ভূমিকা – বাংলার রেনেসাঁস
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯৬৭ সালের লীলা বক্তৃতাবলি আমি ১৯৭১ সালে প্রস্তুত করি। বিষয়টা আমিই নির্বাচন করেছিলুম—বাংলার রেনেসাঁস। এ বিষয়ে আমি তিনটি বক্তৃতা দিই। পরে সেগুলিকে প্রবন্ধের আকার দিতে আরও সময় নিই। এখন পুস্তকাকারে প্রকাশ করছি। পরিশিষ্ট হিসাবে জুড়ে দিচ্ছি অপর একজনের বইয়ের জন্য লেখা ভূমিকা, আমার বক্তব্য যাতে আরও পরিষ্কার হয়।
বহু চিন্তাশীল ব্যক্তির ধারণা গত শতাব্দীতে আমাদের দেশে প্রথমে দেখা দেয় রেনেসাঁস, তারপরে রিভাইভাল। অনেকের মতে রিভাইভালও রেনেসাঁসের অন্য নাম। আমাদের রেনেসাঁস যদি ইটালির সঙ্গে আদৌ তুলনীয় না হত তাহলে কেউ একে রেনেসাঁস নাম দিয়ে শব্দটির অপব্যবহার করতেন না। অপরপক্ষে রেনেসাঁস বলে অভিহিত হলে ইটালির সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে এতটা প্রত্যাশা করলে একদেশের সঙ্গে আরেক দেশে ষোলো আনা মিল কল্পনা করতে হয়। ইতিহাসে কোনো দুটো রেভোলিউশনই একইরকম নয়। তা হলে কোনো দুটো রেনেসাঁসই-বা কেন একইরকম হবে? মাটি আলাদা, মন আলাদা, ইতিহাস আলাদা, ঐতিহ্য আলাদা। বাংলার রেনেসাঁস তাই ইটালির অনুরূপ হয়নি। তা সত্ত্বেও রেনেসাঁস বলে তাকে চেনা যায়। বিভ্রান্তি ঘটে রিভাইভাল যখন রেনেসাঁসের নাম অধিকার করতে চায়।
আমার নিজের ধারণা পঞ্চাশ বছর আগে যেমনটি ছিল এখন তেমনটি নয়। ধীরে ধীরে তার বিবর্তন হয়েছে। এখন আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, আমাদের রেনেসাঁস এসেছিল সাত সমুদ্র পার হয়ে পশ্চিম ইউরোপ থেকে। কালপারাবার পার হয়ে প্রাচীন ভারত থেকে নয়। প্রাচীন ভারত থেকে যেটা আসে সেটার নাম রিভাইভাল। দুটো স্রোতই প্রায় সমসাময়িক, কিন্তু সমান প্রবল নয়। প্রথম দিকে রেনেসাঁস ছিল প্রবলতর। পরবর্তীকালে রিভাইভালই প্রবলতর হয়। আরও পরে রেনেসাঁসের উপর থেকে দেশের লোকের মন উঠে যায়। ওটা যেন স্বাদেশিকতা ও স্বাধীনতাকামনার বিপরীত মেরু। আরও পরে বুদ্ধিমানেরা আবিষ্কার করেন যে ওটা বিদেশি ধনতন্ত্র আর স্বদেশি বুর্জোয়াচক্রের ভাববিলাসিতা। সত্যিকার রেনেসাঁস নয়। মিথ্যে ফাঁকি।
এতকাল আমরা যেটাকে বাংলার রেনেসাঁস বলে ঠিক করেছি বা ভুল করেছি সেটা ছিল অবিভক্ত বাংলার ব্যাপার। পার্টিশনের পর পূর্ব বাংলা—এখন তো বাংলাদেশ—নতুন করে জেগে ওঠে। সেখানে দেখা দেয় দ্বিতীয় এক রেনেসাঁস। প্রথম রেনেসাঁসে নায়কদের মধ্যে ইউরোপীয় ছিলেন, খ্রিস্টান ছিলেন, কিন্তু মুসলমান ছিলেন না। দ্বিতীয় রেনেসাঁসের নায়করা প্রায় সকলেই মুসলমান। এবার তাঁরা পা মিলিয়ে নিচ্ছেন। প্রথম রেনেসাঁস ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। দ্বিতীয় রেনেসাঁস হচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক। এর পূর্বাভাস পার্টিশনের পূর্বেই সূচিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীমহলে যখন জগৎ সম্বন্ধে, জীবন সম্বন্ধে, মানুষ সম্বন্ধে, ধর্ম সম্বন্ধে নতুন করে অনুসন্ধিৎসা জাগে। তখন একে বলা হত ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন। এর নায়কদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন আবুল হোসেন ও কাজি আবদুল ওদুদ। গত শতাব্দীর ডিরোজিয়ো ও তাঁর ‘ইয়ংবেঙ্গল’ গোষ্ঠীর সঙ্গেই এঁদের তুলনা। এঁরাও গোঁড়াদের বিষনজরে পড়েন। এক্ষেত্রেও প্রবাহিত হচ্ছিল রিভাইভালের স্রোত—মুসলিম রিভাইভালের। রিভাইভালই প্রবলতর, রিভাইভালের স্রোতের তোড়ে দেশ ভেঙে যায়। তারপরে যখন ভাষার প্রশ্নে একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদের রক্তে ঢাকার মাটি রঞ্জিত হয় তখন সে-মাটিতে জন্ম নেয় দ্বিতীয় রেনেসাঁস। মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের রক্ত তাকে আরও শক্তি জোগায়। ‘বাংলার রেনেসাঁস’ না বলে এর নাম রাখা যাক ‘বাংলাদেশের রেনেসাঁস’।
প্রথম রেনেসাঁস এখনও অসমাপ্ত। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্ধানে সেনি:শেষিত হয়নি। আমাদের মনে জগৎ সম্বন্ধে, জীবন সম্বন্ধে, মানুষ সম্বন্ধে, সমাজ সম্বন্ধে অফুরন্ত জিজ্ঞাসা। তাই আমাদের রেনেসাঁস চলছে, চলবে।
অন্নদাশঙ্কর রায়
১৪ আগস্ট ১৯৭৪
পুনশ্চ,
দ্বিতীয় সংস্করণে সংযোজিত বাংলা ‘রেনেসাঁসের নবপর্যায়’ ও ‘বাংলার রেনেসাঁস: পুনর্ভাবনা’।
অন্নদাশঙ্কর রায়
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৮০