নিষিদ্ধ সৃষ্টি

নিষিদ্ধ সৃষ্টি

সভ্যসমাজে বাস করতে হলে সারাক্ষণ পোশাক পরে থাকতে হয়, যাতে নগ্নতা ঢাকে। যাতে দর্শকের দৃষ্টি পীড়িত না হয়। তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য না ঘটে। তাঁর মনে বিকার না জন্মায়। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষকে অল্পসল্প অসংবৃত হতে দেওয়া হলেও নারীর বেলা সর্বাঙ্গ মুড়ে রাখাই বিধি।

গত শতাব্দীর ইউরোপে এ নিয়ে প্রতিবাদ ওঠে। বর্তমান শতাব্দীতে মেয়েদের পোশাক এত বেশি সংক্ষিপ্ত হয়েছে যে রানি ভিক্টোরিয়া দেখলে মূর্ছা যেতেন। তবে পুরুষদের পোশাক তার সঙ্গে পাল্লা রেখে বদলায়নি। শোধরানোর প্রস্তাব যত বারই উঠেছে রক্ষণশীলতা বাধা দিয়েছে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই এখন পর্দানশিন। অথচ প্রাচীন গ্রিকদের বেলা পুরুষরা ছিল অনেকটা মুক্তদেহ।

নগ্নতার সেই যে গ্রিক আদর্শ সেইটেই ইউরোপীয় শিল্পের মন জুড়ে রয়েছে। মাঝখানে খ্রিস্টান সাধুদের কবলে পড়ে শিল্পীরা গ্রিক আদর্শ ভুলেছিলেন। কিন্তু রেনেসাঁস এসে তাঁদের চোখের উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়। নগ্ন পুরুষমূর্তি গড়তে কারও বাধে না। দেখতে কারও আপত্তি খাটে না। কিন্তু নগ্ন নারীমূর্তি আঁকতে আরও তিন-চার শতাব্দী লেগে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিবসনা নারী আঁকার রেওয়াজ সেই যে শুরু হয় আজও তার বিরাম নেই।

তবে হ্যাঁ, দর্শকের চোখে ধুলো দেবার জন্যে একটা ডুমুরের পাতার বা সেই জাতীয় আবরণের দরকার হয়। একখানা হাত দিয়ে হয়তো চাপা দেয়। তা সত্ত্বেও যা দেখবার তার কতক দেখা যায়। বড়ো বড়ো মিউজিয়ামে এসব চিত্র সযত্নে সংরক্ষিত হয়। লোকে দর্শনি দিয়ে প্রবেশ করে। লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে ধনীরা এসব কিনে ঘর সাজান। প্রখ্যাত শিল্পীরা সত্যের সঙ্গে সৌন্দর্য মিশিয়ে যা গড়েন যা আঁকেন তাকে অশ্লীল বলে অভিযুক্ত করলেও সেঅভিযোগ ধোপে টেকে না। যেটা টেকে সেটা ওই সৃষ্টির হয়ে ওঠা। সভ্যতার পর সভ্যতা ফৌত হয়ে গেছে, তবু শিল্পসৃষ্টি এখনও অম্লান। কারণ সেযে কথা বলছে তা সভ্যতার চেয়েও গভীরতর স্তরের কথা।

সভ্যসমাজ মাত্রেই পোশাকি সমাজ। মানুষ রেখে-ঢেকে কথা বলে। রেখে-ঢেকে ব্যবহার করে। সবসময় সেজেগুজে থাকে। কেবল দেহের দিক থেকে নয়, মনের দিক থেকেও। এটাও একপ্রকার অভিনয়। এই যে কৃত্রিমতা, এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে সভ্য মানুষের ব্যাবহারিক জীবন। তা হলে কি এই জীবনই হবে আর্টের জীবন?

সমাজ হয়তো এর উত্তর একভাবে দেবে। কিন্তু আর্ট সেইভাবে নাও দিতে পারে। সমাজ হয়তো বলবে সভ্যসমাজে বাস করতে হলে মিথ্যার সঙ্গে আপোশ করা চাই। নয়তো মরবে। কিন্তু আর্ট তেমন কথা বলতে রাজি নয়। বললে বঁাচবে না। তেমনি সৌন্দর্য সম্বন্ধে সমাজ হয়তো বলবে বসনভূষণ যত গুরুভার হয় তত সুন্দর দেখায়। আর্ট বলবে যত লঘুভার হয় তত মনোহর। নাচতে নাচতে সম্পূর্ণ নিরাভরণ ও নিরাবরণ হওয়াই সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা।

ব্যাবহারিক জীবনে লোকলজ্জা একটা প্রধান গণনা। কিন্তু আর্টের জীবনে তা নয়। আর্ট যদি লোকলজ্জার ভয়ে জড়সড় হয় তবে তার থেকে জীবনটাই বাদ পড়ে। একটা অলীক অবাস্তব সামাজিক ছলনা বা খেলা কখনো আর্টের জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। যা সমাজের চোখে রেসপেক্টেবল তা আর্টের চোখে সুন্দর বা সত্য হবে এটা দুরাশা। সমাজের চোখে যা শিব তা যে শিল্পীর চোখেও শিব এমন প্রত্যাশাও অত্যাশা।

আসলে এসব শিল্পীর সহজাত ইনটুইশনের উপর ছেড়ে দিলে ভালো হত। তাকেও ঘরসংসার করতে হয়। তাই সেও সব কথা খোলাখুলি বলে না। হাতে রেখে বলে। কিন্তু বলতে চাইলে বলার অধিকার তার আছে। সমাজ হয়তো একদিন নগ্ন সত্য ও নগ্ন সৌন্দর্যকে স্বীকৃতি দিয়ে শিল্পীকে অভয় দেবে। হাজার হাজার বছর এখনও সামনে পড়ে আছে। সত্যতা যদি পোশাক-পরিচ্ছদের বাহুল্য থেকে মুক্ত হয় তবে শিল্পও প্রকৃতির আরও নিকটবর্তী হবে।

আমাদের যুগে আর্টের উপর সভ্যতার কৃত্রিমতা চাপানোর বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ ধূমায়িত হচ্ছে। ইচ্ছে করেই এমন সব বিষয়ে লেখা হচ্ছে যা নিষিদ্ধ, এমন ভাষায় লেখা হচ্ছে যেটা ব্রাত্য। বিদ্রোহের মূলে যদি আমরা যাই ও বিদ্রোহের তাৎপর্য বুঝে তার বক্তব্য মেনে নিই তা হলে নৌকার পালের থেকে বাতাস কেড়ে নিতে পারব। যাঁদের অকারণে বীর বা শহিদ করে তোলা হচ্ছে তাঁরা ‘না’ কথাটার উত্তরে ‘না’ কথাটি বলছেন। প্রথম ‘না’টি ফিরিয়ে নাও। তা হলে দ্বিতীয় ‘না’টিও ফিরে যাবে।

তর্কটা অনেকটাই এইরূপ। ‘তোমরা এসব কথা লিখতে পারবে না। এমন ভাষায় লিখতে পারবে না। খবরদার!’

‘আমরা এইসব কথাই লিখব। এমনি ভাষাতেই লিখব। দেখি কতদিন ঠেকাতে পার!’

‘সমাজের সর্বনাশ হবে। সাহিত্যের সপিন্ডীকরণ হবে।’

‘সমাজ বলতে কতকগুলি নাবালক-নাবালিকা নয়। আর সাহিত্য অত ক্ষীণায়ু নয়।

‘দাঁড়াও, পুলিশ ডাকছি। আদালতে নালিশ ঠুকছি।’

‘সাহিত্যবিচার ওঁদের কর্ম নয়। ওঁরা বিচারের নামে অবিচারই করবেন।’

সাহিত্যের বা শিল্পের অন্তিম বিচার সরকার বা আদালতের হাতে নয়, পাঠকের বা দর্শকের হাতে। পাঠক যদি পড়তে চান কেউ তাঁকে নিরস্ত করতে পারেন না। তেমনি দর্শককে। একদিন-না-একদিন নিষিদ্ধ বই বা ছবির প্রচার হয়। বরঞ্চ নিষিদ্ধ বলেই একটু বেশি করেই হয়। নাবালক ও নাবালিকাদের রক্ষা করার জন্যে বালির বঁাধ তখন কোথায় ভেসে যায়। তা বলে কি তারা ডুবে মরে? তেমন কোনো দুর্ঘটনার খবর আমাদের জানা নেই।

কোন সৃষ্টি সত্যিকার সৃষ্টি আর কোন সৃষ্টি অনাসৃষ্টি তা বিষয় অনুসারে নির্দিষ্ট হতে পারে না। ভাষা অনুসারেও না। অনাসৃষ্টি আপনার কবর আপনি খোঁড়ে। তার জন্যে ঘটা করে কবর খুঁড়তে হয় না। আর সত্যিকার সৃষ্টি একটা-কিছু বলতে এসেছে। তাকে তার বক্তব্য বলতে না দিয়ে কন্ঠরোধ করলে শ্রোতারাই একদিন তার পক্ষ নেবেন। জনমতই তার বাণী শুনতে চাইবে।

তা হলে কি অশ্লীলতারই জিত! না, জয়টা অশ্লীলতার নয়। জয়টা নবজাতকের। যার অঙ্গে হয়তো জন্মের আনুষঙ্গিক পঙ্ক। সেটা প্রকৃতির সঙ্গে মেলে। সভ্যতার সঙ্গে না মিলুক। সভ্যভব্য হতে গিয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াই ভ্রান্তি। অমন করে কাগজের ফুল তৈরি হয়। মাটির ফুল ফোটানো যায় না। ‘শুদ্ধি’, ‘শুদ্ধি’ করে সৃষ্টির গায়ে হাত দিতে গেলে দশের লাভ হয়তো কিছু হবে, কিন্তু সৃষ্টির প্রতিভা যাঁদের নেই, সৃষ্টির মালিক যাঁরা নন, তাঁরা কি প্রকৃত অধিকারী না অনধিকারী? প্রকৃত অধিকার যাঁর তিনি হয়তো কিছু অনিষ্টই করবেন, কিন্তু অনধিকারীকে দিয়ে যা হবে তা সৃষ্টির উৎসমুখে জগদ্দল পাষাণ চাপানো।

ধর্মের নাম করে, নীতির নাম করে মধ্যযুগে এটা হয়েছে। এখন হচ্ছে সমাজের নাম করে, রুচির নাম করে। এতে সমাজ রক্ষা হয়, কিন্তু সৃষ্টি রক্ষা হয় না। আর আমাদের এই আধুনিক যুগে বলবার মতো কথা এত বেশি আর এতরকম যে কয়েকটি নীতিকথা বা তত্ত্বকথা যেমন সাহিত্যের বা আর্টের সম্বল হতে পারে না তেমনি কয়েকটি ধরাবঁাধা সামাজিক ধারণাকে ‘শুদ্ধ’ আর অবশিষ্টকে ‘অশুদ্ধ’ বলে সাহিত্যের বা আর্টের সীমা সংকুচিত করা সঙ্গত হবে না। আর ভাষা তো ভাবেরই উপযোগী হবে। অনুপযোগী হলে শুদ্ধ ভাষারই-বা মূল্য কী? অনেক ক্ষেত্রে অশ্লীল ভাষাই উপযোগী ভাষা।

পাঠকের হাতে একটা মোক্ষম অস্ত্র আছে। তিনি না পড়তে পারেন। সেই যে না-পড়া সেটাই লেখকের পক্ষে মারাত্মক। পাঠকরা যদি অমনোযোগী বা অসহযোগী হন তা হলে লেখকের উৎসাহ নিবে যায় ও তিনি পাঠকের সঙ্গে সন্ধি করতে উদ্যোগী হন। এমন লেখক নেই যিনি পাঠকদের বিতৃষ্ণাকে ভয় না করেন।

তবে এমন লেখকও আছেন যিনি বিশ্বাস করেন যে তাঁর বক্তব্য অবিকৃতভাবে ব্যক্ত করে যাওয়াই তাঁর কর্তব্য। এ যুগে কেউ কান না দিলেও পরবর্তী যুগে দিতে পারেন। লেখা তো কেবল আজকের জন্যেই নয়। কালকের জন্যেও। সেইজন্যে একালের পাঠকদের ওই যে মোক্ষম অস্ত্র তাতে তিনি ডরান না। অবশ্য তাঁর সাংসারিক ক্ষতি কিছু হয়। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির অঙ্গে আঁচড়টি লাগে না। যদি সত্যি তাঁর লেখায় সত্য থাকে, সৌন্দর্য থাকে।

সাধারণত আপত্তি যাঁরা করেন তাঁরা সত্যের দিক থেকে বা সৌন্দর্যের দিক থেকে করেন না। করেন শিবের দিক থেকে। অর্থাৎ সমাজের মঙ্গলের দিক থেকে। বহুজনের হিতের দিক থেকে। তাঁদের কেবলই ভয় আগুন লেগে কারও ঘর না পুড়ে যায়। কারও মাথা না বিগড়ে যায়। কিন্তু বাইবেল বা পুরাণ পড়েও কি কারও অধঃপতন ঘটে না? ঘটতে পারে না? আমার হাতের কাছে রয়েছে স্বর্গীয় সুধীরচন্দ্র সরকার মহাশয়ের পৌরাণিক অভিযান আর স্মিথ রচিত স্মলার ক্ল্যাসিকাল ডিকশনারি। গ্রিক ও রোমক পুরাণের নির্যাস। দেব-দেবী, বীর-বীরাঙ্গনা, ঋষি-ঋষিপত্নী, রাজা-রানি, গন্ধর্ব অপ্সরা প্রভৃতি বিচিত্র চরিত্রচিত্র। তার মধ্যে ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। মন্দকে বাদ দিয়ে ভালোটুকু পরিবেশন করা যেত নিশ্চয়, কিন্তু প্রাচীন কবিরা সেযুক্তি গ্রাহ্য করেননি। সেইজন্যে চরিত্রগুলি এমন জীবন্ত হয়েছে। কোনো একটি মানুষ নির্জলা মন্দও নয়, নিপাট ভালোও নয়। দেহ যখন আছে তখন দেহের আনুষঙ্গিক রিপুগুলোও আছে। তাদের বাদ দিয়ে শুদ্ধি ঘটানো যেন জীবনকে বাদ দিয়ে মৃত্যু ঘটানো।

সরকার বা স্মিথ তেমন শুদ্ধিকর্ম করতে যাননি। পুরাণকর্তারা তো শুদ্ধিকর্মের কথা ভাবতেই পারেননি। ইন্দ্র, চন্দ্র, বৃহস্পতি, তারা, কেউ মৃত নন। জীবিত প্রাণীর মতোই তাঁদের জীবনেও প্রবৃত্তির তাড়না এসেছে, তাঁরা নিবৃত্ত হননি, যা করে বসেছেন তা অকরণীয়। কিন্তু অকরণীয় বলেই কি অকথনীয়? অপ্রকাশনীয়? নইলে সমাজের অহিত হবে? বালক-বালিকারা উৎসন্ন যাবে? লোকের পাপে মতি হবে?

লোকের যেমন পাপে মতি হতে পারে, তেমনি পুণ্যে মতি হতেও পারে। কারণ মহত্ত্বের কথাও তো বিস্তর বর্ণিত হয়েছে। পাপ যারা করেছে পুণ্যও তারা করেছে। আস্ত একটা চরিত্র ভালো-মন্দ দুই করে। ভালোর দিকটা যদি কেউ আদৌ না দেখেন বা না দেখান তবে তাঁর সেই ত্রুটি তাঁর সৃষ্টির অঙ্গহানি ঘটাবে। শিল্পী বা সাহিত্যিক হয়ে থাকলে তিনি তাঁর সৃষ্টির অঙ্গহানি কখনো পছন্দ করবেন না। নিজের ত্রুটি নিজেই সংশোধন করবেন। তাঁর ভুল যদি কোনোদিন না শোধরান তবে বুঝতে হবে তাঁর দৃষ্টিটাই ভ্রান্ত। তাঁর অনাসৃষ্টি কোথায় তলিয়ে যাবে।