মরু ও সঙ্ঘ
মধ্য-এশিয়ার দিক্সীমাহীন মরুভূমির মাঝখানে বালু ও বাতাসের খেলা। বিরামহীন অস্থির চঞ্চল খেলা। রাত্রি নাই, দিন নাই, সমগ্র মরুপ্রান্তর ব্যাপিয়া এই খেলা চলিতেছে।
খেলা বটে, কিন্তু নিষ্ঠুর খেলা; অবোধ শিশুর খেলার মতো প্রাণের প্রতি মমতাহীন ক্রূর খেলা। ক্ষুদ্র মানুষের সৃষ্ট ক্ষুদ্র নিয়মের এখানে মূল্য নাই; জীবনের কোনও মূল্য নাই। দয়া করুণা এখানে আপন শক্তিহীন ক্ষুদ্রতায় ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে।
প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় কোনও বিধি-বিধান নাই। কখনও পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া বায়ু ও বালুর দুর্লক্ষ্য ষড়যন্ত্রে একটি তৃণশ্যামল নির্ঝর-নিষিক্ত ওয়েসিস ধীরে ধীরে মরুভূমির জঠরস্থ হইতেছে; আবার কখনও একটি দিনের প্রচণ্ড বালু-ঝটিকায় তেমনই শ্যামল লোকালয়পূর্ণ ওয়েসিস বালুস্তূপের গর্ভে সমাহিত হইতেছে। দূরে বহু দূরে হয়তো আর একটি নূতন ওয়েসিসের সূচনা হইতেছে। এমনই অর্থহীন প্রয়োজনহীন ধ্বংস ও সৃজনের লীলা নিরন্তর চলিতেছে।
এই মরু-সমুদ্রের মাঝখানে ক্ষুদ্র একটি হরিদ্বর্ণ দ্বীপ— একটি ওয়েসিস। দূর হইতে দেখিলে মনে হয়, তৃষ্ণাদীর্ণ ধূসর বালুপ্রান্তরের উপর এক বিন্দু নিবিড় শ্যামলতা আকাশ হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে। কাছে আসিলে দেখিতে পাওয়া যায়, শতহস্তব্যাসবিশিষ্ট একটি শষ্পাঞ্চিত স্থান কয়েকটি খর্জুর বৃক্ষের ধ্বজা উড়াইয়া এখনও মরুভূমির নির্দয় অবরোধ প্রত্যাহত করিতেছে। খর্জুর-ছায়ার অন্তরাল দিয়া একটি প্রস্তরনির্মিত সঙ্ঘারামের অর্ধপ্রোথিত ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখা যায়। মধ্য-এশিয়ার মরুভূমিতে প্রাকৃতিক নির্মমতার কেন্দ্রস্থলে মহাকারুণিক বুদ্ধ তথাগতের সঙ্ঘারাম মাথা জাগাইয়া আছে।
একদিন এই স্থান জনকোলাহলমুখরিত সমৃদ্ধ জনপদ ছিল— দশ ক্রোশ স্থান ব্যাপিয়া নগর হাট উদ্যান চৈত্য বিরাজিত ছিল। শত ক্রোশ দূর হইতে সার্থবাহ বণিক উষ্ট্রপৃষ্ঠে পণ্য লইয়া মরুবালুকার উপর কঙ্কাল-চিহ্নিত পথ ধরিয়া এখানে উপস্থিত হইত। ক্ষুদ্র রাজ্যে একজন ক্ষুদ্র শাসনকর্তাও ছিল; কিন্তু এখন আর কিছু নাই। এমন কি, যে কঙ্কালশ্রেণী মরুপথে বহির্জগতের সহিত সংযোগ রক্ষা করিত, তাহাও লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
কিঞ্চিদূন পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বালু ও বাতাস এই স্থানটিকে লইয়া নৃশংস খেয়ালের খেলা আরম্ভ করিয়াছিল। মরু এবং ওয়েসিসের সীমান্ত চিহ্নিত করিয়া খর্জুর বৃক্ষের সারি চক্রাকার প্রাকারের মতো ওয়েসিসকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে; এই সীমান্তভূমির উপর সূক্ষ্ম বালুকার পলি পড়িতে লাগিল। কেহ লক্ষ্য করিল না। দুই-তিন বৎসর কাটিল। সহসা একদিন একটি উৎসের জলধারা শুকাইয়া গেল। লক্ষ্য করিলেও কেহ গ্রাহ্য করিল না। আরও অনেক উৎস আছে।
দশ বৎসর কাটিল। তারপর একদিন সকলে সত্রাসে হৃদয়ঙ্গম করিল— ওয়েসিস সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে; অলক্ষিতে মরুভূমি অনেকখানি সীমানা গ্রাস করিয়া লইয়াছে।
অতঃপর ফাঁসির দড়ি যে-ভাবে ধীরে ধীরে কণ্ঠ চাপিয়া প্রাণবায়ু রোধ করিয়া ধরে, তেমনই ভাবে মরুভূমি ওয়েসিসকে চারিদিক হইতে চাপিয়া ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর করিয়া আনিতে লাগিল। প্রথমে আহার্য-পানীয়ের অপ্রতুলতা, তারপর বসবাসের স্থানাভাব হইল। যাহারা পারিল পলায়ন করিল; উষ্ট্র-গর্দভপৃষ্ঠে যথাসম্ভব ধনসম্পত্তি লইয়া অন্য বাসস্থানের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। যাহারা তাহা পারিল না, তাহারা শঙ্কাকুলচিত্তে মরুর পানে তাকাইয়া অনিবার্য পরিসমাপ্তির জন্য প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। জনপদের জনসংখ্যা অর্ধেকের অধিক কমিয়া গেল।
মরুভূমির ত্বরা নাই, ব্যস্ততা নাই। নাগ-কবলিত ভেকের ন্যায় ওয়েসিস অল্পে অল্পে মরুর জঠরস্থ হইতে লাগিল।
এক পুরুষ কাটিয়া গেল। যাহারা যুবক ছিল তাহারা এই অনির্বাণ আতঙ্ক বুকে লইয়া বৃদ্ধ হইল। কিন্তু সৃষ্টির বিরতি নাই; ধ্বংসের করাল ছায়ার তলে নবতর সৃষ্টি জন্মগ্রহণ করিয়া বর্ধিত হইয়া উঠিতে লাগিল।
একদিন গ্রীষ্মের তাম্রতপ্ত দ্বিপ্রহরে দিগন্তরাল হইতে কৃষ্ণবর্ণ আঁধি উঠিয়া আসিল। মরুভূমির এই আঁধির সহিত তুলনা করিতে পারি পৃথিবীতে এমন কিছু নাই। মহাপ্রলয়ের দিনে শুষ্ক জীর্ণ পৃথিবী বোধ হয় এমনই উন্মত্ত বালু-ঝটিকার আবর্তে চূর্ণ হইয়া শূন্যে মিলাইয়া যাইবে।
দুই দিন পরে আকাশ পরিষ্কার হইয়া প্রখর সূর্য দেখা দিল। বিজয়িনী প্রকৃতির সগর্ব হাসির আলোয় ওয়েসিস উদ্ভাসিত হইল। দেখা গেল ওয়েসিস আর নাই, পর্বতপ্রমাণ বালুকার তলায় চাপা পড়িয়াছে; কেবল উচ্চ ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘারামের অর্ধনিমজ্জিত চূড়া ঘিরিয়া কয়েকটি খর্জুর বৃক্ষ শোকার্তভাবে দাঁড়াইয়া এই সমাধিস্থল পাহারা দিতেছে। মানুষের চিহ্নমাত্র কোথাও নাই।
দ্বিপ্রহরে সঙ্ঘের উপরিতলের একটি বালু-সমহিত গবাক্ষ হইতে অতি কষ্টে বালুক সরাইয়া বিবরবাসী সরীসৃপের ন্যায় দুইটি প্রাণী বাহির হইল। মানুষই বটে; একজন বৃদ্ধ, দ্বিতীয়টি বলিষ্ঠদেহ যুবা বলিয়া প্রতীয়মান হয়। যুবা বৃদ্ধিকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল। তারপরে উভয়ে বহুক্ষণ গবাক্ষের বাহিরে বালুর উপর পড়িয়া দীর্ঘ শিহরিত প্রশ্বাসে মুক্ত আকাশের প্রাণদায়ী বায়ু গ্রহণ করিতে লাগিল। ক্রমে তাহাদের তৃষ্ণা-বিদীর্ণ অধরোষ্ঠে কালিমালিপ্ত মুখে মানুষী ভাব ফিরিয়া আসিল। চিনিবার মতো কেহ থাকিলে চিনিতে পারিত, একজন সঙ্ঘ-স্থবির পিথুমিত্ত, দ্বিতীয় ভিক্ষু উচণ্ড। বালু-ঝটিকা আরম্ভ হইবার সময় সঙ্ঘের অন্যান্য সকলেই ভীত হইয়া বাহিরে আসিয়াছিল, তাহারা কেহ বাঁচে নাই; কেবল এই দুই জন সঙ্ঘের দ্বিতলস্থ পরিবেণে অবরুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন, দৈবক্রমে রক্ষা পাইয়াছেন।
বালুকার স্তূপ ঢালু হইয়া সঙ্ঘের গাত্র হইতে নামিয়া গিয়াছে। উভয়ের বায়ুক্ষুধা কথঞ্চিৎ প্রশমিত হইলে তাঁহারা টলিতে টলিতে নিম্নাভিমুখে অবতরণ করিতে লাগিলেন। বাঁচিতে হইলে জল চাই। সঙ্ঘের পাদমূলে খর্জুরকুঞ্জের মধ্যে একটি প্রস্তর-গুহা হইতে প্রস্রবণ নির্গত হইত, সেখানে দুই জনে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, প্রস্রবণের মুখ বুজিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু বালুবন্ধ উৎসের স্বতঃপ্রবাহ রোধ করিতে পারে নাই; গুহামুখের বালুকা সিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। আরও দেখিলেন, সেই সিক্ত সিকতার উপর— দুইটি মানবশিশু। প্রথমটি পাঁচ-ছয় বৎসরের বালক, নিদ্রিত অথবা মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে; তাহার মেরুসংলগ্ন জঠর ধীরে ধীরে উঠিতেছে পড়িতেছে। দ্বিতীয়টি অনুমান দেড় বৎসরের একটি বালিকা। শুভ্র নগ্নদেহে একাকিনী খেলা করিতেছে, খর্জুর বৃক্ষের চ্যুত পক্ক ফল কুড়াইয়া খাইতেছে, আর নীল নেত্র মেলিয়া আপন মনে কলস্বরে হাসিতেছে। মৃত বা জীবিত আর কেহ কোথাও নাই। প্রকৃতির দুরবগাহ রহস্য। প্রভঞ্জনের ধ্বংস-তাণ্ডবের মধ্যে এই দুইটি সুকুমার জীবন-কণিকা কি করিয়া রক্ষা পাইল?
দুই ভিক্ষু প্রথমে বালু খনন করিয়া জল বাহির করিলেন। একদণ্ড কাল অঙ্গুলি সাহায্যে গুহামুখ খনন করিবার পর উৎসের পথ মুক্ত হইল— উভয়ে অঞ্জলি ভরিয়া জল পান করিলেন।
প্রচণ্ড সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলিয়া পড়িয়াছে— খর্জুর বৃক্ষের ছায়া পূর্ব দিগন্তের দিকে দীর্ঘতর অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কোন্ অনাদি রহস্যের ইঙ্গিত জানাইতেছে। সঙ্ঘ-স্থবির পিথুমিত্ত একবার এই সমাধিস্তূপের চারিদিকে চাহিলেন; ঊর্ধ্বে সঙ্ঘের বালু-মগ্ন শিখর, নিম্নে তরঙ্গায়িত বালুকারশি দিক্প্রান্তে মিশিয়াছে। তাঁহার শীর্ণ গণ্ড বাহিয়া অশ্রুর দুইটি ধারা গড়াইয়া পড়িল। শিশু দুটিকে নিজ ক্রোড়ে টানিয়া লইয়া স্খলিত কণ্ঠে বলিলেন, ‘তথাগত!’
অতঃপর মরুভূমির একান্ত নির্জনতার মাঝখানে, বুদ্ধ তথাগতের সঙ্ঘ-ছায়ায় এই চারিটি মানবজীবনের ক্রিয়া আবার নূতন করিয়া আরম্ভ হইল। স্থবির পিথুমিত্ত বালকের নাম রাখিলেন নির্বাণ। বালিকার নাম হইল— ইতি।
মাধবী পৌর্ণমাসীর প্রভাতে স্থবির পিথুমিত্ত সঙ্ঘের এক প্রকোষ্ঠে বসিয়া পাতিমোক্ষ পাঠ করিতেছিলেন। সঙ্ঘের একমাত্র শ্রমণ, ভিক্ষু উচণ্ড তাঁহার সম্মুখে মেরু-যষ্টি ঋজু করিয়া স্থিরভাবে বসিয়াছিলেন। শ্রোতা কেবল তিনিই।
দীর্ঘ পঞ্চদশ বৎসর উভয়ের দেহেই কাল-করাঙ্ক চিহ্নিত করিয়া দিয়াছে। সঙ্ঘ-স্থবিরের বয়স এখন ন্যূনকল্পে সত্তর বৎসর। মুণ্ডিত মস্তকে মেদহীন চর্মের আবরণতলে করোটির আকৃতি সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, দেখিয়া শুষ্ক দাড়িম্বফলের ন্যায় মনে হয়। চক্ষুতারকা বর্ণহীন, দৃষ্টি নিষ্প্রভ— যেন মরুভূমির উষ্ণ নিশ্বাসে চোখের জ্যোতি নির্বাপিত হইয়াছে। তবু, এই জরা-বিশীর্ণ মূর্তির চারি পাশে জীবনব্যাপী সচ্চিন্তা ও শুচিতার মাধুর্য একটি সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় শ্রী রচনা করিয়া রাখিয়াছে। ত্রিতাপ তাঁহার চিত্তকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।
ভিক্ষু উচণ্ডেরও যৌবন আর নাই; বয়ঃক্রম অনুমান পয়তাল্লিশ বৎসর। কিন্তু দেহ এখনও সবল ও দৃঢ়। সমান্তরালরেখা-চিহ্নিত ললাট-তটে ঘন রোমশ ভ্রূ দুই-একটি পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। চোখের দৃষ্টি কঠোর ও বৈরাগ্যব্যঞ্জক। তাঁহাকে দেখিয়া মনে হয়, প্রকৃতির সহিত নিরন্তর যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হইয়াও তিনি পরাভব স্বীকার করেন নাই; বিদ্রোহীর সদা-জাগ্রত যুযুৎসা তাঁহার ছিন্ন গলিত চীবর ভেদ করিয়া বাহির হইতেছে।
পাতিমোক্ষ পাঠ শেষ হইল। নিদান হইতে অধিকরণ শমথ পর্যন্ত বিবৃত করিয়া পরিশেষে স্থবির বলিলেন, ‘হে মাননীয় ভিক্ষু, আপনার নিকট পারাজিক সংঙ্ঘাদিশেষ প্রভৃতি ধর্ম আবৃত্তি করিলাম। শেষবার প্রশ্ন করিতেছি, যদি কোনও পাপ করিয়া থাকেন খ্যাপন করুন, আর যদি পাপ না করিয়া থাকেন, নীরব থাকুন।’
দীর্ঘ পাতিমোক্ষ পাঠ শুনিতে শুনিতে ভিক্ষু উচণ্ড বোধ করি আত্মস্থ হইয়া পড়িয়াছিলেন, অথবা বিষয়ান্তরে তাঁহার মন সংক্রামিত হইয়াছিল; স্থবিরের শেষ জিজ্ঞাসা কর্ণে যাইতেই তিনি চকিত হইয়া একবার নিজের উভয় পার্শ্বে দৃষ্টিপাত করিলেন। তাঁহার ললাটের ভ্রূকুটি যেন ঈষৎ গভীরতর হইল। ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া তিনি মৌন হইয়া রহিলেন।
স্থবির তখন কহিলেন, ‘হে মাননীয় ভিক্ষু, আপনার মৌনভাব দেখিয়া জানিলাম আপনি পরিশুদ্ধ আছেন।’ মনে হইল এই বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলেন।
অনুষ্ঠান শেষ হইল।
দিবা তখনও প্রথম প্রহর অতীত হয় নাই। অলিন্দপথে তির্যক সূর্যরশ্মি প্রবেশ করিয়া কক্ষের ম্লান ছায়াচ্ছন্নতা দূর করিয়াছে। উভয়ে এই তরুণ রবিকর অনুসরণ করিয়া বাহিরের দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। স্বর্ণাভ সিকতার পটভূমিকায় কয়েকটি আন্দোলিত খর্জুরশীর্ষ চোখে পড়িল।
উভয়ে গাত্রোত্থান করিলেন।
সহসা উচণ্ড কহিলেন, ‘থের, একটি কথা আপনাকে বলিবার অভিলাষ করিয়াছি। নির্বাণকে উপসম্পদা দান করা কর্তব্য; তাহার বিংশ বর্ষ বয়ঃক্রম হইয়াছে।’
স্থবির উচণ্ডের মুখের পানে চাহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘নির্বাণের যথার্থ বয়ঃক্রম বিংশ বর্ষ কি না তাহা আমরা জ্ঞাত নাহি।’
উচণ্ডের কণ্ঠস্বরে ঈষৎ অধীরতা প্রকাশ পাইল, তিনি কহিলেন, ‘এস্থলে অনুমানই যথেষ্ট।’
স্থবির ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন, ‘নির্বাণ কি উপসম্পদা লইতে ইচ্ছুক?’
উচণ্ড কহিলেন, ‘অবশ্য ইচ্ছুক। সঙ্ঘের উপাসকররূপে সে এত কাল আমার নিকট শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। সঙ্ঘেই সে পালিত ও বর্ধিত, সঙ্ঘ ভিন্ন তাহার স্থান কোথায়?’
স্থবির আবার রবিকরোজ্জ্বল বহিঃপ্রকৃতির পানে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন, শেষে বলিলেন, ‘ভাল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা যাউক।’ আবার মনে হইল একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল।
উচণ্ড তীক্ষ্ণ চক্ষে স্থবিরের পানে চাহিলেন; একবার যেন কিছু বলিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই বাক্ সংযত করিয়া বলিলেন, ‘উত্তম! তাহাকে আপনার নিকট ডাকিয়া আনিতেছি।’ বলিয়া তিনি সঙ্ঘের বাহিরে চলিলেন।
গত পঞ্চদশ বৎসরে বিহারের বহিরাকৃতির কোনও পরিবর্তন হয় নাই, বালুঝটিকার পর যেমন অর্ধপ্রোথিত ছিল তেমনই আছে। যে বিরাট বালুস্তূপ তাহাকে আবৃত করিয়াছিল তাহা হইতে মুক্ত করা দুই জন মানুষের সাধ্য নয়। উপরিতলের কয়েকটি প্রকোষ্ঠ কোনক্রমে পরিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহাতেই ভিক্ষুদ্বয় শিশু দুইটিকে লইয়া আশ্রয় লইয়াছিলেন। সঙ্ঘের নিম্নতল চিরতরে অবরুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল।
সঙ্ঘ হইতে অবতরণ করিয়া উচণ্ড খর্জুরকুঞ্জের দিকে চলিলেন।
খর্জুরকুঞ্জের ছায়ায় গুহানিঃসৃত প্রস্রবণের মন্দ স্রোত স্বচ্ছ ধারায় বহিয়া গিয়াছে। কাকচক্ষু জল, মাত্র বিতস্তিপ্রমাণ গভীর, নিম্নে বালুকার আকুঞ্চিত স্তর দেখা যাইতেছে।
গুহামুখের সন্নিকটে নির্বাণ অধোমুখে শয়ান হইয়া মৃদুপ্রবাহিত জলধারার প্রতি চাহিয়া ছিল, দুই বাহুর উপর চিবুক ন্যস্ত করিয়া অন্যমনে কি জানি চিন্তা করিতেছিল। খর্জুরশাখার রন্ধ্রচ্যুত এক ঝলক রৌদ্র তাহার পৃষ্ঠের উপর পড়িয়া তাহার স্বর্ণাভ দেহবর্ণকে মার্জিত ধাতুফলকের ন্যায় উজ্জ্বল করিয়া তুলিতেছিল। ঋজু নাতিমাংসল দেহে কেবল একটি শুভ্র বহির্বাস, কটি হইতে জানু পর্যন্ত আবৃত। উন্মুক্ত স্কন্ধ বাহু ও বক্ষ দৃঢ় পেশীবদ্ধ। মস্তকের কৃষ্ণ কেশ সর্পশিশুর মতো মুখমণ্ডলকে বেষ্টন করিয়া আছে। যৌবনের নবারুণ ঊষালোকে নির্বাণের দেহকান্তি দেখিয়া গ্রীক ভাস্করের রচিত ভাস্কর-দেবতার মূর্তি মনে পড়ে। কিন্তু তাহার মুখে ভাস্কর-দেবতার বিজয়দৃপ্ত গর্বের ব্যঞ্জনা নাই; নবযৌবনের স্বাভাবিক পৌরুষের সহিত চিৎ-শক্তির এক অপরূপ করুণ মাধুর্য মিশিয়াছিল, গ্রীক ভাস্কর এই অপূর্ব সংমিশ্রণ পরিকল্পনা করিতে পারিতেন না।
প্রস্রবণের দিকে চাহিয়া নির্বাণ চিন্তা করিতেছিল। কি গহন দুরবগাহ তাহার চিন্তা সে নিজেই জানে না। নিষ্পলক দৃষ্টি অগভীর জলের স্তর ভেদ করিয়া নিম্নে, আরও নিম্নে, পৃথিবীর কেন্দ্রগুহায় যেখানে কেবল নিরাসক্ত প্রাণধর্মের ক্রিয়া চলিতেছে— বোধ করি সেইখানেই উপনীত হইয়াছিল। বহিঃপ্রকৃতির প্রতি তাহার মন ছিল না। কিন্তু তথাপি, এই অন্তর্মুখী তন্ময়তার মধ্যেও তাহার চক্ষু এবং শ্রবণেন্দ্রিয় অলক্ষিতে সতর্ক উৎকর্ণ হইয়া ছিল।
সহসা তাহার বক্ষ বিস্ফারিত করিয়া একটি গভীর নিশ্বাস নির্গত হইল।
কিছু দিন যাবৎ নির্বাণের মনে এক ভীষণ বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে। যাহারা শিশুকাল হইতে একসঙ্গে বর্ধিত হয়, তাহাদের মনে পরস্পর সম্বন্ধে প্রায় কোনও মোহ থাকে না; নির্বাণের মনেও ইতি সম্বন্ধে মোহ ছিল না। বরং ইতি স্ত্রীসুলভ নমনীয়তায় নির্বাণকে পুরুষত্ব ও বয়োজ্যেষ্ঠতার মর্যাদা দিয়া সসম্ভ্রমে তাহার পিছন পিছন ঘুরিয়াছে। দু’জনে কলহ করিয়াছে, আবার গলা জড়াজড়ি করিয়া খেলা করিয়াছে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে ইতির দেহে যৌবনের মুকুলোদগম হইয়াছে, আয়ত নীল চোখে সৃষ্টির অনাদি কুহক ফুটিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু নির্বাণের মনে ভাবান্তর আসে নাই। ইতি যে নারী এ অনুভূতি তাহার অন্তরকে স্পর্শ করে নাই। এইভাবে পঞ্চদশ বর্ষ কাটিয়াছে। তারপর সহসা একদিন নির্বাণের মনের কৌমার্য পরিণত ফলের প্রান্ত হইতে শীর্ণ পুষ্পদলের মতো খসিয়া গেল।
সেদিন দ্বিপ্রহরে নির্বাণ একাকী খর্জুরকুঞ্জে দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বমুখে একটা ভ্রমরের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিতেছিল। ভ্রমরটা প্রতি বৎসর এই সময় কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, বহু দূরান্তর হইতে বোধ হয় বাতাসের মুখে বার্তা পায়— মরুর খর্জুরশাখায় ফুল ধরিয়াছে। কৃষ্ণকায় ভ্রমর, পাখায় রামধনুর বর্ণ; সে গভীর গুঞ্জন করিয়া এক পুষ্পমঞ্জরী হইতে অন্য পুষ্পমঞ্জরীতে উড়িয়া যাইতেছে, নিঃশব্দে পুষ্পপাত্রে সঞ্চিত রস পান করিতেছে, আবার উড়িয়া যাইতেছে। নির্বাণ উজ্জ্বল কৌতূহলী চক্ষে মুগ্ধ হইয়া এই দৃশ্য দেখিতেছিল।
সহসা ইতি পিছন হইতে আসিয়া দুই বাহু দ্বারা নির্বাণের গলা জড়াইয়া ধরিল; উত্তেজনা-সংহত স্বরে তাহার কর্ণে বলিল, ‘নির্বাণ, একটা জিনিস দেখিবে?’
ইতি স্বচ্ছন্দচারিণী, মরুভূমির যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়ায়; কোথায় বালুর তলে শাখাপত্রহীন মূল বা কন্দ লুক্কায়িত আছে, আহরণ করিয়া আনে। মরুর নিষ্প্রাণ বক্ষে যাহা কাহারও চক্ষে পড়ে না, তাহা ইতির চক্ষে পড়ে।
নির্বাণ ভ্রমরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল, ‘কি?’
ইতি দুই হস্তে সবলে তাহার মুখ নিজের দিকে ফিরাইল, বলিল, ‘এস, দেখিবে এস।’ বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া শবরীর মতো নিঃশব্দ পদে লইয়া চলিল। নির্বাণ দেখিল, আনন্দ-উদ্দীপনায় তাহার দুই চক্ষু নৃত্য করিতেছে।
ওয়েসিসের সীমান্ত পার হইয়া তাহারা মরুভূমির উপর বহুদূর গমন করিল। মধ্যাকাশে জ্বলন্ত সূর্য, চারিদিকে কোটি কোটি বালুকণায় তাহার তেজ প্রতিফলিত হইতেছে। দু’জনে নীরবে চলিয়াছে, মাঝে মাঝে ইতি নির্বাণের মুখের পানে প্রোজ্জ্বল চক্ষু তুলিয়া চুপি চুপি দু’-একটি কথা বলিতেছে— যেন জোরে কথা বলিলেই তাহার রহস্যময় দ্রষ্টব্য বস্তু মায়ামৃগের ন্যায় মুহূর্তে অন্তর্হিত হইবে।
প্রায় এক ক্রোশেরও অধিক পথ চলিবার পর সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড বালিয়াড়ি পড়িল। সেই বালিয়াড়ির কূর্মপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া ইতি দিগন্তের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘ঐ দেখ।’
অঙ্গুলির নির্দেশ অনুসরণ করিয়া নির্বাণ সহসা বিস্ময়ে নিস্পন্দ হইয়া গেল। দূরে দিগন্তরেখা যেখানে আকাশে মিশিয়াছে সেইখানে একটি হরিদ্বর্ণ উদ্যান— শ্যামল তরুশ্রেণী বাতাসে আন্দোলিত হইতেছে, তৃণপূর্ণ প্রান্তরে মেষ-ছাগ চরিতেছে; এমন কি, আকাশে নানা আকৃতির পাখি উড়িতেছে, তাহাদের ক্ষুদ্র দেহ সঞ্চরমাণ বিন্দুর মতো দেখা যাইতেছে। একটি নদী এই নয়নাভিরাম শ্যামলতার বুক চিরিয়া খরধার তরবারির মতো পড়িয়া আছে।
বিস্ময়ের প্রথম অভিভূতির পর প্রতিক্রিয়া আসিল, নির্বাণ উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। ইতি অপেক্ষা তাহার জ্ঞান বেশি।
ইতি কিন্তু উত্তেজনার আতিশয্যে নির্বানের গলা বাহুবেষ্টিত করিয়া প্রায় ঝুলিয়া পড়িল, মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ‘দেখিতেছ? নির্বাণ, দেখিতেছ? কি সুন্দর! চল, আমরা দুইজনে ঐখানে চলিয়া যাই। আর কেহ থাকিবে না, শুধু তুমি আর আমি। — চল, চল নির্বাণ!’
স্মিতমুখে নির্বাণ তাহার পানে চাহিল। ইতির পলাশরক্ত অধর নির্বাণের এত নিকটে আসিয়াছিল যে, কিছু না বুঝিয়াই সে নিজ অধর দিয়া তাহা স্পর্শ করিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, হৃৎপিণ্ডের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করিয়া উঠিল। দেহের অভ্যন্তর হইতে স্নায়ুর সীমান্ত পর্যন্ত একটা অনির্বচনীয় তীক্ষ্ণ অনুভূতি অসহ্য হর্ষ-বেদনায় তাহাকে নিপীড়িত করিয়া তুলিল। সে থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
প্রথম চুম্বনের স্পর্শে ইতি দংশনোদ্যতা সর্পিণীর মতো গ্রীবা পশ্চাতে আকর্ষণ করিয়া নির্বাণের মুখের পানে চাহিল। মনে হইল তাহার নীল নেত্র হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ হইতেছে। ক্ষণকাল এইভাবে থাকিয়া সে দুরন্ত ঝড়ের মতো আবার নির্বাণের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। একবার দুইবার, অগণিত বার নির্বাণের অধর চুম্বন করিতে করিতে অবশেষে যেন নিজের দুর্জয় আবেগের নিকট পরাজিত হইয়া শিথিল দেহে অবনত মুখে বালুর উপর বসিয়া পড়িল। শ্রান্ত ঝড়ের অবসন্ন আক্ষেপের মতো তাহার বক্ষ হইতে এক প্রকার অবরুদ্ধ আর্তশ্বাস বাহির হইতে লাগিল।
নির্বাণও জানু মুড়িয়া তাহার পাশে বসিয়া পড়িল। অকস্মাৎ এ কি হইয়া গেল! এই অজ্ঞাতপূর্ব অচিন্তনীয় আবির্ভাবের সম্মুখে উভয়ে যেন বিমূঢ় হইয়া রহিল।
বহুক্ষণ দুইজনে এইভাবে অগ্নিবর্ষী আকাশের তলে বসিয়া রহিল। তারপর শুষ্ক তপ্ত চক্ষু তুলিয়া দিগন্তের পানে চাহিল। শ্যামল উপবন তখন অদৃশ্য হইয়াছে।
অস্ফুট স্বরে নির্বাণ বলিল, ‘মরীচিকা।’
সেই দিন হইতে নির্বাণের সহিত ইতির সহজ সরল সখ্যের অবসান হইল; নির্বাণ যেন ইতিকে ভয় করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল। তাহাকে দূর হইতে দেখিয়া সে সঙ্কুচিত হইয়া উঠে, তাহার সহিত কথা বলিতে রসনা জড়িত হয়, মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠে; অথচ অন্তরের অন্তস্থল হইতে একটা দুর্নিবার আকর্ষণ তাহাকে ইতির দিকে টানিতে থাকে। ইতির তপ্ত কোমল অধর স্পর্শের স্মৃতি মাদক সুরার মতো তাহার চিত্তকে বিশৃঙ্খল করিয়া তোলে। সে এই সর্বগ্রাসী মোহের আক্রমণ হইতে দূরে নির্জনে পলায়ন করিতে চায়।
ইতির মনোভাব কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত; এত দিন সে নির্বাণের খেলার সাথী ছিল, অনুজা সখী ছিল, আজ বিপুল নারীত্বের সঙ্গে সঙ্গে সে নির্বাণকেও যেন সম্পূর্ণ নিজস্বভাবে পাইয়াছে। নির্বাণ তাহারই, আর কাহারও নয়— নিজ অধর, দেহ, নারীত্বের নিষ্ক্রয়ে সে নির্বাণকে আপন করিয়া লইয়াছে। এই চূড়ান্ত দাবির কাছে পৃথিবীর অন্য সমস্ত দাবি মাথা নীচু করিয়া থাকিবে।
তাহার আচরণে, এমন কি চাহনিতে ও দেহভঙ্গিমায় এই অবিসম্বাদী অধিকারের গর্ব পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। নারী ও পুরুষের প্রভেদ বোধ করি এইখানে।
ইহাদের অন্তরের এই বিপ্লব অন্য দুইজনের কাছেও গোপন রহিল না। মনুষ্যসমাজে যাহা লজ্জা নামে পরিচিত তাহা ইতি কোনও দিন শিখে নাই, তাই তাহার মনের কথাটি কুণ্ঠাহীন অলজ্জিত আনন্দে প্রকাশ পাইল। পিথুমিত্ত ও উচণ্ড সব দেখিলেন, বুঝিলেন। স্থবিরের বর্ণহীন চক্ষু করুণায় নিষিক্ত হইয়া উঠিল; এত দিন যাহা আশঙ্কিত সম্ভাবনা ছিল, আজ তাহা সত্য হইয়া উঠিয়াছে। হায় তথাগত, সঙ্ঘের বৈরাগ্যভস্মের মাঝখানে এ কোন ভঙ্গুর সুকুমার পুষ্প ফুটাইয়া তুলিলে! ভিক্ষু উচণ্ডের কঠোর ললাটে কিন্তু আঁধির অন্ধকার পুঞ্জিত হইয়া উঠিল। তিনি অন্তরমধ্যে গর্জন করিতে লাগিলেন, ‘মার প্রবেশ করিয়াছে! সঙ্ঘে মার প্রবেশ করিয়াছে!’
প্রথম দিন হইতেই ক্ষুদ্র মানবিক ইতির প্রতি ভিক্ষু উচণ্ডের মনে একটা বিমুখতা জন্মিয়াছিল। ভিক্ষুর মনে ভেদজ্ঞান থাকিতে নাই; কিন্তু ভিক্ষু উচণ্ড নির্বাণকে কাছে টানিয়া লইলেন, ইতিকে দূরে দূরে রাখিলেন। নির্বাণ ধর্ম-বিষয়ে শিক্ষা পাইতে লাগিল, ইতি মরুবিহারিণী প্রকৃতিকন্যা হইয়া রহিল। ইতির দেহে যখন প্রথম যৌবন-লক্ষণ প্রকাশ পাইল, সবাগ্রে উচণ্ডই তাহা লক্ষ্য করিলেন। তাঁহার বিমুখতা গভীর আক্রোশে পরিণত হইল; ভিক্ষুর নিপীড়িত ব্যর্থ যৌবন যেন ইতির মূর্তি ধরিয়া নিরন্তর তাঁহাকে কশাঘাত করিতে লাগিল। জর্জরিত উচণ্ডের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের ধ্রুবপদের ন্যায় কেবল ধ্বনিত হইতে লাগিল— মার প্রবেশ করিয়াছে! মার প্রবেশ করিয়াছে!
নির্বাণের প্রতিও তাঁহার আচরণ কঠোর হইয়া উঠিল। তিনি দেখিলেন, ইতি সর্বদা নির্বাণের সঙ্গে ঘুরিতেছে, এক দণ্ড উভয়ে পৃথক থাকে না। তাঁহার বক্ষে অগ্নিশলাকা বিদ্ধ হইতে লাগিল। মার প্রবেশ করিয়াছে— ইতি নির্বাণকে প্রলুব্ধ করিবে! তার পর? বুদ্ধের সঙ্ঘ ব্যভিচারের আগার হইয়া উঠিবে! কখনও না— কখনও না! উচণ্ড নির্বাণকে সুকঠিন ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। মনে হইতে লাগিল তিনি নির্বাণকে উপলক্ষ করিয়া ভিক্ষু-জীবনের পুরুষ নির্মমতা নূতন করিয়া সঙ্ঘে প্রবর্তন করিতেছেন।
নিগৃহীত নিপীড়িত আকাঙ্ক্ষা যখন বিকলাঙ্গ মূর্তিতে বাহির হইয়া আসে, তখন তাহার স্বরূপ সকলে চিনিতে পারে না। সঙ্ঘে সত্যই মার প্রবেশ করিয়াছিল— কিন্তু কাহার দুর্বলতার ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়াছিল তাহা ভিক্ষু উচণ্ড জানিতে পারেন নাই।
মরুভূমির স্বল্পায়ু বসন্ত এইভাবে নিঃশেষ হইয়া আসিল। ইতিমধ্যে নির্বাণ ও ইতির মনোভাব প্রকট হইয়া পড়িল। তখন একদিন মাধবী পূর্ণিমার প্রভাতে উচণ্ড নির্বাণকে উপসম্পদা দান করিয়া পরিপূর্ণ রূপে সঙ্ঘের নিয়মাধীন করিবার প্রস্তাব করিলেন।
প্রস্রবণের মুকুরোজ্জ্বল জলে একটি চঞ্চল ছায়া পড়িল। দিবাস্বপ্ন ভাঙিয়া নির্বাণ উঠিয়া বসিল; ইতি আসিতেছে।
ইতির দেহে একটি মাত্র শ্বেতবস্ত্র। পঞ্চ হস্ত পরিমিত একটি দুকূলপট্টি কটি ও নিতম্ব বেষ্টন করিয়া সম্মুখে বক্ষ আবরণপূর্বক গ্রীবার পশ্চাতে গ্রন্থিবদ্ধ রহিয়াছে; স্কন্ধ ও বাহুমূল উন্মুক্ত। তাহার রুক্ষ কেশভার সুকৃষ্ণ নহে, রৌদ্ররশ্মি পড়িয়া অঙ্গারাবৃত অগ্নিশিখার ন্যায় আরক্ত প্রভা বিকীর্ণ করিতেছে।
লঘুপদে সঙ্কীর্ণ পয়োধারা উল্লঙ্ঘন করিয়া ইতি নির্বাণের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; মুষ্টিবদ্ধ হস্ত পশ্চাতে রাখিয়া বলিল, ‘চক্ষু মুদিত কর।’
নির্বাণ চক্ষু মুদিত করিল।
‘হাঁ কর।’
নির্বাণ মুদিত চক্ষে মুখ ব্যাদান করিল।
ইতি তাহার মুখে মুষ্টিধৃত গুবাক ফলের মতো একটি ক্ষুদ্র দ্রব্য পুরিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার পাশে বসিয়া পড়িল, বলিল, ‘এখন বল দেখি, কি খাইতেছ?’
নির্বাণ চিবাইতে চিবাইতে চক্ষু মেলিয়া বলিল, ‘শর্করা-কন্দ। কোথায় পাইলে?’
ইতি তখন নির্বাণের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া কোথায় শর্করা-কন্দ পাইল তাহা বলিতে আরম্ভ করিল। বালুর নিম্নে মাটি আছে, নানা জাতীয় বিচিত্র বীজকণা সেখানে গিয়া সঞ্চিত হয়। তারপর একদিন প্রকৃতির মন্ত্র-কুহকে অঙ্কুরিত হইয়া আলোকের সন্ধানে ঊর্ধ্বে উঠিতে আরম্ভ করে। কেহ বালু ভেদ করিয়া উঠিতে পারে, কেহ পারে না। বালুকার গর্ভে তাহাদের ফল-কন্দ বর্ধিত হইয়া প্রচ্ছন্ন জীবন যাপন করে। কিন্তু ইতির চক্ষে আবরণ পড়ে নাই। সে দেখিতে পায়। বালু খুঁড়িয়া এই সব রস-পরিপুষ্ট স্বাদু উদ্ভিজ হরণ করিয়া আনে। খর্জুর ভিন্ন যাহাদের অন্য খাদ্য নাই, তাহাদের মুখে ইহা অমৃততুল্য বোধ হয়।
সানন্দে চর্বণ করিতে করিতে নির্বাণ বলিল, ‘তুমি খাও নাই?’
ইতির চক্ষু অর্ধনিমীলিত হইয়া আসিল, সে অধরোষ্ঠের একটি বিমর্ষ ভঙ্গিমা করিয়া বলিল, ‘আর কোথায় পাইব? একটিমাত্র পাইয়াছিলাম।’
নির্বাণের চর্বণক্রিয়া বন্ধ হইল; সে ইতির প্রতি বিস্মিত চক্ষু ফিরাইল। ইতিও চক্ষু পাতিয়া পরম তৃপ্তিভরে নির্বাণের বিস্ময়বিমূঢ় মুখ ক্ষণেক নিরীক্ষণ করিয়া লইল, তারপর কৌতুকবিগলিত কলহাস্য করিয়া তাহার কোলের উপর লুটাইয়া পড়িল।
নির্বাণ এতক্ষণ যেন আত্মবিস্মৃত ছিল, এখন বিদ্যুদাহতের মতো চমকিয়া শিহরিয়া উঠিল। ঠিক এই সময় পশ্চাৎ হইতে বজ্রগম্ভীর আহ্বান আসিল— ‘নির্বাণ!’
প্রথমে নির্বাণের মনে হইল, এই ধ্বনি যেন তাহার মস্তিষ্কের মধ্যেই মন্দ্রিত হইয়াছে। তারপর সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল, মূর্তিমান তিরস্কারের ন্যায় ভিক্ষু উচণ্ড বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া আছেন।
সভয়ে অপরাধ-কুন্ঠিত দেহে নির্বাণ উঠিয়া দাঁড়াইল। উচণ্ড অঙ্গারগর্ভ চক্ষু তাহার উপর স্থাপন করিয়া গভীর কণ্ঠে একবার বলিলেন, ‘ধিক্।’
নির্বাণের মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখ মৃতের মতো পাণ্ডুর হইয়া গেল। সে আড়ষ্টভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
উচণ্ড সঙ্ঘের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘যাও! স্থবির তোমাকে আহ্বান করিয়াছেন।’
যন্ত্রচালিতের ন্যায় নির্বাণ প্রস্থান করিল।
ইতি এতক্ষণ নির্বাক্ বিভিন্ন-ওষ্ঠাধরে ভূমির উপর বসিয়া ছিল, এখন বিস্ফারিত নেত্র উচণ্ডের মুখের উপর নিবদ্ধ রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
নির্বাণ সঙ্ঘমধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেলে উচণ্ড প্রজ্বলিত চক্ষু ইতির দিকে ফিরাইলেন, তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কর্কশ কণ্ঠে কহিলেন, ‘স্কন্ধ আবৃত কর।’
ইতি চকিতে নিজ অঙ্গের প্রতি দৃষ্টি ফিরাইল, তারপর আবার উচণ্ডের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ধীরে ধীরে কণ্ঠলগ্ন বস্ত্র স্কন্ধের উপর প্রসারিত করিয়া দিল।
ভীষণ ভ্রূকুটি করিয়া উচণ্ড প্রশ্ন করিলেন, ‘সঙ্ঘের অলিন্দ পরিষ্কৃত করিয়াছ?’
‘হাঁ অজ্জ, করিয়াছি।’
‘জল সঞ্চয় করিয়াছ?’
‘হাঁ অজ্জ, করিয়াছি।’
‘ফল সংগ্রহ করিয়াছ?’
‘হাঁ অজ্জ, করিয়াছি।’
উচণ্ড অধর দংশন করিলেন। ইতিকে শাসনাধীনে আনা অসম্ভব— সে নারী, ভিক্ষুসঙ্ঘে ভিক্ষুণীর স্থান নাই। উচণ্ড তাহার সর্বাঙ্গে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দ্রুত সঙ্ঘের অভিমুখে চলিলেন। ইতি দুই চক্ষে দুর্জ্ঞেয় দৃষ্টি লইয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল।
ওদিকে নির্বাণ স্থবিরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল, তাঁহার চরণ স্পর্শ করিয়া বলিল, ‘বন্দে।’
স্থবির তাহার পৃষ্ঠে হস্তীর্পণ করিয়া স্নেহার্দ্রস্বরে আশীর্বচন করিলেন— ‘আরোগ্য।’
নির্বাণের অপরাধ-সঙ্কুচিত চিত্ত বোধ হয় স্থবিরের নিকট তীব্র ভর্ৎসনা প্রত্যাশা করিতেছিল, তাই তাঁহার স্নেহসিক্ত বচনে তাহার হৃদয় সহসা দ্রবীভূত হইয়া গেল, চক্ষু বাষ্পাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। সে স্থবিরের পদপ্রান্তে বসিয়া পড়িল।
স্থবির তখন ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘নির্বাণ, তোমার উপাধ্যায়ের নিকট জানিতে পারিলাম তুমি উপসম্পদা গ্রহণে অভিলাষী। ইহা সত্য?’
নির্বাণ যেন কূল পাইল, অবরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘হাঁ ভদন্ত, আমাকে উপসম্পদা দান করিয়া সঙ্ঘে গ্রহণ করুন।’
স্থবির কিছুকাল নীরব রহিলেন; তারপর বলিলেন, ‘নির্বাণ, তুমি সদ্ধর্মে শিক্ষা লাভ করিয়াছ; সঙ্ঘে প্রবেশ করিতে হইলে নশ্বর আসক্তি কামনা ত্যাগ করিয়া আসিতে হয়, ইহা নিশ্চয় তোমার অপরিজ্ঞাত নহে। সঙ্ঘের বিধি-বিধান অতি কঠোর, তুমি পালন করিতে পারিবে?’
এই সময় উচণ্ড প্রবেশ করিয়া নীরবে এক পার্শ্বে দাঁড়াইলেন; নির্বাণ অবনত মস্তকে বলিল, ‘হাঁ ভদন্ত, পারিব।’
‘না পারিলে পাতিমোক্ষ দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে— বিনয়পাঠে অবশ্য তাহা অবগত আছ?’
‘আছি, ভদন্ত।’
স্থবির তখন করুণ বচনে বলিলেন, ‘বৎস, ব্যাধতাড়িত পশু গুহার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে, ত্রিতাপক্লিষ্ট মানব নিষ্কৃতির কামনায় ধর্মের অনুরাগী হয়। বুদ্ধের সঙ্ঘ সেরূপ স্থান নহে। যাহার অন্তরে বৈরাগ্য এবং নির্বাণ-তৃষ্ণা জন্মিয়াছে, সে-ই সঙ্ঘের অধিকারী। তুমি এই সকল বিচার করিয়া উত্তর দাও।’
গলদশ্রু নির্বাণ যুক্তকরে বলিল, ‘আমি সঙ্ঘের আশ্রয় ভিক্ষা করিতেছি— সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। আমাকে উপসম্পদা দান করুন।’
গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া স্থবির বলিলেন, ‘বুদ্ধের ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।’
জলদগন্তীর স্বরে উচণ্ড প্রতিধ্বনি করিলেন, ‘বুদ্ধের ইচ্ছা পূর্ণ হউক।’
অতঃপর বিধিমত প্রশ্নোত্তরদানপূর্বক ভিক্ষাপাত্র ও ত্রি-চীবর ধারণ করিয়া কেশ মুণ্ডিত করিয়া নির্বাণ ভিক্ষুধর্ম গ্রহণ করিল। সংসারে আর তাহার অধিকার রহিল না।
ভিক্ষু উচণ্ডই নির্বাণের আচার্য রহিলেন; নাম পরিবর্তন প্রয়োজন হইল না। ছায়া পরিমাপ ইত্যাদি বিধি সমাপ্ত হইবার পর উচণ্ড বিজয়োদ্ধত কণ্ঠে কহিলেন, ‘বুদ্ধ জয়ী হইয়াছেন, মার পরাভূত হইয়াছে। ভিক্ষু, নিজ পরিবেণে গমন কর। অদ্য হইতে নারীর মুখদর্শন তোমার নিষিদ্ধ।’
নতনেত্রে নির্বাণ নিজ পরিবেণে প্রবেশ করিল।
স্থবির নিজ মনে বলিতে লাগিলেন, ‘হে শাক্য, হে লোকজ্যেষ্ঠ, আমাদের ভ্রান্তি অপনোদন কর, অজ্ঞানমসী দূর কর, সম্যক্ দৃষ্টি দান কর—’
তিন দিন নির্বাণ নিজ পরিবেণ হইতে বাহির হইল না। আর ইতি! দেহবিচ্ছিন্ন ছায়ার মতো সে সঙ্ঘভূমির উপর দিবারাত্র বিচরণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল।
সঙ্ঘের প্রত্যেক অধিবাসীর পরিবেণ স্বতন্ত্র। সঙ্ঘারামের উপরিতলে যে-কয়টি প্রকোষ্ঠ ছিল তাহার একটিতে ইতি রাত্রিযাপন করিত; অলিন্দের অন্য প্রান্তে তিনটি বিভিন্ন কক্ষে নির্বাণ উচণ্ড ও স্থবির বাস করিতেন। স্থবিরের অনুমতি ব্যতীত একের প্রকোষ্ঠে অন্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
নির্বাণের সহিত ইতির আর সাক্ষাৎ হয় না। ইতি সঙ্ঘের কাজ করে, আর নানা অছিলায় নির্বাণের পরিবেণের সম্মুখ দিয়া যাতায়াত করে। কখনও দেখে, নির্বাণ পুঁথি লইয়া নিমগ্নচিত্তে অধ্যয়ন করিতেছে; কখনও বা দেখিতে পায়, উচণ্ড তাহাকে উপদেশ দিতেছেন। কদাচিৎ নির্বাণ গবাক্ষের বাহিরে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া চিন্তায় নিমজ্জিত হইয়া থাকে। ইতির পদশব্দে তাহার চেতনা হয় না। ইতি নিশ্বাস ফেলিয়া সরিয়া যায়।
ভিক্ষু উচণ্ডের মন কিন্তু শান্ত হইতেছে না; কোথাও যেন একটা মস্ত ভ্রান্তি রহিয়া গিয়াছে। নির্বাণ যতই কঠোরভাবে নিজেকে নিগৃহীত করিয়া সঙ্ঘ-ধর্মে আত্মনিয়োগ করিতেছে, তাঁহার অন্তরে সংশয় ও দ্বন্দ্ব ততই মাথা তুলিতেছে। নির্বাণকে সঙ্ঘের শাসনে আবদ্ধ করিয়াও তাঁহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইল না— ইতি ও নির্বাণের মধ্যস্থিত আকর্ষণ-রজ্জু দূরত্বের ফলে দৃঢ়তর হইল মাত্র। কুশাগ্রবৎ সূক্ষ্ম ঈর্ষা ক্রমশ কণ্টক হইয়া উচণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তুলিল। আপন অজ্ঞাতে নির্বাণকে তিনি নিবিড়ভাবে ঘৃণা করিতে আরম্ভ করিলেন।
একদিন মধ্যরাত্রে চন্দ্রের আলোক গবাক্ষপথে নির্বাণের পরিবেণে প্রবেশ করিয়াছিল; অন্ধকার কক্ষে শুভ্র সূক্ষ্ম চীনাংশুকের মতো এক খণ্ড জ্যোৎস্না যেন আকাশ হইতে স্খলিত হইয়া পড়িয়াছিল। নির্বাণের চোখে নিদ্রা নাই, সে ঐ গবাক্ষের দিকে চাহিয়া ভূ-শয্যায় শয়ান ছিল।
নিস্তব্ধ রাত্রি; সঙ্ঘের কোথাও একটি শব্দ নাই। নির্বাণ নিঃশব্দে শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; তারপর ছায়ামূর্তির মতো অলিন্দ উত্তীর্ণ হইয়া সঙ্ঘের বাহিরে উপস্থিত হইল।
খর্জুরকুঞ্জতলে জ্যোৎস্না-তরলিত স্বল্পান্ধকার যেন ইন্দ্রজাল রচনা করিয়া রাখিয়াছে। ঊর্ধ্বে খর্জুরশাখা ক্বচিৎ তন্দ্রালস মর্মরধ্বনি করিতেছে, নিম্নে প্রস্রবণের উৎসমুখে উদগত জলের মৃদু কলশব্দ। চারি দিকে অপার মরুভূমির উপর চন্দ্ররশ্মির শীতল প্রলেপ। নির্বাণের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস পড়িল। এই দৃশ্য তাহার চিরপরিচিত; কিন্তু আজ আর ইহার সহিত তাহার কোনও সম্বন্ধ নাই— সে বহু দূরে চলিয়া গিয়াছে।
‘নির্বাণ!’
প্রস্রবণের কলধ্বনির মতোই মৃদু কণ্ঠস্বর। চমকিয়া নির্বাণ ফিরিয়া চাহিল। শুভ্র বালুকার উপর বায়ুতাড়িত কাশীপুষ্পের ন্যায় ইতি তাহার পানে ছুটিয়া আসিতেছে! তাহার চরণ যেন মৃত্তিকা স্পর্শ করিতেছে না; চন্দ্রকরকুহেলির ভিতর দিয়া স্মিতক্ষুধিত মুখখানি অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।
‘না— না— না’ দুই হস্তে চক্ষু আবৃত করিয়া নির্বাণ পলায়ন করিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজ পরিবেণে প্রবেশ করিয়া অধোমুখে ভূতলে পড়িয়া ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিতে লাগিল।
ফিরিবার সময় নির্বাণের পদপাত সম্পূর্ণ নিঃশব্দ হয় নাই; অন্য পরিবেণে আর একজনের নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছিল।
পরদিন মধ্যরাত্রে আবার চন্দ্ররশ্মি নির্বাণের গবাক্ষ-পথে প্রবেশ করিয়া দুর্নিবার শক্তিতে বাহিরের পানে টানিতে লাগিল। নির্বাণ অনেকক্ষণ নিজের সহিত যুদ্ধ করিল— কিন্তু পারিল না। মোহগ্রস্তের মতো খর্জুরছায়াতলে গিয়া দাঁড়াইল।
‘নির্বাণ!’
ইতি তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু আজ আর নির্বাণ পলাইল না; সমস্ত দেহের স্নায়ুপেশী কঠিন করিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
‘নির্বাণ, আর তুমি আমার সহিত কথা কহিবে না?’
নির্বাণ উত্তর দিল না; কে যেন তাহার কণ্ঠ দৃঢ়মুষ্টিতে চাপিয়া ধরিয়াছে।
ইতি সশঙ্ক লঘু হন্তে তাহার বাহু স্পর্শ করিল।
‘নির্বাণ, আর তুমি আমার মুখ দেখিবে না?’
ইতির কণ্ঠস্বরে শক্তি নাই— ভাঙা ভাঙা অর্ধোচ্চারিত উক্তি। নির্বাণের স্নায়ু-কঠিন দেহ অল্প অল্প কাঁপিতে লাগিল।
‘নির্বাণ, একবার আমার পানে চাও’— ইতি চিবুক ধরিয়া নির্বাণের মুখ ফিরাইবার চেষ্টা করিল।
স্নায়ুপেশীর নিরুদ্ধ বন্ধন সহসা যেন ছিঁড়িয়া গেল; জ্যা-মুক্ত ধনুর ন্যায় নির্বাণের উৎক্ষিপ্ত একটা বাহু ইতির মুখে গিয়া লাগিল। ইতি অস্ফুট একটা কাতরোক্তি করিয়া অধরের উপর হাত রাখিয়া বসিয়া পড়িল।
নির্বাণ ব্যাকুল চক্ষে একবার তাহার পানে চাহিল। তারপর— ‘না না— আমি ভিক্ষু— আমি ভিক্ষু— আমি ভিক্ষু—’
অন্ধের মতো, উন্মাদের মতো নির্বাণ সে স্থান ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
একজন অলক্ষিতে থাকিয়া এই দৃশ্য দেখিলেন। কিন্তু তাঁহার অশান্ত চিত্ত আশ্বস্ত না হইয়া আরও দুর্বার ক্রোধে আলোড়িত হইয়া উঠিল। মার পরাভূত হয় নাই। সঙ্ঘ অশুচি হইয়াছে। এ-পাপ দূর করিতে হইবে— নচেৎ বুদ্ধের ক্রোধানলে সঙ্ঘ ভস্মীভূত হইবে।
কৃষ্ণাপঞ্চমীর ক্ষীয়মাণ চন্দ্র প্রায় মধ্যগগন অতিক্রম করিয়া গিয়াছে।
রাত্রি শেষ হইতে আর বিলম্ব নাই।
সঙ্ঘ নিস্তব্ধ, কোথাও কোনও শব্দ নাই; বুঝি ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রতীক্ষায় নির্বাণ-সমাধিতে নিমগ্ন।
ভিক্ষু উচণ্ড স্থবিরের পরিবেণে প্রবেশ করিয়া অন্ধকারে গাত্রস্পর্শ করিয়া তাঁহাকে জাগরিত করিলেন। সর্পশ্বাসবৎ স্বরে তাঁহার কর্ণে বলিলেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’
নিঃশব্দে দুইজনে ইতির প্রকোষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ম্লান তির্যক কাক-জ্যোৎস্না কক্ষের মসৃণ ভূমির উপর প্রতিফলিত হইতেছে। সেই অস্পষ্ট আলোকে স্থবির দেখিলেন, ইতি একটি উচ্চ পীঠিকার উপর বসিয়া আছে; আর, বেদীমূলে প্রণতি-রত উপাসকের ন্যায় নির্বাণ নতদেহে তাহার জানুর উপর মস্তক রাখিয়া স্থির হইয়া আছে। ইতির কটি হইতে ঊর্ধ্বাঙ্গ কেবল বিস্রস্ত কেশজাল দিয়া আবৃত; শুভ্র মর্মরে রচিত মূর্তির ন্যায় তাহার যৌবন-কঠিন দেহ সগর্বে উন্নত হইয়া আছে; আর দুই চক্ষু হইতে বিজয়িনীর নির্বোধ উল্লাস ও অশ্রু একসঙ্গে ক্ষরিত হইয়া পড়িতেছে।
স্থবির ডাকিলেন, ‘নির্বাণ!’
নির্বাণ ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। দ্বার-সম্মুখে পিথুমিত্তকে দেখিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া রুদ্ধস্বরে কহিল, ‘থের, আমি সঙ্ঘের ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছি। আমার যথোপযুক্ত দণ্ড বিধান করুন।’
স্থবির কম্পিত স্বরে কহিলেন, ‘নির্বাণ, তোমার অপরাধ গুরু। কিন্তু আমার অপরাধ তোমার অপেক্ষাও অধিক। আমি সব জানিয়া-বুঝিয়া তোমাকে সঙ্ঘে গ্রহণ করিয়াছিলাম বৎস!’
উচণ্ডের উগ্র কণ্ঠস্বরে স্থবিরের করুণাবাণী ডুবিয়া গেল, তিনি কহিলেন, ‘থের, এই পতিত ভিক্ষু নিজমুখে পাপ খ্যাপন করিয়াছে, আমরাও স্বচক্ষে উহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। এখন পাতিমোক্ষ অনুসারে উহার দণ্ডাজ্ঞা উচ্চারণ করুন।’
স্থবির কোনও কথাই উচ্চারণ করিতে পারিলেন না, অপরিসীম করুণায় তাঁহার অধর থর থর কাঁপিতে লাগিল।
উচণ্ড তখন কহিলেন, ‘উত্তম, আমি এই ভিক্ষুর উপাধ্যায় ছিলাম, আমিই তাহার দণ্ডাজ্ঞা ঘোষণা করিতেছি। ভিক্ষু, তুমি পারাজিক ও সঙ্ঘাদিশেষ পাপে অপরাধী হইয়াছ, এই জন্য তুমি সঙ্ঘ হইতে বিচ্যুত হইলে। অদ্য হইতে সঙ্ঘের সীমাভুক্ত ভূমির উপর বাস করিবার অধিকার তোমার রহিল না; সঙ্ঘাধিকৃত খাদ্য বা পানীয়ে তোমার অধিকার রহিল না। ইহাই তোমার দণ্ড— বহিষ্কার! তুমি এবং তোমার পাপের অংশভাগিনী বুদ্ধের পবিত্র সঙ্ঘভুক্তি হইতে নির্বাসিত হইলে।’
এই দণ্ডাদেশের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা ধীরে ধীরে সকলেরই হৃদয়ঙ্গম হইল। ইহা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তবু কেহ কোনও কথা কহিল না। নির্বাণ নতমস্তকে সঙ্ঘের অমোঘ দণ্ডাজ্ঞা স্বীকার করিয়া লইল। স্থবিরও মৌন রহিলেন। শুধু, পঞ্চদশ বৎসর পূর্বে নির্বাণ ও ইতিকে কোলে টানিয়া লইয়া তাঁহার শীর্ণ গণ্ডে যে অশ্রুর ধারা নামিয়াছিল, এতদিন পরে আবার তাহা প্রবাহিত হইল।
ঊষালোক ফুটিবার সঙ্গে সঙ্গে ইতি ও নির্বাণ সঙ্ঘ হইতে বিদায় লইল। সঙ্ঘের পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া দুইজনে হাত-ধরাধরি করিয়া নিরুদ্দেশের পথে বাহির হইয়া পড়িল। কোথায় যাইতেছে তাহারা জানে না; এ যাত্রা কিভাবে শেষ হইবে তাহাও অজ্ঞাত। কেবল, উভয়ের বাহু পরস্পর দৃঢ়নিবদ্ধ হইয়া আছে, দুস্তর মরু-পথের ইহাই একমাত্র পাথেয়।
যত দূর দেখা গেল, প্রাচীন নির্বাপিত চোখে স্থবির সেই দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে সূর্য উঠিল, দূরে দুইটি কৃষ্ণ বিন্দু আলোকের ধাঁধায় মিলাইয়া গেল। স্থবির ভাবিতে লাগিলেন, এই সূর্য মধ্যকাশে উঠিবে; তৃষ্ণা-রাক্ষসী প্রতীক্ষা করিয়া আছে—
উচণ্ড আসিয়া স্থবিরের পাশে দাঁড়াইলেন, বলিলেন, ‘থের, আপনাকে উপদেশ দিবার স্পর্ধা আমার নাই। কিন্তু গৃহীজনোচিত মমত্ব কি নির্বাণ-লিপ্সু ভিক্ষুর সমুচিত?’
স্থবির কহিলেন, ‘উচণ্ড, অদৃষ্টবিড়ম্বিতের প্রতি করুণা ভিক্ষুর পক্ষে নিন্দনীয় নহে। শাক্য সকল জীবের প্রতি করুণা করিতে বলিয়াছেন।’
‘সত্য। কিন্তু সেই মহাভিক্ষু শাক্যই পাপীর দণ্ডবিধান পাতিমোক্ষ সৃজন করিয়াছেন। দণ্ডবিধির মধ্যে করুণার স্থান কোথায়? থের, এই সঙ্ঘ কেবল বাস্তব পাষাণ দিয়া গঠিত নয়, ভিক্ষুগণের নির্মমত্বের কঠিনতর মর্মর পাষাণে নির্মিত। তাই সংসারের শত ক্লেদ-পঙ্কিলতার মধ্যে প্রকৃতির রুদ্র বিক্ষোভ উপেক্ষা করিয়া সঙ্ঘ আজিও অটল হইয়া আছে। সঙ্ঘের ভিত্তিমূল যদি করুণার অশ্রুপঙ্কে আর্দ্র হইয়া পড়ে, তবে ধর্ম কয় দিন থাকিবে? করুণার যূপকাষ্ঠে নীতির বলিদান কদাপি মহাভিক্ষুর অভিপ্রেত ছিল না।’
স্থবির দীর্ঘকাল উত্তর দিলেন না; তারপর ক্লিষ্টস্বরে কহিলেন, ‘উচণ্ড, মহাভিক্ষুর অভিপ্রায় দুর্জ্ঞেয়। আমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইয়াছে; কর্তব্যজ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি।’
উচণ্ড প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন, পাতিমোক্ষ-মতে ভিক্ষুর দণ্ডমান অনুচিত হইয়াছে!’
‘জানি না। বুদ্ধের ইচ্ছা দুরধিগম্য।’
‘পাতিমোক্ষ কি বুদ্ধের ইচ্ছা নয়!’
‘তাহাও জানি না।’
উচণ্ড তখন দুই হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিয়া আকাশ লক্ষ্য করিয়া গভীর কণ্ঠে বলিলেন, ‘তবে বুদ্ধ নিজ ইচ্ছা জ্ঞাপন করুন। গৌতম, তুমি আমাদের সংশয় নিরসন কর। তোমার অলৌকিক শক্তির বজ্রালোকে সত্য পথ দেখাইয়া দাও।’
সেইদিন মধ্যাহ্নেবাতাস সহসা স্তব্ধ হইয়া গেল; কেবল প্রজ্বলিত বালুকার উপর হইতে এক প্রকার শিখাহীন অগ্নিবাষ্প নির্গত হইতে লাগিল। পঞ্চাগ্নি-পরিবেষ্টিত সঙ্ঘ যেন উগ্র তপস্যারত বিভূতিধূসর কাপালিকের ন্যায় এই বহ্নিশ্মশানে বসিয়া আছে। আকাশের একপ্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কোথাও একটি পক্ষী উড়িতেছে না। শব্দ নাই। চতুর্দিকে যেন একটা রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা।
মধ্যাহ্ন বিগত হইল; খর্জুর বৃক্ষের ছায়া সভয়ে মূল ছাড়িয়া নির্গত হইবার উপক্রম করিল।
‘থের!’
স্থবির অলিন্দে আসিয়া দাঁড়াইলেন। উচণ্ড নীরবে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করিয়া দিক্প্রান্ত দেখাইলেন।
তাম্রতপ্ত আকাশের এক প্রান্তে চক্রবালরেখার উপর মুষ্টিপ্রমাণ কজ্জলমসী দেখা দিয়াছে। চিনিতে বিলম্ব হইল না। পঞ্চদশ বৎসর পূর্বে এমনই মসী-চিহ্ন আকাশের ললাটে দেখা গিয়াছিল।
ভয়ার্ত কণ্ঠে উচণ্ড কহিলেন, ‘থের, আঁধি আসিতেছে!’
স্থবিরের অধর একটু নড়িল, ‘বুদ্ধের ইচ্ছা! বুদ্ধের ইচ্ছা!’
উন্মত্তের ন্যায় স্থবিরের জানু আলিঙ্গন করিয়া উচণ্ড কহিলেন, ‘থের, তবে কি আমি কি ভুল করিয়াছি? তবে কি আমার পাপেই আজ সঙ্ঘ ধ্বংস হইবে? ইহাই কি বুদ্ধের অলৌকিক ইঙ্গিত!’
দেখিতে দেখিতে আঁধি আসিয়া পড়িল। মরুভূমি ঝঞ্ঝাবিমথিত সমুদ্রের ন্যায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল; গাঢ় অন্ধকারে চতুর্দিক আচ্ছন্ন হইয়া গেল।
এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে স্থবিরের কণ্ঠে উচ্চারিত হইতে লাগিল— ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়! তমসো মা জ্যোতির্গময়!’
উচণ্ড চিৎকার করিয়া উঠলেন, ‘আমি যাইব। তাহাদের ফিরাইয়া আনিব— তাহাদের ফিরাইয়া আনিব—’ ক্ষিপ্তের মতো তিনি অলিন্দ হইতে নিম্নে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন; ঝড়ের হাহারবে তাঁহার চিৎকার ডুবিয়া গেল।
বালু ও বাতাসের দুর্মদ দুরন্ত খেলা চলিতে লাগিল। পৃথিবী প্রলয়ান্ত অন্ধকারে ছাইয়া গিয়াছে। সঙ্ঘ নিমজ্জিত হইল।
স্থবিরের শীর্ণ প্রাচীন কণ্ঠ হইতে তখনও আকুল প্রার্থনা উচ্চারিত হইতেছে; ‘হে শাক্য, হে লোকজ্যেষ্ঠ, হে গোতম, অন্তিমকালে আমাকে চক্ষু দাও। তমসো মা জ্যোতির্গময়— তমসো মা জ্যোতির্গমায়—’
মানবজাতির শমন-ধৃত কণ্ঠ হইতে আজিও ঐ আর্ত বাণীই নিঃসৃত হইতেছে।
১৭ অগ্রহায়ণ ১৩৪৪