গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৭. হূণ রক্ত

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – হূণ রক্ত

মৎস্যের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট একটি উপত্যকায় চষ্টন দুর্গ অবস্থিত। উত্তরদিক হইতে আর্যাবর্তে প্রবেশের যতগুলি সঙ্কট-পথ আছে, এই উপত্যকা তাহার অন্যতম, তাই এখানে দুর্গের প্রতিষ্ঠা। এই পথে পূর্বকালে বহু দুর্মদ যোদ্ধৃজাতির অভিযান আর্যভূমিতে প্রবেশ করিয়াছে; বণিকের সার্থবাহ মহামূল্য পণ্য লইয়া যাতায়াত করিয়াছে; চৈন পরিব্রাজকগণ তীর্থযাত্রা করিয়াছেন। উপত্যকাটি উত্তরে দক্ষিণে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দীর্ঘ; প্রস্থে মাত্র অর্ধক্রোশ। পূর্বে ও পশ্চিমে অতট গিরিশ্রেণী।

চষ্টন দুর্গের সিংহদ্বার দক্ষিণমুখী। দুর্গটি দৃঢ়গঠন, কমঠাকৃতি; কিন্তু আয়তনে বৃহৎ নয়। উচ্চ প্রাকারবেষ্টনীর মধ্যে তিন চারি শত লোক বাস করিতে পারে।

অপরাহ্ণে দুর্গের দ্বার খোলা ছিল; দূর হইতে অশ্বারোহীর দল আসিতে দেখিয়া ঝনৎকার শব্দে লৌহ-কবাট বন্ধ হইয়া গেল।

গুলিক ও চিত্রক দুর্গদ্বারের প্রায় শত হস্ত দূর পর্যন্ত আসিয়া অশ্বের গতিরোধ করিল। এই স্থানে কয়েকটি পার্বত্য বৃক্ষ ঘনসন্নিবিষ্ট হইয়া একটি বৃক্ষ-বাটিকা রচনা করিয়াছে। গুলিকের ইঙ্গিতে সৈনিকের দল অশ্ব পরিচর্যায় নিযুক্ত হইল। আজ রাত্রি সম্ভবত এই তরুতলেই কাটাইতে হইবে। সকলের সঙ্গে দুই তিন দিনের আহার্য ছিল।

চিত্র ও গুলিক অশ্ব হইতে নামিল না। ওদিকে দুর্গের দ্বার তো বন্ধ হইয়া গিয়াছিলই, উপরন্তু দুর্গ প্রাকারের উপর বহু লোকের ব্যস্ত যাতায়াত দেখিয়া মনে হয় তাহারা আক্রমণ আশঙ্কা করিয়া দুর্গ রক্ষার আয়োজন করিতেছে।

ইহাদের যুযুৎসা অভিনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করিয়া চিত্রক মৃদু হাস্য করিল, বলিল— ‘মনে হইতেছে ইহারা বিনা যুদ্ধে আমাদের দুর্গে প্রবেশ করিতে দিবে না। আমরা কে, কোথা হইতে আসিতেছি— তাহা না জানিয়াই দুর্গরক্ষায় উদ্যত হইয়াছে।’

গুলিক বলিল— ‘আমাদের সংখ্যা দেখিয়া বোধহয় ভয় পাইয়াছে। আমরা সকলে দুর্গের দিকে অগ্রসর হইলে উহারা তীর ছুঁড়িবে, পাথর ফেলিবে; কিন্তু দুই একজন যাইলে বোধহয় কিছু বলিবে না। আমরা কে তাহা জানিবার আগ্রহ নিশ্চয় উহাদের আছে। চল, আমরা দুইজনে যাই। আমাদের পরিচয় পাইলে নিশ্চয় দুর্গে প্রবেশ করিতে দিবে।’

চিত্রক বলিল— ‘সম্ভব। কিন্তু আমাদের দুইজনের যাওয়া উচিত হইবে না। যদি দুইজনকেই ধরিয়া রাখে তখন আমাদের নেতৃহীন সৈন্যেরা কী করিবে?’

গুলিক বলিল— ‘সে কথা সত্য। তবে তুমি থাক আমি যাই।’

চিত্রক বলিল— ‘না, তুমি থাক আমি যাইব। প্রথমত, তোমাকে যদি ধরিয়া রাখে তখন আমি কিছুই করিতে পারিব না; সৈন্যরা তোমার অধীন, আমার সকল আদেশ না মানিতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমি যদি কিরাত বর্মার সাক্ষাৎ পাই, আমি তাহাকে এমন অনেক কথা বলিতে পারিব যাহা তুমি জান না। সুতরাং আমার যাওয়াই সমীচীন।’

যুক্তির সারবত্তা অনুভব করিয়া গুলিক সম্মত হইল। বলিল— ‘ভাল। দেখ, যদি দুর্গে প্রবেশ করিতে পার। কিন্তু একটা কথা, সূর্যাস্তের পূর্বে নিশ্চয় ফিরিয়া আসিও। না আসিলে বুঝিব তোমাকে ধরিয়া রাখিয়াছে কিম্বা বধ করিয়াছে। তখন যথাকর্তব্য করিব।’

চিত্রক দুর্গের দিকে অশ্ব চালাইল। সে তোরণ হইতে বিশ হাত দূরে উপস্থিত হইলে তোরণশীর্ষ হইতে পুরুষকণ্ঠে আদেশ আসিল— ‘দাঁড়াও।’

চিত্রক অশ্ব স্থগিত করিল; ঊর্ধ্বে চক্ষু তুলিয়া দেখিল, প্রাকারস্থ সারি সারি ইন্দ্রকোষের ছিদ্রপথে কয়েকজন ধানুকী ধনুতে শর সংযোগ করিয়া তাহার পানে লক্ষ্য করিয়া আছে। একটি ইন্দ্রকোষের অন্তরাল হইতে প্রশ্ন আসিল— ‘কে তুমি? কী চাও?’

চিত্রক গন্তীরকণ্ঠে বলিল— ‘আমি পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ স্কন্দগুপ্তের দূত। দুর্গাধিপ কিরাত বর্মার জন্য বার্তা আনিয়াছি।’

প্রাকারের উপর কিছুক্ষণ নিম্নস্বরে আলাপ হইল; তারপর আবার উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন হইল— ‘কী বার্তা আনিয়াছ?’

চিত্রক দৃঢ়স্বরে বলিল— ‘তাহা সাধারণের জ্ঞাতব্য নয়। দুর্গাধিপকে বলিব।’

আবার কিছুক্ষণ হ্রস্বকণ্ঠে আলোচনার পর তোরণ হইতে শব্দ আসিল— ‘উত্তম। অপেক্ষা কর।’

কিয়ৎকাল পরে দুর্গের কবাট ঈষৎ উন্মোচিত হইল। চিত্রক দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিল। কবাট আবার বন্ধ হইয়া গেল।

তোরণ অতিক্রম করিয়া দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলে এক ব্যক্তি আসিয়া তাহার ঘোড়ার বল্‌গা ধরিল। চিত্রক অশ্বপৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিল। চারিদিক হইতে প্রায় ত্রিশজন সশস্ত্র যোদ্ধা তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। চিত্রক লক্ষ্য করিল, ইহাদের অধিকাংশই আকৃতিতে হূণ; খর্বকীয় গজস্কন্ধ ক্ষুদ্রচক্ষু, মুখে শ্মশ্রু গুম্ফের বিরলতা। সকলের চোখেই সন্দিগ্ধ কুটিল দৃষ্টি।

যে-ব্যক্তি ঘোড়া ধরিয়াছিল সে কর্কশকণ্ঠে বলিল— ‘তুমি দূত! যদি মিথ্যা পরিচয় দিয়া দুর্গে প্রবেশ করিয়া থাক উপযুক্ত শক্তি পাইবে। চল, দুর্গাধিপ নিজ ভবনে আছেন সেখানে সাক্ষাৎ হইবে।’

চিত্রক এই ব্যক্তিকে শান্তচক্ষে নিরীক্ষণ করিল। চল্লিশ বৎসর বয়স্ক দৃঢ়শরীর হূণ; বামগণ্ডে অসির গভীর ক্ষতচিহ্ন মুখের শ্রীবর্ধন করে নাই; বাচনভঙ্গি অতিশয় অশিষ্ট। চিত্রক কিন্তু কোনও রূপ ক্রোধ প্রকাশ না করিয়া তাচ্ছিল্যের সহিত প্রশ্ন করিল— ‘তুমি কে?’

হূণের মুখ কালো হইয়া উঠিল; সে চিত্রকের প্রতি কষায়িত নেত্রপাত করিয়া বলিল— ‘আমার নাম মরুসিংহ। আমি চষ্টন দুর্গের রক্ষক— দুর্গপাল।’

আর কোনও কথা হইল না। চিত্রক নিরুৎসুক চক্ষে দুর্গের চারিদিক দেখিতে দেখিতে চলিল। দুর্গটি সাধারণ প্রাকারবেষ্টিত পুরীর মতই, বিশেষ কোন বৈচিত্র্য নাই। মধ্যস্থলে দুর্গাধিপের প্রস্তরনির্মিত দ্বিভূমক ভবন।

ভবনের নিম্নতলে প্রশস্ত বহিঃকক্ষে কিরাত বাহু দ্বারা বক্ষ আবদ্ধ করিয়া ভ্রূকুটি-বিকৃত মুখে পাদচারণা করিতেছিল; কক্ষের চার দ্বারে চারজন অস্ত্রধারী রক্ষী। চিত্রক ও মরুসিংহ কক্ষে প্রবেশ করিলে কিরাত তাহাদের লক্ষ্য করিল না, পূর্ববৎ পদচারণা করিতে লাগিল। তারপর সহসা মুখ তুলিয়া ক্ষিপ্রপদে চিত্রকের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

পরস্পরের দর্শনে উভয়ের মনে আনন্দ উপজাত হইল না। চিত্রক দেখিল কিরাতের আকৃতি হূণদের মত নয়, সে দীর্ঘকায় ও সুদর্শন; কেবল তাহার চক্ষু দু’টি ক্ষুদ্র ও ক্রূর। চিত্রক মনে মনে বলিল— তুমি কিরাত। রট্টার প্রতি লুব্ধ দৃষ্টিপাত করিয়াছিলে।

কিরাত বলিয়া উঠিল— ‘কে তুমি? কোথা হইতে আসিতেছ?’

চিত্রক বলিল— ‘পূর্বেই বলিয়াছি আমি সম্রাট স্কন্দগুপ্তের দূত। তাঁহার স্কন্ধাবার হইতে আসিয়াছি।’

ক্রোধ-তীক্ষ্ণ স্বরে কিরাত বলিল— ‘স্কন্দগুপ্ত! কী চায় স্কন্দগুপ্ত আমার কাছে? আমি তাহার অধীন নহি।’

চিত্রক বলিল— ‘সম্রাট স্কন্দগুপ্ত কী চান তাহা তাঁহার বার্তা হইতেই প্রকাশ পাইবে।’ একটু থামিয়া বলিল— ‘শিষ্টসমাজে মাননীয় ব্যক্তি সম্বন্ধে বিনয় বাক্য প্রয়োগের রীতি আছে।’

কিরাত অগ্নিবৎ জ্বলিয়া উঠিল— ‘তুমি ধৃষ্ট। আমার দুর্গে আসিয়া আমার সহিত যে ধৃষ্টতা করে আমি তাহার নাসাকর্ণ ছেদন করিয়া প্রাকার বাহিরে নিক্ষেপ করি।’

চিত্রকের ললাটের তিলকচিহ্ন ক্রিমশ লাল হইয়া উঠিতে লাগিল; কিন্তু সে ধীরস্বরে বলিল— ‘সম্রাট স্কন্দগুপ্তের দূতকে লাঞ্ছিত করিলে স্কন্দ সহস্র রণহস্তী আনিয়া তোমাকে এবং তোমার দুর্গকে হস্তীর পদতলে নিপিষ্ট করবেন। মনে রাখিও আমি একা নই; বাহিরে শত অশ্বারোহী অপেক্ষা করিতেছে।’

মনে হইল কিরাত বুঝি ফাটিয়া পড়িবে; কিন্তু সে দন্ত দ্বারা অধর দংশন করিয়া অতি কষ্টে ক্রোধ সম্বরণ করিল। অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরে বলিল— ‘তুমি যে স্কন্দগুপ্তের দূত তাহার প্রমাণ কি?’

চিত্রক নিঃশব্দে অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় বাহির করিয়া দিল।

নতমুখে কিছুক্ষণ অঙ্গুরীয় পর্যবেক্ষণ করিয়া কিরাত যখন মুখ তুলিল, তখন তাহার মুখ দেখিয়া চিত্রক অবাক হইয়া গেল। কিরাতের মুখে অগ্নিবর্ণ ক্রোধ আর নাই, তৎপরিবর্তে অধরপ্রান্তে মৃদু কৌতুকহাস্য ক্রীড়া করিতেছে। কিরাত মিষ্টস্বরে বলিল— ‘দূত মহাশয়, আপনি স্বাগত। আমার রূঢ় ব্যবহারের জন্য কিছু মনে করিবেন না। যুদ্ধবিগ্রহের সময় কোনও আগন্তুক দুর্গে প্রবেশ করিলে তাহাকে পরীক্ষা করিয়া লইতে হয়। আপনি যদি আমার তর্জনে ভয় পাইতেন তাহা হইলে বুঝিতাম— অঙ্গুরীয় সত্ত্বেও আপনি সম্রাটের দূত নন, শত্রুর গুপ্তচর। যা হোক, আপনার ব্যবহারে আমার সন্দেহ ভঞ্জন হইয়াছে। আসুন— উপবেশন করুন।’

চিত্রক কথায় ভিজিল না; মনে মনে বুঝিল কিরাত তাহাকে ভয় দেখাইবার চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া এখন অন্য পথ ধরিয়াছে। সে আরও সতর্ক হইল। কিরাত শুধু ক্রূর ও ক্রোধী নয়, কপটতায় ধুরন্ধর।

উভয়ে আসন পরিগ্রহ করিলে কিরাত বলিল— ‘সম্রাট কি বার্তা পাঠাইয়াছেন? লিখিত লিপি?’

চিত্রক শুষ্কস্বরে বলিল— ‘না, সম্রাট সামান্য দুর্গাধিপকে লিপি লেখেন না। মৌখিক বার্তা।’

কিরাত এই অবজ্ঞা গলাধঃকরণ করিল। চিত্রক তখন বলিল— ‘সম্রাট সংবাদ পাইয়াছেন যে বিটঙ্করাজ রোট্ট ধর্মাদিত্য চষ্টন দুর্গে আছেন—’

চকিতে কিরাত প্রশ্ন করিল— ‘এ সংবাদ কোথায় পাইলেন?’

চিত্রক বলিল— ‘কুমার-ভট্টারিকা যশোধরার মুখে।’

কিরাতের চক্ষু ক্ষণেকের জন্য বিস্ফারিত হইল; সে কিয়ৎকাল স্তব্ধ থাকিয়া বলিল— ‘তারপর বলুন।’

‘সম্রাট জানিতে পারিয়াছেন যে আপনি ছলপূর্বক ধর্মাদিত্যকে দুর্গে আবদ্ধ রাখিয়াছেন।’

কিরাত পরম বিস্ময়ভরে বলিয়া উঠিল— ‘আমি আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি! সে কি কথা! ধর্মাদিত্য আমার রাজা, আমার প্রভু—’

চিত্রক নীরসকণ্ঠে বলিয়া চলিল— ‘কুমার-ভট্টারিকা রট্টা যশোধরাকেও আপনি কপট-পত্র পাঠাইয়া দুর্গে আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন—’

গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া কিরাত বলিল— ‘সকলেই আমাকে ভুল বুঝিয়াছে। ইহা দুর্দৈব ছাড়া আর কি হইতে পারে? ধর্মাদিত্য স্বয়ং কন্যাকে দেখিবার জন্য উৎসুক হইয়াছিলেন—’

চিত্রক বলিল— ‘সে যা হোক, সম্রাট স্কন্দগুপ্ত আদেশ দিয়াছেন অচিরাৎ বিটঙ্করাজকে আমাদের হস্তে অর্পণ করুন। সম্রাট তাঁহার সাক্ষাতের অভিলাষী।’

কিরাত বলিল— ‘কিন্তু বিটঙ্করাজ আমার অধীন নয়, আমিই তাঁহার অধীন। সম্রাটের সহিত সাক্ষাৎ করা না করা তাঁহার ইচ্ছা।’

‘তবে বিটঙ্করাজকেই সম্রাটের আদেশ জানাইব। তিনি কোথায়?’

‘তিনি এই ভবনেই আছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি অতিশয় অসুস্থ। তাঁহার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইতে পারে না।’

কিছুক্ষণ উভয়ে চোখে চোখে চাহিয়া রহিল, কিন্তু কিরাতের দৃষ্টি অবনত হইল না। শেষে চিত্রক বলিল— ‘তবে কি বুঝিব সম্রাটের আজ্ঞা পালন করিতে আপনি অসম্মত?’

কিরাত ক্ষুব্ধস্বরে বলিল— ‘দূত মহাশয়, আপনিও আমাকে ভুল বুঝিতেছেন। আমি অসহায়। ধর্মাদিত্য আমার রাজা, আমার পিতৃতুল্য, তাঁহার জীবন বিপন্ন করিয়া আমি আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ঘটাইতে পারি না। বৈদ্য আমাদের সাবধান করিয়া দিয়াছেন, কোনও প্রকার উত্তেজনার কারণ ঘটিলেই ধর্মাদিত্যের প্রাণবিয়োগ হইবে।’

ক্ষণিক চিন্তা করিয়া চিত্রক বলিল— ‘মহারাজের সঙ্গে সন্নিধাতা আসিয়াছিল, তাহার নাম হর্ষ। সে কোথায়?’

স্কন্দগুপ্তের দূতের কাছে কিরাত এ প্রশ্ন প্রত্যাশা করে নাই, সে চমকিয়া উঠিল। তারপর দ্রুতকণ্ঠে বলিল— ‘হর্ষ আসিয়াছিল বটে, কিন্তু গতকল্য কপোতকূটে ফিরিয়া গিয়াছে।’

‘আর নকুল? এবং তাহার সহচরগণ?’

‘রাজকন্যা রট্টা যশোধরা আসিলেন না দেখিয়া তাহারাও ফিরিয়া গিয়াছে।’

কিরাত যে মিথ্যা কথা বলিতেছে তাহা চিত্রক বুঝিতে পারিল; হর্ষ ও নকুলের দল দুর্গেই কোনও কূটকক্ষে বন্দী আছে। সে নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল— ‘দুর্গাধিপ মহাশয়, আমার দৌত্য শেষ হইয়াছে। সম্রাটকে সকল কথা নিবেদন করিব; তারপর তাঁহার যেরূপ অভিরুচি তিনি করিবেন। তিনি আপনাকে জানাইতে বলিয়াছিলেন যে তাঁহার আদেশ অমান্য করিলে তিনি স্বয়ং আসিয়া সহস্র হস্তী দ্বারা দুর্গ সমভূমি করিবেন। আপনাকে একথা জানাইয়া রাখা উচিত বিবেচনা করি।’

চিত্রক ফিরিয়া দ্বারের দিকে চলিল।

‘দূত মহাশয়!’

কিরাত তাহার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। কিরাতের কণ্ঠস্বর মর্মাহত, মুখের ভাব বশংবদ। সে বলিল— ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না, কিন্তু ভাবিয়া দেখুন মহাপরাক্রান্ত সম্রাটের বিরাগভাজন হইয়া আমার লাভ কি? নিতান্ত নিরুপায় হইয়া আমি—’

‘সে কথা সম্রাট বিবেচনা করিবেন।’

‘দূত মহাশয়, আপনার প্রতি আমার একটি নিবেদন আছে। আপনি কয়েকদিন অপেক্ষা করুন, এখনি ফিরিয়া যাইবেন না। ইতিমধ্যে যদি ধর্মাদিত্য আরোগ্য হইয়া ওঠেন তখন আপনি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যথোচিত কর্তব্য করিবেন। আমার দায়িত্ব শেষ হইবে।’

এ আবার কোন্‌ নূতন চাতুরী? চিত্রক বিবেচনা করিয়া বলিল— ‘আমি আগামী কল্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারি। তাহার অধিক নয়।’

কিরাত ললাট কুঞ্চিত করিয়া বলিল— ‘মাত্র কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত! ভাল, আপনার যেরূপ অভিরুচি। আপনাদের সকলকে দুর্গমধ্যে স্থান দিতে পারিলে সুখী হইতাম; কিন্তু দুর্গে স্থানাভাব। — মরুসিংহ, দূত-প্রবরকে সসম্মানে দুর্গ বাহিরে প্রেরণ কর।’

মরুসিংহ হিংস্রচক্ষে চিত্রকের পানে চাহিল; তারপর বাক্যব্যয় না করিয়া বাহিরের দিকে চলিতে আরম্ভ করিল। চিত্রক তাহার অনুগামী হইল।

ভবনের প্রতিহারভূমি পর্যন্ত আসিয়া চিত্রক একবার ফিরিয়া চাহিল। দ্বারের কাছে কিরাত দাঁড়াইয়া আছে। তাহার মুখে বশংবদ ভাব আর নাই, দুই চক্ষু হইতে কুটিল হিংসা বিকীর্ণ হইতেছে। চারি চক্ষুর মিলন হইতেই কিরাত ফিরিয়া কক্ষে প্রবেশ করিল!

চিত্রক যখন বৃক্ষ-বাটিকায় ফিরিয়া আসিল তখন সূর্যাস্ত হইতেছে। গুলিককে সমস্ত কথা বলিলে গুলিক গুম্ফের প্রান্ত আকর্ষণ করিতে করিতে বলিল— ‘হুঁ। অসভ্য বর্বরটার কোনও দুরভিসন্ধি আছে। রাত্রে সাবধানে থাকিতে হইবে; অতর্কিতে আক্রমণ করিতে পারে।’

কিরাতের যে কোনও গুপ্ত অভিপ্রায় আছে তাহা চিত্রকও সন্দেহ করিয়াছিল; কিন্তু রাত্রে আক্রমণ করিবে তাহা তাহার মনে হইল না। অন্য কোনও উদ্দেশ্যে কিরাত কালবিলম্ব করিতে চাহে। কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য? চিত্রকের দল ফিরিয়া না গিয়া এখানে থাকিলে কিরাতের কী সুবিধা হইবে? কিরাত কি ধর্মাদিত্যকে হত্যা করিয়াছে? কিম্বা হত্যা করিতে চায়? সম্ভব নয়। ইচ্ছা থাকিলেও আর তাহা সাহস করিবে না। তবে কী?

গুলিক বলিল— ‘দণ্ডেন গো-গর্দভৌ— লোকটাকে হাতে পাইলে লাঠ্যৌষধি দিয়া সিধা করিতাম। যা হোক, উপস্থিত সতর্ক থাকা দরকার। আমি দশজন প্রহরী লইয়া মধ্যরাত্রি পর্যন্ত পাহারায় থাকিব, বাকি রাত্রি তুমি পাহারা দিও।’

সন্ধ্যার পর চিত্রক বৃক্ষতলে কম্বল পাতিয়া শয়ন করিল। দেহ ও মন দুইই ক্লান্ত, সে অবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িল।

মধ্যরাত্রে গুলিক আসিয়া তাহাকে জাগাইয়া দিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইতেই গুলিক তাহার কম্বলে শয়ন করিয়া নিমেষমধ্যে নিদ্রাভিভূত হইল এবং ঘর্ঘর শব্দে নাসিকাধ্বনি করিতে লাগিল।

বৃক্ষ-বাটিকায় ঘোর অন্ধকার, চারিদিকে সৈন্যগণ ভূ-শয্যায় পড়িয়া ঘুমাইতেছে। তরুচ্ছায়ার বাহিরে আসিয়া চিত্রক সাবধানে বৃক্ষ-বাটিকা পরিক্রমণ করিল। ভূমি সমতল নয়; অত্রতত্র বৃহৎ পাষাণখণ্ড পড়িয়া আছে, অন্ধকারে দৃষ্টিগোচর হয় না। দশজন সৈনিক স্থানে স্থানে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে প্রহরা দিতেছে। বাটিকার পশ্চাদ্‌ভাগে অশ্বগুলি ছন্দোবদ্ধ অবস্থায় রহিয়াছে। বাহিরের দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া চিত্রক কিছুই দেখিতে পাইল না, ঘন তমিস্রায় সমস্ত একাকার হইয়া গিয়াছে। কেবল দুর্গের উন্নত স্কন্ধ আকাশের গাত্রে গাঢ়তর অন্ধকারের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।

সতর্ক থাকা ব্যতীত প্রহরীর আর কিছু করিবার নাই। চিত্রক তরবারি কোমরে বাঁধিয়া অলস মন্থর পদে বৃক্ষ-বাটিকা প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। দুর্গ নিস্তব্ধ, শব্দ মাত্র নাই। নানা অসংলগ্ন চিন্তা চিত্রকের মস্তিষ্কে ক্রীড়া করিতে লাগিল। রট্টা…স্কন্দগুপ্ত… কিরাত…

ক্রমে চন্দ্রোদয় হইল। চন্দ্রের পরিপূর্ণ মহিমা আর নাই, অনেকখানি ক্ষয় হইয়া গিয়াছে। তবু তাহার ক্ষীণ প্রভায় চতুর্দিক অস্পষ্টভাবে আলোকিত হইল।

পরিক্রমণ করিতে করিতে চিত্রক লক্ষ্য করিল, যে-দশজন সৈনিক পাহারা দিতেছে তাহারা প্রত্যেকেই একটি বৃক্ষকাণ্ডে বা প্রস্তরখণ্ডে পৃষ্ঠ রাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহাদের চক্ষু মুদিত। চিত্রক বিস্মিত হইল না; দাঁড়াইয়া ঘুমাইবার অভ্যাস প্রত্যেক সৈনিকের আয়ত্ত করিতে হয়। অল্পমাত্র শব্দ শুনিলেই তাহারা জাগিয়া উঠিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। সে তাহাদের জাগাইল না।

শত হস্ত দূরে দুর্গের তোরণ ও প্রাকার ম্লান জ্যোৎস্নায় ছায়াচিত্রবৎ দেখাইতেছে। অকারণেই চিত্রক সেই দিকে চলিল। একবার তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে একটি চিন্তা ক্ষণিক রেখাপাত করিল— এই দুর্গ ন্যায়ত ধর্মত আমার।

অর্ধেক দূর গিয়া চিত্রক থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল; তারপর দ্রুত এক প্রস্তরখণ্ডের পশ্চাতে লুকাইল। তাহার চোখের দৃষ্টি স্বভাবতই অতিশয় তীক্ষ্ণ। সে দেখিল, দুর্গের দ্বার নিঃশব্দে খুলিতেছে; অল্প খুলিবার পর দ্বারপথে একজন অশ্বারোহী বাহির হইয়া আসিল।

চিত্রক কুঞ্চিত পলকহীন নেত্রে চাহিয়া রহিল। কিন্তু আর কোনও অশ্বারোহী বাহিরে আসিল না, দুর্গদ্বার আবার বন্ধ হইয়া গেল। যে অশ্বারোহী বাহিরে আসিয়াছিল, এতদূর হইতে মন্দালোকে চিত্রক তাহার মুখ দেখিতে পাইল না। অশ্বারোহী বাম দিকে অশ্বের মুখ ফিরাইয়া নিঃশব্দে ছায়ার ন্যায় প্রাকারের পাশ দিয়া চলিল।

অশ্বারোহীর ভাব-ভঙ্গিতে আত্মগোপনের চেষ্টা পরিস্ফুট; অশ্বক্ষুর হইতে কিছুমাত্র শব্দ বাহির হইতেছে না। চিত্রক একাগ্র দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিয়া দেখিল— অশ্বের চারি পায়ে ক্ষুরের উপর বস্ত্রের মত কিছু বাঁধা রহিয়াছে, তাই শব্দ হইতেছে না। কোথায় যাইতেছে এই নৈশ অশ্বারোহী—?

সহসা তড়িচ্চমকের ন্যায় চিত্রকের মস্তিষ্ক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। পলকের মধ্যে কিরাতের সমস্ত কুটিল দুরভিসন্ধি প্রকাশ হইয়া পড়িল। চিত্রক বুঝিল অশ্বারোহী চোরের মত কোথায় যাইতেছে।