গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

আদিম

আদিম

এই কাহিনীতে আদৌ স্থান কাল পাত্র-পাত্রীর প্রকৃত নাম বদল করিয়া লিখিতেছি। —

মহারাজ সূর্যশেখর শত্রু জয় করিয়া স্বরাজ্যে ফিরিয়াছেন। মরুভূমির পরপারে নির্জিত শত্রু মাথা নত করিয়াছে। মহারাজ সূর্যশেখর সহস্র বন্দী ও সহস্র বন্দিনী সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। তাহাদের মধ্যে সাধারণ মানুষও আছে, আবার অভিজাত বংশের যুবক-যুবতীও আছে। বড় সুন্দর আকৃতি এই বন্দী-বন্দিনীদের; রজতশুভ্র দেহবর্ণ, স্বর্ণাভ কেশ। যুবতীদের দিকে একবার চাহিলে চোখ ফেরানো যায় না।

মহারাজ ঘোষণা করিয়াছেন, একশত বন্দী ও একশত বন্দিনী তিনি স্বয়ং বাছিয়া লইবেন; বাকি যাহা থাকিবে, প্রধান সেনাপতি হইতে নিম্নতম নায়ক পর্যন্ত সকলে পদমর্যাদা অনুযায়ী ভাগ করিয়া লইবে। উপরন্তু লুণ্ঠিত ধনরত্ন যাহা সঙ্গে আসিয়াছে তাহাও ভাগ-বাঁটোয়ারা হইবে।

একদিন অপরাহ্ণে উত্তরায়ণের সূর্য মরুপ্রান্তর প্রজ্বলিত করিয়া অস্তোন্মুখ হইয়াছে এমন সময় বিজয় বাহিনী রাজধানীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হইল। পুরোভাগে মহারাজ সূর্যশেখরের চিত্রবিচিত্র শ্যেনলাঞ্ছন চতুর্দোলা, তাহার পশ্চাতে শিবিকা ও দোলিকায় সেনাপতির দল, তারপর বন্দী-বন্দিনীর শ্রেণী এবং লুণ্ঠিত ধনরত্নবাহী যানবাহন। সর্বশেষে বিপুল সৈন্যবাহিনী।

কিন্তু আজ আর সদলবলে পুরপ্রবেশের সময় নাই; মহারাজ স্বনির্বাচিত বন্দী-বন্দিনীদের লইয়া ডঙ্কা বাজাইয়া নগরে প্রবেশ করিলেন। সেনাপতিরাও নগরে যাইতেছেন; তাঁহারা কাল প্রাতে আসিয়া বন্দী-বন্দিনী বাছাই করিয়া লইয়া যাইবেন। কেবল সৈন্যদল ধনরত্ন ও বন্দী-বন্দিনীদের রক্ষকরূপে রহিল। কাল প্রাতে ধনরত্ন ভাগ হইবে, সৈনিকেরা যে-যার অংশ লইয়া যথাস্থানে প্রস্থান করিবে।

একজন কনিষ্ঠ সেনানীর নাম সোমভদ্র। বয়স একুশ বাইশ, বলিষ্ঠ দেহ, তাম্রফলকের ন্যায় দেহবর্ণ; সুন্দর আকৃতি। রাজধানীতেই তাহার গৃহ, তাহার পিতা একজন মধ্যশ্রেণীর ভদ্র গৃহস্থ। সোমভদ্র এই প্রথম যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিল; যুদ্ধে সে অসীম পরাক্রম দেখাইয়াছে, প্রধান সেনানায়কদের প্রশংসা অর্জন করিয়াছে মহারাজের ভীমকান্ত মুখের প্রসন্ন হাস্য তাহাকে পুরস্কৃত করিয়াছে। তাহার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কিন্তু আজ গৃহের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া যখন সকলের মন গৃহের জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে তখনও তাহার প্রাণে শান্তি নাই। গৃহের কথা স্মরণ হইলেই তাহার মন শঙ্কিত হইয়া উঠিতেছে। গৃহে পিতামাতা আছেন, কনিষ্ঠা ভগিনী শফরী এবং বালক-ভ্রাতা শ্যেনভদ্র আছে; ক্ষুদ্র সংসার। কিন্তু সোমভদ্রের সবচেয়ে ভয় শফরীকে। শফরী শুধুই তাহার অনুজা নয়—

উদ্‌ভ্রান্তভাবে সৈন্য সমাবেশের প্রান্তভূমিতে বিচরণ করিতে করিতে সোমভদ্র গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল; সৈন্যদল শত্রু বিজয় করিয়া ফিরিয়াছে, তাহাদের মনে চিন্তা নাই; তাহারা উচ্চকণ্ঠে গান গাহিতেছে, নিজেদের মধ্যে হুড়াহুড়ি করিতেছে। কাল প্রাতে তাহারা বেতন পাইবে, লুণ্ঠিত দ্রব্যের অংশ পাইবে; হয়তো দুই একটি দাস-দাসী পাইবে, তারপর মহানন্দে গৃহে ফিরিয়া যাইবে। কিন্তু সোমভদ্রের অবস্থা অন্যরূপ; তাহার মন দুইদিকে টানিতেছে। সম্মুখে নীয়মান পতাকার ন্যায় তাহার মন পিছন দিকে তাকাইয়া আছে।

শত্রু বিজয় করিয়া ফিরিবার পথে সহস্র বন্দিনীর মধ্যে একটি বন্দিনীর কাছে সোমভদ্র হৃদয় হারাইয়াছে। ইহা কেবলমাত্র দৈহিক আকর্ষণ নয়, গভীরতর বস্তু। বন্দিনীর নাম মেরুকা; শুভ্রশিখা দীপবর্তিকার ন্যায় তার রূপ, বন্দিনীর ছিন্ন-গলিত বস্ত্রাবরণ ভেদ করিয়া রূপশিখা স্ফুরিত হইতেছে। নীল চোখে কঠিন সহিষ্ণুতা। সে উচ্চবংশের কন্যা, দৈবনিগ্রহে বিজাতীয় শত্রুর কবলিত হইয়া স্বজন হইতে বহুদূরে নিক্ষিপ্ত, পৃথিবীতে আপন বলিতে তাহার কেহ নাই; সে এখন নির্মম শত্রুর পণ্যবস্তু। কিন্তু এই মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়িয়াও মেরুকা মনের স্থৈর্য হারায় নাই।

বন্দিনীদের মধ্যে সুন্দরী অনেক আছে, সকলেই সুন্দরী ও যুবতী; কারণ বাছিয়া বাছিয়া সুন্দরী যুবতীদেরই হরণ করিয়া আনা হইয়াছে। কিন্তু সোমভদ্র একমাত্র মেরুকাকে দেখিয়াই মুগ্ধ হইয়াছে। প্রত্যাবর্তনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিতে করিতে দু’জনে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসিয়াছে; চেনাশোনা হইয়াছে, দুই চারিটি সংক্ষিপ্ত কথার বিনিময় হইয়াছে, দু’জনে পরস্পরের নাম জানিয়াছে, অতীত জীবনের ইতিবৃত্ত জানিয়াছে। সোমভদ্র কিন্তু নিজের মনের কথা মেরুকাকে বলে নাই; বলিবার প্রয়োজন হয় নাই, সোমভদ্রের চোখের ভাষা মেরুকা বুঝিয়াছে।

কিন্তু আজ যাত্রাপথের প্রান্তে পৌঁছিয়া আর নীরব থাকা চলে না, মনের কথা মুখের ভাষায় প্রকাশ করা প্রয়োজন। তাই সোমভদ্রের মন এত বিভ্রান্ত। হৃদয়ে আবেগ আছে, শান্তি নাই। পথের প্রান্তে নয়, সে যেন দ্বিভুজ পথের কোণবিন্দুতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।

সেনাপতিরা সকলে চলিয়া গিয়াছেন। সূর্য অস্তগামী; সৈনিকেরা অপেক্ষাকৃত শান্ত হইয়া রাত্রির আহারের উদ্যোগ আয়োজন করিতেছে। সোমভদ্রের প্রতি কাহারও লক্ষ্য নাই। সে সহসা মনস্থির করিয়া বন্দিনীদের সাময়িক উপনিবেশের দিকে চলিল।

বন্দী ও বন্দিনীদের পৃথক অবরোধ। সৈন্যযূথের বিশ্রাম কালে দোলা-শকটাদি বাহনগুলিকে পর পর সাজাইয়া দুইটি পরিবেষ্টন নির্মিত হয়, একটিতে বন্দিগণ ও অপরটিতে বন্দিনীগণ থাকে। এই শকট-ব্যূহের মধ্যে রাজা ও দুই তিনজন প্রধান সেনাপতি ভিন্ন অন্য কাহারও প্রবেশাধিকার নাই। সোমভদ্র শকট-ব্যূহের বহির্দেশ ঘিরিয়া ধীর পদে পরিক্রমণ আরম্ভ করিল।

আবেষ্টনীর মধ্যে বন্দিনী মেয়েরা দাঁড়াইয়া আছে; তাহাদের দৃষ্টি বাহিরের দিকে। কাহারও চোখে আতঙ্ক, কাহারও চোখে নীরব অশ্রুর ধারা। কেহ বা নিয়তির ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করিয়া উদাসীন হইয়া পড়িয়ছে। কাহারও দৃষ্টি সম্মুখে ভীম নগর-তোরণের উপর নিবদ্ধ, কাহারও চক্ষু পশ্চাতে অদৃশ্য মাতৃভূমির দিকে প্রসারিত। তাহাদের সম্মিলিত মনের নিপীড়িত আকাঙ্ক্ষা কে নির্ণয় করিবে?

আবেষ্টনীর পশ্চাদ্ভাগে মেরুকা দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার চোখের দৃষ্টি সম্মুখেও নয়, পশ্চাতেও নয়; মনে হয় আপন মনের গহন জটিলতার মধ্যে তাহার চক্ষু দুটি পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে।

সোমভদ্র তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল; মাঝখানে একটি শকটের ব্যবধান। কিন্তু মেরুকা তাহাকে দেখিতে পাইল না। সোমভদ্র কিয়ৎকাল একাগ্র চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া অবরুদ্ধ স্বরে ডাকিল— ‘ মেরুকা!’

চকিতে মেরুকার চক্ষু বহির্মুখী হইল। সে ক্ষণকাল স্তিমিত নেত্রে সোমভদ্রকে নিরীক্ষণ করিয়া অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘সেনানী সোমভদ্র!’

শকটের উপর ঝুঁকিয়া সোমভদ্র প্রশ্ন করিল— ‘মেরুকা, তুমি কি ভাবছিলে?’

মেরুকা আকাশের পানে চাহিল। এক ঝাঁক পাখি কলকূজন করিয়া বাসায় ফিরিতেছে। মেরুকা ধীরে ধীরে বলিল— ‘কি ভাবছিলাম জানি না। বোধ হয় নিজের নিয়তির কথা ভাবছিলাম।’

উদগত আবেগ দমন করিয়া সোমভদ্র কহিল— ‘মেরুকা, তুমি আশা হারিও না।’

মেরুকা বলিল— ‘যেদিন বন্দিনী হয়েছি সেদিন থেকে আশা-আকাঙ্ক্ষা দুই-ই ত্যাগ করেছি। শুধু ভাবি, আমার নিয়তি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, ঝড়ের মুখে মরুভূমির বালুকণা কোন্‌ সমুদ্রের জলে ডুবে যাবে।’

তাহার নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বরে যে অপরিসীম হতাশা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা সোমভদ্রের হৃদয়কে আলোড়িত করিয়া তুলিল; সে মেরুকার পানে দুই বাহু প্রসারিত করিয়া আবেগ-স্খলিত স্বরে বলিল— ‘মেরুকা, তুমি আমার ভগিনী! আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

দীর্ঘকাল নীরব থাকিয়া মেরুকা বলিল— ‘ভগিনী! তোমাদের দেশে ভ্রাতা-ভগিনীর বিবাহ হয়! আমাদের দেশে হয় না। কিন্তু তুমি আমার ভ্রাতা নও, তুমি যদি আমাকে বিবাহ করা, আমি স্বর্গ হাতে পাব।’

মেরুকার শুষ্ক চক্ষু সহসা বাষ্পাকুল হইয়া উঠিল, সে সোমভদ্রের দিকে হাত বাড়াইয়া দিল। শকটের দুই পার হইতে আঙুলে আঙুলে ছোঁয়াছুঁয়ি হইল।

সোমভদ্র বলিল— ‘আমি কাল প্রত্যূষে আসব। একটি বন্দিনী আমার প্রাপ্য। আমি তোমাকে বেছে নেব, তারপরে বাড়ি গিয়ে তোমাকে বিয়ে করব।’

মেরুকার অধর থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। সে কথা বলিতে পারিল না, কেবল দুর্দম আকাঙ্ক্ষা ভরা চোখে সোমভদ্রের পানে চাহিয়া রহিল।

সোমভদ্র যখন নিজ গৃহের সম্মুখীন হইল সূর্য অস্ত গিয়াছে, অদূরস্থ নদীর নিস্তরঙ্গ নীল জলে অস্তরাগের খেলা চলিতেছে। গৃহ-প্রাঙ্গণের দ্বারে তাহার পিতা মাতা, ভগিনী শফরী ও বালক-ভ্রাতা শ্যেনভদ্র দাঁড়াইয়া; সকলের দৃষ্টি একসঙ্গে সোমভদ্রের উপর পড়িল। মায়ের মুখে হাসি, চোখে জল; পিতার মুখ তৃপ্তি-গম্ভীর। শ্যেনভদ্র ছুটিয়া দাদার কাছে যাইবার উপক্রম করিলে পিতা তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে আটকাইয়া রাখিলেন। কেবল শফরীকে কেহ আটকাইল না। সোমভদ্রকে স্বাগত সম্ভাষণ করিবার অগ্রাধিকার তাহারই।

শফরীর বয়স সতেরো। রূপ ও যৌবন মিলিয়া সাবলীল স্বর্ণাভ শফরীর মতোই তাহার দেহ। সে লঘুপদে ছুটিয়া গিয়া সোমভদ্রের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, গ্রীবার মধ্যে মুখ গুঁজিয়া গদ্‌গদ স্বরে ডাকিল— ‘ভাই!’

ক্ষণকালের জন্য সোমভদ্রের মনে হইল, তাহার সন্তাপ শান্ত হইয়াছে, অঙ্গ জুড়াইয়া গিয়াছে, দেহমন ভরিয়া একটি পরিতৃপ্ত আনন্দ সুগন্ধি ফুলের মতো ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে শফরীর স্কন্ধ জড়াইয়া লইল।

শফরী মুখ তুলিল। দুই চক্ষে আনন্দ বিকীর্ণ করিয়া সোমভদ্রের অধরের কাছে অধর ধরিল। বলিল— ‘চুমু খাও।’

সোমভদ্রের মন আবার অশান্ত হইয়া উঠিল। শফরীকে বলিতে হইবে, মেরুকার কথা বলিতে হইবে। সে শফরীর অধরে অধর স্পর্শ করিয়া বলিল— ‘শফরি, তুমি ভাল আছ?’

শফরী বলিল— ‘উঃ, কতদিন পরে তুমি ফিরে এলে!’

সোমভদ্র লঘু হাসিয়া বলিল— ‘যদি না ফিরে আসতাম? যদি যুদ্ধে মরে যেতাম!’

শফরীর মুখের হাসি মিলাইয়া গেল, সে বুভুক্ষু চক্ষে কিছুক্ষণ সোমভদ্রের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল— ‘তাহলে— তাহলে— তাহলে আমিও মরে যেতম।’

না, আর নয়, এ প্রসঙ্গ আর বাড়িতে দেওয়া উচিত নয়। সোমভদ্র নিজেকে শফরীর বাহুমুক্ত করিয়া বলিল— ‘না, তুমি মরে যেতে কেন? কিছুদিন হয়তো আমার জন্য দুঃখ করতে, তারপর অন্য কারুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হত। শফরী—’

তাহার কথা শেষ হইল না, শ্যেনভদ্র পিতার হাত ছাড়াইয়া ছুটিয়া আসিয়া বনবিড়ালের মতো তাহার পৃষ্ঠে লাফাইয়া পড়িল, হাঁচোড় পাঁচোড় করিয়া তাহার স্কন্ধে উঠিয়া বসিল। শ্যেনভদ্রের বয়স দশ বছর।

তিনজনে হাসিতে হাসিতে মাতাপিতার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সোমভদ্র নতজানু হইয়া মাতাপিতাকে অভিবাদন করিল। শফরীর চক্ষু সারাক্ষণ সোমভদ্রের মুখের উপর নিবদ্ধ হইয়া রহিল। সোমভদ্রের আচরণে কোথায় যেন বিকলতা রহিয়াছে, সে তাহাকে ভগিনী বলিয়া ডাকে নাই, শফরী বলিয়া ডাকিয়াছে। কেন?—

বাড়িতে অনাড়ম্বর উৎসবের হাওয়া। প্রাঙ্গণে বাঁধা শ্বেত গর্দভটি ঘন ঘন কর্ণ আন্দোলিত করিয়া কোমল চক্ষে চাহিয়া সোমভদ্রকে সম্ভাষণ জানাইয়াছে, গরু ছাগল ও মেষ নিজ নিজ ভাষায় সংবর্ধনা করিয়াছে। মা রন্ধনশালাতে গিয়াছেন, শফরী তাঁহার সঙ্গে গিয়াছে। পিতা প্রীতিবিম্বিত মুখে প্রাঙ্গণী-বেদীর উপর স্থির হইয়া বসিয়া আছেন। কেবল শ্যেনভদ্র জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গ ছাড়ে নাই, ছায়ার মতো তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে এবং নানা প্রশ্ন করিয়া তাহার মন আরও উদ্‌ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে।

সন্ধ্যার পর আহারের সময় সকলে সমবেত হইলে সোমভদ্র তাহার যুদ্ধযাত্রার অনেক বিচিত্র কাহিনী বলিল! সকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনিল। তারপর মাতা ক্লান্ত সোমভদ্রকে শয়ন করিতে পাঠাইলেন। শ্যেনভদ্র শফরীর কোলে মাথা রাখিয়া নিদ্রালু হইয়াছিল, সে তাহাকে শোয়াইয়া দিয়া আসিল। ফিরিয়া আসিয়া দেখিল পিতামাতা ঘনিষ্ঠ হইয়া বসিয়া বিবাহের আলোচনা করিতেছেন। সোমভদ্র ও শফরী বড় হইয়াছে; সোমভদ্র যুদ্ধে কীর্তি অর্জন করিয়া ফিরিয়াছে, এখন আর বিলম্ব করিয়া লাভ নাই, যত শীঘ্র সম্ভব বিবাহ দেওয়া প্রয়োজন। কালই পিতা মন্দিরে গিয়া পুরোহিতের সহিত দিনক্ষণ স্থির করিয়া আসিবেন।

শফরী দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের কথাবার্তা শুনিল। তাঁহাদের স্বর ক্রমশ গাঢ় ও স্মৃতিমধুর হইয়া আসিল; তখন শফরী শয়ন করিতে গেল। নিজের শয়নকক্ষে যাইবার আগে একবার সোমভদ্রের কক্ষে উঁকি মারিল।

ঘরের কোণে প্রদীপের নিষ্কম্প শিখা মৃদু আলোক বিতরণ করিতেছে। সোমভদ্র শয্যায় শুইয়া আছে। তাহার একটি বাহু চোখের উপর ন্যস্ত; নিশ্চয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। শফরী চাহিয়া চাহিয়া একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল। তাহার হৃদয়ে একটি প্রশ্ন বারংবার কাঁটার মতো ফুটিতে লাগিল। কেন? কেন সোমভদ্র তাহাকে ভগিনী বলিয়া ডাকিল না? তবে কি সে আর তাহাকে ভালবাসে না। তবে কি? —

শফরী নিজ কক্ষে গিয়া শয়ন করিল, কিন্তু তাহার ঘুম আসিল না। গৃহ নিঃশব্দ হইয়া গিয়াছে, বাহিরে নদীতীরে ক্বচিৎ হংস বা সারসের উচ্চকিত ধ্বনি শুনা যাইতেছে। নগর সুপ্ত, গৃহ সুপ্ত; কেবল শফরী জাগিয়া আছে।

রাত্রি দ্বিপ্রহরে শফরী উঠিল। অন্ধকারে ধীরে ধীরে সোমভদ্রের কক্ষের দিকে চলিল। ঘরের কোণে দীপশিখাটি ক্ষুদ্র হইয়া আসিয়াছে, সোমভদ্র পূর্ববৎ চক্ষের উপর বাহু রাখিয়া শুইয়া আছে। শফরী নিঃশব্দে তাহার শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইল। তাহার বুকে দুরন্ত ব্যাকুলতা আলোড়িত হইয়া উঠিল। আমার প্রিয়তম! আমার ভাই! এক রক্ত, এক দেহ; আমরা পরস্পরের হয়ে জন্মেছি, পরস্পরের জন্যে বড় হয়েছি, আমাদের মাঝখানে ব্যবধান নেই। আমরা কি কখনো আলাদা হতে পারি!

শয্যাপার্শ্বে নতজানু হইয়া শফরী সোমভদ্রের বুকের মাঝখানে অতি সন্তর্পণে চুম্বন করিল।

সোমভদ্র তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে শয্যায় পড়িয়া ছিল, চমকিয়া জাগিয়া উঠিল।

আজ গৃহে ফিরিবার পর হইতে সে সকলের কাছে মেরুকার কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু বলি-বলি করিয়াও বলিতে পারে নাই; মেরুকার নাম কণ্ঠ পর্যন্ত আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছে। মনে হইয়াছে, মেরুকার নাম উচ্চারণ করিলেই গৃহের এই শান্ত আনন্দময় পরিমণ্ডল চূর্ণ হইয়া যাইবে। সতেরো বছর পূর্বে শফরী যেদিন জন্মগ্রহণ করে সেইদিন হইতে স্থির হইয়া আছে তাহারা দু’জনে স্বামী-স্ত্রী। দু’জনে একসঙ্গে বড় হইয়াছে, কেহ অন্য কথা ভাবিতেও পারে নাই। তারপর যুদ্ধযাত্রা। কোথা হইতে বন্দিনী মেরুকা আসিয়া তাহার হৃদয় হরণ করিয়া লইল। সোমভদ্র প্রাণমন দিয়া মেরুকাকে ভালবাসিয়াছে, তাহাকে বিবাহ করিতে চায়। কিন্তু গৃহে ফিরিবার পর পিতামাতার মুখের পানে চাহিয়া, শফরীর মুখের পানে চাহিয়া তাহার মনে অপরাধের গ্লানি আসিয়াছে, মুখ ফুটিয়া মনের কথা বলিতে পারে নাইা। গৃহে ফিরিয়াই সকলের মনে আঘাত দিতে তাহার মন সরে নাই।

কিন্তু একথা বেশিক্ষণ লুকাইয়া রাখা চলিবে না। কাল প্রাতেই সে মেরুকাকে আনিতে যাইবে; মেরুকাকে লইয়া গৃহে ফিরিবার পর কিছুই আর অজ্ঞাত থাকিবে না। পিতামাতা তখন কি করিবেন, শফরী কি করিবে কিছুই অনুমান করা যায় না। তার চেয়ে আগেই কথাটা জানাইয়া রাখা ভাল। পিতামাতা যদি অমত করেন তখন মেরুকাকে লইয়া সে অন্যত্র ঘর বাঁধিবে। তাহার অর্থের অভাব নাই; সে যোদ্ধা, যুদ্ধে কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছে, অর্থও প্রচুর অর্জন করিবে—

তবু সে বলিতে পারে নাই। বিক্ষুব্ধ মন লইয়া সে শয়ন করিতে গিয়াছিল। তারপর তন্দ্রার ঘোরে সে পিতামাতা ও শফরীর সঙ্গে তর্ক করিয়াছে, স্বপ্নে মেরুকাকে ভগিনী বলিয়া চুম্বন করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে, আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে— এইভাবে অর্ধেক রাত্রি কাটিয়াছে।

শফরীর চুম্বনে ঘুম ভাঙিয়া সে উঠিয়া বসিল। চোখের জড়িমা দূর হইলে দেখিল, মেরুকা নয়, শফরী। তাহার মন অপ্রত্যাশিতভাবে স্বস্থ ও নিরুদ্বেগ হইল। শফরী একাকিনী, তাহাকে সে সব কথা বলিতে পারিবে। শফরীর সহিত তাহার মনের একটি সংযোগ আছে, নাড়ির যোগ, শফরী তাহার মনের কথা বুঝিতে পারে। তাহাকে মেরুকার কথা বলিলে সে বুঝিবে।

সোমভদ্র শফরীর হাত ধরিয়া তাহাকে শয্যার পাশে বসাইল, চুপি চুপি বলিল— ‘শফরি, তোর সঙ্গে কথা আছে।’

শফরী তাহার কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল— ‘কি কথা?’

প্রায় আলিঙ্গনবদ্ধভাবে বসিয়া দু’জনের মধ্যে হ্রস্বকণ্ঠে কথা হইতে লাগিল। জোরে কথা বলিলে মা-বাবার ঘুম ভাঙিয়া যাইতে পারে।

সোমভদ্র বলিল— ‘আমি একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি। কী সুন্দর মেয়ে, একবার দেখলে তুইও ভালবেসে ফেলবি।’

সোমভদ্রের বাহুবেষ্টনের মধ্যে শফরীর দেহ শক্ত হইয়া উঠিল— ‘কে সে?’

সোমভদ্র বলিল— ‘তার নাম মেরুকা, যাদের আমরা যুদ্ধে বন্দিনী করে এনেছি তাদেরই একজন। বন্দিনী হলেও উঁচু ঘরের মেয়ে। আমি তাকে বোন বলে ডেকেছি, তাকেই বিয়ে করব।’

শফরীর মেরুযষ্টি লৌহশঙ্কুর ন্যায় ঋজু হইয়া রহিল, সে ধীরে ধীরে বলিল— ‘তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু সে তো তোমার সত্যিকারের বোন নয়।’

সোমভদ্র বলিল— ‘নাই বা হল সত্যিকারের বোন। যার সঙ্গে ভালবাসা হয় সেই তো বোন। ভেবে দ্যাখ, যার সত্যিকার বোন নেই তার কী হয়? সে তো বাইরের মেয়েকে বিয়ে করে। আমিও তেমনি বাইরের মেয়েকে বিয়ে করব।’

শফরীর জিহ্বা শুষ্ক হইয়া গিয়াছিল। অনেকক্ষণ পরে সে বলিল— ‘কিন্তু ওর তো ঘর নেই। ওকে নিয়ে তুমি যাবে কোথায়?’

‘অবশ্য স্ত্রীর ঘরেই স্বামীকে যেতে হয়। কিন্তু ওর যখন ঘর নেই তখন বাবাকে বলব এই বাড়িতেই আমাদের স্থান দিতে। তা যদি তিনি না দেন তখন আলাদা ঘর বাঁধব।’

‘আর আমি? আমার কি হবে?’ কথাগুলি শফরী অতিকষ্টে কণ্ঠ হইতে বাহির করিল।

সোমভদ্র তাহার কণ্ঠস্বরের মর্মান্তিক শুষ্কতা লক্ষ্য করিল না, সাগ্রহে বলিল— ‘তুইও আমার মতো বাইরে বিয়ে করবি। শাস্ত্রে বলেছে মাঝে মাঝে বাইরে বিয়ে করতে হয়, নইলে বংশের অধোগতি হয়। কিন্তু তুই যদি নিতান্তই বাইরের মানুষকে ঘরে না আনতে চাস— তাহলে শ্যেনভদ্র তো রয়েছে! দু’চার বছরের মধ্যে ও জোয়ান হয়ে উঠবে—’

শফরী সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল— ‘আমি যদি বিয়ে না করি তাতেই বা ক্ষতি কি? তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই কর। — আচ্ছা, এবার ঘুমোও।’

সোমভদ্র তাহার হাত টানিয়া বলিল— ‘আমি ভোর না হতেই চলে যাব মেরুকাকে আনতে। মা-বাবাকে তুই কথাটা শুনিয়ে রাখিস।’

‘আচ্ছা—’ শফরী তাহার হাত ছাড়াইয়া চলিয়া গেল। সোমভদ্র অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে আবার শয়ন করিল। এ ভালই হইল। পিতামাতাকে নিজের মুখে কিছু বলিতে হইবে না।

শফরী নিজের কক্ষে ফিরিয়া গেল, অনেকক্ষণ শয্যায় মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া রহিল। মন বুদ্ধি অবশ হইয়া গিয়াছিল, আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিল; তখন সে শয্যায় উঠিয়া বসিল।

তাহার হৃদয় হিংসায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। কোথাকার একটা ঘৃণ্য বিজাতীয়া বন্দিনী রূপের লোভ দেখাইয়া তাহার ভাইকে ভুলাইয়া লইবে। না না, আমি দিব না। আমার ধন দিব না, তার চেয়ে—

শয্যা হইতে উঠিয়া শফরী দেওয়ালের কুলঙ্গি হইতে একটি শল্য তুলিয়া লইল। পিত্তল নির্মিত তীক্ষ্ণধার শল্য। শফরীর পিতা একজন অতি নিপুণ ধাতুশিল্পী, তিনি এই শল্যটি স্বহস্তে নির্মাণ করিয়া কন্যাকে উপহার দিয়াছিলেন। শফরী শল্যটির সূক্ষ্ম অণি নিজের বুকের মাঝখানে ফুটাইয়া পরখ করিল, তারপর আবার শয্যায় আসিয়া বসিল।

সোমভদ্র নিজ শয্যায় ঘুমাইতেছে। তাহার মন ওই মায়াবিনী রাক্ষসীর রূপে নিমজ্জিত হইয়া আছে; হয়তো ঘুমাইয়া তাহাকে স্বপ্ন দেখিতেছে। কাল সকালেই সে রাক্ষসীকে আনিতে যাইবে। না না, তার পূর্বেই—। সোমভদ্রের বুকের মাঝখানে, যেখানে সে চুম্বন করিয়াছিল, ঠিক সেইখানে এই শল্য বসাইয়া দিবে; তারপর শল্য নিজের বুকে বিঁধিয়া দিয়া দু’জনে একসঙ্গে পরলোকে যাইবে। জন্মাবধি যে বন্ধন আরম্ভ হইয়াছিল, মৃত্যুর পরও তাহা ছিন্ন হইবে না! একই তরুণীতে হাত ধরাধরি করিয়া তাহারা মৃত্যু-নদীর খরস্রোত পার হইবে।

শফরী দৃঢ়মুষ্টিতে শল্য ধরিয়া সোমভদ্রের শয্যাপাশে গিয়া দাঁড়াইল, তাহার নিশ্চিন্ত নিদ্রিত মুখের পানে চাহিল। সহসা অদম্য রোদনের বেগ তাহার বক্ষ হইতে কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল। অতি কষ্টে বাষ্পোচ্ছ্বাস সংবরণ করিয়া সে ফিরিয়া গেল, নিজের শয্যায় পড়িয়া অশ্রুর উৎস মুক্ত করিয়া দিল। না, সোমভদ্রের বুকে সে শল্য বিঁধিতে পারিবে না।

শুইয়া শুইয়া অসহায়ভাবে সে মেরুকাকে গালি দিতে লাগিল— রাক্ষসী! পিশাচী! ডাকিনী! — পিশাচী! রাক্ষসী! ডাকিনী!

নদীতীর হইতে একটা সারসের কেংকার ভাসিয়া আসিল। শফরীর মনে হইল, সারস বলিল— ডাকিনী!

ডাকিনী! এতক্ষণ শফরীর স্মরণ ছিল না, নদীতীরে শর-কাণ্ডের কুটিরে এক ডাকিনী বাস করে। ডাকিনী তন্ত্রমন্ত্র জানে, মারণ বশীকরণ জানে। শফরী নদীতীরে তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছে, দু’-একবার কথাও বলিয়াছে, শীর্ণ কৃষ্ণকায়া বিকট-দশনা বৃদ্ধা, প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বাস করে। কিন্তু রাত্রে তাহার কাছে লোক আসে, যাহারা মন্ত্রৌষধির বলে গোপন অভিসন্ধি সিদ্ধ করিতে চায় তাহারা অন্ধকারে গা ঢাকিয়া চুপি চুপি ডাকিনীর কাছে আসে।

শফরী ক্ষণকাল নিশ্চল বসিয়া রহিল। তারপর উঠিয়া নিঃশব্দে গৃহের বাহির হইল। তীক্ষ্ণ শল্যটি বস্ত্রের মধ্যে লুকাইয়া লইল। সে ডাকিনীর কাছে যাইবে, ডাকিনীর মন্ত্রবলে শত্রু নিপাত করিবে।

গৃহ হইতে অল্প দূরে শরবনের মধ্যে ডাকিনীর কুটির; কুটিরের মাঝখানে মাটির উপর অঙ্গার-কুণ্ড। কিন্তু অঙ্গারের রক্তাভ আলোকে কুটিরের মধ্যে মানুষ দেখা যাইতেছে না।

শফরী শঙ্কিত বক্ষে দ্বারের বাহিরে কিয়দ্দূরে আসিয়া দাঁড়াইল; বেশি কাছে যাইতে ভয় করে। সে কম্পিত কণ্ঠে ডাকিল— ‘ডাকিনি।’

যেন মন্ত্রবলে ডাকিনী তাহার সম্মুখে আবির্ভূত হইল; বিকট হাসিয়া বলিল— ‘বিদেশিনী তোর ভাই-এর মন কেড়ে নিয়েছে, তাই এসেছিস?’

শফরী ভয় ভুলিয়া গেল, ডাকিনীর হাত ধরিয়া আবেগভরে বলিল— ‘হ্যাঁ ডাকিনি, তুই আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে।’

ডাকিনীর আঙুলে দীর্ঘ নখ, সে নখযুক্ত আঙুল শফরীর মুখে বুলাইয়া বলিল— ‘ভাই ওমনি পাওয়া যায় না। কি দিবি?’

শফরী বলিল— ‘তুই যা বলবি তাই দেব।’

‘বুকের রক্ত দিতে পারবি?’

‘পারব।’

‘তবে তাই দে।’ বলিয়া ডাকিনী শফরীর বুকের সামনে নিজ করতল গণ্ডূষ করিয়া ধরিল।

শফরী শল্য বাহির করিয়া নিজের বুকে আঁচড় কাটিল, দরদর করিয়া রক্ত ডাকিনীর গণ্ডূষে পড়িতে লাগিল। গণ্ডূষ পূর্ণ হইলে ডাকিনী বলিল— ‘এতেই হবে। তুই দাঁড়া, আমি আসছি।’

সে কুটিরে প্রবেশ করিল। শফরী রক্তক্ষরিত বক্ষে বাহিরে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, অঙ্গার-কুণ্ডের সম্মুখে নতজানু হইয়া ডাকিনী পূর্ণ করতল আগুনের উপর উপুড় করিয়া দিল। অগ্নি ক্ষণকাল স্তিমিত হইয়া রহিল, তারপর দপ্ করিয়া শিখা তুলিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ডাকিনী তখন মন্ত্র পড়িতে পড়িতে বামাবর্তে অগ্নি পরিক্রমণ করিতে লাগিল।

অন্ধকারে দাঁড়াইয়া শফরী কম্প্রবক্ষে বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া রহিল।

অগ্নিশিখা প্রশমিত হইলে ডাকিনী ধুনী হইতে এক টিপ ভস্ম লইয়া শফরীর কাছে ফিরিয়া আসিল, বলিল— ‘ভয় নেই, ভাইকে ফিরে পাবি। বিদেশিনী তোর ভাইকে কেড়ে নিতে পারবে না।’

রুদ্ধশ্বাসে শফরী বলিল— ‘পারবে না?’

‘না, আমার মন্তর মিথ্যে হয় না! — এই ভস্ম বুকের কাটায় লাগিয়ে দে, কাটা জুড়ে যাবে।’

ভস্ম লইয়া শফরী বুকে মাখিল; মনে হইল ভস্ম নয়, চন্দন। ডাকিনী তখন বলিল — ‘এবার আমায় কি দিবি বল।’

‘তোমায় কী দেব?’ ডাকিনীকে শফরীর অদেয় কিছুই ছিল না, কিন্তু সঙ্গে যে কিছুই নাই। সে অমূল্য শল্যটি ডাকিনীর হাতে দিয়া বলিল— ‘এই নাও। আমার বাবা আমার জন্যে নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন, সারা দেশে এর জোড়া নেই।’

‘দে দে—’ শল্য লইয়া ডাকিনী কুটিরে ফিরিয়া গেল। শফরী দেখিল, সে শল্যটি আগুনের কাছে ধরিয়া লোলুপ চক্ষে দেখিতেছে এবং শিশুর মতো খিলখিল করিয়া হাসিতেছে।

টলমল উদ্বেল হৃদয়ে শফরী গৃহে ফিরিয়া গেল। আশার উৎকণ্ঠায় সারা রাত্রি শয্যায় পড়িয়া জাগিয়া রহিল।

বন্দিনীদের অবরোধে মেরুকাও সারা রাত্রি ঘুমায় নাই। ঊষার উদয়ে সোমভদ্র আসিবে, তাহার প্রতীক্ষায় জাগিয়া আছে। গৃহহীনা বন্দিনী গৃহ পাইবে, স্বামী পাইবে, মেষ-ছাগের মতো দাসীহাটে বিক্রীত হইতে হইবে না। তাই আশার উৎকণ্ঠায় তাহার চোখে ঘুম নাই।

ঊর্ধ্বে নক্ষত্রগুলি ধীরে ধীরে ম্লান হইয়া আসিল, আকাশের অগ্নিকোণে যে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি সূ্র্যোদয়ের পূর্বে উদিত হইলে নদীতে জল বাড়ে, সেই নক্ষত্রটি দপদপ করিতে লাগিল। ক্রমে সে নক্ষত্রটিও নিষ্প্রভ হইয়া পড়িল; প্রত্যূষের ধূসর আলো অলক্ষিতে পরিস্ফুট হইতে লাগিল।

সোমভদ্র কিন্তু আসিল না। মেরুকার ব্যাকুল চক্ষু নগর-দ্বারের দিকে চাহিয়া আছে— ঐ বুঝি সে আসিতেছে। ঐ বুঝি সোমভদ্র!

কিন্তু না, যাহারা আসিতেছে তাহাদের মধ্যে সোমভদ্র নাই। অন্যান্য সেনাপতিরা আসিতেছেন, তাঁহারা স্বচক্ষে দেখিয়া বাছাই করিয়া নির্ধারিত সংখ্যক বন্দী-বন্দিনী লইয়া যাইবেন। সকলের সঙ্গে বহু সশস্ত্র রক্ষী।

সূর্যোদয় হইলে সেনাপতিরা বন্দিনীদের অবরোধে প্রবেশ করিলেন। আর আশা নাই। মেরুকার বুক ফাটিয়া নিশ্বাস বাহির হইল। যুদ্ধে বন্দিনী ক্রীতদাসীর ভাগ্য এত শীঘ্র সুপ্রসন্ন হইবে, ইহা সে কেমন করিয়া আশা করিয়াছিল? ছিন্নমূল লতায় কি ফুল ফোটে!

মেরুকা মনে মনে নিজের ভবিষ্যৎ জীবন কল্পনা করিল। একজন মাংসলোলুপ সেনাপতি তাহাকে লইয়া যাইবেন। কিছুদিন পরে তাহার ভোগতৃষ্ণা চরিতার্থ হইলে তিনি তাহাকে দাসীহাটে বিক্রয় করিবেন। কোনও মধ্যবিত্ত ব্যক্তি তাহার ক্লান্ত-যৌবন দেহটা ক্রয় করিবে। আবার কিছুকাল পরে সেও তাহাকে কোনও দরিদ্র কৃষকের কাছে বিক্রয় করিবে। তারপর একদিন তাহার ভগ্ন জীর্ণ দেহটা নদীর গর্ভে সমাধি লাভ করিবে। ইহাই তাহার জীবনের সুনিশ্চিত পরিণাম।

অমোঘভল্ল নামক এক সেনাপতি মেরুকার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বয়স অনুমান চল্লিশ, দৃঢ় গঠন, মাংসল দেহ, ললাটে গভীর অস্ত্রক্ষত চিহ্ন, চক্ষে কর্তৃত্বের অভিমান। আঠারো বছর হইতে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ করিয়া তিনি বুঝিয়াছিলেন, জীবনে সারবস্তু কেবল দুইটি আছে; শত্রুর শোণিত এবং নারীর যৌবন। মেরুকার দেহ নিরাবরণ করিয়া তিনি ভোগপ্রবীণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিলেন, চিবুক ধরিয়া তাহার মুখ তুলিয়া চোখের উপর চোখ রাখিয়া সহজ গভীর স্বরে বলিলেন— ‘নাম কি?’

তুষারশীতল কণ্ঠে মেরুকা নাম বলিল।

অমোঘভল্ল প্রশ্ন করিলেন— ‘হাসতে জানো?’

অন্তরে বিদ্বেষের তুষানল জ্বালিয়া মেরুকা দশনপ্রান্ত উন্মোচিত করিয়া মুখে হাসির ভঙ্গিমা করিল।

সেনাপতি অমোঘভল্ল সন্তুষ্ট হইলেন। মেরুকার কণ্ঠস্বর মিষ্ট, দন্তপংক্তি সুন্দর। তিনি দুইজন ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন— ‘একে আমার প্রমোদ-বাটিকায় নিয়ে যাও।’

মেরুকা একবার চোখ তুলিয়া মহানায়ক অমোঘভল্লের পানে চাহিল, তারপর নিঃশব্দে দুই ভৃত্যের মধ্যবর্তিনী হইয়া দাঁড়াইল। ভৃত্যেরা তাহার দেহে একখণ্ড লঘু উত্তরীয় জড়াইয়া দিল।

সোমভদ্র ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।

শফরীর সহিত কথা বলিবার পর তাহার মন নিরুদ্বেগ হইয়াছিল, সে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। একেবারে ঘুম ভাঙ্গিল যখন সূর্যোদয় হইতেছে। সে কিছুক্ষণ জড়বৎ বসিয়া রহিল, তারপর স্মৃতিশক্তি ফিরিয়া আসিলে মুখে অব্যক্ত শব্দ করিয়া দৌড়াইতে আরম্ভ করিল।

সেনাপতি আমোঘভল্লের ভৃত্যদ্বয় মেরুকাকে দোলায় তুলিবার উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময় সোমভদ্র সৈন্যব্যূহের সম্মুখে উপস্থিত হইল।

‘মেরুকা!’

মেরুকা উচ্চকিত হইয়া দেখিল সোমভদ্র ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছে। তাহার অন্তরের সমস্ত হতাশা কঠিন-তিক্ত বিদ্বেষে পরিণত হইল, চক্ষু হিমশীতল উপলখণ্ডের ন্যায় নিষ্প্রাণ হইয়া গেল। সে সোমভদ্রের দিকে পিছন ফিরিয়া দোলায় আরোহণের উপক্রম করিল।

সোমভদ্র ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল— ‘মেরুকা! তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

সেনাপতি আমোঘভল্লের ভৃত্যেরা সোমভদ্রকে চিনিত না, একজন রূঢ়হস্তে তাহাকে সরাইয়া দিয়া বলিল— ‘সাবধান! দূরে থাকো।’

সোমভদ্র ক্রোধ-দীপ্ত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া বলিল— ‘আমি সেনানায়ক সোমভদ্র। তোমরা কে? একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

নাম শুনিয়া ভৃত্যেরা নরম হইল, বলিল— ‘আমরা মহানায়ক অমোঘভল্ল মহাশয়ের ভৃত্য। মহানায়ক এই বন্দিনীকে নির্বাচন করেছেন। তাই ওকে তাঁর প্রমোদ-বাটিকায় নিয়ে যাচ্ছি।’

মেরুকা তখন দোলায় উঠিয়া বসিয়াছে, দারুগঠিত মূর্তির ন্যায় দেহ কঠিন করিয়া বসিয়া আছে। সোমভদ্র একবার তাহার পানে চাহিল, একবার ভৃত্যদের পানে চাহিল। তারপর দৃঢ় আদেশের সুরে বলিল— ‘তোমরা দাঁড়াও, চলে যেও না। আমি মহানায়ক অমোঘভল্লের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি।’

সোমভদ্র দ্রুত ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করিল। ভৃত্যদ্বয় ফাঁপরে পড়িয়া কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে মন্ত্রণা করিল, তারপর দোলা তুলিয়া লইয়া প্রস্থান করিল। তাহাদের কাছে প্রভুর আদেশই গরিষ্ঠ।

দোলার মধ্যে মেরুকা দারু-পুত্তলীর ন্যায় বসিয়া রহিল। নিয়তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে নাই, তাহাতে নিয়তি আরও নিষ্ঠুর হইয়া ওঠে। হয়তো এই বৃষস্কন্ধ প্রবীণ যোদ্ধার অন্তরে দয়া মায়া আছে, হয়তো সে চিরদিনের জন্য তাঁহার গৃহে আশ্রয় পাইবে, হয়তো— হয়তো—

দূর্বাঘাসের মতো আশা মরিয়াও মরে না। বুদ্ধির দর্পণে অনিবার্য ভবিষ্যৎ দেখিয়াও মরিতে চায় না—

সোমভদ্র বন্দিনীদের আবেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল, মহানায়ক অমোঘভল্ল একটি বন্দিনীর বস্ত্র মোচন করিয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিতেছেন। তিনি পাঁচটি বন্দিনী পাইবেন, এটি দ্বিতীয়। সোমভদ্রকে আসিতে দেখিয়া অমোঘভল্ল পরম সমাদরের সহিত তাহাকে সম্বোধন করিলেন— ‘দেখ তো সোমভদ্র, এই বন্দিনীটাকে বেশ শক্ত-সমর্থ মনে হচ্ছে। আমার বিহার-নৌকার দাঁড় টানতে পারবে?’

সোমভদ্র একবার বন্দিনীর প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া নিরুৎসুক কণ্ঠে বলিল— ‘পারবে।’ তারপর ব্যগ্রস্বরে কহিল— ‘মহানায়ক, আপনার সঙ্গে আমার আড়ালে একটা কথা আছে।’

মহানায়ক অমোঘভল্ল ঈষৎ বিস্ময়ে একটু সরিয়া আসিয়া বলিলেন— ‘কি কথা?’

সোমভদ্র অধর লেহন করিয়া বলিল— ‘মহানায়ক, যে-বন্দিনীকে আপনার ভৃত্যেরা নিয়ে যাচ্ছে, সে— সে—’

অমোঘভল্ল বলিলেন— ‘যে বন্দিনীটার নাম মেরুকা তার কথা বলছ?’

‘হ্যাঁ মহানায়ক। মেরুকা— আমি— আমি তাকে নিতে চাই। তাকে—’

অমোঘভল্ল উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া বলিলেন, ‘এখন আর হয় না বন্ধু! আমি তাকে হস্তগত করেছি। জানো তো, যে আগে আসে সে আগে পায়।’

সোমভদ্র বলিল, ‘কিন্তু— আপনি আমাকে এই অনুগ্রহ করুন ভদ্র। আমি মেরুকাকে বিবাহ করতে চাই।’

অমোঘভল্লের হাস্যমুখ সহসা গম্ভীর হইল। তিনি বলিলেন— ‘বিবাহ! তুমি একটা বিদেশিনী বন্দিনীকে বিবাহ করতে চাও!’

সোমভদ্র অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল— ‘হ্যাঁ মহানায়ক, আমার হৃদয় মেরুকাকে চায়। আমি তাকে বিয়ে করে সংসার পাততে চাই।’

অমোঘভল্ল ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন— ‘তোমার গৃহে ভগিনী নাই?’

সোমভদ্র চক্ষু নত করিয়া বলিল— ‘আছে ভদ্র।’

‘যুবতী ভগিনী? বিবাহযোগ্যা?’

‘হ্যাঁ ভদ্র।’

অমোঘভল্ল তখন গভীর ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলিলেন— ‘ধিক সোমভদ্র। গৃহে বিবাহযোগ্যা যুবতী। ভগিনী থাকতে তুমি একটা অজ্ঞাতকুলশীলা অজ্ঞাতচরিত্রা বন্দিনীকে বিবাহ করতে চাও। ওরা তো দু’দিনের সম্ভোগের সামগ্রী, ওরা কি ভগিনীর পদ অধিকার করার যোগ্য? তুমি সদ্বংশজাত, তুমি রাজ্যের একজন সেনানায়ক; তুমি যদি এমন কুদৃষ্টান্ত স্থাপন কর, তাহলে সামান্য লোকে কী করবে? জাতির সংস্কৃতি বিজাতীয় ভাবের বন্যায় ভেসে যাবে। তাছাড়া তুমিও সুখী হতে পারবে না। যার সঙ্গে রক্তের সম্বন্ধ নেই, সে কি কখনও হৃদয়ের আত্মীয় হতে পারে? সে কি গৃহের গৃহিণী হতে পারে?’

কিন্তু উপদেশ বাক্যে সোমভদ্রের রুচি নাই। সে ত্বরান্বিত কণ্ঠে বলিল— ‘মহানায়ক, অনুগ্রহ করুন, মেরুকাকে দান করুন।’

অমোঘভল্ল দৃঢ়স্বরে বলিলেন— ‘কখনই না। তুমি উন্মত্ত, জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়েছ; তোমাকে প্রশ্রয় দিলে তোমারই সর্বনাশ হবে। যাও, গৃহে ফিরে যাও, আপন ভগিনীকে বিবাহ কর।’

সোমভদ্র কিছুক্ষণ বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার অন্তর বিদ্রোহ করিতে চাহিল; কিন্তু সে যোদ্ধা, আদেশ লঙ্ঘনে অনভ্যস্ত। সে টলিতে টলিতে ফিরিয়া চলিল।

অমোঘভল্ল সদয়কণ্ঠে তাহাকে ডাকিলেন— ‘শোনো সোমভদ্র।’

সোমভদ্র আবার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অমোঘভল্ল সস্নেহে তাহার স্কন্ধে হস্তার্পণ করিয়া বলিলেন— ‘হতাশ হয়ো না। চুপি চুপি একটা কথা বলি শোনো। দু’মাস পরে হোক ছ’মাস পরে হোক মেরুকাকে আমি বিক্রি করব। তখন যদি তুমি ওকে চাও, তাহলে তোমার হাতেই ওকে বিক্রি করব, অন্য কাউকে দেব না। ইতিমধ্যে তুমি তোমার ভগিনীকে বিবাহ করে সংসারী হও। কেমন?’

সোমভদ্র আর সেখানে দাঁড়াইল না।

অদূরে শক্ত-সমর্থ বন্দিনীটা এতক্ষণ নগ্নদেহে অপেক্ষা করিতেছিল, মহানায়ক অমোঘভল্ল হাসিতে হাসিতে তাহার কাছে ফিরিয়া গেলেন।

ওদিকে শুষ্ক চক্ষু মেলিয়া শফরী শয্যায় পড়িয়া ছিল। সূর্যোদয় কালে সোমভদ্র যখন ছুটিয়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল, তখন সে দুঃস্বপ্নময় চিন্তার জাল সরাইয়া শয্যা হইতে উঠিল। ইতিমধ্যে পিতামাতাও জাগিয়াছেন। শফরী তাঁহাদের কাছে গিয়া সোমভদ্রের সঙ্কল্পের কথা জানাইল, তারপর সহসা মায়ের গলা জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল।

মাতাপিতা প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। তারপর মাতা শফরীকে সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সান্ত্বনা দিতে গিয়া নিজেই অসংবৃত হইয়া পড়িলেন। পিতার মাথায় ঝাঁকে ঝাঁকে দুশ্চিন্তা আসিয়া জুটিল। সোমভদ্র বয়ঃপ্রাপ্ত এবং স্বাধীন, তাহাকে শাসন করা যায় না….বিজাতীয়া নারীকে বিবাহ করিয়া সে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে…এরূপ বিবাহ কখনো সুখের হয় না; মিশ্র রক্তের সন্তানসন্ততি কখনো ভাল হয় না, উন্মার্গগামী হয়…এদিকে শফরীর কি হইবে…শ্যেনভদ্র নিতান্ত বালক; অগ্রজার সহিত অনুজের বিবাহ নিষিদ্ধ না হইলেও বাঞ্ছনীয় নয়…বাহিরের পাত্র ঘরে ডাকিয়া আনিতে হইবে; ধাতুপ্রকৃতির বিষময়তায় সংসারের সুখশান্তি নষ্ট হইবে, খাল কাটিয়া কুমীর আনা এবং বাহিরের জামাতা ঘরে আনা একই কথা…সোমভদ্র এ কী করিল! অন্ধমোহের বশে সুখের সংসার ছারখার করিয়া দিল!

সকলের মনে বিষণ্ণ ব্যাকুলতা, সকলের দৃষ্টি বাহিরের দিকে। ঐ বুঝি বধূর হাত ধরিয়া সোমভদ্র আসিতেছে! শফরী ভাবিতেছে, বধূকে দেখিয়া সে কী করিবে? সংযম হারাইবে না তো?

কিন্তু প্রভাত বহিয়া গেল, সোমভদ্র ফিরিল না। সকলের মন উৎকণ্ঠিত; শফরীর মনে ক্ষীণ আশা ঝিকমিক করিতে লাগিল— তবে কি ডাকিনীর মন্ত্রতন্ত্র ফলিয়াছে। তবে কি—?

দ্বিপ্রহরেও যখন সোমভদ্র ফিরিল না, তখন পিতা চিন্তিত মুখে তাহাকে খুঁজিতে বাহির হইলেন। মাতা শঙ্কা-ভরা বুকে রন্ধনশালায় গেলেন। শফরী অঙ্গনে ছটফট করিয়া বেড়াইতে লাগিল। তারপর হঠাৎ তাহার বুক সন্ত্রাসে চমকিয়া উঠিল। বাল্যকাল হইতে সোমভদ্রের অভ্যাস ছিল, যখনই কোনও কারণে তাহার মন খারাপ হইত, তখনই সে নদীর ধারে গিয়া বসিয়া থাকিত। একবার শফরীর প্রশ্নের উত্তরে বলিয়াছিল— বড় শান্ত শীতল ওই নদীর জল। যেদিন এ পৃথিবী আর ভাল লাগবে না, সেদিন ওর তলায় গিয়ে শুয়ে থাকব।

আতঙ্ক-শরবিদ্ধ হৃদয় লইয়া শফরী হরিণীর মতো নদীতীরে ছুটিল।

জলের কিনারে একটি বালিয়াড়ির আড়ালে সোমভদ্র পাশ ফিরিয়া শয়ান রহিয়াছে, অলস হস্তে নুড়ি কুড়াইয়া একটি একটি করিয়া জলে ফেলিতেছে। শফরী তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, সে দেখিতে পাইল না। অন্তরের অতল গুহায় ডুবিয়া আছে।

শফরী মৃদু গদ্গদ স্বরে ডাকিল— ‘ভাই!’

সোমভদ্রের নিরুৎসুক চক্ষু শফরীর দিকে ফিরিল। শফরীর বুকের মাঝখানে কাটা দাগের উপর দৃষ্টি পড়িল। সে বলিল— ‘কি করে কেটে গেল?’

শফরী ভঙ্গুর হাসিয়া বলিল— ‘কাটেনি। ঘুমের ঘোরে নখ দিয়ে আঁচড়ে ফেলেছি। চল, বাড়ি চল।’

সোমভদ্রের চোখে একটু সচেতনতা দেখা দিল, সে বলিল— ‘বাড়ি? কেন?’

‘সারাদিন খাওনি। এস।’ শফরী সোমভদ্রকে কোনও প্রশ্ন করিল না, শুধু হাত বাড়াইয়া দিল। সোমভদ্র হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, আর কোনও কথা না বলিয়া শফরীর পাশে পাশে বাড়ির দিকে চলিল।

কয়েক মাস পরে একদিন অপরাহ্ণে শফরী অঙ্গনের দ্বারের কাছে ঘোরাঘুরি করিতেছিল। প্রাতঃকালে সোমভদ্র কয়েকজন বন্ধুর সহিত নদীর পরপারে মৃগয়ায় গিয়াছে, এখনও ফিরিয়া আসে নাই।

দূরে সোমভদ্রকে আসিতে দেখা গেল। তাহার স্কন্ধে ধনু, পৃষ্ঠে মৃত হরিণ-শিশু, মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। শফরী হর্ষসূচক শব্দ করিয়া তীরের মতো তাহার দিকে ছুটিল। পিতামাতা অঙ্গনের বেদিকার উপর বসিয়া ছিলেন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলেন। সোমভদ্র আসিতেছে।

শফরীকে আসিতে দেখিয়া সোমভদ্র দাঁড়াইল; ধনু ও হরিণ মাটিতে নামাইয়া দুই বাহু প্রসারিত করিয়া দিল। শফরী নীড়প্রত্যাশী পাখির মতো তাহার বাহুবেষ্টনের মধ্যে প্রবেশ করিল। বহুদিন পরে সে সোমভদ্রের মুখে সেই পুরাতন অকুণ্ঠ হাসি দেখিয়াছে। এতদিন পরে বিদেশিনী কুহকিনীর মোহজাল ছিঁড়িয়া সোমভদ্র তাহার কাছে ফিরিয়া আসিয়াছে।

শফরী মুখ তুলিয়া ক্ষুধিত চক্ষে সোমভদ্রের পানে চাহিল। সোমভদ্র তাহার অধরে চক্ষে ললাটে চুম্বন করিল। শফরী দ্রুত নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বলিল— ‘বলো ভগিনী— বলো বাহিন— বলে বোন।’

সোমভদ্র বলিল— ‘ভগিনী— বহিন— বোন।’

অতঃপর মন শান্ত হইলে শফরী ধনু ও হরিণ তুলিয়া লইল। দু’জনে গৃহে প্রবেশ করিল।

সোমভদ্র পিতার সম্মুখে গিয়া সলজ্জ অনুযোগের স্বরে বলিল— ‘বাবা, আমাদের বিয়ে দেবে কবে?’

পিতা সচকিতে পুত্র ও কন্যার মুখের পানে চাহিলেন, তারপর কোমল গম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন— ‘এখনি পুরোহিতের কাছে যাচ্ছি।’

সোমভদ্র ও শফরী গৃহের অভ্যন্তরে চলিয়া গেল। পিতামাতা পরস্পরের পানে চাহিয়া হাসিলেন। মাতার চক্ষু আনন্দে বাষ্পাচ্ছন্ন হইল।

তাঁহারাও ভ্রাতা-ভগিনী।

এইবার কাহিনীর স্থান কাল বলা যাইতে পারে। ঘটনাস্থল প্রাচীন মিশর; ঘটনাকাল আজ হইতে অনুমান পাঁচ হাজার বছর পূর্বে। মিশরবাসীরা তখন চক্রযানের ব্যবহার জানিত না, লৌহ তখনও আবিষ্কৃত হয় নাই, অশ্বের সহিত মনুষ্য জাতির পরিচয় ছিল না। যে মানুষগুলির কাহিনী লিখিলাম, তাহারা কিন্তু আমাদের মতোই মানুষ ছিল।

৮ শ্রাবণ ১৩৬৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *