গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৬. রমণীর মন

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – রমণীর মন

স্কন্ধাবার তখনও জাগে নাই; পূর্বদিকের পর্বতরেখা আকাশের গায় পরিস্ফুট হইতে আরম্ভ করিয়াছে। চিত্রক ও গুলিক বর্মা একশত সশস্ত্র অশ্বারোহী লইয়া যাত্রা করিল। চতুর্দিকের সুবিপুল নিস্তব্ধতার মধ্যে অশ্বের ক্ষুরধ্বনি ও অস্ত্রের ঝনৎকার অতি ক্ষীণ শুনাইল।

স্কন্দের অধিকৃত এই উপত্যকা হইতে নির্গমনের একটি পথ উত্তর দিকে, দুই গিরিশ্রেণীর মধ্যস্থলে প্রণালীর ন্যায় সঙ্কীর্ণ সঙ্কট-পথ। এই সঙ্কট প্রায় দুই ক্রোশ দূর পর্যন্ত এক সহস্র সতর্ক প্রহরী দ্বারা রক্ষিত। পাছে শত্রু অতর্কিতে স্কন্ধাবার আক্রমণ করে তাই দিবারাত্র প্রহরার ব্যবস্থা। গুলিক বর্মা ও চিত্রক এই সঙ্কটমার্গ দিয়া চলিল। প্রহরীরা সংবাদ জানিত, তাহারা নিঃশব্দে পথ ছাড়িয়া দিল। ক্রমে সূর্য উঠিল, বেলা বাড়িতে লাগিল। সঙ্কট কখনও প্রশস্ত হইতেছে, আবার শীর্ণ হইতেছে; কদাচ বক্র হইয়া অন্য উপত্যকায় মিশিতেছে। মাঝে মাঝে স্কন্দের গুপ্তচরেরা প্রচ্ছন্ন গুল্ম রচনা করিয়া অবস্থান করিতেছে; তাহাদের নিকট পথের সন্ধান জানিয়া লইয়া গুলিক বর্মার দল অগ্রসর হইল।

গুলিক ও চিত্রকের অশ্ব অগ্রে চলিয়াছে; পশ্চাতে শত যোদ্ধা। গুলিক স্বভাবত একটু বহুভাষী, এক রাত্রির পরিচয়ে চিত্রকের প্রতি তাহার সদ্ভাব জন্মিয়াছে; দু’জনেই সমপদস্থ সমবয়স্ক এবং যুদ্ধজীবী। গুলিক নানাবিধ প্রগল্‌ভ জল্পনা করিতে করিতে যাইতেছে; কোন্‌ রাজ্যের যোদ্ধারা কেমন যুদ্ধ করে, কোন্‌ দেশের যুবতীদের কিরূপ প্রণয়রীতি, আপন অভিজ্ঞতা হইতে এই সকল কাহিনী শুনাইতে শুনাইতে ধূমকেতুর ন্যায় গুম্ফ আমর্শন করিয়া অট্টহাস্য করিতে করিতে চলিয়াছে। গুলিকের সরল চিত্তে যুদ্ধ ও যুবতী ভিন্ন অন্য কোনও চিন্তার স্থান নাই।

চিত্রক গুলিকের কথা শুনিতেছে, তাহার সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া উচ্চ হাস্য করিতেছে, কদাচিৎ নিজেও দুই একটি সরস কাহিনী শুনাইতেছে। কিন্তু তাহার হৃদয়ের মর্মস্থলে একটি ভাবনা লূতা-কীটের ন্যায় নিভৃতে জাল বুনিতেছে। রট্টা…মন বলিতেছে রট্টা আর তাহার হইবে না। বিদ্যুৎ শিখার মত অকস্মাৎ সে তাহার অন্তরে আসিয়াছিল, আবার বিদ্যুৎ শিখার মতই অন্তর্হিত হইল, শুধু তাহার শূন্য অন্তর্লোকের অন্ধকার বাড়াইয়া দিয়া গেল। কাল রাত্রে সে বলিয়াছিল— ইহাতে ভালই হইবে। স্কন্দগুপ্ত রট্টার প্রতি আসক্ত হইয়াছেন, ইহাতে ভালই হইবে। …কাহার ভাল হইবে?

কিন্তু রট্টার দোষ নাই। নব-যৌবনের স্বভাববশে সে চিত্রকের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল; দুই দিনের নিত্য-সাহচর্য প্রীতির সৃজন করিয়াছিল…রাত্রে গুহার অন্ধকারে ভয়ব্যাকুল চিত্তে রট্টা যে-কথা বলিয়াছিল, যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিল তাহার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা যায় না; ক্ষণিকের আবেগ-বিহ্বলতাকে স্থায়ী মনোভাব মনে করা অন্যায়। রমণীর মন কোমল ও তরল— অল্প তাপে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে।

এই সময় চিত্রক গুলিকের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইল; গুলিক একটি গল্প শেষ করিয়া বলিতেছে— ‘বন্ধু চিত্রক বর্মা, নারী যতক্ষণ তোমার বাহুমধ্যে আবদ্ধ থাকে ততক্ষণ তোমার, বাহুমুক্ত হইলে আর কেহ নয়। অনেক দেশের অনেক নারী দেখিলাম; সকলে সমান, কোনও প্রভেদ নাই।’

চিত্রক হাসিয়া বলিল— ‘আমারও তাহাই অভিজ্ঞতা।’

গুলিক আবার নূতন কাহিনী আরম্ভ করিল।

না, চিত্রক রট্টাকে মন্দ ভাবিবে না। রট্টা রাজকন্যা; স্কন্দকে দেখিয়া সে যদি মনে মনে তাঁহার অনুরাগিণী হইয়া থাকে ইহাতে বিচিত্র কি? স্কন্দের অনুরাগের যোগ্য পাত্র আর্যাবর্তে আর কে আছে?…ইহাতে ভালই হইবে। — মণিকাঞ্চন যোগ হইবে। …

জল নিম্নে অবতরণ করে, অগ্নির স্ফুলিঙ্গ ঊর্ধ্বে উচ্ছ্রিত হয়। রট্টা অগ্নির স্ফুলিঙ্গ; এত রূপ এত গুণ কি সাধারণ মানুষের ভোগ্য হইতে পারে?

কিন্তু—

চিত্রকের এখন কী হইবে? সাতদিনের মধ্যে তাহার জীবন সম্পূর্ণ ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে। সাতদিন আগে সে যে-মানুষ ছিল, এখন আর সে-মানুষ নাই। সে রাজপুত্র; কিন্তু নিঃস্ব অজ্ঞাত রাজপুত্র; যতদিন সে নিজেকে সামান্য সৈনিক বলিয়া জানিত ততদিন তাহার চরিত্র অন্যরূপ ছিল…আর কি সে সামান্য সৈনিক সাজিয়া যুদ্ধ করিতে পরিবে? তবে তাহার কী দশা হইবে? কী লইয়া সে জীবন কাটাইবে? লক্ষ্যহীন নিরালম্ব জীবন..যে আশাতীত আকাঙ্ক্ষার বস্তু অনাহূত তাহার হৃদয়ের উপকূলে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, প্রবলতর স্রোতের টানে সে দূরে ভাসিয়া যাইতেছে—

এখন সে কী করিবে? তাহার জীবনে আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি?

গুলিক বর্মার হাস্য-কণ্টকিত কণ্ঠস্বর চিত্রকের কর্ণে স্পষ্ট হইয়া উঠিল। গুলিক বলিতেছে— ‘তিন বৎসর পরে সেই শত্রুর সাক্ষাৎ পাইলাম। বন্ধু, ভাবিয়া দেখ, পুরাতন শত্রুকে তরবারির অগ্রে পাওয়ার সমান আনন্দ আর আছে কি?’

চিত্রক বলিল— ‘না, এমন আনন্দ আর নাই।’

গুলিক বলিল— ‘সেদিন শত্রুর রক্তে তরবারির তর্পণ করিয়াছিলাম, সেকথা স্মরণ করিলে আজিও আমার হৃদয় হর্ষোৎফুল্ল হয়। ইহার তুলনায় রমণীর আলিঙ্গনও তুচ্ছ।’

চিত্রকের মনে পড়িয়া গেল যে পুরাতন শত্রুর উপর প্রতিহিংসা সাধন— এই কার্যটি বাকি আছে। যে তাহার পিতাকে হত্যা করিয়াছিল তাহাকে বধ করিয়া ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য পালন এখনও বাকি আছে। নিয়তি কুটিল পথে তাহাকে সেইদিকেই লইয়া যাইতেছে। রোট্ট ধর্মাদিত্যকে হত্যা করিয়া সে পিতৃঋণ মুক্ত হইবে।

তারপর? তারপর কি হইবে ভাবিবার প্রয়োজন নাই। সকল পথের শেষেই তো মৃত্যু।

চিত্রক চষ্টন দুর্গের অভিমুখে চলুক, আমরা স্কন্দের শিবিরে ফিরিয়া যাই।

প্রাতঃকালে স্কন্দ বহিঃকক্ষে আসিয়া বসিলে পিপ্পলী মিশ্র তাঁহাকে স্বস্তিবাচন করিয়া বলিলেন— ‘বয়স্য, কাল রাত্রে বড় বিপদ গিয়াছে।’

স্কন্দ অন্যমনস্ক ছিলেন; বলিলেন— ‘বিপদ!’

পিপ্পলী বলিলেন— ‘শত্রু আমাদের সন্ধান পাইয়াছে। বয়স্য, এ স্থান আর নিরাপদ নয়।’

স্কন্দ তাঁহার বয়স্যকে চিনিতেন, তাই উদ্বিগ্ন হইলেন না। জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কাল রাত্রে কি ঘটিয়াছিল?’

পিপ্পলী বলিলেন— ‘কাল পরম সুখে নিদ্রা গিয়াছিলাম, মধ্যরাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। অনুভব করিলাম, মেরুদণ্ডের অধোভাগে কি কিলবিল করিতেছে। ভারি আনন্দ হইল; বুঝিলাম কুলকুণ্ডলিনী জাগিতেছেন। জপতপ ধ্যানধারণা অধিক করি না বটে কিন্তু গোত্রফল কোথায় যাইবে? অতঃপর সহসা অনুভব করিলাম, কুণ্ডলিনী আমাকে দংশন করিতেছে— দারুণ জ্বালা। দ্রুত উঠিয়া অনুসন্ধান করিলাম। কি বলিব, বয়স্য, কুণ্ডলিনী নয়— পরম-ঘোর কাষ্ঠ-পিপীলিকা। তদবধি আর ঘুমাইতে পারি নাই।’

স্কন্দ ঈষৎ বিমনাভাবে বলিলেন— ‘কাল আমিও ঘুমাইতে পারি নাই।’

পিপ্পলী বলিলেন— ‘অ্যাঁ? তোমারও কাষ্ঠ-পিপীলিকা?’

স্কন্দ উত্তর দিলেন না, মনে মনে বলিলেন— ‘প্রায়।’

এই সময় মহাবলাধিকৃত ও কয়েকজন সেনাপতি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রণা আরম্ভ হইল। শত্রুপক্ষ সম্বন্ধে যে সকল সংবাদ সংগৃহীত হইয়াছিল তাহা লইয়া বাক্‌বিতণ্ডা তর্কবিচার চলিল। পরিশেষে স্থির হইল, শত্রুর অভিপ্রায় যতক্ষণ না স্পষ্ট হইতেছে ততক্ষণ তাহাদের আক্রমণ করা হইবে না; শত্রু যদি আক্রমণ করে তখন তাহাদের প্রতিরোধ করা হইবে। বর্তমানে স্কন্দের স্কন্ধাবার এই উপত্যকাতেই থাকিবে, স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন নাই। এখান হইতে, শত্রু যে-পথেই যাক তাহার উপর দৃষ্টি রাখা চলিবে।

মন্ত্রণা সমাপ্ত হইতে দ্বিপ্রহর হইল। আহারাদি সম্পন্ন করিয়া স্কন্দ বিশ্রাম গ্রহণ করিলেন। লহরী আজ রট্টার সেবায় নিযুক্ত ছিল, একজন ভৃত্য স্কন্দকে ব্যজন করিল।

বিশ্রামান্তে স্কন্দ গাত্রোত্থান করিলে লহরী আসিয়া বলিল— ‘কুমার-ভট্টারিকা রট্টা যশোধরা আসিতেছেন।’

রট্টা আসিয়া রাজার সম্মুখে দাঁড়াইল। সর্বাঙ্গে স্বর্ণভূষা ঝলমল করিতেছে, পরিধানে জবাপুষ্পের ন্যায় রক্তবর্ণ চীনপট্ট; সীমন্তে মুক্তাফলের ললাম। লহরী অতি যত্নে কবরী বাঁধিয়া দিয়াছে। রাজা মুগ্ধ বিস্ফারিত নেত্রে এই কন্দর্প-বিজয়িনী মূর্তির পানে চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণেকের জন্য নিজ অন্তরের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন; ভাবিলেন, জীবন ভঙ্গুর, সুখ চঞ্চল; সারা জীবন যাহা খুঁজিয়া পাই নাই, তাহা যখন আপনি কাছে আসিয়াছে তখন আর বিলম্ব করিব না—

রট্টা রাজাকে প্রণাম করিয়া গদ্‌গদ কণ্ঠে বলিল— ‘দেব, এই সকল উপহারের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিব কি, বিস্ময়ে আমি হতবাক্‌ হইয়াছি। আপনি কি ইন্দ্রজাল জানেন? নারী-বর্জিত সৈন্য-শিবিরে এই সকল অপূর্ব নূতন বস্ত্র অলঙ্কার কোথায় পাইলেন?’

স্মিতহাস্য করিয়া স্কন্দ বলিলেন— ‘সুচরিতে, চেষ্টা এবং পুরুষকার দ্বারা অপ্রাপ্য বস্তুও লাভ করা যায়।’

রট্টা নম্রকণ্ঠে বলিল— ‘তাহাই হইবে। আমি নারী, পুরুষকারের শক্তি কি করিয়া বুঝিব? প্রার্থনা করি আপনার সর্বজয়ী পুরুষকার চিরদিন অক্ষয় থাকুক। উপহারের জন্য আমার অন্তরের ধন্যবাদ গ্রহণ করুন আর্য।’

স্কন্দ বলিলেন— ‘ধন্যবাদের প্রয়োজন নাই। তোমাকে উপহার দিয়া এবং সেই উপহার তোমার অঙ্গে শোভিত দেখিয়া আমি তোমার অপেক্ষা অধিক আনন্দ উপভোগ করিতেছি।’

স্কন্দের প্রশংসাদীপ্ত নেত্রতলে রট্টা সলজ্জ নতমুখে রহিল। স্কন্দ তখন বলিলেন— ‘যুদ্ধের চিন্তায় সর্বদা মগ্ন আছি, তোমার চিত্তবিনোদনের কোনও চেষ্টাই করিতে পারি নাই। এই সৈন্য-শিবিরে একাকিনী থাকিয়া তোমার মন নিশ্চয় উচাটন হইয়াছে, এস পাশা খেলি। খেলিবে?’

স্মিতমুখ তুলিয়া রট্টা বলিল— ‘খেলিব মহারাজ।’

স্কন্দের আদেশে লহরী পাশাক্রীড়ার অক্ষবাট প্রভৃতি আনিয়া পাতিয়া দিল। রট্টা ও স্কন্দ অক্ষবাটের দুইদিকে বসিলেন।

রাজা পাশাগুলি দুই হস্তে ঘষিতে ঘষিতে মৃদু হাসিয়া বলিলেন— ‘কি পণ রাখিবে?’

রট্টা দীনভাবে বলিল— ‘আমার তো এমন কিছুই নাই মহারাজ, যাহা আপনার সম্মুখে পণ রাখিতে পারি।’

স্কন্দ প্রীতকণ্ঠে বলিলেন— ‘উত্তম, পাণ এখন উহ্য থাক। যদি জয়ী হই তখন দাবি করিব।’

রট্টা বলিল— ‘কিন্তু আর্য, যে পণ আমার সাধ্যাতীত তাহা যদি আপনি আদেশ করেন, কী করিয়া দিব? পণ দিতে না পারিলে আমার যে কলঙ্ক হইবে।’

স্কন্দ বলিলেন— ‘তোমার সাধ্যাতীত পণ চাহিব না— তুমি নিশ্চিন্ত থাক।’

‘ভাল মহারাজ! — আপনি কি পণ রাখিবেন?’

‘তুমি কি পণ চাও?’

রট্টা বলিল— ‘যদি বলি দণ্ড-মুকুট— ছত্র-সিংহাসন? মহারাজ, পণ রাখিবেন কি?’

অনুরাগপূর্ণ চক্ষে রট্টার দিকে অবনত হইয়া স্কন্দ গাঢ়স্বরে বলিলেন— ‘এই পণ কি তুমি সত্যই চাও?’

ক্ষণেক নীরব থাকিয়া রট্টা ধীরস্বরে বলিল— ‘আপনার পণও এখন উহ্য থাক, যদি জিতিতে পারি তখন চাহিয়া লইব।’

‘ভাল।’ বলিয়া স্কন্দ রুদ্ধশ্বাস মোচন করিলেন।

অতঃপর অক্ষক্রীড়া আরম্ভ হইল। মহারাজ স্কন্দগুপ্ত নবযুবকের ন্যায় উৎসাহ ও উত্তেজনা লইয়া নানা প্রকার রঙ্গ পরিহাস করিতে করিতে খেলিতে লাগিলেন। রট্টাও হাস্যকৌতুকে যোগ দিয়া পরম আনন্দে খেলিতে লাগিল। উভয়ে খেলায় মগ্ন হইয়া গেলেন।

এতক্ষণ লহরী ও পিপ্পলী মিশ্র এই কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। পিপ্পলী অদূরে বসিয়া খেলা দেখিতেছিলেন; কিছুক্ষণ খেলা চলিবার পর মুখ তুলিয়া দেখিলেন, লহরী তাঁহাকে চোখের ইঙ্গিত করিতেছে। পিপ্পলী মিশ্র ইঙ্গিত বুঝিলেন। তারপর লহরী যখন লঘুপদে কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল, তখন পিপ্পলীও নিঃশব্দে পা টিপিয়া নিষ্ক্রান্ত হইলেন। রট্টা ও স্কন্দ ভিন্ন কক্ষে আর কেহ রহিল না। তাঁহারাও খেলায় এমনই নিমগ্ন হইয়া গিয়াছিলেন যে, তাহাদের অলক্ষ্য অন্তর্ধান জানিতে পারিলেন না।

প্রায় তিন ঘটিকা মহা উৎসাহে খেলা চলিবার পর বাজি শেষ হইল। পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ স্কন্দ পরাজিত হইলেন।

রট্টা করতালি দিয়া হাসিয়া উঠিল। স্কন্দ বলিলেন— ‘রট্টা যশোধরা, আমি তোমার নিকট পরাজয় স্বীকার করিলাম। এখন কী পণ লইবে লও। দণ্ড-মুকুট ছত্র-সিংহাসন সমস্তই লইতে পার।’

রট্টা বলিল— ‘না মহারাজ, অত স্পর্ধা আমার নাই। আমার ক্ষুদ্র পণ যথাসময় যাচনা করিব।’

স্কন্দ কিয়ৎকাল রট্টার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘ভাবিয়াছিলাম পাশার বাজিতে তোমার নিকট হইতে এক অমূল্য বস্তু জিতিয়া লইব। কিন্তু তাহা হইল না। এখন নিতান্ত দীনভাবে তোমার নিকট ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া অন্য পথ নাই। তুমি ভিক্ষা দিবে কি?’

স্কন্দ যে-কথা বলিতে উদ্যত হইয়াছেন তাহা রট্টার অপ্রত্যাশিত নয়; তবু তাহার হৃৎপিণ্ড দুরু দুরু করিয়া উঠিল। সে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল— ‘আদেশ করুন আর্য।’

স্কন্দ বলিলেন— ‘আমার বয়স পঞ্চাশ বৎসর, কিন্তু আমি বিবাহ করি নাই। বিবাহের প্রয়োজন কোনও দিন অনুভব করি নাই। এইরূপ নিঃসঙ্গভাবেই জীবন কাটিয়া যাইবে ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখিয়া, তোমার পরিচয় পাইয়া তোমাকে জীবনসঙ্গিনী করিবার ইচ্ছা হইয়াছে।’

স্কন্দ এইটুকু বলিয়া নীরব হইলেন। রট্টাও দীর্ঘকাল নতমুখে নির্বাক রহিল। তারপর অতি কষ্টে স্খলিত বাক্ সংযত করিয়া বলিল— ‘দেব, আমি এ সৌভাগ্যের যোগ্য নই। আমাকে ক্ষমা করুন।’

স্কন্দের চোখে ব্যথাবিদ্ধ বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল— ‘তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিতেছ?’

সজল চক্ষু তুলিয়া রট্টা বলিল— ‘মহারাজ, আপনি অসীম শক্তিধর, সমুদ্রমেখলা আর্যভূমির অধীশ্বর; কেবল এই তুচ্ছ নারীদেহ লইয়া সন্তুষ্ট হইবেন?’

তীক্ষ্ণচক্ষে রট্টার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া স্কন্দ বলিলেন— ‘না, তোমার দেহ-মন দুই-ই আমার কাম্য। যদি হৃদয় না পাই, দেহে আমার প্রয়োজন নাই। এই বয়সে প্রাণশূন্য নারীদেহ বহন করিয়া বেড়াইতে পারিব না।’

গলদশ্রুনেত্রা রট্টা কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিল— ‘রাজাধিরাজ, তবে মার্জনা করুন। হৃদয় দিবার অধিকার আমার নাই।’

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া স্কন্দ বলিলেন— ‘অন্যকে হৃদয় অর্পণ করিয়াছ?’

রট্টা মুখ অবনত করিল, পুষ্পের মর্মকোষে সঞ্চিত শিশির বিন্দুর ন্যায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরিয়া তাহার বক্ষে পড়িল।

দীর্ঘকাল উভয়ে নীরব। স্কন্দ ভূমিতে এক হস্ত রাখিয়া অক্ষবাটের দিকে চাহিয়া আছেন; তাঁহার মুখে বিচিত্র ভাবব্যঞ্জনা পরিস্ফুট হইয়া আবার মিলাইয়া যাইতেছে। শেষে তিনি একটি গভীর নিশ্বাস ফেলিলেন; তাঁহার অধরে ক্ষীণ হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন— ‘কিছুক্ষণ পূর্বে আমি বলিয়াছিলাম, পুরুষকার দ্বারা অপ্রাপ্য বস্তুও লাভ করা যায়। ভুল বলিয়াছিলাম। ভাগ্যই বলবান। কিন্তু তুমি ধন্য, ধন্য তোমার প্রেম। তোমার প্রেম পাইলাম না, এ ক্ষোভ মরিলেও যাইবে না।’

রট্টা সঙ্কুচিত হইয়া বসিয়া রহিল, কথা বলিতে পারিল না। স্কন্দ আবার বলিলেন— ‘যাহাকে তুমি হৃদয় দান করিয়াছ সে যেই হোক— আমা অপেক্ষা ভাগ্যবান। তুমি বুদ্ধিমতী, তোমাকে প্রলোভন দেখাইব না; বলপূর্বক তোমাকে গ্রহণ করিবার চেষ্টাও করিব না। দীর্ঘকাল বলের চর্চা করিয়া দেখিয়াছি, বলের দ্বারা হৃদয় জয় করা যায় না। তুমি কাঁদিও না। আমি কখনও পরস্ব হরণ করি নাই, আজও তাহা করিব না। — তোমার নিকট একটি প্রার্থনা— আমাকে ভুলিও না, আমি যখন ইহলোকে থাকিব না, তখনও আমাকে মনে রাখিও।’

স্কন্দের পদস্পর্শ করিয়া বাষ্পাকুলকণ্ঠে রট্টা বলিল— ‘দেব, যতদিন বাঁচিয়া থাকিব, আমার হৃদয় মন্দিরে আপনার মূর্তি দেবতার ন্যায় পূজা পাইবে।’

স্কন্দ রট্টার মস্তক স্পর্শ করিয়া বলিলেন— ‘সুখী হও।’

স্কন্দের শিবিরে যখন এই দৃশ্যের অভিনয় হইতেছিল, সেই সময় চিত্রক ও গুলিক বর্মা দলবল লইয়া চষ্টন দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হইল। দিবা তখন একপাদ অবশিষ্ট আছে।