আধুনিক না আদিম

আধুনিক না আদিম

আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়তে পড়তে সংশয় জাগে। এসব ব্যাপার কি আধুনিক না আদিম? হতে পারে বর্তমান শতাব্দীতেই ঘটেছে। কিন্তু খোসা ছাড়িয়ে দেখলে যা পাই তা একালের নয়, আদ্যিকালের শাঁস। খোসার জন্যে নয়, শাঁসের জন্যেই সে-সাহিত্য উপভোগ্য।

মাঝখানে বহু শতাব্দী কেটে গেছে। সভ্যসমাজ মাত্রেই মানা দিয়ে রেখেছে, সাহিত্যে তোমরা এসব ব্যাপার এনো না। আনাটা পাপ কিংবা অপরাধ। মানা যদি না মানে কঠোর শস্তি পাবে। তা সত্ত্বেও সাহিত্য শুদ্ধাচারী সাত্ত্বিক হয়ে ওঠেনি। সাধারণত কর্মের বর্মচর্ম বা নীতিবাক্যের নামাবলি গায়ে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করেছে ও করিয়েছে।

আধুনিক সাহিত্যিকরা ভন্ডামির ধার ধারেন না। কোদালকে কোদাল বলেন। কেউ কেউ দন্ডিত হলেও বেশিরভাগ পার পেয়ে যান। তাঁদের সাফাই হল বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। খুঁটিয়ে দেখলে ওটা বৈজ্ঞানিকও নয় বাস্তবতাও নয়, আসলে ওটা বহু পুরাতন আদিমতা। সমাজের পরতে পরতে জড়ানো। সভ্যসমাজে আর অসভ্য সমাজে লেশমাত্র প্রভেদ নেই। যা আছে তার নাম সামাজিক শিষ্টাচার। বাইরের পালিশ।

আধুনিকতার সঙ্গে আদিমতাকে কী করে মেলানো যায় সেএক প্রহেলিকা। যখন ধর্মের যুগ ছিল তখন আদিমতার জন্যে খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হত। এখন ধর্ম পিছিয়ে পড়েছে। সামাজিক মতবাদ এগিয়ে গেছে। সামাজিক মতবাদ আদিমকে আধুনিক করতে চায়, আধুনিককে আদিম করতে চায় না—একদিনের জন্যেও না। সেইজন্যে আধুনিক উপাখ্যানের মধ্যে আদিমের গন্ধ পেলে ক্ষুব্ধ হয়। বর্ণচোরা আদিমতা পাঠকদের কামনাপূরণ করলেও সমাজনায়কদের অনুমোদন পায় না।

অথচ কত সহজ ছিল ভারতচন্দ্রের যুগে! সেযুগ ধীরে ধীরে অস্ত গেলেও তার গোধূলি দীর্ঘকাল থাকে। সাহিত্যে না হোক জীবনে।

আমার এক আলাপী তাঁর ছেলেবেলায় এমন একটি দৃশ্য চাক্ষুষ করেছিলেন যা অবর্ণনীয়। বছর ষাটেক আগেকার ঘটনা। কবি রবি তখন মধ্যগগনে। স্বদেশির যুগ। যে সম্প্রদায়ের কথা হচ্ছে সেটি পুরোপুরি স্বদেশি। কলকাতার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে তাদের আখড়া বা আস্তানা ছিল। কীর্তনাদি শুনতে আমার আলাপীর কাকা বা মামা মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন। সঙ্গে নিয়ে যেতেন সাত-আট বছরের বালককে। সেও একজন ভক্ত। বালকটি মুগ্ধ হয়ে কীর্তন বা ভাগবত পাঠ শোনে, খাজা বা গজা প্রসাদ পায়, ঘুমের ঘোরে বা ভক্তিভরে ঢলে পড়ে। কেউ তাকে উপস্থিত বলে গণ্য করে না। একবার তাকে দেখে মনে হল সেঘুমিয়েই পড়েছে। কিন্তু তার ওটা ঘুম নয়, তন্দ্রা। রাত তখন দশটা কি সাড়ে দশটা। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা একটু একটু করে গোপীদের বস্ত্রহরণে পৌঁছোয়।

হলঘরটার একদিকে একটা গাছের মতো বা মাচার মতো কিছু ছিল। এতক্ষণ সেদিকে নজর পড়েনি বালকের। হঠাৎ দেখা গেল কে একজন লাফ দিয়ে সেখানে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে এক ফুঁয়ে বাতি নিবিয়ে দিল। বিজলির বাতি নয়। হলঘরের একধারে নানা বয়সের পুরুষ। অন্য ধারে নানা বয়সের নারী। সবাই ভক্তিমান ও ভক্তিমতী। এতক্ষণ সকলেই সুসংযত ও সুসংবৃত ছিলেন। কিন্তু যেই শ্যামের মুরলীধ্বনি শুনলেন অমনি লাজ মান ভয় বিসর্জন দিলেন। রাশি রাশি শাড়িকাপড় অন্ধকারে গাছের উপর বা মাচার উপর ছুড়ে ফেলা হল।

পুরাণে হয়তো সেইখানেই শেষ। জীবনে কিন্তু সেইখানেই শেষ নয়। অন্ধকারের আড়ালে যে যাকে পায় তাকে টেনে নিয়ে একটু দূরে সরে যায়। যতগুলি গোপী ততগুলি কৃষ্ণ। বালক বুঝতে পারে না বাকিটা কী? শুধু বোঝে সেটাও একপ্রকার হরির লুট। ওর সমবয়সি কেউ নেই। থাকলে সেও হয়তো লুট করত বা লুট হত।

জিজ্ঞাসা করিনি, ওরা ওদের শাড়িকাপড় ফিরে পেল তো? চিনে নিল কী করে? বাতি জ্বলে ওঠার আগে না পরে? শুনতে শুনতে এমন বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছিলুম যে বাকস্ফূর্তি হয়নি।

শান্তশিষ্ট সামাজিক মানুষ। ছেলেমেয়ের বাপ, ছেলেমেয়ের মা। হয়তো ঠাকুমা, ঠাকুরদা। শুদ্ধাচারী ধার্মিক। পরকালের ভয় আছে। কিন্তু ওই যে ওদের সাধনা। লাজ মান ভয় ত্যাগ করতে হবে। লাজ মান ভয়, তিন থাকতে নয়।

সমাজে এরূপ সাধনার স্বীকৃতি কোনোদিন ছিল না। তবু সাধনাটা ছিল ও নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে নানারূপ ছিল। এখনও থাকতে পারে। খোঁজ করিনি। কথা হল সমাজের নীতি আর ধর্মের রহস্য সবসময় এক নয়। আর ধর্মের রহস্যকে রূপক বলে ব্যাখ্যা করলেও তা সব ক্ষেত্রে রূপক নয়। সেও বস্তুগত তথ্য। তাকেও চাক্ষুষ করা যায়। কিন্তু তার জন্যে হয়তো সাত বছরের খোকা হতে হবে ও নিদ্রার ভান করতে হবে। ধার্মিকদের প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া যাবে না। মন্ত্রগুপ্তি তাঁদের নিয়ম।

ধর্মের রহস্যের মধ্যে আদিম যদি আত্মগোপন করে থাকে তবে মধ্যযুগে যা সত্য ছিল আধুনিক যুগেও তা সত্য। যুগ পরিবর্তনে তার এমন কিছু ঘোরতর পরিবর্তন হয়নি যে তাকে প্রাগৈতিহাসিক বলে অপাঙক্তেয় করতে হবে।

ধর্মের শামিল ছিল বলে যা এতকাল ধরে চলে আসছিল তাকে ধর্মের থেকে বিযুক্ত করে দেখলে তা কুৎসিত দেখাবেই। তা ছাড়া ধর্মেও তো শিক্ষিতজনের সংশয় জাত হয়েছে। যেখানে ধর্মবিশ্বাস প্রবল সেখানে ধর্মের আনুষঙ্গিকরূপে অনেক কিছুই পার পায়। যেমন নরবলি বা সতীদাহ। এগুলিও প্রাগৈতিহাসিক। এখনও বহু লোক আছে যারা সুযোগ পেলেই সতীদাহ করে, নরবলি দেয়। সেই আদিমের মতো এইসব আদিমও যুগ পরিবর্তন সত্ত্বেও গোপনে বিদ্যমান। ধর্মের থেকে বিযুক্ত করলে এসব হল দস্তুরমতো ‘হরর’ বা বিভীষিকা। পাশ্চাত্য ভূখন্ডে ‘হরর’ উপন্যাস বা গল্প এখন বিপুলসংখ্যকের প্রিয়পাঠ্য। পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যেও তার সংক্রমণ ঘটেছে। ছোটো ছোটো ছেলেদেরও আজকাল ‘হরর’ কাহিনি পড়তে দেওয়া হয়। কেনা-বেচার উপর বিধিনিষেধ নেই।

মানুষের অভিরুচি কেন এমন হল তার উত্তর, জন্ম আর মৃত্যু এ দুটোই সবচেয়ে দুর্ভেদ্য রহস্য। আদিকাল থেকেই মানুষ এর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছে, আজও করে; জন্মরহস্য তাকে আকৃষ্ট করে এক প্রান্তের আদিমের দিকে। মৃত্যুরহস্য আরেক প্রান্তের আদিমের দিকে। আকর্ষণ অতি স্বাভাবিক ও অতি প্রচন্ড বলেই আধুনিক সাহিত্যেও আদিমের প্রতিফলন ঘটে। তবে ও-জিনিস সাহিত্য না অসাহিত্য সেটাও একটা প্রশ্ন। যেমন ধর্ম না অধর্ম এটাও একদা একটা প্রশ্ন ছিল।

বলতে পারা যায় আজকের দিনে ধর্মের স্থান নিয়েছে সাহিত্য। সাহিত্যের নামে অনেক কিছুই পার পেয়ে যাচ্ছে। তা বলে বহিষ্কারনীতি অবলম্বন করতেও মন সায় দেয় না। ইউরোপে ধর্মান্ধদের প্রতাপ এককালে প্রভূত অবিচার ও অনিষ্ট করেছে। ডাইনি শিকার ও ভিন্নমতের ব্যক্তিদের জীবন্ত দহন হাজার বছর ধরে চলেছিল। আধুনিক যুগ তার থেকে মুক্তি দিয়েছে বলেই তার নাম আধুনিক ও তার প্রতিপত্তি এত নিবিড়। ধর্মান্ধদের স্থানে যাঁদের বসানো হবে তাঁরাও যদি সমান অন্ধ হন তবে তো সাহিত্যের আঁচল ধরে সেইসব অবিচার ও অত্যাচারই ফিরে এল।

যে যার নিজের মতো করে বঁাচবে, স্বাধীনতার সারমর্ম এই নয় কি? একবার এটাকে কাম্য বলে মেনে নিলে এক একজনের এক এক রূপরুচিও মেনে নিতে হয়। সেরুচি যদি বিকৃত বা বীভৎস না হয় তবে কেবলমাত্র ইউনিফর্মিটির খাতিরে হস্তক্ষেপ করা উচিত কি? বৈচিত্র্যই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিকৃত বা বীভৎস যদি হয় তবে শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন করতে হবে, সংশোধনের উপায় খুঁজতে হবে, যথাসম্ভব উদার হতে হবে, সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে আইন অনুসারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। স্বাধীনতার অপব্যবহার যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তবে বিচারের আমলে আসবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অভয় দিতে হবে যে স্বাধীনতাই কাম্য।

সুখও যে মানবজীবনের অন্যতম কাম্য এটার ব্যাপক স্বীকৃতিও আধুনিকতার লক্ষণ। সুখের চেয়ে দুঃখের পাল্লা এত ভারী ছিল যে মানুষ পৃথিবীকে দুঃখের স্থান ও স্বর্গকে সুখের স্থান ভাবতে অভ্যস্ত ছিল। জন্ম সার্থক করার মতো সুখ অল্প লোকের কপালেই জুটত। ধরে নেওয়া হত যে সেই ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতীরা পূর্বজন্মে নিশ্চয়ই কোনো সুকৃতি করেছিল। যারা জন্মান্তর মানত না তারা জন্মগত দৈবী অধিকার মানত। অভিজাত কুলে জন্মানোর সুকৃতি। অধিকাংশ লোক ওই একই জন্মের প্রবেশদ্বার দিয়ে এসেছে, অথচ তাদের জন্ম দুঃখের। তারা জন্মদুঃখী। গত চার শতাব্দীর জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষাদীক্ষা চিন্তন ও কর্ম মানুষকে সেই নিষ্ঠুর লৌহ নিয়ম হতে মুক্তি দিয়েছে। যে নিয়ম দুঃখকেই নিয়তি বলে ও সুখকে ব্যতিক্রম বলে মানুষের মন ভোলাত।

সুখের জন্যে আরেক জন্ম অপেক্ষা করতে বা পরলোকের জন্যে ধৈর্য ধরতে আজকাল বিশেষ কেউ রাজি নয়। এটা একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয় কি? সব দেশের আধুনিক সাহিত্যিক ও মনীষীরা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন যে সুখও মানবজীবনের অন্যতম কাম্য। সুখ বলতে ঠিক কী বোঝায় সেটা কিন্তু তর্কের বিষয়। কেউ যদি সন্ন্যাসী হয়েই সুখী হয় তবে তার পথটাও অপথ নয়। তা বলে সেইটেই একমাত্র সুপথ নয়। সন্ন্যাসীশাসিত সমাজে বংশরক্ষা ছিল একটা অপ্রিয় কর্তব্য। কোনোমতে চোখ বুজে সেটা সম্পাদন করতে হত যারা সন্ন্যাসী নয় সেইসব দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের। ওই ‘পাপক্রিয়া’র মধ্যে সুখ আশা করাটাই ছিল অন্যায়। প্রেম? প্রেমের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক? প্রেম হবে অশরীরী, প্রেম হবে নিষ্পাপ।

অপ্রিয় কর্তব্য বনাম প্রিয়মিলন নিয়ে মানুষের মনে যে পুঞ্জীভূত দ্বন্দ্ব ছিল সেটা প্রাচ্যের চেয়ে প্রতীচ্যেই বেশি। সেইজন্যে পাশ্চাত্য সাহিত্যেই তা নিয়ে এত বেশি বিদ্রোহ। বিদ্রোহ থেকে স্বাভাবিক আতিশয্য। এর সবটাই আধুনিকতা নয়। সবটাই যে ধোপে টিকবে তা নয়। পেণ্ডুলাম যেমন এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে যেতে একসময় মধ্যপন্থী হয় সাহিত্যও তেমনি হবে। তখন আদিমের দিকে অতটা ঝোঁক থাকবে না। দেহের সঙ্গে মনের, প্রেমের সঙ্গে কামের, বিবাহের সঙ্গে স্বাধীনতার সামূহিক বোঝাপড়া যখন হবে তখন আধুনিকের সঙ্গে আদিমেরও বিশিষ্ট বোঝাপড়া হবে। তখন সাহিত্যের উপরেও সেবোঝাপড়ার ছাপ পড়বে।

সেই পথেই মানব-মানবীর সুখ ও সার্থকতা। তারই স্বপ্ন দেখতে হবে। কিন্তু বাস্তবের উপর এক চোখ রেখে। দুঃখ শোক আর ব্যর্থতা দিয়ে জীবনের পথ আকীর্ণ।