আর্ট কি স্বাধীন
আমাদের দেশের অজানা গুহাচিত্রের চেয়ে বহুগুণ প্রাচীন গুহাচিত্র অন্যান্য দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে বলে শুনি। মানুষের সেই আদিম স্বাক্ষরের সমানবয়সি সমাজ বা ধর্ম ইতিমধ্যে অন্তর্হিত হয়েছে। কারা এঁকেছিল, কাদের জন্যে এঁকেছিল, কেন এঁকেছিল এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। হাজার হাজার বছর কোথায় তলিয়ে গেছে। মাটির উপর দিয়ে বয়ে গেছে জলস্রোতের মতো জনস্রোত। অনধিগম্য বলে কাল এতদিন ধ্বনি করেনি। হয়তো একালের মানুষই হাজার হাজার বছরের অদেখা অজানা গুহাচিত্রের দ্বিতীয় সাক্ষী।
এর থেকে কী প্রমাণ হয়? প্রমাণ হয় যে সমাজের চেয়ে ধর্মমতের চেয়ে আর্ট আরও বেশি দিন বঁাচে; যদি সুযোগ পায়। তেমন সুযোগ সকলের বরাতে জোটে না। কিন্তু জুটলে বোঝা যেত যে আর্টের জীবনীশক্তি তাকে বঁাচিয়ে রাখতে পারে। আর তার সেই জীবনীশক্তির মূলে তার স্বকীয় সত্তা।
হাঁ, আর্ট একটি সত্তা। একটি অস্তিত্ব। যেমন আলো হাওয়া জল মাটি বিদ্যুৎ। তফাতের মধ্যে এটা মানুষের সৃষ্টি। প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। যেটা প্রকৃতির সৃষ্টি সেটা আগে এসেছে, যেটা মানুষের সৃষ্টি সেটা পরে। কিন্তু পরে বলেই সেটা কম অস্তিত্ববান নয়। সেকালের নদনদীও তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রকৃতির সৃষ্টিও চিরদিন থাকে না। কিন্তু যতদিন থাকে ততদিন তাদের জীবনীশক্তির মূলে থাকে তাদের স্বকীয় সত্তা।
আর্ট আছে, আর আছে তার স্বকীয়তা। এই পর্যন্ত মেনে নিতে বাধা নেই। বাধা আসে স্বাধীনতার বেলা। আর্ট কি স্বাধীন?
স্বাধীন সত্তা নিয়েই আর্ট একদা আবির্ভূত হয়েছিল। মানুষ তার আপন কীর্তি দেখে অবাক। সেযেন এক বিশ্ব আবিষ্কার। সেদিন যা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত তাই ক্রমে অভ্যাসে পরিণত হয় ও তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় রকমারি পাশ। সমাজের দাবি, ধর্মের অনুশাসন, রাজার ফরমাশ, রাজ্যের আইন। উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন উঠে সৃষ্টির প্রেরণাকে নিয়ন্ত্রিত করে। কোথায় আর্টের স্বাধীনতা? তার জায়গা নেয় ঐতিহ্য। ধারাবাহিকতা। সামাজিক প্রয়োজন। লোকহিত। একটা-না-একটা মতবাদ। যা আর্টের নিজের ঘরের নয়, বাইরের দুনিয়ার।
ধর্মের দিক থেকে বলা হয় যে জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগ ধর্মের আমলে আসবে ও ধর্মের আজ্ঞাবহ হবে। শিল্প মাত্রেই হবে ধর্মীয় শিল্প। নয়তো তাকে বর্জন করা হবে, অপাঙক্তেয় করা হবে। এ মনোভাব আজকের দিনেও কাজ করছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। তবে সভ্যজগতে আর কেউ ধর্মের এই সর্বব্যাপিতায় বিশ্বাস করে না। গত শতাব্দীতে ধর্মের বদলে নীতির তরফ থেকে উঠেছিল ওই একই দাবি। জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগ নীতির আমলে আসবে, আর্টও বাদ যাবে না। যা নীতিহীন তা অপাঙক্তেয়। এ মনোভাব আজও এখানে-ওখানে কাজ করছে। কিন্তু সভ্যজগৎ মোটের উপর একমত যে নীতি না থাকলেও আর্ট থাকে, কিন্তু রস না থাকলে আর্ট থাকে না, রূপ না থাকলে আর্ট থাকে না।
তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদীরা, সমাজতন্ত্রবাদীরা, সাম্যবাদীরা বর্তমান শতাব্দীর বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষত যুদ্ধকালে বা বিপ্লবকালে আর্টের কাছে আনুগত্য চেয়েছেন ও পেয়েছেন। ন্যাশনাল আর্ট, সোশ্যাল রিয়্যালিজম ইত্যাদি বয়ান বার বার উচ্চারিত হয়েছে। ধর্ম বা নীতি যা করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে, দেশপ্রেম বা সমাজপ্রীতি তাই করতে কোমর বেঁধেছে। পারবেও, কিন্তু কদিনের জন্যে? একদিন নাচার হয়ে মানতে হবে যে শিল্পীদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া যত সহজ শিল্পের আপনার স্বাধীনতা হরণ করা তত সহজ নয়।
শিল্পীরা যতক্ষণ সৃষ্টি করে ততক্ষণ অসাধারণ। তারপরে আর সকলের মতো নিতান্ত সাধারণ মানুষ। তাদেরই মতো ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর, অভাবে অনটনে জর্জর, লোভে নষ্ট, উচ্চাভিলাষে ভ্রষ্ট। তাদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া বা আঁকিয়ে নেওয়া চিরকাল চলে এসেছে, চিরকাল চলবে। অতীতে এই কাজটি করাতেন রাজন্যবর্গ বা পুরোহিতকুল। ইদানীং করাচ্ছেন বণিক বা কমিশনার মন্ডলী।
কিন্তু শিল্পী স্বাধীন না হলেও শিল্প স্বাধীন ছিল ও থাকবে। কাব্য বা নাট্য বা সংগীত বা নৃত্য যে সমাজের বা সমষ্টির বা রাষ্ট্রের বা ধর্মসংঘের অনুগত হতে বাধ্য এটা কেউ কোনোদিন মন থেকে স্বীকার করেনি ও করবে না। রসের ও রূপের জগৎ একটা স্বতন্ত্র জগৎ। সেজগতে যাদের প্রবেশ আছে তারাই শিল্পী। যাদের নেই তারা বাইরের লোক। বাইরের লোকের অধিকার উপভোগে। তারা উপভোগ করেই সুখী হোক। তা না করে তারা যাবে শিল্পীর হাত ধরে লেখাতে বা আঁকাতে। ফলে যা আকার ধারণ করে তা আর্ট নয় বা আর্ট হিসাবে নিরেস।
আর্ট নিরাকার ব্রহ্ম নয়। আকার ধারণ করেই তাকে অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে হয়। যার হাত দিয়ে কন্ঠ দিয়ে বা অঙ্গ দিয়ে সাকার হয় তারই নাম শিল্পী। শিল্পী পরাধীন হতে পারে। শিল্প কিন্তু স্বাধীন। আর শিল্পের সেই স্বাধীনতাই শিল্পীকে মর্যাদা দেয়। স্বাধীনতা বিনা মর্যাদা নেই। স্বাধীনতা বিনা সৃষ্টিও কি আছে? নব নব উন্মেষের জন্যেও চাই স্বাধীনতা। ধর্ম বা সমাজ বা রাষ্ট্র আপনার জন্যে যে স্বাধীনতা দাবি করে আর্টের বেলা সে-স্বাধীনতা স্বীকার করে নিলেই শিল্পের তথা শিল্পীর স্ফূর্তি। তারপরে কেউ যদি স্বাধীনতা পেয়েও তার অপব্যবহার করে সেভিন্ন কথা।
বলা বাহুল্য স্বাধীনতা যদিও অনন্যনির্ভর তবু অনন্যনিরপেক্ষ নয়। আর্টের স্বাধীনতা বলতে ধর্মের থেকে বা নীতির থেকে বিচ্ছিন্নতা বোঝায় না। সব ক-টি জগৎই পরস্পর প্রবিষ্ট। আর্টের ভিতরে সমাজের অনুপ্রবেশ তেমনি সত্য যেমন সত্য সমাজের ভিতরে আর্টের অনুপ্রবেশ। লোকনৃত্যে বা লোকসংগীতে যোগ দেয় সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতা। এই যে হোলি আসছে, এটি তেমনি একটি উৎসবরূপে কল্পিত হয়েছিল। এর অনুরূপ ছিল প্রাচীন গ্রিসে। প্রাচীনদের মধ্যে লোকের সঙ্গে শিল্পের বিচ্ছেদ তেমন ঘটেনি যেমন ঘটেছে আধুনিকদের মধ্যে। যেসব সমাজ এখনও ট্রাইবাল যুগে বাস করছে সেসব সমাজেও বিচ্ছেদ ঘটেনি।
আধুনিক কালের এটাও একটা সমস্যা, কেমন করে আর্টের সঙ্গে সমাজের তথা ধর্মের তথা নীতির বিচ্ছেদ বা ব্যবধান পরিহার করা যায়, ঘটে থাকলে দূর করা যায় বা হ্রাস করা যায়। যতদিন না এটা সম্ভব হচ্ছে ততদিন মানুষের জীবন খন্ডিত হবেই। সেটা কম দুঃখের নয়। তা বলে তো আর্টের স্বাধীনতাকে খর্ব করা যায় না। সেপথে সমস্যার সমাধান নেই। স্বাধীনতাকে গোড়ায় স্বীকার করে নিয়ে তারপরে পরস্পর নির্ভরতার সন্ধান করতে হবে।
এখানে কথা উঠবে যে, গুহাচিত্রের যুগেও কি স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে পরস্পর নির্ভরতা ছিল? সেযুগেও কি ধর্ম আর সমাজ শিল্পকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল? না রূপদক্ষ জনের অবাধ স্বাধীনতার জন্যে গুহাভিন্ন আর কোনো গোপনীয় আশ্রয় ছিল না? তাই যদি হয়ে থাকে তবে সমস্যাটা কেবল আধুনিক মানবের নয়, এটা আদিতম মানবেরও সমস্যা। সেকালেও শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঘটে থাকতে পারে, শিল্পের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়ে থাকতে পারে, ইচ্ছামতো সৃষ্টি করতে পারা যাচ্ছে না দেখে রূপদক্ষরা গুহার নির্জনতা বরণ করে নিয়ে থাকতে পারে। এতকাল পরে কেউ জোর করে বলতে পারে না প্রকৃত ব্যাপারটা কী। গুহা হয়তো পলাতকদের গজদন্তের গম্বুজ ছিল।
আমরা শুধু আমাদের সমসাময়িকদের সম্বন্ধেই জোর করে বলতে পারি। এর জন্যে দু-চার শতাব্দী পেছিয়ে যাওয়া যদি দরকার হয় তাও করতে পারি। আধুনিক যুগের প্রসঙ্গে মধ্যযুগের প্রসঙ্গও ওঠে।
এমন দেশ নেই যে-দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেনসরশিপ নেই। তুমি লিখতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভয়ে বা ধর্মসংঘের ভয়ে বা সমাজের ভয়ে সম্পাদক তা মঞ্জুর করবেন না, প্রকাশক তা প্রত্যাখ্যান করবেন, মুদ্রাকর তা ছাপবেন না। সাজা হয়তো একজন কি আধজন পান, কিন্তু সাজার ভয়ে বেশিরভাগ লোক তটস্থ। অবশেষে লেখকেরও হাত-পা অবশ হয়ে যায়। তার হাত দিয়ে সাহসের কাজ হয় না। যেটা হয় সেটা নিরীহ নিষ্পাপ ভালোমানুষি। তার সঙ্গে সৌন্দর্য থাকে বলেই তা উত্তীর্ণ হয়। যেখানে সত্য বা সৌন্দর্য কোনোটারই মর্যাদা নেই সেখানে কেউ মনে রাখে না।
আধুনিক যুগের সাহিত্যিকদের বার বার বিদ্রোহ করতে ও কতৃপক্ষের রোষে পড়তে হয়েছে। এটাও একপ্রকার সত্যাগ্রহ। এর ফলে সাহিত্যের রাজপথ এখন জনপথে পরিণত হয়েছে। বহুজন যে স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন এটা দেশ-বিদেশের অসংখ্য সত্যাগ্রহীর শৌর্যের ও দুঃখভোগের নিট ফল। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এখনও করায়ত্ত হয়নি। যদি হয়ে থাকে তবে ফ্রান্সে বা ইংল্যাণ্ডে বা আমেরিকায়। যেসব দেশে সাহিত্যিক সত্যাগ্রহের ঐতিহ্য দুই শত বর্ষব্যাপী। আমরা তাদের সাধনার শরিক না হয়েও তাদের সিদ্ধির অংশভাগী হয়েছি।
না, সেসব দেশেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা করায়ত্ত হয়নি। তবে নিষিদ্ধ দ্বার একে একে খুলে যাচ্ছে। যেখানে প্রবেশ মানা ছিল সেখানে ঢুকতে বাধা নেই। নিষিদ্ধ গ্রন্থের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছে। নিষিদ্ধ নাটক দেখানো হচ্ছে। তাতে যে এমন কিছু অনিষ্ট হচ্ছে তাও নয়। আসলে সেসব দেশের বনিয়াদ এমন মজবুত যে সহজে চৌচির হতে পারে না। দুটো-একটা দেয়াল কি থাম ধসে-পড়া বিচিত্র নয়। আর্টের মুখ চেয়ে তেমন ঝুঁকি নেওয়া যায়। সভ্যতার বা সংস্কৃতির পরখ সেইখানে।
অথচ মধ্যযুগে এরকম ছিল না। তার কারণ সেনয় যে মধ্যযুগের ফিউডাল ব্যবস্থা কম সুদৃঢ় ছিল। তার হেতু জীবনজিজ্ঞাসায় গতানুগতিক ঔদাসীন্য। সব উত্তর বেদ বাইবেল কোরানে লেখা আছে, নতুন কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। জানতে চাও তো গুরু ধরো। নিজের চেষ্টায় কিছু হবে না। আঁকতে চাও তো অনুকরণ করো। বিষয়গুলোও বঁাধাধরা। মধ্যযুগে সৌন্দর্যসৃষ্টিও অপ্রতুল ছিল না, কিন্তু পদে পদে সীমার বঁাধন। আধুনিক যুগ বেপরোয়া। রেনেসাঁস তাকে অসীমের ইঙ্গিত দিয়েছে। মানুষ তার জিজ্ঞাসার উত্তর পাক না পাক জিজ্ঞাসায় উদাসীন নয়। সেইজন্যে প্রতি দশ-বিশ বছর অন্তর অন্তর আর্টের জগতে ইজম বদলে যায়। গতানুগতিককে কেউ আমল দিতে চায় না।