সৃষ্টির স্বাধীনতা
শিল্প সব অবস্থায় স্বাধীন, সবসময় স্বাধীন। কিন্তু শিল্পী তা নয়। শিল্পীকে তার দেশকাল যতটুকু বা যতখানি স্বাধীনতা দেয় ততটুকুই বা ততখানিই সেস্বাধীন। স্বাধীনতার সীমা বাড়িয়ে নেবার জন্যে, স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করার জন্যে, সৃষ্টিকর্মে নিরঙ্কুশ হবার জন্যে শিল্পীরা যুগে যুগে ও দেশে দেশে কম চেষ্টা করেননি। বহু আয়াসে যা অর্জিত হয়েছে তার সংরক্ষণের জন্যেও সজাগ থাকতে হয়।
সৃষ্টির পূর্ণতার জন্যেই সৃষ্টিকরের স্বাধীনতা চাই। নইলে যা সৃষ্ট হবে তাতে জীবনের সর্বাঙ্গীণতা থাকবে না। কতক অঙ্গ অন্ধকারে গোপন রয়ে যাবে। অন্ধকারের বন্ধ কারা থেকে সেকি কোনোকালেই ছাড়া পাবে না? প্রাচীর ভেঙে তাকে উদ্ধার করে আনবে কে? শিল্পী ছাড়া কার উপরে এ দায়িত্ব?
মধ্যযুগের আলকেমিস্টরা যা ভয়ে ভয়ে করতেন আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিকরা তা বুক ফুলিয়ে করছেন। বৈজ্ঞানিকদের স্বাধীনতা অঙ্কুশমুক্ত হওয়ায় জীবনও বহু পরিমাণে অন্ধকারমুক্ত হয়েছে। বিজ্ঞান, বিশেষত মনোবিজ্ঞান শত শত বন্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছে। সেইসব অন্ধকূপে আবদ্ধ সত্য এতকাল পরে বাইরে আসতে পেরেছে।
কিন্তু সৌন্দর্যের মহলে বৈজ্ঞানিকের প্রবেশ নেই। আর সত্যেরও একটা অন্দরমহল আছে যেখানে শুধু শিল্পীজনেরই প্রবেশ। অথচ বৈজ্ঞানিকদের অনুরূপ স্বাধীনতা শিল্পীদের বেলা স্বীকৃত হয় না। পাছে স্বাধীনতার অপব্যবহার হয় ও উন্মার্গগামী শিল্পীরা সমাজকেও উন্মার্গগামী করেন। লোকের ধারণা স্বাধীনতার অপব্যবহার বৈজ্ঞানিকরা করেন না, রাজনীতিকরা করেন না, আর কেউ করেন না—করেন শুধু শিল্পীরাই।
সমষ্টিকে উন্মার্গগামী করার জন্যে এতরকম ও এতগুলো শক্তি কাজ করছে যে শিল্পীরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন তা হলেও উন্মার্গযাত্রার বিরাম হবে না। হতে পারে উনিশ-বিশ। বরঞ্চ শিল্পীরা যদি স্বাধীনভাবে সক্রিয় থাকেন তবে শিল্পের আয়নায় আপনার মুখ দেখে সমাজ শিউরে উঠবে, হুঁশিয়ার হবে, রাশ টেনে ধরবে আশা করা যেতে পারে।
প্রাচীনরা দেবতা ও দানব কল্পনা করে জীবনের একটা ব্যাখ্যা পেয়েছিলেন। তেমনি স্বর্গ ও নরক কল্পনা করে মানুষের নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আধুনিকরা দেখছেন মানুষই দেবতা, মানুষই রাক্ষস, মানুষের অন্তরেই স্বর্গ আর নরক, বাইরেও তাই। এখন একথা শিল্পীরা যদি না বলেন তো বলবে কে? বলতে হলে খোলাখুলিই বলতে হয়। সবটাই বলতে হয়। ঠারেঠোরে আভাসে ইঙ্গিতে নয়।
মানুষের স্বার্থেই মানুষকে বলার দরকার যে, জীবনটা যেন একটা ভাসমান তুষারশৈল। সমুদ্রের উপরে তার চূড়াটুকুই দৃশ্যমান। আর সব জাহাজের লোকের অগোচর। যাত্রীরা তো পরম উল্লাসে নাচ গান হল্লা করছে আর নাবিকরাও পরম নির্ভয়ে দুর্বার বেগে ইঞ্জিন ছুটিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ ও কী! কই, টাইটানিক কোথায়! টাইটানিক চলে গেছে আটলান্টিক মহাদেশের সন্ধানে। কয়েকটি নারী ও শিশুকে লাইফবোটে নামিয়ে দিয়ে।
মানুষকে বোঝানোর দরকার যে, তুষারশৈলের দৃশ্যমান অংশটুকুই জীবন নয়। যা তার দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে তা যদি আমি দেখতে পাই তো আমার মানবিক কর্তব্য তাকে দেখানো। তাতে হয়তো সেএমন শক পাবে যে মিথ্যাবাদী বলে আমাকেই এক ঘা কষিয়ে দেবে। কিন্তু সেআপনি বঁাচবে কোন জাদুবলে! সত্যই তাকে বঁাচাতে পারে। পূর্ণ সত্য।
আধুনিক সাহিত্যিকের আসল জোর এইখানেই। আধুনিক সাহিত্যিক অনুসন্ধিৎসু। সেধরে নেয় না যে যত কিছু জানবার সব জানা হয়ে গেছে বা যত কিছু বলবার সব বলা হয়ে গেছে। সেধরে নেয় না যে নাবিকরা সবজান্তা, ক্যাপটেন অভ্রান্ত। সেঅন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হুল্লোড় করবার মতো নিরুদবিগ্ন নয়। তার নিজস্ব একটা যন্ত্র আছে, যা দিয়ে সেতুষারশৈলের মগ্ন অধোভাগ দেখতে পায়। যা দেখেছে তার কথা যদি সেনা বলে তো কে বলবে? বলতে তাকে হবেই। সেটাই তার মানবিক কর্তব্য।
অখন্ড জীবনের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া ও দেওয়া, এই হচ্ছে একালের সাহিত্যিকদের সাধনা ও সাধ্য। এই তাঁদের লক্ষ্য ও মোক্ষ। বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে না গেলে, বিচিত্র আস্বাদন না পেলে কেউ পরিণত বা পরিপক্ব হয় না। তেমনি ভাষা বা রূপ নিয়ে বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষা বিনা কেউ সুদক্ষ হয় না। শতমারি ভবেৎ বৈদ্য, শিল্পেও এই নিয়ম খাটে। বার বার ব্যর্থ হতে হতেই নিশানা অব্যর্থ হয়। শিল্পের বা সাহিত্যের আর কোনো রাজপথ নেই।
আদিরস আদিকাল হতেই জীবনের তথা সাহিত্যের অঙ্গ। তাকে বাদ দিয়ে বা তুচ্ছ করে জীবনও হয় না, সাহিত্যও হয় না। সব দেশেই সব যুগেই মোটামুটি এটা স্বীকৃত। আমাদের সমসাময়িক কালে নতুনের মধ্যে এই হয়েছে যে, মনোবিজ্ঞান ও মনোবিশ্লেষণ সাহিত্যকেও স্পর্শ করেছে। বদ্ধমূল সংস্কার বা ইনহিবিশন একে একে ভেঙে গেছে ও যাচ্ছে। আরও যাবে। সাহিত্যিকের সংস্কারমুক্তির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আরও দেখা দেবে। নইলে জীবনের রহস্যভেদ করা যাবে না। জীবনের ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে সেকালের সেই ধার্মিক ব্যাখ্যা বা গত শতকের সেই নৈতিক ভাষ্য কেউ মেনে নিতে রাজি নয়।
জীবন সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা একদা আমাদের দেশের একদল সাহিত্যিককে বসতি অভিমুখী করেছিল। চল্লিশ বছর পরে তেমনি আরেক দলকে মনোরাজ্যের আণ্ডারগ্রাউণ্ডের দিকে টানছে। তাঁরা যদি সেখান থেকে উদ্ধার করে আনতে পারেন এমন কোনো অবদমিত সত্য যা জেনে রাখবার আর মনে রাখবার মতো, তা হলে তাঁদের জীবনজিজ্ঞাসা অপরের জীবনজিজ্ঞাসার পরিপূরক হবে। সেইভাবে সাহিত্যের ভান্ডারে পরিপূর্ণতা আসবে।
মানুষ নামক সত্যটি পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের পূর্বে যে পরিমাণ সরল ছিল তার পরবর্তী অধ্যায়ে সেপরিমাণে নয়। দান্তে থেকে শেক্সপিয়র কতটুকু ব্যবধান! তবু জটিলতার দিক থেকে দুস্তর। তেমনি ফ্রয়েডের পূর্বে ও পরে। আধুনিকরা যদি মনের পাতালে নামতে ভয় পান তবে আমি আশ্চর্য হব না। কারণ আমি নিজেও নি:শঙ্ক নই। অবচেতনের কেঁচো খুঁড়তে কে জানে কখন কেউটের ছোবল খেতে হবে। কিন্তু কেউ যদি অগ্রণী হতে চান আমি তাঁকে পেছন থেকে আটকাব না। তবে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দেব যে, রোগ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হলে যেমন স্বাস্থ্যসম্পন্ন ডাক্তার হওয়া চাই তেমনি পাতালে পা দেবার আগে স্বর্গের থেকে শক্তি সংগ্রহ করা চাই। বিষের চিকিৎসায় অমৃত কাজে লাগে।
যাঁর আধ্যাত্মিক জীবন বলতে কিছু নেই, সে-জীবনে কিছু জমেনি, তাঁর পক্ষে ওসব বিপজ্জনক বিষয় নিয়ে কারবার করা সমীচীন নয়। তা বলে তাঁর স্বাধীনতায় বাদ সাধতে যাওয়া ঠিক নয়। কতক লোক অগ্রণী না হলে তো কোনোদিন কোনো নতুন সত্যই আবিষ্কৃত হত না। কোনো বন্ধ দুয়ারই খুলত না। সাহিত্যও আমাদের অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যের মতো কয়েকটা মামুলি ছন্দ নিয়ে পদচারণ করত। অথবা স্ত্রীপাঠ্য ও বিদ্যালয়পাঠ্য রচনায় নিবদ্ধ হত।
আধুনিক দর্শন যেমন আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে আপনাকে মিলিয়ে নিচ্ছে, আধুনিক সাহিত্যও তেমনি করে আপনাকে মিলিয়ে নেবে। জীবন যদি অবিভাজ্য হয়ে থাকে তবে তার সেই অবিভাজ্যতা দর্শন বিজ্ঞান সাহিত্য প্রভৃতি ভাগ-বিভাগকেও প্রভাবিত করে একসূত্রে গাঁথবে। কিন্তু সাহিত্য তা বলে স্বধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়ে দর্শন বা বিজ্ঞান বনে যাবে না। সেতার পারম্পর্য রক্ষা করেই বিবর্তিত হবে।
যেসব কথা বিজ্ঞানের মুখে দিব্যি মানায় সেইসব কথাই সাহিত্যের মুখে শুনলে সমাজরক্ষীরা হইহই করে তেড়ে আসেন। বিজ্ঞানের বই হলে আদালত ছেড়ে দেন, কিন্তু একই বিষয়ে সাহিত্যের বই হলে সাজা দেন। ক্ষতি কি বিজ্ঞানের বই কিছু কম করে? জীবনের তথ্যগুলো বিজ্ঞানে শ্লীল আর সাহিত্যে অশ্লীল এটা কি একটা মান্য করবার মতো যুক্তি? এ যুক্তি পরিত্যক্ত না হলে সাহিত্যের বাড় থেমে যাবে।
‘সত্য কখনো শ্লীল-অশ্লীল হতে পারে না। তবে তার পরিবেশন শ্লীল-অশ্লীল হতে পারে।’ এ হল আমাদের স্বনামধন্য এক লেখিকার উক্তি। বিষয়ে তাঁর আপত্তি নয়, ভাষায় ও ভঙ্গিতে আপত্তি। এক্ষেত্রে আমি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারিনি। কারণ তা হলে জেমস জয়েস, ডি এইচ লরেন্স প্রমুখ যুগান্তকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা বা দন্ডাদেশ সমর্থন করতে হয়। পরবর্তীকালে তাঁদের দুষ্কৃতিই হয়েছে তাঁদের কীর্তি। সাহিত্যে কী ছিল না তাঁরাই প্রথম এনে দিলেন। কেন সত্যকে অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে এলেন, সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ও আর সকলের মুক্তি ঘটালেন, ভাবীকালের পাঠক এই লাইনেই বিচার করবেন। পরিবেশনের স্বাধীনতায় আপত্তি করবেন না।
সাহিত্যে যাকে শ্লীল-অশ্লীল বলা হয়ে থাকে আসলে তা সাহিত্যের উপর সমাজনীতির আরোপ। সমাজের পক্ষে যা শুচি তারই নাম শ্লীল, যা অশুচি তারই নাম অশ্লীল। তার সঙ্গে কিছুটা রুচির প্রশ্নও জড়িয়ে থাকে। ভদ্র ও ভদ্রাদের রুচি। শিল্পীরাও সামাজিক মানুষ, তাঁদের রুচিও ভদ্রজনের রুচি, কিন্তু কীসের দাবিকে তাঁরা অগ্রাধিকার দেবেন? সত্যের দাবিকে না সমাজহিতের দাবিকে, সৌন্দর্যের দাবিকে না ভদ্ররুচির দাবিকে? নিশ্চয় সত্যের ও সৌন্দর্যের দাবিকে।
যেমন সাদা আর কালো বলে দুটি মাত্র রং নেই, মাঝখানে নীল লাল হলদে প্রভৃতি আরও অনেকগুলি রং বা শেড, তেমনি শুচি আর অশুচি, ভালো আর মন্দ, সুরুচিকর আর কুরুচিকর বলে দুটি মাত্র গুণ নেই, মাঝখানে আছে আরও কতরকম গুণ বা স্তর। পাপ-পুণ্যের মাঝখানেও তেমনি। আমরা যে জগতের বা যে জীবনের কথা বলি সে-জগৎ বা সে-জীবন দুটি মাত্র রং দিয়ে আঁকা যায় না। আঁকলে তার প্রতি সুবিচার করা হয় না। সমগ্রতার উপর নজর রেখে আঁকতে বসলে নীতিনিপুণ বা রুচিরোচন অঙ্কনরীতি পরিহার করতে হয়। তা বলে নীতির দাবি বা রুচির দাবি উড়িয়ে দেবার নয়। সামাজিক মানুষ হিসাবে আমরা নীতির দাবি মানতে বাধ্য। তেমনি ভদ্রজন হিসাবে রুচির দাবি। কিন্তু যখন আমরা স্রষ্টা তখন আমরা বিশ্বস্রষ্টার দোসর। তখন আমাদের সামনে আরও বড়ো দাবি।
তিরস্কার বা পুরস্কার, রাজদন্ড বা রাজপ্রাসাদ, স্রষ্টার কাছে এসব গণনা অবান্তর। এসব লোক কে-ই বা ক-দিন থাকবে! সৃষ্টির আয়ু আরও বেশি। আমাদের যে সৃষ্টির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এর যেন সদব্যবহার করতে পারি। নয়তো যিনি দিয়েছেন তিনিই কেড়ে নেবেন। আর্টের নিষ্ঠুরা দেবীর করুণা লাভ করা কি সহজ কথা! কে তাঁকে অশ্লীলতা দিয়ে ভোলাবে! আর কেই-বা শ্লীলতা দিয়ে!