গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

শঙ্খ-কঙ্কণ

শঙ্খ-কঙ্কণ

প্রথম আবর্ত – এক

দিল্লী দখল করিবার পর মুসলমান সুলতানের দীর্ঘকাল দাক্ষিণাত্যের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করেন নাই। বিন্ধ্য গিরিমালা এবং নর্মদা নদী যেন প্রাকার-পরিখা রচনা করিয়া তাঁহাদের নিরস্ত করিয়াছিল।

প্রথম প্রাকার-পরিখা লঙঘন করিলেন আলাউদ্দিন খিল্জি। তিনি পরে অন্নদাতা পিতৃব্যকে হত্যা করিয়া দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার রণপাণ্ডিত্য ছিল, আর ছিল অনির্বাণ নারীতৃষ্ণা। এই দুই মিলিয়া তাঁহার চরিত্র পিশাচতুল্য করিয়া তুলিয়াছিল। ভারতের অন্ধকার মধ্যযুগেও তাঁহার সমান বিশ্বাসঘাতক নৃশংস ইন্দ্রিয়পরায়ণ সুলতান বোধহয় বেশি ছিল না।

দাক্ষিণাত্যে প্রবেশ করিয়া আলাউদ্দিন বেশিদূর অগ্রসর হন নাই, দেবগিরির রাজ্য ছলনার দ্বারা জয় করিয়া প্রচুর ধনরত্ন লুণ্ঠনপূর্বক স্বরাজ্যে ফিরিয়া গিয়াছিলেন; তারপর পিতৃব্যকে হত্যা করিয়া দিল্লীর সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। তাঁহার অন্তঃপুরে সুন্দরী যুবতীর অভাব ছিল না, তবু তিনি গুজরাতের রানী কমলাকে কাড়িয়া আনিয়া নিজের অঙ্কশায়িনী করিয়াছিলেন।

সুন্দরী নারী, রাজরানী হোক বা পথের ভিখারিনী হোক, আলাউদ্দিনের চোখে পড়িলে আর তার নিস্তার নাই। তিনি একবার চিতোরের পদ্মিনীর দিকেও হাত বাড়াইয়াছিলেন, কিন্তু সেই জ্বলন্ত অনলশিখাকে স্পর্শ করিতে পারেন নাই। নারী-বিজয়-ক্ষেত্রে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিনের ইহাই একমাত্র ব্যর্থতা।

কিন্তু দিল্লী বহুত দূর। দিল্লী হইতে দুই শত ক্রোশ দক্ষিণে বিন্ধ্যগিরির ক্রোড়ে সাতপুরা শৈলমালার জটিল আবর্তের মধ্যে এই কাহিনীর সূত্রপাত।

দুই

সাতপুরা শৈলমালার জটিল আবর্তের মধ্যে এই সময় সাতটি ছোট ছোট রাজ্য ছিল। হয়তো সাতপুরা পর্বতের নাম এই সাতটি রাজ্য হইতে আসিয়াছে। অতি ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি; কবে তাহাদের জন্ম হইয়াছিল এবং কবে তাহারা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে ইতিহাস তাহা লক্ষ্য করে নাই। কিন্তু সুলতান আলাউদ্দিনের কালে তাহারা জীবিত ছিল এবং পরস্পরের সহিত কলহ না করিয়া পরম শান্তিতে বাস করিতেছিল। রাজ্যগুলির মাঝখানে পর্বতের ব্যবধান থাকায় লড়াই ঝগড়ার উপলক্ষ ছিল না।

একদিন ভাদ্রমাসের দ্বিপ্রহরে এক পথভ্রান্ত পথিক এই জটিলকুটিল গিরিসঙ্কটের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। আকাশে মেঘ নাই। এখানে অল্পই বৃষ্টি হয়, যেটুকু হয় পাহাড় তাহা গায়ে মাখে না; বৃষ্টির জল সহস্র প্রণালীপথে নামিয়া উপত্যকাগুলিতে সঞ্চিত হয়। এই উপত্যকাগুলিতে মানুষের বাস।

পথিক এক গুহায় রাত্রি কাটাইয়া প্রভাতে লোকালয়ের সন্ধানে বাহির হইয়াছে, কিন্তু এখনও লোকালয় খুঁজিয়া পায় নাই। সে এ অঞ্চলের মানুষ নয়, দক্ষিণ দিক হইতে আসিয়াছে। দ্বিপ্রহরের প্রচণ্ড সূর্যতাপ চারিদিকের উলঙ্গ পর্বতে প্রতিফলিত হইয়া বহ্নিকলাপের মতো জ্বলিতেছে। কিন্তু সেদিকে পথিকের ভ্রূক্ষেপ নাই।

পথিকের বয়স অনুমান বাইশ-তেইশ বছর। সুঠাম বেত্রবৎ দেহ, দেহের বর্ণও বেত্রবৎ।। মুখের গঠন খড়্গের ন্যায় শাণিত, কিন্তু মুখের ভাব শান্ত ও সহিষ্ণু। চোখের দৃষ্টি শ্যেনপক্ষীর ন্যায় সুদূরপ্রসারী, কিন্তু তাহাতে শ্যেনপক্ষীর হিংস্রতা নাই। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে; ঠোঁটের উপর অল্প গোঁফ। পরিধানে একখণ্ড বস্ত্র কটি হইতে জঙ্ঘা পর্যন্ত আবৃত করিয়াছে, দ্বিতীয় একখণ্ড বস্ত্র উত্তরীয়ের আকারে স্কন্ধের উপর ন্যস্ত! হাতে ধনু এবং তিনটি বাণ।

পথিক দুইটি শৈলের মধ্যবর্তী লম্বা খাঁজের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিল; কোথাও জনবসতির চিহ্ন নাই, যেদিকে সে চলিয়াছে সেদিকে কোথাও নির্গমনের পথ আছে কি না তাহাও দেখা যায় না। সে তখন আকাশের দিকে চোখ তুলিল।

আকাশ শূন্য, কেবল বহু ঊর্ধ্বে বায়ু-কোণে এক জোড়া নিরালম্ব গুম্ফ উড়িতেছে। চিল কিংবা শকুন; পথিক অনুমান করিল, ঐদিকে চিল যেখানে উড়িতেছে তাহার নিম্নে লোকালয় থাকিতে পারে। সে অগ্রসর হইয়া চলিল।

ক্রোশেক পথ চলিবার পর হঠাৎ পাশের দিকে পাহাড়ের গায়ে একটি সংকীর্ণ ফাটল মিলিল। উপলবিকীর্ণ নিম্নাভিমুখী রন্ধ্র, এই পথে জল বাহির হইয়া নিম্নতর স্তরে গিয়াছে। দেখা যাক। পথিক রন্ধ্রমধ্যে প্রবেশ করিল।

আঁকাবাঁকা রন্ধ্রপথে কিছু দূর চলিবার পর এক ঝলক হরিদাভা পথিকের চোখের উপর দিয়া খেলিয়া গেল। তারপর সে রন্ধ্রমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সম্মুখে ঈষৎ নিম্নভূমিতে ক্ষুদ্র একটি উপত্যকা; তাহার মাঝখানে শষ্পশয্যার উপর দর্পণের মতো জল সূর্যকিরণ প্রতিফলিত করিতেছে। এই তড়াগের চারিপাশে কয়েকটি তালবৃক্ষ শীর্ণ প্রহরীর ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে; কিছু ঝোপঝাড়ও আছে। মানুষ দেখা যাইতেছে না বটে, কিন্তু অদূরে কয়েকটি ভগ্নপ্রায় শিলাকুটির দৃষ্টিগোচর হয়।

পথিক দ্রুত জলের কিনারায় গেল, নতজানু হইয়া গণ্ডূষ ভরিয়া জল পান করিল। জলপানে শরীর স্নিগ্ধ করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। এবার কিছু খাদ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন, তাহার সঙ্গে যে সামান্য খাদ্য ছিল তাহা ফুরাইয়া গিয়াছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা অতিথিবৎসল হইয়া থাকে, খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হইবে না।

সে এদিক্-ওদিক্ চাহিয়া পাড়ের উপর নিকটতম শৈল-কুটিরের দিকে পা বাড়াইল। কুটিরের তালপাতার ছাউনি অদৃশ্য হইয়াছে, কেবল দেওয়ালগুলা দাঁড়াইয়া আছে। তবু ভিতরে নিশ্চয় মানুষ পাওয়া যাইবে।

দুই পা অগ্রসর হইয়া পথিক সহসা দাঁড়াইয়া পড়িল; দেখিল, একটি ঝোপের অভ্যন্তর হইতে জনৈক শীর্ণকায় ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়া বাহির হইতেছে। চোখাচোখি হইতেই লোকটি বলিয়া উঠিল— ‘ওহে, তোমার কাছে খাদ্যদ্রব্য কিছু আছে?’

পথিক নিকটে গেল, শীর্ণকায় লোকটি উঠিয়া দাঁড়াইল। পথিক দেখিল, লোকটির বয়স অনুমান পঞ্চাশ, বেশভূষা ভদ্র, পায়ে পাদুকা, মাথায় উষ্ণীষ। সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল— ‘আমার সঙ্গে তো খাদ্যদ্রব্য নেই, কেবল তীরধনুক আছে।’

‘তীরন্ধনুক তো খাওয়া যাবে না। হা হতোস্মি! এখন উপায়?’ বলিয়া শীর্ণ ব্যক্তি বুক চাপড়াইল। তাহার ভাবভঙ্গি ও বাচনশৈলীতে হতাশার সহিত ঈষৎ হাস্যরস মিশ্রিত আছে।

ধনুর্ধর যুবক একটু কৌতুক অনুভব করিয়া বলিল— ‘আপনি কে?’

প্রৌঢ় ব্যক্তি বলিলেন— ‘আমার নাম ভট্ট নাগেশ্বর, আমি পঞ্চমপুরের রাজা শ্রীমৎ ভূপ সিংহের বয়স্য। রাজা আমাকে গোপনীয় দূতকার্যে সপ্তমপুরে পাঠিয়েছিলেন, একাই গিয়েছিলাম। সপ্তমপুরে কাজ সেরে ফেরার পথে এখানে দুপুর হয়ে গেল; ভাবলাম, মধ্যাহ্নভোজনটা এখানে সেরে নিয়ে ঝোপঝাড়ের ছায়ায় একটু বিশ্রাম করে বেলা তৃতীয় প্রহরে আবার যাত্রা করব; তাহলে সন্ধ্যার আগেই গৃহে ফিরতে পারব। জলের ধারে গিয়ে খাবারের পুঁটুলি খুলে বসেছি, মাত্র এক গ্রাস মুখে দিয়েছি, এমন সময়— হা হতোস্মি! কোথাকার এক ম্লেচ্ছপুত্র চিল ছোঁ মেরে খাবারের পুঁটুলি নিয়ে উড়ে গেল। সেই থেকে ঝোপের ছায়ায় বসে আছি, ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে।’

যুবক বলিল— ‘কিন্তু গ্রামে লোক আছে, তাদের কাছে খাদ্য সংগ্রহ করা কি সম্ভব নয়?’

ভট্ট নাগেশ্বর চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন— ‘গ্রাম! গ্রাম কোথায়? হা হতোস্মি, বহু বৎসর আগে গ্রাম ছিল বটে, কিন্তু ম্লেচ্ছপুত্র আলাউদ্দিন সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছে। এখানে আর মানুষের বাস নেই।’

আলাউদ্দিনের নাম শুনিয়া যুবক একটু চকিত হইল। নামটা তাহার অপরিচিত নয়। সে বলিল— ‘ম্লেচ্ছপুত্র আলাউদ্দিন!’

নাগেশ্বর বলিলেন— ‘নাম শোনোনি? দিল্লীর ম্লেচ্ছ রাজা। সতেরো বছর আগে সে এই পথে দাক্ষিণাত্যে অভিযান করেছিল, তার সেনা-বাহিনীর পথে যেসব নগর জনপদ পড়েছিল সব শূন্য হয়ে গিয়েছে। পঞ্চমপুরেও এই মহাপিশুন পদার্পণ করেছিল—। কিন্তু যাক, শূন্য উদরে ম্লেচ্ছ-প্রসঙ্গ ভাল লাগে না। এস, ঝোপের ছায়ায় বসা যাক।’

যুবক বলিল— ‘কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের কী হবে?’

নাগেশ্বর বলিলেন— ‘কি আর হবে। আপাতত পেটে মুষ্ট্যাঘাত করে ক্ষুধা নিবারণ করা ছাড়া গতি নেই। — এখন তোমার পরিচয় দাও। কে তুমি, কোথায় যাচ্ছ?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়া যুবক ঊর্ধ্বে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল। একটি তালগাছের শীর্ষে কিছুক্ষণ চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল— ‘তাল পেকেছে মনে হচ্ছে।’

নাগেশ্বর বলিলেন— ‘তা পেকেছে, আমি দেখেছি। কিন্তু তাল পাকলে আমার কী? আমি তালগাছে চড়তে জানি না, তালগাছও আমার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে ফল বিসর্জন দেবে না। আমি সবগুলা তালগাছের গোড়া খুঁজে দেখেছি, একটিও তাল নেই।’

যুবক তালগাছের নিকটে গিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে করিতে বলিল— ‘তালগাছের ডগা ষাট হাতের বেশি হবে না। তাল পাড়া যেতে পারে।’

নাগেশ্বর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন— ‘পাড়া যেতে পারে। বল কি! তুমি তালগাছে উঠতে পারো নাকি?’

যুবক বলিল— ‘না, তীরধনুক দিয়ে তাল পাড়ব।’

যুবক একটি তীর বাছিয়া লইয়া বাকি দুইটি তীর মাটিতে রাখিল, ধনুকে শরযোজনা করিয়া সাবধানে লক্ষ্য স্থির করিল, আকর্ণ ধনুর্গুণ টানিয়া ঊর্ধ্বদিকে তীর ছাড়িয়া দিল। টঙ্কার শব্দে তীর ছুটিয়া গেল, মুহূর্তমধ্যে তীরবিদ্ধ পাকা তাল ধপ্ করিয়া মাটিতে পড়িল।

নাগেশ্বর ছুটিয়া গিয়া বৃহৎ তালটিকে কোলে তুলিয়া লইলেন, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিলেন— ‘চমৎকার! তুমি দেখছি অর্জুনের চেয়ে বড় ধনুর্ধর। অর্জুন মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করে পেয়েছিলেন এক নারী, আর তুমি আকাশ থেকে আহরণ করে এনেছ সুপক্ক তালফল। ক্ষুধার সময় নারীর চেয়ে তালফল অনেক বেশি মুখরোচক। — এস এস, আর দেরি নয়, বসে যাওয়া যাক।’

দুইজনে এক গুল্মের ছায়াতলে গিয়া বসিলেন। তাল হইতে শর বাহির করিয়া তালটি ভাগাভাগি করা হইল। উভয়ে আহার আরম্ভ করিলেন।

পেট কথঞ্চিৎ ঠাণ্ডা হইলে নাগেশ্বর বলিলেন— ‘তোমার পরিচয় তো বললে না।’

যুবক বলিল— ‘আমার নাম ময়ূর।’

‘ময়ূর! ময়ূর সিংহ, না ময়ূর বর্মা, না ময়ূর ভট্ট?’

‘শুধু ময়ূর।’

‘তা ভাল। ময়ূর যখন, তখন নামের পিছনে পুচ্ছের কী প্রয়োজন। — তোমার দেশ কোথায়?’

‘তাপ্তি নদীর দক্ষিণে।’

‘কোথায় চলেছ?’

‘শুনেছিলাম ওদিকে সাতটি রাজ্য আছে। তাই এসেছিলাম যদি কাজ পাই।’

‘ভাল ভাল। বৎস ময়ূর, তুমি ঠিকই শুনেছ, এই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাতটি রাজ্য আছে; প্রথমপুর থেকে আরম্ভ করে সপ্তমপুর পর্যন্ত। কিন্তু এই গোলকধাঁধার মধ্যে তুমি খুঁজে পাবে না। খোঁজাখুঁজির প্রয়োজনও নেই। তুমি আমার সঙ্গে চল, কাজ পাবে! তুমি যে-রকম অব্যর্থ তীরন্দাজ, মহারাজ নিশ্চয়ই তোমাকে অনুগ্রহ করবেন।’

ময়ূর শান্তস্বরে বলিল— ‘ভাল।’

তালফল যখন শেষ হইল তখন দেখা গেল দুইটি ক্ষুধিত মানুষের পেট ভরিয়াছে। তাঁহারা জলাশয়ে গিয়া হাত-মুখ ধুইলেন। ইতিমধ্যে সূর্য অনেকখানি পশ্চিমে ঢলিয়াছে, রৌদ্রের তেজ কমিয়াছে। ভট্ট নাগেশ্বর ময়ূরকে লইয়া পঞ্চমপুরের অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তিনি গোলকধাঁধার পথ চেনেন, কুটিল গিরি-বর্ত্ম ধরিয়া পথ দেখাইয়া চলিলেন।

ভট্ট নাগেশ্বর অতি সহৃদয় ব্যক্তি; কিন্তু তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ, উপরন্তু রাজবয়স্য; তাই বাক্-বাহুল্যের দিকে তাঁহার স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল। সুবিধা পাইলেই তিনি কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া দিতেন, একটি শ্রোতা থাকিলেই হইল।

চলিতে চলিতে তিনি হা হতোস্মি করিয়া আরম্ভ করিলেন— ‘সপ্তপুরের আর বেশিদিন নয়। রক্তপিপাসু ম্লেচ্ছ জাতি দাক্ষিণাত্যের স্বাদ পেয়েছে, তারা আবার এই পথে আসবে। তখন সপ্তপুর ধুলো হয়ে উড়ে যাবে। এতদিন তারা আসেনি কেন এই আশ্চর্য। প্রথমবার ম্লেচ্ছ এসেছিল ঘূর্ণিবাত্যার মতো; এবার আসবে মহাপ্লাবনের মতো, সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।’

ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল— ‘প্রথমবার কী হয়েছিল?’

ভট্ট নাগেশ্বর তখন মহা উৎসাহে গল্প বলিতে লাগিলেন—

সপ্তদশ বৎসর আগে নর্মদা ও তাপ্তি নদীর মধ্যবর্তী এই ভূখণ্ডে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করিতেছিল। সাতটি রাজ্যের সাত রাজা পরম সুখে প্রজাদের শাসন-পালন করেন, তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ নাই, বরং কুটুম্বিতা আছে। বহির্জগতের সহিত সম্পর্ক নামমাত্র; জিগীষু রাজারা এই শুষ্ক দেশের দিকে লুব্ধ কটাক্ষপাত করেন না। সাতটি রাজ্যের নামকরণেও অভিমানের চিহ্ন নাই; প্রথমপুর, দ্বিতীয়পুর ইত্যাদি নামেই তাঁহারা সন্তুষ্ট। যেন সাতটি কপোত-মিথুন পর্বতের খোপেখোপে সাতটি নিভৃত নীড় রচনা করিয়াছে।

হঠাৎ একদিন ঈশান কোণে মেঘ দেখা দিল। ম্লেচ্ছ সেনাপতি আলাউদ্দিন দক্ষিণবিজয়ে যাত্রা করিলেন। সঙ্গে বহু সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য; আলাউদ্দিন সসৈন্যে বিন্ধ্যগিরি উত্তীর্ণ হইলেন, নর্মদার উত্তাল তরঙ্গমালা তাঁহার গতিরোধ করিতে পারিল না। তিনি দক্ষিণাত্যের দ্বারমুখে উপস্থিত হইলেন।

আলাউদ্দিনের যাত্রাপথ পূর্ব হইতে নির্ণীত ছিল; তিনি পঞ্চমপুরের উপত্যকায় প্রবেশ করিয়া শিবির ফেলিলেন। এখানে কিছুদিন সৈন্যদলকে বিশ্রাম দিয়া আবার অগ্রসর হইলেন।

পঞ্চমপুর আলাউদ্দিনের যাত্রাপথে পড়িয়াছিল, ইহা পঞ্চমপুরের দুর্ভাগ্য। অন্য ছয়টি রাজ্য বাঁচিয়া গিয়াছিল। আলাউদ্দিনকে প্রতিরোধ করিবার শক্তি পঞ্চমপুরের রাজা ভূপ সিংহের ছিল না; এমনকি সাত জন রাজা একজোট হইলেও আলাউদিনের কোনও ক্ষতি করিতে পারিতেন না। তাই ভূপ সিংহ নতমস্তকে আলাউদ্দিনের দুরভিযান সহ্য করিলেন।

পঞ্চমপুর রাজ্য একটি বিস্তীর্ণ উপত্যকায় অবস্থিত; উপত্যকার মাঝখান দিয়া ক্ষুদ্র নদী বহিয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্র রাজ্যের ক্ষুদ্র রাজধানী, ক্ষুদ্র রাজপুরী, আশেপাশে গ্রাম জনপদ শস্যক্ষেত্র। আলাউদ্দিন পঞ্চমপুর জয় করিতে আসেন নাই, ইহা তাঁহার পথি-পার্শ্বস্থ পান্থশালা মাত্র। ভূপ সিংহ নিরুপায়ভাবে দিন গণিতে লাগিলেন, কতদিনে আপদ দূর হইবে।

ম্লেচ্ছ সৈন্যদল অবাধে গৃহলুণ্ঠন করিল, নারীধর্ষণ করিল, অকথ্য অত্যাচার করিতে লাগিল। এদেশের লোক পূর্বে কোনও ম্লেচ্ছ দেখে নাই, তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া চাহিয়া রহিল। মানুষ যে এমন হইতে পারে তাহা তাহাদের ধারণার অতীত।

তারপর একদিন আলাউদ্দিনের শিবিরে ভূপ সিংহের তলব হইল। না যাইলে গলায় দড়ি দিয়া টানিয়া লইয়া যাইবে; ভূপ সিংহ ম্লেচ্ছের দরবারে গেলেন। আলাউদ্দিন বলিলেন, তিনি জানিতে পারিয়াছেন রাজার একটি সুন্দরী কন্যা আছে, সেই কন্যাকে সেনাপতির কাছে সওগাত পাঠাইতে হইবে।

বক্ষে তুষানল জ্বালিয়া রাজা ফিরিয়া আসিলেন। রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন প্রবীণ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া রাজা এক চাতুরী অবলম্বন করিলেন; রাজপুরীতে সীমন্তিনী নামে এক নবযৌবনা রূপসী দাসী ছিল, তাহাকে রাজকন্যা সাজাইয়া দোলায় তুলিয়া শিবিরে পাঠাইয়া দিলেন। আসল রাজকন্যাকে পুরীর এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে লুকাইয়া রাখা হইল।

কিন্তু আলাউদ্দিনের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করা সহজ নয়। সপ্তাহকাল পরে তিনি দাসী সীমন্তিনীকে ফেরত দিলেন এবং রাজপুরী তল্লাস করিয়া রাজকন্যাকে ধরিয়া লইয়া গেলেন। রাজকন্যার নাম ছিল শিলাবতী।

অতঃপর যবন সৈন্য বিশ্রাম শেষ করিয়া দক্ষিণ দিকে চলিয়া গেল। শিলাবতীকে আলাউদ্দিন সঙ্গে লইয়া গেলেন। তিনি আর এ পথে আসেন নাই, অন্য পথে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন; পিতৃব্যকে হত্যা করিয়া সুলতান হইয়াছিলেন। শিলাবতীর কি হইল কেহ জানে না। হয়তো তিনি বিষপান করিয়াছিলেন, হয়তো বা দিল্লীর হারেমে আলাউদ্দিনের অসংখ্য উপপত্নীর অন্তর্ভুক্ত হইয়া এখনও বাঁচিয়া আছেন।

সে-সময় ভূপ সিংহের পরিবারে ছিলেন তাঁহার রানী ঊষাবতী, ষোড়শী কন্যা শিলাবতী, দ্বাদশ বর্ষীয় বালকপুত্র রামরুদ্র এবং সদ্যোজাত কন্যা সোমশুক্লা। আলাউদ্দিন যখন শিলাবতীকে হরণ করিয়া লইয়া যান। তখন রানী ঊষাবতী সূতিকাগৃহে ছিলেন। তিনি এই দারুণ আঘাত সহ্য করিতে পারিলেন না, প্রসূতিগৃহেই তাঁহার মৃত্যু হইল। দাসী সীমন্তিনী শিশু সোমশুক্লাকে নিজের বুকে তুলিয়া লইল।

সীমন্তিনীর গর্ভাধান হইয়াছিল; যথাকলে সে একটি কন্যা প্রসব করিল। সে নুন খাওয়াইয়া কন্যাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু ভূপ সিংহ নিষেধ করিলেন— ‘না, আলাউদ্দিনের কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখো, হয়তো পরে প্রয়োজন হবে।’

আলাউদ্দিনের কন্যা বাঁচিয়া রহিল, মাতার বিষদৃষ্টির সম্মুখে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তার নাম হইল— চঞ্চরী।

ভূপ সিংহের বুকে যে শেল বিঁধিয়াছিল তাহা বিঁধিয়া রহিল। তিনি উদার ও মহৎ চরিত্রের পুরুষ ছিলেন, এখন তাঁহার চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত মূর্তি ধারণ করিল। অপমান ও লাঞ্ছনায় জর্জরিত হৃদয়ে তিনি কেবল প্রতিহিংসা সাধনের জন্য জীবিত রহিলেন। কিন্তু দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা সাধন সামান্য ভূস্বামীর পক্ষে সহজ নয়। দিন কাটিতে লাগিল।

আট বৎসর পরে ভূপ সিংহ পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন— ‘রামরুদ্র, তোমার বয়স বিশ বৎসর পূর্ণ হয়েছে। কলঙ্কমোচনের সময় উপস্থিত।’

রামরুদ্র বলিলেন— ‘আমি প্রস্তুত আছি।’

ভূপ সিংহ পুত্রের হস্তে ছুরিকা দিয়া বলিলেন— ‘দিল্লী যাও, এই ছুরি দিয়ে নর-পিশাচকে গুপ্তহত্যা কর।’

পরদিন রামরুদ্র পাঁচজন সঙ্গী লইয়া দিল্লী যাত্রা করিলেন। দীর্ঘ পথ; ভূপ সিংহের দীর্ঘ প্রতীক্ষা আরম্ভ হইল।

এক বৎসর পরে দুইজন সঙ্গী ফিরিয়া আসিল। জল্লাদের হাতে রামরুদ্রের মৃত্যু হইয়াছে। একদিন আলাউদ্দিন রক্ষী পরিবৃত হইয়া অশ্বারোহণে দিল্লীর রাজপথ দিয়া যাইতেছিলেন, রামরুদ্র ছুরিকা-হস্তে তাঁহার দিকে ধাবিত হন; কিন্তু আলাউদ্দিনের কাছে পৌঁছিবার পূর্বেই ধরা পড়েন। তাঁহার আক্রমণ ব্যর্থ হয়। —

এইবার ভূপ সিংহের চরিত্রে এক বিচিত্র পরিবর্তন দেখা দিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে একমাত্র পুত্রকে হারাইয়া তিনি শোক করিলেন না। তাঁহার প্রকৃতি যেন দ্বিধাভিন্ন হইয়া গেল; একদিকে শুষ্ক কঠিন কুটিলতা, অন্য দিকে নির্বিকার ঔদাসীন্য। রানী ঊষাবতীর মৃত্যুর পর তিনি দারান্তর গ্রহণ করেন নাই, এখনও করিলেন না; কিন্তু কন্যা সোমশুক্লাকে তিনি জন্মাবধি অবহেলা করিয়াছিলেন, এখন তাহার প্রতি নির্লিপ্তভাবে ঈষৎ স্নেহশীল হইলেন। সপ্তপুরীর বাকি ছয়জন রাজার সহিত তাঁহার সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হইয়াছিল, এখন তিনি দূত পাঠাইয়া পূর্বতন প্রীতির সম্বন্ধ পুনঃস্থাপন করিলেন। মন্ত্রীর সহিত বসিয়া কখনও মন্ত্রণা করেন, কখনও বা বয়স্যদের সঙ্গে চতুরঙ্গ খেলেন। সপ্তমপুরের অধিপতি সূর্যবর্মা ভূপ সিংহের সমবয়স্ক মিত্র, তাঁহার সহিত দূর হইতে চতুরঙ্গের চাল চালেন। কখনও তিনি গম্ভীর কুটিল সন্দিগ্ধ, কখনও দায়িত্বহীন ক্রীড়াচটুল প্রগল্ভ। সকলে তাঁহার কাছে সশঙ্ক হইয়া থাকে, কখন তাঁহার কোন্ রূপ প্রকাশ পাইবে কেহই বলিতে পারে না।

এইভাবে আরও নয় বৎসর কাটিয়াছে। কুমারী সোমশুক্লা এখন সপ্তদশী যুবতী। প্রথমপুরের যুবরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে তাঁহার বিবাহের একটা প্রসঙ্গ উঠিয়াছে; কিন্তু কোনও পক্ষেই ত্বরা নাই। হিরণ্যবর্মার দুইটি পত্নী বর্তমান, তাঁহারা পুরাতন না হওয়া পর্যন্ত যুবরাজ নূতন বিবাহ সম্বন্ধে নিরুৎসুক।

সীমন্তিনীর কন্যা চঞ্চরী এখন ষোড়শী। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, কিন্তু রূপের ছটায় চোখে ধাঁধা লাগে। সে রাজপুরীতে কুমারী সোমশুক্লার কিঙ্করীর কাজ করে। তাহার মা তাহার পানে মুখ ফিরাইয়া চাহে না, কিন্তু ভূপ সিংহ আলাউদ্দিনের কন্যার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন নয়। কেবল, কদাচিৎ যখন চঞ্চরীর উপর রাজার দৃষ্টি পড়ে তখন তাঁহার চোখে একটা ক্রূর অভিসন্ধি খেলা করিয়া যায়। তিনি যেন প্রতীক্ষা করিয়া আছেন; কিন্তু কিসের প্রতীক্ষা তাহা কেহ জানে না। —

ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে রাজকাহিনী শুনিতে শুনিতে ময়ূর যেন আচ্ছন্নের মতো হইয়া পড়িয়াছিল, মনে হইয়াছিল সেও এই কাহিনীর সহিত নিবিড়ভাবে জড়িত। সুলতান আলাউদ্দিনের নামটাই সে জানিত, এখন একটা বিকৃত মনুষ্যমূর্তি চোখের সামনে দেখিতে পাইল। রাজা ভূপ সিংহের নিদারুণ ভাগ্যবিপর্যয় তাহার অন্তরে অঙ্গারের মতো জ্বলিতে লাগিল। কিন্তু তাহার প্রকৃতি স্বভাবতই অন্তর্মুখী, বাহিরে তাহার মনের উষ্মা প্রকাশ পাইল না।

কাহিনী শেষ করিয়া ভট্ট নাগেশ্বরও নীরবে চলিলেন। আর কোনও কথা হইল না। সূর্যাস্তের সময় তাঁহারা রাজধানীতে উপনীত হইলেন। নাগেশ্বর বলিলেন— ‘আজ আর রাজার সঙ্গে দেখা হবে না। তুমি চল, রাত্রে আমার গৃহে থাকবে। কাল প্রাতঃকালে তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাব।’

তিন

ভট্ট নাগেশ্বরের গৃহ ক্ষুদ্র কিন্তু পাষাণনির্মিত। মাত্র দুইটি ঘর, তৈজসপত্র বেশি নাই। ব্রাহ্মণ অকৃতদার, গৃহ গৃহিণীহীন; নিজেই গৃহকর্ম করেন, নিজেই রন্ধন করেন। তাঁহার গৃহদ্বার সর্বদাই খোলা থাকে; দেশে চোর বেশি নাই, যাহারা আছে তাহারা নাগেশ্বরের শূন্য গৃহে চুরি করিতে আসে না।

হস্তমুখ প্রক্ষালনের পর নাগেশ্বর রন্ধনকার্যে লাগিয়া গেলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাক্যস্রোত আবার প্রবাহিত হইল। তিনি রাজ্য ও রাজপুরীর বহু কৌতুককর ঘটনা বিবৃত করিলেন। ময়ূর তাঁহার বিবৃতি হইতে অনেক কথা জানিতে পারিল।

নৈশাহার সমাধা হইলে নাগেশ্বর ঘরের কোণ হইতে গোল-করা শয্যা আনিয়া দুই ভাগ করিয়া মাটিতে পাতিলেন; তারপর প্রদীপ নিভাইয়া শয়ন করিলেন। উভয়েই ক্লান্ত ছিলেন, অবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িলেন।

পরদিন প্রভাতে নাগেশ্বর ময়ূরকে লইয়া রাজভবনে উপনীত হইলেন। প্রতীহার ময়ূরের হাতে ধনুর্বাণ দেখিয়া ভ্রূ তুলিল, কিন্তু রাজবয়স্যের সঙ্গীকে বাধা দিল না, হাস্যমুখে পথ ছাড়িয়া দিল।

প্রাসাদের একটি নিভৃত কক্ষে ভূপ সিংহ মসৃণ পাষাণকুট্টিমের উপর একাকী বসিয়া আছেন। তাঁহার সম্মুখে পাষাণে ক্ষোদিত চতুরঙ্গ খেলার চতুষ্কোণ ছক পাতা রহিয়াছে। বলগুলির বিন্যাস দেখিয়া মনে হয় খেলা অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছে। কিন্তু খেলার প্রতিপক্ষ উপস্থিত নাই।

ভট্ট নাগেশ্বর স্বস্তিবাচন করিলেন— ‘বয়স্যের জয় হোক। সপ্তমপুর থেকে একটি শুক্তি এনেছি, গ্রহণ করুন আর্য।’ বলিয়া কটিবস্ত্র হইতে একটি শ্বেতবর্ণ ক্ষুদ্র বস্তু বাহির করিলেন।

রাজা ভূপ সিংহ খেলার ছক হইতে অন্যমনস্ক চক্ষু তুলিলেন। শীর্ণ দীর্ঘ অগ্নিদগ্ধ আকৃতি, মুখমণ্ডল বলিরেখাঙ্কিত; মাথার আস্কন্ধ কেশ পক্ক, ভ্রূ ও গুম্ফ পক্ক, কেবল চক্ষুতারকা ঘন কৃষ্ণবর্ণ। তিনি ময়ূরকে দেখিতে পাইলেন না, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলিলেন— ‘শুক্তি!’

‘হাঁ মহারাজ। সপ্তমপুরে এক যাযাবর সমুদ্রবণিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার কাছ থেকে এই শুক্তি কিনেছি। দেখুন মহারাজ, কী অপূর্ব শুক্তি?’ বলিয়া নাগেশ্বর করতলে শুক্তিটি লইয়া রাজার সম্মুখে ধরিলেন।

ভূপ সিংহ নির্লিপ্তভাবে শুক্তি তুলিয়া লইলেন, নাড়িয়া চাড়িয়া বলিলেন— ‘একটি ক্ষুদ্র শঙ্খ। এর অপূর্বত্ব কোথায়?’

সত্যই শম্বুকের ন্যায় ক্ষুদ্র একটি শঙ্খ। নাগেশ্বর উত্তেজিত হইয়া বলিলেন— ‘হা হতোস্মি, দেখছেন না মহারাজ, দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ। মহাভাগ্যদাতা দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ। এ শঙ্খ যার কাছে থাকে তার কখনো অমঙ্গল হয় না।’

ভূপ সিংহ কিয়ৎকাল শূন্যে চাহিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘আমার একটি দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ ছিল। একদিন রানীর হাত থেকে স্খলিত হয়ে মণিকুট্টিমে পড়ল, শত খণ্ডে চূর্ণ হয়ে গেল। আজ থেকে সতেরো বছর আগে।’ তিনি ক্ষুদ্র শঙ্খটি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— ‘হা, দক্ষিণাবর্তই বটে। কিন্তু এ নিয়ে আমি কি করব বয়স্য? আমার আর সৌভাগ্যের কী প্রয়োজন।’

নাগেশ্বর কুন্ঠিত মুখে নীরব রহিলেন। রাজা শঙ্খটিকে কিছুক্ষণ মুষ্টিতে আবদ্ধ রাখিয়া চিন্তা করিলেন, শেষে বলিলেন— ‘সোমশুক্লাকে ডেকে পাঠাও। সে এই শঙ্খ ধারণ করুক, হয়তো তার মঙ্গল হতে পারে।’

‘সেই ভাল, সেই ভাল মহারাজ। আমি নিজেই কুমারী শুক্লাকে ডেকে আনছি।’ বলিয়া নাগেশ্বর দ্রুত অন্তঃপুর অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

এতক্ষণে ময়ূরের প্রতি ভূপ সিংহের দৃষ্টি পড়িল। সে ধনুর্বাণ-হস্তে দ্বারের নিকট নিশ্চল দাঁড়াইয়া ছিল, রাজা মৃদু বিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন— ‘তুমি কে?’

ময়ূর সসম্ভ্রমে শির নত করিয়া বলিল— ‘ভট্ট নাগেশ্বর আমাকে সঙ্গে এনেছেন। আমি বিদেশী, আমার নাম ময়ূর।’

রাজা বলিলেন— ‘তোমার হাতে আটবিক জাতির ধনুর্বাণ, কিন্তু আকৃতি দেখে আর্য মনে হয়।’

ময়ূর বলিল— ‘মহারাজ, আমি আটবিক নাগ জাতির মধ্যে পালিত হয়েছি, কিন্তু জাতিতে ক্ষত্রিয়।’

‘তোমার বংশপরিচয় কি?’

‘বংশপরিচয় জানি না আর্য।’

ময়ূরের পানে চাহিয়া চাহিয়া রাজার মুখ-ভাব পরিবর্তিত হইল, মেরুদণ্ড ঋজু হইল। মনে হইল, একটা মানুষ অন্তর্হিত হইয়া অন্য একটি মানুষ আবির্ভূত হইতেছে। তিনি দৃঢ় আদেশের স্বরে বলিলেন, ‘কাছে এস। উপবিষ্ট হও। তোমার ইতিহাস শুনতে চাই।’

ময়ূর আসিয়া রাজার সম্মুখে জানু মুড়িয়া বসিল; মাঝখানে দাবার ছকের ব্যবধান রহিল।

তারপর ময়ূর নিজ জীবনের ইতিহাস বলিল।

তাপ্তি নদীর দক্ষিণে দেবগিরি রাজ্যে তাহার বাস ছিল, তাহার পিতা দেবগিরি রাজ্যের একজন যোদ্ধা ছিলেন। রাজ্যের উত্তর সীমান্তে একটি সেনা-গুল্মে তাহারা থাকিত। ময়ূরের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর তখন উত্তরাপথ হইতে আলাউদ্দিন নামে এক যবন সেনাপতি দেবগিরি আক্রমণ করেন। সীমান্ত রক্ষা করিতে গিয়া এক খণ্ডযুদ্ধে ময়ূরের পিতা হত হন। তাহার মাতা তাহার প্রাণ বাঁচাইবার জন্য তাহাকে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে পলায়ন করেন। জঙ্গল ও পর্বতের ভিতর দিয়া বহুদূর পথ অতিক্রম করিবার পর তাহারা এক বন্য জাতির গ্রামে আশ্রয় পায়। মাতা কিন্তু বেশিদিন বাঁচিলেন না, দু’-চার দিনের মধ্যে তাঁহার মৃত্যু হইল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ময়ূরের গোত্র-পরিচয় দিয়া যান নাই, কেবল বলিয়াছিলেন— ‘তুমি ক্ষত্রিয়।’

অতীতের কাহিনী শেষ করিয়া ময়ূর বলিল— ‘তারপর আমার জীবনের ষোল বছর নাগজাতির গ্রামে কেটেছে; তারা আমাকে স্নেহ করেছে, আমি তাদের ভালবেসেছি। কিন্তু কয়েকমাস আগে গ্রামবৃদ্ধেরা আমাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে আদেশ দিলেন। তাই আমি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছি; অনেক নদী-পর্বত পার হয়ে এখানে এসেছি।’

রাজা ময়ূরের মুখের উপর স্থির দৃষ্টি রাখিয়া শুনিতেছিলেন, প্রশ্ন করিলেন— ‘গ্রামবৃদ্ধেরা তোমাকে তাড়িয়ে দিল কেন?’

ময়ূর অধোবদন হইল, তাহার মুখ ধীরে ধীরে অরুণাভ হইয়া উঠিল। রাজা বলিলেন, ‘কোনও দুষ্কৃতি করেছিলে?’

ময়ূর আহত মুখ তুলিল— ‘আমার কোনও দোষ ছিল না মহারাজ।’ সে লজ্জাজড়িত স্বরে থামিয়া থামিয়া বলিতে লাগিল— ‘গ্রামের যুবতী মেয়েরা সকলে— কেবল আমার পিছনেই ঘুরে বেড়াতো— আমার জন্যে নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করত— যুবকেরাও আমার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না— আমি মেয়েদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম, তবু যুবকেরা আমাকে ঈর্ষা করত— একজন তীর ছুঁড়ে আমাকে মারবার চেষ্টা করেছিল— তাই গ্রামবৃদ্ধেরা বললেন, তোমার জন্যে গ্রামের শান্তিভঙ্গ হচ্ছে, তুমি চলে যাও।’

রাজার মুখে শুষ্ক হাসির রেখাঙ্ক পড়িল, কিন্তু চক্ষু ময়ূরের মুখ হইতে অপসৃত হইল না। তিনি বলিলেন— ‘তুমি মেয়েদের ভয় কর?’

ময়ূর বলিল— ‘ভয় করি না মহারাজ, কিন্তু— ওদের এড়িয়ে চলতে চাই।’

এই সময় কুমারী সোমশুক্লা কক্ষে প্রবেশ করিলেন, তাঁহার পশ্চাতে ভট্ট নাগেশ্বর!

সপ্তদশ বর্ষীয়া যুবতী সোমশুক্লাকে দেখিলে দর্শকের মন স্নিগ্ধ আনন্দে পূর্ণ হইয়া ওঠে। দীর্ঘাঙ্গী কন্যা, দেহবর্ণের শুচিশুভ্রতা সোমশুক্লা নাম সার্থক করিয়াছে; মুখখানি লাবণ্যে টলমল। তিনি কক্ষে আসিলেন, তাঁহার গতিভঙ্গিতে পাল-তোলা তরণীর অবলীলা। পিতার পাশে নতজানু হইয়া তিনি স্মিতমুখে বলিলেন— ‘আর্য! আমাকে ডেকেছেন?’

রাজার মন কোন্ গভীরতর স্তরে নিমজ্জিত ছিল, তিনি শূন্যদৃষ্টিতে কন্যার পানে চাহিলেন— ‘ডেকেছি।’

ভট্ট নাগেশ্বর কুমারীর পিছনে দণ্ডায়মান ছিলেন, বলিয়া উঠিলেন— ‘হা হতোস্মি! দক্ষিণাবর্ত শঙ্খের কথা ভুলে গেলেন মহারাজ!’

‘ও— হাঁ’— মহারাজ মুষ্টি খুলিয়া শঙ্খটি দেখিলেন, কন্যার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন— ‘বয়স্য আমার জন্য শঙ্খটি এনেছিল। সুলক্ষণ শঙ্খ, তুমি এটি নাও। স্বর্ণকারকে ডেকে পাঠাও, এই শঙ্খ দিয়ে অলঙ্কার গড়িয়ে নাও। সর্বদা অঙ্গে রেখো, মঙ্গল হবে।’

কুমারী সোমশুক্লার শান্ত চোখে আনন্দ ফুটিয়া উঠিল। তিনি শঙ্খটি কপোতহস্তে লইয়া কপালে স্পর্শ করিলেন, বলিলেন— ‘ধন্য পিতা। আমি এখনি স্বর্ণকারকে ডেকে পাঠাচ্ছি। — অনুমতি করুন আর্য।’

তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রাজা বলিলেন— ‘এস কন্যা।’

প্রস্থান করিবার সময় কুমারী সোমশুক্লার দৃষ্টি ময়ূরের উপর পড়িল, ক্ষণকালের জন্য ময়ূরের মুখের উপর সংলগ্ন হইয়া রহিল। তারপর তিনি পাল-তোলা তরণীর ন্যায় কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন।

চার

ময়ূর এতক্ষণ চতুরঙ্গ বলের উপর দৃষ্টি রাখিয়া বসিয়া ছিল, ভট্ট নাগেশ্বর তাহার নিকটে উপবিষ্ট হইয়া বলিলেন— ‘মহারাজ, এই যুবককে আমি আপনার কাছে এনেছিলাম—’

ভূপ সিংহ বলিলেন— ‘জানি।’ নাগেশ্বরের বাগ্‌বিস্তার থামাইয়া তিনি ময়ূরের উপর চক্ষু নিবদ্ধ করিলেন— ‘তুমি আমার অধীনে কর্ম চাও?’

ময়ূর বলিল— ‘হ্যাঁ মহারাজ।’

রাজা বলিলেন— ‘তোমার হাতে ধনুঃশর দেখে অনুমান করছি তুমি ধনুর্বিদ্যা জানো।’

ময়ূর সবিনয়ে বলিল— ‘সামান্য জানি। নাগজাতির কাছে শিখেছি।’

নাগেশ্বর মুখ খুলিয়া আবার বন্ধ করিলেন। রাজা ময়ূরকে প্রশ্ন করিলেন— ‘তুমি ঘোড়ায় চড়তে জানো?’

ময়ূর বলিলেন— ‘না মহারাজ।’

‘অসি চালনা?’

‘না মহারাজ।’

‘শুধুই তীর ছুড়তে জানো?’

নাগেশ্বর আর নীরব থাকিতে পারিলেন না, বলিয়া উঠিলেন— ‘শুধুই কি তীর ছুঁড়তে জানে বয়স্য! এই যুবক অতি ধুরন্ধর তীরন্দাজ, একটি তীর ছুঁড়ে তালগাছের ডগা থেকে পাকা তাল পেড়ে আনতে পারে। বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখুন।’

‘অবশ্য পরীক্ষা করে দেখব। এস আমার সঙ্গে।’ রাজা উঠিয়া দ্বারের দিকে চলিলেন।

রাজপুরী দ্বি-ভূমক হইলেও আকারে ক্ষুদ্র এবং ঘন-সম্বদ্ধ; তাহার পশ্চাৎভাগ অন্তঃপুর, স্বতন্ত্র অবরোধ নাই। অন্তঃপুরের পশ্চাতে উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত বিস্তীর্ণ বিহারভূমি; দুই-চারিটি বৃক্ষ ও লতামণ্ডপশোভিত শষ্পাকীর্ণ অঙ্গন। ভূপ সিংহ এই অঙ্গনের মধ্যস্থলে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন— ‘এবার তোমার ধনুর্বিদ্যা দেখাও।’

ভট্ট নাগেশ্বর ময়ূরকে উৎসাহ দিয়া বলিলেন— ‘দেখাও, দেখাও।’

ময়ূর ঊর্ধ্ব আকাশের পানে চোখ তুলিল, সযত্নে ধনুকে গুণ পরাইল; তিনটি শরের মধ্যে একটি হাতে রাখিয়া বাকি দুইটি মাটিতে ফেলিল, তারপর ধীরে ধীরে ধনুকে শরযোজন করিয়া ধনু ঊর্ধ্বে তুলিল।

প্রাসাদের দ্বিতলে বাতায়ন সম্মুখে দাঁড়াইয়া কুমারী সোমশুক্লা চম্পাকলির ন্যায় ক্ষুদ্র শঙ্খটি দেখিতেছিলেন; পাশের অন্য একটি বাতায়নে চঞ্চরী বাহিরের দিকে মুখ বাড়াইয়া চাহিয়া ছিল। সে হঠাৎ কলস্বরে বলিয়া উঠিল— ‘দেখ, দেখ, রাজকুমারি, অঙ্গনে কী হচ্ছে!’

সোমশুক্লা চকিতে চক্ষু তুলিলেন। প্রাঙ্গণের মাঝখানে দাঁড়াইয়া সেই যুবক, যাহাকে তিনি ক্ষণেকের জন্য পিতার সম্মুখে দেখিয়াছিলেন। যুবক ঊর্ধ্বদিকে ধনু তুলিয়া গুণ আকর্ষণ করিল; ধনু হইতে বাণ ছুটিয়া গেল, আকাশের ঊর্ধ্বলোকে উঠিয়া প্রায় অদৃশ্য হইয়া গেল। ইতিমধ্যে যুবক ক্ষিপ্ত হস্তে মাটি হইতে অন্য একটি বাণ তুলিয়া লইয়া ধনুতে জুড়িয়াছে। প্রথম বাণটি, বেগ নিঃশেষিত হইলে, পাক খাইয়া নীচে নামিতে আরম্ভ করিল। যুবক তখন দ্বিতীয় বাণ মোচন করিল। দুই বাণ মধ্যপথে ফলকে ফলকে চুম্বন করিয়া একসঙ্গে মাটিতে পড়িল।

ভট্ট নাগেশ্বর দুই বাহু আস্ফালন করিয়া হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বলিলেন— ‘সাধু, সাধু!’

রাজা কিছু বলিলেন না, কিন্তু তাঁহার কুঞ্চিত চক্ষে গোপন অভিসন্ধি ক্ষণেকের জন্য ফুটিয়া উঠিল। তিনি হস্তের ইঙ্গিতে ময়ূরকে ডাকিয়া পুরীর দিকে ফিরিয়া চলিলেন। নাগেশ্বর উচ্ছ্বসিত স্বরে ‘অদ্ভুত অদ্ভুত’ বলিতে বলিতে তাঁহার অনুগামী হইলেন।

দ্বিতলের বাতায়নে চঞ্চরী ছুটিয়া গিয়া সোমশুক্লার নিকটে দাঁড়াইল, তাঁহার অঞ্চল টানিয়া দীপ্ত চক্ষে বলিল— ‘রাজকুমারি! কী সুন্দর যুবাপুরুষ!’

রাজকুমারীও চমৎকৃত হইয়াছিলেন, উৎফুল্ল মুখে বলিলেন— ‘অপূর্ব শরসন্ধান।’

বিহ্বলা চঞ্চরী তাঁহার হস্ত আকর্ষণ করিয়া বলিল— ‘ও কে রাজকুমারী!’

সোমশুক্লা চঞ্চরীর মুখে উত্তপ্ত অভীপ্সা দেখিলেন; চঞ্চরীর বহ্নিশিখার মতো রূপ যেন আরও তীব্র-সুন্দর দেখাইতেছে। তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া নীরস কণ্ঠে বলিলেন— জানি না।’

এই সময় সীমন্তিনী প্রবেশ করিল।

সীমন্তিনীর বয়স এখন পঁয়ত্রিশ বছর। শীর্ণ তপঃকৃশ আকৃতি, মুখের উপর দুরপনেয় তিক্ততা স্থায়ী আসন পাতিয়াছে; তবু তাহার মুখাবয়ব হইতে বিগত লাবণ্যের চিহ্ন সম্পূর্ণ লুপ্ত হইয়া যায় নাই।

চঞ্চরীকে সোমশুক্লার হাত ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া সীমন্তিনীর দুই চক্ষু প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল, সে কাছে আসিয়া কঠিন স্বরে কন্যাকে বলিল— ‘চঞ্চরি! কুমারীর অঙ্গ স্পর্শ করেছিস্ কোন স্পর্ধায়! যা— চলে যা এখান থেকে।’

চঞ্চরী মাতাকে যমের মতো ভয় করিত, সে কুমারীর হাত ছাড়িয়া দিয়া ছুটিয়া পলাইল। সীমন্তিনী তখন শান্ত স্বরে বলিল— ‘নন্দিনি, স্বর্ণকার এসেছে, নীচে অপেক্ষা করছে।’

সীমন্তিনী কুমারীকে নন্দিনী বলিয়া ডাকে, সে তাঁহার ধাত্রীমাতা। সোমশুক্লা তাহাকে জিজি বলেন; শৈশবকালের আদরের ডাক।

সোমশুক্লা বলিলেন— ‘তুমিও আমার সঙ্গে এস জিজি।’

সীমন্তিনীর তিক্ত মুখ ক্ষণেকের জন্য কোমল হইল; দুইজনে নীচে নামিয়া গেলেন।

নারী-চরিত্রের জটিলতা কে উন্মোচন করিবে? সীমন্তিনীর জীবনে যে মহাদুর্যোগ আসিয়াছিল তাহার জন্য রাজা ভূপ সিংহের দায়িত্ব কম নয়। অথচ রাজার কন্যাকেই সে নিজের কন্যা বলিয়া বুকে টানিয়া লইয়াছে, নিজের গর্ভজাত কন্যাকে সহ্য করিতে পারে না।

রাজা ফিরিয়া গিয়া নিভৃত কক্ষে বসিয়াছিলেন; ময়ূর ও নাগেশ্বরকে উপবেশন করিতে বলিলেন। সকলে উপবিষ্ট হইলে রাজা ময়ূরকে বলিলেন— ‘তোমাকে আমি কর্ম দেব। তুমি রাজভবনেই অন্যান্য পরিচরের ন্যায় থাকবে। তোমাকে অশ্বারোহণ শিখতে হবে, অসিবিদ্যা শিখতে হবে।’

ময়ূর বলিল— ‘শিখব মহারাজ। আমাকে কোন্ কর্ম করতে হবে?’

রাজা বলিলেন— ‘এখন তোমার কোনো কর্ম নেই। যখন সময় হবে আমি তোমার কর্মনির্দেশ করব। আজ থেকে তুমি আমার আজ্ঞাধীন, আমি যা আদেশ করব তাই করবে।’

ময়ূর যুক্তকরে বলিল— ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’

রাজার অধরপ্রান্তে হাসির মতো একটা ব্যঞ্জনা দেখা দিল, তিনি কতকটা নিজ মনেই বলিলেন— ‘অনেকদিন থেকে প্রতীক্ষা করছি।’

তারপর তাঁহার মধ্যে অন্য মানুষের আবির্ভাব হইল, তিনি নাগেশ্বরের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘তোমার দূতকর্মের কী হল?’

নাগেশ্বর বলিলেন— ‘দূতকর্ম সম্পন্ন হয়েছে বয়স্য। মহারাজ সূর্যবর্মাকে আপনার বলক্ষেপ জানিয়েছি।’

রাজা বলিলেন— ‘কী জানিয়েছ আমার কাছে পুনরাবৃত্তি কর। তোমাকে বিশ্বাস নেই, আগের বার তুমি ভুল বলক্ষেপ জানিয়ে অনর্থ ঘটিয়েছিলে।’

নাগেশ্বর ললাটে করাঘাত করিয়া বলিলেন— ‘হা হতোস্মি! একবার ভুল করেছি বলে কি বার বার ভুল করব। আমি তাঁকে জানিয়েছি যে আপনি বাম দিকের নৌবলকে সম্মুখের তৃতীয় কোষ্ঠে সঞ্চারিত করেছেন! ঠিক বলেছি কি না?’

রাজা সম্মুখে চতুরঙ্গ ছকের দিকে দৃষ্টি নমিত করিলেন। ময়ূর এতক্ষণ ইঁহাদের কথার তাৎপর্য বুঝিতে পারে নাই, এখন বুঝিল ভট্ট নাগেশ্বর কিরূপ গোপনীয় দূতকার্যে সপ্তমপুরে গিয়াছিলেন। দুই রাজা নিজ নিজ রাজ্যে বসিয়া দাবার চাল দিয়া দূতমুখে বার্তা পাঠাইতেছেন। এই খেলাটি বোধ হয় দুই বছর আগে আরম্ভ হইয়াছিল, আরও দুই বছর চলিবে।

ভূপ সিংহ মুখ তুলিয়া বলিলেন— ‘ঠিকই বলেছ। সূর্যবর্মা কি বললেন?’

‘তিনি আপনার চাল নিজের ছকে বসিয়েছেন। বললেন, মাসেক কালের মধ্যে পালটা চাল দূতমুখে জানাবেন।’

‘ভাল। বন্ধু সূর্যবর্মা কুশলে আছেন তো?’

‘শারীরিক কুশলেই আছেন, কিন্তু মনের কুশল কোথায়? অনেক খেদ প্রকাশ করলেন, বললেন— আমি অপুত্রক, আমার বন্ধু ভূপ সিংহ ভাগ্যদোষে পুত্রহীন; আমাদের মৃত্যুর পর রাজ্যের কী দশা হবে কে জানে! হয়তো শৃগালের বাসভূমি হবে।’

ভূপ সিংহ উদ্গত নিশ্বাস চাপিয়া বলিলেন— ‘ওকথা থাক, আমাদের মৃত্যুর পর যা হবার হবে। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছি—’ তারপর সন্নিহিত ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন— ‘বজ্রবাহু, এর নাম ময়ূর। আজ থেকে আমি একে আমার দেহরক্ষী নিযুক্ত করেছি। একে সঙ্গে নিয়ে যাও, রাজভবনে যথাযোগ্য স্থান এবং অশন-বসনের নির্দেশ কর।’

বজ্রবাহু ময়ূরকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেল। রাজা গাত্রোত্থান করিলেন, ভট্ট নাগেশ্বরকে বলিলেন— ‘বয়স্য, চল তোমাকে মিষ্টান্ন ভোজন করাই।’

সে-রাত্রে ভূপ সিংহের চক্ষে নিদ্রা আসিতেছিল না। যথাকালে আহার করিয়া তিনি দ্বিতলে শয়নকক্ষে শয্যা আশ্রয় করিয়াছিলেন, ভৃত্য বজ্রবাহু পদ-সংবাহন করিয়া দিয়াছিল। অভ্যাসমত তাঁহার একটু তন্দ্রাকর্ষণও হইয়াছিল। কিন্তু বজ্রবাহু চলিয়া যাইবার পর তিনি আবার জাগিয়া উঠিয়াছিলেন, চিন্তাতপ্ত মস্তিষ্ক তাঁহাকে ঘুমাইতে দেয় নাই।

শয্যায় শুইয়া তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন, তারপর উঠিয়া কক্ষে পাদচারণ আরম্ভ করিলেন। আজ পূর্বাহ্ণে যে কয়টি ঘটনা ঘটিয়াছে তাহাই তাঁহার চিন্তার বস্তু। — সতেরো বছর পূর্বে রানীর হস্তচ্যুত দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ চূর্ণ হইয়া গিয়াছিল; তারপরেই আসিল সর্বনাশা বিপর্যয়। আজ আবার অযাচিতভাবে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সেই সঙ্গে আসিয়াছে এক অজ্ঞাতকুলশীল যুবক; অদ্ভুত তীরন্দাজ, অথচ শান্ত নিরভিমান দৃঢ়চিরিত্র। দীর্ঘকাল তিনি এমনি একটি মানুষের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন; চঞ্চরীর যৌবনপ্রাপ্তির সন্ধিক্ষণে সে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এ এক অপূর্ব যোগাযোগ। এ কি নিয়তির ইঙ্গিত? তবে কি সত্যই শুভকাল ফিরিয়া আসিয়াছে? তাঁহার জীবনে অন্য শুভ নাই, একমাত্র শুভ প্রতিহিংসাসাধন। তাহা কি সফল হইবে? মহাপাপিষ্ঠ আলাউদ্দিনকে যুদ্ধে পরাভূত করার সামর্থ্য তাঁহার নাই, গুপ্তহত্যার আশাও তিনি ত্যাগ করিয়াছেন। এখন কেবল একটি মাত্র প্রতিহিংসার অস্ত্র তাঁহার হাতে আছে। বৃহতের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্রের প্রতিহিংসা; ক্ষুদ্র বৃশ্চিক হস্তীকে দংশন করিয়া বিষে জর্জরিত করিতে পারে। তিনি তাহাই করিবেন। আলাউদ্দিন তাঁহার কুমারী কন্যাকে অপহরণ করিয়া তাঁহার মুখ কালিমালিপ্ত করিয়াছিল, তিনি সেই কালিমা চতুর্গুণ ফিরাইয়া দিবেন। কামকুক্কুর আলাউদ্দিন জানিতে পরিবে না, তারপর তিনি তাহাকে জানাইয়া দিবেন। সমস্ত যবনরাজ্য জানিতে পরিবে। …এই কার্যের জন্য ময়ূরের ন্যায় যুবক চাই, যে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না, যে চঞ্চরীর রূপের মোহে ভুলিয়া তাহাকে আত্মসাৎ করিতে চাহিবে না। ময়ূর উত্তম উপাদান, কিন্তু তাহাকে গড়িয়া তুলিতে হইবে।

এই চিন্তাগুলি বারংবার ভূপ সিংহের মস্তিষ্কে আবর্তিত হইয়া বিষাক্ত পতঙ্গের ন্যায় তাঁহার চেতনাকে দংশন করিতেছিল। রত্রি দ্বিপ্রহর অতীত হইল, তবু চোখে নিদ্রা নাই— নিদ্রার ইচ্ছাও নাই—

‘আর্য!’

ভূপ সিংহ চমকিয়া দ্বারের পানে চাহিলেন। ম্লান দীপালোকে স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন না, দ্রুত আসিয়া দেখিলেন, দ্বারের কবাট ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন কুমারী সোমশুক্লা। রাজা বলিলেন, ‘শুক্লা!’

সোমশুক্লা হ্রস্বস্বরে বলিলেন— ‘পিতা, আপনার কি নিদ্রা আসছে না?’

ভূপ সিংহ কন্যার প্রতি স্নেহশীল হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে মনের ঘনিষ্ঠতা জন্মে নাই। এখন রাজা যেন কন্যাকে অত্যন্ত নিকটে পাইলেন। তিনি বলিলেন— ‘না বৎসে, ঘুম আসছে না। কিন্তু রাত্রি অনেক হয়েছে, তোমার চোখে ঘুম নেই কেন?’

সোমশুক্লা ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন— ‘আমি ঘুমিয়েছিলাম পিতা, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল। তারপর পাশের ঘরে আপনার পদশব্দ শুনে উঠে এলাম।’

রাজা বলিলেন— ‘তুমি আবার শয়ন কর গিয়ে। আমার ঘুম কখন আসবে ঠিক নেই।’

সোমশুক্লা বলিলেন— ‘না পিতা, আপনি শয়ন করুন, আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। এখনি ঘুম আসবে।’

রাজা শয্যায় শয়ন করিলেন, সোমশুক্লা শিয়রে দাঁড়াইয়া মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অপরিসীম প্রশান্তিতে রাজার দেহমন ভরিয়া উঠিল। তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন।

পাঁচ

রাজভবনে ময়ূরের প্রথম রাত্রিটা সুখনিদ্রায় কাটিল। যে ঘরটি তাহার জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছিল তাহা রাজভবনের নিম্নতলে পশ্চাদ্দিকের এক কোণে। অঙ্গনের দিকে তাহার দ্বার, রাজভবনে প্রবেশ না করিয়াও ঘরে প্রবেশ করা যায়। ঘরের মধ্যে একটি খট্টাঙ্গ পাতা হইয়াছে, তদুপরি নব শয্যা। নূতন বস্ত্রাদিও উপস্থিত। রাজার রন্ধনশালা হইতে সুপক্ক খাদ্য আসিয়াছে, তাহাই সেবন করিয়া দ্বার-গবাক্ষ খোলা রাখিয়া ময়ূর শয়ন করিয়াছিল, একেবারে ঘুম ভাঙিল পাখির ডাকে। পঞ্চমপুরে তাহার কর্মজীবন আরম্ভ হইল।

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় প্রায় দুই মাসব্যাপী।

অশ্বারোহণ বিদ্যা শিখিতে ময়ূরের তিনদিন লাগিল। তাহার শোণিতে অশ্ববিদ্যার বীজ নিহিত ছিল, অশ্বপৃষ্ঠে চড়িয়া সে অপূর্ব হর্ষ অনুভব করিল। রাজভবনের পশ্চাৎভাগে বিহারভূমির প্রাচীরের পাশ দিয়া অশ্ব ছুটাইয়া দিয়া সে দেখিতে পাইত কুমারী সোমশুক্লা দ্বিতলের বাতায়ন হইতে তাহাকে লক্ষ্য করিতেছেন। আনন্দের আতিশয্যে সে এক হাত তুলিয়া হাসিত, দেখিতে পাইত কুমারীর সুন্দর মুখেও স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়াছে।

অশ্ববিদ্যা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিবার পরও ময়ূর রাজ-মন্দুরা হইতে প্রত্যহ নূতন অশ্ব লইয়া অভ্যাস করিত। একদিন সায়াহ্নে বিহারভূমির একপ্রান্তে রাজকন্যার সহিত তাহার দেখা হইয়া গেল। বিহারভূমিতে এক জোড়া ক্ষুদ্রাকৃতি হরিণ ও কয়েকটি শশক ছিল; কুমারী মাঝে মাঝে আসিয়া তাহাদের খাইতে দিতেন। কুমারীকে বিহারভূমিতে দেখিলেই তাহারা ছুটিয়া আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইত।

সেদিনও তাহারা কুমারীকে ঘিরিয়া ধরিয়াছিল। কুমারী চারিদিকে শস্য ছড়াইয়া দিতেছিলেন, তাহারা কাড়াকাড়ি করিয়া খাইতেছিল। সহসা অদূরে অশ্বের দড়বড় শব্দ শুনিয়া তাহারা ভয় পাইয়া পলায়ন করিল।

ময়ূর লতাবিতানের অন্তরালে সোমশুক্লাকে দেখিতে পায় নাই, দেখিতে পাইয়া ত্বরিতে অশ্ব থামাইয়া তাঁহার কাছে আসিল, জোড়হস্তে বলিল— ‘রাজনন্দিনি, আমাকে ক্ষমা করুন।’

সোমশুক্লা একটু হাসিলেন, শুচিস্মিত মুখের উপর একটু অরুণাভ দেখা দিল। তিনি বলিলেন— ‘ওরা বনের প্রাণী, বড় ভীরু। কিন্তু আপনি বিব্রত হবেন না, ওরা এখনি ফিরে আসবে।’

ময়ূর লক্ষ্য করিল, রাজকুমারী তাহাকে সমকক্ষের ন্যায় সম্বোধন করিলেন, ভৃত্য-পরিজনের মতো নয়। তাহার আর কিছু বলিবার ছিল না, তবু সে একটু ইতস্তত করিল। তাহাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখিয়া সোমশুক্লা বলিলেন— ‘আপনি তো অশ্ববিদ্যা শীঘ্র অধিগত করেছেন।’

ময়ূর একটু লজ্জিত হইয়া পড়িল, বলিল— ‘কি জানি। সত্যই কি শীঘ্র? আমার ধারণা ছিল সকলেই অতি সহজে ঘোড়ায় চড়া শিখতে পারে।’

রাজকুমারী শুধু হাসিলেন, তারপর অন্য কথা বলিলেন— ‘আপনার অসিশিক্ষা কতদূর?’

ময়ূর অবাক হইয়া চাহিল, রাজকুমারী তাহার সব খবর রাখেন। একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল— ‘অসিশিক্ষা এখনো চলছে। অস্ত্রগুরু বলেছেন আরও দুই-তিন সপ্তাহ লাগবে।’

ইতিমধ্যে হরিণ মিথুন আবার গুটিগুটি কুমারীর দিকে অগ্রসর হইতেছিল। তাই দেখিয়া ময়ূর আর সেখানে দাঁড়াইল না, ঘোড়ার রাশ ধরিয়া মন্দুরার দিকে চলিয়া গেল।

তারপর আরও কয়েকবার রাজকুমারীর সহিত দেখা হইল; দুই-চারিটি সামান্য বাক্যালাপ হইল। একদিন সে দেখিল কুমারীর মণিবন্ধে একটি নূতন কঙ্কণ শোভা পাইতেছে। চম্পাকলির ন্যায় সুন্দর ক্ষুদ্র শঙ্খটি এই কঙ্কণের মধ্যমণি। ময়ূর উৎসুক নেত্রে সেই দিকে চাহিল।

কুমারী বলিলেন— ‘শঙ্খটি আপনার চেনা, আপনার সামনেই পিতা এটি আমাকে দিয়েছিলেন। — অলঙ্কার কেমন হয়েছে?’ বলিয়া তিনি মৃণালবাহু তুলিয়া দেখাইলেন।

‘ভাল।’ ময়ূর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আরও অনেক কথা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার মুখ দিয়া বাক্য সরিল না। রাজকুমারী মৃদু হাসিলেন।

দিন কাটিতেছে। অশ্বারোহণ ও অসিবিদ্যা অভ্যাস করা ছাড়াও ময়ূর রাজার কাছে যাতায়াত করে, রাজা যে কক্ষে থাকেন সেই কক্ষদ্বারে ধনুর্বাণ হস্তে দাঁড়াইয়া থাকে। রাজা মাঝে মাঝে তাহার প্রতি দীর্ঘ দৃষ্টিপাত করেন, যেন চক্ষু দিয়া তাহার যোগ্যতার পরিমাপ করেন। ভট্ট নাগেশ্বরের সঙ্গেও প্রত্যহ দেখা হয়; ব্রাহ্মণ দু’দণ্ড দাঁড়াইয়া তাহার সহিত বাক্যালাপ ও রঙ্গ-রসিকতা করেন।

এই তো গেল দিনচর্যা। রাত্রিকালেও ময়ূরের কক্ষে কিছু ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাহাকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল; কিন্তু শঙ্কা ও সংকোচে সে কাহাকেও কিছু বলিতে পারিতেছিল না।

রাত্রিকালে সে ঘরের দ্বার-গবাক্ষ উন্মুক্ত করিয়া শয়ন করিত, আবদ্ধ ঘরে শয়ন করা তাহার অভ্যাস নাই। প্রথম কয়েক রাত্রি নির্বিঘ্নে কাটিয়াছিল, তারপর একদা গভীর রাত্রে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে দীপ নিভাইয়া শুইয়াছিল, সুতরাং ঘর অন্ধকার; কিন্তু ঘরের বাহিরে মুক্ত দ্বারপথে নক্ষত্রের আলোকবিদ্ধ তমিস্রা ঈষৎ তরল। জাগিয়া উঠিয়া ময়ূর পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ করিয়া শুইয়া রহিল। ঘরের অভ্যন্তরে অতি লঘু পদপাতের শব্দ আসিতেছে। সে সহসা উঠিয়া বসিয়া তীব্র স্বরে বলিল— ‘কে?’

প্রশ্নের উত্তর আসিল না। কে যেন ভয় পাইয়া দ্রুত চরণে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল।

ময়ূর ভাবিল, হয়তো বিড়াল। তারপর সে অনুভব করিল, ঘরের বাতাসে কেশতৈলের মৃদু গন্ধ ভাসিয়া বেড়াইতেছে। সে বিস্মিত হইয়া ভাবিল, স্ত্রীলোক তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল! কে সে? রাজপুরীতে দাসী-কিঙ্করী আছে, তাহাদের মধ্যে কেহ? কিন্তু কেন?

সে-রাত্রে ময়ূর অনেকক্ষণ জাগিয়া রহিল, কিন্তু আর কিছু ঘটিল না। কয়েকদিন কাটিয়া গেল, কৃষ্ণপক্ষ গিয়া শুক্লপক্ষের তিথি আসিল। একদিন ময়ূর দ্বার খুলিয়া ঘুমাইতেছিল, ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিল। চাঁদ তখনও অস্ত যায় নাই, ঘরের বাহিরে আবছায়া আলো। ময়ূর চক্ষু মেলিয়া অস্পষ্টভাবে দেখিল, তাহার শিয়রে কেহ তাহার পানে চাহিয়া আছে। মুখ দেখা গেল না, কিন্তু কেশতৈলের গন্ধ নাকে আসিল। ময়ূর গম্ভীর স্বরে কহিল— ‘কে তুমি?’

শীৎকারের ন্যায় নিশ্বাস টানার শব্দ হইল, তারপর ছায়ামূর্তি দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল। পলকের জন্য একটা আকৃতির ছায়াচিত্র বাহিরের স্বল্পালোকে দেখা দিয়াই অন্তর্হিত হইল। আগে যদি বা সন্দেহ ছিল এখন আর সন্দেহ রহিল না। তাহার অদৃশ্য অভিসারিকা নারীই বটে।

ময়ূর শয্যা হইতে নামিল না, মাথায় হাত দিয়া বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল। নারীর হাত হইতে তাহার নিস্তার নাই। নারীর জন্য তাহাকে গ্রাম ছাড়িতে হইয়াছে, এখন কি রাজ-আশ্রয় ছাড়িতে হইবে! কিন্তু কে এই নারী? রাজপুরীর দাসী-কিঙ্করীদের সকলকেই সে দেখিয়াছে; তাহাদের মধ্যে কয়েকটি নববয়স্কা যুবতী আছে। তাহারা তাহার পানে সাভিলাষ কটাক্ষ হানিয়াছে, কিন্তু সে দূরে সরিয়া গিয়া তাহাদের এড়াইয়া গিয়াছে। তাহাদেরই মধ্যে কেহ কি? কিন্তু যদি দাসী-কিঙ্করী না হয়। যদি— ময়ূর শিহরিয়া উঠিল— যদি রাজকুমারী হয়!

এখন সে কী করিবে! রাজাকে বলিবে? কিন্তু তিনি যদি বিশ্বাস না করেন। ভট্ট নাগেশ্বরকে বলিবে? না, বাচাল ব্রাহ্মণ এই কথা সর্বত্র রাষ্ট্র করিবেন; তাহাতে সুফল অপেক্ষা কুফলই অধিক ফলিতে পারে। অনেক চিন্তা করিয়া ময়ূর স্থির করিল, অভিসারিণী যদি আবার আসে তাহাকে ধরিতে হইবে, তারপর অবস্থা বুঝিয়া কার্য করিতে হইবে।

তৃতীয়বার অভিসারিকা আসিল আরও চার-পাঁচ দিন পরে। এবার ময়ূর প্রস্তুত ছিল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে এক লাফে উন্মুক্ত দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইল। নারী হঠাৎ ভয় পাইয়া ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া তাহার পাশ কাটাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিল। ময়ূর তাহার হাত ধরিয়া ফেলিল। পুষ্টাঙ্গ চাঁদের আলোয় চিনিতে কষ্ট হইল না, কুমারী সোমশুক্লার পরিচারিকা চঞ্চরী।

ময়ূর চঞ্চরীকে আগে কয়েকবার দেখিয়াছে, কিন্তু তাহার উগ্র রূপ ময়ূরকে আকর্ষণ করিতে পারে নাই, বরং প্রতিহত করিয়াছে। বিশেষত সে ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে চঞ্চরীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়াছিল, দুর্বৃত্ত ম্লেচ্ছ রাজার জারজ কন্যা। ইহাতে তাহার মন আরও বিমুখ হইয়াছিল।

ময়ূর চাপা তর্জন করিয়া বলিল— ‘তুমি কেন আমার ঘরে এসেছিলে?’

চঞ্চরী উত্তর দিল না, আঁকিয়া-বাঁকিয়া ময়ূরের হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল। সে কেন ময়ূরের ঘরে আসিয়াছিল নিজেই বোধ হয় জানে না; সে অনূঢ়া অনভিজ্ঞা, কেবল অন্ধ প্রকৃতির তাড়নায় ময়ূরের সংসর্গ কামনা করিয়াছিল। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, কিন্তু যৌবনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা পূর্ণমাত্রায় দেখা দিয়াছে।

ময়ূর বলিল— ‘চল, তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাই।’

এই সময় পিছন হইতে কণ্ঠস্বর আসিল— ‘ময়ূরভদ্র!’

ময়ূর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল অচ্ছাভ চাঁদের আলোয় দু’টি নারীমূর্তি অদূরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। একজন রাজকন্যা সোমশুক্লা, অন্যজন দাসী সীমন্তিনী। ময়ূর চঞ্চরীর হাত ছাড়িয়া দিল, চঞ্চরী অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

চঞ্চরী রাত্রে তাহার মাতার কক্ষে শয়ন করে। আজ রাত্রে সীমন্তিনী হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া দেখিল চঞ্চরী শয্যায় নাই। সে ছুটিয়া রাজকুমারীর কক্ষে গিয়াছিল, রাজকুমারীও জাগিয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু চঞ্চরী সেখানে নাই। তখন দুইজনে চুপি চুপি চঞ্চরীকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিলেন।

সীমন্তিনী অগ্রসর হইয়া আসিয়া চঞ্চরীর চুলের মুঠি ধরিল, অনুচ্চস্বরে ময়ূরকে বলিল— ‘ভদ্র, এবার চঞ্চরীকে ক্ষমা করুন। ও আমার কন্যা। আমি ওকে শাসন করব। আর কখনো ও আপনাকে বিরক্ত করবে না।’

ময়ূর স্থির দৃষ্টিতে রাজকন্যার পানে চাহিয়া ছিল, সেইভাবে থাকিয়াই বিরসকণ্ঠে বলিল— ‘ভাল।’

সীমন্তিনী চঞ্চরীর চুলের মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে টানিয়া লইয়া গেল। সোমশুক্লা দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ময়ূর মুখ তুলিয়া চাঁদের পানে চাহিল। চাঁদ হাসিতেছে, চারিদিকে শারদ রাত্রির স্নিগ্ধ শীতলতা। একটি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ময়ূর মুখ নামাইল, দেখিল কুমারী তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহার উন্নমিত মুখে বিচিত্র হাসি। তিনি লঘু স্বরে বলিলেন— ‘ময়ূরভদ্র, আপনার জীবনে এরূপ অভিজ্ঞতা বোধ হয় নূতন নয়।’

ময়ূর চকিত হইয়া বলিল— ‘না। আমার জীবনকথা আপনি জানেন?’

শুক্লা বলিলেন— ‘ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে শুনেছি।’

ময়ূর প্রশ্ন করিল— ‘সব কথা শুনেছেন? আমি অজ্ঞাতকুলশীল তা জানেন?’

শুক্লা বলিলেন— ‘জানি। আপনি স্ত্রীজাতির প্রতি বিরূপ, তাও জানি।’

ময়ূর ব্যস্ত স্বরে বলিল— ‘বিরূপ নয় দেবি! আমি— আমি—’

‘স্ত্রীজাতিকে এড়িয়ে চলেন। তা চলুন, কিন্তু কাজটি সহজ নয়।’ কুমারীর কণ্ঠে অতি মৃদু হাসির মূর্ছনা উত্থিত হইয়াই মিলাইয়া গেল। তাঁহার দেহটিও যেন চন্দ্রকিরণে গলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

ময়ূর অনিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল।

ছয়

পঞ্চমপুরের রাজসংসারে আশ্রয়লাভ করিবার পর ময়ূরের জীবনযাত্রায় একটি মন্দমন্থর ছন্দ আসিয়াছিল, দুই মাস পরে সেই ছন্দের যতিভঙ্গ হইল। রাজা ভূপ সিংহ তাহাকে নিভৃত কক্ষে আহ্বান করিয়া বলিলেন— ‘উপবেশন কর। তোমার প্রকৃত কর্মের সময় উপস্থিত।’

ময়ূর রাজার সম্মুখে বসিল। ভূপ সিংহ কিয়ৎকাল গভীর দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া ধীরস্বরে বলিলেন— ‘ময়ূর, গত দুই মাস ধরে আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি, এবং তোমার গতিবিধি লক্ষ্য করেছি। আমার বিশ্বাস জন্মেছে, যে-কাজের ভার আমি তোমাকে দেব তা তুমি পারবে।’

ময়ূর জোড়হস্তে বলিল— ‘আজ্ঞা করুন আর্য।’

রাজা বলিলেন— ‘তোমাকে দিল্লী যেতে হবে। কিন্তু একা নয়, তোমার সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক থাকবে।’

রাজা সপ্রশ্ন নেত্রে ময়ূরের পানে চাহিলেন, ময়ূর তিলমাত্র বিচলিত না হইয়া নিষ্পলকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল— ‘তারপর আজ্ঞা করুন আর্য।’

রাজা সন্তোষের নিশ্বাস ফেলিলেন— ‘দিল্লী এখান থেকে বহুদূর, পথও অতি দুর্গম। দিল্লী ম্লেচ্ছ জাতির রাজধানী, সেখানকার ম্লেচ্ছগণ ঘোর দুর্বৃত্ত এবং দুর্নীতিপরায়ণ, সেখানে হিন্দুর জীবনের কোনো মূল্য নেই। তোমাকে এই শত্রুপুরীতে যেতে হবে একটি সুন্দরী নারীকে নিয়ে। তোমার দায়িত্ব কতখানি বুঝতে পারছ?’

‘পারছি মহারাজ। তারপর আদেশ করুন।’

‘তুমি যাকে নিয়ে যাবে তার নাম চঞ্চরী। তাকে বোধ হয় দেখেছ, সে সুন্দরী। কোনো বিশেষ কারণে আমি তাকে আলাউদ্দিনের কাছে উপঢৌকন পাঠাতে চাই।’

রাজা ক্ষণেকের জন্য নীরব হইলেন, ময়ূরও চুপ করিয়া রহিল; সে যে ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে চঞ্চরীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়াছে তাহার আভাসমাত্র দিল না।

রাজা আবার আরম্ভ করিলেন— ‘কেন আমি চঞ্চরীকে আলাউদ্দিনের কাছে পাঠাচ্ছি তা জানতে চেয়ো না, গূঢ় রাজনৈতিক কারণ কাছে। তুমি কেবল চঞ্চরীকে দিল্লীতে নিয়ে যাবে, সেখানে পৌঁছে চেষ্টা করবে চঞ্চরী যাতে আলাউদ্দিনের দৃষ্টিপথে পড়ে, সুন্দরী নারী দেখলেই সে তাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। তুমি প্রতিরোধ করবে না, আলাউদ্দিনকে মারবার চেষ্টা করবে না। তারপর সাতদিন অতীত হলে এই পত্রটি কোনো উপায়ে তার কাছে পৌঁছে দেবে।’

জতুমুদ্রানিবদ্ধ একটি ক্ষুদ্রাকৃতি পত্র তিনি ময়ূরের হাতে দিলেন। সে দেখিল রাজার কপালের শিরা-উপশিরা স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে, চক্ষুর্দ্বয় রক্তাভ। কিন্তু তিনি বীরভাবে বলিলেন— ‘এই তোমার কাজ। তুমি অশ্বপৃষ্ঠে যাবে, চঞ্চরী দোলায় থাকবে। দশজন সশস্ত্র বাহক তোমাদের সঙ্গে থাকবে, তারা দোলা বহন করবে, যদি পথে দস্যু-তস্কর আক্রমণ করে তারা লড়াই করবে। দস্যু-তস্কর সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখলে অপহরণের চেষ্টা করতে পারে, তুমি সর্বদা সতর্ক থাকবে।’

রাজা বক্তব্য শেষ করিলে ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল— ‘কবে যাত্রা করতে হবে?’

রাজা বলিলেন— ‘কাল প্রত্যূষে। সমস্ত উদ্যোগ আয়োজন প্রস্তুত আছে। তুমি আমার আদেশ বর্ণে বর্ণে পালন করবে।’

ময়ূর শুধু বলিল— ‘হাঁ মহারাজ।’

রাজা বলিলেন— ‘বৎসরাবধি কাল আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষা করব। যদি কার্যসিদ্ধি করে ফিরে আসতে পারো, তোমাকে অদেয় আমার কিছুই থাকবে না। আশীর্বাদ লও বৎস।’

সে-রাত্রে ময়ূর ঘুমাইতে পারিল না, শয্যায় শুইয়া আসন্ন যাত্রা সম্বন্ধে নানা কথা চিন্তা করিতে লাগিল। কি করিয়া কোন্ কার্য করিবে, বিপদে পড়িলে কিভাবে আচরণ করিবে, তাহার ধনুর্বিদ্যা কোন্ কাজে লাগিবে, এইসব চিন্তা। চঞ্চরীর ভাগ্যের কথা সে অধিক চিন্তা করিল না, চঞ্চরী এই চতুরঙ্গ খেলার ক্রীড়নক, অদৃষ্ট তাহাকে নিয়ন্ত্রিত পথে লইয়া যাইতেছে। ময়ূর নিমিত্ত মাত্র।

এইসব ভাবনার মধ্যে রাত্রি তিন প্রহর কাটিয়া গেল। ঘরের বাহিরে অনিমেষ জ্যোৎস্না, যেন প্রকৃতির অঙ্গে রূপালী তবক মুড়িয়া দিয়াছে। ময়ূর শয্যায় উঠিয়া বসিল। রাত্রি শেষ হইতে বেশি বিলম্ব নাই।

দ্বারের বাহিরে একটি নিঃশব্দ মূর্তি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। চন্দ্রালোকে মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। ময়ূরের হৃদ্‌যন্ত্র দুন্দুভির ন্যায় ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সে ত্বরিতে উঠিয়া মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইল।

‘রাজনন্দিনি।’

সোমশুক্লা স্থিরায়ত নেত্রে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন, কথা বললেন না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর ময়ূর হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল— ‘ভেবেছিলাম যাত্রার আগে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না।’

সোমশুক্লা এবার কথা বলিলেন, তাঁহার কণ্ঠ একটু কাঁপিয়া গেল, — ‘ময়ূরভদ্র, আমার এই শঙ্খ-কঙ্কণ আপনি গ্রহণ করুন। এটি সঙ্গে রাখবেন, আপনার কল্যাণ হবে।’

ক্ষণকাল নিশ্চল থাকিয়া ময়ূর সোমশুক্লার সম্মুখে নতজানু হইল, অঞ্জলিবদ্ধ হস্ত তাঁহার দিকে প্রসারিত করিল। সোমশুক্লা মণিবন্ধ হইতে কঙ্কণ খুলিয়া তাহার অঞ্জলিতে রাখিলেন। ময়ূর রুদ্ধ স্বরে বলিল— ‘দেবি, আমি আর কী বলব? আমি— আমি—’

সোমশুক্লা অঙ্গুলি দিয়া তাহার ললাট স্পর্শ করিলেন, মৃদুস্বরে বলিলেন— ‘এখন কিছু বলবেন না। আপনি ফিরে আসুন, তারপর আপনার কথা আপনি বলবেন, আমার কথা আমি বলব।’

উদ্বেল হৃদয়ে ময়ূর মস্তক নত করিল।

সোমশুক্লা প্রাসাদে ফিরিয়া গেলেন। নিজ কক্ষে গেলেন না, ক্ষণেক ইতস্তত করিয়া সীমন্তিনীর কক্ষের বাহিরে দ্বারের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন।

ঘরে দীপ জ্বলিতেছে। চঞ্চরী উত্তেজিত হাসিমুখে মায়ের সম্মুখে বসিয়া আছে, সীমস্তিনী তাহাকে বস্ত্র-অলঙ্কারে সাজাইয়া দিতেছে। সীমন্তিনীর মুখ কঠিন কিন্তু তাহার দুই চক্ষু দিয়া অবশে অশ্রুধারা ঝরিয়া পড়িতেছে। রাজকুমারী ছায়ার মতো দ্বারের নিকট হইতে সরিয়া গেলেন। —

ঊষাকালে ক্ষুদ্র যাত্রীদলের দুরদুর্গম যাত্রা আরম্ভ হইল।

দ্বিতীয় আবর্ত – এক

দুই মাস পরে একটি শীতের অপরাহ্ণে ময়ূর চঞ্চরীকে লইয়া দিল্লীর উপকণ্ঠে পৌঁছিল।

পথে কোনও বিপদ আপদ ঘটে নাই। ভাগ্যক্রমে তাহারা মথুরাযাত্রী একদল হিন্দু বণিকের সঙ্গ পাইয়াছিল; বণিকদের সঙ্গে সশস্ত্র রক্ষী ছিল। তিনদিন পূর্বে বণিকদল মথুরায় নামিয়া গেল; বাকি পথটুকু ময়ূর নিঃসঙ্গভাবেই অতিক্রম করিয়াছে, কিন্তু কোনও উপদ্রব হয় নাই। চঞ্চরীও কোনও প্রকার গণ্ডগোল করে নাই। সেই রাত্রে ধরা পড়িবার পর হইতে সে মনে মনে ময়ূরকে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে, প্রগল্ভতা করিবার সাহস আর নাই। ময়ূর যখন যে আদেশ করে সে নির্বিচারে তাহা পালন করে।

দিল্লীর দক্ষিণ তোরণদ্বার হইতে অর্ধ-ক্রোশ দূরে একটি হিন্দু পান্থশালা পাইয়া ময়ূর এখানেই যাত্রা স্থগিত করিল। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে নগরদ্বার বন্ধ হইয়া যায়, সুতরাং আজ রাত্রিটা পান্থশালায় কাটাইয়া কাল প্রভাতে নগরে প্রবেশ করাই ভাল।

পান্থশালাটি সুপরিসর; মাঝখানে পট্টাবৃত উঠান, চারিদিক ঘিরিয়া ছোট ছোট কুঠুরি। ময়ূর একটি কুঠুরি ভাড়া লইল। তাহাতে চঞ্চরী থাকিবে, অন্য সকলে কুঠুরির দ্বার ঘিরিয়া উঠানে শয়ন করিবে।

হস্তমুখ প্রক্ষালন করিয়া ময়ূর পান্থপালকে ডাকিল, রাত্রির আহারের নির্দেশ দিয়া পান্থশালার বাহিরে গিয়া দাঁড়াইল। কাল দিল্লী প্রবেশ করিতে হইবে, কিছুক্ষণ নির্জনে চিন্তা করা প্রয়োজন।

সূর্যাস্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু শীতের দীর্ঘ সন্ধ্যা এখনও নির্বাপিত হয় নাই। পান্থশালার সম্মুখের পথটি জনশূন্য, আশেপাশে বেশি লোকালয় নাই, ইতস্তত দুই-একটি কুটির দেখা যায়। উত্তর দিকে অর্ধ-ক্রোশ দূরে দিল্লীর কৃষ্ণবর্ণ প্রাকার ঘনায়মান অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছে; যেন একটা বিপুলকায় হস্তী ভূমিতে উপবিষ্ট হইয়া শুণ্ড ঊর্ধ্বে তুলিয়া আছে। ময়ূর জানে না যে ওই ঊর্ধ্বোত্থিত শুণ্ডই জগৎবিখ্যাত কুতবমিনার।

চিন্তাক্রান্ত মুখে পান্থশালার সম্মুখে পাদচারণ করিতে করিতে ময়ূরের চোখে পড়িল, পান্থশালার প্রাচীরগাত্রে সংলগ্ন একটি অতি ক্ষুদ্র বিপণি রহিয়াছে। ফলের ও শাকসব্‌জির দোকান। একটি স্ত্রীলোক মঞ্চের উপর বসিয়া আছে। পান্থশালায় যাহারা আসে তাহাদের মধ্যে স্বপাকভোজী কেহ থাকিলে বোধ করি এই দোকান হইতে ফলমূল শাকপত্র ক্রয় করে।

নিতান্ত কৌতূহলবশেই ময়ূর দোকানের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। মঞ্চের উপর শুষ্ক এবং তাজা দুই প্রকার ফলই সাজানো রহিয়াছে; ডালিম, দ্রাক্ষা, খেজুর এবং আরও অনেক জাতের অপরিচিত ফল। সে একটি সুপক্ক ডালিম তুলিয়া লইয়া পসারিনীর মুখের পানে চোখ তুলিল।

রমণীর মুখের উপর হইতে ময়ূরের দৃষ্টি যেন প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসিল। মুখখানা অস্বাভাবিক রকম কৃষ্ণবর্ণ; বরং কৃষ্ণবর্ণ না বলিয়া নীলবর্ণ বলিলেই ভাল হয়। ময়ূর ক্ষণিক বিস্ময় সংবরণ করিয়া বলিল— ‘এই ডালিমের দাম কত?’

রমণীও একদৃষ্টে ময়ূরের পানে চাহিয়া ছিল। তাহার মুখ দেখিয়া বয়স অনুমান করা যায় না, তবে বৃদ্ধা নয়। সে বলিল— ‘ফলের দাম এক দ্রম্ম। তুমি দক্ষিণ থেকে আসছ, তোমার দেশ কোথায়?’

নবাগত যাত্রীকে এরূপ প্রশ্ন করা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু ময়ূর সতর্ক হইল; রমণীকে এক দ্রম্ম দিয়া তাচ্ছিল্যভরে বলিল— ‘নর্মদার পরপারে।’ তারপর সুন্দর পাকা ফলটি দুই হাতে লোফালুফি করিতে করিতে পাদচারণ করিতে লাগিল। …সোমশুক্লা যে শঙ্খ-কঙ্কণ দিয়াছিলেন তাহা সে সুতা দিয়া গলায় ঝুলাইয়া রাখিয়াছে, আঙরাখার তলায় কঙ্কণ দেখা যায় না; কিন্তু ময়ূর বক্ষের উপর তাহার স্পর্শ অনুভব করে। কুমারী সোমশুক্লা—

সন্ধ্যা ঘন হইয়া আসিল। পসারিনী রমণী দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেছে, ময়ূর পান্থশালার কোণ পর্যন্ত গিয়া ফিরিবার উপক্রম করিল। বাহিরে বেশ ঠাণ্ডা, এবার পান্থশালার মধ্যে আশ্রয় লওয়া যাইতে পারে। এই সময় সে লক্ষ্য করিল, উত্তর দিক হইতে একটি লোক আসিতেছে। ছায়ান্ধকারে লোকটির অবয়ব ভাল দেখা গেল না; কিন্তু সে খঞ্জ, লাঠিতে ভর দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আসিতেছে। আরও কাছে আসিলে ময়ূর দেখিল লোকটির মুখে প্রচুর দাড়িগোঁফ রহিয়াছে, সম্ভবত মুসলমান। সে ফিরিয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে আহ্বান আসিল— ‘দয়ালু শ্রেষ্ঠি, বিকলাঙ্গ অক্ষমকে দয়া কর।’

ময়ূর আবার ফিরিল। সঙ্গে সঙ্গে খঞ্জ ভিক্ষুকটা লাঠি হাতে লইয়া দুই পায়ে দাঁড়াইল এবং ক্ষিপ্রহস্তে লাঠি তুলিয়া ময়ূরের মস্তকে সজোরে আঘাত করিল। ময়ূর আত্মরক্ষার সময় পাইল না; জ্ঞান হারাইবার পূর্বে সে রমণীকণ্ঠের একটি তীব্র চিৎকার শব্দ শুনিতে পাইল। তারপর আর কিছু তাহার মনে রহিল না।

জ্ঞান ফিরিয়া পাইয়া ময়ূর দেখিল সে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে শুইয়া আছে, ঘরের কোণে দীপ জ্বলিতেছে। একটি স্ত্রীলোক তাহার পাশে বসিয়া মাথায় ও কপালে জলের প্রলেপ দিতেছে। সে চিনিল, ফলের দোকানের পসারিনী।

প্রথমেই ময়ূর বুকে হাত দিয়া দেখিল, কঙ্কণ যথাস্থানে আছে। তখন সে বলিল— ‘খঞ্জ লোকটা কে?’

পসারিনী দ্বারের দিকে চাহিল। পান্থপাল সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল— ‘ওর নাম মামুদ, দিল্লীর দস্যু। ও সত্যই খঞ্জ নয়, খঞ্জের ভান করেছিল। দিল্লীর বাইরে পান্থশালার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। নূতন মুসাফিরকে একলা পেলে মাথায় লাঠি মেরে যথাসর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পালায়। দিল্লীতে এরকম ঠক্ রাহাজান অনেক আছে।’

পসারিনী বলিল— ‘ভাগ্যে আমি দেখতে পেয়েছিলাম, কাটারি নিয়ে ছুটে গেলাম। আমাকে দেখে মামুদ পালালো, নইলে তোমার সর্বস্ব কেড়ে নিত।’

ময়ূর শয্যায় উঠিয়া বসিল। মাথাটা টন্‌টন্‌ করিতেছে বটে, কিন্তু গুরুতর কিছু নয়। সে মুখ তুলিয়া দেখিল দ্বারের কাছে তাহার সঙ্গীরাও উৎকণ্ঠিত মুখে দাঁড়াইয়া আছে। সে হাসিমুখে হাত নাড়িয়া বলিল— ‘ভয় নেই, আমি অক্ষত আছি।’ তাহারা নিশ্চিন্ত হইয়া চলিয়া গেল।

ময়ূর পসারিনীকে বলিল— ‘এটি কি তোমার ঘর?’

পসারিনী বলিল— ‘হাঁ, আমি এই পান্থশালায় থাকি।’ ময়ূর উঠিয়া দাঁড়াইবার উপক্রম করিলে সে বলিল, — ‘উঠো না উঠো না, আরও খানিক শুয়ে থাকো, শরীর সুস্থ হবে।’

ময়ূর বসিল, কৃতজ্ঞ স্বরে বলিল— ‘তুমি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’

পসারিনী বলিল— ‘তুমি হিন্দু, আমার দেশের লোক। তোমার প্রাণ বাঁচাব না?’

ময়ূর কিছুক্ষণ পসারিনীর নীলবর্ণ মুখের পানে চাহিয়া রহিল, শেষে বলিল— ‘তুমি দক্ষিণ দেশের মানুষ?’

পসারিনী যেন একটু বিচলিত হইয়া পড়িল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল— ‘হাঁ। অনেক দিন দেশ ছাড়া। এই পান্থশালায় দোকান করেছি, দক্ষিণ দেশ থেকে যারা আসে তাদের কাছে দেশের খবর পাই—’

এই সময় পান্থপাল এক পাত্র গরম দুধ আনিল; পসারিনী বলিল— ‘গরম দুধ টুকু খাও, শরীর সুস্থ হবে।’

ময়ূর দুগ্ধ পান করিয়া শরীরে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিল। পান্থপাল শূন্য পাত্র লইয়া যাইবার পর পসারিনী বলিল— ‘তুমি নর্মদার ওপর থেকে আসছ, কিন্তু রাজ্যের নাম তো বললে না।’

ময়ূর একটু ইতস্তত করিল। কিন্তু প্রাণদাত্রীর কাছে মিথ্যা বলা চলে না, সে বলিল— ‘পঞ্চমপুরের নাম শুনেছ?’

পসারিনীর চক্ষু ধক্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ময়ূর এবার পসারিনীর মুখ ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। মুখের বর্ণ নীল বটে, কিন্তু গঠন অতি সুন্দর, আভিজাত্যব্যঞ্জক। এই গঠনের মুখ সে যেন কোথায় দেখিয়াছে।

পসারিনী যখন কথা বলিল তখন তাহার কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন উত্তেজনার ঝঙ্কার শোনা গেল— ‘পঞ্চমপুরের নাম শুনেছি। তুমি পঞ্চমপুর থেকে আসছ?’

ময়ূর বলিল— ‘হাঁ।’

‘পঞ্চমপুরের সকলকে চেনো?’

‘সকলকে চিনি না। ভট্ট নাগেশ্বরকে চিনি।’

‘ভট্ট নাগেশ্বর!’ নামটি পসারিনী পরম স্নেহভরে আস্বাদন করিয়া উচ্চারণ করিল— ‘আর কাকে চেনো?’

ময়ূর বলিল— ‘আমার অন্তরাত্মা বলছে তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি। — আমি রাজপুরীর সকলকে চিনি, রাজা ভূপ সিংহ আমার প্রভু।’

পসারিনীর চক্ষু দুইটি অন্তর্বাষ্পে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। অতঃপর ময়ূর সসম্ভ্রমে বলিল— ‘আপনাকে সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলা মনে হচ্ছে। কিন্তু— আপনার—’

‘মুখ কালো?’ পসারিনী হাসিল! সুন্দর দন্তপংক্তির রেখা ঈষৎ দেখা গেল।

ময়ূর বিস্ফারিত চক্ষে কিয়ৎকাল চাহিয়া থাকিয়া করজোড়ে বলিল— ‘আপনাকে চিনেছি।’

পসারিনী বলিল— ‘চিনেছ! কি করে চিনলে?’

ময়ূর বলিল— ‘আপনার হাসি দেখে। রাজকন্যা সোমশুক্লার হাসি ঠিক আপনার মতো।’

‘সোমশুক্লা! ওঃ, তার বয়স এখন সতেরো বছর।’ পসারিনী সহসা দু’হাতে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

কিছুক্ষণ কাটিবার পর ময়ূর স্খলিত স্বরে বলিল— ‘কিন্তু দেবি, আপনি এখানে— এভাবে—’

চক্ষু মুছিয়া পসারিনী বলিল— ‘আমার কথা পরে হবে। আগে তুমি সব কথা বল। কুমার রামরুদ্র ভাল আছেন?’

ময়ূর হেঁটমুখে বলিল— ‘কুমার রামরুদ্র বেঁচে নেই। নয় বছর আগে রাজা তাঁকে দিল্লী পাঠিয়েছিলেন বংশের কলঙ্কমোচনের জন্য, আলাউদ্দিনের জল্লাদের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’

পসারিনী কপালে করাঘাত করিয়া আবার কাঁদিল। শেষে অশ্রু সংবরণ করিয়া বলিল— ‘হায়, রামরুদ্রের সঙ্গে যদি আমার দেখা হত। নয় বছর আগে আমি এখানেই ছিলাম। সবই বিধিলিপি। কিন্তু এখন রাজা তোমাকে কি জন্য পাঠিয়েছেন তাই বল।’

আর গোপনতার প্রয়োজন ছিল না, ময়ূর যাহা যাহা জানিত সব বলিল। পসারিনী সর্বগ্রাসী চক্ষু মেলিয়া শুনিতে লাগিল; শুনিতে শুনিতে কখনও তাহার চক্ষু উদ্দীপনায় স্ফুরিত হইল, কখনও হিংসায় প্রখর হইল। বিবৃতির অন্তে সে দীর্ঘকাল করলগ্ন কপোলে বসিয়া থাকিয়া শেষে বলিল— ‘পিতা প্রতিহিংসার উত্তম উপায় উদ্ভাবন করেছেন। ম্লেচ্ছ রাক্ষস ভোগের জন্য পাগল, কিন্তু তার মনে একটিমাত্র বাধা আছে; নিজের কন্যা—। এখনো আলাউদ্দিনের ভোগক্ষুধা মেটেনি। — যাক, দৈব অনুকূল, তাই আমার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে। তুমি একা এ কার্য সাধন করতে পারতে না।’

ময়ূর নিজ বক্ষস্থিত শঙ্খ-কঙ্কণটি একবার স্পর্শ করিল, মনে মনে বলিল— সত্যই দৈব অনুকূল, এই শঙ্খ আমার ভাগ্যদাতা। মুখে বলিল— ‘দেবি, ভাগ্যবশে আপনার সাক্ষাৎ পেয়েছি। কিন্তু এবার আপনার কথা বলুন।’

শিলাবতী তখন ভূমিসংলগ্ন নেত্রে ধীরে ধীরে নিজের মর্মন্তুদ কাহিনী বলিলেন—

আলাউদ্দিনের সঙ্গে সাত-আট হাজার অশ্বারোহী সৈন্য এবং দশ-বারোটা হাতি ছিল। শিলাবতীকে হাতির পিঠে তুলিয়া সে সসৈন্যে দক্ষিণ দিকে চলিল। দেবগিরির উত্তুঙ্গ দুর্গের সম্মুখে দুইবার ভীষণ যুদ্ধ হইল; হাতির পিঠে বসিয়া শিলাবতী যুদ্ধ দেখিলেন। এমন বীভৎস দৃশ্য পৃথিবীতে আর নাই। তারপর বহু ধনরত্ন হাতির পিঠে তুলিয়া ম্লেচ্ছরা ফিরিয়া চলিল। প্রথমে তাহারা গেল প্রয়াগের নিকট কারা-মানিকপুর নামক স্থানে। সেখানে আলাউদ্দিনের প্রধানা বেগম এবং অন্যান্য বহু স্ত্রীলোক ছিল; শিলাবতীও হারেমে স্থান পাইলেন।

এই কারা-মানিকপুরেই আলাউদ্দিন বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা তাহার পিতৃব্য সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করে, তারপর পিতৃব্যের মুণ্ড বর্শাফলকে তুলিয়া দিল্লী যাত্রা করে এবং সিংহাসন অধিকার করে।

শিলাবতীও আসিয়া দিল্লীর হারেমে রহিলেন। সেখানে নিত্য নবযৌবনা সুন্দরীর আবির্ভাব। যাহারা পুরাতন হইয়াছে তাহারা সহসা কোথায় অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে কেহ জানে না। হারেমে ক্ষুন্নযৌবনার স্থান নাই।

হারেমে একটি দাসী ছিল, তাহার নাম ছিল কপোতী। সে অনেক শিল্পবিদ্যা জানিত— পান সাজা, মালা গাঁথা, অলকা-তিলক আঁকা, আরও কত কি। সে আদৌ হিন্দু ছিল, তাহাকে গো-মাংস খাওয়াইয়া মুসলমান করা হইয়াছিল। কিন্তু মনে মনে সে হিন্দু ছিল। হারেমের মেয়েরা তাহাকে কবুতর বিবি বলিয়া ডাকিত। এই কবুতর বিবি প্রথম হইতেই শিলাবতীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, সুযোগ পাইলেই আসিয়া দু’দণ্ড গল্প করিত; শিলাবতীর দুঃসহ জীবন এই বিগতযৌবনা দাসীর সাহচর্যে কিঞ্চিৎ সহনীয় হইয়াছিল।

দুই বৎসর কাটিবার পর হারেমে প্রবেশ করিলেন গুর্জরের রানী কমলা। তিনি অলৌকিক রূপবতী এবং রতিশাস্ত্রে সুপণ্ডিতা ছিলেন; অল্পকাল মধ্যেই তিনি আলাউদ্দিনকে বশীভূত করিলেন। তারপর কমলার কটাক্ষ ইঙ্গিতে হারেম হইতে উপপত্নীরা একে একে অন্তর্হিত হইতে লাগিল। একদিন কবুতর বিবি চুপি চুপি আসিয়া শিলাবতীকে জানাইল— ‘খবর পেয়েছি তোমাকে সরাবার চেষ্টা হচ্ছে। ঘোড়াশোলের সর্দার-সহিসের ওপর সুলতান খুশি হয়েছেন, তোমাকে তার হাতে দান করবেন।’

শুনিয়া ঘৃণায় শিলাবতীর দেহ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। তিনি কবুতর বিবির পদতলে পড়িয়া বলিলেন— ‘আমাকে বাঁচাও। আমি হারেম থেকে পালিয়ে যেতে চাই।’

কবুতর বিবি বলিল— ‘পালানো কি সহজ? হারেমের ফটকে কড়া পাহারা।’

শিলাবতী বলিলেন— ‘তুমি উপায় কর, আমি তোমার কেনা হয়ে থাকব।’

কবুতর বিবি তখন বলিল— ‘আমি এক বিদ্যা জানি, তার জোরে তুমি পালাতে পারবে, রক্ষীরা তোমাকে হাবসি দাসী ভেবে পথ ছেড়ে দেবে।’

সেই রাত্রে কবুতর বিবি শিলাবতীর মুখে ও হাতে সূচী ফুটাইয়া ফুটাইয়া উলকি কাটিয়া দিল, অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করিয়া শিলাবতী উলকি পরিলেন, তাঁহার মুখ ও হাতের শুভ্রতা উলকির নীলবর্ণে ঢাকা পড়িল।

পরদিন তিনি মাথায় জলের কলস লইয়া হারেম হইতে বাহির হইলেন। হারেমের হাবসি দাসীরা অন্দরে-বাহিরে নিত্য যাতায়াত করে; শিলাবতীর স্ফীত কৃষ্ণবর্ণ মুখের পানে রক্ষীরা তাকাইল না, পথ ছাড়িয়া দিল।

হারেমের বাহিরে কিয়দ্দূর আসিয়া তিনি কলস ফেলিয়া দিয়া নগরের দক্ষিণ দ্বারের দিকে চলিলেন; তোরণ পার হইয়া সিধা পথ ধরিয়া চলিলেন। কোথায় যাইতে হইবে তাহা জানেন না, কেবল দক্ষিণ দিকে চলিয়াছেন।

এই পান্থশালা পর্যন্ত আসিয়া তাঁহার আর চলৎশক্তি রহিল না। পান্থপাল তাঁহাকে ভিতরে লইয়া গেল। তদবধি শিলাবতী এই পান্থশালায় আছেন। পান্থপাল পঞ্চমপুরের লোক, সে তাঁহার প্রকৃত পরিচয় জানে। সে তাঁহাকে পঞ্চমপুরে ফিরিয়া যাইবার জন্য নির্বন্ধ করিয়াছিল, কিন্তু তিনি যান নাই। কোন্ মুখ লইয়া পিতার সম্মুখে দাঁড়াইবেন?

অনন্তর চৌদ্দ বৎসর এই পান্থশালায় ফল বিক্রয় করিয়া কাটিয়াছে। কেহ তাহাকে চিনিতে পারে নাই। শিলাবতী নাম্নী হতভাগিনী রাজকন্যা মরিয়া গিয়াছে।

তারপর আজ—

আত্মকাহিনী শেষ করিয়া শিলাবতী অঙ্গারের ন্যায় চক্ষু তুলিলেন, বলিলেন— ‘না, শিলাবতী এখনো মরেনি।’

তারপর তিনি উঠিয়া ঘরের বাহিরে গেলেন। অল্পকাল পরে তিনি ও পান্থপাল ময়ূরের রাত্রির আহার লইয়া উপস্থিত হইলেন। শিলাবতী বলিলেন— ‘তুমি আহার কর। তোমার সঙ্গীরা নৈশাহার শেষ করে শয়ন করেছে, চঞ্চরীও ঘুমিয়েছে। তুমি আহার করে নাও, তারপর পরামর্শ হবে।’

ময়ূর বলিল— ‘আপনি আহার করবেন না?’

শিলাবতী বলিলেন— ‘না, ময়ূর ভাই, আজ আমার গলা দিয়ে অন্ন নামবে না।’

পান্থপাল আসন পাতিয়া, জলের ঘটি রাখিয়া চলিয়া গেল। পান্থপালটি অতি স্বল্পবাক্ মানুষ, নীরবে কাজ করিয়া যায়। ময়ূর আহারে বসিল।

আহারান্তে মন্ত্রণা আরম্ভ হইল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত মন্ত্রণা চলিল।

দুই

পরদিন প্রাতঃকালে ময়ূর, চঞ্চরী ও শিলাবতী সাজসজ্জা করিয়া বাহির হইলেন। অদ্ভুত তাঁহাদের পরিচ্ছদ; ময়ূরের পরিধানে পায়জামা, মাথায় টোপ, হাতে ধনুর্বাণ; শিলাবতী কৃষ্ণবস্ত্রে দেহ আবৃত করিয়া মাথায় ফলের ঝুড়ি লইয়াছে; চঞ্চরীর শরীর আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। তিনজনে পদব্রজে দিল্লীর দিকে চলিলেন। সঙ্গীরা পান্থশালায় রহিল; তাহাদের কাজ আপাতত শেষ হইয়াছে।

দিল্লীর দক্ষিণ দ্বারে মানুষ গরু গাধা উটের ভিড়। অধিকাংশ প্রবেশ করিতেছে, কিছু বাহিরে আসিতেছে। দিল্লীর প্রাকারচক্রের বাহিরে মানুষের বসতি কম নয়।

দিল্লী নগরী প্রাগৈতিহাসিক কাল হইতে হিন্দু রাজার রাজধানী ছিল, কিঞ্চিদধিক শতবর্ষ পূর্বে মুসলমানেরা তাহা অধিকার করিয়াছে। স্থাপত্য শিল্পে দুই জাতীয় শিল্পকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। বড় বড় অট্টালিকা ও মসজিদ আছে, কিন্তু পথগুলি সংকীর্ণ। নগরের আনাচে-কানাচে নিম্নতন শ্রেণীর মানুষের বাস। কোনোটি হিন্দুপল্লী, কোনোটি মুসলমান-মহল্লা। রাজভবনের চারিপাশে অনেকখানি উন্মুক্ত স্থান, এখানে অহোরাত্র অশ্বারোহী রক্ষীর দল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সর্বোপরি কুতবমিনারের অভ্রংলিহ শিখর নগরীর শিয়রে দাঁড়াইয়া ইসলামের জয় ঘোষণা করিতেছে।

তিনজনে নগরে প্রবেশ করিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইল; দূর হইতে রাজপ্রাসাদ দেখিল। প্রাসাদের শীর্ষে বহু পারাবত উড়িতেছে। সুলতান আলাউদ্দিনের পায়রা পোষার শখ আছে, বিশেষত দূত-পারাবত। শত ক্রোশ দূরে ছাড়িয়া দিলেও তাহারা স্বস্থানে ফিরিয়া আসে।

নগরদর্শন শেষ করিতে দ্বিপ্রহর হইল। তখন ময়ূর দরিদ্র হিন্দুপল্লীতে গিয়া বাসা ভাড়া লইল। দুইটি ক্ষুদ্র ঘর, সম্মুখে সংকীর্ণ দালান; দুইটি ঘরের একটিতে ময়ূর থাকিবে, অন্যটিতে থাকিবে শিলাবতী ও চঞ্চরী। চাল-ডাল, হাঁড়ি-কলসি কিনিয়া তিনজনে সংসার পাতিয়া বসিল। কতদিন থাকিতে হইবে তাহার স্থিরতা নাই।

আজ সকালে শিলাবতীর কালো মুখ দেখিয়া চঞ্চরী ভয় পাইয়াছিল, ক্রমে ভয় কাটিয়াছে। সে ঘরে আসিয়া বোরকা খুলিয়া ফেলিল। উচ্ছলিত কণ্ঠে বলিল— ‘কী সুন্দর নগর! কত মানুষ, কত বাড়ি। কী উঁচু স্তম্ভ! আমি আর ফিরে যাব না, এখানেই থাকব।’

শিলাবতী শুষ্ক স্বরে বলিলেন— ‘সেই চেষ্টাই হচ্ছে।’

অপরাহ্ণে তাঁহারা আবার বাহির হইলেন। ময়ূর রাস্তার একটা চৌমাথায় তীর-ধনুকের খেলা দেখাইল। শূন্যে তীর ছুঁড়িয়া দ্বিতীয় তীর দিয়া ফিরাইয়া আনিল। চঞ্চরীর বোরকা-ঢাকা মাথায় ডালিম রাখিয়া তীর দিয়া ডালিম বিদ্ধ করিল। অনেকগুলি দর্শক জুটিয়া গিয়াছিল, ময়ূর কিছু পয়সা পাইল।

পরদিন সকালে তাহারা আবার বাহির হইল। এবার ময়ূর নগরের অন্যদিকে গিয়া খেলা দেখাইল। ধীরে ধীরে তাহারা রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হইতেছে।

অপরাহ্ণে তাহারা প্রাসাদের আরও নিকটস্থ হইল। এখানে সিপাহী দর্শকের সংখ্যাই বেশি, কিছু সাধারণ নাগরিকও আছে। দুই-একটি প্রৌঢ়া বৃদ্ধা স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া খেলা দেখিতেছে।

খেলা দেখাইতে দেখাইতে ময়ূর লক্ষ্য করিল, ভিড়ের মধ্যে একজন লোক আছে যাহাকে সে পূর্বে দেখিয়াছে; খঞ্জ সাজিয়া যে তাহার মাথায় লাঠি মারিয়াছিল সেই মামুদ। মামুদকে সে চিনিতে পারিলেও মামুদ তাহাকে নূতন বেশভূষায় চিনিতে পারে নাই; শিলাবতীর গুণ্ঠন-ঢাকা মুখও দেখিতে পায় নাই। মামুদের খঞ্জভাব এখন আর নাই, সে একাগ্র চক্ষে খেলা দেখিতেছে। ময়ূর নির্বিকার মুখে খেলা দেখাইয়া চলিল।

ভিড়ের মধ্যে একটি স্থূলকায়া প্রৌঢ়া রমণী নিষ্পলক নেত্রে শিলাবতীর অর্ধাবগুণ্ঠিত মুখ দেখিতেছিল; ক্রমে শিলাবতীর দৃষ্টি তাহার উপর পড়িল। দুইজনের চক্ষু অনেকক্ষণ পরস্পরের মুখে সম্বদ্ধ হইয়া রহিল।

তীর-ধনুকের খেলা শেষ হইলে দর্শকের দল ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। ময়ূর মাটি হইতে পয়সা কুড়াইতেছে এমন সময় মামুদ আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইল। মামুদের আকৃতি সরীসৃপের ন্যায়, চিবুকের নীচে চুটকি দাড়ি; পান চিবাইতে চিবাইতে দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল— ‘খাসা খেলা দেখিয়েছ! তুমি তো দিল্লীর লোক নও, মুলুক কোথায়?’

ময়ূর উত্তর দিল না, পয়সা কুড়াইয়া কোমরে রাখিল। মামুদ বলিল— ‘তা তুমি পাঠান মোগল উজবুক যে হও, আমার কি। কাছেই শরাবখানা আছে, চল না সেখানে খেলা দেখাবে। অনেক পয়সা পাবে।’

ময়ূর এবারও কথা বলিল না, শিলাবতীর দিকে তাকাইল। দেখিল, তিনি সেই স্থূলকায়া প্রৌঢ়া রমণীর সহিত কথা কহিতেছেন। দুই-চারিটি কথা বলিয়াই তিনি মুখ ফিরাইলেন, রমণী চলিয়া গেল।

মামুদ কিন্তু দমিবার পাত্র নয়, সে চঞ্চরীর দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল— ‘বোরকা-ঢাকা ওটি বুঝি তোমার বিবি? বিবি নিয়ে দিল্লীতে এসেছ, খুব সাবধান। এখানে খুবসুরৎ বিবি বেবাক চুরি যায়। তবে যদি ভাল মুসাফিরখানায় থাকো তাহলে ভয় নেই। আমি একটি ভাল মুসাফিরখানা জানি—’

ময়ূর ধনুতে শর-যোজনার ভান করিয়া বলিল— ‘বেশি কথা বললে পেট ফুটো করে দেব।’

মামুদ লাফাইয়া পশ্চাৎপদ হইল এবং দূরে দাঁড়াইয়া গলার মধ্যে গজগজ করিয়া বোধ করি তুর্কী ভাষায় খিস্তিখেউড় গাহিতে লাগিল।

সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, শিলাবতী ও চঞ্চরীকে লইয়া ময়ূর ফিরিয়া চলিল। কিছুদূর গিয়া ময়ূর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল মামুদ দূরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিতেছে। সে একটু বিমনা হইল। মামুদ অতি নিম্নশ্রেণীর দুর্বৃত্ত, দিল্লীতে নবাগত ব্যক্তিদের ঠকাইয়া কিংবা সুবিধামত রাহাজানি করিয়া উদরপূর্তি করে; সে ময়ূরকে চিনিতে পারে নাই তাহা নিঃসন্দেহ, চিনিতে পরিলে তাহার কাছে ঘেঁষিত না। কিন্তু মামুদ ক্ষুদ্রপ্রাণী হইলেও তাহার সম্বন্ধে সাবধান থাকা আবশ্যক। ক্ষুদ্র প্রাণী অনেক সময় বৃহৎ কার্য ভ্রষ্ট করিয়া দিতে পারে।

গৃহে ফিরিয়া চঞ্চরী বোরকা খুলিবার জন্য ঘরে প্রবেশ করিলে ময়ূর চুপিচুপি শিলাবতীকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘যে স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলেন সে কে?’ শিলাবতী মুখ টিপিয়া হাসিলেন— ‘কবুতর বিবি।’

রাত্রির আহারের পর চঞ্চরী ঘুমাইয়া পড়িলে শিলাবতী নিঃশব্দে ময়ূরের ঘরে আসিলেন, বলিলেন— ‘ময়ূর ভাই, আমি আবার বেরুব, কবুতর বিবির সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজ তুমি যেখানে খেলা দেখিয়েছিলে সেখানে সে আসবে।’

ময়ূর বলিল— ‘যাওয়া প্রয়োজন?’

শিলাবতী বলিলেন— ‘নিতান্ত প্রয়োজন।’

ময়ূর উদ্বিগ্ন স্বরে বলিল— ‘কিন্তু আপনি একা যাবেন, চলুন, আমি সঙ্গে যাই।’

শিলাবতী বলিলেন— ‘না, চঞ্চরীকে একা রেখে যাওয়া নিরাপদ নয়। তুমি চিন্তা করো না, চাঁদের আলো আছে, আমি পথ চিনে যেতে পারব।’

শিলাবতী কৃষ্ণ বস্ত্রে অঙ্গ ঢাকিয়া চলিয়া গেলেন। কবুতর বিবি হারেমের পুরাতন দাসী, যখন ইচ্ছা অন্দরে-বাহিরে যাতায়াত করে, কেহ তাহাকে বাধা দেয় না। শিলাবতী নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া দেখিলেন এক দেবদারু বৃক্ষের ছায়ায় কবুতর বিবি অপেক্ষা করিতেছে।

রাত্রি তৃতীয় প্রহরে শিলাবতী ফিরিলেন। ময়ূর ধনুর্বাণ লইয়া দালানে বসিয়া ছিল; হ্রস্বস্বরে দুইজনের কথা হইল। তারপর উভয়ে আশান্বিত মনে নিজ নিজ কক্ষে শয়ন করিতে গেলেন।

তিন

পরদিন সকালে ময়ূর খেলা দেখাইতে বাহির হইল না। বিকালে সাজসজ্জা করিয়া চঞ্চরী ও শিলাবতীকে লইয়া রাজপ্রাসাদের অভিমুখে চলিল। চঞ্চরীর দেহ বোরকায় ঢাকা, শিলাবতীর মাথায় ফলের ঝুড়ি।

প্রাসাদের পশ্চাদ্ভাগে হারেম, প্রাকারবেষ্টিত মহলের কোলে প্রশস্ত অঙ্গন। অঙ্গনের দ্বারে কয়েকজন রক্ষী দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদের কোমরে তরবারি, হাতে বল্লম। ময়ূরকে দেখিয়া একজন রক্ষী চিনিতে পারিল, সে পূর্বে ময়ূরের খেলা দেখিয়াছে। ময়ূর অগ্রবর্তী হইয়া তাহাদের সম্মুখে দাঁড়াইল এবং নত হইয়া সেলাম করিল। সর্দার-রক্ষী বলিল— ‘কি চাও?’

ময়ূর সবিনয়ে বলিল— ‘যদি অনুমতি হয়, বেগম সাহেবাদের তীর-ধনুকের খেলা দেখাব।’

রক্ষীরা মুখ তাকাতাকি করিল, তারপর নিম্ন স্বরে পরামর্শ করিতে লাগিল। তীর-ধনুকের খেলা দেখিবার ঔৎসুক্য তাহাদের নিজেদেরই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এই বাজিকরকে অঙ্গনে আসিতে দেওয়া উচিত হইবে কি না, এই লইয়া তাহাদের মধ্যে তর্ক উঠিল। শেষে সর্দার-রক্ষী ময়ূরকে বলিল— ‘ভিতরে আসার হুকুম নেই, তুমি ফটকের সামনে খেলা দেখাও।’

ময়ূর মনে মনে একটু নিরাশ হইল, কিন্তু দ্বিরুক্তি না করিয়া ধনুকে গুণ পরাইতে প্রবৃত্ত হইল।

এই সময় এক অতি সুন্দরকান্তি যুবাপুরুষ রক্ষীদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন। রক্ষীরা সসম্ভ্রমে তসলিম্ করিল, একজন অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘হজরৎ মালিক কাফুর।’

মালিক কাফুরকে আলাউদ্দিন বহু বর্ষ পূর্বে ক্রীতদাসরূপে ক্রয় করিয়াছিলেন; এক হাজার স্বর্ণদীনার দিয়া ক্রয় করিয়াছিলেন বলিয়া লোকে কাফুরকে হাজারদীনারী খোজা বলিত। তারপর যুদ্ধে রণপাণ্ডিত্য দেখাইয়া তিনি সুলতানের প্রধান সেনাপতি হইয়াছিলেন; আলাউদ্দিনের শেষ বয়সে কাফুর তাঁহার দক্ষিণহস্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। বর্তমানে তাঁহার বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে, কিন্তু দেখিলে যুবক বলিয়া মনে হয়।

ময়ূরও মালিক কাফুরকে তস্লিম্ করিল, তারপর খেলা দেখাইতে আরম্ভ করিল। প্রথমে সে শূন্যে তীর ছুড়িয়া দ্বিতীয় তীর দিয়া প্রথম তীর ফিরাইয়া আনিল। মালিক কাফুর খেলা দেখিয়া বলিলেন— ‘এই খেলা আবার দেখাও।’

ময়ূর আবার খেলা দেখাইল। কাফুর তখন সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন— ‘তোমরা অঙ্গনে এস, বেগম সাহেবারা খেলা দেখবেন।’

তখন চঞ্চরী ও শিলাবতীকে সঙ্গে লইয়া ময়ূর হারেমের প্রাঙ্গণে গিয়া দাঁড়াইল। মালিক কাফুর অন্দরমহলে প্রবেশ করিলেন। তিনি খোজা, অন্দরে তাঁহার অবাধ গতিবিধি।

ময়ূর দ্বিতীয় খেলা দেখাইল, চঞ্চরীকে বিশ হাত দূরে দাঁড় করাইয়া তাহার মাথায় ডালিম রাখিয়া তীর দিয়া ডালিম বিদ্ধ করিল। এই সময় হারেমের দ্বিতলের অলিন্দে বাতায়নে সূক্ষ্ম মলমলে ঢাকা রমণী মুখের আবির্ভাব হইতে লাগিল। অন্তরীক্ষে রূপের হাট বসিয়া গেল; নির্মেঘ আকাশে বিদ্যুৎ-বিলাস।

দ্বিতীয় খেলা শেষ করিয়া ময়ূর গুপ্ত কটাক্ষে দেখিল, একটি গবাক্ষে দুইজন পুরুষ দাঁড়াইয়াছে— একজন মালিক কাফুর, অন্যজন নিশ্চয় সুলতান আলাউদ্দিন। গবাক্ষপথে তাঁহাকে আবক্ষ দেখা যাইতেছে; বৃদ্ধ ছাগের মতো একটা মুখ, কিন্তু চক্ষে লালসার ধুমকলুষিত অগ্নি।

এইবার সময় উপস্থিত। ময়ূর শিলাবতীকে ইঙ্গিত করিল, শিলাবতী চঞ্চরীর বোরকা খুলিয়া লইলেন। চঞ্চরীর দেহে সূক্ষ্ম মলমলের বস্ত্র, সে রূপের পসরা উদ্ঘাটিত করিয়া দাঁড়াইল। দর্শকেরা নিশ্বাস ফেলিতে ভুলিয়া গেল।

ময়ূর নির্লিপ্ত মুখে আরও দুই-একটা খেলা দেখাইল। শিলাবতীর ঝুড়ি হইতে তিনটি ডালিম লইয়া সে চঞ্চরীর মাথায় ও দুই হাতে রাখিল, তারপর তাহাকে হারেমের দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড় করাইল। চঞ্চরী দুই হাত স্কন্ধের দুই পাশে রাখিয়া দাঁড়াইল; ময়ূর তাহার পিছনে বিশ হাত দূরে গিয়া ধনুতে তিনটি শর একসঙ্গে যোজনা করিল। একসঙ্গে তিনটি শরই ছুটিয়া গেল, তিনটি ডালিম একসঙ্গে তীরবিদ্ধ হইয়া মাটিতে পড়িল।

দ্বিতলের অলিন্দে বাতায়ন হইতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার বৃষ্টি হইল। ময়ূর সেলাম করিতে করিতে মুদ্রাগুলি কুড়াইতেছে এমন সময় মালিক কাফুর নামিয়া আসিলেন। ময়ূরের পানে অবহেলাভরে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘এই বিবিকে সুলতান দেখতে চান। তুমি অপেক্ষা কর।’ চঞ্চরীর হাত ধরিয়া কাফুর হারেমে লইয়া চলিলেন। চঞ্চরী আপত্তি করিল না, কাফুরের সুন্দর মুখের পানে চাহিয়া তাহার অধরে হাসির বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইতে লাগিল।

ময়ূর যেন হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছে এমনিভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর শিলাবতীর পাশে গিয়া বসিল। শিলাবতীর মুখ অর্ধাবগুণ্ঠিত, তিনি খর্বকণ্ঠে বলিলেন— ‘ওষুধ ধরেছে।’

ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল— ‘ওই বৃদ্ধই আলাউদ্দিন?’

শিলাবতী বলিলেন— ‘হাঁ।’

ময়ূর আর-একবার আলাউদ্দিনের দিকে তাকাইল। ইচ্ছা করিলেই সে আলাউদ্দিনকে হত্যা করিতে পারে, বিদ্যুদ্বেগে তীর-ধনুক লইয়া লক্ষ্যবেধ করা, কেবল একটি টঙ্কার শব্দ। আলাউদ্দিন নড়িবার সময় পাইবে না। —

খেলা শেষ হইয়াছে দেখিয়া বাতায়ন হইতে সুন্দর মুখগুলি অপসৃত হইল, রক্ষীরা স্বস্থানে ফিরিয়া গেল। দ্বারের বাহিরে রাস্তার উপর কিছু নাগরিক তামাসা দেখিবার জন্য জমা হইয়াছিল, তাহারা অধিকাংশ ইতস্তত ছড়াইয়া পড়িল; দুই-চারি জন নিষ্কর্মা লোক আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

শিলাবতী বলিলেন— ‘তুমি থাকো, আমি ফিরে যাই। আজ রাত্রে কবুতর বিবির সঙ্গে আবার দেখা করতে হবে।’ ফলের ঝুড়ি মাথায় লইয়া তিনি চলিয়া গেলেন।

ময়ূর আরও কিয়ৎকাল অপেক্ষা করিবার পর মালিক কাফুর ফিরিয়া আসিলেন, ময়ূরের হাতে এক মুঠি মোহর দিয়া সদয় কণ্ঠে বলিলেন— ‘এই নাও তোমার বক্শিস্। বিবির জন্যে ভেবো না, সে সুলতানের কাছে সুখে থাকবে।’

মালিক কাফুর চলিয়া গেলেন। ময়ূর মোহরগুলির পানে তাকাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর সেগুলি কোমরে রাখিয়া ধনুর্বাণ হাতে নতমুখে হারেমের দেউড়ি পার হইয়া গেল।

সে পথে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াছে, পিছন হইতে কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইল— ‘কী দোস্ত। বলেছিলাম কিনা, দিল্লীতে বৌ চুরি যায়।’ মামুদ পিছন হইতে আসিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল, সহানুভূতিসিক্ত কণ্ঠে বলিল— ‘দুঃখ কোরো না, যা বক্শিস্ পেয়েছ তাতে চারটি বিবি কিনতে পারবে। এখন চল শরাবখানায়, দু’ পেয়ালা টানলেই মেজাজ দুরন্ত হয়ে যাবে।’

ময়ূরের একবার ইচ্ছা হইল চঞ্চরীর দেহের মূল্য মোহরগুলা মামুদের হাতে দিয়া তাহাকে বিদায় করিয়া দেয়। সে তো এইজন্যই পিছনে লাগিয়া আছে। কিন্তু তাহা করিলে দুর্জনকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। ময়ূর রুখিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘আমার মেজাজ ভাল নেই। বিরক্ত কোরো না, বিপদে পড়বে।’

মামুদ অমনি পিছাইয়া গেল। সে অত্যন্ত ভীরু, ময়ূরের মতো তীরন্দাজকে বেশি ঘাঁটাইতে সাহস করে না। কিন্তু সে ময়ূরের হাতে সোনা দেখিয়াছে, সহজে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়াও মামুদের পক্ষে অসম্ভব।

রাত্রে আহারাদি সমাপ্ত হইলে শিলাবতী বলিলেন— ‘অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে, এখনো অর্ধেক কাজ বাকি।’

ময়ূর প্রশ্ন করিল— ‘কবুতর বিবি পায়রা ধরতে পারবে তো?’

‘প্রাসাদের ছাদে পায়রার খোপ, রাত্রে সহজেই ধরা যাবে।’

রাত্রি গভীর হইলে শিলাবতী বাহির হইলেন। আজ আর ময়ূরের গৃহে থাকিয়া পাহারা দিবার প্রয়োজন নাই, সেও তীর-ধনুক লইয়া শিলাবতীর সঙ্গে চলিল। চঞ্চরীর কথা ভাবিয়া তাহার একটা নিশ্বাস পড়িল। চঞ্চরীর ভাগ্যে কি আছে কে জানে। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, হয়তো বেশি দুঃখ পাইবে না।

পথ জনহীন, আকাশে আধখানা চাঁদ। দুইজনে পথ চলিতে চলিতে অনুভব করিলেন, কেহ দূরে থাকিয়া তাঁহাদের অনুসরণ করিতেছে। ময়ূরের মুখে ক্রোধের ভ্রূকুটি দেখা দিল, সে চাপা গলায় বলিল— ‘হতভাগা মামুদ।’

শিলাবতী বলিলেন— ‘ও যদি জানতে পারে হারেমের দাসীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, কবুতর বিবি বিপদে পড়তে পারে।’

ময়ূর বলিল— ‘আমি ব্যবস্থা করছি।’

সে পিছনে ফিরিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইল না; কিন্তু নিস্তব্ধ বাতাসে সন্তর্পণে পদশব্দ শুনিতে পাইল। তখন সে শিলাবতীর হাত ধরিয়া টানিয়া একটি গৃহের ছায়াতলে লুকাইল। চাঁদের আলোয় ছায়া বড় গাঢ় হয়; ময়ূর ধনুকে শরসংযোগ করিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিল।

কিছুক্ষণ পরে দূরে একটি মানুষ আসিতেছে দেখা গেল। আরও কাছে আসিলে ময়ূর দেখিল মামুদই বটে। তখন সে আকর্ণ ধনু টানিয়া শর নিক্ষেপ করিল।

মরণাহত কুক্কুরের মতো একটা বিকট চিৎকার। মামুদ রাস্তায় পড়িয়া গড়াগড়ি যাইতে লাগিল।

শিলাবতী বলিলেন— ‘মরে গেল নাকি?’

ময়ূর বলিল— ‘না, উরুতে মেরেছি। ওকে সত্যসত্যই খোঁড়া করে দিলাম। কিন্তু এখানে আর নয়, হয়তো লোকজন এসে পড়বে।’

কিন্তু দিল্লীর অধিবাসীরা বুদ্ধিমান, দ্বিপ্রহর রাত্রে অতিবড় বিকট শব্দ শুনিলেও ঘরের বাহির হয় না। ময়ূর ও শিলাবতী মামুদের বিলীয়মান কাতরোক্তি শুনিতে শুনিতে চলিলেন। দেবদারু বৃক্ষতলে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন কবুতর বিবি দাঁড়াইয়া আছে।

চুপিচুপি কথা হইল। কবুতর বিবি কোঁচড় হইতে একটি ধূম্রবর্ণ কপোত বাহির করিয়া দিল। একটু পাখার ঝটপট শব্দ, শিলাবতী কপোতটিকে নিজ বস্ত্রমধ্যে লুকাইলেন। ময়ূর মালিক কাফুরের নিকট যত স্বর্ণমুদ্রা পাইয়াছিল সমস্ত কবুতর বিবির হাতে দিল। শিলাবতী কবুতর বিবির গণ্ডে চুম্বন করিলেন, উভয়ের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইল। তারপর কবুতর বিবি ছায়ার মতো হারেমের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

বৃক্ষচ্ছায়াতলে দাঁড়াইয়া ময়ূর বলিল— ‘আর বাসায় ফিরে গিয়ে কাজ নেই। চলুন, নগরের দক্ষিণ দরজার কাছে লুকিয়ে থাকি, দরজা খুললে বেরিয়ে যাব। দিল্লীতে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।’

পরদিন পান্থশালায় ফিরিয়া গিয়া ময়ূর আরও সাতদিন সেখানে রহিল; তারপর কপোতের পায়ে জতুনিবদ্ধ পত্র বাঁধিয়া কপোতকে উড়াইয়া দিল। অভ্রান্ত কপোত একবার চক্রাকারে ঘুরিয়া দিল্লীর দিকে উড়িয়া চলিল। ময়ূর মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইল, কপোত রাজপ্রাসাদের চূড়ায় গিয়া বসিয়াছে, কোনও পরিচারিকা তাহার পায়ে পত্র বাঁধা আছে দেখিয়া সুলতানকে খবর দিল। তারপর সুলতান আলাউদ্দিনই সেই পত্র পড়িলেন।

দুরাচারীর পাপজর্জরিত জীবনের চরম পরিণাম।

ইহার পর আলাউদ্দিন বিকৃত মস্তিষ্ক ও ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তিন বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। ইহাই ইতিহাসের সাক্ষ্য।

চার

চৈত্র মাসের শেষে একদা রাত্রিকালে রাজা ভূপ সিংহ প্রাসাদের ছাদে উঠিয়া একাকী পাদচারণ করিতেছিলেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি চন্দ্রহীন; পঞ্চমী তিথির চাঁদ বিলম্বে উঠিবে। নক্ষত্র-বিকীর্ণ স্বল্পান্ধকারে পরিক্রমণ করিতে করিতে রাজা চিন্তা করিতেছিলেন।

মাত্র কয়েক মাস পূর্বে চঞ্চরীকে লইয়া ময়ূর দিল্লী গিয়াছে, এখনও তাহার ফিরিবার সময় হয় নাই। কিন্তু সকলের মনেই উদ্বেগপূর্ণ প্রতীক্ষা, সকলেই যেন অন্যমনস্ক। রাজসংসারের ভৃত্যপরিজন নিঃশব্দে কাজ করিয়া যায়, কাহারও মুখে হাসি নাই। সীমন্তিনীর মুখে শীর্ণ কঠিনতা; রাজকুমারী সোমশুক্লা দিন দিন যেন শুকাইয়া যাইতেছেন। রাজা মনে মনে ভাবিতেছেন— এই তাহার শেষ চেষ্টা, এ চেষ্টা যদি নিষ্ফল হয়, আর কিছু করিবার নাই। ময়ূর কি পরিবে? যদি না পারে—

সম্প্রতি রাজার মনে একটু নির্বেদের ভাব আসিয়াছে। প্রতিহিংসা কি এতই বড়! যদি তাঁহার প্রতিহিংসা চরিতার্থ না হয় তাহাতেই বা কি? সূর্য-চন্দ্রের গতি রুদ্ধ হইবে না। তিনি একদিন মরিবেন, মহাপাপী আলাউদ্দিনও মরিবে; তখন প্রতিহিংসা কোথায় থাকিবে? জীবন অনিত্য, হিংসাদ্বেষ অনিত্য; মৃত্যুই পরম অবসান।

পূর্বাকাশে পীতাভ খণ্ডচন্দ্র উদয় হইল। রাজপুরী সুপ্ত, নগর সুপ্ত, পৃথিবী ও সুপ্ত। এই সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে মহাপ্রকৃতি যেন দীপ জ্বালিয়া দিয়াছে। এই পরম মুহূর্তেও কি মানুষের মনে হিংসাদ্বেষ আছে! হায়, সংসারে যদি হিংসাদ্বেষ না থাকিত!

ময়ূর কি ফিরিয়া আসিবে? তাহার প্রতি ভূপ সিংহের স্নেহ জন্মিয়াছিল, বিশ্বাস জন্মিয়াছিল; সে যদি ফিরিয়া না আসে, যদি রামরুদ্রের মতো সেও ঘাতকের হস্তে হত হয়—

নিস্তব্ধ বাতাসে অশ্বের ক্ষীণ হ্রেষাধ্বনি শুনিয়া রাজা সেই দিকে চক্ষু ফিরাইলেন। রাজপুরীর সম্মুখ পথ দিয়া একদল লোক আসিতেছে। রাজার চোখের দৃষ্টি এখনও তীক্ষ্ণ আছে, তিনি দেখিলেন যাহারা আসিতেছে তাহাদের মধ্যে একটা দোলা এবং একজন অশ্বারোহী রহিয়াছে। রাজা রুদ্ধশ্বাসে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর দ্রুত ছাদ হইতে নামিতে লাগিলেন। নিশ্চয় ময়ূর ফিরিয়াছে। কিন্তু সঙ্গে দোলা কেন? তবে কি চঞ্চরীকে ফিরাইয়া আনিয়াছে!

দ্বিতলে অবতরণ করিলে কুমারী সোমশুক্লা পিছন হইতে চকিতস্বরে ডাকিলেন— ‘পিতা!’ কিন্তু রাজা শুনিতে পাইলেন না।

ময়ূর প্রাসাদ সম্মুখে অশ্ব হইতে অবতরণ করিল। রাজা একাকী দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহার পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া বলিল— ‘আর্য, আমি ফিরে এসেছি। কার্যসিদ্ধি হয়েছে।’

কার্যসিদ্ধির কথা রাজার কানে পৌছিল কিনা সন্দেহ; তিনি কম্পিত স্বরে বলিলেন— ‘দোলায় কে?’

ময়ূর বলিল— ‘একটি স্ত্রীলোক আপনার দর্শন চায়, তাকে সঙ্গে এনেছি। মহারাজ, আপনি নিজ কক্ষে গিয়ে বসুন, আমি এখনি দর্শনপ্রার্থিনীকে নিয়ে আসছি।’

রাজা কক্ষে গিয়া স্বয়ং দীপ জ্বালিলেন, তারপর ভূমিতলে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার দেহমনের সমস্ত শক্তি যেন ফুরাইয়া গিয়াছে, স্নায়ুমন্ডল আলোড়িত হইতেছে। ময়ূর কাহাকে সঙ্গে আনিয়াছে? কে তাঁহার দর্শনপ্রার্থিনী?

ময়ূর দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, সঙ্গে কৃষ্ণাননা একটি স্ত্রীলোক। দ্বারের কাছে ক্ষণকাল ন যযৌ ন তস্থৌ থাকিয়া স্ত্রীলোকটি ছুটিয়া আসিয়া রাজার পদপ্রান্তে পড়িল, অবরুদ্ধস্বরে কাঁদিয়া উঠিল— ‘পিতা, আমাকে কি গৃহে স্থান দেবেন? আমি দাসী হয়ে থাকিব, আমার পরিচয় কেউ জানবে না—’

রাজা পক্ষাঘাতগ্রস্তের ন্যায় ক্ষণেক নিশ্চল রহিলেন, তারপর উন্মত্তবৎ চিৎকার করিয়া উঠিলেন— ‘শিলা! শিলা!’

ময়ূর দ্বারের কাছে প্রহরীর ন্যায় ঋজুদেহে দাঁড়াইয়া রহিল। শিলাবতী প্রথমে ময়ূরের সঙ্গে পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিতে চাহেন নাই, বলিয়াছিলেন— ‘আমি ভ্রষ্টা ধর্মচ্যুতা, আমাকে গৃহে স্থান দিলে পিতার কলঙ্ক হবে। তিনি যদি আমাকে গ্রহণ না করেন?’ ময়ূর বলিয়াছিল— ‘যদি গ্রহণ না করেন আমরা দুই ভাই-বোন অন্য কোথাও চলে যাব। বিস্তীর্ণা পৃথিবীতে কি দু’টি মানুষের স্থান হবে না?’ তখন শিলাবতী সম্মত হইয়াছিলেন।

ময়ূর চাহিয়া দেখিল, রাজার বাহ্য়জ্ঞান নাই, তিনি কন্যাকে শিশুর মতো আদর করিতেছেন— ‘মা আমার! মা আমার! কন্যা! কন্যা! কন্যা!’

ময়ূর একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। এই হৃদয়াবেগ হইতে দূরে সরিয়া যাওয়াই ভাল। সে দ্বার বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে, আবার ইতস্তত করিতেছে, এমন সময় কেহ তাহার হস্ত স্পর্শ করিল। ময়ূর ফিরিয়া দেখিল, সোমশুক্লা!

সোমশুক্লার মুখ ঈষৎ কৃশ, চোখের কোলে ছায়া, কিন্তু তাঁহার হাসি দেখিয়া ময়ূরের মনে হইল ইহার অধিক পুরস্কার বুঝি পৃথিবীতে আর নাই। সে কুমারীর হাত ধরিয়া উদ্যানে লইয়া গেল।

চাঁদ আর একটু উপরে উঠিয়াছে, আর একটু উজ্জ্বল হইয়াছে। চন্দ্রালোকে দুইজনে পরস্পরের মুখ দেখিলেন, তারপর সোমশুক্লা ভঙ্গুর কণ্ঠে বলিলেন— ‘ভাল ছিলে?’

এই কয়েক মাসের অদর্শন যেন তাঁহাদের মনের ব্যবধান সরাইয়া দিয়াছে, প্রকৃত সম্বন্ধ জানাইয়া দিয়াছে। ময়ূর বলিল— ‘তোমার শঙ্খ আমার সমস্ত বিঘ্ন দূর করেছে, অতি সহজে কার্যসিদ্ধি হয়েছে। এবার তোমার শঙ্খ তুমি ফিরিয়ে নাও।’

ময়ূর বক্ষ হইতে শঙ্খ লইয়া শুক্লার সম্মুখে ধরল। শুক্লা হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলেন— ‘তুমি পরিয়ে দাও।’

তারপর কতক্ষণ কাটিয়া গেল কেহ জানিল না। একটি বৃক্ষশাখায় একদল পাখি সমস্বরে কলকূজন করিয়া আবার নীরব হইল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে।

ময়ূর বলিল— ‘আমি যাই।’

শুক্লা জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কোথায় যাবে?’

ময়ূর বলিল— ‘রাজার কাছে। তিনি বলেছিলেন যদি কার্যসিদ্ধি হয়, আমাকে অদেয় তাঁর কিছুই থাকবে না। তাই পুরস্কার চাইতে যাচ্ছি।’

রাজা আপন কক্ষে ঋজু দেহে বসিয়া ছিলেন। তাঁহার মুখ প্রফুল্ল, মনে হয় দশ বছর বয়স কমিয়া গিয়াছে। ঝটিকাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র শান্ত হইয়াছে। ময়ূর প্রবেশ করিতেই তিনি অধরে অঙ্গুলি রাখিয়া ইঙ্গিত করিলেন, পাশের দীপহীন কক্ষে ভূমিশয্যায় পড়িয়া শিলাবতী ঘুমাইতেছেন, যেন সতেরো বছরের পুঞ্জীভূত গ্লানি নিদ্রার কোলে নামাইয়া দিয়াছেন।

রাজা চুপিচুপি বলিলেন— ‘শিলা ঘুমিয়ে পড়েছে। ও আমার কাছে এই রাজভবনেই থাকবে। সাবধান, ওর প্রকৃত পরিচয় যেন কেউ জানতে না পারে। তুমি ওকে দিল্লী থেকে এনেছ এই ওর একমাত্র পরিচয়।’

ময়ূর বলিল— ‘তাই হবে আর্য। আমার জ্যেষ্ঠ সহোদরা।’

রাজা তখন ময়ূরের স্কন্ধে হাত রাখিয়া গভীর প্রীতিভরে বলিলেন— ‘বৎস, তুমি আমার পুত্রের তুল্য। তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম তার শতগুণ কাজ তুমি করেছ। কি পুরস্কার চাও বল।’

ময়ূর ধীরে ধীরে বলিল— ‘মহারাজ, যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে আমি আপনার কাছে কুমারী সোমশুক্লার পাণি প্রার্থনা করি।’

রাজা ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন, শেষে বলিলেন— ‘সোমশুক্লা, কিন্তু— কিন্তু—’

ময়ূর বলিল— ‘তিনি আমার উচ্চাকাঙক্ষা জানেন। তাঁর অমত নেই।’

রাজা বলিলেন— ‘কিন্তু— তুমি অজ্ঞাতকুলশীল। তোমার সঙ্গে শুক্লার বিবাহ দিলে সপ্তমপুরের রাজাদের কাছে তোমার কী পরিচয় দেব?

ময়ূর নীরব রহিল। রাজা ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া আকাশপাতাল ভাবিতে লাগিলেন। তাঁহার পুত্র নাই, তাঁহার মৃত্যুর পর জামাতাই রাজ্য পাইবে। ময়ূরের মতো যোগ্য উত্তরাধিকারী কোথায় পাওয়া যাইবে? কিন্তু তবু— অজ্ঞাতকুলশীল—। শীল রক্ষা করা রাজার কর্তব্য। উচ্চকুলশীল দুরাচার লম্পটের সহিত রাজকন্যার বিবাহ হইলে কেহ নিন্দা করে না— কিন্তু—

রাজা বলিলেন— ‘অন্য কোনো পুরস্কার চাও না?’

‘না আর্য।’

রাজা গুম্ফ আকর্ষণ করিতে করিতে আবার চিন্তায় মগ্ন হইলেন।

কক্ষের বাহিরে তখন প্রভাত হইয়াছে। ঘরের প্রদীপ ম্লান হইয়াছে, রাজপুরী যে জাগিয়া উঠিতেছে তাহার শব্দ আসিতেছে।

সহসা ভট্ট নাগেশ্বর দ্বারের কাছে আবির্ভূত হইয়া বলিয়া উঠিলেন— ‘হা হতোস্মি। একি বয়স্য, রাত্রে কি নিদ্রা যাননি?’ বলিয়াই ময়ূরকে দেখিয়া থামিয়া গেলেন। পাশের ঘরে সুপ্তা শিলাবতীকে তিনি দেখিতে পাইলেন না।

রাজা যেন অকূলে কূল পাইলেন, হাত বাড়াইয়া বলিলেন ‘এস বয়স্য। — ময়ূর, যাও বৎস, তুমি নাগেশ্বরের গৃহে গিয়ে বিশ্রাম কর। সন্ধ্যার পর এস।’

ময়ূর প্রস্থান করিলে রাজা গাত্রোত্থান করিয়া ভট্ট নাগেশ্বরকে বলিলেন— ‘চল বয়স্য, ছাদে যাওয়া যাক, তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে। তুমি অবশ্য ঘোর মূর্খ, তোমার পরামর্শের কোনো মূল্য নেই, কিন্তু মূর্খের মুখ থেকে কদাচ জ্ঞানের কথা বাহির হতে পারে।’ বলিয়া তিনি উচ্চহাস্য করিলেন।

দুই দিন পরে ভূপ সিংহ সাজসজ্জা করিয়া বিদেশ যাত্রা করিলেন। তাঁহার গন্তব্যস্থান সপ্তমপুর।

বয়স্যকে লইয়া রাজা চতুর্দোলায় উঠিলেন। সঙ্গে অশ্বপৃষ্ঠে ময়ূর ও দশজন রক্ষী।

সপ্তমপুরের অপুত্রক রাজা সূর্যবর্মা বন্ধুকে পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন। ভূপ সিংহ তাঁহার আলিঙ্গনমুক্ত হইয়া বলিলেন— ‘ভাই, আমার কন্যা সোমশুক্লার সঙ্গে একটি যুবকের বিবাহ স্থির করেছি। যুবকটি অতি সৎপাত্র, কিন্তু নামগোত্রহীন; তুমি তাকে দত্তক নেবে এই প্রস্তাব নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। চল, অন্তরালে তোমাকে সব কথা বলি।’—

দু’মাস পরে সপ্তমপুরের যুবরাজ ময়ূরবর্মার সহিত পঞ্চমপুরের রাজকন্যা সোমশুক্লার বিবাহ হইল।

৪ জুলাই ১৯৬২

1 Comment
Collapse Comments

WOUNDERFULL STORY

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *