আর্ট

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

টলস্টয়ের মতো মহাশিল্পী তাঁর কীর্তির শিখরে বসে আর্টজিজ্ঞাসা লিখে তাঁর আপন সৃষ্টিকেই খর্ব করেছিলেন। এটা আমার মনে লেগেছিল। কারণ আমি ছিলুম তাঁর আনা কারেনিনার মন্ত্রমুগ্ধ।

বিশ বছর বয়সে সেই যে আমার মনে আর্টজিজ্ঞাসা সঞ্চারিত হয় তারই পরিণতি এই ‘আর্ট’। এটি লেখার কল্পনা আমার ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে, যখন আমি সত্যাসত্য রচনায় নিবিষ্ট। খাতার পাতায় নোট করে যাই, কিন্তু প্রবন্ধ আকার দিইনে। চল্লিশ বছর বয়সে বুদ্ধদেব বসুর আহ্বান পাই। তাঁর সম্পাদিত কবিতার জন্যে ধারাবাহিক প্রবন্ধ চাই। বিষয় আর্টের মূলসূত্র।

তখনও আমার বলবার কথা আমারই কাছে পরিষ্কার হয়নি। বুদ্ধদেব বসুর আহ্বানে সাড়া দিলে অপদস্থ হব। তা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলুম। আর কিছু না-হোক সম্পাদকের চাপে নিবিড়ভাবে ভাবতে বাধ্য হব। কিন্তু কয়েকটি প্রবন্ধ লেখার পর দেখি দেশময় অশান্তি। সাম্রাজ্য টলমল। আমার উপরে রাজপুরুষোচিত দায়। কোনোমতে আরও কয়েকটি প্রবন্ধ লিখতে পারলুম। তারপর আমার চোখের সুমুখে দেশ ভেঙে গেল। সেই ভাঙনের দিনে আমার উপরে চাপল আরও দুর্বহ দায়। শেষে সব ছেড়ে দিয়ে দায়মুক্ত হলুম।

ভেবেছিলুম অঢেল অবসর পাব ও যত খুশি লিখব। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে দূরে সরে থাকলেও দেশ থেকে তো বিদায় নিইনি। সাময়িক সমস্যাই আমার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। অনেক দিন পরে ‘অন্তঃসার’ লিখি। কিন্তু তার পরের প্রবন্ধ ‘অন্তঃসৌন্দর্য’ আরম্ভ করে আর এগোতে পারিনে। এবার দেশের দশা দেখে নয়; এবার আমার নিজেরই আইডিয়া স্পষ্ট নয় বলে। জোর করে তাকে স্পষ্ট করা যেত না। অপেক্ষা করাই শ্রেয়। প্রজাপতিকে ধরতে ছুঁতে পাকড়াতে ও পিনবদ্ধ করতে এগারো বছর লাগল।

ওই প্রবন্ধটিকে ডিঙিয়ে যেতে পারলে এ বই কবে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তাহলে বাকিটা ঠিকমতো লেখা হত না। আমার চিন্তার বিবর্তনে ওই প্রবন্ধটি একটি স্টেজ।

আরও কয়েকটা প্রবন্ধ লেখার অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু তাহলে আরও অনেক দেরি হত। যে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে বিশ বছর কি তারও আগে, তাকে আর ফেলে রাখা যায় না। আমার প্রকাশক অতিশয় সজ্জন। তা বলে তিনি চিরকাল ধৈর্য ধরতে পারেন না। তাই এইখানে দাঁড়ি টানছি। সবসময় কিছু হাতে রেখে দেওয়াও আর্ট। হাত একেবারে খালি করে দিতে নেই। তা ছাড়া আমার আর্টজিজ্ঞাসাও অফুরন্ত।

অন্নদাশঙ্কর রায়
১২ নভেম্বর ১৯৬৮

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

আর্ট কথাটি আমি পাই বারো বছর বয়সে সবুজপত্র পড়তে গিয়ে। বাংলা হরফে লেখা এই ইংরেজি শব্দটির অর্থ কী তখন আমি জানতুম না। কিন্তু শব্দটি আমার মনে গেঁথে যায়। কলেজে পড়তে গিয়ে হাতের কাছে পাই টলস্টয়ের বই হোয়াট ইজ আর্ট । কতক বুঝি কতক বুঝিনে। অস্কার ওয়াইল্ড না কার রচনায় পাই ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’। আর্টের জন্যই আর্ট। টলস্টয় কিন্তু এটা সইতে পারেন না। সত্য আর শিব তাঁর কাছে শ্রেয়। সৌন্দর্যই একান্ত নয়। রম্যা রল্যাঁর দৃষ্টি ছিল জনগণের উপরে। শেষবয়সে টলস্টয়েরও তাই। আর্ট যেন তাঁদের জন্যে।

এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে করতে একদিন পাটনা থেকে যাই শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথকে নির্জনে পেয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘Is Art too good to be human nature’s daily food?’ আর্ট কি এতই ভালো যে মানবপ্রকৃতির দৈনন্দিন পথ্য হতে পারে না?

তিনি একটু ভেবে নিয়ে বলেন, ‘তা কী করে হবে? উচ্চতর গণিত কি সর্বজনবোধ্য? আগে সহজ গণিত শিখতে হবে।’

বোঝা গেল যে আর্ট উচ্চতর গণিতের সঙ্গে তুলনীয়। তাহলে তো শুধু বিদগ্ধজনের জন্যে। মন মানে না। বছর চারেক বাদে সুইটজারল্যাণ্ডে গিয়ে রম্যা রল্যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ও সেই একই প্রশ্ন শুধাই। তিনি তা শুনে বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘রেনেসাঁসের যুগে সাধারণ কারিগররাও সুন্দর সুন্দর ভোগ্যসামগ্রী তৈরি করত। সাধারণের জন্যে। সকলেই ব্যবহার করত, সকলেই খুশি হত। আর্ট কতক লোকের বিলাসবস্তু নয়।

নানা মুনির নানা মত শুনে আমি নিজের জন্যে একটা পথ খুঁজে বার করি। আমি পাঠকদের দিকে অর্ধেক দূর যাব। পাঠকরা আমার দিকে অর্ধেক দূর আসবেন। আমি যেমন তাঁদের জন্যে শ্রম স্বীকার করব, তেমনি তাঁরাও আমার জন্যে শ্রম স্বীকার করবেন। বিনা শ্রমে গড়বার মতো লেখা আমার নয়। বিনা শ্রমে আমিও তো লিখিনে। বিশুদ্ধ আর্টের রসাস্বাদন ও রূপভোগের জন্যে জনগণকেও প্রস্তুত হতে হবে। তা সেসাহিত্যই হোক আর সংগীতই হোক আর চিত্রই হোক। যা নিছক জনপ্রিয়, তা রসোত্তীর্ণ ও রূপতীর্থ তথা কালোত্তীর্ণ হয় না। উত্তীর্ণ হওয়াটাই লক্ষ্য।

এই পুস্তকের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে উদ্যোগী হয়ে কার্তিক ঘোষ আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। শিশুসাহিত্য রচনায় ইনি সুনাম অর্জন করেছেন। প্রকাশনায়ও তিনি সার্থকতা অর্জন করবেন আশা করি।

অন্নদাশঙ্কর রায়
১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *