অখন্ডদৃষ্টি

অখন্ডদৃষ্টি

সূর্যের আলো যেখানে জন্ম নেয় সেইখানেই আবদ্ধ থাকে না, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কত কোটি কোটি যোজন দূরে তার গতি, তেমনি কবির বাক্য সংস্কৃত বা গ্রিক বা চৈনিক ভাষায় জন্ম নিলেও সেই ভাষা যে-দেশের ভাষা সেই দেশেই নিবদ্ধ রয় না। অনুবাদের সাহায্যে দেশে দেশে সঞ্চারিত হয়।

তেমনি যুগে যুগে। বিংশ শতাব্দীতে যার জন্ম সেত্রিংশ শতাব্দীতেও জীবিত থাকতে পারে। এ সম্ভাবনা কবিদের প্রত্যেকের বাক্যে নিহিত। ‘সম্ভাবনা’ বলেছি। ‘সম্ভবপরতা’ বলিনি। যা প্রত্যেকের বেলা সম্ভব তা অত্যল্পের বেলা সম্ভবপর। ডাকা হয় অনেক জনকে, বেছে নেওয়া হয় কয়েক জনকে। কারা সেই ভাগ্যবান তা মহাকালই জানেন।

আর্ট দেশ ও কালে জন্ম নিলেও তার জীবন দেশ ও কালে সীমিত নয়। নিখিল বিশ্ব ও নিরবধি কাল তার স্বদেশ ও স্বকাল। সেইজন্যে আর্টের মূল্য নিশ্চয়ই এক দেশের হয়েও সব দেশের, এক যুগের হয়েও সব যুগের। স্বাদেশিক হয়েও বিশ্বজনীন, ইদানীন্তন হয়েও চিরন্তন। যেক্ষেত্রে নিতান্তই একদেশি বা একযুগী সেক্ষেত্রে আর্ট হয়ে থাকে সংকীর্ণ, প্রাদেশিক, সাময়িক ও কোনো একটা উদ্দেশ্যসিদ্ধির উপায়। সেউদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক-না কেন উদ্দেশ্যসিদ্ধির জিনিসটাই এমন যে আর্টকে তার বাহন করতে গেলে আর্ট খাটো হয়ে যাবেই। গঙ্গার মতো নদী—যাকে দেবী বলে লোকে পূজা করে—যদি জলবিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যে যন্ত্ররাজ বিভূতির দ্বারা শৃঙ্খলিত হয় তবে তার মুক্তধারার জন্যে যারা পিপাসিত তারা বিদ্রোহ করবেই।

আজকের জগতে সাহিত্য হয়েছে নানা বিচিত্র উদ্দেশ্যসিদ্ধির উপায়। অথবা একান্ত প্রাদেশিক বা সামাজিক, সাময়িক বা ক্ষণিক। সাহিত্য যে একটা গোষ্ঠীর সামগ্রী হবে না, হবে জনগণের; এটা একটা বড়ো কথা। কথাটা এই যুগেই শোনা যাচ্ছে সুতরাং এ যুগের মনের কথা। কিন্তু তার আগে তাকে সাহিত্য হতে হবে। সাহিত্য নামধেয় হলেই হবে না। সাহিত্য থেকে যদি সাহিত্যরস চলে যায় তা হলে সেই নীরস পদার্থকে সাহিত্য নামে ডাকলেই কি তা সাহিত্যের মতো সুগন্ধ বিতরণ করবে? জনগণের তৃষ্ণা যদি সাহিত্যের অপেক্ষা রাখে তবে তাদের জন্যে পরিবেশিত সাহিত্যেও থাকবে সাহিত্যের রস, সাহিত্যের সত্য; কেবল কতকগুলি তত্ত্ব বা তথ্য নয়। যা দিয়ে হয়তো সামাজিক প্রগতি বা কল্যাণ হবে, ব্যক্তিগত তৃষাহরণ নয়।

সেরস, সেসত্য বিশ্বজনীন তথা চিরন্তন বলেই মহামূল্য। নয়তো মূল্যহীন বা স্বল্পমূল্য। নিকৃষ্ট পদার্থও রস বলে বিকোতে পারে। সুধাও রস, আবার সুরাও রস, সোমরস। বিষও রস হতে পারে। দশ-বিশ লক্ষ পাঠক বা শ্রোতা বা দর্শক ভোট দিয়ে নিকৃষ্টকে উৎকৃষ্ট করতে পারে না। তাদের অনাদর উৎকৃষ্টকে নিকৃষ্ট করতে পারে না। তার যে মহিমা তা লোকগণনার ঊর্ধ্বে। পুরস্কার বা তিরস্কারের দ্বারা তার ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। সেস্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তাকে মহামূল্য করে দেশাতীত ও কালাতীত মূল্য। সত্য শিব সুন্দর।

আর্টের সত্য শিব সুন্দর ঠিক সমাজের সত্য শিব সুন্দর নয়। সামাজিক বিচার ব্যক্তিগত বিচারের মতো ভুলভ্রান্তিতে ভরা, হ্রস্বদৃষ্টি ও অনুদার হতে পারে। প্রায়ই হয়ে থাকে। ধার্মিকরা তো সত্য শিব সুন্দরকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেবেনই। একালের এক-একটা ইডিয়োলজির প্রভাব এক-একটা ধর্মের মতো। তাদের সত্য শিব সুন্দরকে তারা আর্টের উপর আরোপ করতে চায়। যদি আদৌ মানে। সামাজিক, ধার্মিক বা ইডিয়োলজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আর্টিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় মেলে না, মিললেও হুবহু মেলে না। আর্টিস্টের আর এক জোড়া চোখ আছে। তা দিয়ে সেসত্য শিব সুন্দরকে নিরন্তর দেখছে। কিন্তু অপরের দেখার সঙ্গে তার দেখার এমন কিছু তফাত আছে যার জন্যে সেআর্টিস্ট।

প্রেম, করুণা ইত্যাদি হৃদয়ভাব—কোনো কোনোটা সুনীতির পর্যায়ে পড়ে না, যেমন হিংসাদ্বেষ নিয়ে সাহিত্যের কারবার। শেক্সপিয়রের নাটকে না আছে কী! সমস্তই কি সাধুসম্মত হৃদয়ভাব! না। মানুষের হৃদয়ে যদি হিংসা দ্বেষ থাকে তবে সাহিত্যেও তা থাকবে। তার পরিণাম যদি ভয়ংকর হয় তবে সে-ভয়ংকরও থাকবে। বহুক্ষেত্রে নিরীহ নির্দোষ যারা তাদেরই যত দুঃখ। দুরাত্মার দন্ড নেই এমনও তো দেখা যায়। সাহিত্য কেমন করে সব ক্ষেত্রে দন্ডদান করবে? জীবনের প্রতি সত্যনিষ্ঠ যে সাহিত্য সেজীবনের অন্তরালে কোনো নৈতিক বিধান কাজ করছে কি না তার অনুসন্ধান করে, কিন্তু যতক্ষণ না তার খোঁজ পাচ্ছে ততক্ষণ গতানুগতিকভাবে পাপের সাজা বা পুণ্যের পুরস্কার দেখায় না। কারণ প্রতিক্ষেত্রে পাপের সাজা ও পুণ্যের পুরস্কার দেখা যায় না। জীবন যেমন তাকে তেমনিটি দেখাতে হবে। তবে সরল দৃষ্টিতে নয়, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে। অন্তরালে গিয়ে, গভীরে নেমে। আজকালকার জীবন এমন বিপর্যস্ত যে সাধারণত অশিবেরই জয়, শিবের পরাজয়, অসুন্দরেরই প্রতাপ, সুন্দরের দুর্বলতা চোখে পড়ে। সেইজন্যে আরও গভীরে নামতে হবে, অন্তরালে যেতে হবে, সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখতে হবে, নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে হবে, দিব্যদৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করতে হবে, চোখ বুজে ধ্যান করতে হবে। তা হলেই পাওয়া যাবে সত্যের দর্শন—শিবেরও। সাহিত্যিকের দৃষ্টি নিছক প্রত্যক্ষদর্শী নাগরিকের নয়, অপরপক্ষে নীতিনিপুণের বা ধার্মিকেরও নয়, সমাজপতির তো নয়ই।

জীবন একালে এমন ভাঙাচোরা খন্ডবিখন্ড যে এর একটি সমগ্র রূপ কোথাও দেখবার জো নেই। না শহরে না গ্রামে না প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে না মধ্য আফ্রিকার অরণ্যে না হিমালয়ের গুহায়। ভাঙা কাচের টুকরোগুলোকে একত্র জুড়লে তা সমগ্র হয় না। প্রাচীনরা জীবনের সমগ্র রূপ কোথাও-না-কোথাও দেখতে পেয়েছিলেন বলে তাঁদের মধ্যে একটা প্রশান্তি ছিল। যদিও তাঁদের সকলে কিছু গভীরে যাননি, অন্তরালে যাননি, ধ্যানী ছিলেন না, সূক্ষ্ম দৃষ্টি বা দূরদৃষ্টি লাভ করেননি। আধুনিকরা জীবনের সমগ্র রূপ কোথাও দেখতে পাচ্ছেন না। হয় তাঁদের এটা জুড়ে জুড়ে তৈরি করতে হবে—যা কখনো সমগ্রতার আবিষ্কারের আনন্দ দেয় না—নয় সমগ্রকে সাধনার দ্বারা আবিষ্কার করতে হবে। যাঁরা এর কোনোটাই করেন না তাঁরা নিছক প্রত্যক্ষদর্শী বা পর্যবেক্ষক হয়েই ক্ষান্ত হবেন। কেউ কেউ ধর্মজ্ঞ বা নীতিজ্ঞ হবেন। বহুসংখ্যক হবেন সমাজহিতৈষী, গণহিতৈষী। দু-চার জন তত্ত্বজ্ঞও হবেন। কিন্তু রসজ্ঞ একজনও না। কারণ রসের সাধনা সমগ্রের আবিষ্কারের সাধনা। হৃদয় দিয়ে আবিষ্কারের। সেসমগ্র হয়তো ভান্ডারের মধ্যে ব্রহ্মান্ডের মতো স্থিত। একটি মুহূর্তের মধ্যে অনন্তকালের মতো।

অবচেতন বা অচেতন স্তরের অস্তিত্ব এ যুগের মস্তবড়ো এক আবিষ্কার। সাধারণ চেতনা দিয়ে সব কিছু জানা যায় না। সাধারণ চেতনার আড়ালে কত কী কাজ করছে। সাহিত্যে ও চিত্রকলায় তাকেও ধরতে ছুঁতে হবে। তাকেও ঠাঁই দিতে হবে। বিংশ শতাব্দীর কবি ও চিত্রীদের অনেকেই একপ্রকার স্বপ্নলোকের বার্তা বয়ে নিয়ে আসছেন যেখানকার ধরনধারণ স্বপ্নের মতো খামখেয়ালি বা হেঁয়ালি, অশাসিত, অনিয়ন্ত্রিত, অটোমেটিক, পারম্পর্যহীন, যুক্তিহীন, অর্থহীন। এটা একটা বৈপ্লবিক বিকাশ কিন্তু স্বাধীন বিকাশ নয়। মনোবিজ্ঞানের বিকাশ থেকেই এটার উদ্ভব। চাঁদের আলোর মতো এটা প্রতিফলিত আলোক। তা বলে কম সত্য নয়।

কিন্তু এহো বাহ্য। একে জুড়ে জুড়েও সমগ্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে না। এও একরকম খন্ডদর্শন। অখন্ডদর্শন নয়। মানুষ নিশ্চয় এর চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক বেশি জটিল। জগৎটা নিরালম্ব স্বপ্নলোক নয়। সেটার অস্তিত্ব স্বীকার করলেও সেঅস্তিত্ব সমগ্রের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। সমগ্রের উপর দৃষ্টি থাকলে সেঅস্তিত্বেরও অর্থভেদ হতে পারে। বৃহত্তর যুক্তির অঙ্গীভূত হলে অযৌক্তিক আর অযৌক্তিক নয়। যেটা বল্গাহীন, অটোমেটিক, নিরঙ্কুশ সেটাও প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা শাসিত। আভ্যন্তরিক শৃঙ্খলার আয়ত্তাধীন। বিজ্ঞানীরা ততদূর না গেলেও শিল্পীরা ততদূর যেতে পারেন, যদি স্বাধীনভাবে যাত্রা করেন। এই যে বিজ্ঞানের আঁচল ধরে চলার মতো স্বাধীনতার অন্তরায়। আর স্বাধীন না হলে শিল্পী তাঁর বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে পারে না। গতানুগতিকের অনুসরণ করে।

প্রাচীন কালে বা মধ্যযুগে বিজ্ঞানের এমন জয়জয়কার ছিল না। বিজ্ঞানের দৌলতে আজ মানুষ কেবলমাত্র আকাশে আকাশে উড়তে পারছে তাই নয়, মহাশূন্যেও বিহার করছে, ডেরা বঁাধার কৌশল ফাঁদছে। একদিন চাঁদেও পৌঁছে যাবে। এর ফলে বিজ্ঞানের গৌরব আর্টের গৌরবকে নিষ্প্রভ করছে। তাতেও কিছু এসে যেত না। কিন্তু অনেকেই প্রত্যাশা করছেন যে নাটক উপন্যাসও বিজ্ঞানের মতো অবজেক্টিভ হবে। সব কিছু মাপাজোখা, যথাযথ, তথ্যসিদ্ধ, দলিলবদ্ধ। কিন্তু হাজার অবজেক্টিভ হলেও তা আনরিয়্যাল হতে পারে। কারণ যেসব সত্য নিয়ে নাটক উপন্যাসের কারবার সেসব স্রষ্টার অনুভূতিও কল্পনাকে বাদ দিয়ে নয়। বিজ্ঞানীর পক্ষে যেটা গুণ নয় দোষ, শিল্পীর পক্ষে সেইটেই গুণ, দোষ নয়। বাল্মীকি যদি ক্রৌঞ্চনিধনে শোক পেয়ে শ্লোক রচনা করা ছেড়ে দিয়ে পাখিটাকে ব্যবচ্ছেদ করে পক্ষিতত্ত্বের সন্দর্ভ লিখতেন, তা হলে সেটা অবজেক্টিভ হত সন্দেহ নেই। কিন্তু কাব্য হত না, নি:সন্দেহ।

একালে যদি কোনো বাল্মীকি থাকেন তাঁর হৃদয় হবে সংবেদনশীল, অপরের দুঃখ দেখে তিনি দুঃখ অনুভব করবেন, তেমনি সুখ দেখে সুখীও হবেন। তিনি অসংকোচে হৃদয়চর্চা করবেন। ট্র্যাজেডির দিকে কমেডির দিকে তাঁর চোখ খোলা থাকবে, দিল খোলা থাকবে। সাধারণের অনুভূতির চেয়ে তাঁর অনুভূতি হবে বহুগুণ প্রখর ও গভীর। অনুভূতির সঙ্গে থাকবে কল্পনা। অনুভূতি শোক পায়। আর কল্পনা তাকে নিয়ে শ্লোক বানায়। একটিকে ছেড়ে আরেকটি বেশিদূর যেতে পারে না।

তা হলে কি নাটক উপন্যাস অবজেক্টিভ হবে না? যথাসম্ভব হবে। না হলেও ক্ষতি নেই। হলে আরও ভালো হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলাফল এখন হোমারের ইলিয়াডের সমর্থন করছে। ট্রয়ের যুদ্ধ নিছক কবিকল্পনা নয়। কুরুক্ষেত্র খনন করলে একদিন হয়তো মহাভারতের সমর্থন পাওয়া যাবে। তা বলে ইলিয়াডকে বা মহাভারতকে কোনো ঐতিহাসিক ইতিহাস বলে স্বীকার করেন না। ইলিয়াড বা মহাভারতের রস ইতিহাসের রস নয়, সুতরাং ঐতিহাসিকদের উপর নির্ভর করছে না তার মূল্য। অথচ যথাসম্ভব অবজেক্টিভ বলে তার মর্যাদাও মানতে হবে। সমসাময়িক জীবনের সঙ্গে নিবিড়তম পরিচয় অখন্ডদৃষ্টির সহায়ক। গ্যেটে তো একই কালে বৈজ্ঞানিকও ছিলেন। বৈজ্ঞানিক তাঁর বেলা শিল্পীর সহযোগী। সহযোগী না হয়ে প্রভু বা গুরু হতে চাইলে মুশকিল। তা হলে আবার সেই ধর্মেও প্রভুত্বের বা গুরুগিরির মতো ব্যাপার হবে। আর্টের ও সাহিত্যের ইতিহাসে যা বার বার হয়েছে।

অখন্ডদৃষ্টির জন্যে সকলের সাহায্য নিতে হবে। বিজ্ঞানের, ধর্মের, নীতির, দর্শনের। কিন্তু শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি যেন আচ্ছন্ন বা বিভক্ত না হয়।