ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – চৈন পরিব্রাজক
সূর্যোদয়ের সঙ্গে পান্থশালার দ্বার খুলিল।
পারসিক সার্থবাহ ইতিপূর্বেই উষ্ট্র গর্দভের পৃষ্ঠে পণ্যভার চাপাইয়া প্রস্তুত ছিল, তাহারা পান্থশালার শুল্ক চুকাইয়া দিয়া বাহির হইয়া পড়িল। তাহারা সারা আর্যাবর্তে পরিভ্রমণ করিবে, পথপার্শ্বে আলস্যবশে বিলম্ব করিলে চলিবে না।
চিত্রক রাত্রে ঘুমায় নাই, কিন্তু সেজন্য তাহার শরীরে তিলমাত্র ক্লান্তিবোধ ছিল না। সে দেখিল, পান্থশালা শূন্য হইয়া গিয়াছে; কিন্তু রট্টার কক্ষদ্বার এখনও রুদ্ধ। রাজকুমারীর এখনও ঘুম ভাঙ্গে নাই। চিত্রক মনে মনে গত রাত্রির অলীক ভয় ভাবনার কথা চিন্তা করিতে করিতে প্রাচীর বেষ্টনের বাহিরে গিয়া দাঁড়াইল।
নবীন রবিকরে উপত্যকা ঝলমল করিতেছে, তৃণ-প্রান্তে তখনও শিশিরবিন্দু শুকায় নাই। হিমার্দ্র মন্থর বায়ু শরীর পুলকিত করিতেছে। চিত্রক উৎফুল্ল নেত্রে চারিদিকে তাকাইয়া দেখিতে লাগিল। আজ তাহার চোখে প্রকৃতির রঙ বদলাইয়া গিয়াছে।
চারিদিকে দেখিতে দেখিতে তাহার চোখে পড়িল, কাল রাত্রে যেখানে সে আগুনের প্রভা দেখিয়াছিল সেইখানে আকাশ ও দিগন্তের সঙ্গমস্থলে অনেক পক্ষী উড়িতেছে; আর কোনও দিকে অমন ঝাঁক বাঁধিয়া পক্ষী উড়িতেছে না। পক্ষীগুলিকে আকাশের পটে সঞ্চরমাণ কৃষ্ণবিন্দুর ন্যায় দেখাইতেছে।
চিত্রক অনেকক্ষণ স্থিরনেত্রে সেই দিকে চাহিয়া রহিল। এই সময় রট্টা বাহিরে আসিয়া তাহার পাশে দাঁড়াইলেন। চিত্রক সহাস্য হৃদ্যতার সহিত তাঁহাকে সম্ভাষণ করিল—
‘রাত্রে সুনিদ্রা হইয়াছিল?’
রট্টা তাহার মুখ হইতে দৃষ্টি সরাইয়া নিম্নে নদীর পানে চাহিলেন, বলিলেন— ‘হাঁ। আপনার?’
চিত্রক অম্লানবদনে বলিল— ‘আমারও। খুব ঘুমাইয়াছি।’
রট্টা নদীর পানে একটু চাহিয়া রহিলেন। আজ তাঁহার মনের ভাব অন্য প্রকার: একটু চাপা, একটু অন্তর্মুখী। চিত্রকের মনোভাব কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। সে অন্তরে এক অপূর্ব প্রীতি-প্রগল্ভ উদ্দীপনা অনুভব করিতেছে; কোনও অজ্ঞাত উপায়ে এই রাজকুমারীর উপর তাহার যেন স্বত্বপূর্ণ অধিকার জন্মিয়াছে। যাহার জন্য জাগিয়া রাত কাটাইতে হয়, তাহার প্রতি সম্ভবত এইরূপ অধিকার-বোধ জন্মে।
সে জিজ্ঞাসা করিল— ‘আপনি কি যাত্রার জন্য প্রস্তুত?’
রট্টা বলিলেন— ‘আমি প্রস্তুত। কিন্তু দু’দণ্ড পরে যাত্রা করিলেও ক্ষতি নাই’— বলিয়া গিরিক্রোড়স্থ নির্জন পান্থশালাটির প্রতি সস্নেহ দৃষ্টিপাত করিলেন।
চিত্রক হাসিয়া উঠিল, বলিল— ‘সত্য বলুন, এই পান্থশালার প্রতি আপনার মমতা জন্মিয়াছে!’
রট্টা স্মিতমুখে বলিলেন— ‘তা জন্মিয়াছে। — ফিরিবার পথে আবার এখানে রাত্রিযাপন করিব।’ মনে মনে ভাবিলেন, ফিরিবার সময় সঙ্গে অনেক লোক থাকিবে…এমন রাত্রি আর হইবে কি?
দুই একটি অন্য কথার পর চিত্রক পশ্চিমদিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিল— ‘দেখুন তো, কিছু দেখিতে পাইতেছেন?’
রট্টা চক্ষের উপর করতলের অন্তরাল রাখিয়া কিছুক্ষণ দেখিলেন— ‘অনেক পাখি উড়িতেছে। কী পাখি?’
চিত্রক বলিল— ‘চিল্ল শকুন—’
রট্টা চকিতে চিত্রকের পানে চাহিলেন। কিন্তু এই সময় তাঁহাদের মনোযোগ অন্য দিকে আকৃষ্ট হইল।
পান্থশালার সম্মুখে ও দুই পাশে পথের তিনটি শাখা এতক্ষণ শূন্য পড়িয়া ছিল; পারসিক সার্থবাহ অনেক পূর্বেই গিরিসঙ্কটের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছিল; এখন উত্তরদিক হইতে কয়েকটি মানুষ আসিতেছে দেখা গেল। তাহাদের সহিত উষ্ট্র গর্দভ নাই, কেবল কয়েকটি মানুষ অদ্ভুত বেশভূষা পরিয়া পৃষ্ঠে ঝোলা বহিয়া পদব্রজে আসিতেছে।
চিত্রক বিস্মিত হইল। প্রাতঃকালে পান্থশালায় যাত্রী আসে না; কোথা হইতে আসিবে? নিকটে কোথাও জনালয় নাই। তবে ইহারা কে?
যাত্রিগণ আরও কাছে আসিলে চিত্রক দেখিল, ইহাদের বেশভূষাই শুধু অদ্ভুত নয়, আকৃতিও অদ্ভুত। ক্ষুদ্রাকৃতি মানুষগুলি; মুখ বর্তুলাকার, হনূ উচ্চ, চক্ষু তির্যক। চিত্রক অনেক দেশ ভ্রমণ করিয়াছে, কিন্তু এরূপ আকৃতির মানুষ কখনও দেখে নাই।
পান্থশালার সম্মুখে আসিয়া পথিকদল দাঁড়াইল। চারিজন পথিক, তন্মধ্যে একজন বৃদ্ধ। মুখে অতি সামান্য শুক্ল শ্মশ্রুগুম্ফ আছে, দেহ কৃশ ও শ্রমসহিষ্ণু; মুখের ভাব দৃঢ়তাব্যঞ্জক। ইনিই এই দলের নেতা সন্দেহ নাই। চিত্রক ও রট্টা পরম কৌতূহলের সহিত ইঁহাদের দর্শন করিতেছিলেন, বৃদ্ধও কিছুক্ষণ তাঁহাদের নিরীক্ষণ করিয়া সাগ্রহে অগ্রসর হইয়া আসিলেন এবং তাঁহাদের সম্ভাষণ করিলেন।
চিত্রক ও রট্টা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর মধুর ও মন্দ্র, কিন্তু তাঁহার ভাষা চিত্রক বুঝি-বুঝি করিয়াও বুঝিতে পারিল না। যেন পরিচিত ভাষা, অথচ উচ্চারণের বিকৃতির জন্য ধরা যাইতেছে না।
চিত্রক রট্টাকে হ্রস্বকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল— ‘কিছু বুঝিতে পারিলেন?’
রট্টা বলিলেন— ‘না। ইহারা বোধহয় চীনদেশীয়।’
চিত্রক তখন বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিল— ‘আপনারা কে? কি চান?’
বৃদ্ধ উত্তর দিলেন, কিন্তু এবারও চিত্রক কিছু বুঝিল না। সে মাথা চুলকাইয়া শেষে জম্বুককে ডাকিল, বলিল— ‘তোমার নূতন অতিথি আসিয়াছে। ইহারা কে?’
জম্বুক নবাগতদের দেখিয়াই বলিল— ‘ইহারা চৈনিক পরিব্রাজক। এইরূপ পথিক মাঝে মাঝে এই পথে আসেন।’
‘ইহাদের ভাষা তুমি বুঝিতে পার?’
‘পারি। ইঁহারা পালি ভাষায় কথা বলেন।’
‘ভাল। জিজ্ঞাসা কর আমাদের নিকট কী চান?’
জম্বুক বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিল এবং তাঁহার উত্তর শুনিয়া বলিল— ‘ভিক্ষু জানিতে চান ইনি রাজকন্যা রট্টা যশোধরা কিনা।’
চিত্রক সন্দেহপূর্ণ নেত্রে ভিক্ষুকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল— ‘এ প্রশ্নের উত্তর পরে দিব, অগ্রে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বল।’
অতঃপর জম্বুকের মধ্যস্থতায় ভিক্ষুর সহিত চিত্রকের নিম্নরূপ প্রশ্নোত্তর হইল।
চিত্রক : আপনি কে? কোথা হইতে আসিতেছেন?
ভিক্ষু : আমার নাম টো ইঙ্। আমরা চীনদেশ হইতে আসিতেছি। ইহারা আমার শিষ্য।
চিত্রক : চীনদেশ কত দূর?
ভিক্ষু : দুই বৎসরের পথ।
চিত্রক : কোথায় যাইবেন?
ভিক্ষু : কুশীনগর যাইব। লোকজ্যেষ্ঠ বুদ্ধ যেখানে দেহরক্ষা করিয়াছিলেন সেই পবিত্র স্থানে দেহরক্ষা করিব এই আশা লইয়া চলিয়াছি। এখন বুদ্ধের ইচ্ছা।
চিত্রক : এইজন্য এতদূর পথ আসিয়াছেন? অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই?
ভিক্ষু : অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই।
চিত্রক : ক্ষমা করুন। আপনারা প্রাতঃকালে এখানে আসিলেন কি করিয়া?
ভিক্ষু : আমরা অহিংসাধর্মী বৌদ্ধ, অস্ত্রধারণ করা আমাদের নিষেধ। কিন্তু এ পথে দস্যু তস্কর আছে; তাই আমরা রাত্রিকালে পথ চলি, দিবাভাগে বিশ্রাম করি। কাল রাত্রে চন্দ্রোদয় হইলে যাত্রা করিয়াছিলাম।
চিত্রক : কোথা হইতে যাত্রা করিয়াছিলেন?
ভিক্ষু : চষ্টন দুর্গ হইতে।
রট্টা এতক্ষণ নীরবে শুনিতেছিলেন; এখন চষ্টন দুর্গের নাম শুনিয়া সাগ্রহে অগ্রসর হইয়া আসিলেন— ‘চষ্টন দুর্গ! তবে আমার পিতার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল!’
ভিক্ষু হাসিলেন; বলিলেন— ‘আমি অনুমান করিয়াছিলাম তুমিই রাজকন্যা রট্টা যশোধরা। …আমি তোমার পিতার নিকট হইতে কিছু বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছি। ভাবিয়াছিলাম কপোতকূটে যাইতে হইবে; ভালই হইল, পথেই তোমার দেখা পাইলাম। এখানে আমার কর্তব্য শেষ করিয়া নিজ কর্মে যাইব।’
রট্টা : পিতা কী বার্তা পাঠাইয়াছেন?
ভিক্ষু : ধর্মাদিত্যের বার্তা সকলের নিকট প্রকাশ্য নয়। কিন্তু যখন দ্বিভাষীর প্রমুখাৎ কথা বলিতে হইতেছে তখন গোপন রাখা অসম্ভব। ভরসা করি ইহাতে ক্ষতি হইবে না।
রট্টার মুখে শঙ্কার ছায়া পড়িয়াছিল, তিনি ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন— ‘না, ক্ষতি হইবে না, আপনি বলুন।’
ভিক্ষু : ধর্মাদিত্য তোমাকে এই বার্তা পাঠাইয়াছেন— তুমি কদাপি চষ্টন দুর্গে আসিও না, আসিলে ঘোর বিপদ ঘটিবে।
রট্টা স্থির বিস্ফারিত নেত্রে ভিক্ষুর পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর স্খলিতস্বরে বলিলেন— ‘বিপদ ঘটিবে! কিরূপ বিপদ?’
ভিক্ষু : যাত্রার পূর্বে ক্ষণেকের জন্য ধর্মাদিত্যের সহিত বিরলে সাক্ষাৎ হইয়াছিল। দুর্গাধিপতি কিরাত অতিশয় দুষ্ট। সে ছলনা দ্বারা তোমাকে চষ্টন দুর্গে লইয়া গিয়া বলপূর্বক বিবাহ করিতে চায়। ধর্মাদিত্যকে সে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে।
রট্টা : পিতাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে!
ভিক্ষু : কারাগারে বন্দী করে নাই। কিন্তু তাঁহার দুর্গ ত্যাগ করিবার অধিকার নাই, পত্র লিখিবারও অধিকার নাই। কপোতকূটে যে পত্র গিয়াছিল তাহা ধর্মদিত্য স্বেচ্ছায় লেখেন নাই।
দীর্ঘ নীরবতার পর রট্টা চিত্রকের দিকে ফিরিলেন। তাঁহার মুখ রক্তহীন, কিন্তু চক্ষে চাপা আগুন। রুদ্ধ স্বরে বলিলেন— ‘কিরাতের যে এতদূর স্পর্ধা হইবে তাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই। এখন কর্তব্য কি?’
চিত্রক কিছুকাল নীরব থাকিয়া ভিক্ষুকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহারাজ কি কোনও অনুজ্ঞা দিয়াছেন?’
ভিক্ষু : না। তিনি কেবল রট্টা যশোধরাকে চষ্টন দুর্গে যাইতে নিষেধ করিয়াছেন। কিন্তু তোমাদের কর্তব্য এই দুর্জনের হস্ত হইতে ধর্মাদিত্যকে উদ্ধার করা। কিরাত মিষ্ট কথায় ধর্মাদিত্যকে মুক্তি দিবে না। তাহার কূট অভিপ্রায় ব্যর্থ হইয়াছে জানিলে সে আরও ক্রুদ্ধ হইবে; হয়তো ধর্মাদিত্যের অনিষ্ট করিতে পারে—
রট্টা ব্যাকুল নেত্রে চিত্রকের পানে চাহিলেন। চিত্রক শান্তস্বরে বলিল— ‘আপনি অধীর হইবেন না, বিপদের সময় বুদ্ধি স্থির রাখিতে হয়। মহাশয়, আপনারা পরিশ্রমে পীড়িত, এখন বিশ্রাম করুন। জম্বুক, তুমি ইঁহাদের পরিচর্যা কর।’
যে ব্যাপারে যুদ্ধবিগ্রহের গন্ধ আছে তাহাতে চিত্রক কখনও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয় না; যুদ্ধের প্রাক্কালে প্রবীণ সেনাপতির ন্যায় সে সমস্ত দায়িত্বভার নিজ হস্তে তুলিয়া লইল।
রট্টার হাত ধরিয়া সে তাঁহাকে কক্ষে আনিয়া বসাইল। রট্টার করতল তুষারের মত শীতল, অধর ঈষৎ কম্পিত হইতেছে। নারী বাহিরে যতই পৌরুষের অভিনয় করুন, অন্তরে তিনি অবলা।
চিত্রক তাঁহার সম্মুখে বসিল এবং ধীরভাবে তাঁহাকে দুই চারিটি প্রশ্ন করিয়া কিরাত ও চষ্টন দুর্গ সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য বিষয় জানিয়া লইল। রট্টাও চিত্রকের সহিত কথা কহিতে কহিতে অনেকটা আত্মস্থ হইলেন।
এখন কর্তব্য কি— এই প্রশ্নের উত্তরে চিত্রক বলিল— ‘দুইটি পথ আছে। কিন্তু আপনি যদি কিরাতকে বিবাহ করিতে সম্মত থাকেন তাহা হইলে কোনও পথেরই প্রয়োজন নাই।’
রট্টা বলিলেন— ‘কিরাতকে বিবাহ করার পূর্বে আমি আত্মঘাতিনী হইব।’
চিত্রক বলিল— ‘তবে দুই পথ। এক, কপোতকূটে ফিরিয়া যাওয়া, সৈন্যদল লইয়া চষ্টন দুর্গ অবরোধ করা। যতদূর জানি সৈন্য সংগ্রহ করিতে সময় লাগিবে। চষ্টন দুর্গের ন্যায় ক্ষুদ্র দুর্গও অন্তত পাঁচশত সৈন্যের কমে অবরোধ করা অসম্ভব।’
রট্টা প্রশ্ন করিলেন— ‘দ্বিতীয় পথ কী?’
চিত্রক বলিল — ‘দ্বিতীয় পথ, স্কন্দগুপ্তের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করা।’
রট্টা উচ্চকিত হইয়া চাহিলেন— ‘স্কন্দগুপ্ত সাহায্য দিবেন?’
চিত্রক বলিল— ‘তিনি ক্ষত্রিয়-চূড়ামণি। তাঁহার শরণ লইলে তিনি অবশ্য সাহায্য করিবেন।’
‘তবে স্কন্দগুপ্তেরই শরণ লইব। তাঁহার নাম শুনিলে কিরাত ভয় পাইবে, বিরুদ্ধতা করিতে সাহস পাইবে না।’
‘তাঁহা সম্ভব। কিন্তু স্কন্দগুপ্তের কাছে কে যাইবে?’
‘আমি যাইব। আপনি সঙ্গে থাকিবেন।’
চিত্রক ক্ষণেক মৌন রহিল, তারপর বলিল— ‘আপনি নারী, লক্ষ লক্ষ সৈন্যপূর্ণ স্কন্ধাবার নারীর উপযুক্ত স্থান নয়। অবশ্য আমি সঙ্গে থাকিলে বিশেষ ভয় নাই, অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় দেখাইয়া স্কন্দের সমীপে পৌঁছিতে পারিব। কিন্তু একটি কথা আছে—’
‘কি কথা?’
‘সকল কথা বলার সময় নাই। কিন্তু আমি যে স্কন্দগুপ্তের দূত একথা তাঁহাকে বলা চলিবে না। আমি বিটঙ্ক রাজ্যেরই একজন সেনানী, এই পরিচয় দিলেই হইবে। স্কন্দ আমাকে চেনেন না, সুতরাং কোনও গোলযোগের সম্ভাবনা নাই।’
‘কিন্তু-কেন?’
‘ওকথা এখন জিজ্ঞাসা করিবেন না। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিব না।’
রট্টা বলিলেন— ‘আর্য চিত্রক, চিত্রক, আমি সম্পূর্ণ আপনার অধীন। আপনি যাহা বলিবেন তাহাই করিব।’
চিত্রক বলিল— ‘আমি আপনার দাস। আপনার মঙ্গলের জন্য যাহা কর্তব্য তাহা করিব। স্কন্দগুপ্তের শরণ লওয়াই স্থির?’
‘হাঁ।’
চিত্রক উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল— ‘তবে উঠুন। অবিলম্বে যাত্রা করিতে হইবে।’ দ্বার পর্যন্ত গিয়া সে ফিরিয়া দাঁড়াইল— ‘একটা কথা। আপনি এমনভাবে বস্ত্র পরিধান করুন যাহাতে আপনাকে কিশোরবয়স্ক পুরুষ বলিয়া মনে হয়। ইহা প্রয়োজন।’ বলিয়া তাড়াতাড়ি কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।
রট্টার মুখে ধীরে ধীরে অরুণাভা ফুটিয়া উঠিল। তিনি কক্ষের দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া নূতনভাবে বেশ-প্রসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন।
চিত্রক বাহিরে আসিয়া দেখিল, পাশেই একটি কক্ষে চৈন ভিক্ষুগণ আশ্রয় লইয়াছেন; জম্বুক তাঁহাদের পরিচর্যায় নিযুক্ত আছে। চিত্রক তাঁহাদের নিকটে গিয়া বলিল— ‘জম্বুক, ভিক্ষু মহাশয়কে আমি একটি প্রশ্ন করিতে ইচ্ছা করি— মহারাজ স্কন্দগুপ্ত সম্বন্ধে তিনি কিছু জানেন কি?’
প্রশ্ন শুনিয়া ভিক্ষু বলিলেন— ‘জানি। স্কন্দগুপ্ত হূণ দলনের জন্য আসিয়াছেন। নিকটেই আছেন।’
চিত্রক : কোথায় আছেন?
ভিক্ষু; এই উপত্যকার পশ্চিমে যে পর্বতশ্রেণী আছে তাহা পার হইলে আর একটি বৃহত্তর উপত্যকা আছে; স্কন্দগুপ্ত তথায় সৈন্য স্থাপন করিয়াছেন।
চিত্রক : একথা আপনি কিরূপে জানিলেন?
ভিক্ষু : চষ্টন দুর্গে শুনিয়াছি। জনৈক সৈনিক মৃগয়ায় গিয়াছিল, সে দেখিয়া আসিয়াছে। চিত্রক তখন ভিক্ষুকে সাধুবাদ করিয়া জম্বুককে আড়ালে ডাকিয়া আনিল, বলিল— ‘জম্বুক, আমরা স্থির করিয়াছি স্কন্দগুপ্তের শিবিরে যাইব।’
জম্বুক বলিল— ‘সে ভাল কথা।’
চিত্রক বলিল— ‘তোমাকে কপোতকূটে যাইতে হইবে। মন্ত্রী চতুর ভট্টের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সকল কথা তাঁহাকে বলিবে। তারপর তিনি যাহা ভাল হয় করিবেন।’
‘যথা আজ্ঞা।’
‘এখন আমাদের অশ্ব আনিতে বল। এই বেলা যাত্রা করিলে সূর্যাস্তের পূর্বে স্কন্দগুপ্তের শিবিরে পৌঁছিতে পারিব।’
জম্বুক অশ্ব আনিতে গেল। চিত্রক ফিরিয়া গিয়া রট্টার দ্বারে করাঘাত করিল। রট্টা দ্বার খুলিয়া নতচক্ষে সম্মুখে দাঁড়াইলেন।
চিত্রক দেখিল, বেশ পরিবর্তন করিয়া রট্টাকে অন্যরূপ দেখাইতেছে; প্রথম যেদিন সে রট্টাকে দেখিয়াছিল সে দিনের মতই তাঁহাকে সহসা নারী বলিয়া চেনা যায় না, ভস্মের তলে রূপের আগুন চাপা পড়িয়াছে। কিন্তু মস্তকে শিরস্ত্রাণ নাই, বেণী শোভা পাইতেছে। তাহার কী হইবে?
চিত্রক নিজ কটিবন্ধ খুলিয়া রট্টার মাথায় উষ্ণীষ বাঁধিয়া দিল; উষ্ণীষের অন্তরালে বেণীবন্ধ ঢাকা পড়িল। চিত্রক বিচারকের দৃষ্টিতে রট্টার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া গম্ভীরমুখে বলিল— ‘এতক্ষণে ছদ্মবেশ সন্তোষজনক হইয়াছে। স্কন্দের সম্মুখে না পৌঁছানো পর্যন্ত ছদ্মবেশ আবশ্যক। যুদ্ধক্ষেত্র কিরূপ স্থান তাহা আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি। তাই এই সাবধানতা।’
রট্টার চোখে জল আসিল; তিনি অবরুদ্ধ স্বরে বলিলেন— ‘স্ত্রীজাতি বড় জঞ্জাল।’
চিত্রক মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘না, পুরুষ বড় জঞ্জাল।’