রস আর রূপ

রস আর রূপ

প্রথমে আসে রসের উপলব্ধি, তারপরে রূপের উপলব্ধি। আমি যখন একটি কবিতা বা গল্প লিখে শেষ করি তখন কবিতাটির বা গল্পটির রূপ দর্শন করি। তার আগে ঘটে গেছে রসোপলব্ধি। রসোপলব্ধি যদি আপনাতে আপনি পরিসমাপ্ত হত তাহলে কবিতা বা গল্প লেখা হত না, রূপোপলব্ধি হত না। রূপোপলব্ধি না হলে আমি রসিক হতুম, কিন্তু রূপকার হতুম না। আমি যে রসিক তার প্রমাণ আমার রসোপলব্ধি। আমি যে রূপকার তার প্রমাণ আমার রূপোপলব্ধি। শিল্পীমাত্রেই একাধারে রসিক ও রূপকার।

বললুম বটে কবিতাটির রূপ, গল্পটির রূপ। বলতে পারতুম রসের রূপ। রস যখন একের অন্তর থেকে অপরের অন্তরে যায় তখন রূপ ধরে যায়। কবিতারূপ, কাহিনিরূপ, চিত্ররূপ, নৃত্যরূপ, এমনি কতরকম রূপ। আমি যখন রসদান করি তখন রূপদান করি। নইলে দান করা অসম্ভব হত। রস দিতে হলে রূপ দিতে হয়। রূপ না দিলে রস দেওয়া হয় না। অন্তরের রস অন্তরেই আবদ্ধ থাকে। মুক্তি পায় না। শিল্লীর মুক্তি নির্ভর করে রসের মুক্তির উপর। আর রসের মুক্তি নির্ভর করে রূপের সৃষ্টির উপর। সৃষ্টি মানেই রূপসৃষ্টি।

রূপসৃষ্টি থেকে মনে হতে পারে রূপ আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। কিন্তু তা নয়। রূপ হচ্ছে রসের পরিসমাপ্তি। যেখানে রস নেই সেখানে রূপ নেই, যদি থাকে তবে তা প্রাণহীন রূপ। যেমন মূলহীন ফুল। যারা বিশুদ্ধ রূপের পূজারি তারা স্রষ্টা নয়, কারণ সৃষ্টির শেষ কথা যদিও রূপ, সার কথা হচ্ছে রস। পক্ষান্তরে যারা বিশুদ্ধ রসের উপাসক তারাও স্রষ্টা নয়, কারণ সৃষ্টি যেমন মূলহীন ফুল নয় তেমনি ফুলহীন মূল নয়। সাকার ও নিরাকার, রূপ ও রস উভয়বিধ সাধনাই শিল্পীর সাধনা। শিল্পীর অন্য নাম স্রষ্টা।

রস জিনিসটার সংজ্ঞা দেওয়া শক্ত। কেননা রস একটা জিনিসই নয়। যারা বস্তুবাদী রস তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং রসের সাধনা যে তারা স্বীকার করবে এ কখনো আশা করা যায় না। যারা বস্তুবাদী নয় অথচ পদে পদে ইন্টেলেকটের হাত ধরে চলে তারা বিশ্লেষণধর্মী। বিশ্লেষণ করে কেউ কোনোদিন রসের আস্বাদন পায়নি। একটা অখন্ড অনুভূতিকে খন্ড খন্ড করলে তার অখন্ডত্ব হারিয়ে যায়। প্রাণ যদি চলে যায় তো দেহ ভাগ করে কী হবে! ওটা ভোগের উপায় হয়।

রসের সংজ্ঞা জানিনে। শুধু এই জানি যে রস একটা অখন্ড উপভোগ, একটা পরম উপভোগ, অনেকের জীবনে একটা দুর্লভ উপভোগ। সেইজন্যে রসের এত মূল্য। যার মূল্য যত বেশি তার নকল তত বেশি, বিকার তত বেশি। রসাভাব ও রসবিকার দিয়ে কত লোক তাদের রসপিপাসা মেটায়। যেমন ঘোল দিয়ে মেটায় দুধের সাধ। রস এত দুর্লভ বলে রসের সাধকও দুর্লভ। রসের সাধনা হচ্ছে দুর্লভের সাধনা। রসের উপভোগ যাদের জীবনে ঘটেছে তারা অপরকে চায় সেই উপভোগের ভাগ দিতে। ভাগ দিতে গিয়ে দেখে নিজেদের ভাগ তাতে কমে না, বরং বাড়ে। কারণ রস দিতে গেলেই রূপ দিতে হয়। আর রূপদান হচ্ছে রূপভোগ। এটাও একটা উপভোগ। রসের উপভোগ বহুধাবিভক্ত হলে তার সঙ্গে যুক্ত হয় রূপের উপভোগ। কিন্তু এর জন্যেও সাধনা করতে হয়। রসের সাধনার উপর রূপের সাধনা।

রূপের সাধনাও দুর্লভের সাধনা। সকলে তার মূল্য দিতে পারে না বলে তার বিকৃতি অথবা অনুকৃতি এত বেশি। একটি রূপবান কবিতা বা গল্প লিখতে পারা বহু ভাগ্যে ঘটে। কবি কিটস ছিলেন ভাগ্যবান পুরুষ। অকালমরণে তাঁর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। হত না রবীন্দ্রনাথেরও। রসভোগ ও রূপভোগ দ্বিবিধ উপভোগ এঁদের জীবনে ঘটেছিল অদীর্ঘ সাধনায়। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য তাঁকে শেষবয়সেও পরিত্যাগ করেনি, কারণ দ্বিবিধ সাধনাকে তিনি শেষবয়সেও পরিত্যাগ করেননি। এ সাধনা কালসাপেক্ষ নয়, কিন্তু নিষ্ঠাসাপেক্ষ। নিষ্ঠা যেখানে দুর্বল সিদ্ধি সেখানে সুদূর। সেইজন্যে সারাজীবনেও কেউ কেউ রস থেকে রূপে, রসলোক থেকে রূপলোকে উপনীত হয় না।

আগে রসলোক, তার পরে রূপলোক। এই অগ্রপশ্চাৎ জ্ঞানটাও কারো কারো থাকে না। তারা চায় রসলোকের পাশ কাটিয়ে রূপলোকে পৌঁছোতে। আকাশে উড়ে নদী পার হতে। কিন্তু জলে না নেমে হাবুডুবু না খেয়ে পাড়ে যারা যায় তারা একটা পরম উপভোগ হারায়। রসের উপভোগ যাদের হয়নি তারা কীসের ভাগ দিতে যাবে, কেনই-বা যাবে! কে তাদের ডাকছে! দান করবার মতো রস যার হাতে নেই দান করবার মতো রূপও কি তার হাতে আছে? নিষ্ফল রূপচর্চার নাম রূপভোগ নয়। রসহীন কবিতা বা গল্প রূপবান হতে পারে না। হয়তো তাকে রূপবানের মতো দেখায়। সেটা দৃষ্টিবিভ্রম।

রসের জন্যে সাধারণ মানুষের চিত্তে শাশ্বত পিপাসা। তাই এত নৃত্যগীত অভিনয় চিত্র ভাস্কর্য গাথা গল্প। এ পিপাসা কি নিছক রূপ দিয়ে মিটতে পারে! যে রূপ রসের রূপ তার জন্যেও পিপাসা জাগে। সেপিপাসাও শাশ্বত। কিন্তু রসবিরহিত রূপের জন্যে তো পিপাসা নেই। যে রূপ আত্মসর্বস্ব তার যদি কোনো আদর থাকে তো সেটা পিপাসাতৃপ্তির পরে। সেটা হল সাজসজ্জার সামগ্রী। প্রসাধনের অঙ্গ। অলংকার। নিশ্চয় তার একটা নিজস্ব মূল্য আছে। কিন্তু পিপাসুর কাছে নয়, পিপাসামুক্তের কাছে। যে দেশে রসসমন্বিত রূপের অভাব নেই সেদেশে রসবিরহিত রূপের আদর স্বাভাবিক। কিন্তু যে দেশে রস বিরহিত রূপ ভিন্ন আর রূপ নেই সেদেশে তার আদর যেন অনাবৃষ্টির দেশে গোলাপজলের আদর।

অন্ন মানুষের চাই-ই চাই, অন্নের দুর্ভিক্ষ যে কেমন তা আমরা পঞ্চাশের মন্বন্তরে প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু মানুষের তো কেবল অন্নের ক্ষুধা নয়, অমৃতের তৃষ্ণাও আছে। অমৃতের তৃষ্ণা আছে বলেই কোরান বাইবেল উপনিষদ আছে ও থাকবে। এসব যদি যায় তো এসবের স্থান নেবে এই জাতীয় আর কোনো উৎস, জল যার অফুরন্ত। অমৃতের তৃষ্ণা অমৃতেই মিটবে, অন্নে মিটবে না। ভোগোপকরণ হয়তো একদিন সব মানুষের সমান প্রচুর হবে, এবং সেদিন হয়তো অদূরে। কিন্তু অমৃতের পিয়াস তো অমৃত বিনা তৃপ্ত হবে না। ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ।

অমৃতের পিয়াস যাকে বললুম রসের পিপাসা ঠিক সেই জাতীয় না হলেও তারই সঙ্গে তুলনীয়। মেঘদূত ঠিক উপনিষদ বর্গীয় নয়, হ্যামলেট বা টেমপ্লেট নয় বাইবেল বর্গীয়। কিন্তু তার সঙ্গে তুলনার যোগ্য এইজন্যে যে মেঘদূত বা হ্যামলেটের রস বহুকাল ধরে বহু মানবের চিত্ত সরস করেছে ও করবে। সাহিত্য বা সংগীত একটা বিলাস বা মন্ডন নয়। তাকে বাদ দিলে মানুষের একটা পরম উপভোগ বাদ পড়ে। তার থেকে বঞ্চিত হলে মানুষ কী নিয়ে তৃপ্ত হবে! তার স্থান পূরণ করতে পারে কী এমন আছে! ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ।

রস আমাদের চাই-ই চাই এবং অন্য কিছুতেই রসের তৃষ্ণা মিটবে না, সুতরাং রসই দিতে হবে মানুষকে, যদি অন্তরে রসের উপলব্ধি ঘটে থাকে। এটা একটা কর্তব্য। ধর্মও বটে। রসের উপলব্ধি যাতে অবারিত হয় তার জন্যে রসের সাধনা আমাদের নিত্যকৃত্য। কেবল রসের সাধনাই যথেষ্ট নয়। রূপের সাধনাও আবশ্যিক। কিন্তু রস বিরহিত রূপের সাধনা নয়। রসের উপলব্ধি দূরে থাক, রূপের উপলব্ধিও নেই তাতে। কারণ রূপ তো রস থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব তার নাম রূপ নয়, আবরণ না আভরণ। তারও প্রয়োজন আছে, কিন্তু সে-প্রয়োজন প্রাথমিক নয়, সে-প্রয়োজন প্রাথমিক পরিপূরক বা পরিসমাপক নয়। সেটা অতিরিক্ত বা উদবৃত্ত। সেও একপ্রকার উপভোগ, কিন্তু পরম বা চরম উপভোগ নয়। সেইজন্যে তাকে আমি উপলব্ধির কোঠায় ফেলিনে। তবে আমি একথাও মানি যে মানুষের যেমন দেহ আছে তার জন্যে চাই অন্ন, মানুষের যেমন মন আছে তার জন্যে চাই আলো, মানুষের যেমন আত্মা আছে তার জন্য চাই অমৃত, মানুষের যেমন হৃদয় আছে তার জন্যে চাই রস, মানুষের যেমন ইন্দ্রিয় আছে তার জন্যে চাই রূপ—মানুষের তেমনি রুচি আছে তার জন্যে চাই আবরণ বা আভরণ। কারুশিল্পের উদ্ভব হয়েছে মানুষের রুচির দাবি মেটাতে।

কারুশিল্পকে কেন আর্ট বলা হয় না তার কারণ তার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক গৌণ! রুচির সম্পর্কই মুখ্য। সোনার হার বা চুড়ি কার-না ভালো লাগে! কিন্তু সেই ভালো লাগাটা রসোপলব্ধি নয়, সেইজন্যে কারুশিল্পকে চারুশিল্পের আদর্শ দেওয়া হয় না। তা হলেও কারুশিল্পও তো শিল্প। বৃহত্তর অর্থে আর্ট বলতে দোষ কী? স্বর্ণকারের অন্তরে যে রস আছে সে-রস তো রূপায়ণের আর কোনো উপায় পাচ্ছে না। স্বর্ণকার যদি ওই সোনার অলংকারের সঙ্গে তার হৃদয়রস সংমিশ্রণ করে তো সেরূপ স্থলে তাকে স্রষ্টা বলতে ও তার নির্মিতিকে সৃষ্টি বলতে আপত্তি কী? ক্রাফট সেরূপ ক্ষেত্রে আর্ট নয় কেন? গ্রিসদেশীয় পাত্র দেখে কিটসের মনে যে আনন্দ তা কি কেবল ক্রাফট দেখে না ক্রাফটের মধ্যে আর্ট দেখে? কারুশিল্প ও চারুশিল্প বিভিন্নও বটে। ওটা নির্ভর করে হৃদয়রসের যোগ-বিয়োগের উপরে। সেই অনুসারে ওদের রূপও বিভিন্ন বা অভিন্ন। একটা হল রসের রূপ, অপরটির রুচির রূপ। রসরূপ ও রুচিরূপ একাধারে বিধৃত হলে আমরা খুশি হয়ে বলি, এই আর্টিস্ট একজন ক্রাফটসম্যান, এই ক্রাফটসম্যান একজন আর্টিস্ট।