মায়া ও সত্য

মায়া ও সত্য

আমার মা বলতেন, ‘এ সংসার মায়ার। কেউ কারও নয়। ওই যে গোপাল বিগ্রহ দেখছিস, ওই সত্য।’

অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মায়া। ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন তত্ত্ব। মা কিন্তু ওটা শাস্ত্র পড়ে পাননি। অত বিদ্যা ছিল না তাঁর। পেয়েছিলেন বহু দুঃখে। ঠাকুরের কাছে দিনরাত পড়ে থেকে। এ জ্ঞান যার হয়েছে সেবেশিদিন বঁাচে না। সংসারের মায়া কাটায়।

আমি কিন্তু ওকথা মানতুম না। এখনও মানিনে। ব্রহ্ম সত্য সে-বিষয়ে আমি নি:সন্দেহ। কিন্তু এ জগৎ মায়ার জগৎ হলে কীসের আকর্ষণে আমি বেঁচে আছি? কেনই-বা সৃষ্টির দায় মাথায় নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছি?

না, আমি স্বীকার করব না যে এ সংসার মায়ার সংসার। কিন্তু মা যে ওর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন কেউ কারও নয় সেটা এককথায় উড়িয়ে দিই কী করে? মানুষ কোনখান থেকে আসে, কোনখানে যায়, মাঝখানে ক-টা দিনের জন্যে কতরকম সম্পর্কে বঁাধা পড়ে। একজনের ছেলে আরেক জনের স্বামী, আরেকজনের বাপ, আরেকজনের বন্ধু, এসব যখন ভাবি তখন আমিও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, সমুদ্রের বেলায় বালুর খেলাঘর।

মহাযুদ্ধ রাষ্ট্রবিপ্লব প্রভৃতি যদি সত্য না হয় তো সত্য কী? সত্য কাকে বলে? তবু আমারও থেকে থেকে মনে হয় যে মহামায়ার মায়া। সব যেন পর্দার উপর ছায়াছবির মতো ভাসছে। একটু বাদে মিলিয়ে যাবে। এই অভিনেতারা কেউ থাকবে না। এদের কীর্তির রেকর্ডও হাজার কয়েক বছর বাদে নি:শেষে মুছে যাবে। মহাকালের দৃশ্যপটে কয়েক হাজার বছর তো কয়েকটা মুহূর্ত। কয়েক লক্ষ বছর বাদে পৃথিবীও থাকে কি না দেখো। মহাকালের মহামায়া সৌরজগৎকেও বালুর খেলাঘরের মতো ভাঙবেন।

দেখতে দেখতে চোখের সুমুখে মিলিয়ে গেল দীর্ঘ সাত পুরুষের ইংরেজ রাজত্ব। মায়া নয় তো কী! সাত শতাব্দীর গৌড়বঙ্গ ভূমিকম্পে দ্বিখন্ড হয়ে গেল। মায়া নয় তো কী! কিন্তু কত লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ গেল, প্রাণের চেয়ে প্রিয় পূর্বপুরুষের বাস্তু গেল, কত সহস্র সহস্র নারীর প্রাণের চেয়ে মূল্যবান ইজ্জত গেল—হায় মহামায়া! সেও কি তোমার মায়া! শঙ্করাচার্য কী বলেন?

জ্ঞান হবার সময় থেকেই মানবজাতির এ জিজ্ঞাসা। যা-কিছু দেখছি সবই কি সত্য? সবই কি মায়া? যা-কিছু ঘটছে সবই কি সত্য? সবই কি মায়া?

দেশবিদেশের দার্শনিকরা এখনও এ জিজ্ঞাসার সর্বসম্মত মীমাংসা খুঁজে পাননি। দর্শনের মতো আর্টেরও এটা একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন। সাপের মতো যেটা দেখতে সেটা হয়তো সাপ নয়, দড়ি। কিংবা দড়ির মতো যেটা দেখতে সেটা হয়তো দড়ি নয়, সাপ। জীবনমরণের প্রশ্ন বই কী। যদি দড়ি না হয়ে সাপ হয়ে থাকে তবে সর্পে রজ্জুভ্রমের পরিণাম হয়তো মৃত্যু। রজ্জুতে সর্পভ্রমও অনেকসময় ভয়ংকর হয়। অকারণ ভয় থেকেও কখনো কখনো মৃত্যু ঘটে। শক পেয়ে মৃত্যু।

বিভ্রম ও সত্যতা দর্শন, বিজ্ঞানের মতো আর্টেরও একটা মূলগত সমস্যা। কোনটা ইলিউশন, কোনটা রিয়্যালিটি এ নিয়ে মতভেদ হতে পারে, কিন্তু একটা যে অপরটা নয় এ বিষয়ে সকলে একমত। সাপটা যদি সত্য হয় দড়িটা মায়া। দড়িটা যদি সত্য হয় সাপটা মায়া। কিন্তু কী করে স্থিরনিশ্চিত হব যে ওটা দেখতে দড়ির মতো, আসলে সাপ? বা দেখতে সাপের মতো, আসলে দড়ি?

শিল্পীদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অন্তহীন তর্ক করবেন না। সোজা এগিয়ে গিয়ে সাপের গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করবেন সাপ না দড়ি। অত্যন্ত বিপজ্জনক পরীক্ষা। এঁরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বিশ্বাস করেন ও তার ঝুঁকি নিতেও তৈরি। আগুনে হাত না দিয়ে এঁরা মেনে নেবেন না যে হাত পুড়ে যাবে, হাতের ছোঁয়া লেগে মুখও পুড়বে। জীবনের স্বাদ জীবনের কাছেই মেলে, দুধের স্বাদ যেমন দুধের কাছে। কল্পনা সে-স্বাদ জোগাতে পারে না। পরোক্ষ অভিজ্ঞতা বা শোনা কথা তার স্থান নিতে পারে না। অথচ জীবনের ক-টা অভিজ্ঞতাই-বা কজনের বেলা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা!

আমার এক বন্ধু আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন বিবাহযোগ্যা কুমারীদের ফোটো দেখে বিশ্বাস না করতে। ফোটোতে নাকি আসল রূপ ধরা পড়ে না। বলতে হয়, কন্যাটিকে স্বচক্ষে দেখতে চাই। স্বচক্ষে দেখেও কত লোক ঠকে গেছে বন্ধু বোধ হয় জানতেন না। কিংবা জানলেও একজন বাস্তববাদী সাহিত্যিক হিসাবে সেইটেই তাঁর দাবি। নিজের চোখের উপর তাঁর অসীম আস্থা। বাস্তববাদী হলে যা হয়। আমি কিন্তু রোমান্টিক। আমি চোখে না দেখেও ইমেজ বানাই। ফোটো না দেখেও প্রতিমা গড়ি। রূপ যাকে বলি তার কতক আমার কল্পনা, কতক নারীর আপন রূপ। তেমনি যেকোনো মানুষের বা প্রাণীর বা বস্তুর বা ঘটনার আসল সত্যের রূপ খোলা চোখেও দেখা যায় না। সেযেন সূর্যের রূপ।

একজন বিচারক হিসাবে আমার কাজ ছিল ঠিক কী হয়েছিল তা সাক্ষীদের মুখে শোনা ও শুনে লিপিবদ্ধ করা। ঠিক যে কী হয়েছিল তা চাক্ষুষ সাক্ষীরাও বলতে পারে না। অনেক জায়গায় ফাঁক থেকে যায়। অনেক জায়গায় গোলমাল হয়ে যায়। লিপিবদ্ধ যেটা হয় সেটা হুবহু সত্য নয়। বাস্তববাদ তা হলে কীসের উপর নির্ভর করে পাঁচজনকে ডেকে বলবে, এই যা লিপিবদ্ধ হল তা-ই সত্য? তা-ই ঠিক? তা-ই আসল?

কাজ চালানো গোছের বাস্তবতা না হলে অফিস-আদালত চলে না, সংসার চলে না। এমনকী ঘরগৃহস্থালিও চলে না। কিন্তু কাজ চালানো গোছের রিয়্যালিটি দিয়ে উচ্চাঙ্গের দর্শন বা সাহিত্য হতে পারে কি? আর্ট আরও গভীরে যেতে চায়। কাজ চালানো গোছের রিয়্যালিটি তার জন্যে নয়। কাজ চালানোর জন্যে মাথাব্যথা তার নেই। ‘নইলে কাজ চলবে কী করে’ এ প্রশ্ন তাকে ভাবিয়ে তোলে না। তার প্রশ্ন, ‘আসল ব্যাপারটা কী?’

এই চেয়ারটার একটা বাহ্য রূপ আছে, সেটাই এর আসল রূপ। কিন্তু এর উপরে যে মানুষটা বসে আছে তার কি শুধু একটা বাহ্য রূপই আছে? তার আভ্যন্তরিক রূপ অপরে দেখবে কী করে? সে-ই বা দেখাবে কী করে? মুখের কথায়? পুরো মানুষটার পুরো রূপ সেনিজেই দেখেনি, সেইজন্যেই তো সাধকরা বলে থাকেন, আত্মানং বিদ্ধি। বাহ্যরূপের বর্ণনা এমন কিছু কঠিন নয়, কিন্তু তার আড়ালে ও তাকে জড়িয়ে যে অনির্বচনীয় রূপ আছে সেযে বর্ণনাতীত।

তেমনি বাহ্য ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করা শক্ত নয়, কিন্তু তার পেছনে যে কার্যকারণ পরম্পরা রয়েছে তার সন্ধান নিতে গেলে মহাভারত হয়। আর্টের পরিসর সীমাবদ্ধ। তা ছাড়া ঘটনা যেমন আকর্ষক কার্যকারণ পরম্পরা হয়তো তেমন নয়। সাধারণত এত ক্লান্তিকর যে পাঠককে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অসংখ্য খুঁটিনাটি দিয়ে জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা পরিচালিত। শরীরকে চালায় মন, মনকে চালায় প্রবৃত্তি বা প্রয়োজন বা দয়ামায়া বা উদারতা। যথার্থ অভিপ্রায় যে কী তা অনেক সময় দুর্জ্ঞেয়। অসুখ না করলে কেউ মনোবিশ্লেষণ করায় না। অসুখী ছাড়া কারও মন মনোবিশ্লেষকদের পরীক্ষার বিষয় হয় না। খাপছাড়া বা খারাপ কিছু না হলে সেটা ‘খবর’ হয় না। অধিকাংশ গল্প উপন্যাস খবরধর্মী।

সেইজন্যে প্রকৃত সত্য যে কী তা রীতিমতো ধাঁধা। বৈজ্ঞানিকরা এতকাল প্রকৃতিকে নিয়ে ব্যাপৃত ছিলেন। ইদানীং মানুষের উপর দৃষ্টি পড়েছে। কিন্তু আভ্যন্তরিক বলতে তাঁরা যা বোঝেন তা যথেষ্ট গভীর নয়। আরও গভীরে যেতে হলে কবি ও ঋষিরাই পথপ্রদর্শক। তাঁদের পথ দেখায় তাঁদের গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। সেখানে যে নিয়ে যায় তার নাম ইনার রিয়্যালিটি। সে-ই যদি সত্য হয় তবে আর সব আপাত সত্য, বা সত্যাভাস।

এই দৃশ্যমান জগৎকে মায়া বলে অগ্রাহ্য করে বা ছোটো করে কোনো কিছুই সৃষ্টি করা যায় না। সেপন্থা আর্টের পন্থা নয়। এ যেমন একদিকের কথা তেমনি আরেক দিকের কথা হচ্ছে এই দৃশ্যমান জগৎকে তার নিজের ভাষায় বা নিজের অর্থে বোঝাও যায় না, বোঝানোও যায় না—বৃথা চেষ্টা। এর বাইরে গিয়ে বাইরে থেকে দৃষ্টিপাত করা জীবিত মানুষের অসাধ্য, কিন্তু সাধনা করলে ভিতরে গিয়ে ভিতর থেকে দর্শন করা সম্ভব। সেটা কেবল সাধুসন্ত বা মুনিঋষি বা মরমিদের পন্থা নয়, কবি বা শিল্পীদেরও পন্থা। শুধু ধর্মের পন্থা নয়, আর্টেরও পন্থা সেই।

আর্টকে আমি ধর্মের অনুসরণ করতে বলছিনে। স্বধর্মের অনুসরণ করতেই বলছি। স্বধর্মের অনুসরণ করতে করতেই সেদৃশ্যমানের অন্তরালে কী আছে তার মর্মভেদ করবে। তখন তারই আলোয় দৃশ্যমানকেও ঠিকভাবে চিনবে। ঠিকভাবে বুঝবে। তার ফলে যে তার সৃষ্টি ব্যাহত বা বন্ধ হবে তা নয়। আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক যে গ্যেটে তাঁর ‘ফাউস্টের’ সমাপ্তির জন্যে বিশ্বরূপ প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল। আর বিশ্বরূপ কেবল মর্ত্যরূপ নয়। কী করে তিনি তা নিরীক্ষণ করতেন যদি-না অন্তর্ভেদী দৃষ্টির বর্তিকা হাতে নিয়ে যাত্রা করতেন? ফাউস্টের জীবনবৃত্ত কোথায় গিয়ে সম্পূর্ণতা পেল তা উপলব্ধি করেই তিনি শান্তি পান। নইলে প্রথম খন্ডের খন্ডসত্য তাঁকে আমরণ অস্বস্তি দিত।

না, দৃশ্যমানকে খারিজ করে বা খাটো করে নয়, তাকে তার আভ্যন্তরিকের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েই বিধাতার সৃষ্টির সমগ্রতাবোধ ও মানবের সৃষ্টির পরিণতি। রবীন্দ্রনাথ যে রূপসাগরে ডুব দিয়েছিলেন তাঁর মনে ছিল অরূপরতনের আশা। রূপদৃষ্টি তাঁর মতো আর কার অমন ছিল! অথচ সেইখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি। অরূপদৃষ্টির উন্মীলন চেয়েছেন। তাঁর কাব্য তা বলে ব্রহ্মসূত্রে পর্যবসিত হয়নি।

বিধাতা তাঁর সৃষ্টির দায়ের খানিকটা আমাদের হস্তান্তর করে দিয়েছেন। আমরাও স্রষ্টা। আমরা যা সৃষ্টি করি তার অঙ্গেও মায়া-মাখানো। নাটকের বা উপন্যাসের জগৎও কি মায়ার জগৎ নয়? হ্যামলেট বা আনা কারেনিনা কি সত্যিকার চরিত্র? তাদের জীবনের ঘটনা কি সত্য ঘটনা? মায়া নিয়েই আমাদের কারবার, অথচ আমরা সত্যের আবরণ খুলে দিই। হিরন্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ আবৃত। সেআবরণ খুলে দেখানোর ভার যাদের উপরে পড়েছে আমরাও তাদের মধ্যে আছি। হে শিল্পী, হে কবি, তৎ ত্বম অপাবৃণু।