রেনেসাঁসের নবপর্যায়

রেনেসাঁসের নবপর্যায়

ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা যায়, নতুন করে লেখা যায়, কিন্তু যা ঘটে গেছে তাকে ইচ্ছামতো পালটে দেওয়া যায় না। জাতীয় অহমিকায় বাধে, সামাজিক অভিমান আহত হয় তবু এটা মেনে নেওয়াই ভালো যে ভারত একটা অক্ষয় অব্যয় অনাদি অনন্ত চিন্ময় সত্তা নয়। সেকখনো গৌরবের কখনো অগৌরবের কখনো আলোকের কখনো অন্ধকারের কখনো উত্থানের কখনো পতনের কখনো স্বাধীনতার কখনো পরাধীনতার ভিতর দিয়ে গেছে। একই কথা বলতে পারা যায় ইউরোপীয় দেশগুলোর বেলায়ও। ইতিহাস কেবল একটানা সৌভাগ্যের ইতিহাস নয়, দুর্ভাগ্যেরও ইতিহাস। দুর্ভাগ্যকে জয় করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে ঘটেছে এটা মেনে নিতে হয়।

মানবিক ব্যাপারে দুর্ভাগ্যও অবিমিশ্র দুর্ভাগ্য নয়। কালো মেঘেরও একটা রুপালি রেখা থাকে। পরাধীনতার সেই কালো মেঘের রুপালি রেখা ছিল বাংলার রেনেসাঁস। বাংলা ছিল ভারতের অঙ্গ। সুতরাং সেটা ছিল ভারতেরও রেনেসাঁস। বাংলায় শুরু হলেও সেটা সেইখানে সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্রমে ক্রমে ভারতময় ব্যাপ্ত হয়েছিল। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বিস্তৃত যে যুগ তার বিস্তার কেবল দশক থেকে দশকে নয়, প্রদেশ থেকে প্রদেশে। হিন্দি সাহিত্যের ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র, ওড়িয়া সাহিত্যের ফকিরমোহন সেনাপতি, অসমিয়া সাহিত্যের লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া—এঁরাও রেনেসাঁস যুগের নায়ক।

রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের ছ-বছর বাদে পরাধীনতারও অবসান। রবীন্দ্রোত্তর ও ব্রিটিশোত্তর মোটামুটি সমবয়স্ক। আমরা যারা এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে জন্মেছি তারা এক যুগ থেকে আরেক যুগে উপনীত হয়েছি। কিন্তু যাদের জন্ম স্বাধীন ভারতে তাদের জীবন তো আমাদের মতো অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তরণ নয়। তাদের কী করে বোঝানো যাবে যে অন্ধকার রাত্রেও আকাশে তারা ফোটে চাঁদ ওঠে আর জ্যোৎস্নায় দশদিক প্লাবিত হয়ে যায়। কী জানি কেমন করে সূর্যও উঠেছিল। রেনেসাঁস সত্যি সত্যিই একটা রুপালি রেখা ছিল। যদিও একালের লোক বিশ্বাসই করতে চায় না যে পরাধীন দেশে রেনেসাঁস হতে পারে। বিশ্বাস করলেও বলে তা অকিঞ্চিৎকর। যেহেতু তার সৃষ্টি স্থিতি ও বিলয় বুর্জোয়া শ্রেণিতে। ইংরেজদের মতো বুর্জোয়াদেরও আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে এসেছে। তাদের রেনেসাঁস তাদের সঙ্গেই সহমরণে যাবে।

ইতিহাসের পাতায় অনেক বৈদেশিক আক্রমণের বিবরণ আছে, কিন্তু এমনটি কোথাও লেখা নেই যে সাত সমুদ্রপারের একটি সওদাগর কোম্পানি প্রথমে ভারতের সাগর উপকূলে মাদ্রাজ, বোম্বাই ও কলকাতা নামে তিনটি বন্দর পত্তন করে, পরে সেই তিনটি বন্দর থেকে বাণিজ্য করতে করতে আত্মরক্ষার জন্যে তিনটি দুর্গ নির্মাণ করে, আরও পরে তিনটি অঞ্চলের রাজনীতির জালে জড়িয়ে পড়ে, আরও পরে ছলে-বলে-কৌশলে তিনটি আঞ্চলিক সরকার গঠন করে, পরিশেষে তিন দিক থেকে সারা ভারত ঘিরে ফেলে ও একচ্ছত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের রাজা-বাদশারা ছিলেন একচক্ষু হরিণ। তাঁরা স্বপ্নেও ভাবেননি যে সমুদ্রপথ দিয়ে শত্রু আসতে পারে, সামুদ্রিক বন্দর হতে পারে বৈদেশিক নৌবাহিনীর ঘাঁটি, সি পাওয়ার থেকে আসতে পারে ল্যাণ্ড পাওয়ার, অতিকায় মোগল ফৌজ ও দুর্ধর্ষ মারাঠা সেনা একমুঠো গোরা গোলন্দাজের কাছে হার মানতে পারে।

কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে আসলে ওটা ছিল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় তিন শতাব্দী এগিয়ে থাকা একটি শক্তির কাছে তিন শতাব্দী পেছিয়ে থাকা অন্য কয়েকটি খন্ডশক্তির পরাজয়। এই খন্ডশক্তিগুলি যদি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে বলক্ষয় না করত তাহলে হয়তো পেছিয়ে থাকা সত্ত্বেও জাপানের মতো স্বাধীনতা রক্ষা করত। কিন্তু কলহ তাদের অস্থিমজ্জায়। দুই শতাব্দী পরাধীন থেকেও তারা একতাবদ্ধ হতে শিখল না। ফলে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেশ হয়ে গেল দু-ভাগ। আমাদের ইতিহাসে এটা নতুন কিছু নয়। বরং এইটেই আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। কোনো একজন রাজচক্রবর্তী আর সবাইকে যুদ্ধে হারিয়ে না দিলে ভারত কখনো আপনা হতে একশাসনাধীন হয়নি। তবে তাঁরা ছিলেন রাজচক্রবর্তী, সওদাগর শিরোমণি নন। মোগল বাদশারাও প্রকারান্তরে ক্ষত্রিয়, প্রকারান্তরে বৈশ্য নন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব ছিল বৈশ্য রাজত্ব। ভারতে তারা নিয়ে আসে বৈশ্য যুগ। তাদের স্বদেশেই ক্ষত্রিয় যুগের আয়ু শেষ হয়ে এসেছিল, ঠাটটা ক্ষত্রিয় রয়ে গেলেও চরিত্রটা বৈশ্য। ক্ষমতার আসনে ভূম্যধিকারীদের দল, কিন্তু ক্ষমতার রশি যাঁদের হাতে তাঁরা পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের দল। চার্চ বা ব্রাহ্মণশক্তি রাষ্ট্র বা ক্ষত্রিয়শক্তির কাছে বশ্যতাস্বীকার করেছিল। আবার রাষ্ট্র বা ক্ষত্রিয়শক্তিও পার্লামেন্ট বা ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের যৌথশক্তির কাছে নতি স্বীকার করেছিল। এর ফলে ইঙ্গদ্বীপী ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের মধ্যে যে পরিমাণ একতা ছিল তেমন আর কোনোখানে ছিল না। ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশ আত্মকলহে জর্জর।

ইটালিতে এবং তার পরে ফ্রান্সে স্পেনে ও ইংল্যাণ্ডে যে রেনেসাঁস হয় তার পটভূমিকা ও আমাদের এদেশে যে রেনেসাঁস হয় তার পটভূমিকা এক নয়। এক না হওয়ার কারণ এ নয় যে ওরা ছিল রেনেসাঁসের সময় স্বাধীন আর আমরা ছিলুম রেনেসাঁসের পরাধীন। ওদের রেনেসাঁস বৈশ্যযুগের পূর্বেই ঘটেছিল, আমাদের রেনেসাঁস বৈশ্যযুগের সূচনার পর। এই প্রভেদটা ভালো করে মনে রাখা দরকার। আমাদের রেনেসাঁসের নায়করা বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত। ওদের রেনেসাঁসের নায়করা তখনও বুর্জোয়া বলে চিহ্নিত হয়নি। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকরা তাঁদের দেশের অভিজাত শ্রেণি। চার্চও গোড়ার দিকে পৃষ্ঠপোষক ছিল, কিন্তু রেনেসাঁসের স্বরূপ আবিষ্কার করার পর বিরূপ হয়। রেনেসাঁস থেকে আসে বিজ্ঞানে মতি। আর বিজ্ঞান তো যুক্তি বিনা এক কদমও এগোয় না। আর যুক্তি করাই যার প্রকৃতি সেকখনো বিনা বাক্যে শাস্ত্রবাক্য মেনে নিতে পারে না। সাহিত্যে আর চিত্রভাস্কর্যে আসে গ্রিকদের জীবনদর্শন। সেজীবনদর্শন খ্রিস্টীয় জীবনদর্শনের সঙ্গে মেলে না। দর্শনশাস্ত্র ধর্মশাস্ত্রের থেকে পৃথক হয়ে যায়। পদে পদে বিরোধ বঁাধে। কিন্তু ওসব দেশের অভিজাত শ্রেণি রেনেসাঁসের গোড়ায় যেমন পক্ষপাতী ছিলেন শেষেও তেমনি। নাইটদের জীবনদর্শনের সঙ্গে রেনেসাঁসের জীবনদর্শনের তেমন কোনো বিরোধ ছিল না। রেনেসাঁসের ফলে তাঁদের জীবন আরও সমৃদ্ধ হয়। তাঁরা থিয়েটারে যান। অভিনয় দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। গ্রিক সাহিত্য পড়েন। অবজার্ভেটরিতে বসে টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহনক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। স্টুডিয়োতে গিয়ে শিল্পীদের উৎসাহ দেন গ্রিক আদর্শে আঁকতে ও গড়তে। ওয়ার্কশপে গিয়ে কারিগরদের ফরমাশ করেন রকমারি তৈজসপত্র বানাতে। অভিজাত শ্রেণির অনুসরণে বুর্জোয়া শ্রেণিও পরবর্তীকালে রেনেসাঁসের পৃষ্ঠপোষক হন। কিন্তু এঁরা ছিলেন অভিজাতকুলের তুলনায় অধিকতর পরিমাণে চার্চের আঁচলে বঁাধা।

ষোড়শ শতাব্দীর রেনেসাঁস যখন ঊনবিংশ শতাব্দীতে পড়ে তার বহুপূর্বেই ইংল্যাণ্ডে একটা পটপরিবর্তন ঘটে যায়। বুর্জোয়া শ্রেণি ততদিনে জাঁকিয়ে বসেছেন। থিয়েটারের দর্শক, বইপত্রের পাঠক ও গ্রাহক, শিল্পদ্রব্যের ক্রেতা, ভোগ্যসামগ্রীর উদ্ভাবক অভিজাতদের পেছনে ফেলে বুর্জোয়া শ্রেণির কাঞ্চনকুলীন। এই কাঞ্চনকৌলীন্যই এদেশে আমদানি হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে পলাশির পর। সূর্যাস্ত আইনে পুরোনো জমিদারি কিনে নেন নতুন জমিদারকুল। এঁরা মহাজনি তেজারতি ও ব্যাবসাদারি করে বড়োলোক। এঁদের অভিজাত না বলে কাঞ্চনকুলীন বলাই সমীচীন। এঁরা জাতে যা-ই হন বর্ণে বৈশ্য।

সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য কেন্দ্র মাদ্রাজ, বোম্বাই ও কলকাতা অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয় প্রশাসন কেন্দ্র। তারপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র। তিনটির মধ্যে কলকাতাই হয় অগ্রগণ্য কারণ সারা ভারতের রাজধানী স্থাপিত হয় কলকাতায়। এই শহরের অবস্থান যদিও পূর্ব ভারতে তবু এই কেন্দ্র থেকে সমগ্র উত্তর ভারত ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজ যেখানেই যায় বাঙালিও যায় সেখানে। সাংস্কৃতিক দিগবিজয়ে ইংরেজদের সহকারী সেনাপতি হয় বাঙালি। এতে তার মান বাড়ে বই কমে না। কিন্তু শতাব্দীর প্রারম্ভের এই সম্মানের সম্পর্কটা সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে ক্রমশ অসম্মানের হয়ে ওঠে। কিপলিং-এর ‘হারি চান্ডার মুকার্জির’ অপরাধ তিনি সাহেবদের সমকক্ষ হতে চান। সহকারী সেনাপতির সাধ কিনা সেনাপতি হতে। বামন হয়ে চাঁদে হাত। সাহেবখেদা আন্দোলনে বাঙালির নেতৃত্ব নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করে। কিন্তু ইতিমধ্যে রেনেসাঁসের দফারফা। সেপড়ে যায় দুই আগুনের মাঝখানে। সাম্রাজ্যবাদ বনাম জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদকে জোর জোগায় রেনেসাঁস নয়, রিভাইভালিজম অর্থাৎ পুনরুজ্জীবনবাদ।

পুনরুজ্জীবন বলতে বোঝায় প্রাচীন ভারতের আদর্শে আধুনিক ভারতের রূপায়ণ। কিন্তু প্রাচীন ভারত কি কেবল আর্য ভারত? বৈদিক ভারত? তার পূর্বেও তো প্রাচীনতর আর্যপূর্ব ভারত ছিল। আমাদের পুনরুজ্জীবনবাদীরা জানতেন না যে সিন্ধু সভ্যতা বলে একটি প্রাচীনতর সভ্যতা ছিল, সেটা আর্যদের জন্যে অপেক্ষা না করে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল। মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পা খনন করতে গিয়ে দুটি অতুলনীয় নগর পাওয়া গেছে। বৈদিক আর্যদের তেমন কোনো কীর্তির সন্ধান মেলেনি। উৎখনন এখনও চলছে ও নিত্যনতুন সাক্ষ্য উদ্ধার হচ্ছে। সেই সভ্যতার বিস্তার কেবল সিন্ধুতটেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার বিস্তার রাজস্থানকে ছাড়িয়ে আরও পূর্ব দিকে ও কাথিয়াবাড়কে ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণ দিকে এগিয়েছিল। বৈদিক আর্যদের সঙ্গে এই প্রাকবৈদিক প্রাগার্যদের বিরোধ বেঁধেছিল বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয়, কারণ বেদ যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনায় মুখর। শত্রুরা দুর্জয় না হলে তাদের বধ করার জন্যে দেবতাদের স্তবস্তুতি করতে হত না। সিন্ধু সভ্যতারই-বা পুনরুজ্জীবন হবে না কেন, যদি পুনরুজ্জীবনই হয় লক্ষ্য? তারপর আর্য ভারতও যে সার্বভৌম ছিল তা নয়। আর্যাবর্তেই তার সীমাবদ্ধতা। তার বাইরে ছিল বঙ্গ, তার বাইরে ছিল দাক্ষিণাত্য। আর তার স্থিতিকালও হাজার বছরের বেশি নয়। আর্য ভারতের পরে মৌর্য ভারত। আর্য-অনার্যের মিশ্র ভারত। তার অধিকার প্রায় ভারতব্যাপী। ভারতের বাইরেও তার প্রভাব। ততদিনে বেদবিরোধী বৌদ্ধ জৈন ধর্ম সংঘবদ্ধ হয়ে রাজশক্তিকেও ধর্মান্তরিত করেছে।

মৌর্য ভারতের পরে যাকে সাধারণত হিন্দু ভারত বলে অভিহিত করা হয় তার মোহানায় মিশেছিল গ্রিক আর পারসিক, শক আর কুষাণ, হূন আর বহুপ্রকার মোঙ্গলীয় উপজাতি। এদের কেউ এসেছিল উত্তর-পূর্ব থেকে, কেউ উত্তর থেকে। প্রাচীন ভারত বলতে মুসলিমপূর্ব এই ভারতকেও বোঝায়। এই ভারতে ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ঐতিহ্যের বিরোধ চরমে ওঠে। ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যই জয়ী হয়, কিন্তু সেআর ক-দিনের জন্যে। দেখতে দেখতে ইসলামধর্মী আরব তুর্ক মোগল এসে পড়ে। মোগল যে সময়ে আসে সেই সময়ে আসে তার বিপরীত দিক থেকে খ্রিস্টধর্মী পোর্তুগিজ। তার পিছু পিছু ইংরেজ ফরাসি ওলন্দাজ। জার্মানও এসেছিল, কিন্তু স্বদেশেও গৃহবিবাহের দরুন গুছিয়ে বসতে পারেনি। পূর্ব দিক থেকে আসে আহোম। আহোমরা শাক্ত ও বৈষ্ণব দীক্ষা ও সংস্কৃত নাম গ্রহণ করে। কিন্তু অন্যেরা তা করে না। তার ফলে মুসলিম ভারত বলে একটি সত্তার সূচনা হয়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ভারত, ফরাসি ভারত, পোর্তুগিজ ভারত এরাও উদয় হয়।

পুনরুজ্জীবনবাদীরা শেষের এই তিনটি ভারতের অবসান চেয়েছিলেন। এটা সবাই জানে। কিন্তু মুসলিম ভারতেরও অবলোপ চেয়েছিলেন কি? যদি চেয়ে থাকেন তা হলে আর মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদীদের দোষ দিয়ে কী হবে? মুসলিম ভারত হিন্দুর পক্ষে যতই অগৌরবের হোক-না কেন মুসলমানদের পক্ষে গৌরবের। মুসলিম ভারতকে হিন্দু ভারতের থেকে ভিন্ন করতে হলে দেশটাকেও ছিন্নভিন্ন করতে হয়। অতীতমুখী ভাবনার অনিবার্য পরিণাম ভারতভাগ। এর পরেও যদি কেউ পুনরুজ্জীবনের কথা ভাবেন তা হলে বলতে হবে তিনি আজকের এই খন্ডিত ভারতকেও খন্ড খন্ড করতে চান। অত কিছুর পরেও কি সে-গৌরব ফিরবে? ফিরতে পারে না। কারণ তার আয়ু সেনি:শেষে ভোগ করেছে। দ্বিতীয় বার যদি সেআসে দ্বিতীয় বার সেযাবে। মাঝখানের স্থিতিকাল হয়তো বিশ-ত্রিশ বছর।

রেনেসাঁস ও রিভাইভাল আমাদের ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে দুটি বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। রেনেসাঁসের যাঁরা ধারক ও বাহক তাঁরা সকলেই ইংরেজি শিক্ষিত। অনেকেই ইংল্যাণ্ডে ঘুরে এসেছেন। কেউ কেউ সেইখানেই দেহরক্ষা করেছেন। সমসাময়িক ইউরোপীয় চিন্তার সঙ্গে নিত্য ও অবিচ্ছিন্ন যোগ রক্ষা করতেন তাঁরা। তাঁদের সম্পাদিত সাময়িকপত্র পাঠ করলেই সেটা বোঝা যায়। কোনোটি ইংরেজীতে প্রকাশিত, কোনোটি আধুনিক ভারতীয় ভাষায়। কিন্তু একখানিও সংস্কৃত ভাষায় নয়। তার মানে এ নয় যে তাঁরা সংস্কৃত জানতেন না বা পড়তেন না। প্রাচীন সংস্কৃতিকে তাঁরা শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন, তাকে সংরক্ষণ করতেই তাঁদের বাসনা। কিন্তু যে প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান বৃদ্ধি পেতে পেতে বহুকাল পূর্বে একটি জায়গায় এসে থেমে গেছে তাকে ক্রমবর্ধমান আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে কেমন করে মেলাবেন। খ্রিস্টীয় চার্চ যদি তা পারত তাহলে এতজন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিককে পুড়িয়ে মারতে হত না। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অজ্ঞান নয়। বস্তুজ্ঞান। বাস্তবজ্ঞান। তাকে সত্য বলে স্বীকার করলে প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বিদায় দিতে হয়। অন্তত আবার যাচাই করে শোধন করতে হয়।

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিদেশ থেকে এসেছে বলে তা বর্জনীয় নয়, বিজাতির সঙ্গে এসেছে বলে অনাচরণীয় নয়, বিজেতার সঙ্গে এসেছে বলে বিতাড়নযোগ্য নয়, পশ্চিম থেকে এসেছে বলে পাশ্চাত্য দোষে দূষিত নয়। পশ্চিম একটি দিকবাচক বা দেশবাচক শব্দ। আধুনিক একটি কালবাচক বা যুগবাচক শব্দ। আমরাও যদি আধুনিক কালের বা আধুনিক যুগের মানুষ হয়ে থাকি তবে আমাদের কালের সঙ্গে আমাদেরও তাল রাখতে হবে, আমাদের যুগের সঙ্গে আমাদের পা মিলিয়ে নিতে হবে। কালিদাস ভালোবাসি বলে কালিদাসের কালে নিশ্বাস নিতে পারি-নে। রামায়ণ ভালোবাসি বলে রামায়ণের যুগের সঙ্গে মনের মিল অনুভব করতে পারিনে। টলস্টয়ের উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে আমি তার চেয়ে বেশি সহমর্মিতা বোধ করি। ব্রাউনিং-এর কবিতা আমাকে তার চেয়ে বেশি দোলা দেয়।

ঐতিহ্যের মাটিতে মূল থাকুক, মূলোৎপাটনের জন্য কেউ উৎসাহী নয়। দেশ থাকলে তার মূল্য থাকবেই। সেমূল আর্যই হোক আর আর্যপূর্বই হোক। তেমনি কাল থাকলে তার এক এক ঋতুতে এক একরকম ফুল ফোটাতে হবে। এক এক শতাব্দীতে এক একরকম আদর্শ বা তত্ত্ব মেনে চলতে হবে। ফরাসি সাহিত্যে তো এক এক দশকে এক-একটা ‘ইজম’ চলতি হয়। নব নব উন্মেষ না হলে সাহিত্য বা চিত্রকলা প্রাণবন্ত হয় না। যার প্রাণপ্রবাহ শুকিয়ে গেছে তার কাছে নতুন কিছু পাবার নেই। রসের জন্যে, রূপের জন্যে, আইডিয়ার জন্যে, জ্ঞানের জন্যে, আমাদের আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্য বা আর্টের কাছে যেতে হয়। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে যা পাই শুধুমাত্র তারই উপর নির্ভর করলে আমরাও কিছুদিনের মধ্যে ফুরিয়ে যাই বা বুড়িয়ে যাই। লিখব উপন্যাস অথচ ইংরেজি বা ফরাসি বা রুশ উপন্যাস পড়ব না, পড়ব শুধু কাদম্বরী ও দশকুমারচরিত এমনতরো ফতোয়া জারি হলে উপন্যাসের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে, আর যিনি লিখবেন তিনিও বিশ্বসাহিত্যের দরবারে অপাঙক্তেয় হবেন। পুনরুজ্জীবনবাদীরা এমন কিছু দিতে পারেনি যা তাঁদের পূর্বপুরুষরা দিয়ে যাননি। অতীতের অনুকরণও একপ্রকার অনুকরণ।

স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের পর পুনরুজ্জীবনবাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিন্তু তার প্রবক্তাদের বদ্ধমূল ধারণা তাঁরাই স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যতের নিয়ন্তা। ভাবী ভারত হবে প্রাচীন ভারতের ছাঁচে ঢালা। বিদেশির হাত থেকে স্বাধীনতা পেলেও অতীতের হাত থেকে স্বাধীনতা পাবে না। ইতিহাস না পড়ে পুরাণ পড়তে হবে, পৌরাণিক যুদ্ধবিগ্রহকে বলতে হবে ঐতিহাসিক যুদ্ধবিগ্রহ, পৌরাণিক যুদ্ধক্ষেত্রকে ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র, পৌরাণিক বীরপুরুষদের ঐতিহাসিক বীরপুরুষ। এ বিভ্রম ঐতিহাসিকদের কারো কারো গবেষণায় লক্ষ করা যায়। পরাধীন ভারতে এঁদের পৃষ্ঠপোষকের অভাব ছিল। এখন এঁরা উচ্চপদস্থ। এই যেমন পুরাণের সঙ্গে ইতিহাসকেও একাকার করা তেমনি থিয়োলজির সঙ্গে ফিলসফিকে একাকার করাও লক্ষণীয়। মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় সাড়ে চার শতাব্দী পূর্বে ও-দুটোকে আলাদা করেছিল। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শুধু ফিলসফিই প্রবর্তিত হয়েছিল। এখন ফিলসফির বাঘের ঘরে থিওলজির ঘোগ বাসা বঁাধছে।

আবার এমনও দেখছি যে মোগল ও ব্রিটিশ আমলের জমিদারকুল নির্মূল, হিন্দু আমলের রাজবংশ নির্বীর্য। প্রাচীন ভারতের ক্ষত্রিয় শ্রেণিকে পুনরুজ্জীবিত করতে দিচ্ছে কে? তাঁদের নি:ক্ষত্রিয় করাই তো যুগধর্ম। দেশে দেশে সেই কর্ম চলেছে। নেহাত ইংল্যাণ্ডের আশ্রয়ে ছিলেন বলেই তাঁরা এতদিন রক্ষা পেয়েছিলেন। ইংল্যাণ্ডের অভিজাত শ্রেণী তাঁদের প্রতি অনুকম্পাপরায়ণ। ক্ষত্রিয় শ্রেণি যাগযজ্ঞ ও দানধ্যান না করলে ব্রাহ্মণ শ্রেণির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। ব্রহ্মোত্তর ও দেবোত্তর জমি ভূমিসংস্কার আইনের আওতায় পড়ে। তা হলে বাকি থাকে বৈশ্যবর্ণ শুদ্রবর্ণ। ধনিক ও শ্রমিক। জোতদার ও চাষি। ক্ষমতার আসনে যাঁরা অধিষ্ঠিত তাঁরা শ্রেণিসংঘর্ষ পরিহার করতে চান। মহাত্মা গান্ধীও ট্রাস্টিশিপের মন্ত্র ও মন্ত্রণা দিয়ে গেছেন। পুনরুজ্জীবনে বৈশ্য বর্ণের উচ্চাভিলাষ পূর্ণ হতে পারত, কিন্তু শূদ্রবর্ণের অভিযোগ দূর হবার নয়। তারা বিদ্রোহী হলে তাদের দমন করার জন্যে সে-রামও নেই, সে-অযোধ্যাও নেই। শূদ্রের দিক থেকে শম্বুকবধ প্রার্থনীয় নয়। তার দৃষ্টি এখন রুশ চীনের উপরে। যেমন বৈশ্যের দৃষ্টি আমেরিকার উপরে।

না, এখন আর পশ্চিম দিকে তাকাতে কারও অভিমানে বাধে না। মুসলমানের যেমন মক্কা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শ্রমিক শ্রেণির মস্কো আর ধনিক শ্রেণির নিউইয়র্ক। প্রতিদিন আকাশপথে পুষ্পক বিমান ছুটছে পশ্চিম ভূমন্ডলের দুই প্রান্তে। আজকাল পশ্চিম ভূমন্ডলকে দুই প্রান্তে ভাগ করা হয়েছে। পূর্ব প্রান্ত ও পশ্চিম প্রান্ত। পশ্চিম প্রান্তে আমেরিকা প্রমুখ ধনতন্ত্রী দেশ। পূর্ব প্রান্তে রাশিয়া প্রমুখ সমাজতন্ত্রী দেশ। সেকালে যেমন কিপলিং বলতেন পূর্ব আর পশ্চিম কস্মিনকালে মিলবে না একালেও তেমনি একদল সাহিত্যিকের ধুয়ো পূর্ব আর পশ্চিম কোনোদিনই মিলবে না। সেকালে যেমন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন পূর্ব আর পশ্চিম পরস্পরের পরিপূরক, মহামানবের সাগরতীরে তাদের মিলন হবে। একালেও তেমনি আরেক দল সাহিত্যিকের স্বপ্ন পূর্ব আর পশ্চিম তৃতীয় মহাযুদ্ধে নামবে না, তার আগেই মিটমাট করবে। তার লক্ষণ এই সেদিন হেলসিঙ্কি শহরে দেখা গেল। ফরাসি ভাষায় দুটো শব্দ আছে। আঁতাত আর দেঁতাত। মনে রাখবেন, দাঁতাত নয়। চন্দ্রবিন্দুটা প্রথম অক্ষরের মাথার উপরে। আপাতত দুই মহাশক্তির কাম্য দেঁতাত। আঁতাত বহু দূর। মহাশূন্যে সোয়ুজের সঙ্গে অ্যাপোলোর সাযুজ্য এক সুদূরবর্তী সম্ভাবনার আভাস।

রিভাইভালিজম যদি এই পরিবর্তিত পরিবেশে নিশ্বাস নিতে পারে তাহলে মানতে হবে সেএক মহত্তর শক্তি। জোর করে কিছুই বলা যায় না। কে জানত গ্যেটের জার্মানি একদিন নাতসি হবে। হিটলারের দল ক্ষত্রিয়ও ছিল না, বৈশ্যও ছিল না, ব্রাহ্মণ তো ছিলই না। নানা কার্যকারণের যোগাযোগে শূদ্রদেরই এক অংশ অপর অংশের জোটের বিপক্ষে জোট পাকায়। জার্মানিতে কমিউনিস্টরা যদি অত প্রবল না হত নাতসিরাও অত প্রবল হত না। প্রবলের সঙ্গে প্রবলের দ্বন্দ্বে প্রবলতর কে হবে রাজনৈতিক গনতকারদেরও গণনার বাইরে ছিল। শেষমুহূর্তে নাতসিদের দিকেই পাল্লা ভারী হয়। সেটার অন্যতম কারণ বিশুদ্ধ আর্যরক্তে অন্ধ বিশ্বাস আর গভীর ইহুদি বিদ্বেষ। জার্মানির ইহুদিদেরও ছিল বিশুদ্ধ সেমিটিক রক্তে অন্ধবিশ্বাস ও আদিবাসভূমির প্রতি প্রথম আনুগত্য। ভারতেও অনুরূপ কতরকম জটিলতা আছে। চক্রের ভিতরে চক্র। তার ভিতরে চক্র। বুর্জোয়া যাদের বলা হচ্ছে তারাও কি একজোট নাকি? পরস্পরের এত বড়ো শত্রু কি আর আছে? এত যে রাজনৈতিক খুনোখুনি হয়েছে, মেরেছে ও মরেছে কারা? শ্রেণিতত্ত্বে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ইডিয়োলজিতে থাকতে পারে। যেমন মেরেছে ও মরছে একই শ্রেণির হিন্দু-মুসলমান। ইডিয়োলজিও একপ্রকার ধর্ম।

সেদিন এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘রেনেসাঁস কি আছে না নেই?’ এককথায় উত্তর দেওয়া শক্ত। থাকলে তিনি নিজেই দেখতে পেতেন। দেখতে না পেলে আমার সাক্ষ্যের কী মূল্য। এই পর্যন্ত বলতে পারি যে রামমোহন রবীন্দ্রনাথের ভাবধারা এখনও শুকিয়ে যায়নি। পরে যদি শুকিয়ে যায় তা হলেও অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বহমান থাকবে। রেনেসাঁসের ইতিহাসে কাউন্টার রেনেসাঁসও অজানা নয়। পালাবদল হলে ভিতরে ভিতরে মূল্যবোধও বদলে যায়। সকলের সেটা সহ্য হয় না। তারা বিদ্রোহী হয়। বুদ্ধির মুক্তিও অনেকের কাছে ভয়াবহ। তাদের কাছে যুক্তির চেয়ে ভক্তিই শ্রেয়।

ইডিয়োলজি যদি থিয়োলজির স্থান নেয় ও ফিলজফির সঙ্গে একাকার হয়ে যায় বা একাকারত্ব দাবি করে তা হলেও রেনেসাঁস তার তাৎপর্য হারায়। ইতিহাস লিখতে বসে যদি বিশিষ্ট বিপ্লবী নেতাদের নাম মুছে ফেলা হয় বা ঘটনা চাপা দেওয়া হয় তা হলেও রেনেসাঁস তার গতিপথে বাধা পায়। নিজেদের বানানো আধুনিক পুরাণও পুরাণ। উদ্দেশ্য তার নতুন রাজবংশের মহিমাকীর্তন ও অভিনব ধর্মপ্রচার। প্রকৃত ইতিহাসের মর্মোদ্ধার ভাবীকালের ঐতিহাসিকদের পক্ষে দুরূহ হবে, যদি সরকারি ইতিহাস ভিন্ন আর কোনো ইতিহাস প্রকাশিত না হয়। বিপ্লবোত্তর দেশগুলির বৈজ্ঞানিক প্রগতি বিস্ময়কর। তার জন্যে আমরা তাদের টুপি খুলে অভিবাদন জানাব। কিন্তু ফিলসফি ও থিয়োলজি যদি আবার একাকার হয়ে যায় তবে আমরা আবার মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন যুগে ফিরে যাব। তেমনি পুরাণ ও ইতিহাস যদি আবার অভিন্ন হয়ে যায় তা হলে আবার আমরা চার শতাব্দী পিছু হটব। বিজ্ঞান ও টেকনোলজি টানতে থাকবে সামনের দিকে আর থিয়োলজি ও পুরাণ পেছনের দিকে—এই দোটানার মধ্যে পড়ে শিক্ষিত মানস দিশাহারা হবে।

বুর্জোয়া আধিপত্য যাবার মুখে। মরা ঘোড়াকে চাবুক মেরে হাতের সুখ খুব বেশিদিন থাকবে না। তখন প্রশ্ন উঠবে, কোন সত্যের উপরে নতুন রেনেসাঁস প্রতিষ্ঠিত হবে? সেকি কেবল বিজ্ঞানের সত্য? টেকনোলজির সঙ্গে দর্শনের সত্য নয়? ইতিহাসের সত্য নয়? এসব ক্ষেত্রে কি থিয়োলজি ও পুরাণ আবার জমিয়ে বসবে? আর্টের সত্যও আরও একপ্রকার সত্য। ধর্মপ্রচার বা তত্ত্ব প্রচার তার কর্ম নয়। শিল্পীকে তার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা না দিলে যা সেসৃষ্টি করবে তা স্বকীয়তাহীন ফরমায়েশি সৃষ্টি। সৃষ্টি নয় সৃষ্টির অপলাপ। এর লক্ষণ দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে। এদেশেও দেখা যেতে পারে, যদি-না কতক শিল্পী স্বাধীনতা রক্ষা করেন।

যাঁদের বিশ্বাস বুর্জোয়া আমলে রেনেসাঁস হতে পারে না, বহু দেশ ও ইতিহাস তাঁদের অপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। সমাজতন্ত্রী আমলের নতুন এক রেনেসাঁস-এর জন্যে পটভূমিকা এখন প্রস্তুত। উঠোনকে দোষ দেওয়া এ জমানায় আর চলবে না। এখন দেখাতে হবে নাচ। সেনাচ যারা দেখবে তারা একবাক্যে সাধুবাদ দিয়ে বলবে, ‘কোথায় লাগে শেক্সপিয়র, গ্যেটে।’ দেখাতে না পেরে সোভিয়েট রাশিয়াও বুর্জোয়া রাশিয়ার সাহিত্যের প্রতি সশ্রদ্ধ হয়েছে। ডস্টয়েভস্কি ও চেকভের উপর থেকে নিষেধ উঠে গেছে। টলস্টয়কে সকলেই মান্য করে। গোর্কিকে টুর্গেনেভের চেয়ে উচ্চতর স্থান দেয় না। রসের মূল্য, রূপের মূল্য বোঝে। কিন্তু এঁদের প্রতি সুবিচার যেমন আনন্দের বিষয় জীবিতদের প্রতি সুবিচারও তেমনি কাম্য। বোধ হয় জিনিসটাই শর্তাধীন। শর্তটা হচ্ছে মরণোত্তর কালোত্তীর্ণতা। কালজয়ীর সঙ্গে কে না চায় আত্মীয়তা দাবি করতে!

ইতিহাস পরাধীন ভারতকে যে সুযোগ দেয়নি স্বাধীন ভারতকে তা দিয়েছে। স্বাধীন ভারতের শ্রমিক কৃষক শ্রেণিকে যে সুযোগ দেয়নি পরে সমাজতন্ত্রী জমানায় তা দেবে। যারা প্রায় তিন হাজার বছর ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের দাপটে মাথা তুলতে ও মুখ খুলতে পারেনি তাদের মধ্যে নিহিত রয়েছে অক্ষত সম্ভাবনা। তাদের মতো আমিও চাই তাদের সেই নিহিত সম্ভাবনাসমূহের পরিপূর্ণ প্রকাশ ও বিকাশ। মতভেদ শুধু এইখানে যে, সেটা কি ইংল্যাণ্ডের মতো ধীরে ধীরে বিবর্তনসূত্রে হবে না রুশ-চীনের মতো রাতারাতি বিপ্লবসূত্রে হবে? যদি বিপ্লবসূত্রে হয় তবে গান্ধীপন্থায় অহিংসভাবে হবে না লেনিনপন্থায় সহিংসভাবে হবে? সেটা যে সূত্রেই হোক, যেভাবেই হোক, ইতিহাসের গতি সেই অভিমুখে। একটা কথা আছে, অন্ধস্য বামা গতি। কথাটা বোধ হয় সমাজের বেলাও খাটে। সমাজেরও বাম দিকে গতি। বামাই সমাজের গতি। শূদ্র জাগরণ ও নারী জাগরণ স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে আরও ব্যাপকভাবে দেখব।

কিন্তু যেটা দেখতে চাই সেটা কেবল ক্ষমতার বামা গতি নয়, কেবল বিত্তের বামা গতি নয়, জ্ঞানেরও বামা গতি, রসেরও বামা গতি, রূপেরও বামা গতি। কেবল বিজ্ঞানের বামা গতি নয়, সংস্কৃতির বিবিধ বিভাগেরও বামা গতি। এখন আর উঠোনের দোষ নয়, নাচবে যারা তাদেরই দোষ। নতুন একটা রেনেসাঁসের জন্যে পটভূমিকা প্রস্তুত হচ্ছে, কিন্তু পটভূমিকাই তো সব নয়। কোথায় সেইসব শিল্পী ও দার্শনিক, রসিক ও ভাবুকের সমাবেশ যাঁদের বাদ দিয়ে রেনেসাঁস যেন ডেনমার্কের যুবরাজকে বাদ দিয়ে হ্যামলেট! হয়তো এখনও সময় হয়নি। বুর্জোয়ারা মঞ্চ জুড়ে রয়েছেন বলেই বোধ হয় তাঁরা মঞ্চে প্রবেশ করছেন না। সত্য-মিথ্যা বোঝা যাবে আরও বিশ-ত্রিশ বছর অতীত হলে।

সেরেনেসাঁস সত্য হলে এ রেনেসাঁস মিথ্যা হয়ে যাবে না। সেটা হবে এই নি:শেষিতপ্রায় রেনেসাঁসের নবপর্যায়। নবপর্যায়ের স্বরূপ এখন থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা যেন নিছক শ্রেণিবিদ্বেষে বা শ্রেণিগরিমায় পর্যবসিত না হয়। রেনেসাঁসের মঞ্চে যাঁরাই প্রবেশ করবেন তাঁদেরই দেখাতে হবে উচ্চাঙ্গের নাটক। যাত্রা বা প্রহসন নয়। তাঁদেরও লিখতে হবে ক্ল্যাসিক। তাঁদেরও হতে হবে তত্ত্বদর্শী। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অতন্দ্র সন্ধানী হতে হবে তাঁদেরও। ইতিহাসকে আর দর্শনকে পুরাণ আর থিয়োলজির সঙ্গে একাকার করবেন না তাঁরাও। কোনটা যুক্তিসহ আর কোনটা ভক্তিপ্রবণ এই পার্থক্যবোধ তাঁদেরও থাকবে। পূর্ব ও পশ্চিম যেমন পরস্পরের পরিপূরক, প্রাচীন ও আধুনিক যেমন পরস্পরের পরিপূরক, তেমনি সেই রেনেসাঁসও হবে এই রেনেসাঁসের পরিপূরক।

একবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁসের নায়ক হবেন যাঁরা তাঁরাও অনুভব করবেন যে জীবনের যেকোনো বিভাগে নতুন কোনো কাজ দেখাতে হলে তার আগে চাই চিন্তার ও কল্পনার স্বাধীনতা, নিরীক্ষণ ও পরীক্ষণের স্বাধীনতা, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের স্বাধীনতা, বাক্যের ও প্রকাশের স্বাধীনতা, বিচারের ও বিবেকের স্বাধীনতা। সব স্বাধীনতার মূল প্রত্যয় ব্যক্তিসত্তার পরম মূল্য। ব্যক্তি আবার কে? সমাজই তো সব। ব্যক্তি আবার কে? রাষ্ট্রই তো সব। ব্যক্তি আবার কে? নেশনই তো সব। ব্যক্তি আবার কে? আর্যরক্ত বা সেমিটিক রক্তই তো সব। ব্যক্তি আবার কে? শ্রেণিই তো সব। এই যে ব্যক্তিবিরোধী সমষ্টিসর্বস্ব মনোভাব এ যদি থাকে তো রেনেসাঁস থাকে না। ক্ষণবিদ্যুতের মতো তার চোখ-ধাঁধানো দীপ্তি সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। ইলেকট্রিকের বাতির মতো রাতদিন জ্বলে না। রেনেসাঁস ব্যক্তিসত্তাকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করে। ব্যক্তিই দিয়ে যায় নতুন ভাবনা নতুন রস, নতুন ধ্যান নতুন রূপ। বুদ্ধ বা যিশু, হোমার বা কালিদাস, কনফুসিয়াস বা প্লেটো, হিপোক্রেটিস বা চরক, আভিসেনা বা গালিলিয়ো, শেক্সপিয়ার বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, ভলতেয়ার বা রুশো, মার্কস বা ফ্রয়েড, আইনস্টাইন বা গান্ধী, এঁদের প্রত্যেকেই এক একজন ব্যক্তি। যদিও সমাজের থেকে বা স্বজাতির থেকে বিচ্ছিন্ন নন।

ষোড়শ শতাব্দীর রেনেসাঁস রাতারাতি কোনো বিপ্লব বা বিদ্রোহ ঘটায়নি, কিন্তু ব্যক্তির উপর যে মূল্য আরোপ করেছে তার থেকে এসেছে প্রচলিত মূল্যরাজির পরিবর্তন ও বিবর্তন। স্থলে স্থলে সেপরিবর্তন বৈপ্লবিক হয়েছে। বৈপ্লবিক যে সর্বত্র হবেই তেমন কোনো কথা ছিল না। বৈপ্লবিক যে কোথাও হবে না এমন কোনো কথাও কি ছিল? তবে পুরাতন মূল্য একবার বদলাতে শুরু করলে কতদূর বদলাবে তা কেউ গণনা করে বলতে পারে না। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের নায়করাও জানতেন না যে তাঁরা বিজ্ঞানের সত্য নির্ণয় করতে গিয়ে লোকের বদ্ধমূল সংস্কারে ঘা দিচ্ছেন ও তার ফলে চার্চ তার অথরিটি হারাচ্ছে। রেনেসাঁস বলে একটা অধ্যায় না থাকলে এনলাইটেনমেন্ট বলে আর একটা অধ্যায় থাকত না, সেটা না থাকলে পরে ফরাসি বিপ্লব বলে আরও একটা অধ্যায় থাকত না, সেটা না থাকলে আরও পরে রুশ বিপ্লব বলে আরও একটা অধ্যায় থাকত না। এই যে পারম্পর্য, এর মধ্যে শিল্পবিপ্লবও পড়ে। যারা একপ্রকার বিপ্লব এড়িয়েছে তারা আরেকপ্রকার বিপ্লব এড়াতে পারেনি।

কিন্তু অদৃষ্টের এমনই বিড়ম্বনা যে ব্যক্তির মূল্যটাই সমাজের বা দেশের বা রাষ্ট্রের বা নেশনের বা শ্রেণির দৃষ্টিতে খর্ব হয়েছে। মন্ডলী বা দলগঠন করতে না পারলে ব্যক্তি যেমন দুর্বল ছিল তেমনি দুর্বল কিংবা তার চেয়েও অসহায়। তাই সংকটকালে স্মরণ করতে হয় সেই সনাতন ভগবানকে।

ভগবানকে স্মরণ করলে আবার তর্ক ওঠে, এ কেমনতরো মানবিকবাদ যে ভগবানকে স্বীকার করে? রেনেসাঁসের সময় থেকেই মানবিকবাদ বা হিউম্যানিজম কথাটির চল হয়েছে। বস্তুটি বৌদ্ধ ও বাউলদের মধ্যেও ছিল। ছিল প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যেও। তবে ভক্তিমূলক ধর্মেও প্রবল প্লাবনে মানবিকবাদ ছিল মজ্জমান। এবার এল দর্শননির্ভর মানবিকবাদ। দর্শনও হল বিজ্ঞাননির্ভর। বিজ্ঞানও হল নিরীক্ষণ ও পরীক্ষণনির্ভর। অতীন্দ্রিয় বা অতিপ্রাকৃতের জন্যে মনের দরজা-জানালা খোলা রইল না। ভগবান তাহলে আসবেন কোন পথ দিয়ে? লাইব্রেরি, লেবরেটরি, অবজার্ভেটরি কোন আঙিনা দিয়ে?

তা বলে মানবিকবাদীরা সকলেই কিন্তু নিরীশ্বরবাদী নন। এক ভাগ এখনও ঈশ্বরবাদী। অপরাপর ভাগ নিরীশ্বরবাদী বা অজ্ঞেয়বাদী। মানবিক জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্রহ্মজিজ্ঞাসাও কি পড়ে না? মানুষের কি কেবল ইন্টেলেক্ট আছে, ইনটুইশন নেই? চোখ দিয়ে সব কিছু দেখা যায় না বলে টেলিস্কোপ ও মাইক্রোস্কোপ লাগে। দূরের চেয়ে কি আরও দূর নেই? সূক্ষ্মের চেয়ে কি আরও সূক্ষ্ম নেই? সীমার বাইরে কি অসীম নেই? দৃশ্যমানের অন্তরালে কি অদৃশ্য নেই? সব জিজ্ঞাসার মীমাংসা যুক্তি দিয়ে হয় কি? তাই মানবিকবাদীরা সবাই রেনেসাঁস থেকে প্রেরণা লাভ করলেও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক যাঁরা ছেদ করেননি তাঁরাও মানবিকবাদী। হিউম্যানিস্ট অথচ খ্রিস্টান এই যাঁদের পরিচিতি তাঁদের সংখ্যাও অল্প নয়।

রেনেসাঁস যদি খাস ইউরোপেও নি:শেষিত হয়ে এসে থাকে তবে তা বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রেণিসত্তার ঐতিহাসিক প্রয়োজন ফুরিয়ে আসার জন্যই কি? না তার অন্য কোনো কারণ আছে? এমনও তো হতে পারে যে রেনেসাঁস মানুষকে প্রকৃতি মন্থন করার যে শক্তি দিয়েছে তার অতিপ্রয়োগ বা অপপ্রয়োগের ফলে অমৃতের সঙ্গে সঙ্গে গরলও উঠছে, কিন্তু সেগরলকে ধারণ করার জন্যে কোনো নীলকন্ঠ নেই। আকাশ বাতাস জল স্থল সব বিষিয়ে গেছে। যেখানে যায়নি সেখানেও যাবে। হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী রেনেসাঁসের পক্ষে অনুকূল নয়। হিংসা যে মানুষের ইতিহাসে নতুন তা নয়, কিন্তু এমন নির্বিবেক হৃদয়হীন নৈর্ব্যক্তিক হিংসা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে লক্ষিত হয়নি। তৃতীয় মহাযুদ্ধে এর পরাকাষ্ঠা ঘটবে, যদি-না মদমত্ত মানুষ স্বেচ্ছায় অস্ত্রত্যাগ করে। তা যদি সেকরে তবে সেটা হবে একটা নৈতিক বিপ্লব। তখন দেখতে পাওয়া যাবে মানুষ কত উচ্চে উঠতে পারে। মানুষের নৈতিক সত্তা রেনেসাঁসের সঙ্গে বেখাপ নয়। বরং বলা যেতে পারে রেনেসাঁসের জন্যেই ক্রীতদাস প্রথার উচ্ছেদ হল। বিশ্বমানবের সেই নৈতিক সত্তা একদিন তাকে অস্ত্রত্যাগেরও প্রবর্তনা দেবে।

যেসব মূল্য মরা পাতার মতো আপনি ঝরে পড়ছে সেসব পুরাতন মূল্যকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকলে নতুন মূল্যগুলিকে তাদের প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভালো-মন্দের কষ্টিপাথরে তাদের সব ক-টিই হয়তো সোনা নয়, তা হলেও তাদের পরখ করতে হবে ও যতক্ষণ না তারা মন্দ বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে ততক্ষণ তাদের জন্যে মনটাকে খোলা রাখতে হবে। এই খোলামন না হলে রেনেসাঁস হয় না। খোলা মন যেমন অত্যাবশ্যক, খোলা সমাজও তেমনি। আমাদের মধ্যযুগে না ছিল খোলা মন, না ছিল খোলা সমাজ। আধুনিক যুগের মহিমাই এইখানে যে মন এখন খোলা, সমাজ এখন খোলা। কিন্তু আবার যদি পুনরুজ্জীবনের নামে বা স্বয়ংসম্পূর্ণতার নামে বা বিপ্লবের নামে খোলা সমাজ বন্ধ হয়ে যায় তা হলে আধুনিক যুগের আধুনিকতা বলতে যা অবশিষ্ট থাকবে তা ওই নামটা। গুণগত আধুনিকতা কোথায় মিলিয়ে যাবে।

গুণগত আধুনিকতা প্রাচীন সংস্কৃতিকেও সম্মান করে। মধ্যযুগের সংস্কৃতিকেও শ্রদ্ধা করে। পুরাতন ক্লাসিক বা পুরাতন ক্যাথিড্রাল বা পুরাতন মন্দির বা পুরাতন মন্দির বা পুরাতন মসজিদ আধুনিকতাবাদীদেরও প্রিয়। মানবিকতাবাদীদের যে ভাগটি নিরীশ্বরবাদী সেভাগটিও পুরোনো মদ ভালোবাসে। সেইসঙ্গে পুরোনো ছবি বা মূর্তি। এমন কালাপাহাড় একালে কেউ নেই যে অসত্য বা অশুভ বলে কীর্তি ধ্বংস করবে। মানব বিবর্তন একের পর এক যেসব অতিক্রম করে এতদূর এসেছে তার প্রত্যেকটি অধ্যায়ের ধ্বংসাবশিষ্ট সম্পদ সযত্নে সংরক্ষণ করা হচ্ছে ভাবীকালের জন্যে। উত্তরপুরুষ যাতে পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্যুত না হয়। মাঝে মাঝে ধারাভঙ্গ ঘটেছে। তা সত্ত্বেও ধারাবাহিকতার সন্ধান চলেছে। সেটা হয়তো পাওয়া যাবে কারিগর শ্রেণির কারুশিল্পে। হরপ্পা মহেঞ্জোদরো থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত এদেশের লোকের উপজীব্য কৃষি ও কারুশিল্প। এই নিয়ে যারা ছিল ও আছে তাদের সৃষ্ট লোকগীতি, লোকগাথা, রূপকথা, কিংবদন্তি, প্রবাদবচন প্রভৃতির মধ্যে কি একটি ধারাবাহিকতা মেলে না? আমার তো মনে হয় মৃৎশিল্প, দারুশিল্প ও শিলাশিল্পর মধ্যেও তা মেলে। আমাদের দৃষ্টি সাধারণত লোকসংস্কৃতির বা লোকশ্রুতির উপর পড়ে না। তার সম্যক চর্চা থেকেও নতুন একটা রেনেসাঁস ঘটতে পারে। সেটা জনমানসের রেনেসাঁস।

সম্ভবত সেই নতুন রেনেসাঁস বাইরে থেকে নয়, উপর থেকে নয়, অতীত থেকে নয়, তল থেকে আসবে। তল থেকে আসাও ভিতর থেকে আসা। তার দিকে আমি তো আমার একটা হাত বাড়িয়েই রেখেছি।