আসিতেছে।
চুচু ছুটিতে ছুটিতে রত্তি ও মিত্তিকে দেখিয়া আবার উচ্চকণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল। মিত্তি রত্তির হাত চাপিয়া ধরিয়া দ্রুতনিম্নকণ্ঠে বলিল— ‘সাপ! জাত সাপ।’
বজ্র যখন কচ্ছুকে পয়ঃপ্রণালীর পাশে নামাইল তখন কচ্ছুর জ্ঞান নাই। বজ্রও এই এক ক্রোশ কণ্টাকাকীর্ণ শিলাকর্কশভূমি কচ্ছুকে বহন করিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে, পথে কোথাও বিশ্রাম করে নাই; তাহার সংজ্ঞাও লুপ্তপ্রায়। সে কচ্ছুর পাশে বসিয়া পড়িয়া শুষ্ক তালু হইতে কোনও প্রকারে শব্দ উচ্চারণ করিল— ‘সাপ— সাপে কামড়েছে।’
এ সংবাদ রত্তি মিত্তির কাছে নূতন নয়, চুচুর ডাক হইতে পূর্বেই তাহারা জানিয়াছিল। কুকুরের ডাক শবর-শবরীর কাছে যে বার্তা বহন করে সভ্য মানুষের কাছে তাহা দুর্বোধ্য।
রত্তি ও মিত্তি বৃথা বিলাপ করিল না, বজ্রের পানেও ফিরিয়া চাহিল না; নিঃশব্দ ক্ষিপ্রতার সহিত কচ্ছুর পরিচর্যা আরম্ভ করিল। কচ্ছুর চোখের পাতা তুলিয়া দেখিল, পায়ের অঙ্গুষ্ঠে সাপের দাঁতের দাগ পরীক্ষা করিল, ধরাধরি করিয়া তাহাকে পয়ঃপ্রণালীর অগভীর জলে শোয়াইয়া দিল। তারপর মিত্তি হরিণীর মত ছুটিয়া একদিকে চলিয়া গেল।
ইতিমধ্যে দিনের দীপ্তি নিঃশেষ হইয়াছে, চাঁদের আলো ফুটিয়াছে। রত্তি অন্তর্জলশয়ান কচ্ছুর পা হইতে ধনুকের ছিলা খুলিয়া ফেলিল, কচ্ছুর অঙ্গুষ্ঠে অধর সংযুক্ত করিয়া রক্ত-মোক্ষণ করিতে লাগিল। কচ্ছু নড়িল না, অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিল।
মিত্তি ফিরিয়া আসিল, তাহার হাতে কয়েকটা লতাপাতা ও শিকড় বাকড়। সে রত্তিকে ডাক দিয়া গুহায় প্রবেশ করিল এবং আগুন জ্বালিতে প্রবৃত্ত হইল। গুহার এক কোণে ভস্মাচ্ছাদনের অন্তরালে অঙ্গার ছিল, মিত্তি ফুঁ দিয়া তাহা জ্বালাইয়া তুলিল। রত্তি কচ্ছুর দেহ অবলীলাক্রমে জল হইতে তুলিয়া লইয়া গুহায় প্রবেশ করিল।
বজ্র বাহিরে বসিয়া দেখিতে লাগিল। আজ সমস্ত দিনের অন্যভস্ত পরিশ্রমে তাহার বজ্রকঠিন দেহও গুঁড়া হইয়া গিয়াছে। কচ্ছুর প্রাণ বাঁচাইবার জন্য যেটুকু তাহার সাধ্য তাহা সে করিয়াছে; কিন্তু সে সাপের মন্ত্রৌষধি জানে না, আর কি করিতে পারে? এখন কচ্ছুর ভাগ্য, আর রত্তি-মিত্তির গূঢ়বিদ্যার শক্তি। বজ্র জলস্রোতের পাশে অবনত হইয়া অঞ্জলি অঞ্জলি জল পান করিল, তারপর শিলাপট্টের উপর শয়ন করিল।
গুহার মধ্যে কচ্ছুর মুষ্টিযোগ আরম্ভ হইয়াছে। মিত্তি পাতা ও শিকড় চিবাইয়া অঙ্গুষ্ঠে বাঁধিয়া দিয়াছে, রত্তি ময়ূরের পালক আগুনে পুড়াইয়া কচ্ছুর নাকের কাছে ধরিতেছে। আর সেই সঙ্গে উভয়ে অস্ফুটকণ্ঠে অবিশ্রাম মন্ত্র আবৃত্তি করিয়া চলিয়াছে।
এই দৃশ্য গুহামুখ হইতে দেখিতে দেখিতে বজ্র ঘুমাইয়া পড়িল।
বনপ্রান্তে এক পাল শৃগালের যাম-ঘোষণার শব্দে বজ্র জাগিয়া উঠিল। রাত্রির মধ্যযাম। চন্দ্র অস্ত যাইতেছে।
গুহার মধ্যে রক্তাভ আগুন জ্বলিতেছে। বজ্র উঠিয়া গিয়া দেখিল কচ্ছু তেমনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়িয়া আছে, রত্তি ও মিত্তি তাহার দুই পাশে বসিয়া সর্বাঙ্গে হাত বুলাইতেছে ও গূঢ়স্বরে মন্ত্র পড়িতেছে। বজ্র জিজ্ঞাসু নেত্রে রত্তি ও মিত্তির পানে চাহিল; কিন্তু তাহাদের মুখের ভাব তন্ময় সমাহিত। বজ্র প্রশ্ন করিতে পারিল না, কিছুর জীবনের আশা আছে কিনা? সে বাহিরে আসিয়া আবার শয়ন করিল।
এবার যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল তখন চারিদিকে পাখির কলরব, সূর্যোদয় হইতেছে। বজ্র চক্ষু মেলিয়া দেখিল, রত্তি ও মিত্তি তাহার শিয়রে দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের নিকষ অঙ্গে নবারুণের সোনালী কষ লাগিয়াছে; চোখে মুখে ক্লান্তির জড়িমা। রত্তির হাতে পত্রপুটে হরিণের মাংস, মিত্তির দুই হাতে দুটি পাকা ডালিম।
ধড়মড় করিয়া বজ্র উঠিয়া বসিল— ‘কচ্ছু—?’
উভয়ে ক্লান্তিশিথিল কণ্ঠে হাসিল।
‘বাঁচ্বে।’
বজ্র দ্রুত উঠিয়া গুহায় প্রবেশ করিল। দেখিল, কচ্ছুর জ্ঞান হইয়াছে, সে শুইয়া শুইয়া মিটিমিটি চাহিতেছে। এই এক রাত্রে তাহার দেহ শুকাইয়া প্রেতাকৃতি হইয়া গিয়াছে; গালের চর্ম কুঞ্চিত, চক্ষু কোটরগত। বজ্র তাহার পাশে নতজানু হইয়া আনন্দবিগলিত স্বরে ডাকিল— ‘কচ্ছু!’
কচ্ছু শীর্ণ কম্পমান হাত দুটি তুলিয়া বজ্রের গলা জড়াইয়া লইল, স্খলিতস্বরে বলিল — ‘ভাই, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’
বজ্র বলিল— ‘না, না, তোমার বৌরা তোমাকে বাঁচিয়েছে।’
রত্তি ও মিত্তি বজ্রের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহাদের পানে চোখ তুলিয়া কচ্ছু ক্ষীণ হাসিল— ‘তুমি কাঁধে তুলে এনেছিলে তাই ওরা বাঁচাতে পারল। কাল থেকে তোমার কিছু খাওয়া হয়নি, আমি অতিথির সেবা করতে পারলাম না। রত্তি! মিত্তি!’
রত্তি ও মিত্তি হরিণের মাংস ও ডালিম বজ্রের সম্মুখে রাখিল। কচ্ছু বলিল— ‘খাও ভাই, আমি দেখি।’
বজ্রের যথেষ্ট ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল, সে খাইতে বসিল। রত্তি ও মিত্তি নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কি কথা বলিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। বজ্র খাইতে খাইতে কচ্ছুর প্রতি স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তাহার মনে হইল কচ্ছু যেন তাহার কতদিনের পুরানো বন্ধু; কচ্ছু যমের মুখ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে এই তৃপ্তিতে তাহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিল।
আহার শেষে বজ্র বাহিরে গিয়া জল পান করিল। বাহিরে কিন্তু রত্তি মিত্তিকে দেখিতে পাইল না। সে ফিরিয়া আসিয়া কচ্ছুর কাছে বসিল, বলিল— ‘রত্তি মিত্তি কোথায় গেল? তাদের দেখলাম না।’
কচ্ছু বলিল— ‘বোধহয় জঙ্গলে গেছে শিকারের খোঁজে। কাল আমি কিছু মেরে আনতে পারলাম না—’
বজ্র তখন কচ্ছুর বুকের উপর হাত রাখিয়া বলিল— ‘ভাই, আজ তবে আমি যাই। আমাকে কানসোনা যেতে হবে। অনেক দূরের পথ।’
কচ্ছু তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কাতর স্বরে বলিল— ‘বন্ধু, আজকের দিনটা থাকো, যদি যেতেই হয় কাল যেও। আমি তোমার সেবা করতে পারলাম না, আমার বৌরা তোমার সেবা করুক। আমাদের সেবা না নিয়ে যদি চলে যাও, তাহলে— তাহলে—’ কচ্ছুর অক্ষিকোটর জলে ভরিয়া উঠিল।
‘ভাল, কালই যাব।’ বজ্র নির্বন্ধ করিল না। তাহার হাত-পা এখনও আড়ষ্ট হইয়া আছে, গায়ের ব্যথা মরে নাই। একদিনের বিলম্বে কী ক্ষতি হইবে?
দ্বিপ্রহরে রত্তি ও মিত্তি ফিরিয়া আসিল, সঙ্গে কয়েকটা নধর বন্য কুক্কুট। তাহারা বনে ফাঁদ পাতিয়া আহার্য সংগ্রহ করিয়াছে।
অতঃপর কুঁকুড়ার মাংস রন্ধন হইলে সকলে একসঙ্গে আহারে বসিল। বজ্র একাই দুইটা কুঁকুড়া উদরস্থ করিল। কচ্ছু অল্প একটু খাইল।
আহারান্তে বজ্র কচ্ছুর পাশে লম্বা হইল। রত্তি ও মিত্তি তাহার দুই প্রান্তে আসিয়া বসিল; মিত্তি পা টিপিতে আরম্ভ করিল, রত্তি মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। বজ্র একটু আপত্তি করিল কিন্তু তাহারা শুনিল না। তখন বজ্র পরম আরামে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইল। রত্তি ও মিত্তি রাত্রে ঘুমায় নাই, তাহারাও অল্পকাল মধ্যে বজ্রের দুই প্রান্তে ঢুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িল।
অপরাহ্ণে বজ্র যখন জাগিয়া উঠিল তখন তাহার দেহের সমস্ত গ্লানি দূর হইয়াছে। কচ্ছুও শরীরে অনেকটা বল পাইয়াছে এবং নিজের চেষ্টায় উঠিয়া বসিয়াছে। তিনজনে ধরাধরি করিয়া তাহাকে গুহার বাহিরে প্রস্তরপট্টের উপর বসাইয়া দিল। পশ্চিমে সূর্য তখন বনানীর শীর্ষ স্পর্শ করিয়াছে।
কচ্ছুর দুই পাশে তাহার দুই স্ত্রী গা ঘেঁষিয়া বসিল; বজ্র তাহাদের সম্মুখে কিছুদূরে বসিল। সকলের মুখেই প্রীতি-গদ্গদ হাসি। তাঁহাদের দেখিয়া বজ্র ভাবিতে লাগিল, কী মধুর ইহাদের জীবন! এই তিনটি আদিম নরনারীর মধ্যে কি নিবিড় ভালবাসা! ঈর্ষা নাই, স্বার্থপরতা নাই, ক্ষুদ্রতা নাই, আছে শুধু অফুরন্ত প্রাণের প্রাচুর্য!
রত্তি ও মিত্তি কচ্ছুর কানের কাছে গুন্গুন্ করিয়া গান গাহিতে লাগিল। গানের কথাগুলি তেমন স্পষ্ট নয়, কিন্তু ভাঙ্গা ভাঙ্গা জংলা সুর কখনও স্নেহে আর্দ্র, কখনও চটুল হাসিতে লুটাইয়া পড়িতেছে। কচ্ছুর নবজীবন লাভে তাহারা কত সুখী হইয়াছে তাহাই যেন তাহাদের কণ্ঠের কাকলিতে প্রকাশ পাইল। গান শেষ হইলে তাহারা কচ্ছুর দুই কাঁধে মাথা রাখিয়া নীরব রহিল।
শবর-শবরীদের এই অকুণ্ঠ প্রণয়লীলা দেখিয়া বজ্র একটু লজ্জা পাইল, কিন্তু মনে মনে মুগ্ধও হইল। ইহারা যেন পাখির জাত। লজ্জা জানে না।
ক্রমে সন্ধ্যার ছায়া নামিয়া আসিল। কচ্ছু তখন বজ্রকে সম্বোধন করিয়া বলিল— ‘ভাই, কাল সকালে তুমি চলে যাবে। তুমি শুধু আমাদের অতিথি নয়, আমার প্রাণদাতা। আমি বনের মানুষ, কি দিয়ে তোমার পূজা করব? আমার দুই বৌ আছে, এদের মধ্যে যাকে তোমার ভাল লাগে তাকে তুমি নাও, আজ রাত্রির জন্যে সে তোমার বৌ—’
কচ্ছুর ইঙ্গিতে রত্তি ও মিত্তি আসিয়া বজ্রের সম্মুখে বসিল এবং তাহার মুখের কাছে মুখ আনিয়া মধুর হাস্য করিল। তাহাদের সরল মুখে মলিনতার চিহ্নমাত্র নাই, তাহাদের সহজ প্রীতি তাহারা অর্পণ করিতে চায়, বন্ধুজনকে প্রীত করিতে চায়।
বজ্র ক্ষণেক হতভম্ব হইয়া রহিল, তারপর উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। রত্তি ও মিত্তির হাত ধরিয়া তুলিয়া তাহাদের কচ্ছুর পাশে বসাইয়া দিয়া বলিল— ‘কচ্ছু, তোমার বৌ তোমারই থাক, আমার দরকার নেই।’
কচ্ছু আহতস্বরে বলিল— ‘ওদের কাউকে ভাল লাগে না?’
‘দু’জনকেই ভাল লাগে। ওদের তুলনা নেই। কিন্তু—’
বজ্র কচ্ছুর সম্মুখে বসিল। গুঞ্জার মুখ তাহার চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল; আবেগমথিত মুখ, তীব্র প্রেমতৃষ্ণাভরা চোখ দুটি। বজ্র গাঢ়স্বরে বলিল— ‘আমার বৌ আছে। তাকে গ্রামে রেখে এসেছি। অন্য বৌ আমার দরকার নেই।’
বজ্রের বৌ আছে শুনিয়া রত্তি ও মিত্তি কৌতুক-কৌতূহলী চক্ষে চাহিল। কচ্ছু কিন্তু বড় নিরাশ ও মনঃক্ষুণ্ণ হইল।
পরদিন প্রাতঃকালে বজ্র কচ্ছুর নিকট বিদায় লইল। কচ্ছু আজ বেশ সুস্থ হইয়াছে কিন্তু বেশি দূর পথ হাঁটিতে পারিবে না। তাই রত্তি ও মিত্তি বজ্রকে পথ দেখাইয়া বনের প্রান্তে রাজপথ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া আসিবে।
কচ্ছু বজ্রকে আলিঙ্গন করিয়া বলিল— ‘বন্ধু, তোমার সঙ্গে আর বোধহয় কখনও দেখা হব না। আমি বনের মানুষ, তুমি লোকালয়ের মানুষ। কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকব তোমাকে ভুলব না! তুমিও আমাদের ভুল না। যদি কোনও দিন দরকার হয়, মনে রেখো এই জঙ্গলে তোমার তিনজন বন্ধু আছে।’
কচ্ছু গুহাদ্ধারে চুচুকে লইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, বজ্র বাহির হইয়া পড়িল। এইখানেই বলিয়া রাখা ভাল যে বজ্রের সহিত এই শবরদম্পতির ইহজীবনে আর সাক্ষাৎ হয় নাই।
বজ্রকে লইয়া রত্তি ও মিত্তি পূর্বদিকে চলিল। আবার বন আরম্ভ হইল; তেমনি প্রদোষছায়াচ্ছন্ন ঘন বনানী। তাহার মধ্যে দুই চঞ্চলা শবরযুবতী অভ্রান্তভাবে পথ চিনিয়া চলিল।
প্রায় দুই ঘটিকা চলিবার পর তাহারা এক রাজপথে আসিয়া উপনীত হইল। উত্তর দক্ষিণে পথ, তাহার অপর পারে কলোর্মি-চঞ্চলা ভাগীরথী। এই রাজপথের উল্লেখ পূর্বে করিয়াছি, উত্তরে মহাকোশল হইতে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত ইহা ভুজঙ্গের ন্যায় বক্ররেখায় পড়িয়া আছে।
রত্তি বজ্রের হাতে একটি লতা দিয়া বাঁধা পাতার মোড়ক দিল, বলিল— ‘খাবার আছে— খেও। এবার ঐদিকে চলে যাও, কানসোনায় পৌঁছবে।’ ‘আচ্ছা।’
রত্তি ও মিত্তির মুখে এক ঝলক মিষ্ট হাসি খেলিয়া গেল। তারপর তাহারা দুইটি বিচিত্র নীল প্রজাপতির ন্যায় আবার বনের মধ্যে মিলাইয়া গেল।