মরুদস্যু – ২

দুই

গাড়ির গতি কমিয়ে পথের ধারে সরে গেল হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ান। তার মাত্র তিন সেকেণ্ড পর ঝড় তুলে পাশ কাটিয়ে গেল নীল পিকআপ। উধাও হলো ইঞ্জিনের গর্জন। চারপাশে থাকল শুধু ধুলোর মেঘ।

‘লোকটা কে?’ রেগে গিয়ে জানতে চাইল মুসা, ‘আরেকটু হলে তো গেছিলাম!’

ফুলে উঠেছে ফিলিপ রায়ানের চোয়ালের হাড়। ভীষণ খেপে গেছে সে-ও, ঘুরিয়ে নিল গাড়ি, পিছু নিল নীল পিকআপের। আড়ষ্ট স্বরে বলল, ‘ডোনাল্ড ওয়াইলি! কী ডাকাতি করতে গেল জানি না, কিন্তু ওর বুঝতে হবে গায়ের জোরে রাস্তা থেকে কাউকে নামিয়ে দেয়া যায় না।’

হুইলের উপর চেপে বসেছে রেঞ্জারের দু’হাতের আঙুলগুলো।

পুরু ধুলোর মেঘের কারণে উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

এরই ভিতর বহু দূরে চলে গেছে নীল পিকআপ, আর দেখা গেল না ওটাকে।

আরও কিছুক্ষণ পর চারপাশের ধুলোর চাদর হালকা হলো।

‘আমার ভুল না হয়ে থাকলে এ পথে কোনও টার্নঅফ নেই,’ বলল কিশোর। ‘হয় মরুভূমির ভেতর দিয়ে ফিরতে হবে, নইলে আবারও আসতে হবে এ পথেই। আমরা এগুলে বোধহয় দেখা পাব ওয়াইলির।’

‘সমস্যা: পার্কের সব রাস্তা বৃত্তাকার আর ওয়ান-ওয়ে,’ বলল ফিলিপ রায়ান, ‘মরুভূমির ক্ষতি কমাতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু অনেক দুর্ঘটনাও ঘটছে এর ফলে। এখন ভুল দিকে চলেছে ওয়াইলি। যে গতি তুলছে, যখন-তখন কোনও গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে।’

কথাটা মাত্র শেষ করেছে রায়ান, এমন সময় নীল পিকআপটা দূরে দেখতে পেল ওরা।

রাস্তার পাশে থেমে আছে।

কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল সেই তছনছ করা ঝোপঝাড়।

ওদিক থেকে পিকআপের দিকে আসছে সোনালী চুলওয়ালা এক লম্বা লোক, হাতে কোদাল। পরনে কাজের ধূসর ইউনিফর্ম, বয়স হবে বিশ-বাইশ।

হেড রেঞ্জার তার পিকআপের পিছনে নিজের গাড়ি রাখতেই ভুরু কুঁচকে তাকাল সে।

গাড়ি থেকে নামল ফিলিপ রায়ান, দড়াম আওয়াজে বন্ধ করল দরজা। নেমে পড়েছে তিন গোয়েন্দা ও ওমর শরীফও।

‘এখানে তোমার কীসের কাজ, ওয়াইলি? ত্যাড়া সুরে জানতে চাইল রেঞ্জার। ‘পাগল হলে? ভাল করেই জানো এই রাস্তা ওয়ান- ওয়ে।’

গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে ডোনাল্ড ওয়াইলি, হাতে কোদাল। এক মুহূর্ত পর বলল, ‘আমি এসেছি আমার কোদাল নিতে।’

‘তোমার কোদাল…’ অবাক হয়েছে রেঞ্জার। ‘ওটার জন্যে?’ আস্তে করে মাথা নাড়ল হতাশ হয়ে। ‘ওই কোদালের জন্যে পাগলামি করছিলে?’

আস্তে করে মাথা দোলাল ওয়াইলি। ‘হ্যাঁ, তাই। এটা আমার বাবার কোদাল। ভয় হচ্ছিল ফিরে এসে দেখব চুরি হয়ে গেছে।’

‘কেন আপনার মনে হলো ওটা চুরি হতে পারে?’ কৌতূহল দমাতে পারল না কিশোর।

ওকে আপাদমস্তক দেখে নিল যুবক। মনে হলো তিন গোয়েন্দা ও ওমর শরীফকে প্রথমবারের মত দেখছে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

‘আমার নাম কিশোর পাশা,’ বলল গোয়েন্দা-প্রধান। ‘এরা মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড। আমরা তিনবন্ধু। আর ইনি আমাদের সিনিয়র বন্ধু বেদুঈন বৈমানিক ওমর শরীফ। আপনার কথা শুনে অবাক হয়েছি। আর তাই জানতে চাইছি কেন ভাবছেন মরুভূমির ভেতর চুরি হতে পারে আপনার কোদাল?’

কাঁধ ঝাঁকাল ডোনাল্ড ওয়াইলি। ‘আমি এসব নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না।’

‘কী নিয়ে কথা বাড়াতে চান না?’ আস্তে করে জানতে চাইল মুসা।

হেড রেঞ্জার রায়ানের দিকে একবার চাইল ওয়াইলি, তারপর মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিছুই না, ভুলে যাও। আমি দুঃখিত যে তোমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম।’ পিকআপের পিছনে কোদাল রেখে দিল সে, ক্যাবের দরজা খুলে উঠবার সময় বলল, ‘এবার কাজে যাব।’ একবার রেঞ্জারের দিকে চাইল। ‘সকালে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, বস?’

‘হ্যাঁ,’ বিরক্ত স্বরে বলল ফিলিপ। ‘সঠিক সময়ে আসা উচিত ছিল তোমার।’

‘আর ভুল হবে না, বস,’ বলল ওয়াইলি। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল সে, সঠিক দিকে রওনা হয়ে গেল।

‘মিস্টার রায়ান,’ বলল কিশোর, ‘ওই লোক তো কারও সঙ্গে কথাই বলতে চায় না।’

গাড়ির দরজা খুলে ইশারা করল হেড রেঞ্জার। সবাই উঠতেই রওনা হয়ে গেল ক্যাম্প গ্রাউণ্ডের উদ্দেশে। বলল, ‘তোমার কথা ঠিক, কিশোর। ওয়াইলি কম কথা বলে। ওকে এবং অন্যদেরকে জানিয়ে দিয়েছি, তদন্তের ব্যাপারে টু শব্দও করবে না, নইলে পার্ক থেকে ছুটি দিয়ে দেব।’

‘তার মানে চাকরি থাকবে না?’ জানতে চাইল মুসা।

‘চাকরি ঠিকই থাকবে, কিন্তু যেতে হবে বেতন ছাড়া ছুটিতে।

‘একটা ব্যাপার বুঝিনি,’ বলল কিশোর। ‘আপনি বলেছেন: তদন্তের বিষয়ে কথা বেশি চালাচালি না হওয়াই ভাল। নইলে আরও সতর্ক হয়ে উঠবে ডাকাতরা। আবারও বলেছেন, ওয়াইলি ডাকাত দলের লোক। … সেক্ষেত্রে সে তো ভাল করেই জানে তদন্ত চলছে?’

‘কথা ঠিকই বলেছ,’ বলল ফিলিপ রায়ান। ‘আসলে চাইলেও লুকাতে পারব না যে তদন্ত চলছে। আমার সব ক’জন কর্মচারী জানে। এবং যারা কিছুদিন ধরে আছে ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে, তারাও আঁচ করেছে। কিন্তু তদন্তের ভেতরের সব খবর এদের পক্ষে জানা অসম্ভব।’

‘কতদিন ধরে আপনার হয়ে কাজ করছে ওয়াইলি?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘ধরো দুই মাস,’ বলল রায়ান, ‘ভাল করেই চেনে এ এলাকার ইকোসিস্টেম। চুপচাপ মানুষ, কোনও কাজ দিলে নিখুঁতভাবে শেষ করে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল এমন কাজের জন্যে উপযুক্ত লোক সে।’

‘কেন আপনার মনে হয়েছে ক্যাকটাস ডাকাতির সঙ্গে সে জড়িত?’ জানতে চাইল কিশোর।

বিরক্তির ছাপ পড়ল হেড রেঞ্জারের মুখে। এক মুহূর্ত পর বলল, ‘তাকে সন্দেহ করছি আসলে সময়টার কারণে। ডোনাল্ড ওয়াইলি চাকরি নেয়ার পরই শুরু হলো ডাকাতি। মাথায় রাখতে হবে, বড় সব গাছ অক্ষত ভাবে তোলার অভিজ্ঞতা আছে তার। এ ছাড়া, যেসব জায়গা থেকে গাছ তুলে নিয়েছে ডাকাতরা, তার বেশিরভাগ জায়গাই আবিষ্কার করেছে সে। আজকেরটাও। অথচ ওকে কাজ দিয়েছিলাম পার্কের অন্য এলাকায়।

‘তাতে কেন তাকে সন্দেহ করা হবে?’ জিজ্ঞেস না করে পারল না কিশোর। ‘ওই লোক যদি অপরাধীই হয়, তার মনে হওয়ার কথা নয়: অন্য কেউ ওই ডাকাতির জায়গা আবিষ্কার করুক?’

‘লোকটা সম্ভবত বোঝাতে চাইছে সে নিরাপরাধ,’ বলল রায়ান। ‘তবে তাকে তার সঙ্গীদেরসহ হাতে-নাতে ধরব। আসলে আমার জানতে হবে ওয়াইলি কার হয়ে কাজ করছে।’

‘আপনি ভাবছেন ওয়াইলির সঙ্গে আরও লোক আছে,’ বলল মুসা। ‘হ্যাঁ, যেসব ক্যাকটাস নিয়েছে, সব বড় স্পেসিমেন। ওগুলো সরাতে ভারী ইকুইপমেন্ট লেগেছে। এ কাজ একজনের নয়, বেশ কয়েকজনের।’

‘এই তদন্তের দায়িত্বে আছেন কে?’ জানতে চাইল ওমর।

কাঁধ ঝাঁকাল রায়ান। ‘ফিনিক্সের স্টেট ইনভেস্টিগেটরদের সঙ্গে কাজ করার কথা আমার। কিন্তু তারা অন্যান্য তদন্তে ব্যস্ত, কাজেই আসতে পারেনি এখানে।’

‘আপাতত আপনাকে সাহায্য করছে কে?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘আমি এখন পার্কের এদিকে একা,’ বলল হেড রেঞ্জার। কড়া ব্রেক কষে বাঁচিয়ে দিল এক জ্যাকর‍্যাবিটকে। ‘ডাকাতির সাইট চোখে পড়লে দেরি না করে ওখানে তদন্ত করছি। ফটোগ্রাফ তোলা, মাপজোক নেয়া, রেকর্ড করা— সব আমাকেই করতে হচ্ছে। একটু একটু করে সংগ্রহ করছি নানান প্ৰমাণ।’

‘ডোনাল্ড ওয়াইলির অতীত ঘেঁটে দেখেছেন?’ জানতে চাইল কিশোর। ‘আগে জেল হয়েছে কি না, বা পুলিশে…’

‘এহহে! এদিকটা তো একেবারেই ভাবিনি,’ লালচে হয়ে গেল ফিলিপ রায়ানের মুখ।

‘অন্যান্য সব কাজ করতে গিয়ে…’ কাঁধ ঝাঁকাল ওমর শরীফ। আস্তে করে মাথা দোলাল হেড রেঞ্জার। ‘কিন্তু কাজটা আমারই। ভুল করেছি। এবার খোঁজ নেব পুলিশে।’

কিশোর বলল, ‘জমিতে গভীর গর্ত, জমির ক্ষতি, গাছপালার ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে যাওয়া— এসব নিশ্চয়ই চোখে পড়ছে টুরিস্টদের? ডাকাতির ব্যাপারে কী ভাবছেন তাঁরা?’

‘মাঝে মাঝে সবই চোখে পড়ছে ওদের,’ স্বীকার করল হেড রেঞ্জার। ‘কখনও কখনও রিপোর্টও করছে। তখন বলছি: মস্ত ক্ষতি করা হচ্ছে পার্কের, আর আমরা এসব নিয়ে তদন্ত করছি। এরপর আর বেশি আগ্রহ দেখায় না কেউ।’

‘যদি অনুমতি দেন, আমরা হয়তো এ কেসে সাহায্য করতে পারব.’ বলল কিশোর।

‘কথাটা বলেছ সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ,’ বলল ফিলিপ রায়ান। চট্ করে কিশোরকে দেখে নিল রিয়ারভিউ মিররে। ‘তবে আপাতত লাগছে না সাহায্য। তোমরা বিশ্রাম নাও, মরুভূমিটা ঘুরে দেখো। দেখার মত বহু কিছুই পাবে এখানে।

একটু পর বাঁক নিয়ে ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে ঢুকে পড়ল ওদের গাড়ি, তার আগেই চুপ হয়ে গেছে ওমর শরীফের বন্ধু।

সব মোবাইল হোম দু’পাশে রেখে সরু রাস্তায় চলেছে ওদের গাড়ি। প্রতিটি ক্যাম্প সাইটের পাশে একটা করে পিকনিক টেবিল। বেশিরভাগ টেবিল ঘিরে হৈ-চৈ করছে কপোত-কপোতি বা ছোট-বড় সব পরিবারের সদস্য।

‘মনে হচ্ছে, কেউ কেউ বেশ কিছুদিন ধরেই আছে,’ মন্তব্য করল ওমর শরীফ।

‘হ্যাঁ,’ বলল তার বন্ধু। ‘ক’জন এসেছে সপ্তাহখানেক আগে। অন্যরা দু’এক দিন হলো।’

‘কেউ আছে যে কয়েক সপ্তাহের বেশি ধরে আছে?’ জানতে চাইল কিশোর।

আস্তে মাথা দোলাল রেঞ্জার।

কিশোরদের মোবাইল হোমের পিছনে থামল তার গাড়ি।

‘তোমাদের ডানদিকের লোকটাই তো বহুদিন ধরে আছে। নাম জর্জ আর্নল্ড, কোথাকার যেন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। বায়োলজিকাল কী নিয়ে যেন রিসার্চ করছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে রেখেছে নিজের মেয়েকে। খুব ভাল মেয়ে, কিন্তু প্রফেসর আবার সবসময় মুখ বুজে রাখে। বেশিরভাগ সময় থাকে, তা-ও নয়। দু-এক সপ্তাহ পর পর কয়েক দিনের জন্য হঠাৎ করেই উধাও হয়।

জানতে চাইল কিশোর, ‘ডোনাল্ড ওয়াইলি ছাড়া আর কেউ ক্যাকটাস ডাকাতি করতে পারে, এমন কারও  ́ কথা মনে হচ্ছে আপনার?’

‘বা কোনও টুরিস্ট?’ যোগ করল মুসা।

‘না, তেমন কেউ নেই,’ বলল ফিলিপ রায়ান। শ্রাগ করল। ‘কান পেতে কথা শোনে এদিকের মানুষ। চাই না ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে কেউ অতিরিক্ত কৌতূহলী হোক। …জানি, তদন্ত করতে চাইছ, হয়তো তোমরা সত্যিই ভাল ডিটেকটিভ, কিন্তু তোমাদের মনে রাখতে হবে: আপাতত কারও প্রতি সন্দেহ প্রকাশ পাক তা আমি চাই না। এখনই নয়।’

‘ফিলিপ, ওরা কিন্তু সত্যিই খুব দক্ষ ডিটেকটিভ,’ তিন গোয়েন্দার পক্ষ নিয়ে বলল ওমর শরীফ। ‘বন্ধ রাখতে জানে মুখ। হয়তো কাজে আসবে তোমার। মরলেও প্রকাশ করবে না গোপন কিছু।’

‘প্রস্তাবটা দিলে সেজন্য ধন্যবাদ, কিন্তু আপাতত নিজেই তদন্ত করব। অবশ্য কথাটা মাথায় রাখলাম, যদি সাহায্য লাগে, প্রথমেই ওদের বলব। …ঠিক আছে, এবার অফিসে গিয়ে কাজগুলো গোছাতে হবে।’ গাড়ির গিয়ার ফেলল সে, কিন্তু রওনা হলো না। ‘ক’দিন আগেও দারুণ লাগত এই চাকরি। কিন্তু এখন বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে সরকার, ছাঁটাই করছে কর্মচারী, তার ওপর ডাকাতি… সত্যিই ক্লান্ত হয়ে উঠছি। …যাই হোক, ডিনারের দাওয়াত কি এখনও আছে?’

‘তোমার জন্যে অপেক্ষা করব আমরা, ফিলিপ,’ গাড়ি থেকে নেমে এল ওমর শরীফ। ‘কী বলো তোমরা, তিন গোয়েন্দা?’

‘আবার বলতে!’ হাসল মুসা, ‘ঝটপট চলে আসবেন আমাদের ডিনারে!’

গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে তিন বন্ধু।

‘ঠিক আছে, আসব। আর কাল সকালে এসো আমার অফিসে,’ বলল ফিলিপ রায়ান। ‘তোমাদের দেখিয়ে দেব পার্কের সেরা জায়গা কোথায় কোথায়।’

রওনা হয়ে গেল হেড রেঞ্জার।

পিছন থেকে চেয়ে রইল কিশোর-মুসা-রবিন।

‘জানি তোমরা কী ভাবছ,’ বলল ওমর শরীফ। ‘কিন্তু মনে হচ্ছে এসবে তোমাদেরকে জড়াতে চাইছে না ও। সত্যিই সাহায্য লাগলে তখন নিশ্চয়ই সহায়তা চাইবে।’

‘তাই আসলে,’ বলল রবিন।

কোনও মন্তব্য করল না কিশোর

‘শুনতে কিন্তু খারাপ লাগছিল না ক্যাকটাস রাসলিং,’ বলল মুসা।

‘বহুদিন আমার বিশ্রাম নেই,’ জানাল ওমর। ধপ্ করে বসল পিকনিক টেবিলের চেয়ারে। ‘তোমরা পার্ক ঘুরে দেখো, আমি নেব পরিপূর্ণ রেস্ট।’

‘নিশ্চয়ই রেস্ট নেবেন, কিন্তু… খাইছে!’ হঠাৎ হাহাকার করে উঠল মুসা, ‘পেট তো জ্বলে গেল দাউ-দাউ আগুনে, খাওয়া পাই কই!’

‘বৎস, চুলা ধরাও,’ উৎসাহ দিল কিশোর, ‘এবার তোমারই রাঁধার পালা।’

‘তাই?’ দমে না গিয়ে বলল মুসা, ‘আজ রাতে আপনারা ভক্ষণ করবেন মুসা আমানের বিন ও ওয়েইনিস।’

‘আগেরবার মুসা আমানের বিন আর ওয়েইনি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল,’ অতীত স্মৃতিচারণ করল রবিন।

‘এমন হয়েছিল কারণ…’ খাবারের প্যাকেট ও পানির ক্যান আনতে দরজা খুলে মোবাইল হোমে উঠল মুসা, ‘সেবার দায়িত্ব নিয়েও আগুনের কাছ থেকে সরে যায় শ্রীমান রবিন মিলফোর্ড। এ থেকেই বোঝা যায় সে আসলে পাষণ্ড লোক!’

তিন মিনিট পর আবারও দরজায় উদয় হলো মুসা। বকবক করছে: ‘এসব মোবাইল হোমকে ভাল না বেসে পারা যায় না! একইসাথে কত কিছু! বাথরুম, বিছানা, ডাইনিং রুম, লিভিং রুম, তার ভেতর আবার টিভি! আরও আছে আস্ত এক কিচেন! চাকাওয়ালা বাড়ি! চাইলে সত্যিকারের কাউবয়ের মত ওয়েইনি বিক্রি করে জীবন পার করতে পারব! কে ঠেকাবে আমাকে?’

‘ঠেকাবেন রাফাত চাচা,’ নিচু স্বরে বলল রবিন। ‘কান ছিঁড়ে নেবেন তোমার, বেয়াক্কেলে!’

‘স্যালভেজ ইয়ার্ডে পুরনো মালের নীচে আমাদের যে মোবাইল হোমটা আছে, ওটাও একসময় এমনই ছিল,’ মন্তব্য করল কিশোর। ‘একই মডেলের।’

ফিনিক্স থেকে অর্গান পাইপ মনুমেন্ট পার্ক আসার আগে ওমর শরীফ এবং তিন বন্ধু মিলে ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে মোবাইল হোম ভাড়া নিয়েছে। অভিজ্ঞতাটা অদ্ভুত— যেন বাড়ি নিয়ে দূরে চলেছে রাস্তা ধরে। অবশ্য দ্রুত মানিয়ে নিয়েছে নিজেদেরকে। ভ্রমণটা প্রায় ট্রেনে করে যাওয়ার মতই।

মোবাইল হোমের ডিলার বলে দেয়ায় আরেকটা ছোট গাড়ি ভাড়া নিয়েছে ওরা। পিছনে বেঁধে এনেছে ওটা। ফলে অর্গান পাইপে পৌঁছে ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে পার্ক করেছে মোবাইল হোম, চারপাশ ঘুরতে ব্যবহার করছে ছোট গাড়ি।

মোবাইল হোমে আছে শক্তিশালী টু-ওয়ে সিবি রেডিয়ো, আর আলাপ করে তিন গোয়েন্দা ভাড়া নিয়েছে সিবি ওয়াকি-টকিও।

মোবাইল হোমে উঠে রাঁধবার দরকারী সব জিনিস জোগাড় করতে লাগল মুসা ও রবিন।

দরজার পাশের কেবিনেট থেকে ব্যাগ ভরা কয়লা নিল কিশোর গাড়ি থেকে নেমে আসবার পর ইঁটের উঁচু বারবিকিউ চুলার পেটে গেল কয়লা। কাজটা শেষ করে বলল কিশোর, ‘ওমর ভাই, ভাবছি একটা কথা। এ কেসটা আমরা নিতে পারি। আপনার বন্ধু না জানলেই হলো।’

‘তাই?’ পানি, জুস ও টুকটাক জিনিস টেবিলে গুছিয়ে রাখছে ওমর। আপাতত কোনও মন্তব্য করবে না ঠিক করেছে।

‘কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য সব ডাকাতির স্পট ঘুরে দেখতে হবে,’ বলল কিশোর। ‘গোপনে তদন্ত করতে পারি আমরা। এই পার্ক তো বহু বর্গমাইল জুড়ে, আমাদের দেখবে না আপনার বন্ধু।’

‘ঠিক কী করতে চাও?’ জানতে চাইল ওমর।

‘ডাকাতের গাড়ির চাকার মেজারমেন্ট নেব, কী ক্ষতি করছে দেখব, আবার পেতে পারি জুতোর ছাপও। এ ছাড়া খোঁজখবর নেব ক্যাম্প গ্রাউণ্ডের লোকগুলোর। হয়তো এতেই বেরিয়ে আসবে কারা এসব করছে। আমার ধারণা আপনার বন্ধু সব সূত্র হাতে পাননি।’

‘হতে পারে,’ বলল ওমর।

‘তা ছাড়া উনি গোয়েন্দা নন,’ কয়লায় আগুন দিল মুসা।

‘হয়তো আমরা ওঁর জন্যে গুছিয়ে দিলাম গোটা কেস,’ বলল রবিন। ‘মন্দ কী!’

‘আপনি হয়তো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন, সে-সুযোগে আমরা তদন্ত করলাম,’ বলল কিশোর। ‘ডোনাল্ড ওয়াইলির পিছু নেব, খোঁজ নেব আগে কখনও অপরাধ করেছে কি না। আপনি হয়তো পাবেন বন্ধুর কাছ থেকে জরুরি তথ্য। পরে সেসব আমাদের কাজে আসবে।’

‘একটা কথা ভেবেছ,’ বলল ওমর। ‘ফিলিপ কিন্তু সাহায্য __ না, বরং নিষেধ করছে। আমরা যদি ঝামেলা হয়ে উঠি ওর জন্যে, শেষে বিচ্ছিরি পরিস্থিতির ভেতর পড়ব। আমার মনে হচ্ছে, হয়তো একাই এই রহস্য উন্মোচন করবে ফিলিপ।

কয়লার সুন্দর লালচে আগুনে মন দিয়েছিল মুসা, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত হলো সতর্ক হয়ে উঠেছে।

ওদের মোবাইল হোমের পিছনে, মাটিতে বসে পড়েছে হ্যাংলা এক তরুণ, ওখান থেকে তাকে দেখাই যাচ্ছে না প্রায়।

বামদিকের পিছন চাকার কাছে ছোট্ট ক্যাকটাস, ওটার দিকে তাক করেছে ক্যামেরা। কিন্তু তার চোখ ঠিক কিশোরদের উপর।

এইমাত্র মুসাকে দেখেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল কাঠির মত তরুণ, ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত-সমস্ত ভঙ্গি করছে।

আইসক্রিমের কাঠির বয়স আঠারো কি উনিশ, ভাবল মুসা। পনি টেইল করা সোনালি চুল। সন্দেহ নেই লুকিয়ে কথা শুনছিল। গায়ের জোরে ওর সঙ্গে পারবে না।

‘অ্যাই!’ হাঁক ছাড়ল মুসা, ‘এখানে কী? কী চাই?’ মোবাইল হোমের কোণ লক্ষ্য করে পা বাড়াল ও। কুঁচকে গেছে ভুরু।

চট্ করে ঘুরে রওনা হয়ে গেল তরুণ। ভাব দেখে মনে হলো খেয়ালই করেনি মুসাকে।

‘অ্যাই যে, মিয়া!’ জোরে গলা ছাড়ল মুসা। ‘আমি জানতে চাই কী করছিলেন এখানে!

ঝামেলা করবার সুর গলায়, শক্তপোক্ত-বিপজ্জনক ছেলেটাও কেমন যেন— পাঁই করে আধ পাক ঘুরেই ছুট দিল চিকনউদ্দীন।

যেন উড়ে চলেছে।

কিন্তু অলিম্পিকের সেরা দৌড়বিদের মত ধেয়ে গেল মুসা আমান।

ওর পিছনে ছুটতে শুরু করেছে কিশোর ও রবিন!