আর্টের উদ্দেশ্য

আর্টের উদ্দেশ্য

আর্টের উদ্দেশ্য কী?

এর পালটা প্রশ্ন, প্রকৃতির উদ্দেশ্য কী?

একমাত্র প্রকৃতির সঙ্গেই আর্টের প্রতিতুলনা। আর্টের কথা ভাবলে নেচারের কথা মনে আসে। আবার নেচারের কথা ভাবলে আর্টের কথা। মানুষ বলে আরেক জন না থাকলে প্রকৃতি একাই থাকত। এটা হত একমাত্র প্রকৃতির জগৎ। মানুষ এসেছে তার সৃষ্টির অমিত শক্তি নিয়ে। প্রকৃতির মতোই সেঅকৃপণ ও সর্বক্ষণ সক্রিয়। এটা তাই মানুষেরও জগৎ।

কিন্তু মানুষ যদি শ্রান্ত হয়ে ক্ষান্তি দেয় তাহলে আর মানুষেরও জগৎ বলে কিছু থাকবে না। থাকবে শুধু প্রকৃতির জগৎ। প্রকৃতির শ্রান্তি নেই, ক্ষান্তি নেই। মানুষ যদি প্রকৃতির কাছ থেকে প্রকৃতিরই মতো অশ্রান্ত অক্ষান্ত থাকার রহস্যটি আয়ত্ত করতে পারে তাহলে মানুষেরও শ্রান্তি নেই, ক্ষান্তি নেই। সেও অনন্তকাল সৃষ্টি করে যেতে পারবে।

প্রায় প্রত্যেক যুগসন্ধিতে একবার করে প্রকৃতির কাছে ফিরে চলার রব ওঠে। কিন্তু সভ্যতা মানুষকে এমন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে যে প্রকৃতির সঙ্গে আপনাকে মিলিয়ে নেবার সাধ্য তার ক্ষীণ। আরও প্রাকৃতিক না হয়ে সেতাই আরও সভ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সেটা যে আর্টের দিক থেকেও অগ্রগতি তা নয়। কারণ আর্টের দিক থেকে সেহয়তো ক্লান্ত বা নি:শেষিত। তখন তার নূতনত্ব সাধারণত পদ্ধতির বা ঘটনার। আর নয়তো বিকৃতির।

প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গেলে আর্ট তার উদ্দেশ্য থেকেও দূরে সরে যায়। তখন আর্ট হয় উদ্দেশ্যহীন কেরামতি। প্রকৃতি তো কোনোদিন কেরামতির চেষ্টা করে না। প্রকৃতির রাজ্যে কেরামতি বলে কিছু নেই। প্রকৃতির সমস্তটাই লীলা। প্রকৃতির উদ্দেশ্য ওই এককথায় বলা যায়—লীলা।

তেমনি আর্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে লীলা।

যেকোনো একটি খেলার মতো তার নিয়মকানুন খুব কড়া। সেসব মেনে না নিলে খেলা জমে না। কিন্তু খেলার শেষে বোঝা যায় তার সার্থকতা আছে। খেলোয়াড়রা খেলায় সুখ পান নিয়মকানুন মেনে ও তার ঊর্ধ্বে উঠে। তেমনি লীলারও নিয়মকানুন আছে। সেসবও কম কড়া নয়। যদিও অনেক সময় আমরা না জেনেই মেনে চলি। লিখতে লিখতে লেখা আপনি নিখুঁত হয়।

লীলা তখনই সার্থক হয় যখন সৃষ্টি একটি পরিপূর্ণতায় এসে পৌঁছোয়। হয়তো চার লাইনের একটি কবিতা। চৌপদী যার নাম। জাপানি হাইকুর মতো সতেরো সিলেবলও হতে পারে। নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যেই তার পরিপূর্ণতা। তার সেই সীমা মেনে নিয়ে সেযখন পরিপূর্ণতা পায় তখন তার আকৃতি তাকে আর্ট বলে চিনিয়ে দেয়। আকৃতি বিনা আর্ট নেই। আর্ট বিনা আকৃতি নেই।

আর্টের একদিকে যেমন প্রকৃতি আরেক দিকে তেমনি আকৃতি। প্রকৃতির প্রত্যেকটি সৃষ্টির নিজের একটি আকৃতি আছে। প্রকৃতি যত খুশি সৃষ্টি করে চললেও প্রত্যেকের জন্যে আলাদা একটা আকৃতি বরাদ্দ করতে ভোলে না। তেমনি শিল্পীরাও তাঁদের সৃষ্টির প্রত্যেকটি আকৃতি সম্বন্ধে সচেতন। কোনো সৃষ্টিই নিরবয়ব বা নিরাকার নয়। কিন্তু তা-ই যথেষ্ট নয়। আকারের সঙ্গে থাকবে আকৃতি।

নৈসর্গিক কবিপ্রতিভা সকলের নেই। কিন্তু আকৃতিজ্ঞান যেমন করে হোক অর্জন করতে হবে। নানা দেশের নানা যুগের সেরা কবিতা পড়তে পড়তে শুনতে শুনতে এ জ্ঞান জন্মাতে পারে। তেমনি ছবি দেখতে দেখতে চিত্রকরসুলভ আকৃতিজ্ঞান। গান শুনতে শুনতে সংগীত সম্পর্কিত আকৃতিজ্ঞান। মানুষকে জন্মসূত্রে যা দেওয়া হয়েছে তার অভাব যদি কারও জীবনে দেখা যায় তবে তার অভাব পূরণ করে শিক্ষা। এইজন্যে শিক্ষার এত মূল্য। যারা জাতশিল্পী তাদেরও শিক্ষার দরকার হয়। ঐতিহ্য তো পড়ে পাওয়া যায় না। বড়ো বড়ো প্রতিভাকেও হাতেকলমে পূর্বসূরিদের কাছে শিখতে হয়।

ধারাবাহিকতা যেমন প্রকৃতির বেলা তেমনি আর্টের বেলাও সত্য। বহতা নদীর মতো এর আদি নেই অন্ত নেই। আছে শুধু ধারা। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি ধারাভঙ্গ করতে পারো, কিন্তু তা হলেও একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। আর সে-ধারাকে আলাদা করে দেখলেও সেএকেবারে নি:সম্পর্কীয় নয়। যার থেকে সেপৃথক তার ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র কোথাও এক জায়গায় রয়েছেই। শাখা অসংখ্য হলেও মূলস্রোত একই। ধারাভঙ্গ বার বার ঘটলেও ধারাবাহিকতা গঙ্গোত্রীর সঙ্গে অন্বয় রক্ষা করে। ঐতিহ্য যেখানে হারিয়ে গেছে সেখানেও তার সঙ্গে সংযোগ ফিরে পাবার জন্য প্রাচীনের পুনরুদ্ধার করতে হয়।

কিন্তু পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে পুনরাবৃত্তি নয়। স্বদেশি আন্দোলনের দিনে যখন আমরা ভারতীয় চিত্রকলা সম্বন্ধে নতুন করে সজাগ হই তখন অজন্তার সঙ্গে জোড় মিলিয়ে নেবার দরকার ছিল। কিন্তু পৌরাণিকের পুনরাবৃত্তি দু-দিনেই নি:শেষ হতে বাধ্য। কারণ স্বযুগটা পৌরাণিক নয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পরে আর পুনরাবৃত্তি নয়। নব নব কল্পনা ও নব নব আকৃতি আমাদের ঐশ্বর্যের পরিচায়ক।

দেশের মতো যুগেরও একটা মূলস্রোত আছে। তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে শুধুমাত্র দেশের ধারা বেশিদিন বিচিত্র থাকে না। ঊনবিংশ শতাব্দী আমাদের কবিদের গঙ্গাস্নানে অভ্যস্ত জীবনকে সমুদ্রস্নান করায়। সমুদ্রের জোয়ার ছুটে আসে গঙ্গার বুকে। তার ফলে যা ঘটে তার নাম আমাদের সাহিত্যের রেনেসাঁস। প্রয়াগের বা হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় বার বার গঙ্গাবগাহন করেও এ ফল লাভ হত না। আমাদের অনেকেই এ সত্য ইতিমধ্যে ভুলে গেছেন। কুম্ভমেলার সহস্র সহস্র বর্ষের পুনরাবৃত্তি পরম বিস্ময়ের বিষয় হলেও সমুদ্রের একদিনের একটা জোয়ার তার চেয়েও ফলপ্রসূ। তবে ফলপ্রসূ বলতে যাঁরা পরকালে বা পরলোকে ফলপ্রসূ বোঝেন তাঁদের কাছে এ যুক্তি নিষ্ফল।

এ যুগে বাস করলে এ যুগের মূলস্রোতে অবগাহন করতে হয়। সেই মূলস্রোত যদি জোয়ার হয়ে এদেশের নদীতে প্রবেশ করে তবে তা যদিও উলটো স্রোত তবু তার সঙ্গে স্বদেশের বহমান স্রোতকে মিলিয়ে নিতে হবে। এটা একপ্রকার সংস্কৃতি বিপ্লব। সারা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে এর সঙ্গে যোঝাযুঝি ও বোঝাবুঝি চলছে। বিংশ শতাব্দীতেও তার শেষ নিষ্পত্তি হয়নি। লক্ষণ দেখে মনে হয় সমুদ্র আমাদের পর আর গঙ্গা আমাদের আপনার; এই সংস্কার এখনও একান্ত প্রবল। রেনেসাঁস যদি ভঙ্গিসর্বস্ব হয় তবে তার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে বলতে হবে।

রেনেসাঁস হচ্ছে নতুন প্রাণশক্তির উত্তাল তরঙ্গ। তার রঙ্গ জীবনের অন্যান্য বিভাগের মতো আর্টকেও আন্দোলিত করে। যে তরুণী এতদিন নদীর জলে পাল তুলে ভেসেছিল সেএখন সমুদ্রের জলে দিশাহারা বোধ করে। মাথার উপরে ধ্রুবতারা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। হাতের কাছে থাকে কম্পাস। আকাশ যখন মেঘে ঢাকা তখনও তার দিকনির্ণয়ের ভুল হয় না। ঝড়ঝাপটায় কম্পাসও ভেঙে যেতে পারে। সে-সময় তাকে বঁাচাবে কে! সেইটেই বিংশ শতকের মধ্যভাগে যুদ্ধবিগ্রহের ও রাষ্ট্রবিপ্লবের মুখে পড়া তরুণীর প্রশ্ন। এ প্রশ্নে ইউরোপই এখন জর্জরিত। জীবন যদি লন্ডভন্ড হয় আর্ট কী করে আপনাকে নিয়ে আত্মসমাহিতভাবে বঁাচবে?

কবিদের কাছে জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা আসছে। তাঁদের নিজেদেরও জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা জমছে। এসব জিজ্ঞাসার উত্তর হোমর বাল্মীকি ভার্জিল কালিদাসের দিকে তাকালে পাওয়া যাবে না। ক্লাসিক এখানে নিরুত্তর। রেনেসাঁস যতগুলো ঢেউ তুলেছে ততগুলো ঢেউ ভাঙতে বা ঢেউয়ের পিঠে চড়তে শেখায়নি। সাহিত্য আজকাল সমস্যার অবতারণা করে, সমাধান বলে দেয় না—বলতে পারে না। সমাধানের জন্যে দ্বারস্থ হলে পাশ কাটিয়ে যায়। বলে, ‘একালের সাহিত্য বেদ বাইবেল কোরান তো নয়ই, কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল বা মাও-সে-তুং এর চিন্তাও নয়। কী জবাব দেবে? জবাব জানা থাকলে তো? আজকের যেটা দেবে কালকেই সেটা বাসি হয়ে যাবে। কাল যে কী ঘটবে কেউ তা বলতে পারে না। আমরা দিন আনি দিন খাই।’

কতক লোক যে ধর্মের শরণ নেবে এটা অস্বাভাবিক নয়, এটাই বরং স্বাভাবিক। তেমনি সংঘের শরণ নেওয়া, তা সেযেকোনো সংঘই হোক। বুদ্ধের স্থান নিয়েছেন রাজনীতির গণনায়করা। তাঁদের কাছেও লোকে শরণ পায়। কিন্তু আর্ট বা সাহিত্য কাউকে শরণ দিতে অক্ষম। ওই যে অক্ষমতা ওটা ইচ্ছাকৃত নয়। ধ্রুবতারা অদৃশ্য হলে, কম্পাস অচল হলে তরণী নিজেই দিশাহারা।

তা হলেও কেবল ভেসে বেড়ানো চলবে না। আপনার ভিতর থেকেই প্রত্যয় সংগ্রহ করতে হবে। আর্টের কাছে প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর মিলবে না সেকথা ঠিক। কিন্তু আর্ট কেন মিথ্যার ব্যাপারী হবে? আর্টের কাজ সত্যের কাছে সত্যরক্ষা। আমার জীবনের যা সত্য, আমার যা সত্য, তাই আমার হাতে রূপ পাবে। কারও ভয়ে আমি যেন তাকে চেপে না রাখি বা অন্যরকম না করি।

সংকট যতই ঘনিয়ে আসুক-না কেন কবি বলে কেউ যদি বেঁচে থাকেন ও লেখনী তুলে ধরা যদি অসম্ভব না হয় তবে সত্যের কাছে সত্যরক্ষাই তাঁর কাজ। সেইভাবে কাব্যের মধুচক্রে যা জমবার তা জমবে। লোকে একদিন তার আস্বাদন নেবে, কিন্তু সদ্য সদ্য কোনো দুরূহ প্রশ্নের উত্তর পাবে কি না সন্দেহ।

সভ্যতা দিন দিন যেমন জটিল হচ্ছে তাকে সরল করে আনার কোনো উপায় যদি না থাকে তবে আর্ট তাকে কারও কাছে সরল করতে পারবে না। সরল করতে হলে বাদসাদ দিতে হয়, পরিহার করতে হয়। পপুলার সায়েন্সের মতো পপুলার আর্ট সৃষ্টি করতে হয়। তেমন করে আর্ট অগ্রসর হবে না।

যেটুকু আমার কাছে উপলব্ধ সত্য সেইটুকুতেই আমার অধিকার। আর্টের অতি সামান্য ভগ্নাংশ হলেও সত্যের দিক থেকে তা নিটোল। তেমনি রূপের দিক থেকেও নিখুঁত। হয়তো এক ফোঁটা চোখের জল, তবু আর্টের মধুচক্রে তারও ঠাঁই আছে। কোনো জিজ্ঞাসার উত্তর না হয়েও সেস্বত্ববান। সেঅস্তিত্ববান।

লীলা যাকে বলি তা এই অস্তিত্বের মধ্যে আপনাকে খুঁজে পাওয়া ও ধরে দেওয়া। কার কোন কাজে লাগবে জানিনে, তবে এ না হলে আমি বঁাচিনে। আর্ট আমাকে বঁাচায়।