বাংলার রেনেসাঁস : পুনর্ভাবনা

বাংলার রেনেসাঁস : পুনর্ভাবনা

ইংরেজরা যখন এদেশে বাণিজ্য করতে আসে তার আগেই তারা রেনেসাঁসের ভিতর দিয়ে গেছে ও তখন রিফর্মেশনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ ক্যাথলিক থেকে প্রোটেস্টান্ট হয়ে উঠছে। বাণিজ্য করতে এসে রাজত্ব যখন হাতে পায় তার আগেই তাদের দেশে এনলাইটটেনমেন্ট শুরু হয়ে গেছে ও তখন ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন শুরু হয়ে যাচ্ছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আরও দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। আমেরিকার স্বাধীনতা ও ফরাসি বিপ্লব। এ দুটির সঙ্গেও এদেশের ইংরেজরা জড়িয়ে পড়ে। বস্টন টি-পার্টির চা যায় কলকাতা থেকে বস্টনে। আর এদেশের ফরাসি অধিকৃত অঞ্চলগুলির উপর ব্রিটিশ পতাকা ওড়ে।

তুর্ক আফগান মোগলের পরে নতুন একদল বিদেশি এসে এদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করল। কিন্তু এটাই একমাত্র সত্য নয়। তাদের জীবনকে অবলম্বন করে বইতে লাগল ইউরোপের ইতিহাসের বহমান স্রোত। রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, এনলাইটেনমেন্ট। আমেরিকার স্বাধীনতা তথা ফরাসি বিপ্লব। আমেরিকার স্বাধীনতাকেও বিপ্লব বলা হয়। তা হলে যুগলবিপ্লব। এদেশের মানসেও তাঁর পরশ লাগল।

সুদূর ইউরোপ থেকে জাহাজ আসে। গঙ্গার ঘাটে নামিয়ে দেয় ইংরেজি ভাষায় লেখা বইপত্র। নাটক উপন্যাস কাব্য প্রবন্ধ। রাজনীতি অর্থনীতি দর্শন বিজ্ঞান সন্দর্ভ। ইংরেজদের ঘরে ঘরে ক্লাবে ক্লাবে বইপত্র জমে ওঠে। কিছু কি বাঙালিদের নজরে পড়ে না? ইংরেজদের জন্যে থিয়েটার গড়ে ওঠে। বাঙালিরা কেউ কি টিকিট কেটে অভিনয় দেখতে যায় না? ইংরেজদের জন্যে পাশ্চাত্য পদ্ধতির সুরম্য হর্ম্য নির্মিত হয়। বাঙালি অভিজাতরা কেউ কি অনুকরণ করেন না? ইংরেজদের জন্য আমদানি হয় ঘোড়ার গাড়ি। বাঙালি বড়োলোকরা কেউ কি কেনেন না? ইংরেজদের জন্য আমদানি বা তৈরি হয় পাশ্চাত্য ধরনের আসবাব। শৌখিন বাঙালিরা কেউ কি তা দিয়ে ঘর সাজান না? অলক্ষিতে বাঙালির জীবনেও ইউরোপের স্রোত সঞ্চারিত হয়। সেইউরোপ মধ্যযুগীয় নয়, আধুনিক। তাকে আধুনিক করে তুলেছে রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, এনলাইটেনমেন্ট, আমেরিকান তথা ফরাসি বিপ্লব। অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বেই কলকাতা শহরের পত্তন। সারা অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে বিলিতি জাহাজের আনাগোনা। লণ্ডনের মানসলোক কলকাতায় প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালিদের কেউ কি সেই মানসলোকের প্রভাব অনুভব করেনি?

আমার মনে হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতেই বাংলার নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল, যদিও তার সমসাময়িক প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলারা সংস্কৃতচর্চা করতেন, ফারসিচর্চা করতেন, সেইসঙ্গে বাংলাচর্চাও করতেন। বাঙালি কারিগরকে দিয়ে বাংলা হরফও তৈরি করিয়েছিলেন। বাংলার প্রতি এই মনোযোগ থেকে প্রণীত হয় হ্যালহেডের ব্যাকরণ। কোম্পানির আমলাদের ভাষাচর্চা খ্রিস্টীয় মিশনারিদের মতো ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। তাঁরা হিউম্যানিস্ট। মানুষ সম্পর্কিত যেকোনো ব্যাপারে তাঁর ঔৎসুক্য। স্যার উইলিয়াম জোন্সের অনুবাদকর্ম সেই ঔৎসুক্যের থেকে সঞ্জাত। হিউম্যানিস্ট বলেই তিনি ইণ্ডোলজিস্ট। আর হিউম্যানিজম তো রেনেসাঁসের সঙ্গে ওতপ্রোত।

খ্রিস্টীয় মিশনারিদের ব্রিটিশ ভারতে আসা নিষিদ্ধ ছিল। তাঁদের আসতে দেন শ্রীরামপুরের দিনেমার কতৃপক্ষ। সেইখান থেকেই তাঁরা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ ছেপে বার করেন। উদ্দেশ্যটা রেনেসাঁসের দ্যোতক নয়, কিন্তু মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় পুস্তক প্রকাশ রেনেসাঁসের সহায়ক। তাঁরা এর পরে সংবাদপত্রও প্রকাশ করেন বাংলায়। তাতে থাকে নানা দেশের বিচিত্র বিবরণ। প্রথম প্রসঙ্গটাই ছিল আমেরিকা বলে এক অজানা ভূখন্ডের। ধর্মপ্রচার যদিও মূল উদ্দেশ্য তবু বৃহত্তর জগতের জ্ঞান পরিবেশনও কর্তব্য। মানুষকে মানুষের জীবন সম্পর্কে সচেতন করা হিউম্যানিজমের আওতায় পড়ে। মিশনারিরা সেদিক থেকে হিউম্যানিস্ট। তাঁরা যেসব বিদ্যালয় স্থাপন করেন সেসব বিদ্যালয়ে ভূগোল, ইতিহাস, গণিত প্রভৃতি যুগোচিত বিদ্যার প্রচলন ছিল। যারা খ্রিস্টান নয় ও হবে না তাদের কাছেও ছিল সেসব বিদ্যাসত্র অবারিত। কোম্পানির সরকার ভারতীয় বিদ্যার্থীদের জন্য ততখানি উদ্যোগী ছিলেন না যতখানি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত খ্রিস্টীয় মিশন। এঁরা পরে ব্রিটিশ ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ পান। কেরি সাহেবের সহযোগিতায় কোম্পানির আমলের রাজকর্মচারীদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হয়ে ওঠে বাংলা, হিন্দি, উর্দু প্রভৃতি ভার্নাকুলারের গদ্যসাহিত্যের আঁতুড়ঘর।

ইটালি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশের রেনেসাঁসের অন্যতম কর্ম ছিল ইটালীয়, ফরাসি, ইংরেজি প্রভৃতি ভার্নাকুলারের গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি। মাতৃভাষা তাদের বেলা ল্যাটিন গ্রিক নয়। এদেশের বেলা সংস্কৃত আরবি ফারসি নয়া ভার্নাকুলার আগে ছিল অবজ্ঞাসূচক। রেনেসাঁসই তাকে মর্যাদা দেয়। তবে জার্মান গদ্যসাহিত্যের সূচনা রিফর্মেশন থেকে। মার্টিন লুথারই জার্মান গদ্যের জনক। আবার জার্মানরাই সর্বপ্রথম তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ল্যাটিনের জায়গায় জার্মান মাধ্যম প্রবর্তন করে।

রেনেসাঁস ও রিফর্মেশন একই জিনিস নয়। রিফর্মেশন হল খ্রিস্টধর্মের সংস্কার। আর সেনেসাঁস হল পরলোকের বা পরকালের বা অতিপ্রাকৃতের স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে ইহলোকের তথা প্রকৃতির মধ্যে মানবজীবনের পরিপূর্ণতার অন্বেষা। মানুষ এই জগতের নিয়মগুলো জেনে নিয়ে এই জগতেই উন্নতির চরম শীর্ষে উত্তীর্ণ হতে পারে। যেমন হয়েছিল প্রাচীন গ্রিকরা। কত উন্নত ছিল তাদের কাব্য নাটক দর্শন বিজ্ঞান। তাদের নাট্য নৃত্য ভাস্কর্য স্থাপত্য! রেনেসাঁস ধর্ম বা খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে বাদ দিতে চায়নি। যা চেয়েছে তা নতুন করে ভাববার স্বাধীনতা, আঁকবার স্বাধীনতা, গড়বার স্বাধীনতা, করবার স্বাধীনতা। এতখানি স্বাধীনতা খ্রিস্টীয় সংস্কারকরা সহ্য করতেন না। তাই রিফর্মেশন আর রেনেসাঁসের মধ্যে একটা তফাত ছিল। ক্রমে ব্যবধান হ্রাস পায়।

এদেশের রেনেসাঁসের মূলে গ্রিস রোম নয়, ইংল্যাণ্ড ফ্রান্স। ইংরেজ ফরাসিরা এদেশে না এলে এদেশের রেনেসাঁস ভিতর থেকে ঘটত না। সংস্কৃত বা পারসিক শিক্ষা থেকেও নয়। তার জন্যে আমাদের বিদ্যার্থীদের ইউরোপ যেতে হত। সংস্কৃত বা পারসিকচর্চা এদেশে একদিনের জন্যেও বন্ধ হয়নি। সেই উৎস থেকে রেনেসাঁস প্রবাহিত হলে বহু পূর্বেই প্রবাহিত হত। মানতেই হবে যে তার জন্যে ইংরেজ ফরাসির প্রয়োজন ছিল। ইংরেজির তুলনায় ফরাসিচর্চা সামান্যই হয়। ইংরেজরা না হয়ে ফরাসিরা আমাদের শাসক হলে আরও বেশি ফরাসিচর্চা হত। রেনেসাঁসের পক্ষে সেটাও হত অনুকূল। রামমোহন, দ্বারকানাথ, মধুসূদন তিন জনেই ইংল্যাণ্ডে তথা ফ্রান্সে যান। মধুসূদন তো ফরাসি সহধর্মিণীর সঙ্গে ফ্রান্সে বসবাস করেন।

তা বলে আমাদের মনীষীরা কেউ প্রাচীন গ্রিস বা প্রাচীন রোমে তাঁদের শিকড় খুঁজতে যাননি। শিকড় তাঁদের এই দেশের অতীতেই। ইলিয়াডে ওডিসিতে নয়, রামায়ণ মহাভারতেই। তবে ইলিয়াড না পড়লে মেঘনাদবধ লেখা যেত না। তার জন্যে শুধুমাত্র রামায়ণ পড়াই যথেষ্ট ছিল না। আমাদের রেনেসাঁস প্রাচীন ভারতের সঙ্গেও একপ্রকার ধারাবাহিকতা ফিরে পায়। ইউরোপের রেনেসাঁস যেমন ফিরে পেয়েছিল প্রাচীন গ্রিস রোমের সঙ্গে ধারাবাহিকতা। প্রাচীন ভারতের পুনরাবিষ্কারে ইউরোপীয় ভারততত্ত্ববিদদের কাছে আমাদের ঋণ অশেষ। গোটা বৌদ্ধ যুগটাই তো হারিয়ে গেছিল। কেই-বা মনে রেখেছিল মৌর্যসম্রাট অশোককে। কিংবা কুষাণসম্রাট কনিষ্ককে! কিংবা মহাকবি অশ্বঘোষকে! কিংবা বৌদ্ধ জাতককে! অনবদ্য ভাস্কর্য অবহেলিত অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে রয়েছিল। আমাদের রেনেসাঁস বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান বাদ দিয়ে কেবল ব্রহ্মণ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবলম্বন করতে গেলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এর জন্যে চীন জাপান তিব্বতের দিকে তাকাতে হবে। সেসব দেশে সংরক্ষিত হয়েছে আমাদের বৌদ্ধ উত্তরাধিকার।

অথচ আমাদের রেনেসাঁস বৌদ্ধ উত্তরাধিকার সমন্ধে অজ্ঞ বা উদাসীন বললে চলে। ব্যতিক্রম কেবল রবীন্দ্রনাথ ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, যতদূর মনে পড়ে। বৈদিক ধারাটাই প্রাচীন ভারতের একমাত্র ধারা ছিল না। কিন্তু বৌদ্ধ ধারা শুকিয়ে যাওয়ায় বা খাত বদল করে তিব্বতে চীনে জাপানে প্রবাহিত হওয়ায় বৈদিক ধারাই হয় একমাত্র বহমান ধারা। এর থেকে যতখানি উর্বরা হওয়া সম্ভব ততখানি উর্বর হয়েছে আমাদের সাহিত্যের ও দর্শনের খেত। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ফলন লক্ষ করা যায়নি। যাকে আমরা হিন্দু ঐতিহ্য বলি তার ঝোঁকটা যুক্তির দিকে নয়, বিশ্বাসের দিকে। তাই আমাদের দার্শনিকরা ফিলসফি আর থিয়োলজির পার্থক্য মানেন না। ধর্মগ্রন্থও তাঁদের কাছে দার্শনিক গ্রন্থ। তেমনি, আমাদের ঐতিহাসিকদের কাছে পুরাণে ইতিহাসে প্রভেদ নেই। রামায়ণ মহাভারতও তাঁদের কাছে ইতিহাসের মর্যাদা পায়। তেমনি, আমাদের শিক্ষিতজনের কাছে জ্যোতিষ আর জ্যোতির্বিজ্ঞান অভিন্ন।

প্রাচীন গ্রিসের সঙ্গে ধারাবাহিকতা পুনঃস্থাপন না করলে ইউরোপের রেনেসাঁস সম্ভব হত না। তা বলে কি কেউ প্রাচীন গ্রিসকেই পুনরুজ্জীবিত করার কথা ভেবেছেন বা বলেছেন? রেনেসাঁসের অন্য নাম রিভাইভাল নয়। অথবা রিভাইভালের নামান্তর রেনেসাঁস নয়। রেনেসাঁসের দৃষ্টি সম্মুখের দিকে। তার সামনে অনন্ত ভবিষ্যৎ। অতীত তার তুলনায় কতটুকু! অপরপক্ষে রিভাইভালের দৃষ্টি পশ্চাৎ দিকে। সেপদে পদে অতীতের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চায়। যেন অতীতেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে তার ভবিষ্যৎ। অতীতকে অতিক্রমণের স্বাধীনতা নেই। যেন অতীতই অভ্রান্ত।

আমাদের রেনেসাঁস বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যবয়স থেকে প্রাচীন ভারতের পুনরুজ্জীবনের দিকে মোড় ঘোরে। ততদিনে সিপাহিবিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বিদেশি শাসকের সংহারমূর্তি উদঘাটিত হয়েছে। স্বদেশি শিল্পের বিনাশফলে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ যান্ত্রিক প্রগতি দিয়ে ঢাকা যায় না। স্বদেশ বনাম বিদেশ এই চিন্তা থেকে উদ্ভূত হয় জাতীয়তাবাদ। কিন্তু গোড়ায় সেটা রূপ নেয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের। প্রাচীন ভারতের হিন্দু জাতির পুনরুজ্জীবনই হয় লক্ষ্য। মুসলমানরা তো প্রাচীন ভারতে ছিল না। সুতরাং তাদের বাদ দিয়ে ভাবা হয়। যাদের বাদ দেওয়া হল তারাও চায় পুনরুজ্জীবন। কিন্তু প্রাচীন ভারতের নয়। কারণ সেখানে তারা ছিল না। তারা চায় ইসলামের আদিপর্বের পুনরুজ্জীবন। তাদের বেলা ওটা জাতীয়তাবাদ নয়। প্যান ইসলামিজম। পরবর্তীকালে হিন্দু জাতীয়তাবাদ যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হয় তখন প্যান ইসলামিজম হয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ।

সব দেশেই রেনেসাঁস দেশভিত্তিক অথবা ভাষাভিত্তিক। কোথাও ধর্মভিত্তিক বা সমাজভিত্তিক নয়। পুনরুজ্জীবনবাদীরা বিদেশি বর্জন করতে গিয়ে স্বযুগকেও বর্জন করার পরামর্শ দেন। ফিরে যেতে বলেন প্রাচীন যুগে বা মধ্যযুগে। ফিরিয়ে আনতে চান প্রাচীন যুগ বা মধ্যযুগকে। পরাধীন ও পরশোষিত দেশে রেনেসাঁসের বাণী তার গরিমা হারায়। আগে তো আমরা স্বাধীন ও স্বয়ম্ভর হই, তার পরে হবে রেনেসাঁস। স্বয়ম্ভর বলতে এটাও বোঝায় যে সংস্কৃতিতে স্বয়ম্ভর হতে হবে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমাদের স্বয়ম্ভরতার অন্তরায়। তাঁদের বিশ্বাস ইংরেজিচর্চা করলে বাংলার উন্নতি হতে পারে না। অথচ হিন্দু কলেজের উদ্যোক্তারা বাংলাকেও ইংরেজির সঙ্গে বন্ধনীভুক্ত করেছিলেন ও ইংরেজি শিক্ষার গোড়া থেকেই বাংলা শিক্ষা ছিল। তার সঙ্গে সংযুক্ত পাঠ্যপুস্তক লেখা হত ইংরেজি, বাংলা, ফরাসি, সংস্কৃত ও আরবি ভাষায়। কলকাতায় স্কুলবুক সোসাইটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, জানুয়ারি ১৮৩২ থেকে ডিসেম্বর ১৮৩৩ এই দুই বছরে ইংরেজি বই বিক্রি হয় ১৪,৭৯২ খানা। বাংলা বই ৪,৮৯৬ খানা। ফারসি বই ৮৩ খানা। সংস্কৃত বই ২০৮ খানা। আরবি বই ১৩ খানা। বেশ বোঝা যায় ইংরেজির ঠিক পরে আসর জমিয়ে বসেছে বাংলা। পরাধীনতা ও পরশোষণ তার অন্তরায় হয়নি।

সংস্কৃত সাহিত্য একদা অতি জীবন্ত ছিল, কিন্তু কালক্রমে তার অবস্থা হয় জীবন্মৃতের মতো। তার কাছ থেকে পাবার যা ছিল তা ক্রমে নি:শেষিত হয়, কিন্তু ইংরেজির মারফত পাওয়া ইউরোপীয় সাহিত্য দর্শন ইতিহাস প্রভৃতির ভান্ডার অফুরন্ত। স্বযুগ স্বদেশের চেয়ে বড়ো। অতীতকে কাঁধে নিয়ে কেউ বঁাচতে পারে না। বাড়তে পারে না। রেনেসাঁস থেকে যাঁরা অতীতে সরে গেছেন তাঁরাও রেনেসাঁস পরবর্তী বিজ্ঞানের কাছে ঋণী। বিজ্ঞান না হলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অচল। বিশেষত শহর অঞ্চলে। আধুনিক বিজ্ঞান পাশ্চাত্য রেনেসাঁসেরই মানসসন্তানই। এ স্রোতের উজানে যাওয়া নিরর্থক। ধর্মের বেলা সেটা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানের বেলা অসম্ভব। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ মহাশূন্য অতিক্রম করে চন্দ্রে পদার্পণ করেছে। মানুষের অসাধ্য কী আছে, যদি সেক্রমাগত অগ্রসর হয়? যদি আপনার অস্ত্রে আপনি নির্মূল না হয়?

মানুষ যে অসাধ্যসাধন করতে পারে এ ধারণা আগেও ছিল, কিন্তু মন্ত্রতন্ত্রের সাহায্যে। এখন মন্ত্রতন্ত্রের স্থান নিয়েছে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। তার পেছনে রয়েছে অবশ্য এই প্রতীতি যে মানুষই মানুষের নিয়ন্তা। বাইরের কোনো অলৌকিক শক্তি নয়। প্রকৃতির সমস্ত রহস্য এখনও অধিগত হয়নি, কিন্তু হতে পারে এমন সম্ভাবনা আছে। মানুষের ভিতরেও রয়েছে অপার সম্ভাব্যতা। সেহতে হতে কী হয়ে উঠবে তা সেনিজেই জানে না। সুপারম্যান হওয়াও অসম্ভব নয়। সেকালে লোকে তপস্যা করত স্বর্গের ইন্দ্র হতে। একালের বিশ্বমানচিত্রে স্বর্গের অবস্থান অজানা। ইন্দ্রের হাতে ছিল বজ্র। তার চেয়েও শক্তিমান হাইড্রোজেন বোমা এখন মানুষের হাতে। আরও শক্তিশালী মারণাস্ত্র এর পরে হাতে আসতে পারে। রেনেসাঁসের পূর্বে বৌদ্ধরা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ সাধনা করলে বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারে। আর বুদ্ধ যিনি হন তিনি দেবতাদের চেয়েও ঊর্ধ্বে। দেবত্ব লাভ করাই বড়ো কথা নয়। রেনেসাঁসের পরে হিউম্যানিস্টরা বিশ্বাস করেন যে দেবত্বলাভ বা বুদ্ধত্বলাভও শেষ কথা নয়। শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই। ক্রমাগত বিবর্তিত হতে হবে, জগতের পরিবর্তন ঘটাতে হবে, এমন কোনো পরিণতি কাম্য নয় যা অপরিবর্তনীয় বা চিরন্তন।

এসব সত্ত্বেও আজকের দিনের মানুষ আশাবাদী নয়। যতদূর বোঝা যায় পৃথিবী ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসবে, তুষার দিয়ে ঢেকে যাবে। মানুষ যদি বেঁচে থাকে তো এস্কিমোদের মতো বরফের গুহায় বাস করবে। ভাবনার কথা বই কী। তখন হয়তো মানুষ গ্রহান্তরে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করবে। সারাপৃথিবী তো আজ এখনই উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু বনে যাচ্ছে না। সামনে হাজার হাজার বছর সময় রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক ব্যবস্থা উদ্ভাবনের। প্রাণ এক ফুঁয়ে নির্বাপিত হয় না। এটা অবশ্য বিশ্বাসের কথা।

রেনেসাঁস হল রিয়্যালিটির সঙ্গে পা মিলিয়ে নেওয়া। তা যদি না হয় তো সেটা রেনেসাঁস নয়, সেই নামে অন্য জিনিস। বাংলার রেনেসাঁস কি রিয়্যালিটির সঙ্গে পা মিলিয়ে নিয়েছে? ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত বইপত্র পড়ে যাঁদের জ্ঞানোদয় হয় তাঁরা ধর্মে ও সমাজে ঘোর রক্ষণশীল হলেও বাস্তব জগতের স্বরূপ জানতে সংস্কারকদের মতোই উৎসুক ছিলেন। হিন্দু কলেজের সনাতনী উদ্যোক্তারা স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্টকে যা বলেন তা হাইডের পত্রে বর্ণিত হয়েছিল এইভাবে—

The principal objects proposed for their adoption had been cultivation of the Bengalee and English languages in particular. The Hindustanee tongue as convenient in the Upper Provinces, and the Persian if desired as ornamental. General duty to God. The English system of morals (the Pundits and some of the most sensible of the rest deplored their national deficiency in morals), Grammar Writing in English (as well as Bengalee), Arithmetic (this is one of the Hindu virutes), History, Geography, Astronomy, Mathematics, English Belles Letters, Poetry as the fund increases. (Sir Edward Hyde East’s letter to the Earl of Buckinghamshire, dated, Calcutta, 7 May 1816).

লক্ষণীয় এই যে বিষয়তালিকায় সংস্কৃতের উল্লেখ ছিল না। হিন্দু কলেজের ছাত্ররা হিন্দু। তারাই তাহলে সংস্কৃতবর্জিত শিক্ষালাভ করবে। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় বেসরকারি উদ্যোগে। সরকার তার দায়িত্ব নিতে নারাজ। পরে সরকারি উদ্যোগে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে সমাজসংস্কারক রামমোহন রায় লর্ড আমহার্স্টকে যে পত্র লেখেন তার সার কথা এইরূপ:

Rammohan’s chief arguments were the Sanskrit learning resembled the pre-Baconian scholastic learning of medieval Europe; he apprehended that the plan to establish a Sanskrit College could ‘only be expected to lead the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practical use to the possessors or to society.’ He therefore made a fervent appeal to the Government to ‘promote a more liberal and enlightened system of instruction, embracing mathematics, natural philosophy, chemistry and anatomy with other useful sciences which may be accomplished with the sum proposed by employing a few gentlemen with talents and learning educated in Europe, and providing a College furnished with the necessary books and instruments and other apparatus.’ This remarkable letter was forwarded by Lord Amherst to the Committee for Public Instruction for its consideration. But the Committee dominated by the ‘Orientalists’ seemed to ignore it. Social Ideas and Social Change in Bengal, 1818-1835 by Dr A. F. Salahuddin Ahmed, pp 159-60)।

হিন্দুরা সংস্কৃত চায় না, চায় পাশ্চাত্য বিদ্যা। ইংরেজরা পাশ্চাত্য বিদ্যা শেখাতে চায় না, শেখাবে সংস্কৃত। আজ আমাদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে এটাই ছিল শিক্ষার অবস্থা এবং ব্যবস্থা। তৃতীয় দশকে মেকলে এসে পাশ্চাত্য বিদ্যার পক্ষে মত দেন। পাশ্চাত্য বিদ্যার বাহন হয় প্রথমত ইংরেজি, দ্বিতীয়ত বাংলা। পাশ্চাত্য না বলে তাকে আধুনিক বলাই সঙ্গত। স্কুল কলেজে প্রধানত আধুনিক বিদ্যাই শেখানো শুরু হয়। সংস্কৃতকেও স্থান দেওয়া হয়। আরবি, ফারসিকেও।

ইউরোপের রেনেসাঁসের অন্য নাম নিউ লার্নিং। সেখানকার রেনেসাঁসের সূচনা আর নববিদ্যার সূচনা সমসাময়িক। এদেশের রেনেসাঁসের সূচনা আর নববিদ্যার সূচনাও সমসাময়িক। নববিদ্যা যে চিরকাল ইংরেজি ভাষার সাহায্য নেবে এমন কোনো কথা ছিল না, এমন কোনো কথা নেই। বাংলাও নববিদ্যার বাহন হতে পারে। হচ্ছেও বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গে যদি না হয়ে থাকে তার কারণ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গ। আর ভারত একটি বহুভাষী দেশ। প্রত্যেকটি রাজ্য যদি ভাষাভিত্তিক হয় তবে ভারত বহুধাবিভক্ত হতে পারে। যেমন হয়েছে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি। ইংরেজিই একমাত্র ভাষা যা সব রাজ্যের বিদ্বানরা বোঝেন, যা তাঁদের যোগাযোগের ভাষা। তাই ইংরেজির প্রয়োজন ফুরোয়নি, চিন্তার আদান-প্রদানের জন্যে তা অপরিহার্য এক লিঙ্গুয়া ফাঙ্কা। তা ছাড়া বাইরের বিশ্বের নতুন জ্ঞানও তো ইংরেজির সাহায্যেই আমরা পাচ্ছি। সংস্কৃত বা ফারসির মতো ইংরেজি গতিহীন নয়। এ দেশের ইংরেজি জানা লোকেরাই সবচেয়ে এগিয়ে। নিছক বাংলা জানা লোকেরা তুলনায় পেছিয়ে। রেনেসাঁস তো অগ্রসরদের নিয়েই হয়। সর্বজনকে দিয়ে নয়।

সার্বজনীন শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। সেটাও হবে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষা। তার সঙ্গে কারিগরি বা কৃষিকর্মের। কিন্তু তার জন্যে আমি ইংরেজির আবশ্যকতা দেখিনে। তবে যাদের বেলা সেটা উচ্চতর শিক্ষার সোপান তাদের জন্যে ইংরেজির ব্যবস্থা থাকা চাই। নইলে তাদের উচ্চতর শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শিক্ষার সম্পূর্ণতা ন্যায়ত সকলের প্রাপ্য, কিন্তু কার্যত তাদেরই, যারা তার যোগ্য ও যারা তাদের যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়েছে। শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে অন্তত পঁচিশ বছর বয়স লাগে, অতদিন অপেক্ষা করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া ক-জনেরই বা তাতে সত্যিকার আগ্রহ আছে? অধিকাংশেরই তো লক্ষ্য রুজিরোজগার। তার জন্যে জীবনের প্রথম পঁচিশটা বছর অপেক্ষা করতে রাজি হবে ক-জন? স্কুলের পড়া শেষ হতে-না-হতেই ইংল্যাণ্ডে আজকাল চাকরি জুটে যায় অধিকাংশের। চাকরি করতে করতে তারা রাতের বেলা ক্লাস করে, পরে পরীক্ষা দেয়, ডিগ্রি পায়। নয়তো লাইব্রেরিতে গিয়ে বা লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে পড়াশোনা করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলাটাই মুখ্য। যারা পেছিয়ে পড়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রিধারী হলেও একালের দৃষ্টিতে সেকালের।

ইংরেজ আমলের আগে হিন্দুরা ছিল পেছিয়ে পড়া সেকেলে এক ধর্ম সম্প্রদায়। মুসলমানরা তাদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছিল গ্রিক থেকে অনূদিত আরবি গ্রন্থের ও আরবি থেকে অনূদিত ফারসি গ্রন্থের মাধ্যমে। ইটালিতে গ্রিক পন্ডিতদের আশ্রয়গ্রহণের পূর্বে আরবরাই স্পেন জয় করে গ্রিক থেকে অনূদিত আরবি গ্রন্থের সাহায্যে সেকালের পক্ষে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা দেয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিক থেকে সেটাও একপ্রকার রেনেসাঁস। কিন্তু তার সীমা অত্যন্ত সংকীর্ণ। গ্রিক থেকে কিছু দার্শনিক গ্রন্থও আরবিতে তর্জমা হয়েছিল। কিন্তু সবার উপরে কোরান সত্য, তাহার উপরে নাই। তাই মানবিকবাদী চিন্তা আরব-পারসিকদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ভারতের মুসলিমসমাজ কালক্রমে সেকেলে হয়ে যায়। রিয়্যালিটির থেকে তাদের দূরত্ব মাদ্রাসার শিক্ষার দ্বারা ঘোচে না। ঘোচবার নয়। প্রয়োজন ছিল হিন্দু কলেজের অনুরূপ আর একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার অথবা হিন্দু কলেজেই অহিন্দু ছাত্রদের সহাধ্যয়নের। প্রথমটিতে মুসলিমসমাজের আগ্রহ ছিল না। দ্বিতীয়টিতে হিন্দুসমাজের আপত্তি ছিল। শেষে সরকারি চাপে হিন্দু কলেজের উচ্চতর বিভাগ রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে, নিম্নতর বিভাগ নামান্তরিত হয় হিন্দু স্কুলে। মুসলমানরা কলেজ বিভাগে প্রবেশ পায়। কিন্তু তাদের সংখ্যা বাড়া দূরে থাক কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায়। বোঝা গেল যে তারা কলেজ ফি জোগাড় করতে পারছে না। তখন তাদের জন্যে ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হয়। ইতিমধ্যে হিন্দু ছাত্ররা ঝাঁকে ঝাঁকে পাস করে বেরিয়েছে। কেবল প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে নয়, বেসরকারি কলেজ থেকে; সেখানকার ফি অনেক কম। হিন্দু ছাত্ররা যে স্টার্ট পেয়ে যায় মুসলিম ছাত্ররা একই কলেজে পড়ে কোনোদিনই তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। তখন তাদের জন্যে আলাদা কলেজ খুলতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো সেই একই। পরে তাদের জন্যে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ও হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা প্রধানত তাদের স্বার্থেই প্রতিষ্ঠিত।

হিন্দু কলেজের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও ঐতিহাসিক ভূমিকা হল রেনেসাঁসের উদবোধন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ গোষ্ঠীর উদয় হয় তার নজির কলকাতার হিন্দু কলেজের ‘ইয়ংবেঙ্গল’ গোষ্ঠী। ডিরোজিয়ো যার নেতা। মুসলমানপ্রধান পূর্ব বাংলার রেনেসাঁসের সূত্রপাত হয় মূল বাংলার রেনেসাঁসের শতখানেক বছর পরে। এই অস্বাভাবিক বিলম্বের একাধিক কারণ। প্রথম কারণটা হল খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে একাকার ভেবে ইংরেজির প্রতি অনীহা। এটা হিন্দুদের মধ্যেও কতক পরিমাণে ছিল। ওড়িশায় এ মনোভাব বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও লক্ষিত হয়েছে। চিন্তামণি আচার্যের পিতা তাঁকে ইংরেজি স্কুলে পড়তে পাঠাবেন না, ছেলে পাছে খ্রিস্টান হয়ে যায়। ছেলেকে বাড়ি থেকে পালাতে হয়। অমূলক আশঙ্কা। কিন্তু এর ফলে রেনেসাঁস বিলম্বিত। সারা দুনিয়ার মুসলমান এর দরুন পশ্চাৎপদ। ইংরেজির প্রতি অনীহা দূর হল যদি তো বাংলার প্রতি বিরাগ কিছুতেই যায় না। বাংলা নাকি হিন্দু ধর্মের সঙ্গে একাকার। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও বাঙালি মুসলমান বাংলার মধ্যে হিন্দুত্বের গন্ধ পায়। যে ভাষা ইসলামের ভাষা নয় সেভাষা কী করে বাঙালি মুসলমানের ভাষা হবে? অথচ উর্দু শিখতেও সেউৎসাহ বোধ করে না। প্রতিযোগিতায় উর্দুভাষী মুসলমানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। আরবি হরফে লেখা বাংলা, আরবি ফারসি দিয়ে ‘পাক’ করা বাংলা এমনই কতরকম প্রস্তাবের পর সেবাংলাকেই তার আপনার ভাষা বলে মেনে নেয় ও তার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করে।

ভূমি বা ভাষা এর একটির বা এ দুটির উপর দাঁড়িয়ে আছে যেকোনো দেশের রেনেসাঁস। তা সেইটালিরই হোক আর বাংলারই হোক। হিন্দুত্বের রেনেসাঁস হয় না, হয় রিফর্মেশন। ইসলামের রেনেসাঁস হয় না, হতে পারত রিফর্মেশন, কিন্তু এখনও হয়নি। হিন্দুরা এটা মোটামুটি বুঝতে পারে মাইকেল মধুসূদনের কীর্তি দেখে। তিনি ধর্মে হিন্দু নন, তাঁর স্ত্রী ফরাসি, তাঁর আচার সাহেবি, অথচ তাঁর সৃষ্টির জন্যে প্রত্যেক বাঙালির উচ্চতা বেড়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ বহুদেবতাবাদী সাকারবাদী হিন্দু নন, একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম। অথচ বিশ্বকবিসভায় তিনিই বাঙালির অদ্বিতীয় প্রতিনিধি। বাংলার রেনেসাঁসের আদিপুরুষ বলে যদি রামমোহনকে গণনা করি তবে তিনিও সাম্প্রদায়িক অর্থে হিন্দু নন। আর যদি রামমোহনকে রেনেসাঁসের আদিপুরুষ না বলে রিফর্মেশনের আদিপুরুষ বলি তবে রেনেসাঁসের আদিপুরুষ বলতে হয় ডিরোজিয়োকে। কিন্তু তাঁর চিন্তার বাহন ছিল বাংলা নয়, ইংরেজি। ঐতিহাসিক কারণে বাংলা আর ইংরেজি দুই ভাষাই হয় বাংলার রেনেসাঁসের আধার। রামমোহনের বেলাও তাই। মাইকেলের বেলাও তাই। বঙ্কিমচন্দ্রের বেলাও তাই। এমনকী বিদ্যাসাগরও ইংরেজিতে লিখেছেন। এক্ষেত্রে দেশই বড়োকথা। ভাষা তার পরে।

এখন যাকে বাংলাদেশ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার বেলা কিন্তু ভাষাই বড়োকথা। দেশ তার পরে। পাকিস্তানের সৃষ্টি ধর্ম থেকে। বাংলাদেশের সৃষ্টি ভাষা থেকে। সেখানকার রেনেসাঁস বিলম্বিত হলেও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবসময় মনে রাখতে হবে যে রিয়্যালিটির সঙ্গে পা মিলিয়ে নিতে হবে নইলে বাংলাও সংস্কৃত ও ফারসির মতো পেছনে পড়ে থাকবে।