মরুদস্যু – ১২

বারো

‘হ্যাঁ, সে এ-ই!’ বামের ফুটপাথ লক্ষ্য করে আঙুল তুলেছে লিলি

‘কোন্‌জন?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘ওই যে প্লাযার রামের ক্যাফে-তে ঢুকছে,’ বলল লিলি। ‘যে হ্যাট খুলে সিধে করছে চুল!’

দুই সেকেণ্ডে লোকটাকে দেখে নিল কিশোর।

পিছন সিট থেকে বলল ওমর, ‘কোনও তাড়াহুড়ো কোরো না, কিশোর।’

আস্তে মাথা দোলাল কিশোর। ওর মন চাইল, প্লাযার ভিতর দিয়ে উড়িয়ে নেবে গাড়ি। কিন্তু বাস্তবে গতি স্বাভাবিক রাখল। সতর্ক হওয়ার সুযোগ দেবে না ওই লোককে।

ধীরে সুস্থে গিয়ে রেস্টুরেন্টের কাছে গাড়ি রাখল কিশোর।।

‘এবার?’ জানতে চাইল লিলি, ‘গিয়ে বলবে আপনি কেন আমাদের মোবাইল হোমে…’

মাথা নাড়ল কিশোর। ‘চোখে চোখে রাখব। বুঝতে দেব না আমরা তাকে চিনি।’

‘চলো, কোল্ড ড্রিঙ্ক কিনে ভেতরে বসি,’ বলল ওমর।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে কিশোর।

‘আমরা গোয়েন্দা পুলিশের মত করে দূর থেকে পিছু নেব, তাই না?’ জানতে চাইল লিলি

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলাল কিশোর, ‘সত্যিই যদি সাপ রেখে থাকে, আমাদেরকে হয়তো চেনে সে। সতর্ক থাকতে হবে।’

ক্যাফেতে ঢুকবার পর ওরা দেখল টয়লেটের দরজা থেকে একটু দূরের এক টেবিলে বসেছে কাউবয়। আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছে। অন্য লোকটার পরনে সাদা শার্ট।

‘ওই লোকই তো, লিলি?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘কোনও ভুল নেই,’ জোর দিয়ে বলল লিলি, ‘আমি সায়েন্টিস্ট হওয়ার ট্রেইনিং নিচ্ছি, চোখ এড়ায় না কিছুই, কিছুই ভুলি না।’

‘ওমর ভাই, আপনি লিলিকে নিয়ে কোনও বুদে বসুন, একটা কাজ সেরে আসি,’ বলে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। দশমিনিট পর আবারও ফিরল, পরনে নতুন ডেনিম জ্যাকেট ও ক্যাপ।

‘এ পোশাকে দারুণ স্মার্ট লাগছে তোমাকে,’ সরল মনে বলল লিলি। ‘তবে ক্যাপের কারণে দেখাই যাচ্ছে না মুখটা।’

‘তাই তো চাই,’ হাসল কিশোর। ‘ওদিকের টেবিলে গিয়ে বসতে পারব না, কিন্তু টয়লেটের দরজার কাছে টেলিফোনের অ্যালকোভ, ওখান থেকে চোখ রাখব। এমন ভঙ্গি নেব, ফোনে কথা বলছি।’

‘খুব সাবধান,’ বলল লিলি।

একবার ওমর শরীফের দিকে চেয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল কিশোর, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কাউবয়কে পাশ কাটিয়ে চলে গেল টেলিফোন বুদে। স্লটে কয়েন ফেলে ডায়াল করল।

বলতে গেলে কথাই বলছে না লোকদুটো। হালুম হালুম করে সাবাড় করছে বিশাল দুই বার্গার।

‘ম্যাপে তুলে নিয়েছ?’ জানতে চাইল কাউবয়।

জবাবে অস্পষ্ট কী যেন বলল অন্য লোকটা।

কয়েক মুহূর্ত পর কাউবয়কে বলতে শুনল কিশোর:

‘তা হলে আজই শেষ চালান? … ভেবেছিলাম আরও তুলব।’

‘কথা তাই ছিল,’ বলল সাদা শার্ট। ‘কিন্তু ওই ছোঁড়াগুলো খুব সমস্যা করছে। আপাতত আজই শেষ চালান।’

আলাপ চলল দু’জনের, কিন্তু এত নিচু স্বরে, কিছুই শুনতে পেল না কিশোর।

একটু পর সাদা শার্ট বলল, ‘তৈরি তো, উইনটন?’

‘হ্যাঁ,’ চেয়ার ছাড়ল চিকন কাউবয়। ‘চলো, যাওয়া যাক।’ ক্যাশিয়ারের দিকে রওনা হয়ে গেল তারা। উইনটনের পাশের লোকটা বেঁটে এবং মোটা। বেণী করেছে লম্বা চুল। সঙ্গীর মতই পরনে নীল ডেনিম জিন্স।

প্রথমবারের মত তাদেরকে ভালভাবে দেখতে পেল কিশোর।

উইনটনকে চিনল।

দু’দিন আগে এ গিয়েছিল ফিলিপ রায়ানের অফিসে।

কথা হয়েছিল পার্ক থেকে গরু সরিয়ে নেবে।

লিলি বলেছে, ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে ঘুরঘুর করছিল উইনটন।

বোধহয় সে-ই ওদের মোবাইল হোমে ছেড়েছে সাপ।

লোকদুটো ক্যাফে থেকে বেরুতেই বুদে হাজির হলো কিশোর। এরই ভিতর বয়ের জন্য টেবিলে টাকা রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে ওমর। কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল বার্গার। ‘চলতে চলতে খেতে হবে।’

‘অসুবিধে নেই,’ বার্গার নিল কিশোর।

বুদের বেঞ্চ থেকে পিছলে বেরিয়ে এল লিলি।

চলল ওরা দরজা লক্ষ্য করে।

বাইরে বেরিয়ে দেখল লোকদুজন উঠছে একটা পিকআপে, কয়েক সেকেণ্ড পর ইঞ্জিন চালু করে রওনা হয়ে গেল।

‘আরে, ওটা তো ডোনাল্ড ওয়াইলির পিকআপ!’ ওমর এবং লিলির উদ্দেশে বলল কিশোর, ‘আগে ওটাকে দেখেছি ফিলিপ রায়ানের অফিসের সামনে।’

‘পিছু নিতে হবে,’ বিড়বিড় করে বলল ওমর।

নিজেদের গাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে কিশোর।

দ্রুত পায়ে ওর পিছু নিল অন্য দু’জন।

‘কী শুনলে ওখানে?’ কিশোরের কাছে জানতে চাইল ওমর।

গাড়ির পাশে পৌছে ঝটপট ড্রাইভিং সিটে উঠে পড়ল কিশোর, বলল, ‘আজ রাতেই শেষ ডাকাতি হবে। কাউবয়ের নাম উইনটন।’

লিলি ও ওমর উঠে পড়েছে গাড়িতে, ইঞ্জিন চালু করে রওনা হয়ে গেল কিশোর।

‘আরও ক্যাকটাস ডাকাতি কেন করবে না, এ বিষয়ে কিছু বলেছে?’ জানতে চাইল ওমর।

মৃদু হেসে ফেলল কিশোর। ‘হ্যাঁ, বলেছে। কয়েকটা বিচ্ছু ছেলে জ্বালাতে শুরু করেছে তাদেরকে।’

দূর থেকে পিকআপের পিছু নিয়েছে কিশোর।

বেশ কয়েক ব্লক পেরুল লোকদুটো, তারপর পিকআপ রাখল এক মোটেল পার্কিং লটে। তাদের গাড়ির পাশেই হলদে এক ভ্যান।

গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছে কিশোর, বলল, ‘আমাদের ফিউয়েল লাইন কাটা পড়ার সময় ওই হলদে ভ্যান দেখা দিয়েছিল।’

‘আগে তো বলোনি তোমাদের ফিউয়েল লাইন কেটে দিয়েছে কেউ!’ অবাক হয়ে বলল লিলি, ‘বলেছিলে ফিউয়েল লাইনে সমস্যা!’

জবাব দিল না কিশোর। ওর মন অন্যদিকে।

খেয়াল করছে ছোট এক বাংলো বাড়িতে ঢুকছে লোকদুটো।

নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে আনমনে বলল কিশোর, ‘ভাবছি এরা জানল কীভাবে কোথায় ছিল আমাদের গাড়ি! আমাদের সঙ্গে ছিল ভালদারেজ, আর ওই সাইটে যাওয়ার আগে ডোনাল্ড ওয়াইলিকে দেখিনি আমরা। ওরা দুইজন রেডিয়ো করতে পারত না। এরা ফিউয়েল লাইন কাটার জন্যে আগে থেকেই যেন তৈরি ছিল!’

‘কিশোর,’ চাপা স্বরে বলল ওমর। ‘ওই ট্রাকটা দেখো!’

দস্যুদের ওই বাংলোর পার্কিং লটে অন্যান্য গাড়ির ভিতর দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্র্যাক্টর-ট্রেইলার ট্রাক।

পাশে হেভি-ডিউটি ফ্ল্যাটবেড ট্রাক। ওটার পিছনে দুই জোড়া করে চাকা। ফ্ল্যাটবেডের পিছনে বড় একটা উইঞ্চ।

‘ওমর ভাই,’ চাপা স্বরে বলল কিশোর, আমরা বোধহয় ডাকাত দলের খোঁজ পেয়ে গেছি! এবার হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে হবে পুলিশের কাছে।’

‘তোমাদের কথা বুঝতেই পারছি না,’ আপত্তির সুরে বলল লিলি। ‘আসলে কী বলছ তোমরা?’

সংক্ষেপে ক্যাকটাস ডাকাতির কথা ওকে বলল কিশোর।

অবাক হয়ে গেল লিলি। খুব বিরক্ত হয়ে বলল, ‘জানতামই না কিছু! আর আমি আছি ক্যাম্পে সপ্তাহের পর সপ্তাহ!’

‘গোপনে তদন্ত করছিল আমার বন্ধু হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ান, বলল ওমর। ‘এবার আরও কিছু ব্যাপার জানতে হবে আমাদের, নইলে কারও দিকে আঙুল তুলতে পারব না।’

‘আপাতত কাউকে কিছু বোলো না, লিলি,’ নরম স্বরে বলল কিশোর। ‘এখন দূরে গিয়ে গাড়ি রাখব, তারপর হেঁটে ফিরব। ট্রাকগুলো পরীক্ষা করব, কিন্তু পিছনের মোটেল থেকে কেউ বেরুলে ধরা পড়ে যেতে পারি। …লিলি, ভাল হয় গাড়িতে তুমি বসে থাকলে।’

‘না, আমিও তোমাদের সঙ্গেই থাকব,’ জানিয়ে দিল লিলি।

আর আপত্তি তুলল না কিশোর বা ওমর।

আরও এক শ’ গজ যাওয়ার পর ওমরের কথায় গাড়ি রাখল কিশোর।

হেঁটে ফিরতে লাগল ওরা মোটেলের পার্কিং লট লক্ষ্য করে।

তিনমিনিট পর ফ্ল্যাটবেড ট্রাকের পিছনে পৌঁছল কিশোর। মনোযোগ দিয়ে দেখল চাকার নকশা। পকেট থেকে বের করল মেযারিং টেপ, মেপে নিল চাকার আকার।

‘সবই মিলে গেছে,’ নিচু স্বরে বলল কিশোর।

বাংলোর দরজার দিকে চেয়ে আছে ওমর শরীফ।

‘সম্ভব হলে সেমি-ট্রেইলারের ভেতর চোখ বোলাতে চাই,’ বলল কিশোর।

‘আমি পেছনে উঠছি,’ বলল ওমর।

চট্ করে বাংলো দেখে নিয়ে বলল কিশোর, ‘কাজটা আমাদেরকে করতেই হবে।’

‘কিন্তু বাংলো থেকে কেউ বেরিয়ে এলে?’ কাঁপা স্বরে বলল লিলি। ‘সত্যিই হয়তো ট্রেইলারে অর্গান পাইপ ক্যাকটাস আছে!’

ট্রেইলারের পিছন দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলেছে ওমর, দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিল।

মস্ত এক অর্গান পাইপ ক্যাকটাস দেখা গেল, কাঠের ফ্রেমে পাশ ফিরিয়ে রাখা হয়েছে। দরজার দিকে একপাশের বাহুগুলো।

‘ওরা ভাল করেই জানে কী করতে হবে,’ নিচু স্বরে বলল ওমর।

মাথা দোলাল কিশোর। ‘ভেতরে কয়টা গাছ, ওমর ভাই?’

আঁধার ট্রেইলারে উঠে পড়ল ওমর।

পরক্ষণে ওর পাশে উঠে এল কিশোর।

আস্তে করে ভিড়িয়ে দিল দরজা।

পকেট থেকে বের করেছে ফ্ল্যাশলাইট, জ্বেলে নিল আলো।

ট্রেইলারের ভিতরে সব মিলে তিনটে গাছ।

কাঠের ফ্রেমে যত্ন করে রাখা।

‘আমাদের কাজ শেষ, এবার পুলিশে জানাতে হবে,’ বলল ওমর। ‘আরে…’ ক্যাকটাসের পাশে কোদাল, চকচক করছে। পকেট থেকে রুমাল নিল ওমর, কিশোরকে বলল, ‘আমিও একটু গোয়েন্দাগিরি করি, কী বলো? কোদালে আঙুলের ছাপ থাকলে পুলিশের কাজে আসবে।’

‘আপনি আসুন, আমি যাই,’ দরজা সামান্য খুলে রাস্তায় নেমে গেল কিশোর।

সেমি থেকে না নেমে কোদালের হ্যাণ্ডেল রুমালে মুড়িয়ে নীচের দিকে বাড়িয়ে দিল ওমর। ‘রাখো, কিশোর।’

বৈমানিকের হাত থেকে কোদাল নিল কিশোর। দেখতে পেল ওটার বুকে ইস্পাতে খোদাই করে লেখা: ‘জন ওয়াইলি।’

‘ঠিকই বলেছিল ফিলিপ, আসল কালপ্রিট ডোনাল্ড ওয়াইলি,’ বলল ওমর।

তখনই কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা।

দড়াম করে খুলে গেছে বাংলোর দরজা।

কারা যেন আসছে!

‘এসো, লিলি!’ তাড়া দিল কিশোর। ছিটকে সরে গেল একটা গাড়ির ওপাশে। মাটিতে বসে পড়েছে লিলির হাত ধরে।

প্রায় একইসময়ে ট্রেইলারের দরজার সামনে হাজির হলো উইনটন ও সাদা শার্ট।

লাফ দিয়ে নেমে যাওয়ার সময়ও ছিল না ওমরের।

চট্ করে আবারও ফিরেছে সে আঁধার ট্রেইলারের ভিতর।

‘রিগ আমি চালাব, তুমি ফ্ল্যাটবেড চালাও,’ বলল উইনটন। ‘আরে, দেখো গাধার কীর্তি! …তুমি তো দেখছি একটা দরজাও বন্ধ করতে জানো না! কোদালটা ঠিকভাবে রেখেছ তো? ভুলের পর ভুল করছ!’

লোকগুলো কোদাল দেখতে গেলে ধরা পড়বে ওমর শরীফ, গলা শুকিয়ে গেল কিশোরের। বোধহয় মারপিট করে বেরিয়ে যেতে পারবে ওমর শরীফ। কিন্তু সতর্ক হয়ে উঠবে দস্যুরা। তাদের জন্য ফাঁদ পাতা আর সম্ভব হবে না।

‘তোমাকে বস্ বানিয়েছে কে?’ খেঁকিয়ে উঠল সাদা শার্ট। ফ্ল্যাটবেড ট্রাকের ক্যাবের পাশে চলে গেল। ‘কোদাল ঠিক ভাবেই রেখেছি! ক্যাকটাসের পাশে! মাথা গরম করে দেবে না, উইনটন! এমনিতেই পুরনো ট্রাক চালালে মেজাজ গরম হয়ে যায় আমার!’

‘ঠিক আছে, অত রাগের কী আছে,’ নরম হলো উইনটন।

তার সঙ্গী উঠল ফ্ল্যাটবেড ট্রাকের ক্যাবে।

আর ঘটাং আওয়াজ তুলে সেমি ট্রেইলারের পিছন দরজার ছিটকিনি আটকে দিল কাউবয়।

কিশোরের বলতে ইচ্ছে হলো, ‘দাঁড়ান! আটকা পড়েছে আমাদের একজন!’

ওমর শরীফের কাছে মোবাইল ফোন আছে। কিন্তু কিশোর জানে, এসব সেমি ট্রেইলারের ভিতর সিগনাল থাকে না।

পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না ওমর ভাই।

পুলিশ ডেকে আনতে হবে ওকেই, ভাবল কিশোর। তার আগে জানতে হবে ওমর শরীফকে কোথায় নিয়ে চলেছে এরা!