তক্ত্ মোবারক
১
মুরশিদাবাদের প্রাচীন রাজপ্রাসাদের অনাবৃত চত্বরে বহুদিন ধরিয়া একখানি রাজসিংহাসন পড়িয়া থাকিত। ইহার নাম তক্ত্ মোবারক— মঙ্গলময় সিংহাসন। অতি সাধারণ প্রস্তরে নির্মিত অনতিবৃহৎ সিংহাসন, বোধ করি দেড় শত বৎসর এমনি অনাদরে অবহেলায় পড়িয়াছিল। যে বণিক-সম্প্রদায়ের তুলাদণ্ড সহসা একদিন রাজদণ্ডে পরিণত হইয়াছিল, তাঁহারা সুড়ঙ্গপথের অন্ধকারে আপনি সিংহাসন লইয়া আসিয়াছিলেন, এই পুরাতন সিংহাসন ব্যবহার করেন নাই। তক্ত্ মোবারকে শেষ উপবেশন করিয়াছিলেন প্রভুদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর।
পরবর্তী কালে লর্ড কার্জন প্রত্নরক্ষায় তৎপর হইয়া এই সিংহাসন কলিকাতায় আনয়ন করেন, পরে উহা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রক্ষিত হয়।
তক্ত্ মোবারক— মঙ্গলময় সিংহাসন! কথিত আছে, এখনও গ্রীষ্মকালে এই সিংহাসনের পাষাণগাত্র বহিয়া রক্তবর্ণ স্বেদ ঝরিতে থাকে, যেন বিন্দু বিন্দু রক্ত ক্ষরিত হইতেছে। সেকালে মুরশিদাবাদের মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল, বাদশাহীর অতীত গৌরবগরিমা স্মরণ করিয়া তক্ত্ মোবারক শোণিতাশ্রু বিসর্জন করে। কিন্তু তাহা ভ্রান্ত বিশ্বাস। তক্ত্ মোবারকের শোণিত-ক্ষরণের ইতিকথা আরও নিগূঢ়, আরও মর্মান্তিক।
তক্ত্ মোবারকের মতো এমন অভিশপ্ত সিংহাসন বোধ করি পৃথিবীতে আর নাই। সুবা বিহারের অন্তর্ভুক্ত মুঙ্গের শহরে এই সিংহাসন নির্মিত হইয়াছিল, সম্রাট সাজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান সুজা আদেশ দিয়া উহা নির্মাণ করাইয়াছিলেন। জন্মক্ষণ হইতেই অভিশাপের কালকূট যে এই সিংহাসনের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ডটি নিষিক্ত করিয়া রাখিয়াছে সুজা তাহা জানিতেন না, বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বুঝিতে পারেন নাই; এই বিশেষত্বহীন স্থূল কারুকার্য-খচিত সিংহাসনটির প্রতি তাঁহার অহেতুক মোহ জন্মিয়াছিল।
তখন সাজাহানের রাজত্বশেষে ভ্রাতৃযুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। ঔরংজেবের নিকট পরাভূত হইয়া সুলতান সুজা পলায়নের পথে কিছুকাল মুঙ্গেরে অবস্থান করিয়াছিলেন; তারপর ঔরংজেবের সেনাপতি মীরজুম্লার তাড়া খাইয়া সেখান হইতে রাজমহলে পলায়ন করেন। তক্ত্ মোবারক তাঁহার সঙ্গে ছিল। কিন্তু রাজমহলেও বেশি দিন থাকা চলিল না, তিনি সিংহাসন লইয়া ঢাকায় গেলেন।
মীরজুম্লা যখন তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ঢাকায় উপস্থিত হইলেন তখন সুজার শোচনীয় অবস্থা; তিনি তক্ত্ মোবারক ঢাকায় ফেলিয়া আরাকানে পলায়ন করিলেন। অতঃপর যে রক্ত-কলুষিত স্বখাত-সলিলে তাঁহার সমাধি হইল তাহার বহু কিম্বদন্তী আছে, কিন্তু জীবিতলোকে আর তাঁহাকে দেখা যায় নাই। শাহেনশা বাদশার পুত্র এবং ময়ূর সিংহাসনের উমেদার সুজার ইতিবৃত্ত এইখানেই শেষ! অভিশাপ কিন্তু এখনই শেষ হইল না।
পরিত্যক্ত সিংহাসন মীরজুম্লার কবলে আসিল। মীরজুম্লা অন্তরে অন্তরে দুরন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন; সুবা বাংলার সিংহাসনের উপর তাঁহার লোভ ছিল। তক্ত্ মোবারক হাতে পাইয়া তাঁহার লোভ আরও বাড়িল। কিন্তু ঔরংজেবকে তিনি যমের মতো ভয় করিতেন। একদিন গোপনে তিনি নিজ শিবিরে তক্ত্ মোবারকের উপর মসলন্দ পাতিয়া বসিলেন এবং আলবোলায় অম্বুরী তামাকু সেবন করিতে করিতে প্রভু-দ্রোহিতার স্বপ্ন দেখিলেন।
ইহার কিছুদিন পরে অকস্মাৎ তাঁহার মৃত্যু হইল।
অতঃপর তক্ত্ মোবারক কি করিয়া ঢাকা হইতে আবার পশ্চিম বঙ্গে ফিরিয়া আসিল তাহার কোনও ইতিহাস নাই। নবাবী আমলে মুরশিদকুলি খাঁর জামাতা সুজা খাঁ এই সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। শীঘ্রই তাঁহার মৃত্যু হইল।
তাঁহার পুত্র সরফরাজ সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। সরফরাজকেও বেশি দিন রাজ্য ভোগ করিতে হয় নাই। গিরিয়ার প্রান্তরে বিদ্রোহী ভৃত্য আলিবর্দির সহিত যুদ্ধে তিনি নিহত হইলেন। আলিবর্দি শূন্য সিংহাসন দখল করিলেন।
আলিবর্দির পালা শেষ হইলে আসিলেন সিরাজদ্দৌলা। তাঁহার পর মীরজাফরও এই সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। তারপর যবনিকা পড়িল।
তক্ত্ মোবারকের রক্তক্ষরণ শোকাশ্রু নয়। ইহার মূল উৎস অন্বেষণ করিতে হইলে তক্ত্ মোবারকের রচয়িতা মুঙ্গের নিবাসী খ্বাজা নজর বোখারী নামক জনৈক প্রস্তর-শিল্পীর জীবন কাহিনী অনুসন্ধান করিতে হয়। কে ছিল এই খ্বাজা নজর বোখারী?
তক্ত্ মোবারকের গায়ে পারস্য ভাষায় নিম্নোক্ত কথাগুলি খোদিত আছে— ‘এই পরম মঙ্গলময় তক্ত্ মোবারক সুবা বিহারের মুঙ্গের শহরে ১০৫২ সালের ২৭ শাবান তারিখে দাসানুদাস খ্বাজা নজর বোখারী কর্তৃক নির্মিত হইয়াছিল।’
এই পরম মঙ্গলাস্পদ তক্ত্ মোবারকের প্রত্যেকটি প্রস্তরখণ্ডে শিল্পী খ্বাজা নজর বোখারী তাহার পিতৃহৃদয়ের জ্বলন্ত রক্তাক্ত অভিশাপ ঢালিয়া দিয়াছিল। যতদিন সিংহাসনের অস্তিত্ব থাকিবে ততদিন এই অভিশাপের বিষক্রিয়া শান্ত হইবে না। শুধু সুলতান সুজার বিরুদ্ধেই নয়, এ অভিশাপ গর্বান্ধ উচ্ছৃঙ্খল রাজশক্তির বিরুদ্ধে, মানুষের মনুষ্যত্বকে যাহারা শক্তির দর্পে অপমান করে তাহাদের বিরুদ্ধে। তাই বোধ হয় ইহার ক্রিয়া এখনও শেষ হয় নাই।
২
মুঙ্গেরে উত্তরবাহিনী গঙ্গা প্রাচীন কেল্লার কোল দিয়া বহিয়া গিয়াছে। আজ হইতে তিন শত বছর আগেকার কথা; কিন্তু তখনই মুঙ্গেরের কেল্লা পুরাতন বলিয়া পরিগণিত হইত। তাহারও শতাধিক বর্ষ পূর্বে লোদি বংশের এক নরপতি বিহার পুনরধিকার করিতে আসিয়া মুঙ্গেরে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তখনও এই কেল্লা দণ্ডায়মান ছিল। কোন্ স্মরণাতীত যুগে কাহার দ্বারা এই দুর্গ নির্মিত হইয়াছিল কেহ জানে না। হিন্দুরা বলিত, জরাসন্ধের দুর্গ।
মুঘল বাদশাহীর আমলে মুঙ্গের শহরের বিশেষ প্রাধান্য ছিল না; ইতিহাসের পাকা সড়ক হইতে শহরটি দূরে পড়িয়া গিয়াছিল। যে সময়ের কথা, সে সময় একজন মুঘল ফৌজদার কিছু সৈন্য সিপাহী লইয়া এই দুর্গে বাস করিতেন বটে কিন্তু দীর্ঘ শান্তির যুগে দুর্গটিকে যত্নে রাখিবার কোনও সামরিক প্রয়োজন কেহ অনুভব করে নাই; প্রাকারের পাথর খসিয়া পড়িতেছিল, চারিদিকের পরিখা প্রায় ভরাট হইয়া গিয়াছিল।
দুর্গের পূর্ব দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দ্বার; তিনটি সেতু পরিখার উপর দিয়া বহির্ভূমির সহিত দুর্গের সংযোগ রক্ষা করিয়াছে। পরিখা পরপারের দুর্গকে বেষ্টন করিয়া অর্ধচন্দ্রাকার শহর। শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানের বাস। হিন্দুরা প্রাতঃকালে উঠিয়া গঙ্গাস্নান করিত, তারপর ঘৃত, তিসি ও তেজারতির ব্যবসা করিত; মুসলমানেরা প্রতি শুক্রবারে দুর্গমধ্যস্থ ‘পীর শাণফা’ নামক পীরের দরগায় শিরনি চড়াইত। তাহাদের জীবনযাত্রায় অধিক বৈচিত্র্য ছিল না।
একদিন ফাল্গুন মাসের মধ্যাহ্নে কেল্লার দক্ষিণ দরজার বাহিরে, পরিখার অগভীর খাত যেখানে গঙ্গার স্রোতের সহিত মিলিয়াছে সেইখানে বসিয়া একটি যুবক মাছ ধরিতেছিল। অনেকগুলি নামগোত্রহীন গাছ হলুদবর্ণ ফুলের ঝালর ঝুলাইয়া স্থানটিকে আলো করিয়া রাখিয়াছে; সম্মুখে বিপুলবিস্তার গঙ্গার বুকে দুই-একটি চর জাগিতে আরম্ভ করিয়াছে। এই সময় প্রায় প্রত্যহ দ্বিপ্রহরে পশ্চিম হইতে বাতাস ওঠে, চরের বালু উড়িয়া আকাশ কুজ্ঝটিকাচ্ছন্ন হইয়া যায়। গৃহবাসী মানুষ ঝরোখা বন্ধ করিয়া ঘরের অন্ধকারে আশ্রয় লয়, কেবল বহিঃপ্রকৃতির কবোষ্ণ শূন্যতায় বসন্তের বিদায়বার্তাবহ পাখি গাছের বিরল পত্রান্তরাল হইতে ক্লান্ত-স্তিমিত কণ্ঠে ডাকিয়া ওঠে— পিউ বহুৎ দূর! আজও পাখি থাকিয়া থাকিয়া ডাকিতেছিল— পিউ বহুৎ দূর।
হলুদবর্ণ ফুলের ভারে অবনম্র একটি নামহীন গাছ গঙ্গার স্রোতের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া যেন দর্পণে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল। চারিদিক নির্জন, আকাশে বালু উড়িতেছে, পিছনে ভীমকান্তি দুর্গের উত্তুঙ্গ প্রাকার বহু ঊর্ধ্বে মাথা তুলিয়াছে— এইরূপ পরিবেশের মধ্যে ঐ পীত-পুষ্পিত গাছের ছায়ায় বসিয়া যুবকটি নিবিষ্টমনে ছিপ দিয়া মাছ ধরিতেছিল।
যুবকের নাম মোবারক। সে কান্তিমান পুরুষ, বলিষ্ঠ চেহারায় একটি উচ্চ আভিজাত্যের ছাপ আছে। তাহার বয়স বড় জোর কুড়ি-একুশ, গায়ের বর্ণ পাকা খরমুজার মতো; ঈষৎ গোঁফের রেখা ও চিবুকের উপর কুঞ্চিত শ্মশ্রুর আভাস তাহার মুখে একটি তীক্ষ্ণ মাধুর্য আনিয়া দিয়াছিল। তাহার উপর চোখে সুর্মা, পরিধানে ঢিলা পায়জামা ও ঢিলা আস্তিনের ফেন-শুভ্র মল্মলী কুর্তা। মেয়েদের তো কথাই নাই, পুরুষেরাও মোবারককে একবার দেখিলে ঘাড় ফিরাইয়া আবার তাকাইত।
মোবারক মাছ ধরিতে ভালবাসে, মাছ ধরা তাহার নেশা; তবু আজ যে এই বালুবিকীর্ণ মধ্যাহ্নে সে ঘরের আকর্ষণ উপেক্ষা করিয়া মাছ ধরিতে আসিয়াছে তাহার অন্য কারণও ছিল। পরীবানুর সহিত তাহার বাজি লাগিয়াছিল। পরীবানু মোবারকের বধূ, নববধূও বলা চলে, কারণ বিবাহ যদিও কয়েক বছর আগে হইয়াছে, মিলন হইয়াছে সম্প্রতি। পরীর বয়স সতেরো বছর, রূপে সে মোবারকের যোগ্য বধূ— অনিন্দ্যসুন্দরী; বাদশাহের হারেমেও এমন সুন্দরী দেখা যায় না। মাত্র ছয় মাস তাহারা একত্র ঘর করিতেছে; নব অনুরাগের মদবিহ্বলতায় দু’জনেই ডুবিয়া আছে।
পরী তামাসা করিয়া বলিয়াছিল, ‘ভারী তো রোজ রোজ তালাওয়ে মাছ ধরো। দরিয়ায় মাছ ধরতে পারো তবে বুঝি বাহাদুরী।’
মোবারক বলিয়াছিল, ‘কেন, দরিয়ায় মাছ ধরা এমন কি শক্ত কাজ?’
‘শক্ত নয়? ধরেছ কোনও দিন?’
‘যখন ইচ্ছে ধরতে পারি।’
‘ধরো না দেখি। পুকুরের পোষা মাছ সবাই ধরতে পারে। গঙ্গার মাছ ধরা অত সোজা নয়।’
‘বেশ, রাখো বাজি।’
‘রাখো বাজি।’
মোবারক ওড়না ধরিয়া পরীকে কাছে টানিয়া লইয়াছিল; কানে কানে বাজির শর্ত স্থির হইয়াছিল। শর্ত বড় মধুর। অতঃপর মোবারক ছিপ এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ লইয়া মহোৎসাহে দরিয়ায় মাছ ধরিতে বাহির হইয়াছিল।
মাছ কিন্তু ধরা দেয় নাই, একটি পুঁটিমাছও না। যবের ছাতু, পিঁপড়ার ডিম, পনির প্রভৃতি মুখরোচক টোপ দিয়াও গঙ্গার মাছকে প্রলুব্ধ করা যায় নাই। দীর্ঘকাল ছিপ হাতে বসিয়া থাকিয়া মোবারক বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িয়াছে গাছের তলা হইতে সরিয়া যাইতেছে। অন্য দিন হইলে মোবারক বাড়ি ফিরিয়া যাইত, কিন্তু আজ এত শীঘ্র শূন্য হাতে বাড়ি ফিরিলে পরী হাসিবে। সে বড় লজ্জা। মোবারক বঁড়্শির টোপ বদলাইয়া বঁড়্শি জলে ফেলিল এবং দৃঢ় মনোযোগের সহিত ফাৎনার দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
গাছের উপর হইতে একটা পাখি বিরস স্বরে বলিল, ‘পিউ বহুৎ দূর’!
মোবারকের অধর কোণে চকিত হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে উপর দিকে চোখ তুলিয়া মনে মনে বলিল, ‘সাবাস পাখি! তুই জান্লি কি করে?’
এই সময় গঙ্গার দিক হইতে দূরাগত তূর্য ও নাকাড়ার আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেই মোবারক চমকিয়া সেই দিকে চাহিল। গঙ্গার কুঞ্চিত জলের উপর সূর্যের আলো ঝলমল করিতেছে। দূরে দক্ষিণদিকে অসংখ্য নৌকার পাল দেখা দিয়াছে, বোধ হয় দুই শত রণতরী। ঐ তরণীপুঞ্জের ভিতর হইতে গভীর রণবাদ্য নিঃস্বনিত হইতেছে।
স্রোতের মুখে অনুকূল পবনে তরণীগুলি রাজহংসে মতো ভাসিয়া আসিতেছে। মোবারক লক্ষ্য করিল, তরণীব্যূহের মাঝখানে চক্রবাকের মতো স্বর্ণবর্ণ একটি পাল রহিয়াছে। সেকালে সম্রাট ভিন্ন আর কেহ রক্তবর্ণ শিবির কিম্বা নৌকার পাল ব্যবহার করিবার অধিকারী ছিলেন না; কিন্তু সম্রাট-পদ-লিপ্সুরা নিজ নিজ গৌরব গরিমা বাড়াইবার জন্য পূর্বাহ্ণেই এই রাজকীয় প্রতীক ধারণ করিতেন। মোবারকের বুঝিতে বিলম্ব হইল না, কে আসিতেছে। সে অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘ঐ রে সুলতান সুজা ফিরে এল।’
কয়েক মাস পূর্বে সাজাহানের মৃত্যুর জনরব শুনিয়া সুলতান সুজা এই মুঙ্গের শহর হইতেই মহা ধুমধামের সহিত পাল উড়াইয়া আগ্রা যাত্রা করিয়াছিলেন। যে ঘাটে নৌবহর সাজাইয়া তিনি যাত্রা করিয়াছিলেন, তাহার নাম দিয়াছিলেন সুজাই ঘাট*। এখন খাজুয়ার যুদ্ধে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঔরংজেবের হাতে পরাজিত হইয়া তিনি আবার সুজাই ঘাটে ফিরিয়া আসিতেছেন।
মোবারক অবশ্য যুদ্ধে পরাজয়ের খবর জানিত না। কিন্তু মুঙ্গেরের মতো ক্ষুদ্র শহরে সাম্রাজ্যগৃধ্নু যুবরাজ ও বিপুল সৈন্যবাহিনীর শুভাগমন হইলে সাধারণ নাগরিকের মনে সুখ থাকে না। সৈন্যদল যতই শান্ত সুবোধ হোক, অসামরিক জনমণ্ডলীর নিগ্রহ ঘটিয়া থাকে। গতবারে ঘটিয়াছিল, এবারও নিশ্চয় ঘটিবে। তাই মোবারক মনে মনে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল।
দুর্গমধ্যেও নৌবহরের আগমন লক্ষিত হইয়াছিল। ফৌজদার মহাশয় চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি শান্তিপ্রিয় প্রৌঢ় ব্যক্তি; সাজাহানের নিরুপদ্রব দীর্ঘ রাজত্বকালে নিশ্চিন্তে ফৌজদারী ভোগ করিয়া তিনি কিছু অলস ও অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়াছিলেন। রাজ-দরবারের সমস্ত খবরও তাঁহার কাছে পৌঁছিত না; ভায়ে ভায়ে সিংহাসন লইয়া লড়াই বাধিয়াছে এইটুকুই তিনি জানিতেন। কয়েক মাস পূর্বে সুজা আগ্রার পথে যাত্রা করিলে তিনি বেশ উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন; হয়তো আশা করিয়াছিলেন তক্ত্ তাউস্ সুজারই কবলে আসিবে। তাই তাঁহাকে আবার ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া তিনি বিব্রত হইয়া পড়িলেন। যা হোক, সুলতান সুজাকে অমান্য করা চলে না, সিংহাসন পান বা না পান তিনি শাহজাদা। উপরন্তু তাঁহার সঙ্গে অনেক সৈন্য সিপাহী রহিয়াছে।
দুর্গের দক্ষিণ দ্বার হইতে সুজাই ঘাট মাত্র দুইশত গজ দূরে। ফৌজদার মহাশয় কয়েকজন ঘোড়সওয়ার লইয়া ঘাটে সুজার অভ্যর্থনা করিতে গেলেন।
দেখিতে দেখিতে নৌবহর আসিয়া পড়িল। মোবারক যেখানে মাছ ধরিতে বসিয়াছিল সেখান হইতে বাঁদিকে ঘাড় ফিরাইলেই সুজাই ঘাট দেখা যায়। ঘাটটি আয়তনে ছোট; সব নৌকা ঘাটে ভিড়িতে পারিল না, ঘাটের দুইপাশে কিনারায় নঙ্গর ফেলিতে লাগিল। চারিদিকে চেঁচামেচি হুড়াহুড়ি, মাঝিমাল্লার গালাগালি; গঙ্গার তীর দুর্গের কোল পর্যন্ত তোলপাড় হইয়া উঠিল। মোবারক দেখিল এখানে মাছ ধরার চেষ্টা বৃথা! সে ছিপ গুটাইয়া বাড়ি ফিরিয়া চলিল। বিরক্তির মধ্যেও তাহার মনে এইটুকু সান্ত্বনা জাগিতে লাগিল, পরীবানুর কাছে কৈফিয়ৎ দিবার মতো একটা ছুতা পাওয়া গিয়াছে।
৩
কেল্লার পূর্বদ্বার হইতে যে রাজপথ আরম্ভ হইয়াছে তাহা শহরকে দুই সমানভাগে বিভক্ত করিয়া বাংলার রাজধানী রাজমহলের দিকে গিয়াছে। এই পথের দুই পার্শ্ব, দুর্গমুখ হইতে প্রায় অর্ধক্রোশ পর্যন্ত গিয়া, ক্রমে গৃহবিরল হইতে হইতে অবশেষে নিরবচ্ছিন্ন মাঠ-ময়দানে পরিণত হইয়াছে। এইখানে নগর-সীমান্তে একটি ক্ষুদ্র চটি আছে— চটির নাম পূরব সরাই। পূর্ব হইতে সমাগত যাত্রীদল এই চটিতে রাত্রির মতো আশ্রয় পায়, পরদিন শহরে প্রবেশ করে।
চটি হইতে কিছুদূরে একটি পাকবাড়ি, ইহা মোবারকের পিতৃভবন। কাছাকাছি অন্য কোনও গৃহ নাই, বাড়িটি রাজপথের ধারে নিঃসঙ্গ দাঁড়াইয়া আছে; আকারে ক্ষুদ্র হইলেও তাহার যেন একটু আভিজাত্যের অভিমান আছে। পূরব সরাই চটি ও তাহার আশেপাশে যে দু’-চারিটি দীনমূর্তি গৃহ দেখা যায় সেগুলি যেন ঐ বাড়িখানি হইতে সসম্ভ্রমে দূরে সরিয়া দাঁড়াইয়াছে।
চুনকাম-করা সুশ্রী বাড়ি; সম্মুখের বারান্দা জাফ্রিকাটা পাথরের অনুচ্চ আলিসা দিয়া ঘেরা। বাড়ি এবং পথের মধ্যস্থলে খানিকটা মুক্ত অঙ্গন, সেখানে নানা আকৃতির ছোটবড় পাথরের পাটা পড়িয়া আছে— পাশে একটি খাপরা-ছাওয়া ক্ষুদ্র চালা। চালার ভিতরেও নানা আকৃতির পাথর রহিয়াছে, কিন্তু সেগুলি বাটালির ঘায়ে রূপ পরিগ্রহ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহা হইতে অনুমান হয়, গৃহস্বামী একজন প্রস্তর-শিল্পী।
প্রস্তর-শিল্পী গৃহস্বামীর নাম খ্বাজা নজর বোখারী। ইনিই মোবারকের পিতা। বয়স পঁয়তাল্লিশ পার হয় নাই, দেহ এখনও দৃঢ় ও কর্মপটু; কিন্তু এই বয়সেই ইঁহার মুখমণ্ডল হইতে যৌবনের উন্মাদনা সম্পূর্ণ তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। সুন্দর পৌরুষ-বলিষ্ঠ অবয়বে জরার চিহ্নমাত্র নাই, তবু মনে হয় তিনি বৃদ্ধত্বের নিষ্কাম তৃপ্তিলোকের সন্ধান পাইয়াছেন। মুখে একটি শান্ত দীপ্তি। যাহারা স্থূল ইন্দ্রিয়সুখ ও ভোগলিপ্সা কাটাইয়া উঠিতে পারিয়াছে তাহাদের মুখেই এমন সৌম্য জ্যোতি দেখিতে পাওয়া যায়।
খ্বাজা নজর বোখারী ধনী ব্যক্তি নহেন, প্রস্তর-শিল্প তাঁহার জীবিকা। যাহারা নূতন গৃহ নির্মাণ করায় তাহারা তাঁহাকে দিয়া পাথরের স্তম্ভ খিলান জাফ্রি প্রভৃতি তৈয়ার করাইয়া লয়। তবু শহরের ইতর ভদ্র সকলেই তাঁহার চরিত্রগুণে এবং পূর্ব ইতিহাস স্মরণ করিয়া তাঁহাকে সম্ভ্রম করিয়া চলে। সাধারণের নিকট তিনি মিঞা সাহেব নামে পরিচিত।
এইখানে খ্বাজা নজরের পূর্বকথা সংক্ষেপে ব্যক্ত করা প্রয়োজন।
খ্বাজা নজরের পিতা বোখরা হইতে হিন্দুস্থানে আসিয়াছিলেন। সে-সময় দিল্লীর দরবারে গুণের আদর ছিল, দেশদেশান্তর হইতে জ্ঞানী গুণী আসিয়া বাদশাহের অনুগ্রহ লাভ করিতেন। বোখারা একে পর্বত-বন্ধুর দরিদ্র দেশ, উপরন্তু তখন পারস্যের অধীন। সেখানে ভাগ্যোন্নতির আশা নাই দেখিয়া খ্বাজা নজরের পিতা বালকপুত্র সমভিব্যাহারে দিল্লী উপনীত হইলেন।
তিনি পরম সুপুরুষ ছিলেন, উত্তম যোদ্ধা বলিয়াও তাঁহার খ্যাতি ছিল। শীঘ্রই তিনি সাজাহানের নজরে পড়িলেন। তারপর একদিন মুঙ্গেরের ফৌজদার পদের সনদ পাইয়া বিহার-প্রান্তের এই প্রাচীন দুর্গে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইলেন। ইহা সাজাহানের রাজত্বকালের গোড়ার দিকের কথা।
তারপর দশ বৎসর নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল। বিশাল সাম্রাজ্যের এপ্রান্তে যুদ্ধ-বিগ্রহের হাঙ্গামা নাই তাই ফৌজদার নিজের শৌর্যবীর্য দেখাইয়া আরও অধিক পদোন্নতির সুযোগ পাইলেন না, তিনি ফৌজদারই রহিয়া গেলেন। ইতিমধ্যে এক সৈয়দবংশীয়া কন্যার সহিত খ্বাজা নজরের বিবাহ হইল।
খ্বাজা নজর তখন ভাবপ্রবণ কল্পনাবিলাসী যুবক। তিনি পারসীক ভাষায় শয়ের লিখিতেন; ভাস্কর্য এবং স্থপতি-শিল্পের উপরও তাঁহার গাঢ় অনুরাগ জন্মিয়াছিল। পিতৃসৌভাগ্যের ছায়াতলে বসিয়া তিনি পরম নিশ্চিন্ত মনে শিল্পকলার চর্চা করিতে লাগিলেন। যোদ্ধার তরবারির পরিবর্তে ভাস্করের ছেনি ও বাটালি তাঁহার অস্ত্র হইয়া দাঁড়াইল।
কিন্তু এই নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ জীবনযাত্রা তাঁহার রহিল না। মোবারক জন্মিবার কিছুদিন পরে সহসা একদিন খ্বাজা নজরের জীবনযাত্রা ওলট-পালট হইয়া গেল। ফৌজদার অশ্বপৃষ্ঠ হইতে পড়িয়া অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। খ্বাজা নজবের সুখের দিন ফুরাইল।
হিন্দুস্থানের অধীশ্বর শাহেনশাহ বাদশাহ সাজাহান বাহ্যত বিলাসী ও বহুব্যয়ী প্রতীয়মান হইলেও অন্তরে কৃপণ ছিলেন। এই জন্যই বোধ করি তিনি বহু ধনরত্ন সঞ্চয় করিয়া তাজমহল এবং ময়ূর সিংহাসন নির্মাণ করিয়া যাইতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার রাজত্বকালে নিয়ম ছিল, কোনও ওমরাহ বা রাজকর্মচারীর মৃত্যু হইলে মৃতের সঞ্চিত ধনসম্পত্তি তৎক্ষণাৎ বাজেয়াপ্ত হইত। আমীর-ওমরাহেরা এই ব্যবস্থায় মনে মনে সন্তুষ্ট ছিলেন না; সকলেই ধনরত্ন লুকাইয়া রাখিতেন কিম্বা মৃত্যুর পূর্বেই ওয়ারিশদের মধ্যে চুপি চুপি বণ্টন করিয়া দিতেন। গল্প আছে, এক ওমরাহ* দীর্ঘকাল রাজসরকারে কার্য করিয়া বহু ধন সঞ্চয় করিয়াছিলেন। বৃদ্ধ ওমরাহের মৃত্যু হইলে সাজাহান তাঁহার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য রাজপুরুষদের পাঠাইলেন। ওমরাহের বাড়িতে কিন্তু একটি তালাবন্ধ সিন্দুক ব্যতীত আর কিছুই পাওয়া গেল না; রাজপুরুষেরা সিন্দুক সাজাহানের সম্মুখে উপস্থিত করিল। সাজাহান তালা ভাঙ্গিয়া দেখিলেন সিন্দুকের মধ্যে কেবল ছেঁড়া জুতা ভরা রহিয়াছে। সম্রাট লজ্জা পাইয়াছিলেন কিন্তু তাঁহার স্বভাব পরিবর্তিত হয় নাই।
ফৌজদারের বেলায় নিয়মের ব্যতিক্রম হইল না। তিনি যাহা কিছু সঞ্চয় করিয়াছিলেন পাটনা হইতে সুবেদারের লোক আসিয়া তুলিয়া লইয়া গেল। দুর্গে নূতন ফৌজদার আসিল। খ্বাজা নজর রিস্তহস্তে পথে দাঁড়াইলেন।
যাহার রণশিক্ষা নাই সে কোন্ কাজ করিবে? শেষ পর্যন্ত শিল্পবিদ্যাই তাঁহার জীবিকা হইয়া দাঁড়াইল। ঘরানা ঘরের সন্তান, অবস্থা বিপাকে দুর্দশায় পতিত হইয়াছেন— তাই শহরের গণ্যমান্য সকলেই তাঁহাকে সাধ্যমত সাহায্য করিল।
গত বিশ বছরে খ্বাজা নজরের অবস্থা কিছু সচ্ছল হইয়াছে। তিনি এখন সাধারণ গৃহস্থ, শহরের প্রান্তে ক্ষুদ্র বাড়ি করিয়াছেন। সুখে দুঃখে জীবন চলিতেছে। পত্নীর মৃত্যু হইয়াছে, মোবারকের বিবাহ হইয়াছে। খ্বাজা নজরের জীবনে বড় বেশি উচ্চাশা নাই, কেবল একটি আকাঙ্ক্ষা অহরহ তাঁহার অন্তরে জাগিয়া থাকে। মোবারক বড় হইয়া উঠিয়াছে, এইবার একদিন তাহাকে দিল্লী পাঠাইবেন। মোবারক বাদশাহের নিকট হইতে আবার ফৌজদারীর সনদ লইয়া আসিবে।
মোবারকের বালককাল হইতে খ্বাজা নজর তাহাকে সৎশিক্ষা দিয়াছেন, কুসঙ্গ হইতে সযত্নে দূরে রাখিয়াছেন। আরবী ও পারসী ভাষায় সে পারদর্শী হইয়াছে। যুদ্ধবিদ্যায় যদিও তাহার বিশেষ রুচি নাই— সেও তাহার পিতার মতো কল্পনাপ্রবণ— তবু তাহাকে যথারীতি অস্ত্রবিদ্যা শিখানো হইয়াছে। তাহার উপর অমন সুন্দর চেহারা! সে যদি একবার বাদশাহের সিংহাসনতলে গিয়া দাঁড়াইতে পারে, বাদশাহ তাহার আশা পূর্ণ না করিয়া পারিবেন?
এই আকাঙ্ক্ষা বুকে লইয়া খ্বাজা নজর পুত্রকে বড় করিয়া তুলিয়াছেন— ইহা ভিন্ন তাঁহার জীবনে অন্য কামনা নাই। মোবারকের কুড়ি বছর বয়স পূর্ণ হইবার পর তিনি তাহার দিল্লী গমনের উদ্যোগ আয়োজন আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু সহসা বাদশাহের পীড়া ও ভ্রাতৃদ্বযুদ্ধের সংবাদ আসিয়া চারিদিকে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছে। মোবারকের দিল্লী গমন আপাতত স্থগিত আছে।
সেদিন অপরাহ্ণে মোবারক রিক্তহস্তে গঙ্গাতীর হইতে বাড়ি ফিরিয়া দেখিল, তাহার পিতা কারখানার চালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া এক ব্যক্তির সহিত কথা কহিতেছেন। শহরের ধনী বেনিয়া দুনীচন্দের পুত্রের বড় অসুখ, সে মিঞাসাহেবের কাছে মন্ত্রপাড়া জল লইতে আসিয়াছে। মিঞাসাহেবের জলপড়ার ভারি গুণ, কখনও ব্যর্থ হয় না। তিনি মন্ত্রপূত জলের বাটি দুনীচন্দের হাতে দিয়া বলিলেন, ‘যাও। ছেলে আরাম হলে পীর শাণাফার দরগায় শিরনি চড়িও।’ বলিয়া দুনীচন্দকে বিদায় দিলেন।
মোবারক এই ফাঁকে অলক্ষিতে গৃহে প্রবেশের চেষ্টা করিতেছিল, খ্বাজা নজর ডাকিলেন, ‘মোবারক?’
মোবারক ফিরিয়া আসিয়া পিতার সম্মুখে দাঁড়াইল। তিনি স্নিগ্ধচক্ষে একবার তাহার মুখের পানে চাহিলেন; রৌদ্রে ধূলায় মোবারকের মুখখানি আরক্ত হইয়াছে তাহা লক্ষ্য করিলেও সে-কথার উল্লেখ না করিয়া বলিলেন, ‘কিছু খবর শুনলে? শহরে নাকি আবার ফৌজ এসেছে?
মোবারক বলিল, ‘হ্যাঁ, সুলতান সুজা ফিরে এসেছে।’
খ্বাজা নজর একটু বিমনাভাবে আকাশের পানে চাহিলেন, ভ্রূ ঈষৎ কুঞ্চিত হইল। কিন্তু তিনি আর কোনও প্রশ্ন না করিয়া কারখানার চালার ভিতর প্রবেশ করিলেন। চালার ভিতর হইতে তাঁহার অন্যমনস্ক কণ্ঠস্বর আসিল, ‘যাও, তুমি স্নান কর গিয়ে।’
মোবারক তখন বাড়িতে প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিবার পূর্বেই দেখিতে পাইল, দ্বারের আড়ালে পরী দাঁড়াইয়া আছে এবং অপূর্ব সুন্দর চোখ দু’টিতে দুষ্টামি ভরিয়া হাসিতেছে। মোবারকও হাসিয়া ফেলিল। পরী আজ কোনও ছলছুতা মানিবে না, বাজির পণ পুরামাত্রায় আদায় করিয়া লইবে।
৪
সুলতান সুজার নৌবহর গঙ্গার স্রোত বাহিয়া আসিয়াছিল; তাঁহার স্থলসৈন্য— পিয়াদা ও সওয়ার গঙ্গার তীর ধরিয়া অগ্রসর হইতেছিল। নৌকায় স্বয়ং সুজা ছিলেন, তাঁহার অগণিত নারীপূর্ণ হারেম ছিল, আর ছিল বড় বড় কামান গোলা বারুদ। যে কয়জন আমীর এখনও তাঁহার সংসর্গ ত্যাগ করেন নাই তাঁহারাও নৌকায় ছিলেন।
মুঙ্গেরে অবতীর্ণ হইয়া সুজা কেল্লার মধ্যে ফৌজদারের বাসভবনে অধিষ্ঠিত হইলেন। দুর্গের পশ্চিমভাগে উচ্চভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত দুইটি বড় বড় মহল; একটিতে সুজার হারেম রহিল, অপরটি তাঁহার দরবার ও মন্ত্রণাগৃহে পরিণত হইল। সুজার প্রধান উজির আলিবর্দি খাঁর জন্যও উৎকৃষ্ট বাসভবন নির্দিষ্ট হইল। আলিবর্দি খাঁ সুজার অতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন, সুজা আদর করিয়া তাঁহাকে ‘খান্ ভাই’ বলিয়া ডাকিতেন! তিনি ‘করণ-চূড়া’ নামক কেল্লার উত্তরভাগের একটি সুন্দর শৈলগৃহ অধিকার করিলেন। সৈন্যদল মাঠে ময়দানে তাম্বু ফেলিল; কতক নৌকায় রহিল।
মুঙ্গেরে পৌঁছিয়া সুলতান সুজা একদণ্ডও বৃথা কালক্ষয় করিলেন না, প্রবল উৎসাহে দুর্গসংস্কার আরম্ভ করিয়া দিলেন। পাটনা হইতে আসিবার পথে তিনি স্থির করিয়াছিলেন, মুঙ্গেরের দুর্ধর্ষ দুর্গেই তাঁহার শক্তির কেন্দ্র রচনা করিবেন। যদিও রাজমহল তাঁহার রাজধানী, তবু রাজমহল আগ্রা হইতে অনেক দূর; মুঙ্গের অপেক্ষাকৃত নিকট। যাঁহার দৃষ্টি ময়ূর সিংহাসনের উপর নিবন্ধ তাঁহার পক্ষে রাজমহল বা ঢাকা অপেক্ষা মুঙ্গেরে ঘাঁটি তৈয়ার করিবার ইচ্ছাই স্বাভাবিক। সুজার আদেশে ও তত্ত্বাবধানে কেল্লার প্রাকার মেরামত হইতে লাগিল, পরিখা আরও গভীরভাবে খনন করিয়া গঙ্গার ধারার সহিত তাহার নিত্যসংযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা হইল। দুর্গপ্রাকারের বুরুজের উপর বড় বড় কামান বসিল। সুজা অশ্বপৃষ্ঠে চারিদিকের বিপুল কর্মতৎপরতা তদারক করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। সুজার সঙ্গী-সাথীরা তাঁহার এই অপ্রত্যাশিত কর্মোৎসাহ দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। যাঁহারা বুদ্ধিমান তাঁহাদের সন্দেহ দূর হইল, সুজা কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঔরংজেবকে অনুকরণ করিবার চেষ্টা করিতেছেন।
একচল্লিশ বছর বয়সে সুজার চরিত্র সংশোধনের আর উপায় ছিল না। তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমান ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘকালব্যাপী ব্যসনাসক্তি তাঁহার বুদ্ধি ও দেহের উপর জড়তার প্রলেপ মাখাইয়া দিয়াছিল। তৈমুরবংশের রক্তে তিনটি প্রধান উপাদান— বিবেকহীন উচ্চাশা, অদম্য ভোগলিপ্সা এবং কুটিল নৃশংসতা। সকল মোগল সম্রাটের মধ্যেই এই প্রবৃত্তিগুলি অল্পাধিক অনুপাতে বিদ্যমান ছিল। সুজার জীবনে ভোগলিপ্সাই প্রধান হইয়া উঠিয়ছিল।
কিন্তু তাই বলিয়া উচ্চাশাও তাঁহার কম ছিল না। মাঝে মাঝে তাহা খড়ের আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিত; তীব্র সর্পিল বুদ্ধি জড়ত্বের খোলস ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিত। কিন্তু তাহা ক্ষণিক। ঔরংজেবের ন্যায় লৌহদৃঢ় চিত্তবল তাঁহার ছিল না। আবার তিনি আলস্যে বিলাসে গা ভাসাইয়া দিতেন।
কিন্তু মুঙ্গেরে পৌঁছিয়া তিনি এমন বিপুল উদ্যমে কাজ আরম্ভ করিয়া দিলেন যে সাতদিনের মধ্যে জীর্ণ দুর্গের সংস্কর শেষ হইল। কেবল দুর্গ মেরামত করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হইলেন না, শত্রু যাহাতে দুর্গের কাছে না আসিতে পারে তাহার ব্যবস্থাও করিলেন। জলপথে অবশ্য সুজার কোনও ভয় ছিল না, কারণ সে-সময় বাংলার অধীশ্বর সুজা ভিন্ন আর কাহারও নৌবহর ছিল না। স্থলপথে মুঙ্গের আক্রমণের পথ পূর্ব ও দক্ষিণ হইতে; তাহাও গিরিশ্রেণীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। কিন্তু গিরিশ্রেণীর ফাঁকে ফাঁকে সৈন্য চালনার উপযোগী রন্ধ্র আছে। সুজা এই রন্ধ্রগুলি বড় বড় বাঁধ তুলিয়া বন্ধ করিয়া দিবার বন্দোবস্ত করিলেন। সুজা সত্যই রণপণ্ডিত ছিলেন, সুতরাং মুঙ্গের কেল্লা ও পারিপার্শ্বিক ভূমি সংরক্ষণের কোনই ত্রুটি রহিল না।
হাজার হাজার মজুর লাগিয়া গেল। পাহাড়ের ব্যবধানস্থলে উচ্চ জাঙ্গাল খাড়া হইল, তাহার মাথার উপর কামান বসিল। সুজা ঘোড়ার পিঠে সমস্ত পরিদর্শন করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। বন্ধু এবং উজির খান্ ভাই আলিবর্দি খাঁ সর্বদা তাঁহার সঙ্গে রহিলেন।
সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যার সময় সুজার মহলে দরবার বসিত। দরবার অবশ্য পাকা দরবার নয়, আদব কায়দার কড়াকড়ি ছিল না; অনেকটা মজলিসের মতো আসর বাসিত, আলিবর্দি খাঁ, মির্জা জান বেগ প্রমুখ কয়েকজন অন্তরঙ্গ পারিষদ আসিয়া বসিতেন। মখমল বিছানো বৃহৎ কক্ষে বহু তৈলদীপের আলোতে শিরাজি চলিত, হাস্য পরিহাস চলিত, ক্বচিৎ মন্ত্রণা পরামর্শও হইত। রাত্রি যত গভীর হইত সুজা ততই মাতাল হইয়া পড়িতেন, কিন্তু পরদিন প্রাতঃকালে আবার তিনি অশ্বপৃষ্ঠে বাহির হইতেন। পারিষদেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিয়া ভাবিতেন, এভাবে আর কতদিন চলিবে।
এইভাবে একপক্ষ কাটিল।
একদিন সন্ধ্যার পর মজলিস বসিয়াছিল। সুজার হাতে শিরাজির পাত্র ছিল, তিনি ফৌজদারের পানে চাহিয়া বলিলেন, ‘পীর পাহাড়ের দিকে কাজ কেমন চলছে?’
ওদিকের কার্য-তত্ত্বাবধানের ভার ফৌজদার মহাশয়ের উপর ছিল, তিনি বলিলেন, ‘ভালই চলছে জাঁহাপনা, ঘাঁটি প্রায় তৈরি হয়ে গেছে।’
সুজা বলিলেন, ‘বেশ, কাল ওদিকে তদারক করতে যাব।’
স্ফটিকের পানপত্র নিঃশেষ করিয়া তিনি বাঁদীর হাতে ফেরৎ দিলেন। কয়েকজন যুবতী বাঁদী শরাবের পাত্র, তাম্বূলের পেটি ও গোলাপজল ভরা গুলাবপাশ লইয়া মজলিসের পরিচর্যা করিতেছিল। সুজার ইঙ্গিতে একটি বাঁদী ফৌজদারের সম্মুখে পানের বাটা ধরিল। সম্মানিত ফৌজদার তস্লিম করিয়া একটি তবক্-মোড়া পান তুলিয়া লইলেন।
শরাবের আর একটি পাত্র হাতে লইয়া সুজা বলিলেন, ‘আমার শরাবের পুঁজি তো প্রায় ফুরিয়ে এল। ফৌজদার সাহেব, আপনাদের দেশে মদ পাওয়া যায় না?’
ঈষৎ হাসিয়া ফৌজদার বলিলেন, ‘পাওয়া যায় হজরৎ— তাড়ি।’
সুজা প্রশ্ন করিলেন, ‘তাড়ি? সে কি রকম জিনিস?’
ফৌজদার বলিলেন, ‘মন্দ জিনিস নয়। গ্রীষ্মকালে এদেশের ইতর-ভদ্র সকলেই খায়। স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ ভাল। কিন্তু বড় দুর্গন্ধ।’
সুজা হাসিয়া বলিলেন, ‘আন্দাজ হচ্ছে ফৌজদার সাহেব তাড়ি চেখে দেখেছেন!’
ফৌজদার কহিলেন, ‘জী। পুদিনার আরক একটু মিশিয়ে দিলে গন্ধ চাপা পড়ে— তখন মন্দ লাগে না।’
ক্রমে রাত্রি হইল। সুজা কিংখাপের তাকিয়ার উপর এলাইয়া পড়িলেন, তাহার কথা জড়াইয়া আসিতে লাগিল। বাঁদীরা তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিল।
আলিবর্দি খাঁ বুঝিলেন, আজ রাত্রে সুজা হারেমে ফিরিবেন না। তিনি অন্য পারিষদবর্গকে চোখের ইশারা করিলেন, সকলে কুরনিশ করিয়া বিদায় হইলেন।
দরবারকক্ষের পর্দা-ঢাকা দ্বারের বাহিরে হাব্সী খোজারা লাঙ্গা তলোয়ার লইয়া পাহারা দিতেছে। তাহারা আমীরগণকে এত শীঘ্র বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়া নিঃশব্দে দাঁত বাহির করিয়া হাসিল। তাহারা পুরাতন ভৃত্য, প্রভুর স্বভাব-চরিত্র ভাল করিয়াই জানে।
৫
পরদিন আমাদের আখ্যায়িকার একটি স্মরণীয় দিন; যদিও ইতিহাস উহা স্মরণ করিয়া রাখে নাই।
পূর্বাহ্ণে সুজা আলিবর্দি খাঁকে সঙ্গে লইয়া ঘোড়ার পিঠে পীর পাহাড় পরিদর্শনে বাহির হইলেন। পরিদর্শন কার্যে সুজা সাধারণ বেশবাস পরিয়াই বাহির হইতেন, সঙ্গে রক্ষী থাকিত না। কেবল খান্ ভাই আলিবর্দি খাঁ এই সকল অভিযানে তাঁহার নিত্যসঙ্গী ছিলেন।
আলিবর্দি খাঁ একজন অতি মিষ্টভাষী চাটুকার ছিলেন; তাঁহার চাটুকথার বিশেষ গুণ এই ছিল যে উহা সহসা চাটুকথা বলিয়া চেনা যাইত না। সুজা আখেরে দিল্লীর সম্রাট্ হইবেন এই আশায় তিনি সুজার সহিত যোগ দিয়াছিলেন। কিন্তু পরে যখন সে আশা আর রহিল না তখন তিনি সুজার সৈন্য ভাঙাইয়া লইয়া পালাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুজা তাঁহাকে ধৃত করিয়া প্রকাশ্যে তাঁহার মুণ্ডচ্ছেদ করাইয়াছিলেন। কিন্তু ইহা আরও কিছুদিন পরের কথা।
দ্বিপ্রহরে পীর পাহাড়ে পৌঁছিয়া সুজা কার্যাদি তদারক করিলেন। পীর পাহাড় শহরের পূর্বদিকে গঙ্গার সন্নিকটে গম্বুজাকৃতি একটি টিলা; স্বভাবতই সুরক্ষিত। তাহার শীর্ষদেশ সমতল করিয়া তাহার উপর আর একটি গম্বুজের মতো মহল উঠিতেছে। ইহা সুজার আতিস্-খানা হইবে— গোলাবারুদ প্রভৃতি এখানে সঞ্চিত থাকিবে। টিলার চূড়া হইতে একটি কূপও খনিত হইতেছে; গঙ্গার স্রোতের সহিত তাহার যোগ থাকিবে।
আত্মরক্ষার বিপুল আয়োজন। শত শত মজুর রাজমিস্ত্রি ছুতার কাজ করিতেছে।
পরিদর্শন শেষ করিতে অপরাহ্ণ হইয়া গেল। সুজা ও আলিবর্দি খাঁ ফিরিয়া চলিলেন। ভাগ্যক্রমে আজ বালি উড়িতেছে না, খর রৌদ্রতাপে বাতাস স্তব্ধ হইয়া আছে।
অর্ধেক পথ অতিক্রম করিতে সুজা ঘর্মাক্ত কলেবর হইলেন, সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়াছে, মুখের উপর রৌদ্র পড়িয়া মুখ রক্তবর্ণ হইল। শহরের উপকণ্ঠে যখন পৌঁছিলেন তখন তৃষ্ণায় তাঁহার গলা শুকাইয়া গিয়াছে।
একটি নিম্নশ্রেণীর লোক অপর্যাপ্ত তাড়ি সেবন করিয়া মনের আনন্দে পথের এধার হইতে ওধার পরিভ্রমণ করিতে করিতে চলিয়াছিল। সুজা ঘোড়া থামাইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এখানে কোথায় পানীয় পাওয়া যায় বলতে পার?’
পথিক হাস্যবিম্বিত মুখে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘ঐ যে পূরব সরাই, ঐখানে ঢুকে পড়ুন, দেদার তাড়ি পাবেন।’ বলিয়া প্রসন্ন একটি হিক্কা তুলিয়া প্রস্থান করিল।
আলিবর্দি খাঁ ও সুজা দৃষ্টি-বিনিময় করিলেন। সুজা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, ‘আসুন খান্ ভাই, এদেশের খাঁটি জিনিস চোখে দেখা যাক।’
পূরব সরাই নেহাৎ নিম্নশ্রেণীর পানশালা নয়; তবে গ্রীষ্মকালে এখানে তাড়ি বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। স্বত্বাধিকারী একজন মুসলমান; দুইজন ফৌজী সওয়ারকে পাইয়া সে সাদরে তাহাদের অভ্যর্থনা করিল। সুজা পুদিনার আরক-সুরভিত তাড়ি ফরমাস দিলেন।
নূতন মাটির ভাঁড়ে শুভ্রবর্ণ পানীয় আসিল। উভয়ে পান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিলেন। শুষ্ককণ্ঠে নূতনতর পানীয় মন্দ লাগিল না। তারপর সরাইওয়ালা যখন এক রেকাবি ঝাল-মটর আনিয়া উপস্থিত করিল, তখন সুজা আবার পানীয় ফরমাস করিলেন।
ঝাল-মটর সুজার বড়ই মুখরোচক লাগিল। এরূপ প্রাকৃতজনোচিত আহার্য পানীয়ের আস্বাদ সুজা পূর্বে কখনও গ্রহণ করেন নাই, তিনি খুব আমোদ অনুভব করিলেন। পানীয়ের দ্বিতীয় পাত্রও ঝাল-মোটর সহযোগে শীঘ্রই নিঃশেষিত হইল।
কোমরবন্ধের তরবারি আল্গা করিয়া দিয়া সুজা তৃতীয় কিস্তি পানীয় হুকুম করিলেন। আলিবর্দি খাঁর দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন, ‘কী খান্ ভাই, কেমন লাগছে?’
খান্ ভাই মাথা নাড়িয়া মোলায়েম ভর্ৎসনার সুরে বলিলেন, ‘হজরৎ, আপনি গরিবের ফুর্তির দাম বাড়িয়ে দিলেন।’
এক ঘড়ি সময় কাটিবার পর সুজা ও আলিবর্দি যখন সরাইখানা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন তখন তাঁহাদের মনের বেশ আনন্দঘন অবস্থা। উভয়ে আবার ঘোড়ার উপরে উঠিয়া যাত্রা করিলেন।
কিন্তু বেশি দূর যাইবার আগেই তাঁহাদের গতি ভিন্নমুখী হইল। আরোহীদ্বয়ের তৃষ্ণ নিবারণ হইয়াছিল বটে কিন্তু ঘোড়া দু’টি তৃষ্ণার্তই ছিল; তাই চলিতে চলিতে পথের অনতিদূরে একটি জলাশয় দেখিতে পাইয়া তাহারা হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল এবং বল্গার শাসন উপেক্ষা করিয়া সেই দিকে চলিল। সুজা ঘোড়ার মুখ ফিরাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ঘোড়া বাগ মানিল না। তখন তিনি আর চেষ্টা না করিয়া লাগাম আল্গা করিয়া ধরিলেন।
কিন্তু দীঘির তীরে পৌঁছিয়া আবার তাঁহাকে দৃঢ়ভাবে রাশ টানিতে হইল। দীঘির পাড় বড় বেশি ঢালু, ঘোড়া নামিবার সুবিধা নাই; একটি সঙ্কীর্ণ ঘাট আছে বটে কিন্তু তাহার ধাপগুলি এতই সরু এবং উঁচু যে ঘোড়া সেপথে অতিকষ্টে নামিতে পারিলেও উঠতে পরিবে না। সুজা ও আলিবর্দি খাঁ দ্বিধায় পড়িলেন। ঘোড়া দু’টি জলের সান্নিধ্যে আসিয়া আরও চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। তাহাদের ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।
একটি লোক জলের কিনারায় বসিয়া নিবিষ্টমনে ছিপ দিয়া মাছ ধরিতেছিল; ঘাটে বা দীঘির আশেপাশে আর কেহ ছিল না। তাহার পিছনে পাড়ের উপর সুজা ও আলিবর্দি খাঁ উপস্থিত হইলে সে একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিয়া আবার মাছ ধরায় মন দিয়াছিল; ফৌজী সওয়ার সম্বন্ধে তাহার মনে কৌতূহল ছিল না।
এদিকে সুজার মনের প্রসন্নতাও আর ছিল না। ঘোড়ার ব্যবহারে তিনি বিরক্ত হইয়াছিলেন; পুকুর পাড়ে ঘোড়ার জলপানের কোনও সুবিধাই নাই দেখিয়া তাঁহার বিরক্তি ক্রমে ক্রোধে পরিণত হইতেছিল। তার উপর ঐ লোকটা নির্বিকারচিত্তে বসিয়া মাছ ধরিতেছে, তাঁহাকে সাহায্য করিবার কোনও চেষ্টাই করিতেছে না। দিল্লীর ভবিষ্যৎ বাদশাহ শাহজাদা আলমের ধৈর্য আর কতক্ষণ থাকে? তিনি কর্কশকণ্ঠে মৎস্যশিকাররত লোকটিকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘এই বান্দা, পুকুরে ঘোড়াকে জল খাওয়াবার কোনও রাস্তা আছে?’
মৎস্যশিকারী মোবারক। সম্বোধন শুনিয়া তাহার রক্ত গরম হইয়া উঠিল। কিন্তু এই অশিষ্ট দায়িত্বহীন সিপাহীগুলার সহিত কলহ করিয়া লাভ নাই, তাহাতে নিগ্রহ বাড়িবে বৈ কমিবে না। বিশেষত মোবারক নিরস্ত্র। সে আর-একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিয়া আবার ফাৎনার উপর চোখ রাখিল।
সুজা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। অবহেলায় তিনি অভ্যস্ত নন; তাই তিনি যে ছদ্মবেশে আছেন সেকথা ভুলিয়া গিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, ‘আরে বাঁদীর বাচ্চা! তুই কানে শুনতে পাস না? বদ্তমিজ, এদিকে আয়।’
ইহার পর আর চুপ করিয়া থাকা যায় না। মোবারক আরক্ত মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল, ছিপটা হাতে তুলিয়া পাড় বাহিয়া উপরে উঠিয়া আসিল। ঘোড়ার সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সুজার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর অর্ধাবরুদ্ধ ক্রোধের স্বরে বলিল, ‘বাঁদীর বাচ্চা তুমি। তোমার শরীরে ভদ্র-রক্ত থাকলে ভদ্রভাবে কথা বলতে।’
আলিবর্দি একেবারে হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিলেন, ‘বেয়াদব যুবক! তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ জানো? উনি সুলতান সুজা।’
নাম শুনিয়া মোবারকের বুকে মুগুরের ঘা পড়িল। সে বুঝিল তাহার জীবনে এক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু তবু এখন ভয়ে পিছাইয়া যাইতে সে ঘৃণাবোধ করিল। অকারণ লাঞ্ছনার গ্লানি তাহার আরও বাড়িয়া গেল; নীচ শ্রেণীর লোকের মুখে ইতর ভাষা বরং সহ্য হয় কিন্তু বড়’র মুখে ছোট কথা দ্বিগুণ পীড়াদায়ক। মোবারকের মুখে একটা ব্যঙ্গ-বঙ্কিম বিকৃতি ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, ‘সুলতান সুজা ছোট ভাইয়ের কাছে যুদ্ধে মার খেয়ে এখন নিরস্ত্রের ওপর বাহাদুরী দেখাচ্ছেন!’
সুজার অন্তরে যে-গ্লানি প্রচ্ছন্ন ছিল, যাহার ইঙ্গিত পর্যন্ত করিতে ওমরাহেরা সাহস করিতেন না, তাহাই যেন শ্লেষের চাবুক হইয়া তাঁহার মুখে পড়িল। আর তাঁহার দিগ্বিদিক জ্ঞান রহিল না, উন্মত্ত রোষে তরবারি বাহির করিয়া তিনি মোবারকের পানে ঘোড়া চালাইলেন।
‘গোস্তাক্। বদ্বখ্ত—।’
ইতিমধ্যে ভোজবাজির মতো কোথা হইতে অনেকগুলি লোক আসিয়া জুটিয়াছিল, তাহারা সমস্বরে হৈ হৈ করিয়া উঠিল। কেহ বা মোবারককে পলায়ন করিবার উপদেশ দিল; মোবারক কিন্তু এক পা পিছু হটল না। ঘোড়া যখন প্রায় তাহার বুকের উপর আসিয়া পড়িয়াছে তখন সে একবার সজোরে ছিপ চালাইল। ছিপের আঘাত শপাৎ করিয়া সুজার গালে লাগিল।
সুজাও বেগে তরবারি চালাইলেন। মোবারকের গলদেশে তরবারির ফলা বসিয়া গেল। সে বাঙ্নিষ্পত্তি না করিয়া মাটিতে পড়িল।
কয়েক মুহূর্ত পূর্বে যাহা চিন্তার অতীত ছিল, অতি তুচ্ছ কারণে অকস্মাৎ তাঁহাই ঘটিয়া গেল।
৬
দিন শেষ হইয়া আসিতেছে।
খ্বাজা নজর বোখারী তাঁহার কারখানা ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দুনীচন্দ্ বেনিয়ার সহিত হাসিমুখে কথা বলিতেছিলেন। দুনীচন্দের পুত্র আরোগ্যলাভ করিয়াছে, তাই সে মিঞা সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাইতে আসিয়াছে।
সহসা রাজপথের উপর অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। খ্বাজা নজর চোখ তুলিয়া দেখিলেন একদল লোক একটি মৃতদেহ বহন করিয়া আনিতেছে, তাহাদের পশ্চাতে দুইজন সওয়ার। খ্বাজা নজর শঙ্কিত হইয়া ঈশ্বরের নাম স্মরণ করিলেন।
মৃতদেহ বাহকগণ খ্বাজা নজরের অঙ্গনে প্রবেশ করিল। খ্বাজা নজর নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। বাহকেরা মোবারকের রক্তাক্ত মৃতদেহ আনিয়া খ্বাজা নজরের সম্মুখে একটি পাথরের পাটার উপর শোয়াইয়া দিল। কেহ কথা কহিল না। খ্বাজা নজর নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিলেন; তাঁহার রক্তহীন অধর একটু নড়িল, ‘মোবারক—’
যাহারা বহন করিয়া আনিয়াছিল তাহারা নিঃশব্দে অশ্রুমোচন করিয়া সরিয়া গেল। কেবল অশ্বারোহী দুইজন গেল না। সুজার মুখে ক্রোধের অন্ধকার এখনও দূর হয় নাই, চোখে জিঘাংসা ধিকিধিক জ্বলিতেছিল। তাঁহার গালে ছিপের আঘাত চিহ্নটা ক্রমে বেগুনী বর্ণ ধারণ করিতেছে। তিনি মাঝে মাঝে তাহাতে হাত বুলাইতেছেন এবং তাঁহার চক্ষু হিংস্রভাবে জ্বলিয়া উঠিতেছে।
সহসা সুজা খ্বাজা নজরকে উদ্দেশ করিয়া কঠোর কণ্ঠে বলিলেন, ‘তুমি এর বাপ?’
খ্বাজা নজর সুজার দিকে শূন্য দৃষ্টি তুলিলেন, কথা কহিলেন না। মোবারক তো বন্সী তালাওয়ে মাছ ধরিতে গিয়েছিল…!
উত্তর না পাইয়া আলিবর্দি খাঁ বলিলেন, ‘ইনি মালিক উল্মু্ল্ক সুলতান সুজা। তোমার ছেলে এর অমর্যাদা করেছিল তাই তার এই দশা হয়েছে।’
খ্বাজা নজর এবারও উত্তর দিলেন না, ভাবহীন নিস্তেজ চক্ষু অশ্বারোহীদের উপর হইতে সরাইয়া মোবারকের উপর ন্যস্ত করিলেন। দেখিলেন পাথরের পাটা মোবারকের কণ্ঠ-ক্ষরিত রক্তে ভিজিয়া উঠিয়াছে। মোবারক বাঁচিয়া নাই…ইহারা তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে—
সুজা মুখের একটা বিকৃত ভঙ্গি করিলেন। এই সামান্য প্রস্তর-শিল্পীর পুত্রকে হত্যা করিবার পর ইহার অধিক কৈফিয়ৎ বা দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন নাই। সুজা আলিবর্দিকে ইঙ্গিত করিলেন; উভয়ে ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া প্রস্থানোদ্যত হইলেন।
এই সময় বাড়ির ভিতর হইতে তীব্র আর্তোক্তি আসিল, সঙ্গে সঙ্গে পরীবানু ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। তাহার কেশ বিস্রস্ত, বোধকরি ভয়ঙ্কর সংবাদ শুনিবার সময় সে কেশ প্রসাধন করিতেছিল; অঙ্গে ওড়্নি নাই, কেবল চোলি ও ঘাঘ্রি। সে ছুটিয়া আসিয়া মোবারকের মৃতদেহের পাশে ক্ষণেক দাঁড়াইল, ব্যাকুল বিস্ফারিত নেত্রে মোবারকের মৃত্যুস্থির মুখের পানে চাহিল, তারপর ছিন্নলতার মতো তাহার বুকের উপর আছড়াইয়া পড়িল। খ্বাজা নজর মোহগ্রস্ত মূকের মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন।
সুজা ঘোড়ার পৃষ্ঠ হইতে ঘাড় ফিরাইয়া এই দৃশ্য দেখিলেন; কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে পরীবানুর পানে চাহিয়া রহিলেন। সামান্য মানুষের গৃহেও এমন স্ত্রীলোক পাওয়া যায়? পানাপুকুরে মরালী বাস করে?
সুজার সমসাময়িক ইতিকার লিখিয়াছেন, চামেলির মতো ক্ষুদ্র বস্তু সুজার চোখে পড়িত না। আজ কিন্তু এই শিশির-সিক্ত চামেলি ফুলটি ভাল করিয়াই তাঁহার চোখে পড়িল। সন্ধ্যার ছায়ালোকে তিনি যখন দুর্গের দিকে ফিরিয়া চলিলেন, তখনও ঐ শোক-নিপীড়িতার যৌবনোচ্ছল লাবণ্য তাঁহার চিত্তপটে ফুটিয়া রহিল।
দুর্গের সিংহদ্বারে প্রবেশ করিতে সুজা বলিলেন, ‘বুড়ো বান্দাটা পাথরের কারিগর মনে হল।’
আলিবর্দি বলিলেন, ‘হাঁ হজরৎ, আমারও তাই মনে হল।’ বলিয়া সুজার পানে অপাঙ্গে চাহিলেন।
সুজা চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া গণ্ডের স্ফীত কৃষ্ণবর্ণ আঘাত চিহ্নটার উপর অঙ্গুলি বুলাইলেন।
তাঁহার দৃষ্টি ছুরির নখাগ্রের মতো ঝিলিক দিয়া উঠিল।
পরদিন সন্ধ্যাকালে খ্বাজা নজরের গৃহে অনৈসর্গিক নীরবতা বিরাজ করিতেছিল। অন্তঃপুরে শব্দমাত্র নাই, যেন সেখানে মানুষ বাস করে না; পরীবানু শোকের কোন্ নিগূঢ় গর্ভগৃহে আশ্রয় লইয়াছে। বাহিরের অঙ্গনও শূন্য নিস্তব্ধ; কেবল মোবারকের রক্তচর্চিত প্রস্তরপট্টের পানে চাহিয়া খ্বাজা নজর একাকী বসিয়া আছেন।
মোবারকের কফন দফন আজ প্রভাতেই হইয়া গিয়াছে। খ্বাজা নজর ভাবিতেছেন মোবারক নাই… কাল যে সুস্থ প্রাণপূর্ণ ছিল আজ সে নাই। বর্ষ কাটিবে, যুগ কাটিবে, পৃথিবী জীর্ণ হইয়া যাইবে, সূর্য ম্লান হইবে, চন্দ্র ধূলা হইয়া খসিয়া পড়িবে তবু মোবারক ফিরিয়া আসিবে না। এমন নিশ্চিহ্ন হইয়া কোথায় গেল সে? না, একেবারে নিশ্চিহ্ন নয়, ঐ যে পাথরের উপর তাহার শেষ মোহর-ছেপ্ৎ রাখিয়া গিয়াছে… শুষ্ক রক্ত… পাথরে রক্তের দাগ কতদিন থাকে? ঘোড়ার খুরের শব্দে চোখ তুলিয়া খ্বাজা নজর দেখিলেন, কল্যকার একজন অশ্বারোহী আসিতেছে। তিনি ভাবিলেন, এ কে? সুলতান সুজা? মোবারক তাঁহার সহিত ধৃষ্টতা করিয়াছিল, সে ধৃষ্টতার ঋণ এখনও শোধ হয় নাই? তবে তিনি আবার কেন আসিলেন?
অশ্বারোহী কিন্তু সুজা নয়, আলিবর্দি খাঁ। আলিবর্দি অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া খ্বাজা নজরের পাশে আসিয়া বসিলেন এবং এমনভাবে তাহার সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিলেন যেন তিনি খ্বাজা নজরকে নিজের সমকক্ষ মনে করেন। সহানুভূতিতে বিগলিত হইয়া তিনি জানাইলেন, সুলতান সুজা কল্যকার ঘটনায় বড়ই মর্মাহত হইয়াছেন। অবশ্য তিনি যেভাবে অপমানিত হইয়াছিলেন তাহাতে অপরাধীকে সবংশে বধ করিয়া তাঁহাদের দেহ কুকুর দিয়া খাওয়াইলেও অন্যায় হইত না; কিন্তু সুজার হৃদয় বড় কোমল, তিনি অন্যায় করেন নাই জানিয়াও কিছুতেই মনে শান্তি পাইতেছেন না। শোক-তপ্ত পরিবারের দুঃখ মোচন না হওয়া পর্যন্ত তাঁহার বুকের দরদও দূর হইবে না। সুলতান সুজা খবর পাইয়াছেন যে খ্বাজা নজর একজন প্রসিদ্ধ শিল্পী। সুজার ইচ্ছা সম্রাট হইবার পর নূতন সিংহাসনে বসেন; তাই তিনি অনুরোধ জানাইয়াছেন, খ্বাজা নজর যদি একটি মঙ্গলময় সিংহাসন তৈয়ারের ভার গ্রহণ করেন তাহা হইলে সুজা নিরতিশয় প্রীত হইবেন। পরম পরিমার্জিত ভাষায় এই কথাগুলি বলিয়া আলিবর্দি খাঁ এক মুঠি মোহর খ্বাজা নজরের পাশে রাখিলেন।
খ্বাজা নজরের মন তিক্ত হইয়া উঠিল; তিনি ভাবিলেন, ইহারা কি মানুষ! মোবারকের অভাব একমুঠি সোনা দিয়া পূর্ণ করিতে চায়! মুখে বলিলেন, ‘শাহজাদার ইচ্ছাই আদেশ, সিংহাসন তৈরি করে দেব!’
অতঃপর আরও কিছুক্ষণ মিষ্টালাপ করিয়া, তখ্ত যত শীঘ্র তৈয়ারি হয় ততই ভাল, এই অনুজ্ঞা জানাইয়া আলিবর্দি খাঁ প্রস্থান করিলেন।
আসন্ন রাত্রির ঘনায়মান অন্ধকারে খ্বাজা নজর একাকী বসিয়া রহিলেন। কী নিষ্ঠুর ইহারা। অথচ ইহারাই শক্তিমান, ইহারাই সিংহাসনে বসে। ঈশ্বর ইহাদের এত শক্তি দিয়াছেন কেন? মোবারকের রক্তে যাহার হাত রাঙ্গা হইয়াছে আমি তাহারই জন্য মঙ্গলময় সিংহাসন তৈয়ার করিব! মঙ্গলময় সিংহাসন— তক্ত্ মোবারক—!
ভাবিতে ভাবিতে খ্বাজা নজর রক্তলিপ্ত পাথরের দিকে চাহিলেন। মনে হইল, শ্বেত পাথরের উপর গাঢ় রক্তের দাগ যেন প্রায়ান্ধকারে জ্বলিতেছে। খ্বাজা নজরের দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল, সূক্ষ্ম নাসাপুট ঘন ঘন স্ফুরিত হইতে লাগিল। তিনি অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি করিলেন, ‘তক্ত্ মোবারক— তক্ত্ মোবারক— তক্ত্ মোবারক—’
ইহাই তক্ত্ মোবারকের ইতিহাস। কিন্তু আর একটু আছে। শুধুই রক্তমাখা পাথর এবং পিতার অভিশাপ লইয়া তক্ত মোবারক জন্মগ্রহণ করে নাই, তাহার উপর আরও গাঢ় পাপের প্রলেপ পড়িয়াছিল।
৭
তিন দিন পরে আলিবর্দি খাঁ আবার আসিলেন। খ্বাজা নজর অপরাহ্ণে কারখানায় চালার নীচে বসিয়া কাজ করিতেছিলেন; সিংহাসন প্রায় তৈয়ার হইয়াছে দেখিয়া আলিবর্দি খুশি হইলেন। কিন্তু আজ তিনি অন্য কাজে আসিয়াছিলেন, দুই চারিটি অবান্তর কথার পর কাজের কথা আরম্ভ করিলেন।
সুজার মনস্তাপ এখনও নিবৃত্ত হয় নাই। বস্তুত মোবারকের বিধবা কবিলার কথা স্মরণ করিয়া তিনি মনে বড় কষ্ট পাইতেছেন; বিধবার মনে সুখ শান্তি ফিরাইয়া আনা তিনি অবশ্য কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেছেন। জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু প্রজাকে সুখী করাই রাজার ধর্ম। সুজা সদয় মনে ইচ্ছা করিয়াছেন যে মোবারকের কবিলা তাঁহার হারেমে আসিয়া বাস করুক; আরাম ও ঐশ্বর্যের মধ্যে থাকিয়া সে শীঘ্রই শোক ভুলিতে পরিবে। ইহাতে খ্বাজা নজরের আনন্দ হওয়া উচিত, এরূপ সম্মান অল্প লোকের ভাগ্যেই ঘটিয়া থাকে। ইত্যাদি।
খ্বাজা নজরের বুকে বিষের প্রদাহ জ্বলিতে লাগিল। রাক্ষস— রাক্ষস এরা! মোবারককে লইয়াছে, এখন আমার ইজ্জত লইতে চায়। আমি কি করিতে পারি? ‘না’ বলিলে জোর করিয়া লইয়া যাইবে। যাক— পরীকে লইয়া যাক। পরী আমার ঘরে কতদিনই বা থাকিবে? সে যুবতী, দু’মাসে হোক ছ’মাসে হোক আর কাহাকেও নিকা করিয়া চলিয়া যাইবে। তার চেয়ে এখনই যাক—
মুখে বলিলেন, ‘আমি দাসানুদাস— রাজার যা ইচ্ছা তাই হোক।’
আলিবর্দি অশ্বারোহণে ফিরিয়া গেলেন। সন্ধ্যার পর তিনটি ডুলি আসিয়া খ্বাজা নজরের বাড়ির সদরে থামিল। সঙ্গে কয়েকজন বরকন্দাজ। দুইটি ডুলি হইতে চারিজন বাঁদী নামিয়া খ্বাজা নজরের অন্দরে প্রবেশ করিল। কিছুক্ষণ পরে পরীবানু কাঁদিতে কাঁদিতে, চোখ মুছিতে মুছিতে বাঁদীদের সহিত বাহির হইয়া আসিল এবং ডুলিতে গিয়া বসিল। কানাৎ-ঢাকা তিনটি ডুলি বরকন্দাজ পরিবেষ্টিত হইয়া চলিয়া গেল।
রাত্রি হইল। খ্বাজা নজর কারখানা ঘরে আলো জ্বালিয়া কাজ করিতেছেন। তাঁহার দেহ নুইয়া পড়িয়াছে। বাটালি দিয়া সিংহাসনের গায়ে নাম খোদাই করিতেছেন আর মনে মনে চিন্তার অবশ ক্রিয়া চলিয়াছে—
মোবারকের বিবাহ… কতদিনের কথা? এইতো সেদিন…মুঙ্গের শহরে ১০৫২ সালের ২৭ শাবান তারিখে…দাসানুদাস খ্বাজা নজর বোখারী কর্তৃক…
ঠক্ ঠক্ করিয়া বাটালির উপর হাতুড়ির ঘা পড়িতেছে; খ্বাজা নজরের মন কখনও অতীতের স্মৃতিতে ডুবিয়া যাইতেছে, কখনও কঠিন নির্মম বর্তমানে ফিরিয়া আসিতেছে— মোবারকের বিবাহের তারিখের সহিত তাহার মৃত্যুর তারিখ মিশিয়া যাইতেছে—
মধ্যরাত্রি পর্যন্ত খ্বাজা নজর এইভাবে কাজ করিয়া চলিয়াছেন। যেমন করিয়া হোক আজই এই অভিশপ্ত সিংহাসন শেষ করিয়া দিতে হইবে। আর সহ্য হয় না— আর শক্তি নাই—
সিংহাসন দেখিয়া সুজা প্রীত হইলেন। দেখিতে খুব সুশ্রী নয়, কিন্তু কি যেন একটা অনৈসর্গিক আকর্ষণ উহাতে আছে। সুজা সিংহাসন লইয়া গিয়া দরবার কক্ষে বসাইলেন।
সন্ধার সময় সভা বসিল। সুজা সিংহাসনের উপর মসলন্দ বিছাইয়া দুইপাশে মখমলের তাকিয়া লইয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন। সভাসদেরা সহর্ষে কেরামৎ করিলেন। বাঁদীদের হাতে হাতে শরাবের পেয়ালা চলিতে লাগিল।
হাস্য পরিহাস রসালাপ চলিতেছে এমন সময় গুরুতর সংবাদ আসিল। পাটনা হইতে জলপথে দূত আসিয়াছে; সে সংবাদ দিল, মীরজুম্লা ত্রিশ হাজার সৈন্য লইয়া স্থলপথে আসিতেছেন, শীঘ্রই মুঙ্গের অবরোধ করিবেন।
শরাবের পাত্র হাতে লইয়া সুজা দীর্ঘকাল নীরব হইয়া রহিলেন। তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘আমি রাজমহলে ফিরে যাব। এখানে যুদ্ধ দেব না।’
সকলে বিস্ময়াহত হইয়া চাহিয়া রহিলেন। এত আয়োজন এত পরিশ্রম করিয়া এ দুর্গ অজেয় করিয়া তোলা হইয়াছে, তাহা ছাড়িয়া পলায়ন করিতে হইবে?
সুজা কহিলেন, ‘আমার মন বলছে বাংলা দেশে ফিরে যেতে। আপনারা বাড়ি যান, আজ রাত্রিটা বিশ্রাম করুন। কাল সকাল থেকেই রাজমহল যাত্রার আয়োজন শুরু করতে হবে।’
সকলে অন্তরে ধিক্কার বহন করিয়া নীরবে প্রস্থান করিলেন। যাঁহারা সুজার বুলন্দ ইক্বালের উপর এখনও আস্থাবান ছিলেন তাঁহারাও বুঝিলেন সুজার পুরুষকার মহত্তর পুরুষকারের নিকট পরাস্ত হইয়াছে!
সুজাও অবসাদগ্রস্ত মনে আবার সিংহাসনে বসিলেন। কক্ষে বাঁদীর দল ছাড়া আর কেহ ছিল না; তাহারা কেহ তাঁহার সম্মুখে পানপত্র ধরিল, কেহ ময়ূরপঙ্খী পাখা দিয়া ব্যজন করিল, কেহ বা পদমূলে বসিয়া তাঁহার পদসেবা করিতে লাগিল।
সুজা ভাবিতে লাগিলেন, ঔরংজেব আর মীরজুম্লা! এই দু’টা মানুষ তাঁহার জীবনের দুর্গ্রহ। ইহাদের নাম শুনিলেই তাঁহার মন সঙ্কুচিত হয়, নিজেকে ক্ষুদ্র বলিয়া মনে হয়, শক্তি অবসন্ন হয়। মীরজুম্লার বিশ মণ হীরা আছে, সে যুদ্ধ করিতে আসে কেন? ঔরংজেব তাঁহার ছোট ভাই হইয়াও তাঁহার মনে ভয়ের সঞ্চার করে কেন?
সুজার মনের আত্মাগ্লানি ক্রমে জিঘাংসায় পরিণত হইতে লাগিল। কাহাকেও আঘাত হানিতে পারিলে গ্লানি কতকটা দূর হয়। চিন্তা-কুঞ্চিত মুখে বসিয়া তিনি নিজ গণ্ডস্থল অঙ্গুলি দিয়া স্পর্শ করিলেন। গণ্ডের আঘাত চিহ্নটা প্রায় মিলাইয়া গিয়াছে, তবু একটু কালো দাগ এখনও আছে। মোবারকের ছিপের দাগ। বাঁদীর বাচ্চা! বদ্জাৎ কুত্তা! তাহার প্রতি সুজার আক্রোশ এখনও সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয় নাই— প্রতিহিংসার আগুনে পূর্ণাহুতি পড়ে নাই।
সুজা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কাল যে নূতন বাঁদীটা এসেছে তার কান্না থেমেছে?’
একটি বাঁদী বলিল, ‘এখনও থামেনি হজরৎ, তেম্নি কেঁদে চলেছে।’
নিরানন্দ হাস্যে সুজার দন্তপংক্তি প্রকট হইল। তিনি বলিলেন, ‘তার কান্না আমি থামিয়ে দিচ্চি। তোরা যা, তাকে এখানে পাঠিয়ে দে।’
বাঁদীরা চলিয়া গেল। তক্ত্ মোবারকের উপর অঙ্গ এলাইয়া দিয়া সুজা অর্ধশয়ান হইলেন, গালের চিহ্নটার উপর অঙ্গুলি বুলাইতে বুলাইতে নূতন বাদী পরীবানুর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। তাঁহার চোখে কুটিল আনন্দ নৃত্য করিতে লাগিল।
পরীবানু সামান্যা নারী, খ্বাজা নজর বোখারী সাধারণ মানুষ, মোবারক হতভাগ্য স্বল্পায়ু যুবক; তাহাদের জীবন-মৃত্যু নিগ্রহ-নিপীড়ন হাসি-অশ্রুর মূল্য কতটুকু? কেহ কি তাহা মনে করিয়া রাখে?
হে অতীত, তুমি মনে করিয়া রাখিয়াছ। যাহাদের কথা সকলে ভুলিয়াছে তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই, তোমার ভাণ্ডারে মানুষের সব কথা সঞ্চিত হইয়া আছে। তাই বুঝি বর্তমানের ললাটে তোমার অভিশাপের ভস্মটিকা দেখিতে পাইতেছি।
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৪
—
*অদ্যাপি এই ঘাট ‘সুজি ঘাট’ নামে পরিচিত।
*নেকনাম খাঁ। (বার্ণিয়ার)
Valo golpo