মরুদস্যু – ১০

দশ

একেবারেই নেই দড়ির টানটান ভাব!

উঁচু পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে নীচে চাইল হতবাক মুসা ও রবিন। আত্মা খাঁচা-ছাড়া হয়ে গেছে ওদের। পরক্ষণে চেঁচিয়ে উঠল ওরা :

‘কিশোর!’

‘কিশোর!!’

‘চিন্তা কোরো না,’ নীচ থেকে ভেসে এল বেসুরো কণ্ঠ। হাঁপিয়ে চলেছে কিশোর। ‘আটকে আছি একটা তাকে।’

‘ঠিক আছ তো?’ বলল রবিন।

‘আমি নেমে আসব?’ জানতে চাইল মুসা।

‘না, আঁধার হয়ে গেছে, ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না,’ বলল কিশোর। ‘আমি ঠিক আছি।’

তাকের বাইরের দিকে কিশোরের পতন ঠেকিয়েছে মাঝারি এক ঝোপ। ওটা ধরে আবারও উঠে এসেছে। এখন দেয়ালের মত খাড়া এক জায়গায় পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে।

‘কিশোর?’ ডাকল রবিন, চিন্তিত। সূর্যের আলো মিলিয়ে যেতেই শুরু হয়েছে হু-হু হাওয়া। ‘কী করবে ভাবছ?’

‘বারান্দার মত একটা জায়গায় আছি,’ বলল কিশোর। ‘যথেষ্ট চওড়া। রাতটা এখানেই শুয়ে ঘুম দেব।’

‘সেটাই বোধহয় ভাল,’ বলল মুসা।

‘স্লিপিং ব্যাগ খুলে ঢুকে পড়ব, সমস্যা নেই,’ বলল কিশোর। ‘সঙ্গে যথেষ্ট খাবার আছে, একটু পর খেয়ে নেব।’

নিজের ব্যাগ থেকে জুস ও হাতে বানানো স্যাণ্ডউইচ বের করল মুসা। পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে খিদে লেগে গেছে। পরের পাঁচ মিনিট অতি ব্যস্ত থাকল। খাওয়া শেষে চালু করল ওয়াকি-টকি, সেট করল চ্যানেল পাঁচে। ট্র্যান্সমিশন বাটন টিপল।

‘আমরা বলছি,’ বলল মুসা।

ওদিক থেকে জবাব এল না।

আবারও সুইচ টিপল মুসা।

‘আমরা মুসা-রবিন-কিশোর, শুনছেন, ওমর ভাই?’

এখনও সাড়া নেই।

একটু আগে ডুবে গেছে সূর্য, কিন্তু লালচে রং পুরো মিলিয়ে যায়নি। পুরো আঁধার নামলে আবারও যোগাযোগ করবে, ভাবল মুসা। তখন অনেক কম বাধা আসবে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রে থেকে। আরও একটা ব্যাপার হতে পারে, হয়তো ক্যাম্প গ্রাউণ্ড পর্যন্ত সিগনাল পাঠাবার ক্ষমতাই নেই এই সেটের!

হু-হু হাওয়াকে বাদ দিলে প্রায় নীরব রাত।

ক্রমেই বাড়ছে শীত।

বেশ কিছুক্ষণ পর টুকটাক কথা থেমে গেল ওদের।

যে-যার মত ঢুকে পড়ল স্লিপিং ব্যাগে।

যার যার মত খেয়ে নিল রবিন ও কিশোর।

ওমরের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না সিবি রেডিয়োতে।

কী যেন দেখা দিল আকাশে।

মরুভূমির আঁধারে উড়বে না কোনও পাখি।

অবশ্য বাদুড় হতে পারে।

বাদুড় এবং ভ্যাম্পায়ারের কথা ভেবে শুকিয়ে গেল মুসার গলা। একটু পর বলল, ‘কিশোর-রবিন? বাদুড়ের আওয়াজ পাচ্ছ? দেখতে পেয়েছ এক-আধটাকে?’

‘আওয়াজ শুনছি,’ বলল রবিন। ‘তবে দেখিনি।’

কিশোর জানাল, ‘ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।’

‘কিন্তু যদি কামড় দেয়?’ বুকে ফুঁ দিল মুসা। ‘যেতে হবে সেই ফিনিক্সের হাসপাতালে। তার আগেই তো হয়ে যাব ভ্যাম্পায়ার!’

‘তখন তোমার ভয় কী,’ মন্তব্য করল রবিন। ‘চোঁ-চোঁ করে শুষে নেবে অন্যের রক্ত! ‘

‘এসব নিয়ে ঠাট্টা করবে না, রবিন!’ বলল কিশোর। ‘ও আসলে আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবছে।’

দুজন মিলে টিটকারি মারায় ব্যোম খেপা খেপে গেল মুসা।

‘মুসা, ওমর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো,’ বলল কিশোর।

‘বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তো চেষ্টা করছে,’ বলল রবিন, ‘বোধহয় আমাদের রেডিয়ো নষ্ট। আগেই পরীক্ষা করা উচিত ছিল।’

‘ভেবে এখন কী হবে!’ বলল মুসা, ‘তবুও চেষ্টা করছি।’

কিশোর বলল, ‘অন্য চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখো।’

‘তাই তো করছি।’

একটু পর পর চ্যানেল পাল্টাতে থাকল মুসা।

আজ দশ নম্বর চ্যানেলে কারও কণ্ঠ নেই।

আছে শুধু বিশ্রী খড়খড় স্ট্যাটিকের আওয়াজ। নব ঘুরিয়ে আওয়াজ কমিয়ে দিল মুসা। আবারও ফিরবে পাঁচ নম্বর চ্যানেলে, এমন সময় শুনতে পেল নিচু কণ্ঠ।

‘ওই ছোকরা গোয়েন্দারা…’

আরেকটু হলে মুসার হাত থেকে পড়ে যেত রেডিয়ো।

কান পাতল মুসা ও রবিন।

এত নিচু আওয়াজ, শুনতে পাবে না কিশোর।

কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও শুনল রবিন-মুসা:

‘হ্যাঁ, ওরা বুনো হাঁসের পিছনে ছুটতে থাকুক।’

‘এবার রেডিয়ো রাখো,’ বলল কড়কড়ে এক কণ্ঠ।

ওই গলা কেন যেন চেনা-চেনা লাগল মুসার।

কিন্তু কণ্ঠ এত অস্পষ্ট, বোঝা গেল না কে হতে পারে।

আরও কিছুক্ষণ কান পাতল ওরা।

নতুন করে আর কিছুই ট্র্যান্সমিট করা হলো না।

নীচ থেকে জানতে চাইল কিশোর, ‘বোধহয় ওমর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারলে না, মুসা?’

‘না, সম্ভব হয়নি,’ বলল মুসা। ‘কিন্তু দশ নম্বর চ্যানেলে কথা বলতে শুনলাম দু’জনকে।’

‘আমাদেরকে ছোকরা গোয়েন্দা বলেছে,’ বলল রবিন।

‘আরও বলেছে আমরা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটছি,’ বলল মুসা।

চুপ করে থাকল কিশোর, ভাবছে কী যেন। একটু পর বলল, ‘এখন বুঝতে পারছি, আসবে না মরুদস্যু। …তোমরা কী ভাবছ?’

‘বোকা-বোকা লাগছে,’ বলল রবিন।

চুপ করে আছে মুসা। কয়েক মুহূর্ত পর বিরক্ত স্বরে বলল, ‘আমাদেরকে ঠকানো হয়েছে।’

চুপ হয়ে গেল ওরা।

দশমিনিট পর পর সিবি রেডিয়োতে আবার ওমর শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইল মুসা।

সাড়া এল না।

ওরা বুঝে গেছে, ঠিক আছে ওয়াকি-টকি।

সমস্যা ওমর শরীফের সিবি সেটে। অথবা…

চুপ করে শুয়ে থাকল ওরা।

সিবি রেডিয়োতে কাদের কথা শুনল ওরা, ভাবছে কিশোর-রবিন- মুসা।

কিশোরের মনে পড়ল: ভালদারেজকে একা রেখে প্রফেসরকে খুঁজতে জঙ্গলে গিয়েছিল ওরা। তখন বোধহয় ওই পাথরের ছোট দেয়াল তৈরি করেছে সে। সরিয়ে দিয়েছে ওদেরকে ভুল পথে

আর দড়ির ব্যাপারটা?

এত শক্ত জিনিস ওভাবে পট্ করে ছেঁড়ার কথা নয়!

অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল।

চুপচাপ শুয়ে আছে রবিন। শ্বাসের আওয়াজ পেয়ে বুঝে গেল ঘুমিয়ে পড়েছে মুসা। কান পাতল ও। দূরে হাহাকার করছে একদল কয়োটি। আঁধারে শিকার করে ওরা। পাহাড়েও বোধহয় আছে কয়েকটা।

স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়াল রবিন। নিচু স্বরে বলল, ‘কিশোর, জেগে আছ?’

‘হ্যাঁ,’ সাড়া দিল কিশোর, ‘চারপাশে নজর রাখছি। ভুলে গেলে, এ জন্যেই এসেছি?’

মৃদু হাসল রবিন। ‘হ্যাঁ, মনে আছে। মুসা ঘুমিয়ে পড়েছে। কে ভাববে পাহাড়ের মাথায় উঠে পাহারা দেব আমরা?’

‘তুমি ভেবেছ,’ বলল কিশোর, ‘রেঞ্জার রায়ানকে বলেছিলে এখানে পাহারা দেয়া উচিত। কিন্তু ওই চিন্তা ভালদারেজের কাছ থেকে পেয়েছ। সে-ই আবিষ্কার করেছিল পাথরের দেয়াল।’

চুপ করে আছে রবিন, চিন্তা করছে গভীরভাবে।

‘ভাবছি আজ রাতে কোথায় আছে ভালদারেজ’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর।

‘আমারও মন খচখচ করছে,’ বলল রবিন।

চুপ হয়ে গেল ওরা।

‘এসো শুয়ে পড়ি,’ একটু পর বলল কিশোর।

‘তাই বোধহয় ভাল,’ বলল রবিন। ফিরে এসে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল ও। আঁধারে চুপ করে শুয়ে থাকল।

কত সময় পেরিয়েছে বলতে পারবে না, কিন্তু অনেকক্ষণ পর আধা সচেতন অবস্থায় চোখ মেলল রবিন। দেখতে পেল ওর স্লিপিং ব্যাগের পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। নাইলন কাপড়ে হ্যাঁচকা টান দিল।

‘কী ব্যাপার, কিশোর…’ পা সরিয়ে নিল রবিন। ঘুমিয়ে পড়তে চাইল আবারও। তারপর ওর মনে পড়ল, কিশোর আছে তিরিশ ফুট নীচে পাহাড়ি কার্নিসে!

হঠাৎ এই আঁধারে কে বা কী উঠে এল ওপরে?

ঝটকা দিয়ে উঠে বসল রবিন, চমকে গেল ভীষণভাবে।

ওটা ঠাণ্ডা দুই চোখ সরাসরি রেখেছে ওর চোখে!