গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

প্রাগ্‌জ্যোতিষ

প্রাগ্‌জ্যোতিষ

আর্য দ্রাবিড় হূণ মোঙ্গল— প্রত্যেক মৌলিক জাতির জীবনেই একটা সময় আসে যেটাকে তাহার নবীন যৌবন বলা চলে; যখন তপ্ত যৌবনের দুর্দমনীয় অপরিণামদর্শিতায় তাহারা বহু অসম্ভব ও হাস্যকর প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে এবং শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিজ্ঞা পালন করিয়া ছাড়ে।

যাহাদের আমরা আর্যজাতি বলিয়া জানি, তাহাদের জীবনে এই নবীন যৌবন আসিয়াছিল বোধ হয় কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধেরও আগে। পাঁজিপুঁথি তখনও জন্মগ্রহণ করে নাই; আকাশের গ্রহ নক্ষত্র চন্দ্র সূর্য স্বেচ্ছামত নিশ্চিন্ত মনে স্ব-স্ব কক্ষায় পরিভ্রমণ করিত— মানুষ তাহাদের গতিবিধি ও কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখিতে আরম্ভ করে নাই।

আর্য বীরপুরুষগণ ভারতভূমিতে পদার্পণ করিয়া আদিম অনার্যদিগকে বিন্ধ্যাচলের পরপারে খেদাইয়া দিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, উপরন্তু তাহাদের রাক্ষস পিশাচ দস্যু প্রভৃতি নাম দিয়া কটূক্তি করিতেছিলেন। মনে হয়, সে-যুগেও শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাইবার প্রথা পুরাদস্তুর প্রচলিত ছিল।

তারপর একদা অগস্ত্য মুনি কতিপয় সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া দক্ষিণাপথে অগস্ত্যযাত্রা করিলেন, আর ফিরিলেন না। রাক্ষস ও পিশাচগণ তাঁহাকে কাঁচা ভক্ষণ করিল কি না পুরাণে তাহার উল্লেখ নাই। যা হোক, তদবধি অন্যান্য আর্য বীরগণও বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণ দিকে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিলেন।

দুইজন নবীন আর্য যোদ্ধা সৈন্যসামন্ত লইয়া দক্ষিণাপথে বহুদূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছিলেন এবং দেখিয়া-শুনিয়া খানিকটা উর্বর ভূভাগ হইতে কৃষ্ণকায় দস্যু-তস্করদের তাড়াইয়া স্বরাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। এই আর্য বীরপুরুষ দু’টির নাম— প্রদ্যুম্ন এবং মঘবা। উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড বন্ধুত্ব।

আজকাল বন্ধুত্ব বস্তুটার তেমন তেজ নাই; ইয়ারকি দিবার জন্যই বন্ধুকে প্রয়োজন হয়। সেকালে দস্যু ও রাক্ষস দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া বন্ধুত্ব পুরামাত্রায় বিস্ফুরিত হইবার অবকাশ পাইত।

দুই বন্ধুর যৌথ বাহুবলে রাজ্য স্থাপিত হইল। কিন্তু প্রশ্ন উঠিল— রাজা হইবে কে?

প্রদ্যুম্ন কহিলেন, ‘মঘবা, তুই রাজা হ, আমি সেনাপতি হইব।’

মঘবা কহিলেন, ‘উঁহু, তুই রাজা হ— আমি সেনাপতি।’

সমস্যার সমাধান হইল না; বন্ধুকে বঞ্চিত করিয়া রাজা হইতে কেহই ব্যগ্র নয়। এদিকে নবলব্ধ রাজ্যটি এতই ক্ষুদ্র যে ভাগাভাগি করিতে গেলে কিছুই থাকে না, চটকস্য মাংসং হইয়া যায়। প্রজা ভাগাভাগি করিলেও শক্তিক্ষয় অনিবার্য— চারিদিকে শত্রু ওৎ পাতিয়া আছে। বন্ধযুগল বড়ই ভাবিত হইয়া পড়িলেন।

একদিন রাত্রিকালে আকাশে গোলাকৃতি চন্দ্র শোভা পাইতেছিল— অর্থাৎ পূর্ণিমার রাত্রি। প্রস্তরনির্মিত উচ্চ দুর্গের চূড়ায় দুই বন্ধু চিন্তাকুঞ্চিত ললাটে অবস্থান করিতেছিলেন। দুর্গটা অবশ্য বিতাড়িত অনার্য দস্যুদের নির্মিত; আর্যেরা আদৌ দুর্গ নির্মাণ করিতে জানিতেন না। রামচন্দ্র লঙ্কায় রাবণের দুর্গ দেখিয়া একেবারে নির্বাক্‌ হইয়া গিয়াছিলেন।

মঘবা তাঁহার পিঙ্গলবর্ণ দাড়ির মধ্যে ঘন ঘন অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে মুক্ত ছাদে পায়চারি করিতেছিলেন। প্রকাণ্ড ষণ্ডা চেহারা, নীল চক্ষু; মুদ্‌গরের মতো দৃঢ় ও নিরেট দেহ। চিন্তা করার অভ্যাস তাঁহার বিশেষ ছিল না, তাই দুশ্চিন্তা উপস্থিত হইলেই তিনি নিজের দাড়ি ধরিয়া টানাটানি করিতেন।

প্রদ্যুম্নের চেহারাখানা অপেক্ষাকৃত লঘু কিন্তু সমধিক নিরেট ও দৃঢ়। মাথায় সোনালী চুল, চোখের মণি গাঢ় নীল। দাড়ি নাই; গলা চুলকাইত বলিয়া তিনি তরবারির অগ্রভাগ দিয়া দাড়ি কামাইয়া ফেলিতেন। কেবল এক জোড়া সূক্ষ্ম গোঁফ ছিল। এই গোঁফে অঙ্গুলি বুলাইতে বুলাইতে প্রদ্যুম্ন প্রাচীর-বেষ্টনীতে ঠেস দিয়া চাঁদের পানে ভ্রূকুটি করিতেছিলেন।

চাঁদ কিন্তু হাসিতেছিল। তাহার যে গুরুতর বিপদ আসন্ন হইয়াছে, পঞ্জিকা না থাকায় সে তার পূর্বাভাস পায় নাই।

সহসা মঘবা বলিলেন, ‘একটা মতলব মাথায় আসিয়াছে। প্রদ্যুম্ন, আয় পাঞ্জা লড়ি— যে হারিবে তাহাকেই রাজা হইতে হইবে।’

প্রদ্যুম্ন গোঁফের আড়ালে শ্লেষ হাস্য করিলেন, ‘জুচ্চুরির মতলব। গত যুদ্ধে আমার কব্জি মাচকাইয়া গিয়াছে জানিস কি না!’

ব্যর্থ হইয়া মঘবা আবার দাড়ি টানিতে লাগিলেন। শেষে বলিলেন, ‘দু’জনে রাজা হইলে দোষ কি?’

প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘দু’জনে রাজা হইলে কে কাহার হুকুম মানিবে? কে প্রজাদের হুকুম দিবে?’

‘তা বটে।’

‘তবে দু’জনে রাজা হওয়া যায়। পর পর।’

‘সে কি রকম?’

‘তুই কিছুদিন রাজা হইলি, আমি সেনাপতি। তারপর আমি রাজা হইলাম। এই আর কি।’

মঘবা ভাবিয়া বলিলেন, ‘মন্দ কথা নয়। একদিন তুই রাজা, একদিন আমি।’

‘উঁহু, অত তাড়াতাড়ি রাজা বদল করিলে গণ্ডগোল বাধিবে।’

‘গণ্ডগোল কিসের?’

‘মনে কর, আমি রাজা হইয়া তোকে হুকুম দিলাম— সেনাপতি, শুনিয়াছি দক্ষিণে লম্বোদর নামক রাক্ষসদের রাজ্যে রসাল নামক এক প্রকার অতি সুন্দর ফল পাওয়া যায়, তুমি দ্রুত গিয়া ঐ ফল আহরণ করিয়া আন,— আমার খাইবার ইচ্ছা হইয়াছে। — তুই ফল লইয়া ফিরিতে দিন কাবার হইয়া গেল, তুই রাজা হইলি আমি সেনাপতি বনিয়া গেলাম। তখন কে ফল খাইবে?’

মঘবা বলিলেন, ‘তাই তো। বড়ই ফ্যাসাদ দেখিতেছি।’

মনে রাখিতে হইবে, আর্যগণ তখনও স্থির হইয়া বসিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা আরম্ভ করেন নাই; দু’-একজন ঋষি হঠাৎ মন্ত্রদ্রষ্টা হইয়া চকিতে বিদ্যুৎরেখাবৎ এক-আধটা সূত্র উচ্চারণ করিয়া ফেলিতেন, এই পর্যন্ত। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা— এইরূপ ঋতু পরিবর্তনের কথা মোটামুটি জানা থাকিলেও, সময়কে সপ্তাহ মাস বৎসরে বিভাজিত করিবার বুদ্ধি তখনও গজায় নাই।

সুতরাং প্রদ্যুম্ন ও মঘবা বড়ই ফাঁপরে পড়িয়া গেলেন।

ওদিকে আকাশে চন্দ্রও ফাঁপরে পড়িয়াছিল। প্রদ্যুম্ন তাহার প্রতি ভ্রূকুটি করিবার জন্য চোখ তুলিয়াই সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, ‘আরে আরে, একি!’

মঘবাও দৃষ্টি উৎক্ষিপ্ত করিলেন। দেখিলেন, আকাশ নির্মেঘ, কিন্তু চন্দ্রের শুভ্র মুখের উপর ধূম্রবর্ণ ছায়া পড়িয়াছে; করাল ছায়া ধীরে ধীরে চন্দ্রকে গ্রাস করিবার উপক্রম করিতেছে।

দুই বন্ধুর মনে সশঙ্ক উত্তেজনার উৎপত্তি হইল। ব্যাপারটা পূর্বে কয়েক বার দেখা থাকিলেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটা প্রাকৃতিক ঘটনা বলিয়া সাব্যস্ত হয় নাই, ভূকম্পের মতো অপ্রত্যাশিত একটা মহাদুর্যোগ বলিয়াই বিবেচিত হইত। মঘবা দ্রুত আসিয়া প্রদ্যুম্নের হাত চাপিয়া ধরিলেন, গাঢ় স্বরে ফিসফিস করিয়া বলিলেন, ‘চন্দ্রগ্রহণ!’

প্রদ্যুন্ন পাংশুমুখে বন্ধুকে আশ্বাস দিয়া বলিলেন, ‘হাঁ, কিন্তু ভয় নাই। চাঁদ আবার মুক্ত হইবে। — ছেলেবেলায় বুড়া অঙ্গিরা ঋষির কাছে বিদ্যা শিখিতে কয়েক বার গিয়াছিলাম, বুড়া একদিন বলিয়াছিল আকাশে রাহু নামে একটা অদৃশ্য রাক্ষস আছে, সে মাঝে মাঝে চন্দ্র-সূর্যকে ধরিয়া গিলিয়া ফেলে। কিন্তু বেশিক্ষণ চাপিয়া রাখিতে পারে না।’

‘হাঁ, আমিও চার-পাঁচ বার দেখিয়াছি।’

‘আমিও। মাঝে মাঝে এরূপ ঘটিয়া থাকে।’

দুই বন্ধ হাত-ধরাধরি করিয়া দেখিতে লাগিলেন, বিপন্ন ম্রিয়মাণ চন্দ্র যেন একটা তাম্রবর্ণ অর্ধস্বচ্ছ অজগরের পেটের ভিতর দিয়া পশ্চাদভিমুখে চলিয়াছে। দুর্গের নিম্নে ভয়ার্ত জনগণ সমবেত হইয়া চিৎকার ও নানাপ্রকার বাদ্যধ্বনি করিতে লাগিল। দুষ্ট রাক্ষসগণ নাকি এইরূপ বিকট শব্দ শুনিলে ভয় পাইয়া পলায়ন করে।

দীর্ঘকাল পরে চাঁদের একটি চক্চকে কোণ বাহির হইয়া পড়িল। তারপর দেখিতে দেখিতে চন্দ্র সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে সহাস্য মুখে রাক্ষসের কবল হইতে নির্গত হইয়া আসিলেন।

সকলে ঊর্ধ্বস্বরে মহা আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল। মঘবা প্রদ্যুম্নের হাত ছাড়িয়া দিয়া সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘যাক বাঁচা গেল।’

প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘শুধু তাই নয়, আমাদের সমস্যারও সমাধান হইয়াছে।’

‘কিরূপ?’

‘শুন। আজ হইতে তুমি রাজা হইলে। আবার যখন চন্দ্রে গ্রহণ লাগিবে তখন তোমার রাজত্বকাল শেষ হইবে, আমি রাজা হইব। এইভাবে চলিতে থাকিবে।’

মঘবা ভাবিয়া বলিলেন, ‘মন্দ কথা নয়। — কিন্তু প্রথমেই আমি রাজা হইব কেন?’

‘যেহেতু বুদ্ধিটা আমি বাহির করিয়াছি। এখন চলিলাম, কাল সকালে সৈন্যসামন্ত লইয়া যুদ্ধযাত্রা করিব— সেনাপতির আর কাজ কি? মহারাজ ইতিমধ্যে অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালন করিতে থাকুন। মহারাজের জয় হোক।’

মুচকি হাসিয়া প্রদ্যুম্ন দুর্গশিখর হইতে নামিবার উপক্রম করিলেন। মঘবা অত্যন্ত মুষড়িয়া পড়িয়া দাড়ি টানিতে লাগিলেন।

মঘবার মাথায় বড় বেশি বুদ্ধি খেলে না, কিন্তু এখন সহসা তাহার মস্তিষ্করন্ধে রাজবুদ্ধির উদয় হইল। তিনি গম্ভীর স্বরে ডাকিলেন, ‘সেনাপতি প্রদ্যুম্ন!’

‘আজ্ঞা করুন মহারাজ।’

মহারাজ মঘবা মেঘমন্দ্র স্বরে বলিলেন, ‘আজ্ঞা করিতেছি, কল্য প্রাতে আমি সৈন্যসামন্ত লইয়া যুদ্ধযাত্রা করিব। যত দিন না ফিরি, তুমি অপত্যনির্বিশেষে প্রজা পালন করিতে থাক। রাত্রি গভীর হইয়াছে, এবার আমি রাজশয্যায় শয়ন করিতে চলিলাম।’

মুচকি হাসি হাসিতে মঘবা অভ্যস্ত নহেন, প্রদ্যুম্নের প্রতি একবার চোখ টিপিয়া অট্টহাস্য করিতে করিতে তিনি প্রস্থান করিলেন।

বোকা বনিয়া গিয়া প্রদ্যুম্ন বাম কর্ণের পশ্চাদ্ভাগ চুলকাইতে লাগিলেন।

নবযৌবনের প্রধান ধর্ম এই যে, সে জীবনটাকে গাম্ভীর্যের চশমার ভিতর দিয়া দেখে না; জগৎ তাহার কাছে খেলার মাঠ; যুদ্ধ একটা সরস কৌতুক, প্রেম একটা মাদক উত্তেজনা।

মহারাজ মঘবা মহানন্দে অর্ধেক সৈন্য লইয়া যুদ্ধ করিতে চলিয়া গেলেন। রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে কোদণ্ড নামে এক অনার্য জাতি আছে, উদ্দেশ্য— তাহাদের উৎপীড়ন করা।

আধুনিক গণনায় যে-সময়টাকে তিন মাস বলা চলে, অনুমান তত দিন পরে মঘবা যুদ্ধযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার পিঙ্গল কেশ রুক্ষ, দেহে পশুচার্মের আবরণ ছিন্নভিন্ন, মুখে পরিতৃপ্ত বাসনার হাসি।

আসিয়াই তিনি প্রদ্যুম্নের পৃষ্ঠে বজ্রসম চপেটাঘাত করিলেন। বলিলেন, ‘কি রে, কেমন আছিস?’

দুই বন্ধু নিবিড়ভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হইলেন। প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘রোগ হইয়া গিয়াছিস দেখিতেছি; রাক্ষসদের মুল্লুকে কিছু খাইতে পাস নাই বুঝি?’ তারপর আত্মসম্বরণ করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজের জয় হোক। আর্যের সমস্ত সংবাদ শুভ?’

মঘবা বলিলেন, ‘মন্দ নয়। কোদণ্ড ব্যাটাদের খুব ঠুকিয়াছি। শুধু তাই নয়, একটা মজার জিনিস আনিয়াছি, দেখাইব চল।’

বিজিত জাতির নিকট হইতে অপহৃত বহু বিচিত্র বস্তু এক দল সৈনিকের রক্ষণায় ছিল, মঘবা তাহাদের ইঙ্গিত করিয়া রাজভবন অভিমুখে চলিলেন। যাইতে যাইতে প্রদ্যুম্নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তারপর, রাজ্য কেমন চলিতেছে? প্রজারা আনন্দে আছে?’

‘প্রজাদের আনন্দ সম্প্রতি বিলক্ষণ বাড়িয়া গিয়াছে।’

‘কিরূপ?’

‘আর্য যোদ্ধৃগণের প্রাণে রসের সঞ্চার হইয়াছে। তাহারা অনার্য মেয়ে ধরিয়া আনিয়া পটাপট বিবাহ করিয়া ফেলিতেছে।’

মঘবা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন, ‘তাই নাকি?— রোগ ছোঁয়াচে দেখিতেছি।’

প্রদ্যুম্ন মঘবার প্রতি বক্র কটাক্ষ করিলেন। মঘবা বলিলেন, ‘কিন্তু উপায় কি? এই দেশেই যখন বসবাস করিতে হইবে, তখন আর্য রক্ত নিষ্কলুষ রাখা অসম্ভব। আর্যাবর্ত হইতে এত মেয়ে আমদানি করা চলে না, অথচ বংশরক্ষাও না করিলে নয়। এই যে রাজ্য জয় করিলাম— কাহাদের জন্য?’

প্রদ্যুম্ন শুধু বলিলেন, ‘হুঁ।’

রাজা ও সেনাপতি মন্ত্রগৃহে গিয়া বসিলেন। সামন্ত সচিব শ্রেষ্ঠী বিদূষক কিছুই নাই, সুতরাং মন্ত্রণাগৃহ শূন্য। চার জন সৈনিক একটা বৃহৎ বেত্র-নির্মিত পেটারি ধরাধরি করিয়া তাঁহাদের সম্মুখে রাখিল। পেটারির মুখ ঢাকা, ভিতরে গুরুভার কোনও দ্রব্য আছে মনে হয়।

বিস্মিত প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘কি আছে ইহার মধ্যে? অজগর সাপ নাকি?’

মঘবা হস্তসঞ্চালনে সৈনিকদের বিদায় করিয়া হাসিতে হাসিতে পেটারির ঢাকা খুলিয়া দিলেন।

সাপুড়ের ঝাঁপি খোলা পাইয়া কৃষ্ণকায় সর্পী যেমন ফণা তুলিয়া দাঁড়ায়, তেমনই একটি নারী পেটারির মধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার নীলাঞ্জন চোখে ধিকি ধিকি বিদ্যুৎ।

প্রদ্যুম্ন হতভম্ব হইয়া গেলেন। তাঁহার ব্যাদিত মুখ হইতে বাহির হইল, ‘আরে একি! এ যে একটি মেয়ে।’

মঘবা অট্টহাস্য করিলেন; তারপর বলিলেন, ‘কেমন মেয়ে? সুন্দর নয়?’

প্রদ্যুম্ন নীরবে বন্দিনীকে নিরীক্ষণ করিলেন। মার্জিত তাম্রফলকের ন্যায় দেহের বর্ণ; দলিতাঞ্জন দু’টি চোখ, দলিতাঞ্জন চুল। বস্ত্র-অলঙ্কারের বাহুল্য নাই; গলায় একটি বীজের মালা, বাহুতে শঙ্খের অঙ্গদ; কবরী ও কর্ণে পুষ্পভূষা শুকাইয়া গিয়াছে। কটি হইতে জানু পর্যন্ত একটি বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত পট্টাংশু। কৃশাঙ্গী যুবতীর যৌবনমেদুর দেহের অভ্যন্তর হইতে যেন কৃশানুর দীপ্তি বিচ্ছুরিত হইতেছে।

মঘবা পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি মনে হয়? সুন্দর নয়?’

প্রদ্যুম্ন চমকিয়া মঘবার দিকে ফিরিলেন, তারপর ভর্ৎসনাপূর্ণ স্বরে বলিলেন, ‘তুই একটা আস্ত গোঁয়ার। যুদ্ধ করিতে গিয়া মেয়ে ধরিয়া আনিলি। এখন ইহাকে লইয়া কি করিবি?’

ইহাকে দিয়া যে দাসীকিঙ্করীর কাজ চলিবে না, তাহা একবার দৃষ্টি করিয়াই আর সংশয় থাকে না!

মঘবা বলিলেন, ‘ঠিক করিয়াছি বিবাহ করিব।’

প্রদ্যুম্ন সচকিতে বলিলেন, ‘বিবাহ!’

‘হাঁ! ও কে জানিস? কোদণ্ডরাজার মেয়ে।’

প্রদ্যুম্নের মুখ সহসা গম্ভীর হইল। মঘবা বলিতে লাগিলেন, ‘কোদণ্ডদের রাজপুরী দখল করিয়া দেখিলাম সকলে পলাইয়াছে, কেবল মেয়েটা একা দাঁড়াইয়া আছে। ভারি ভাল লাগিল। ওকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে পারিল না। তাই পেটারি বন্ধ করিয়া সঙ্গে আনিয়াছি। আর্য রাজার মহিষী হইবার যোগ্য মেয়ে বটে; কিন্তু উহাকে আগে আর্যভাষা শিখাইতে হইবে। তারপর আমার পট্টমহিষী করিব।’

প্রদ্যুম্ন আর একবার যুবতীর পানে ফিরিয়া দেখিলেন। সে তাহাদের কথাবার্তার মর্ম কিছুই বুঝিতে পারে নাই; কেবল তাহার চোখ দু’টি একের মুখ হইতে অন্যের মুখে যাতায়াত করিতেছে। তাহার মুখে ভয় বা আশঙ্কার চিহ্ন কিছুই নাই; আছে কেবল এই বর্বরদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে ঘৃণাপূর্ণ গর্বিত জিজ্ঞাসা।

ভ্রূযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া প্রদ্যুম্ন মঘবার দিকে ফিরিলেন, ‘অন্যায় করিয়াছ মঘবা। হাজার হোক রাজার মেয়ে, তাহাকে এভাবে ধরিয়া আনা আর্য শিষ্টতা হয় নাই।’

মঘবা বলিলেন, ‘বিবাহ করিবার জন্য কন্যা হরণ করিলে আর্য শিষ্টতা লঙ্ঘন হয় না।’

‘হয়। অরক্ষিতা মেয়েকে ধরিয়া আনা তস্করের কাজ। এই দণ্ডে এই কন্যাকে ফেরত পাঠানো উচিত।’

তপ্তকণ্ঠে মঘবা বলিলেন, ‘কখনই না—!’ তারপর আত্মসম্বরণ করিয়া অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরে বলিলেন, ‘আমি মহারাজ মঘবা, তোমাকে আদেশ করিতেছি, সেনাপতি প্রদ্যুম্ন, তুমি এই কন্যার যোগ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা কর— যাহাতে সুখে থাকে অথচ পলাইতে না পারে। — মনে থাকে যেন, কন্যা পলাইলে দায়িত্ব তোমার।’

প্রদ্যুম্ন একবার কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর যুক্তকরে মস্তক অবনত করিয়া শুষ্কস্বরে কহিলেন, ‘মহারাজের যেরূপ অভিরুচি।’

দুর্গচূড়ার কূটকক্ষে ভাবী রাজমহিষীর বাসস্থান নির্দিষ্ট হইল। কোদণ্ড-কন্যা দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধরে অকম্পিত পদে দুর্গ-শীর্ষের কারাগারে প্রবেশ করিলেন। কার্যত কারাগার হইলেও স্থানটি প্রশস্ত অলিন্দযুক্ত একটি মহল। সকল সুবিধাই আছে, শুধু পলাইবার অসুবিধা।

মঘবা সহর্ষে প্রদ্যুন্মের পৃষ্ঠে একটি মুষ্ট্যাঘাত করিয়া বলিলেন, ‘রানীর মতো রানী পাওয়া গিয়াছে— কি বলিস?’

প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘হুঁ।’

পরদিন প্রাতঃকালে কিন্তু গুরুতর সংবাদ আসিল। কোদণ্ডদেশ হইতে সদ্যপ্রত্যাগত নিরতিশয় নির্জীব একটি ভগ্নদূত জানাইল যে, রাজকন্যা-হরণের কথা জানিতে পারিয়া পলাতক কোদণ্ড জাতি আবার কাতারে কাতারে ফিরিয়া আসিয়াছে এবং একেবারে ক্ষেপিয়া গিয়াছে। মঘবা যে অল্পসংখ্যক আর্যকটক থানা দিবার জন্য রাখিয়া আসিয়াছিলেন, শত্রুর অতর্কিত ক্ষিপ্ততায় তাহারা কচুকাটা হইয়াছে— কেবল ভগ্নদূত পদদ্বয়ের অসাধারণ ক্ষিপ্রতাবশত প্রাণ বাঁচাইতে সমর্থ হইয়াছে। পরিস্থিতি অতিশয় ভয়াবহ।

শুনিয়া প্রদ্যুম্ন চঞ্চল হইয়া উঠিলেন, ‘মহারাজ, অনুমতি দিন শ্যালকদের ঢিট করিয়া আসি।’

মঘবা কিন্তু রাজী হইলেন না, বলিলেন, ‘তাহা হয় না। ঢিট করিতে হয় আমি করিব।’

সৈন্য সাজাইয়া আবার মঘবা বাহির হইলেন। কিছু দূর গিয়া ফিরিয়া আসিয়া প্রদ্যুম্নকে বলিলেন, ‘ইতিমধ্যে মেয়েটাকে তুই আর্যভাষা শেখাস্‌।’

মনের ক্ষুব্ধতা গোপন করিয়া প্রদ্যুন্ম বলিলেন, ‘আচ্ছা।’

দু’-এক দিনের মধ্যেই প্রদ্যুম্ন বুঝিতে পারিলেন, অনার্য মেয়েটি অতিশয় মেধাবিনী। অষ্টাহমধ্যে সে ভাঙা ভাঙা কথা কহিতে আরম্ভ করিল।

তাহার নাম এলা। অনার্য নাম বটে, কিন্তু শুনিতে ও বলিতে বড় মিষ্ট। প্রদ্যুম্ন কয়েক বার উচ্চারণ করিলেন, ‘এলা! এলা! বাঃ! বেশ তো।’

কথা কহিতে শিখিয়াই এলা প্রথম প্রশ্ন করিল, ‘ও লোকটা কে? যে আমাকে ধরিয়া আনিয়াছে?’

প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘আমার বন্ধু।’

বন্ধু শব্দের ভাবার্থ বুঝিতে এলার কিছু বিলম্ব হইল। অবশেষে বুঝিতে পারিয়া সে নাক সিঁটকাইল; তীব্র অবজ্ঞার কণ্ঠে বলিল, ‘তোমরা বর্বর।’

প্রদ্যুম্ন অবাক হইয়া গেলেন; ভাবিলেন, কি আশ্চর্য! আমরা বর্বর!

ক্রমশ এল আর্যভাষায় কথা কহিতে লাগিল— কোনও কথা বলিতে বা বুঝিতে তাহার বাধে না। একদিন জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমাকে এখানে ধরিয়া রাখিয়াছ কেন?’

প্রদ্যুম্ন ঢোক গিলিয়া বলিলেন, ‘আর্যভাষা শিখাইবার জন্য।’

এলা বলিল ‘ছাই ভাষা। ইহা শিখিয়া কি হইবে?’

প্রদ্যুম্ন একটু রসিকতা করিয়া বলিলেন, ‘প্রেমালাপ করিবার সুবিধা হইবে। মহারাজ মঘবা তোমাকে বিবাহ করিবেন স্থির করিয়াছেন।’

এলা বসিয়া ছিল, ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল, কিছুক্ষণ অপলক নেত্রে প্রদ্যুম্নের পানে চাহিয়া রহিল। তারপর আবার বসিয়া পডিয়া নিশ্চিন্ত স্বরে বলিল, ‘উহাকে আমি বিবাহ করিব না। বর্বর!’

প্রদ্যুম্ন স্তোক দিবার জন্য বলিলেন, ‘মঘবা দাড়ি রাখে বটে, কিন্তু লোক খারাপ নয়—’

এলা শুধু বলিল, ‘বর্বর!’

এমনি ভাবে দিন কাটিতে লাগিল। কিন্তু মঘবার দেখা নাই— তিনি কোদণ্ডদের ঢিট করিলেন অথবা কোদণ্ডেরা তাঁহাকে ঢিট করিল, কোনও সংবাদ নাই! প্রদ্যুম্ন উতলা হইয়া উঠিলেন।

দেখিতে দেখিতে তিন মাস অতীত হইয়া গেল।

একদিন প্রাতঃকালে প্রদ্যুম্ন এলার কূটগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, এলা বাতায়ন-পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বেণী উন্মোচন করিতেছে। প্রদ্যুম্নকে দেখিয়া সে একবার ঘাড় ফিরাইল, তারপর আবার বাহিরের দূর দৃশ্যের পানে তাকাইয়া বেণীর বিসর্পিল বয়ন মোচন করিতে লাগিল।

প্রদ্যুম্ন গলা ঝাড়া দিলেন, কিন্তু কোনও ফল হইল না। তখন তিনি বাতায়ন-সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন; আকাশের দিকে তাকাইলেন, নিম্নে উঁকিঝুঁকি মারিলেন, তারপর পুনশ্চ গলাখাঁকারি দিয়া বলিলেন, ‘শীত আর নাই; দিব্য গরম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে।’

এলা বলিল, ‘হুঁ।’

উৎসাহ পাইয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘আজকাল দক্ষিণ হইতে যে হাওয়া বহিতেছে, তাহাকেই বুঝি তোমরা মলয় সমীরণ বলিয়া থাক? আর্যাবর্তে এ হাওয়া নাই।’

এলা তাঁহার দিকে গম্ভীর চক্ষু তুলিয়া প্রশ্ন করিল, ‘দু-দিন আসা হয় নাই কেন?’

প্রদ্যুম্ন থতমত খাইয়া বলিলেন, ‘ব্যস্ত ছিলাম’,— একটু থামিয়া— ‘তোমার তো আর আর্যভাষা শিখিবার প্রয়োজন নাই। যাহা শিখিয়াছ তাহাতেই আমাদের সকলের কান কাটিয়া লইতে পার।’

কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না; এলা নতনেত্রে মুক্ত বেণী আবার বিনাইতে লাগিল। শেষে প্রদ্যুম্ন পূর্ব কথার জের টানিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘মঘবা আসিয়া পড়িলে বাঁচা যায়। অনেক দিন হইয়া গেল, এখনও তাহার কোন খবর নাই। — দুর্ভাবনা হইতেছে।’

এলা তিলমাত্র সহানুভূতি না দেখাইয়া নির্দয়ভাবে হাসিল, বলিল, ‘তোমার মঘবা আর ফিরিবে না, আমার স্বজাতিরা তাহাকে শেষ করিয়াছে।’

ক্রুদ্ধ চক্ষে চাহিয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘মঘবাকে শেষ করিতে পারে এমন মানুষ দাক্ষিণাত্যে নাই। সে মহাবীর!’

তাচ্ছিল্যভরে এলা বলিল, ‘বর্বর।’

অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘ঐ বর্বরকেই তোমাকে বিবাহ করিতে হইবে।’

ভ্রূভঙ্গি করিয়া এলা বলিল, ‘তাই নাকি! আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে?’

‘তুমি তো বন্দিনী। তোমার আবার ইচ্ছা কি?’

প্রত্যেকটি শব্দ কাটিয়া কাটিয়া এলা উত্তর দিল, ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বিবাহ করিতে পারে এমন পুরুষ তোমাদের আর্যাবর্তে জন্মে নাই— এই বীজের মালা দেখিতেছ?’ এলা দুই আঙুলে নিজ কণ্ঠের বীজমালা তুলিয়া দেখাইল, ‘একটি বীজ দাঁতে চিবাইতে যেটুকু দেরি— আর আমাকে পাইবে না।’

প্রদ্যুম্ন সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, ‘কি সর্বনাশ— বিষ!— দাও, শীঘ্র মালা আমায় দাও।’

এলা দূরে সরিয়া গিয়া বলিল, ‘এত দিন তোমাদের বন্দিনী হইয়া আছি, ভাবিয়াছ আমি অসহায়া? তোমাদের খেলার পুতুল? তাহা নহে। যখন ইচ্ছা আমি মুক্তি লইতে পারি।’

প্রদ্যুম্ন মূঢ়ের মতো তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘তবে লও নাই কেন?’

এলা ক্ষণেক চুপ করিয়া রহিল; তারপর গর্বিত স্বরে বলিল, ‘সে আমার ইচ্ছা।’

এই সময় বাতায়নের বাহিরে দূর উপত্যকায় শঙ্খের গভীর নির্ঘোষ হইল। চমকিয়া প্রদ্যুম্ন সেই দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। সীমান্তের বনানীর ভিতর হইতে ধ্বজকেতনধারী আর্যসেনা ফিরিয়া আসিতেছে। ললাটের উপর করতলের আচ্ছাদন দিয়া প্রদ্যুম্ন সেই দিকে চাহিয়া রহিলেন, তারপর গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, ‘যাক, বাঁচা গেল— মঘবা ফিরিয়াছে!’

প্রদ্যুম্ন তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। পিছন হইতে এলার শান্ত কণ্ঠস্বর আসিল, ‘আমিও বাঁচিলাম, মুক্তির আর দেরি নাই।’

প্রদ্যুম্ন চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, এলা তেমনি দাঁড়াইয়া বেণী বয়ন করিতেছে, তাহার মুখে সূচীবিদ্ধ মৃত প্রজাপতির মতো একটুখানি হাসি।

প্রদ্যুম্ন তাহার কাছে ফিরিয়া গিয়া অনুনয়ের কণ্ঠে বলিলেন, ‘এলা, ছেলেমানুষি করিও না। মঘবাকে বুঝিতে সময় লাগে, বিবাহের পর বুঝিতে পরিবে তাহার মতো মানুষ হয় না— মিনতি করিতেছি, ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ একটা কিছু করিয়া বসিও না।’

এলা বলিল, ‘হঠাৎ কোনও কাজ করা আমার অভ্যাস নয়; আমি কোদণ্ড-কন্যা, বর্বর নহি। যদি মঘবা বলপূর্বক আমাকে বিবাহ করিবার চেষ্টা করে, বিবাহের সভায় আমি মুক্তি লইব।’

মঘবা বলিলেন, ‘কোদণ্ডদের ভাল রকম কাবু করিতে পারিলাম না। ক্ষেপিয়া গেলে ব্যাটারা ভীষণ লড়ে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সন্ধি করিয়াছে।’

প্রদ্যুম্ন প্রশ্ন করিলেন, ‘সন্ধির শর্ত কিরূপ?’

মঘবা উচ্চৈঃস্বরে হাসিলেন, ‘চমৎকার। অদ্ভুত জাত এই কোদণ্ড, আশ্চর্য তাঁহাদের রীতিনীতি। — জনিস, ওদের জাতে মেয়ে বাপের উত্তরাধিকারিণী হয়, ছেলে মামার সম্পত্তি পায়! শুনিয়াছিস কখনও?’

মাথা নাড়িয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘না। কিন্তু সন্ধির শর্ত কিরূপ?’

‘শর্ত এই— কোদণ্ডের রাজকন্যা অপহরণ করাতে তাহাদের মর্যাদায় বড় আঘাত লাগিয়াছে; এই কলঙ্ক-মোচনের একমাত্র উপায় কন্যাকে বিবাহ করা। বিবাহ না করিলে তাহারা যুদ্ধ করিবে, কিছুতেই শুনিবে না। আর যদি বিবাহ করি, তবে উত্তরাধিকারসূত্রে কোদণ্ডদের রাজা হইব। গুরুতর শর্ত নয়?’ বলিয়া মঘবা গলা ছাড়িয়া হাসিতে লাগিলেন।

প্রদ্যুম্ন কিয়াৎকাল হেঁটমুখে রহিলেন, তারপর ঈষৎ হাসিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘গুরুতর বটে।’

মঘবা বলিলেন, ‘সুতরাং আর বিলম্ব নয়, তাড়াতাড়ি কোদণ্ড-কন্যাকে বিবাহ করিয়া ফেলা দরকার। — মেয়েটা ঠিক আছে তো?’

‘ঠিক আছে।’

‘আর্যভাষা কেমন শিখিল?’

‘বেশ।’

‘তবে কালই বিবাহ করিব।’

কিছু কাল নীরব থাকিয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘কন্যার মতামত জানিবার প্রয়োজন নাই?’

‘কিছুমাত্র না। এ রাজকীয় ব্যাপার, কথার নড়চড় চলিবে না। সন্ধির শর্ত পালন করিতেই হইবে।’

সেই দিন গভীর রাত্রে প্রদ্যুম্ন চোরের মতো এলার মহলে প্রবেশ করিলেন। আকাশে প্রায় পূর্ণাবয়ব চন্দ্র গবাক্ষপথে কিরণস্রোত ঢলিয়া দিতেছে; সেই জ্যোৎস্নার তলে মাটিতে পড়িয়া এলা ঘুমাইতেছে। ঘরে প্রদীপ নাই।

নিঃশব্দে প্রদ্যুম্ন তাহার কাছে গেলেন; হাঁটু গাড়িয়া তাহার পাশে বসিলেন; নিশ্বাস রোধ করিয়া তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গেলেন।

এলা ঘুমাইতেছে, কিন্তু তাহার চক্ষের কোণ বাহিয়া বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছে। স্বপ্নে এলা গদগদ অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতেছে— ‘প্রদ্যুম্ন! প্রদ্যুম্ন! প্রদ্যুম্ন! আমি মরিতে চাহি না…তুমি কেমন মানুষ…কিছু বুঝিতে পার না?…বর্বর!…আমাকে উদ্ধার কর…প্রদ্যুম্ন! প্রদ্যুম্ন…’

যে-কার্য করিতে আসিয়াছিলেন তাহা করা হইল না, বীজের মালা এলার কণ্ঠেই রহিল। প্রদ্যুম্ন চোরের মতো নিঃশব্দে ফিরিয়া গেলেন।

পরদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাকাশে চন্দ্রোদয় হইল। মঘবা রাত্রির জন্যই প্রতীক্ষণ করিতেছিলেন, বলিলেন, ‘প্রদ্যুম্ন, এবার বিবাহের আয়োজন কর।’

রাজভবনের সম্মুখস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ধুনির মতো অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল; অগ্নি সাক্ষী করিয়া বিবাহ হইবে। হোমাগ্নির পুরোভাগে বরবধূর কাষ্ঠাসন-পীঠিকা সন্নিবেশিত হইল।

বিবাহের সংবাদ পূর্বাহ্ণেই প্রচারিত হইয়াছিল; উৎসুক জনমণ্ডলী প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে লাগিল।

বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া প্রদ্যুম্ন একদৃষ্টে অগ্নির পানে তাকাইয়া আছেন; একবার বক্ষপঞ্জর ভেদ করিয়া একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বাহির হইল।

মঘবা আসিয়া স্কন্ধে হাত রাখিতে তাহার চমক ভাঙ্গিল, অগ্নি হইতে চক্ষু তুলিয়া সম্মুখে চাহিলেন। সম্মুখেই চন্দ্র; বৃক্ষশাখার অন্তরাল ছাড়াইয়া এইমাত্র ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে। প্রদ্যুম্ন সেই দিকে তাকাইয়া রহিলেন।

মঘবা বলিলেন, ‘রাত্রি হইয়াছে, বিবাহের সময় উপস্থিত। তুই এবার গিয়া বধূকে লইয়া আয়।’

প্রদ্যুম্ন ধীরে ধীরে মঘবার দিকে ফিরিলেন; গম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন, ‘সেনাপতি মঘবা!’

মঘবা ভ্যাবাচ্যাক খাইয়া গেলেন। রাজা হওয়ার অভ্যাস তাঁর প্রাণে এমনই বসিয়া গিয়াছিল যে প্রথমটা কিছু বুঝিতেই পারিলেন না। তারপর প্রদ্যুম্নের দৃষ্টি অনুসরণ করিতেই চাঁদের প্রতি চক্ষু পড়িল।

আকাশ নির্মেঘ কিন্তু চন্দ্রের শুভ্র মুখের উপর ধূম্রবর্ণ ছায়া পড়িয়াছে; করাল ছায়া ধীরে ধীরে চন্দ্রকে গ্রাস করিবার উপক্রম করিতেছে।

প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ‘সেনাপতি মঘবা, আমি বধূকে আনিতে যাইতেছি; সন্ধির শর্ত রক্ষার জন্য আমিই তাহাকে বিবাহ করিব। ইতিমধ্যে তুমি প্রজামণ্ডলকে ব্যাপারটা বুঝাইয়া দাও।’

মঘবা কিয়ৎকাল স্তম্ভের মতো নিশ্চল হইয়া রহিলেন। তারপর তাঁহার প্রচণ্ড অট্টহাস্যে আকাশ বিদীর্ণ হইয়া গেল।

সহসা হাস্য থামাইয়া মঘবা করজোড়ে বলিলেন, ‘যে আজ্ঞা মহারাজ।’

এলা বাতায়নের পাশে বসিয়া ছিল, প্রদ্যুম্ন প্রবেশ করিতেই উঠিয়া দাঁড়াইল।

‘আমাকে লইতে আসিয়াছ?’

‘হাঁ রাজকুমারী। কোদণ্ডদের সহিত আমাদের সন্ধি হইয়াছে; তাহার শর্ত এই যে, আর্যরাজা কোদণ্ড-কন্যাকে বিবাহ করিবেন। আমরা ধর্মত এই শর্ত পালন করিতে বাধ্য।’

‘আর কিছু বলিবার আছে?’

‘সামান্য। ঘটনাক্রমে আমি এখন আর্যরাজা, মঘবা আমার সেনাপতি। সুতরাং বিবাহ করিতে হইলে আমাকেই বিবাহ করিতে হইবে।’

এলা দীর্ঘকাল বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া স্থির হইয়া রহিল; শেষে ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করিল, ‘কি বলিলে?’

প্রদ্যুম্ন রাজকীয় গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন, ‘আমাকে বিবাহ করিতে হইবে। এখন চট্‌ করিয়া স্থির করিয়া ফেল, বিবাহ করিবে, না বীজ ভক্ষণ করিবে।’

স্বপ্নের অবরুদ্ধ আকুলতা এতক্ষণে বন্যার মতো নামিয়া আসিল, দলিতাঞ্জন চক্ষু দুইটি ছাপাইয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।

প্রদ্যুম্ন বাতায়নের উপর উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘গ্রহণ ছাড়িতে এখনও বিলম্ব আছে। ততক্ষণ তোমাকে বিবেচনা করিবার সময় দিলাম।’

বর্ষণের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ-চমকের মতো হাসি হাসিয়া এলা বলিল, ‘বর্বর!’

৯ আষাঢ় ১৩৪৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *