আসল-নকল – ১

এক

মানুষ হারিয়ে যায়।

পুরানো জীবন ছেড়ে, নাম পাল্টে, অন্য কোনও শহরে বা দেশে কাজ করা দোষের কিছু নয়।

এব্যাপারে কখনও-সখনও অবশ্য আরও ভয়ঙ্কর ব্যাখ্যাও দেয়া যায়। অপরাধচক্রে মানুষ চোখের আড়ালে চলে যায়-এবং আর কখনও লোক সমাজে আসে না। গুজব আছে, আমাদের নয়া মোটরওয়েগুলোতে যে কংক্রিটের পাইলিং রয়েছে সেগুলোর আড়ালে অনেক নোংরা বিষয় লুকিয়ে আছে। ইংল্যাণ্ডের মত ছোট দেশেও এমন-এমন সব জায়গা রয়েছে যেখানে লাশ লুকিয়ে রাখলে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায় না।

কিছু-কিছু অন্তর্ধানের অনেক অদ্ভুত ব্যাখ্যা রয়েছে—যেমন গ্রেগ চ্যাপেলের অন্তর্ধানটি।

ছোট্ট এক মফস্বল শহরের এক ব্যাঙ্কের সহকারী ম্যানেজার ভদ্রলোক। লম্বা, পাতলা, হর্ন রিমের চশমা পরা হাসি খুশি এক মানুষ, এক কথায় সাধারণ পাবলিক।

তিনি ভাগ্যবান, কর্মক্ষেত্রের কাছেই বাস করেন। বেশিরভাগ দিন এমনকী গাড়ি নিয়েও বেরোন না। বিশ মিনিট পা চালিয়ে হাঁটলেই হাই স্ট্রীট ব্যাঙ্কের সদর দরজা থেকে, পতিত জমি পেরিয়ে, সুনসান পাড়াটিতে ভাড়া করা তাঁর বিশাল বাড়ির দরজায় পৌঁছে যান।

এই বিশেষ সন্ধেটিতেও ব্যাঙ্ক ত্যাগের ঠিক আগ মুহূর্তে স্ত্রীকে ফোন করলেন তিনি, এবং প্রতি কর্মদিবসের সন্ধেয় যেমনটা বলেন তেমনি জানালেন বিশ মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছবেন। মিসেস চ্যাপেল ‘ঠিক আছে’ বলে ড্রিঙ্ক ক্যাবিনেটের কাছে গেলেন এবং স্বামীর জন্য এক গ্লাস মিডিয়াম-ড্রাই শেরি ঢাললেন। বিশ মিনিট পরে দরজায় স্বামীর চাবির শব্দ শুনতে পাবেন তিনি

মাঝে-মাঝে তাঁর মনে হয় গ্রেগের মধ্যে একটু রহস্যময়তা, একটু অনিশ্চয়তা থাকলে মন্দ হত না।

ঘটনা যা ঘটল, তাতে গ্রেগ চ্যাপেলের জীবন বড়ই রহস্যময় হয়ে উঠল।

শহর ছেড়ে হনহন করে বেরিয়ে এলেন তিনি। পতিত জমি আড়াআড়ি পেরিয়ে, এক দঙ্গল গাছ-গাছালি ভেদ করে চলে-যাওয়া পথটা অনুসরণ করে, ছোট্ট গর্ত মত জায়গাটা পাড়ি দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। গরমের চমৎকার এক সন্ধে সেদিন। বাসায় কাজ নিয়ে যাচ্ছেন না তিনি। সঙ্গে রেইনকোট, ব্রলি এমনকী ব্রিফকেসও নেই, নিশ্চিন্ত মনে সবুজ গ্রামাঞ্চল ভেদ করে গটগটিয়ে হেঁটে চলেছেন। কালো বিজনেস সুটে খানিকটা বেমানান লাগছে তাঁকে।

ভদ্রলোক ছোট্ট গতমত জায়গাটার মাথায় দাঁড়িয়ে পড়লেন চরম বিস্ময়ে। গর্তের মাঝখানে চারকোনা এক ধাতব আকৃতি দাঁড়িয়ে। কাছ থেকে বিশাল দেখাল ওটাকে, ছোটখাট এক বাড়ির মতন। ভারী ইস্পাতের প্লেট দিয়ে তৈরি জিনিসটা, রংচটা এবং মরচে ধরা। সাবধানে ওটার উদ্দেশে হেঁটে গেলেন গ্রেগ।

ঠং-ঠং, ঘর-ঘর শব্দ উঠল। এবং এক পাশে একটা দরজা হড়কে খুলে গেল। এক দল লোক ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে সেনাবাহিনীর মত পোশাক। উগ্র ভাব-ভঙ্গি। নেতার মুখে দাড়ি, ইয়াবড় পেট। কুতকুতে, ধূর্ত একজোড়া চোখ শুয়োরমুখো চেহারায়। তার পিছনের লোকটা অপেক্ষাকৃত লম্বা। চিবুকে ধূসর দাড়ি। আরও লোক উদয় হলো, কঠিন, বুনো মুখের চেহারা। বেল্টে অদ্ভুত দর্শন অস্ত্র গোঁজা তাদের।

গ্রেগকে অবাক করে দিয়ে দু’জন লোক সামনে থেকে তাঁর পিছনে ধেয়ে এসে দাঁড়াল। দু’বাহু চেপে ধরেছে। প্রাণপণ যুঝলেন তিনি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।

‘কী করছেন আপনারা?’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানতে চাইলেন তিনি। ‘এটা কি স্টুডেন্ট র‍্যাগিং নাকি?’

কেউ জবাব দিল না।

স্পষ্টতই যে গাঁট্টাগোট্টা, শ্মশ্রুমণ্ডিত লোকটি নেতা, সে গ্রেগকে চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে নিরীখ করল। মনে-মনে কোনও কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে নিল যেন। এবার মাথা ঝাঁকাল।

লম্বা, লিকলিকে লোকটা পকেট থেকে ছোট্ট এক রুপোলী সিলিণ্ডার বের করে গ্রেগের ঘাড়ে চেপে ধরল। নিমেষে, গ্রেগ শান্ত আর নিথর হয়ে গেলেন। দাঁড়ানো অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি, এবং তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে মহাকাশযানটিতে তোলা হলো।

ধীরেসুস্থে, হেলে দুলে শিপটা চালু হলো। বিদ্যুৎ গতিতে গ্রীষ্মের আকাশে উড়ে উঠল ওটা, এবং তারপর হাইপার-স্পেসে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দীর্ঘ যাত্রায় গ্রেগ ইলেকট্রনিক ঘুমপাড়ানি চিকিৎসার প্রভাবে থাকলেন। তাঁর ঘুম ভাঙার পর শুরু হলো আসল দুঃস্বপ্ন।

.

কিডন্যাপারদের স্পেস ক্র্যাফটটি এক পর্যায়ে লাল রঙের আরেকটি মহাকাশযানের সঙ্গে একই বিন্দুতে মিলিত হলো। অনেকটা পুলিস বক্সের মত দেখতে দ্বিতীয় এই মহাকাশযানটির মাথায় একটি বাতি ঝলসাচ্ছে।

ওটা হচ্ছে কিশোর পাশার চাচা হিরন পাশার তৈরি টাইম মেশিন। এটাতে চড়ে ওরা টাইম এবং স্পেসে ঘুরে বেড়ায়, অভিযান করে। জিনিসটাকে বাইরে থেকে দেখতে ছোট মনে হলেও ভিতরে অবিশ্বাস্যরকমের পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।

টাইম মেশিনের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত কন্ট্রোল রূমে, হিরু চাচা এখন কাজে ব্যস্ত। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ সে। বড়-বড় দুটি চোখ, মাথায় কোঁকড়া চুল। বেশির ভাগ সময় লম্বা এক কোট পরে থাকে, জিনিসটা ওভারকোট আর স্মোকিং জ্যাকেটের মাঝামাঝি একটা কিছু। লাল রঙের মখমলে তৈরি।

হিরু চাচা এমুহূর্তে শার্ট-স্লীভ পরে রয়েছে, কোমরে অ্যাপ্রন। __ বিচিত্রবর্ণ লম্বা এক স্কার্ফ আর চওড়া ব্রিমের নরম হ্যাটটা পুরানো আমলের এক কোট-স্ট্যাণ্ড থেকে ঝুলছে। কন্ট্রোলরূমে জিনিসগুলোকে একেবারে বেমানান দেখাচ্ছে।

এমুহূর্তে হিরু চাচা আসলে টাইম মেশিনটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। কাজটা ছেড়ে দিয়েছে ভাতিজা কিশোর পাশার উপর।

হিরু চাচা যে কাজটি নিয়ে ব্যস্ত, সেটি হচ্ছে রোবট কুকুর রোকুর মেরামতি। সাগরে পড়ে গিয়েছিল ওটা, যে কারণে সাময়িকভাবে অচল হয়ে পড়েছে। রোকু একটি স্বয়ংক্রিয় চলন্ত কম্পিউটার, সঙ্গে রয়েছে প্রতিরোধের শক্তি। যন্ত্র হলে কি হবে, অত্যন্ত আবেগপ্রবণ আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও।

রোকু অবশ্য এখন এক টেবিলের উপর নীরবে এবং নিথর রয়েছে। সাগরের লোনাজলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওর সার্কিটগুলো চাচা তার সনিক স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে রোকুকে সারিয়ে তুলতে ব্যস্ত। সেন্ট্রাল কন্ট্রোল কনসোলের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে কিশোরের উপর।

হিরু চাচা একাগ্রচিত্তে কাজ করে চলেছে। মাঝেমধ্যে ‘আহা!’ ‘এই তো’ এবং ‘ইলেক্ট্রো-প্লায়ার্সটা যে কোথায় রাখলাম’? এধরনের টুকরো-টাকরা কথা আপন মনে আওড়াচ্ছে। কাজের ফাঁকে মঙ্গলগ্রহের প্রাচীন এক ঘুমপাড়ানি গানের সুর শিস দিয়ে বাজাচ্ছে।

যে কোনও কারণেই হোক; কিশোরের ভয়ানক বিরক্তি লাগছে। কনসোল ঘিরে ঘুরছে সে, কন্ট্রোল ঠিকঠাক করছে এবং ডায়াল চেক করছে। একটু পরপরই হিরু চাচার দিকে তির্যক চাহনি হানছে।

শেষমেশ হিরু চাচা মুখ তুলে চাইল।

‘প্রায় হয়ে গেছে, ভাতিজা। কাজটা খুব ডেলিকেট। তুই টাইম মেশিন থামা, হঠাৎ ঝাঁকুনি চাই না।’

নেভিগেশনাল কনসোল জরিপ করল কিশোর L

‘সম্ভবত আমরা এখন প্রিয়ন প্ল্যানেটারি সিস্টেমে রয়েছি। ল্যাণ্ড করাই ভাল।’

ভ্রূ কুঁচকে গেল হিরু চাচার। প্রিয়ন প্ল্যানেটারি সিস্টেম ক্ষীণভাবে পরিচিত শোনাল, কিন্তু সে মনে করতে পারল না তার এখানকার স্মৃতি ভাল নাকি মন্দ।

‘তুই স্রেফ ভেসে থাক।’

কিশোর যথারীতি নিজের মতকেই প্রাধান্য দিল।

‘তুমি শিয়োর, হিরু চাচা? কাছেই এডেন নামে এক গ্রহ আছে।’

হিরু চাচা রোকুর সার্কিটগুলো নিয়ে ধ্যানমগ্ন।

‘এডেন? কখনও নাম শুনিনি।’

‘আলফা-তুরা নামেও একটা গ্রহ দেখতে পাচ্ছি। তুমি এটার নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? সব ইতিহাসের বইতেই আছে।’

‘কারও ইতিহাস ইতিহাস বইতে সবগুলোই আছে, আলফা-তুরার বিশেষত্বটা কী?’

‘জাত টেকনোলজিকাল সভ্যতা। মনে করা হয় এনার্জি-ম্যাট্রিক্স টেকনোলজিতে অবিশ্বাস্যরকম এগিয়েছিল। রহস্যময় গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে। গোটা সভ্যতা ধুলো আর ছাই হয়ে উড়ে গেছে। এখন পর্দাগুলো ছাড়া আর কিছু নেই।’

‘তাই? কীসের পর্দা?’

‘বিশাল-বিশাল সব ধাতব স্ক্রীন, গ্রহের সার্ফেসে পাঁচটা সেট করা হয়েছে কেন কে জানে। আলফা-তুরার পর্দা।’

‘ওহ, সেই স্ক্রীনগুলো…’ ঝট করে মাথা তুলল হিরু চাচা। ‘অবশ্যই! আমি এডেনে গিয়েছি। তুই এডেন বলেছিস, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি ওখানে গিয়েছিলাম।’

কিশোর প্রশ্ন করল, ‘তুমি এডেনে গিয়েছিলে? কবে?’

‘ওহ, সে বেশ অনেক আগে। টমাস নামে চমৎকার একজন মানুষ আমাকে চারদিক ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। আবার যেতে বলেছিল। এতদিনে সুযোগ পাওয়া গেল!’

কন্ট্রোল কনসোলের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু কিশোর তাকে বাধা দিল।

‘একবারে একটা করে কাজ করা উচিত। আমি ভেসে থাকার জন্যে কন্ট্রোল সেট করছি, তুমি রোকুকে সারিয়ে তোলো। তারপর আমরা এডেনে মেসেজ পাঠাব।’

‘আগের কাজ আগে, তাই তো?’ সম্মতির সুরে বলল হিরু চাচা।

‘ঠিক তাই।’

‘বেশ,’ বলে নিজের কাজে ফিরে গেল হিরু চাচা।

.

এডেনের ভূ-পৃষ্ঠের নীচে সমস্যার শেষ নেই। গোটা একটা সভ্যতাকে পাতালে সরিয়ে নেয়া সহজ কাজ নয়। রোদ, বাতাস আর বহতা পানির স্বাভাবিক উৎস যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে প্রয়োজন জ্বালানী, প্রচুর পরিমাণে—তাপ, আলো আর এয়ারকণ্ডিশনিঙের জন্য, হাইড্রোপনিক ফার্মের জন্য, ফুড স্টোরেজ এবং আরও হাজারো প্রয়োজনে। ভাগ্যক্রমে, এডেনবাসীদের প্রচুর পরিমাণ জ্বালানীর মজুদ রয়েছে, যেটা আসে অনন্যসাধারণ এবং অক্লান্ত এক উৎস থেকে। এটি তাদের ধর্মের কেন্দ্রস্থল এবং সভ্যতার ভিত্তি-ডোডেকাহেড্রন। সুদূর অতীতে প্রকাণ্ড এক ক্রিস্টাল রহস্যময়ভাবে নেমে আসে আকাশ থেকে। পাওয়ার রূমে মর্যাদার সঙ্গে স্থাপিত ডোডেকাহেড্রনটি এডেনবাসীদের জীবনে অমূল্য এক সম্পদ।

কিন্তু ডোডেকাহেড্রন ব্যর্থ হচ্ছে। পুরোপুরি কিংবা একনাগাড়ে নয়। মাঝে মধ্যে আগের মতই উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়ায়, শক্তি জোগায় গোটা পাতাল সভ্যতাটিকে। কিন্তু ইদানীং পাওয়ার ওঠা-নামা করছে। কখনও হঠাৎই চলে যাচ্ছে, কখনও বা আরও যেটি বিপজ্জনক, অব্যাখ্যাত স্ফীতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এবং শক্তির ওঠা-নামার ব্যাপারটা ক্রমেই আরও ঘন-ঘন ঘটছে…..

এডেনের পুরো অভ্যন্তর গুহা আর সুড়ঙ্গ নিয়ে মৌচাকের মত ফুটোবহুল। সভ্যতার বিস্তার ঘটার সঙ্গে-সঙ্গে এডেনবাসী এটিকে আরও বাড়িয়েছে এবং উন্নততর করেছে। এডেনবাসী এগুলোকে বলে ওয়াকওয়ে, এখানে-সেখানে ধাতবে মোড়া সুড়ঙ্গের কোনও ফাঁক দিয়ে পাথর বেরিয়ে থাকে। কিংবা পাথুরে দেয়ালের চেম্বারগুলোকে এখনও প্রাকৃতিক গুহার মতন দেখায়।

এক সার্ভিস টানেলের শেষপ্রান্তে, পাওয়ার রূমের কাছে, ক্যারি নামে এক আকর্ষণীয় যুবতী ধোঁয়া-ওঠা এক কন্ট্রোল প্যানেলে পাগলের মত কাজে ব্যস্ত। তাকে লক্ষ করছে আতঙ্কিত, ফ্যাকাসেমুখো এক টেকনিশিয়ান। প্যানেলটা হঠাৎই ওভারলোডেড হয়ে গেছে এবং ক্যারিকে ওটা মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। ও একজন সাভাণ্ট, এডেনের আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শ্রেণীর মানুষ। তার জাতের লোকদের মত সে-ও সাদা কুইন্টেড জ্যাকেট, যার বেল্ট আর কলারে কালচে দাগ, কালো ট্রাউজার আর বুট পরে রয়েছে। হলদে, ঝলমলে চুল পরিপাটী করে আঁচড়ানো।

সময়ের সঙ্গে যুঝছে, ক্যারি পোড়া এক পাওয়ার ইউনিট বদলে বড় ধরনের ওভারলোড ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কাজ প্রায় সেরে এনেছে, এ সময় আরেকটি রহস্যময় পাওয়ার সার্জ তার প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দিল। পাওয়ার গেজটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘সাবধান, এটা উড়ে যাবে!’ দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে পিছনদিকে ছুঁড়ে দিল ক্যারি, পরমুহূর্তে প্যানেলটা চোখ ধাঁধানো ঝলকানির পরে বিস্ফোরিত হলো।

ক্যারির পাশে দাঁড়ানো টেকনিশিয়ানটা অতটা চটপটে কিংবা ভাগ্যবান নয়। আর্তনাদ ছেড়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে, মুখে হাত চাপা দিয়েছে।

ক্যারি তার পোর্টেবল কমিউনিকেশন্স সেট অপারেট করল। যন্ত্রটা কাজ করছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

‘ইমার্জেন্সি! ইমার্জেন্সি! ওয়াকওয়ে লাইনে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখুনি মেডিকেল আর লাইটিং অ্যাসিসট্যান্স পাঠান।’

কাছেই, সেন্ট্রাল কন্ট্রোলে ক্যারির কণ্ঠস্বর কড়-কড় করে উঠল লাউডস্পিকারে। সুবিশাল কন্ট্রোল রুমটি এডেন সভ্যতার কেন্দ্রস্থল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সারিবদ্ধ ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল পাওয়ার রূমে বসানো ডোডেকাহেড্রনের উৎপাদিত এনার্জি ফ্লো মনিটর ও কন্ট্রোল করছে। এখন পাওয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, এবং এখানে বাতি নিভু-নিভু হয়ে এসে আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ডায়ালগুলো উন্মাদের মত দপ-দপ করছে।

মেইন কন্ট্রোল ডেস্কে বসে আছেন হ্যান্সি, সাভান্টদের একজন যথাযোগ্য ব্যক্তি। ইমার্জেন্সি মেসেজগুলো মনিটর করছেন এবং শক মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন। ক্যারির মত তাঁর পরনেও সাদা-কালো উর্দি। সোনালি চুল ছোট করে ছাঁটা এবং পরিপাটীভাবে আঁচড়ানো। সমস্ত সাভান্টদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে-তাদের শত্রুরা বলে তারা একইরকম দেখতে এবং একই মানসিকতার অধিকারী।

হ্যান্সি ক্যারির মেসেজটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন এবং জরুরি দিক নির্দেশনা দিলেন। ক্যারির সার্কিটে ফিরে গেলেন তিনি।

‘তুমি ব্যথা পাওনি তো, ক্যারি?’ পেশাদার উদ্বেগের চাইতেও বেশি কিছু প্রকাশ পেল তাঁর কণ্ঠে। ক্যারির গলা শোনা না পর্যন্ত অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করলেন তিনি ।

‘না। আমার এক টেকনিশিয়ান সামান্য ঝলসে গেছে, তবে ব্যাপারটা অতখানি সিরিয়াস নয়।’

‘গুড। মেডিকেল সাপোর্ট পাঠানো হয়েছে।’

আরেকটি মেসেজ এল।

‘এয়ার পিউরিফিকেশন ইউনিট ওয়ান কাজ করছে না।’

বাতাস বিশুদ্ধকরণ ইউনিটের আবার কী হলো? ভাবলেন হ্যান্সি। আরেকটি চ্যানেলে চলে গেলেন সুইচ টিপে।

‘ইউনিট ওয়ানে ওপেন এয়ার ভেণ্ট তিন থেকে আট।’

কন্ট্রোল ডেস্কের উপর আড়াআড়ি একটা ছায়া পড়ল। ঝটিতি চোখ তুলে চাইতেই মাথা ঢাকা আলখিল্লা পরিহিত একজনকে তাঁর উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলেন হ্যান্সি। পরনে সন্ন্যাসীর মত সাদামাঠা পোশাক থাকলেও, এই দীর্ঘদেহী, সাদাচুলো বুড়ো মানুষটি এ গ্রহের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ইনি ইসাস, সমগ্র এডেনবাসীর নেতা।

‘ক্ষমা করবেন, ইসাস, আপনাকে আমি ঢুকতে দেখিনি।’

‘বসুন, হ্যান্সি, এখন আনুষ্ঠানিকতার সময় নয়। আপনার কাজ চালিয়ে যান।’

এসময় আরেকটি মেসেজ এল, যদিও এটি স্বস্তিকর।

‘সব ফ্রন্টে পাওয়ার লেভেল স্থিতিশীল। সেচের লেভেল ঠিক আছে।’

স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন হ্যান্সি।

‘ধন্যবাদ। সব চ্যানেল ক্লিয়ার করা হচ্ছে।’ নিজের আসনে শরীর ছেড়ে দিলেন তিনি। ‘এযাত্রা বাঁচা গেছে।’

তাঁর ক্লান্ত মুখের চেহারার দিকে সহানুভূতির চোখে চাইলেন ইসাস।

‘ব্যাপারটা কতখানি খারাপ, হ্যান্সি?’

হ্যান্সি অবিচল কণ্ঠে বললেন, ‘খুব খারাপ, স্যর। আমরা পাওয়ার লেভেল বেশিক্ষণ কন্ট্রোল করতে পারব না। পাওয়ার এভাবে বেড়ে যেতে থাকলে একসময় পুরোপুরি ভেঙে পড়বে-এবং এডেন শেষ হয়ে যাবে।’