সোনার জহুরি

সোনার জহুরি

বাউলদের মুখে শোনা যায়—

কমলবনে কে আসিল সোনার জহুরি
নিকষে কষয়ে কমল আ মরি আ মরি!

জহুরিও ভালো, নিকষও ভালো, কিন্তু কমলের পক্ষে নয়, সোনার পক্ষে। এই সামান্য কথাটা মনে থাকলে সোনার সমঝদার যিনি, তিনি কমলের সমঝদার হতে রাজি হতেন না। কিন্তু কথাটা তাঁরও মনে থাকে না, যাঁদের চোখে সোনার দামই বেশি তাঁরাও মনে করিয়ে দেন না। তাই অনেকসময় সোনার জহুরি এসে কমল পরীক্ষা করেন।

নীতির বেলা বা আইনের বেলা বা সাংসারিক লাভ-লোকসানের বেলা যাঁর বিচার শিরোধার্য, রুচির বেলা তাঁর রায় হয়তো নির্ভরযোগ্য নয়। আবার রুচির বেলা যাঁর অভিমত নির্ভরযোগ্য তিনিও হয়তো শিল্পকর্মের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্যক অবগত নন।

বিধাতা আমাকে যেমনটি করে গড়েছেন আমি তেমনিটি। তার চেয়ে ভালোও নই, তার চেয়ে খারাপও নই। আমি যদি আমার প্রকৃতির প্রতি সত্য হয়ে থাকি তবে আমি যা হবার তাই হয়েছি। আমাকে আরও ভালো করতে গিয়ে অসত্য করে তোলা বিধাতার অভিপ্রায় নয়। তা যদি হত তবে তিনি আমাকে না গড়ে আরেক জনকে গড়লেই পারতেন। আমাকে যারা চায় তারা আমার স্বকীয়কেই চায়, আমার উত্তমকে নয়।

উপরে যা বলা গেল তা যেমন প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রে খাটে তেমনি প্রত্যেকটি শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে। কাব্য যদি তার প্রকৃতির প্রতি সত্য হয়ে থাকে তবে যা হবার তাই হয়েছে। তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যদি সিদ্ধ হয়ে থাকে তবে সেযেমনটি হয়েছে তেমনিটিই ভালো। চিত্র বা নৃত্য সম্বন্ধেও সেই কথা।

এক-একটি সৃষ্টি এক-একটি বিশেষ রূপধারণ করে আসে। সঞ্চার করতে আসে এক-একটি বিশেষ রস। বিশেষেরও একটা মূল্য আছে। সেইজন্যেই তার এত আদর। আর-সব গুণ বাড়তি গুণ। নীতির দিক থেকে রুচির দিক থেকে অনবদ্য হলে সেটা হবে বাড়তি গুণ। আইনের দিক থেকে, বাজারের দিক থেকে মার না খেলে সেটাও হবে তেমনি বাড়তি গুণ।

কিন্তু যেখানে বিশেষ বলে কোনো রস বা রূপ নেই সেখানে ভালো বলে একটি গুণ তার জায়গা নিতে পারে না। নীতিবোধ যাকে ভালো বলে রসবোধ বা রূপবোধ হয়তো তাকে নিয়ে কিছু-একটা সৃষ্টি করতে অক্ষম হয়।

সাহিত্যে ইতিপূর্বে এত বেশি নীতিমূলক কাহিনি বা কাব্য লেখা হয়ে গেছে যে নীতির গন্ধ পেলেই একালের পাঠকরা দৌড় দেন। তেমনি রুচিতেও অরুচি ধরে গেছে অনেকের। গুছিয়ে লেখা দেখলেই সন্দেহ হয় যে বানিয়ে লেখা। বানিয়ে লেখার উপরেও অনেকে ক্ষিপ্ত। জীবন যদি মসৃণ না হয় তো সাহিত্য মসৃণ হবে কী করে! এলোমেলো এবড়োখেবড়ো রচনাই তাঁদের পছন্দ। চেতনার স্রোত বলা হয়ে যাকে তার গতি আঁকাবঁাকা উলটোপালটা মাথামুন্ডুহীন।

এমনি করে এসেছে অ্যাবসার্ড নাটক। সোনার জহুরিদের সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। হাজার চেষ্টা করেও সেনাটকের সংস্কার ঘটানো যায় না। তাকে আরও ভালো বা কম মন্দ করা অসম্ভব। নাটকের সঙ্গে ঝগড়া করে কী হবে! জীবনটাই অ্যাবসার্ড। তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাও তো করো গে।

অ্যাবসার্ড নাটকের একটা বিশেষ রস আছে। সেইজন্যে তো সাহিত্যের ঘরের জিনিস। তার বিচার হবে সাহিত্যের নিজস্ব নিকষে। সেটা দিয়ে শুধু সাহিত্যের পরীক্ষা হয়, সোনার পরীক্ষা হয় না। জীবনের এক এক বিভাগের জন্যে এক এক নিকষ আছে। নীতির নিকষ বিজ্ঞানের অচল। বিজ্ঞানের নিকষ সাহিত্যে অচল।

কোথাও হয়তো একটা সবতাল চাবি আছে, যা দিয়ে সব ক-টা তালা খোলা যায়। জীবন যদিও বহুধাবিভক্ত তবু মূলে তো এক। নিকষও তাহলে একটাই হবে না কেন? কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা সেই সবতাল চাবির সন্ধান পাইনি। ধর্মকেই এককালে সর্বক্ষেত্রে উপযোগী নিকষ মনে করা হত। ধর্মের জহুরিদের বিচারই ছিল শেষ বিচার। কিন্তু মানব-ইতিহাসের সেই স্বর্ণযুগ এখন বহু পশ্চাতে পড়ে আছে।

মাঝখানে ধর্মের স্থান নিতে চেষ্টা করেছিল নীতি। কিন্তু নীতির জহুরিরাও বিকল্প কিছু সৃষ্টি করতে বা করাতে পারেননি। নেতি নেতি বলে তৈরি জিনিসকে বাতিল করা এক, ইতি ইতি বলে নতুন জিনিস তৈরি করে তোলা আরেক। নীতির বিচারে যেটা নিখুঁত বলে গণ্য হল লোকে তার দিকে ফিরেও তাকাল না। দেখা গেল পাপের উপরেই তাদের পক্ষপাত, অবশ্য পাপের জন্য অনুতাপ বা শাস্তিবিধান থাকারও তারা পক্ষপাতী। পাপ জিতে যাবে এটা তো তারা চায় না। পাপও থাকবে, পাপের পরাজয়ও থাকবে। আর নয়তো পাপের থেকে পরিত্রাণ।

টলস্টয় ডস্টয়েভস্কির যুগ ছাড়িয়ে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। পাপ দেখতে চাইলে যতখুশি দেখাতে পারি, কিন্তু পাপের জন্যে অনুতাপ বা শাস্তিবিধান বা তার থেকে পরিত্রাণ কি জীবনে দেখতে পাই যে সাহিত্যে দেখাব? সেভার জীবনবিধাতার উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তিনি হয়তো একভাবে না একভাবে শাস্তি দেন, আমরা খোঁজ রাখিনে। পরিত্রাণও ঘটে হয়তো। আমরা খবর পাইনে। বাধ্য হয়ে মানতে হয় সেই দর্শন, যে বলে পাপই পাপের পরিণাম পুণ্যই পুণ্যের পুরস্কার।

পাপ-পুণ্যের মাঝখানে অনেকগুলি স্তর। যেমন সাদা-কালোর মাঝখানে অনেকগুলি রং। আধুনিক শিল্পী চরমপন্থী নন, তিনি মধ্যপন্থী। তিনি সহসা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হন না। শেষটা অনির্দিষ্ট রেখে দেন। ‘মরাল’ ও ‘ইমমরাল’ ছাড়া আরও একটা কথা আছে। তাকে বলে ‘আমরাল’। আজকালকার আর্টে ‘আমরাল’ চারদিকে ছড়ানো। কিন্তু তাকেই লোকে ভুল করে ঠাওরায় ‘ইমমরাল’। কারণ বহুদিন থেকে লোকের সংস্কার যা ভালো নয় তা মন্দ। ও ছাড়া যে আরও একটা কথা আছে এটা তাদের সংস্কারবিরুদ্ধ।

সমাজে যেমন কতকগুলি জাতকে যুগ যুগ ধরে অস্পৃশ্য ও অশুচি বলে বর্জন করা হয়ে এসেছে, সাহিত্যেও তেমনি কতকগুলি বিষয়কে ও শব্দকে। এসব বিষয়ে লেখা যায় না, এসব কথা লেখনীর মুখে আনা যায় না। এরা অবদ্য, এরা অনুচ্চারণীয়।

বিংশ শতাব্দীর সমাজভাবনা স্বীকার করে না যে হরিজনরা মন্দিরে প্রবেশ করলে মন্দির অপবিত্র হবে বা বিগ্রহকে স্পর্শ করলে বিগ্রহ অপবিত্র হবে। ওরাও তো মানুষ। এ কেমন মন্দির যে মানুষের দ্বারা অপবিত্র হয়! এ কেমন দেবতা যে মানুষ এঁকে অপবিত্র করতে পারে! উলটে পবিত্র করার সাধ্য কি মন্দিরেরও নেই! দেবতারও নেই!

সাহিত্যেরও সেই একই জিজ্ঞাসা। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের সদর দরজা দিয়ে এমন সব বিষয় আর শব্দ নিত্য প্রবেশ করছে যারা খিড়কি দিয়ে অনুপ্রবেশ করতেও সাহস পেত না। এখন কেউ অপাঙক্তেয় বলে সরাসরি বহিষ্কারযোগ্য নয়। সমাজভাবনার মতো সাহিত্যভাবনাও আজকের দিনে আর আচারসর্বস্ব নয়, সেও বিচারসম্পন্ন। বিচারও আর কাজির বিচার নয়, ইতিমধ্যে অনেকরকম সূক্ষ্ম প্রশ্ন উঠেছে। কাজিরাও ততটা নিশ্চিন্ত নন, যতটা আগে ছিলেন। এক দেশের কাজির রায় আরেক দেশের কাজি মানতে চান না। এক যুগের কাজির রায় আরেক যুগের কাজি রদবদল করেন।

ভগবান কারও মুখ চেয়ে সৃষ্টি করেননি। ধ্বংসও যখন করেন তখন কারও মুখ চেয়ে নয়। শিল্পীরাও যে যার আপন সীমানার মধ্যে সৃষ্টি করে থাকেন। বিশ্বের এক-একটি প্রকোষ্ঠে শিল্পীরাও স্রষ্টা। তাঁরাও কারও মুখ চেয়ে সৃষ্টি করার পাত্র নন। যাঁর পছন্দ হবে না তিনি পড়বেন না বা দেখবেন না। কিন্তু সাধারণত পাঠকের বা দর্শকের অভাব হয় না। বরঞ্চ তাঁদের ঠেকিয়ে রাখবার জন্যেই বই বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু আখেরে ঠেকিয়ে রাখা যায় কি? পড়বার মতো হলে লোকে পড়বেই, দেখবার মতো হলে দেখবেই। হয়তো তারপর ফেলে দেবে। কিন্তু পরের কথায় ফেলে দেবে না।

মুসলমানদের মধ্যে একটা কথা আছে—

 মিয়া বিবি রাজি

 কী করবে কাজি?

লেখক ও পাঠক যদি একমত হন তাহলে সমালোচক বা বিচারক বা সরকার কীই-বা করতে পারেন! মিয়া আর বিবি যেমন বিয়ে করতে চাইলে বিয়ে করেন লেখকও তেমনি লেখেন, পাঠকও তেমনি পড়েন; কারও জন্যে কিছু আটকায় না।

লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার এখন ইংরেজরা লাখে লাখে পড়ছে। বখে যাবার ভয় ভেঙে গেছে। ভয়টা যে অমূলক ছিল তা আমি বলব না। কমবয়সিরা সত্যি বখে যেতে পারত। এখনও পারে। ভবিষ্যতেও পারবে। কিন্তু তা বলে প্রাচীন মূর্তির গায়ে তো কেউ ঘেরাটোপ জড়িয়ে রাখে না। সমাজকে ভয় অতিক্রমণের শক্তি অর্জন করতে হয়। এটা রসের খাতিরে, রূপের খাতিরে। নয়তো কোণার্ক বা খাজুরাহো আর কখনো গড়া হবে না।

লেডি চ্যাটার্লির কথাই ধরা যাক। ওর সম্বন্ধে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, ও-বই লেখার সত্যি কি কোনো দরকার ছিল? দরকার ছিল মেনে নিলে দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে, ওভাবে না লিখে কি অন্যভাবে লেখা যেত না? ও-ভাষায় না লিখে অন্য ভাষায়? ওই যে প্রশ্ন দুটি ওদের উত্তর দিতে পারতেন একমাত্র লরেন্স। তাঁর অবর্তমানে দিতে পারেন লরেন্সের পক্ষপাতী পাঠক, যদি পাঠকদের পাঠ করার সুযোগ দেওয়া হয়। সুযোগ পাবার পর ইংল্যাণ্ডের পাঠকদের ব্যবহার দেখে মনে হয় তাঁরা প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘হ্যাঁ’ আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ‘না।’

যেকোনো সাহিত্যসৃষ্টি সম্বন্ধে ওই দুটি প্রশ্নই সত্যিকার প্রশ্ন। বিচারকরা যদি বিচারকের আসনে না বসে পাঠকের স্থানে বসেন তাহলে তাঁদের সেই পাঠকসত্তাই সত্যিকার উত্তর দেবে। কিন্তু সাধারণত দেখা যায় তাঁরা সমাজের মুখ চেয়ে নীতিবোধের নিকষ হাতে নিয়ে রুচিবোধের দ্বারা চালিত হয়ে বিচার করেন। চূড়ান্ত মীমাংসার ভার কিন্তু কাজির উপর নয়, বিবির উপর। রসিকের উপর।