আসল-নকল – ১১

এগারো

মূল কন্ট্রোল কনসোলে কাজ করছে ডিলাক, দেখছে গ্যাগারিন আর পটোম্যাক। দু’জনেই ডিলাকের প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ করছে, পটোম্যাক স্রেফ মুগ্ধতা নিয়ে আর গ্যাগারিন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।

ডিলাককে কথা বলার নেশায় পেয়েছে, এবং সে ওদেরকে ডোডেকাহেড্রনের ইতিহাস শোনাচ্ছে।

ওরা জানতে পারল, এ গ্রহের ক্যাকটাসসদৃশ অধিবাসী আলফা- তুরানরা এক জাতের প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। নিজেদের গাছ-দেহ পাল্টে যে কোন প্রাণীর রূপ নেয়ার এবং তাকে ইচ্ছেমত পরিচালনা করার ক্ষমতা অর্জন করেছে তারা। যে কারও ছদ্মবেশে ছায়াপথে বিচরণ করতে পারে আলফা-তুরানরা।

‘আপনার জন্যে পৃথিবীর লোক ধরে আনতে বলেছিলেন কেন?’ প্রশ্ন করল গ্যাগারিন, ডিলাকের হাতের প্রতিটা নড়াচড়া ধূর্ত চোখে লক্ষ করছে সে।

‘আমার একটা দেহ দরকার ছিল, যেটা আমি শুধু কন্ট্রোল নয়, নিজের মন মত আকার দিতে পারব। পৃথিবীবাসীরা সাধারণত নমনীয়, তাদেরকে গড়ে নেয়া যায়-বেশিরভাগের কথা বলছি আরকী!’ বাঁকা হাসল ডিলাক। ‘তবে ঘটনা হলো, আপনারা কঠিন এক বান্দা বেছেছেন। আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে, এখন অবশ্য ওকে আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি।’

‘লোকটাকে আপনার দরকার পড়ল কেন?’ জানতে চাইল গ্যাগারিন। ‘আমাদেরকে যখন মেসেজ পাঠান তখন তো জানতেন না যে ডক্টর আসছে।’

‘প্রথমে আমার চিন্তা ছিল আমাকে কোন এডেনবাসীর ছদ্মবেশ নিতে হবে, হয়তো খুব দ্রুত পরপর কয়েকজনের ছদ্মবেশ, যাতে ডোডেকাহেড্রনের কাছে পৌঁছতে পারি। তারপর তো ডক্টরের মেসেজ আর বোকা গাধা ইসাসের জবাব ইন্টারসেপ্ট করলাম। ইসাস ডক্টরকে বলেছিল ডোডেকাহেড্রনটা পরীক্ষা করে দেখতে।’ মুচকি হাসল ডিলাক। ‘তখুনি ঠিক করি হিরন পাশার রূপ ধরব। এতে করে সহজে যেমন জায়গামত পৌঁছনো যাবে, তেমনি আবার পালানোর সময় তাকে বলির পাঁঠা বানাতে পারব! বেচারী হিরন পাশা মনে হয় এতক্ষণে পাথরের চাপে ভর্তা হয়ে গেছে। বিশেষ করে ডিয়নরা ভয়ানক হিংস্র, আদিম।’ হিরু চাচার অনুকরণে চিবুক ঘষল ডিলাক। ‘এই রূপ আরও কিছুক্ষণ ধরে থাকব—ডক্টরের যেহেতু এটার আর প্রয়োজন নেই।’

‘অরিজিনাল আকৃতি, মানে সেই পৃথিবীবাসীটার কী হবে?’

‘ও শীঘ্রিই মারা যাবে, আশা করি, দায়সারাভাবে বলল ডিলাক। ‘প্রসেসটায় হোস্টের শরীর বড্ড যন্ত্রণা পায়।’

কৌতূহলী চোখে ওর দিকে চাইল গ্যাগারিন।

‘তারপর কী করবেন?’

‘অল্প সময়ের জন্যে আমার অরিজিনাল ক্যাকটাস আকৃতিতে ফিরে যাব। এই ল্যাবোরেটরিতে সে ব্যবস্থা আছে। এর বেশিরভাগ ফাংশন চিন্তার স্রোত দিয়ে অপারেট করা যায়-যেমন দরজাগুলো।’

‘কিন্তু এখন যেটা করছেন সেটা সম্ভব নয়, তাই না?’

‘না, জটিল অপারেশনগুলো হাতে-কলমে করতে হয়। কেন বলুন তো?’

গ্যাগারিনকে অপ্রস্তুত দেখাল, মনে পড়ল ডিলাককে ঠকানোর ওর প্রথম চেষ্টার কথা। ও এখন আরেকটা বিশ্বাসঘাতকতার ফন্দি আঁটছে, যদিও ও নিশ্চিত এবারে সফল হবে। গ্যাটাকদের জন্য মক্কেলের সঙ্গে বেঈমানী করা মোটেই অসম্মানের বিষয় নয়।

‘ওহ্, এমনিতেই, স্রেফ কৌতূহল।’ গ্যাগারিন অস্বস্তির সঙ্গে ভাবল, ডিলাক সন্দেহ করে বসল কি না। উদ্ভট ধারণা, পরক্ষণে ভাবল ও। ডিলাকের ধারণা ওর অবস্থান এখন সবার উপরে, এবং সে নিশ্চিত বোকা পটোম্যাকের মত গ্যাগারিনও তাকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে।

‘আমার যদি নতুন একটা হোস্ট শরীর লাগে,’ ঠাট্টা করে বলল ডিলাক, ‘আপনারা আমাকে ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’

প্রবৃত্তির বশে পিছিয়ে গেল গ্যাগারিন, এবং ডিলাক খলখল করে হেসে উঠল।

‘চিন্তা করবেন না, জেনারেল, আমি কোন গ্যাটাকের সঙ্গে নিজেকে জড়াব না।’

গ্যাগারিন অপমানটা উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল—তখনকার মত।

‘এই ডোডেকাহেড্রন জিনিসটা কী?’ প্রশ্ন করল।

ডিলাক ডোডেকাহেড্রনের লম্বা ইতিহাস বর্ণনা করতে লাগল। পাওয়ার-সোর্স হিসেবে আলফা-তুরার প্রথম সারির এনার্জি- সায়েন্টিস্টরা ওটা বানিয়েছিল। অন্যরা অস্ত্র হিসেবে এর উপযোগিতা উপলব্ধি করে।

‘তখন পর্দাগুলো বানানো হয়, বলল ডিলাক। ‘আমি নিজে অস্ত্রটার নকশা করেছি!’

‘সমস্যাটা কোথায় হলো?’

ডিলাক ব্যাখ্যা করল, গ্রহটা দুটি বিবদমান ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষ শক্তির উৎস হিসেবে ডোডেকাহেড্রন রক্ষা করতে চায়, অপরপক্ষ ওটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ছায়াপথের শ্রেষ্ঠ গ্রহ হিসেবে আলফা-তুরাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধে গ্রহটা ধ্বংস হয়ে গেছে। পাতাল ল্যাবোরেটরিতে লুকিয়ে থেকে বেঁচে যায় শুধু ডিলাক। ডিলাক এবং অন্য আরেকজন, অন্তত কিছু সময়ের জন্য।

শান্তি পার্টির নেতা ডোডেকাহেড্রন চুরি করে এডেনে পালিয়ে যায়। জঙ্গলে বিধ্বস্ত হয় তার স্পেসশিপ, মারা যায় সে।

‘আদিম এডেনবাসীরা জঙ্গলে ডোডেকাহেড্রন খুঁজে পায়, এবং মনে করে ওটা দেবতাদের তরফ থেকে পাওয়া উপহার, ফলে ওটাকে নিয়ে যায় তাদের পাতাল শহরে। প্রথমে ওটার পূজা করেই সন্তুষ্ট ছিল ওরা, পরে টেকনোলজি আবিষ্কার করে ওটাকে পাওয়ার-সোর্স হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে…’

ওদিকে, পাতাল ল্যাবোরেটরিতে আশ্রয় নেয়া ডিলাক শুধু দেখে গেছে আর অপেক্ষা করেছে, ডোডেকাহেড্রন পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করেছে।

‘অনেক সময় নিয়েছেন, তাই না?’ ঘাউ করে উঠল গ্যাগারিন। ‘দশ হাজার বছর!’

‘আমরা জেরোফাইটরা দীর্ঘদিন বাঁচি,’ বলল ডিলাক। ‘অপেক্ষা করতে আমাদের অসুবিধে নেই।’ সটান সিধে হয়ে কনসোলের কাছ থেকে সরে এল। ‘সবুরে মেওয়া ফলে। আমাদের কিছু আলফা-তুরান সঙ্গী-সাথী আমাদের সব কিছু ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা আজকের দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘পর্দাগুলো পাওয়ার শুষছে, তাই না?’ বলল গ্যাগারিন।

সামান্য বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে চাইল ডিলাক।

‘ঠিক ধরেছেন, জেনারেল। শুষছে, ম্যাগনিফাই করছে, কনসেনট্রেট করছে। যে পাঁচটা রশ্মি ওগুলো থ্রো করছে সেগুলো দিয়ে ছায়াপথের যে কোন গ্রহে কনসেনট্রেট করা যায়।

এবার এমনকী পটোম্যাকও বুঝতে পারল।

‘এবং বিস্ফোরণ ঘটানো যায়?’

‘স্রেফ ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া যায়,’ মৃদু হাসল, ডিলাক। ‘পটোম্যাক, আপনি বুঝদার মানুষ। একটা গ্রহ বাছুন—যে কোন গ্রহ।’

পটোম্যাক অসহায় চোখে ওর দিকে চাইল। ও মহানন্দে কোন স্পেসশিপ কিংবা শহর ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু তাই বলে আস্ত একটা গ্রহ? মাত্রাটা ওর জন্য অনেক বেশি হয়ে যায়। আবেদনের ভঙ্গিতে গ্যাগারিনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ও।

‘আপনি ওঁকে বলুন। ‘

‘ওহ, একবারের জন্যে হলেও নিজে সিদ্ধান্ত নাও।’

পটোম্যাক গভীর চিন্তা করে হাল ছেড়ে দিল।

‘আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আমার ওই কোটটা হলেই চলবে!’

মৃদু হাসল ডিলাক।

‘ঠিক আছে। জেনারেল গ্যাগারিন, এবার আপনার পালা। কী চাই বলুন?’

গ্যাগারিন এখনও তার তিক্ত পরাজয়ের কথা ভোলেনি।

‘এডেন,’ সঙ্গে-সঙ্গে বলল ও। ‘এডেন দিয়ে শুরু করা যাক!’

.

টাইম মেশিন ল্যাণ্ড করল একটা পর্দার বেশ খানিকটা পিছনে, জ্বলন্ত ডোডেকাহেড্রনের আলোয় আলোকিত বৃত্তটার ঠিক বাইরে। হিরু চাচা, কিশোর, ক্যারি, হ্যান্সি আর রি-চার্জ করা রোকু সবাই বেরিয়ে এসে চারপাশে নজর বোলাতে লাগল।

টাইম মেশিনে হাত বুলাল কিশোর।

‘ওয়েল ডান, আমরা খুব কাছে এসে গেছি।’

হিরু চাচার চোখে চোখ পড়তেই ঝট করে হাত সরিয়ে নিল ও। টাইম মেশিনটাকে পোষা প্রাণীর মত মনে করে বলে প্রায়ই হিরু চাচার সমালোচনা করে কিশোর। ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে ছোঁয়াচে।

পর্দার ওপাশের চোখ ধাঁধানো দীপ্তিটার দিকে চেয়ে রয়েছেন হ্যান্সি।

‘গোটা আকাশ আলো হয়ে গেছে!’

‘হ্যাঁ,’ বলল হিরু চাচা। ‘আপনারা সবাই বরং এখানে থাকুন।

‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন, ডক্টর?’ ক্যারি প্রশ্ন করল।

‘ডিলাকের সাথে বোঝাপড়া করতে।’

‘তুমি একা যেয়ো না, হিরু চাচা,’ কিশোর বলল। ‘এখনও বেশ ক’জন গ্যাযটাক বেঁচে আছে, তারা তোমাকে দেখলেই খুন করবে।’

‘দেখলেই?’ মুচকি হাসল হিরু চাচা। ‘ঠিক একাজটাই ওরা করবে না!’

ভ্রূ কুঁচকাল কিশোর।

‘কেন?’ হঠাৎই বুঝতে পারল। ‘তোমাকে দেখলে ওরা ডিলাক মনে করবে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও।’

‘ঠিক ধরেছিস। ডিলাক যদি আমার ছদ্মবেশ ধরতে পারে-’

‘তা হলে তুমিও ওর ছদ্মবেশ ধরতে পারো!’

‘হ্যাঁ, আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।’ আলগোছে সরে পড়ল হিরু চাচা।

.

কন্ট্রোল সেটিঙে কাজ করছে ডিলাক, গ্যাগারিন শ্যেনদৃষ্টিতে লক্ষ করছে।

‘রিলেটিভ মোশনের জন্যে ফাইনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট,’ বলল ডিলাক। একটা কন্ট্রোল মুচড়ে দিয়ে পিছিয়ে এল। ‘রশ্মিগুলো এখন এডেনের ওপর পড়বে।’

‘কাউণ্টডাউন শুরু করা যাক,’ বলল পটোম্যাক। উদ্‌গ্রীব হয়ে রয়েছে সে। এডেন নিয়ে পারোয়া করে না ও, জঙ্গলের বেয়াড়া কাঁটায় ওর কোটটা ছিঁড়ে গেছে। ‘এখান থেকে দেখা যাবে গ্রহটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে?’

ধৈর্য ধরুন,’ বলল ডিলাক, গা থেকে কোট খুলতে শুরু করতেই পটোম্যাক সাহায্য করতে লাফিয়ে সামনে এগোল। হাতা গুটিয়ে ডিলাক বলল, ‘আমরা এমন পাওয়ার ছাড়ব যেমনটা কোনও ইন্টেলিজেন্স আজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেনি। এখানে ভুলের কোন সুযোগ নেই। আমি বাইরে গিয়ে পর্দাগুলোর অ্যালাইনমেণ্ট রি-চেক করিগে।’ ডিলাক গটগট করে বাইরে বেরিয়ে এল, পরনে শার্ট স্লীভ, ওকে অনুসরণ করল গ্যাযটাক সহকারী।

পটোম্যাক ওকে যেতে দেখল, এবং গভীর মমতায় বুকের সঙ্গে চেপে ধরল কোটটা।

.

রাতের আঁধার ভেদ করে নিঃশব্দে এগোচ্ছে, হিরু চাচা শেষমেশ গ্যাটাকদের স্পেসশিপটা খুঁজে পেল। নিজেকে ওটার সঙ্গে মিশিয়ে দিল সে, দু’জন টহল গার্ড পাশ কাটাল, কিন্তু ওদের দৃষ্টি স্থির ছিল ডোডেকাহেড্রনের উপর, তাই হিরু চাচাকে দেখতে পেল না। সবচাইতে কাছের পর্দাটার কাছে চলে এল সে।

কোনা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেল ডিলাক ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়ে আসছে, এবং অন্য আরেকটা পর্দার দিকে চলেছে।

‘শার্ট স্লীভ, তাই না?’ বলল হিরু চাচা, এবং কোট খুলে ফেলতে লাগল।

হঠাৎ আতঙ্ক নিয়ে অনুভব করল দুটো হাত সাহায্য করছে তাকে। কাঁধের উপর দিয়ে চেয়ে দেখে ভয়াল দর্শন এক গ্যাটাক তার উদ্দেশে বন্ধুসুলভ হাসি হাসছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে হিরু চাচা ভাবল আসল-নকলে ভাল কাজ দিচ্ছে। লোকটা ভেবেছে সে ডিলাক।

‘অনেক ধন্যবাদ,’ বিনীত গলায় বলল হিরু চাচা। ‘আরেকটা কাজ করে দেবেন?’

গ্যাটাকটা মাথা ঝাঁকাল।

‘আমি ঠিক শিয়োর নই এই পর্দাটা ভার্টিকাল কিনা। এটা কি ভার্টিকাল? এটা একটু ধরে থাকলে আমি অন্য দিকটা চেক করতাম। দেখিয়ে দিচ্ছি!’

গ্যাটাকটাকে দাঁড় করাল হিরু চাচা, দু’বাহু শূন্যে তোলা, খামোকা বিশাল ধাতব পর্দাটার নীচের অংশ ধরে আছে, হিরু চাচার কোটটাও এক হাতে ধরা।

‘চমৎকার,’ বলল হিরু চাচা। ‘একটুও নড়বেন না!’

শশব্যস্তে চলে গেল সে।

.

ডিলাকের কোটের ক্রিজগুলো ঝাড়ছিল পটোম্যাক। সপ্রশংস ভঙ্গিতে তুলে ধরল ওটা।

‘দারুণ!’

গ্যাগারিন সরু চোখে ওর দিকে চাইল। ওর এখনও পটোম্যাককে দরকার, লড়াকু লোক যেহেতু কমে এসেছে। কিন্তু ওকে কি বিশ্বাস করা যায়, লিকলিকে গাধাটা যখন ডিলাকে মুগ্ধ? কোটটা হয়তো একটা সমাধান হতে পারে।

‘পরে ফেলো,’ বাতলে দিল গ্যাগারিন।

চোখজোড়া জ্বলে উঠল পটোম্যাকের। মাথা নাড়ল।

‘ও দেখলে কী বলবে?’

‘ও কী বলল তাতে আর কিছু আসে যায় না,’ বলল গ্যাগারিন। ‘ও অনেক বেশি বলে ফেলেছে।’ ভ্রূ কুঁচকে লক্ষ করল পটোম্যাক ব্যাপারটা কীভাবে নেয়। গ্যাগারিন মেইন কনসোলে চাপড় বসাল বেপরোয়া আত্মবিশ্বাসে। ‘ও কী কী করেছে সব লক্ষ করেছি আমি, ওর মুখ দিয়ে সব ব্যাখ্যা বের করেছি, দেখনি?’

‘তো?’

‘তো সব কিছু আমি গুছিয়ে ফেলেছি। ওকে আর আমাদের দরকার নেই। কোটটা পরে নাও।’ উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে গ্যাগারিন। পটোম্যাক কোটটা পরলে ডিলাকের প্রতি ওর আনুগত্যের সমাপ্তি ঘটবে—এবং ডিলাকও শেষ হয়ে যাবে।

লোভ সামলাতে পারল না পটোম্যাক, হাতার ভিতরে বাহু ঢুকিয়ে দিল, তারপর শ্রাগ করে কাঁধে বসিয়ে নিল। এক ভিশন স্ক্রীনে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিল ও, এসময় ল্যাবোরেটরিতে ঢুকল ডিলাক। পটোম্যাক অপরাধী চোখে চেয়ে রইল।

আসলে ওটা ডিলাক নয়, হিরু চাচা স্বয়ং, তবে পটোম্যাক আর গ্যাগারিনের কাছে ওটা তখনও ডিলাক।

পটোম্যাকের উদ্দেশে উজ্জ্বল হাসল হিরু চাচা।

‘কোটটায় আপনাকে ভাল মানিয়েছে। দারুণ দেখাচ্ছে।’ মেইন কনসোলের কাছে তড়িঘড়ি চলে গেল। ‘এখন দেখা যাক এখানকার কী অবস্থা।’ ডিলাকের কন্ট্রোল সেটিঙে ত্বরিত পরিবর্তন করতে শুরু করল সে।

‘কাউন্টডাউনের ব্যাপারটা কী হবে?’ প্রশ্ন করল পটোম্যাক।

‘এখনই নয়,’ অমনোযোগের সঙ্গে বলল হিরু চাচা। আরও কিছু সেটিং পাল্টাল।

গ্যাগারিন সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে, সে উপলব্ধি করছে কিছু-একটা গোলমাল ঘটছে।

‘আপনি বলেছিলেন এটা প্রোগ্রাম করা আছে।’

‘প্রোগ্রাম করা?’

‘এডেনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য।’

‘হ্যাঁ, তা আছে—প্রায়,’ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল হিরু চাচা। ‘অল্প কিছু মাইনর অ্যাডজাস্টমেন্ট।’ চাকা সদৃশ এক কন্ট্রোলে উঁকি দিল। ‘এটা কীসের জন্যে তাই ভাবছি।’

‘আপনি বলেছিলেন ওটা রশ্মি ফোকাস করার জন্যে,’ সন্দেহ ফুটল গ্যাগারিনের কণ্ঠে। ডিলাক অদ্ভুত আচরণ করছে। ও কি নিজেও আরও বেঈমানীর পরিকল্পনা আঁটছে?

‘অবশ্যই, অবশ্যই,’ বলল হিরু চাচা, কনসোলের উপর উড়ে বেড়াচ্ছে তার আঙুলগুলো। ‘আমি একটু বাইরে থেকে আসছি…’

হিরু চাচা বেরোতে যাবে এসময় এক গ্যাটাক প্রবেশ করে তাকে তার কোটটা দিল। এই লোকটাকে হিরু চাচা পর্দা ধরে রাখতে বলেছিল। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে পড়ে সে, ফলে চলে এসেছে, তারপর মনে পড়েছে তার কাছে তখনও কোটটা রয়েছে—ওর ধারণা ডিলাকের কোট। এখন এসেছে মালিককে তার জিনিস ফিরিয়ে দিতে।

গ্যাগারিন হিরু চাচার হাতে ধরা কোটটার দিকে চাইল, এবং তারপর তাকাল পটোম্যাকের পরনের কোটটার দিকে।

‘দুটো কোট?’ আস্তে করে বলল সে। ‘দুটো কোট? কী হচ্ছে এসব?’

.

ডিলাক পর্দা পরীক্ষা শেষে পিছনে দাঁড়ানো গ্যাযটাকটার দিকে চাইল। গ্যাগারিন নির্দেশ দিয়েছে ডিলাক প্রহরী ছাড়া যেন কোথাও না যায়-’তার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে।’

‘দারুণ! ম্যাগনিফিকেশন লেভেল কনস্ট্যান্ট। আর একবার চেক করলেই, ব্যস।’

সরে গেল ওরা।

টাইম মেশিনের পাশে অপেক্ষা করছিল কিশোর, এবং ক্রমেই হিরু চাচার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল।

ক্যারি আর হ্যান্সি রয়েছেন ওর সঙ্গে, প্রখর দীপ্তিপূর্ণ ডোডেকাহেড্রনের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রয়েছেন।

‘অবিশ্বাস্য,’ বললেন হ্যান্সি। ‘স্রেফ অবিশ্বাস্য।’

‘কাছ থেকে যদি দেখতে পেতাম,’ বলল ক্যারি।

‘হয়তো দেখা সম্ভব,’ বলল কিশোর। ‘রোকু, আয়।’

‘মাস্টার।’

জ্বলন্ত আলোটার দিকে এগোল ওরা।

.

উদ্ভাসিত হেসে জেনারেল গ্যাগারিনের দিকে কোটটা বাড়িয়ে দিল হিরু চাচা।

‘এটা আপনার জন্যে, জেনারেল, আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন, বিনিময়ে এটা সামান্য একটা উপহার।’ গল্পটা দুর্বল, কিন্তু মুহূর্তের জন্য গ্যাগারিনের সন্দেহ দূর হলো।

খোঁত করে শব্দ করে কোটটা নিল সে, ছুঁড়ে দিল এক চেয়ারের উপরে।

‘আমরা কি এখন রেডি?’

‘হ্যাঁ, প্রায়…’ বলল হিরু চাচা, দেরি করার আর কোন বুদ্ধি চট করে মাথায় খেলল না।

‘তারমানে কাউন্টডাউনের পরে অ্যাক্টিভেশন?’

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক আছে, শীঘ্রি কাজটা করা যাক,’ বলল গ্যাগারিন।

পটোম্যাক খুশিমনে গুনতে লাগল।

‘ষাট, ঊনষাট, আটান্ন…’

‘না, না, না,’ প্রবল আপত্তি তুলল হিরু চাচা। ‘এখনই নয়! পর্দাগুলোর পুরো অ্যাক্টিভেশনে পৌছতে আরও অন্তত দু’মিনিট লাগবে। যাই, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’

দরজার দিকে শ্লথ পায়ে এগোল সে। মেইন কনসোলের সেটিঙগুলোর দিকে সন্দেহের চোখে চেয়ে রয়েছে গ্যাগারিন। ওগুলোকে এখন অন্য রকম দেখাচ্ছে।

দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়াল হিরু চাচা।

‘কন্ট্রোলগুলো ছোঁয়া ঠিক হবে না। সব কিছু ভেস্তে যেতে পারে।’ ল্যাবোরেটরি ছাড়ল সে।

পটোম্যাকের দিকে ঘুরে চাইল গ্যাগারিন।

‘ধরো ওকে!’

‘কী?’ বোকা বনে গেছে পটোম্যাক। ‘ডিলাককে ধরব?’

‘হ্যাঁ, ওকে স্পেসক্র্যাফট সিকিউরিটি হোল্ডে ভরো। আমরা ওকে কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখব, যদি কাজে লাগে, কিন্তু ওকে ছাড়াও আমাদের চলবে-কাজেই ধরো ওকে!

ইতস্তত করল পটোম্যাক।

গ্যাগারিন দ্বিতীয় কোটটা তুলে নিল, যেটি আসল হিরু চাচার কোট।

‘তুমি চাইলে এটাও নিতে পারো।’

মুহূর্তে হুঁশ ফিরল পটোম্যাকের। দরজায় দাঁড়ানো অপর দুই হতভম্ব গ্যাটাকের দিকে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে।

‘জেনারেলের কথা তো শুনেছ। ধরো ওকে!’