আসল-নকল – ৩

তিন

গনগনে হলদে বালির বুকে, স্বচ্ছ নীলাকাশ থেকে আগুন ঝরাচ্ছে লাল সূর্য। চারদিকে ধু-ধু মরুভূমি। শূন্য ভূমিতে একটি জিনিস, সঠিকভাবে বললে পাঁচটি জিনিস প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে: পর্দাগুলো। গান- মেটাল ব্লুর পাঁচটি পেল্লায় ধাতব পর্দা স্বর্গের দিকে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওগুলোকে খাড়া করে রেখেছে প্রকাণ্ড সব ধাতব খুঁটি। এগুলো হচ্ছে আলফা-তুরার পর্দা।

বেঁটে, মোটা, কুৎসিতদর্শন এক অবয়ব উদয় হলো পরিষ্কার নীল আকাশ চিরে। ক্রমেই নেমে এল ওটা-প্রাচীন এক মহাকাশযান। মরচে ধরা এক ধাতব চৌকো আকৃতি, উড়ন্ত জঞ্জাল, একটি ইন্টারগ্যালাকটিক স্ট্র্যাপহিপ। পর্দাগুলোর মাঝখানে ধপ করে বিদঘুটে ভঙ্গিতে নেমে এল স্পেসশিপটা।

দরজাটা ক্যাচ করে খুলে যেতেই জেনারেল গ্যাগারিন দ্য গ্যাটাক টলতে-টলতে নেমে এল বালির বুকে। মোটা, ভুঁড়িওয়ালা লোকটির পরনে বুট আর ব্রীচেস। গায়ের লম্বা ওভারকোটটি নানা ধরনের প্রতীক চিহ্ন দিয়ে ঠাসা, সে যার কোনওটিরই যোগ্য নয়। মাথায় রত্নখচিত অস্বাভাবিক এক হ্যাট। জিনিসটা রোমান হেলমেট আর ফুলের টবের মাঝমাঝি কিছু একটা। খুদে চোখজোড়া পিটপিট করে চারধারে সাবধানী চাউনি বুলাল, অ্যামবুশের জন্য সতর্ক।

তার পিছনে সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড পটোম্যাক। লিকলিকে এক লোক, দাঁতবিহীন, হাড়সর্বস্ব চিবুকে সাদা দাড়ি। পরনে চীফের চাইতেও ছেঁড়াখোঁড়া সামরিক উর্দি।

এ দু’জনের পিছনে উদয় হলো হিংস্র চেহারার, বহু বর্ণ, ছিন্নভিন্ন পোশাক পরা একদল লোক। নানা ধরনের এবং নানা আকৃতির ছোরা, তরোয়াল আর ব্লাস্টার গোঁজা তাদের বেল্টে। এরা হচ্ছে মহাবিশ্বের তাবৎ খুনে, বিদ্রোহী, আকাশদস্যু, চোর-ডাকাত এবং অপরাধী।

এধরনের গ্যাটাক দল রয়েছে শয়ে শয়ে, এমনকী হাজারে- হাজারেও হতে পারে। মহাশূন্যে ভাঙাচোরা, পুরানো স্পেসশিপে চড়ে ঘুরে বেড়ায় এরা, যার কাছ থেকে যা পায় লুটে, ছিনিয়ে পেট চালায়। গ্যাগারিনের দলটা অন্যদের চাইতে আলাদা, যদিও বেশিরভাগ দলের চাইতে এদের লোকবল কম। জেনারেল গ্যাগারিন একসময় ছোট্ট এক ভাড়াটে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিত। তোবড়ানো স্পেস-ক্রুজারের একটা ছোট বহর ছিল তার, আদিম এক গ্রহের স্থানীয় এক ওঅরলর্ড ভাড়া করেছিল তাকে। গ্রহটা ছিল ছায়াপথের এক প্রান্তে। বেশ ভালই চলছিল, কিন্তু গ্যাগারিন ভুল পক্ষ বেছে নেয়।

বিধ্বংসী শেষ যুদ্ধটার পর ভাগ্যগুণে একটা শিল্প আর কিছু লোক নিয়ে পালাতে পারে সে। সঙ্গে অবশ্যই ছিল বিশ্বস্ত পটোম্যাক, একমাত্র সে-ই কখনও গ্যাগারিনের নেতৃত্বের উপর থেকে আস্থা হারায়নি।

সেজন্যই জেনারেল গ্যাগারিন ও তার দল এরকম একটা ছোট কাজ করতে রাজি হয়েছে। টাকার প্রস্তাবটা লোভনীয় ছিল যদিও এখন পর্যন্ত তারা একটি পয়সারও মুখ দেখেনি।

পটোম্যাক হতাশ চোখে চারপাশে দৃষ্টি বুলাল।

‘খালি বালি, আর কিছু নেই। পুরো গ্রহটাই এরকম!’

গ্যাগারিন চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে সবচাইতে কাছের পর্দাটার দিকে চাইল।

‘এই জিনিসগুলো আছে।’

‘একজন পৃথিবীবাসীকে আলফা-তুরার পর্দার কাছে নিয়ে এসো,’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কোট করল পটোম্যাক। ‘কাজটা কখনওই পছন্দ হয়নি আমার।’

গ্যাগারিন তার দু’জন লোকের উদ্দেশে হাতছানি দিল, এবং তারা তখনও হতবিহ্বল গ্রেগকে শিপ থেকে বের করে আনল। সচেতন এখন তিনি, খানিকটা বিভ্রান্ত-সজাগ এবং আতঙ্কিত।

গ্যাগারিন তাঁর দিকে চাইল।

‘পুরুষ মানুষ, ককেশিয়ান, প্রায় দুই মিটার লম্বা, সন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল সে। ‘ক্লায়েন্ট ঠিক যেমনটা বলেছিল।’

‘আমরা তো ওকে ডেলিভারি দিলাম। এখন পেমেণ্ট করবে কে?’ পটোম্যাক প্রশ্ন করল।

গ্রেগের গলা থেকে বিচিত্র, শ্বাসকষ্টের মত এক ধরনের শব্দ আসছে।

‘মনে হয় কিছু বলতে চাইছে,’ গ্যাগারিনের কণ্ঠে তেমন আগ্রহ ফুটল না।

পটোম্যাক তখনও সন্দেহের দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।

‘এটা একটা ফাঁদ হতে পারে!’ জ্বলন্ত চোখে পৃথিবীবাসীর দিকে চাইল। ‘কিছু বলছে? কী জানে ও?’

‘কিছু না,’ ককিয়ে উঠলেন গ্রেগ। ‘আমি কিছুই জানি না। আমি কী করেছি?’

‘কেউ কিছু জানে না,’ বিষণ্ন শোনাল গ্যাগারিনের কণ্ঠ।

‘কিন্তু আমাকে কেন ধরে আনা হলো?’

‘কেন কাউকে ধরে আনা হয়? আপনার কি ধারণা আপনাকে বিশেষ খাতির করে ধরে আনা হয়েছে?’

আতঙ্কে ফোঁপাচ্ছেন, গ্রেগ গার্ডদের হাত থেকে ছাড়া পেতে দুর্বল চেষ্টা চালালেন।

হাই তুলল গ্যাগারিন।

‘ওকে আরেকটা দাও।’

পটোম্যাক তার রুপোলী সিলিণ্ডার বের করে গ্রেগের ঘাড়ে চেপে ধরল। নিমেষে গ্রেগ নিশ্চুপ আর অসাড় হয়ে গেলেন।

‘আমার এখনও ধারণা মেসেজটা খাঁটি ছিল,’ জোর গলায় বলল গ্যাগারিন। ‘আমরা অপেক্ষা করব।’

‘খাঁটি?’ গর্জে উঠল পটোম্যাক। ‘আমরা এমনকী এটাও জানি না কে ওটা পাঠিয়েছে। এখানে কেউ নেই। আর্থলিংটাকে মেরে এখান থেকে বিদায় হই চলুন।’

‘কোথায় যাব?’ প্রশ্ন করল গ্যাগারিন। ‘তারচেয়ে বরং মাথা খাটানো যাক।’ পৃথিবীবাসীটির দিকে মাথা ঝাঁকাল সে। ‘কেউ এরকম একটা প্রাণীকে চেয়ে পাঠাল কেন?’

ভাবল পটোম্যাক। কিন্তু প্রশ্নটা খুবই জটিল। হাল ছেড়ে দিল ও।

‘কোনও ধারণা নেই।’

‘আমারও।’

হঠাৎই তাদের সামনের মাটি কাঁপতে লাগল। সন্দিহান গ্যাটাকরা লাফিয়ে পিছু হটল, যার যার অস্ত্র তুলে নিল।

ওদের খানিকটা সামনে, পর্দাগুলোর মাঝখানে বালির বুক ফুঁড়ে উদয় হচ্ছে অতিকায় এক চারকোনা কাঠামো। ওটার উপরের অংশ স্বচ্ছ, ভিতরে কোনও ধরনের খুঁটি চমকাচ্ছে, নীচের অংশ ধাতব-ঝিকমিক করছে। গ্যাটাকরা বিস্মিত চোখে চেয়ে-চেয়ে দেখছে, ওদের সামনে বালির বুক চিরে বিশাল এক দালান মাথা তুলছে।

পুরোপুরি বেরিয়ে আসার পর দেখা গেল ওটা একটা চকচকে চারকোনা কাঠামো, মাথায় স্বচ্ছ এক মিনার, যেটিকে অসম্পূর্ণ দেখাল ওদের দৃষ্টিতে। বাড়িটার এক পাশের একটি দরজা হড়কে খুলে গেল। ভিতর থেকে ছড়িয়ে পড়ল স্নিগ্ধ, সবুজ এক আভা। সবাই নির্বাক।

দরজাটার দিকে এগোতে লাগল গ্যাগারিন।

পটোম্যাক তার বাহু চেপে ধরল।

‘না! এটা ফাঁদ।’

‘চুপ করো। এসো।’

নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ক’জন অনুসারী অনুসরণ করল তাদেরকে। খোলা দরজাটার দিকে পা বাড়াল তারা।

দোরগোড়ায় মুহূর্তের জন্য থমকাল গ্যাগারিন, তারপর ভিতরে প্রবেশ করল। অনুসরণ করল পটোম্যাক।

বিশাল এক কামরায় নিজেদেরকে আবিষ্কার করল তারা। ঘরটিতে রহস্যময় সব যন্ত্রপাতি ঠাসা, নিঃশব্দে গুঞ্জন করে চলেছে। সারকে সার গেজ, ডায়াল আর কন্ট্রোল কনসোল, কিছু ফ্রী-স্ট্যাণ্ডিং, কিছু দেয়ালে বসানো। এসব কীসের জন্য, জাদুবলে বালির বুক ফুঁড়ে কেন এটা বেরিয়ে এসেছে, গ্যাগারিনের সামান্যতম ধারণা নেই।

কামরার মাঝখানে, এক স্ট্যাণ্ডে বিরাট এক ক্যাকটাস দাঁড়িয়ে, আকারে প্রায় এক মানুষ সমান।

পটোম্যাক সন্তর্পণে ঘুরে দেখতে শুরু করল। এক কনসোলের উপরে এল-শেপের রহস্যময় এক ধাতব যন্ত্র লক্ষ করল ও, কন্ট্রোল আর খুদে এক স্ক্রীন নিয়ে সেট করা। প্রবৃত্তির বশে ও ওটা তুলে নিয়ে, ছিন্নভিন্ন মিলিটারি কোটের অনেকগুলো পকেটের একটিতে ভরে রাখল। সুযোগ পেলেই চুরি করা গ্যাটাকদের নীতি।

একটি গুরুগম্ভীর, অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, ‘পৌঁছলেন তবে। ওয়েলকাম, জেণ্টলমেন!’

সন্দিহান পটোম্যাক পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল, আশঙ্কা করল ও বোধহয় কোনও অ্যালার্ম অন করে দিয়েছে।

‘আপনারা ভয় পাবেন না,’ কণ্ঠটি কৌতুকের সুরে বলল।

গ্যাগারিন রীতিমত আতঙ্কিত, কিন্তু গলায় তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে তুলতে পারল।

‘ভয় পাব? আমি? আপনি জানেন, কার সাথে কথা বলছেন?’

‘আমার ধারণা, জেনারেল গ্যাগারিন এবং লেফটেন্যান্ট পটোম্যাক, সঙ্গে তাদের ফরচুন-হান্টারের দল। একটা পৃথিবীবাসীরও আশপাশে থাকার কথা।’

দোরগোড়ায় দাঁড়ানো তার এক লোকের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল গ্যাগারিন।

‘ওকে নিয়ে এসো,’ চারপাশে চোখ বুলাল। ‘এবং আপনি-কে আপনি?’ ইতোমধ্যেই মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে তার।

‘মাফ করবেন,’ মসৃণ গলায় বলল কণ্ঠটি। ‘ভুল হয়ে গেছে। আমি ডিলাক, এই গ্রহে একমাত্র আমিই বেঁচে আছি।’

চরম বিস্ময়ে গ্যাগারিনের দিকে চাইল পটোম্যাক। শ্রাগ করল গ্যাগারিন, এবং প্রকাণ্ড ক্যাকটাসটার দিকে মাথা ঝাঁকাল।

‘ঠিক ধরেছেন, জেনারেল গ্যাগারিন,’ বলল কণ্ঠস্বরটি। ‘গাছটাই আমি। নিখুঁতভাবে বললে একটা জেরোফাইট।’

গার্ডদের ধাক্কায় কামরায় ঢুকে পড়লেন গ্রেগ চ্যাপেল। গ্যাগারিন হাতছানি দিতেই পৃথিবীবাসীটিকে গাছটার সামনে এনে দাঁড় করানো হলো।

‘চমৎকার, জেনারেল গ্যাগারিন,’ বলল ডিলাক। ‘আপনি দারুণ কাজ দেখিয়েছেন। এখন আমি আপনাকে একটা সত্যিকারের প্রস্তাব দিচ্ছি…’

.

এডেনের ডিবেটিং চেম্বারে বাদানুবাদ তখনও চলছে। ইসাস বৃথা চেষ্টা করছেন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে।

‘এই চেম্বারে শুধু আমার কর্তৃত্ব থাকবে।’

‘আপনি সেটা হারিয়েছেন,’ হ্যান্সি বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বললেন। ‘আপনার এলিয়েন বন্ধুদেরকে আপনি প্রতিনিধি করেছেন।’

একবারের জন্য হলেও গ্রেবা তাঁর সঙ্গে সায় দিলেন।

‘একজন পৃথিবীবাসী, আমরা কীভাবে তাকে বিশ্বাস করি?’

‘ডক্টর হিরন পাশার ওপর নিশ্চিন্তে বিশ্বাস রাখা যায়,’ বললেন ইসাস।

তেতো হাসলেন হ্যান্সি।

‘বিশ্বাস! আবার সেই শব্দ? আমাদের দরকার জ্ঞান।’

‘হিরন পাশার তা-ও আছে।’

‘জ্ঞান আমাদের কাছেও আছে, শুধু যদি তা ব্যবহার করার সুযোগ পেতাম!’ আফসোস করে বললেন হ্যান্সি।

গ্রেবা সটান উঠে দাঁড়ালেন।

‘এই তর্ক চলতেই থাকবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমি শক্তির কাছ থেকে নিজে দিক্ নির্দেশনা চাইব।’

তিনি চেম্বার ত্যাগ করতে যাবেন, এসময় হুড়মুড় করে কামরায় প্রবেশ করল ক্যারি, তার হাতে-মুখে এখনও কালি লেগে রয়েছে।

‘আমার এই চেম্বারে কিছু কথা বলার আছে।’

‘না,’ গর্জে উঠলেন গ্রেবা, এবং ডিয়ন অংশ থেকে প্রতিবাদের গর্জন সমর্থন জানাল তাঁকে।

ইসাস একটা হাত তুললেন।

‘ক্যারি এই শহরের সেবা করার জন্যে অনেকবারই জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। ও কী বলতে চায় শোনা যাক।’

ধীরে-ধীরে উত্তেজনা কমে এল।

সম্মেলনের মুখোমুখি হলো ক্যারি।

‘আমরা যদি এমনকী পাওয়ার মেরামতও করতে পারি-কিংবা ডিয়নদের কথায় পাওয়ার যদি নিজেই নিজেকে মেরামত করে-হিমায়িত খাবারের যে মজুদ রয়েছে তার বেশিরভাগটাই নষ্ট হবে। আমাদেরকে মাটির ওপরে ফিরে যেতে হবে।’

ডিয়নরা, এবং কিছু সাভাণ্টও প্রতিবাদে গর্জে উঠল।

.

ডিলাকের কথা শেষ হলে, দুই গ্যাটাক নেতা মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল। প্রস্তাবটির ধৃষ্টতা তাদেরকে বিমূঢ় করে দিয়েছে।

এবার পটোম্যাক চাইল গ্যাগারিনের দিকে।

‘ও একটা পাগল। পেমেন্ট নিয়ে চলে যাই চলুন!’

‘গ্যাযটাকরা!’ ব্যঙ্গ ঝরল ডিলাকের গলায়। ‘ছায়াপথের লুটেরা! আপনাদের মত হাজারও ছোট-ছোট দল আছে। এবং সেগুলো কীসের জন্যে?’

‘লুট!’ পটোম্যাক সহজ গলায় বলল।

‘নানা ধরনের অকেজো ট্রফি! কতদিন ধরে এগুলো সংগ্রহ করছেন আপনারা?’

‘সারাজীবন ধরে,’ সগর্বে বলল পটোম্যাক।

‘অথচ আপনারা আমাকে সময় অপচয় করার জন্য দোষ দিচ্ছেন।’

‘দেখুন,’ ভারী গলায় বলল গ্যাগারিন, ‘আপনি আমাদেরকে যে কাজ করতে বলছেন তা সম্ভব নয়। ‘

‘অসম্ভব নয়-স্রেফ বোঝার ক্ষমতার বাইরে।’

‘ওই শহরে ঢোকার একটা মাত্র পথ: মানুষখেকো এক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আর ওই এডেনবাসীরা ডোডেকাহেড্রনকে জীবন দিয়ে পাহারা দেবে, ওটা ওদের কাছে ঈশ্বরের মতন।’

মাথা ঝাঁকাল পটোম্যাক।

‘ঠিক। এবং আমরা যদি ওটার কাছে পৌঁছতেও পারি, লোকে বলে ওটাকে স্পর্শ করা খুবই বিপজ্জনক।’

‘সত্যি তাই,’ সাবধানী শোনাল ডিলাকের গলা। ‘আপনারা কি ভেবেছেন আমি ও নিয়ে চিন্তা করিনি-এবং সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাইনি? তবে আপনারা মনে হয় রাজি না হয়ে ঠিকই করেছেন। আপনাদের মধ্যে উদ্দীপনার অভাব আছে। আপনারা সত্যিকারের ঐশ্বর্য, সত্যিকারের ক্ষমতায় আগ্রহী নন। তো লেফটেন্যান্ট পটোম্যাক যদি আমার রি-ডাইমেনশনাইজারটা ফিরিয়ে দেন, আমরা ডিলটা শেষ করতে পারি।

‘দিয়ে দাও, বোকা কোথাকার,’ খেঁকিয়ে উঠল গ্যাগারিন। ‘ওটা দিয়ে কী করবে তুমি? ম্যাস কনভার্শন মেকানিকস সম্পর্কে কী জান তুমি?’

গোমড়া মুখে রি-ডাইমেনশনাইজারটা বের করে কনসোলের উপর সশব্দে রেখে দিল পটোম্যাক।

চিন্তামগ্ন গ্যাগারিন তার দেহভার রাখল এক চেয়ারে।

‘তাড়াহুড়োর দরকার নেই, ডিলাক। আমি আগ্রহী নই বলছি না, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে আরও অনেক জানতে হবে।’

.

হিরু চাচা রোকুর শায়িত দেহের দিকে চেয়ে রয়েছে।

‘ওর সব কন্সট্যান্ট রি-প্রোগ্রাম করতে হলে ঝামেলা হয়ে যাবে।’

‘সারাজীবন লেগে যাবে,’ বিষণ্ন কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘আমি পাওয়ার ডিপ্লেশন নিতে চিন্তিত। এই হারে চললে, প্রতি দু’ঘণ্টা পরপর রিচার্জ করতে হবে।’

‘ওহ, আমি শীঘ্রি ওটা সারিয়ে ফেলব। আমি পাওয়ার সোর্সের এক্সপার্ট বলতে পারিস।’

‘তাই! এডেনের এই ছোট্ট কাজটা করতে তার মানে তোমার বেশি সময় লাগবে না?’

‘ফ্লাইং ভিজিট!’ হালকা চালে বলল হিরু চাচা। ‘দরকার স্রেফ একটা কুইক সার্ভিস।’

‘এনার্জি প্রসেসটা আসলে কী, হিরু চাচা? ব্যারিয়ন মাল্টিপ্লিকেশন?’

‘হ্যাঁ, তেমনই একটা কিছু। শেষবার ওরা আমাকে দেখতে দেয়নি। ধর্মীয় বাধা…’

.

‘তো ডোডেকাহেড্রন এখানে এই আলফা-তুরায় বানানো হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ, জেনারেল গ্যাগারিন। এডেনের ওই বর্বর গর্দভগুলো ওটার অতি সামান্য অংশই ব্যবহার করতে পারছে।’

‘অতি সামান্য? ওদের গোটা গ্রহকে পাওয়ার দিচ্ছে ওটা!’

‘খুব অল্প একটা ফ্র্যাকশন। ইদানীং যে পাওয়ার কম-বেশি হচ্ছে সেটা ওটার বিল্ট-ইন প্রোগ্রামিঙের অংশ। ওটার রি-স্টার্ট মোড়ে, আউটপুট এমন এক পর্যায়ে তোলা যাবে, গোটা ছায়াপথকে পাওয়ার দিতে পারবে।’

‘অসম্ভব।’

‘আপনার সীমিত জ্ঞানে হয়তো তাই,’ অধৈর্য কণ্ঠে বলল ডিলাক। ‘এখন যখন শর্তগুলোতে আমরা একমত, কাজ শুরু করলে হয় না? আপনি কাজ শুরুর ধরন সম্পর্কে ক্লিয়ার তো?’

গ্যাগারিন উঠে দাঁড়াল। মেইন কনসোলের কাছে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে ওটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা কন্ট্রোল টিপল। ছাদ থেকে পাশাপাশি নেমে এসে দুটো স্বচ্ছ প্লাস্টিক সিলিণ্ডার ঝুলে রইল বাতাসে।

গ্যাগারিনের ইশারায় তার জনা দুয়েক লোক পৃথিবীবাসীটিকে সামনে নিয়ে গেল, দাঁড় করাল একটা সিলিণ্ডারের নীচে। এবার গাছটাকে স্ট্যাণ্ডসহ সরিয়ে আনল দ্বিতীয় সিলিণ্ডারটির নীচে।

গ্যাগারিন আরেকটি বাটন চাপতেই মেঝে অবধি নেমে এল সিলিণ্ডার দুটো। আলাদা দুটি কন্টেইনারে ঢেকে ফেলল ডিলাক আর পৃথিবীবাসীটিকে।

স্বচ্ছ কারাগার থেকে গমগম করে উঠল ডিলাকের কণ্ঠস্বর।

‘জেনারেল গ্যাগারিন, পদ্ধতিটা কি আমি পরিষ্কার করতে পেরেছি?’

‘হ্যাঁ, একদম পরিষ্কার।’ গ্যাগারিন নির্দেশ করল। ‘এই বাটনটা পরিবর্তন প্রক্রিয়া চালু করে। কাজ শেষ হলে এটা আপনাকে মুক্তি দেবে।’

‘চমৎকার! তা হলে শুরু করুন।’

পটোম্যাকের উদ্দেশে চোখ টিপল গ্যাগারিন।

‘অবশ্যই।’

ডিলাককে ধারণ-করা কন্টেইনারটার পিছনে হেঁটে এসে দাঁড়াল গ্যাগারিন। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ওটাকে, নিশ্চিত হয়ে নিল জিনিসটা পুরোপুরি নিরাপদ।

অস্বস্তি নিয়ে চেয়ে রয়েছে পটোম্যাক।

‘কাজ শুরু করা যাক। আমার মনে হচ্ছে ও রেডি আছে। এই বাটনটাই তো, তাই না?’

পটোম্যাক কন্ট্রোলগুলোর দিকে এগোলে খেঁকিয়ে উঠল গ্যাগারিন, ‘ওখান থেকে সরে যাও।’

‘দেরি কীসের? আমি এই গ্রহ থেকে যত শীঘ্রি সম্ভব চলে যেতে চাই।’

‘আমিও তাই চাই।’ কামরাটার চারপাশে হাত নাড়ল গ্যাগারিন। ‘কিন্তু এতসব কিছু ফেলে রেখে যেতে কষ্ট হবে।’

পটোম্যাক উজ্জ্বল হাসল। গ্যাগারিনের প্রতি বিশ্বাস জোরাল হলো তার।

‘আপনার একটা প্ল্যান আছে! আমরা ওকে ওখানে আটকে রাখব, তারপর সব চুরি করে ভেগে যাব!’

গ্যাগারিন সবচাইতে কাছের কনসোলটিতে চাপড় দিল।

‘এটা কততে বিকোবে বলে তোমার ধারণা?’

‘পাঁচ মিলিয়ন?’ আশান্বিত কণ্ঠে বাতলে দিল পটোম্যাক। ‘আমাদের দারুণ কপাল, তাই না?’

‘কপাল?’ নিজের কপালে অর্থপূর্ণ টোকা দিল গ্যাগারিন। ‘ব্রেইন, মাই ল্যাড।’ কামরার চারপাশে চোখ বুলাল ও, এদিক-সেদিক আঙুল দেখাল। ‘আমরা মেইন কনসোলটা দিয়ে শুরু করতে পারি। জিনিসটা খুব ভারী হবে যদিও।’

‘ভেঙে ফেলা যায়।’

‘দাম কমে যাবে তো। আস্ত জিনিসটা চমৎকার!’

খুশিতে দাঁত বের করে হাসল পটোম্যাক। লুটপাটে তার ভারী আনন্দ, একাজে তার জ্ঞানও প্রচুর।

‘আমি অন্যদের নিয়ে আসি।’ দরজার কাছে গেল, ঠেলা দিয়ে পরক্ষণে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। ‘বন্ধ।’

‘খুলছে না কেন?’

‘খুলবে না।’ ভ্রূ কুঁচকাল পটোম্যাক। ‘যখন ঢুকলাম তখন ঠিকই খুলেছিল-অটোমেটিক্যালি।’

এসময় ডিলাকের কণ্ঠ বলে উঠল, ‘ঠিক তাই। অটোমেটিক্যালি!’

গ্যাগারিন পটোম্যাকের দিকে চাইল।

‘ও আমাদেরকে ফাঁদে ফেলেছে।’

‘আমাদেরকে বিশ্বাস করেনি,’ দুঃখিত কণ্ঠে বলল পটোম্যাক।

শয়তানী হাসি হাসল ডিলাক।

‘কোনও কিছুই এত সোজা নয়। আমি জানতাম আপনারা অন্য কিছু ভাববেন, সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবেন। আমি চেয়েছিলাম ব্যাপারটা আগেভাগেই ঘটুক-আপনারা যাতে বোঝেন এসব করে লাভ হবে না।

গ্যাগারিন আর পটোম্যাকের চোয়াল ঝুলে পড়ল।

ঘৃণ্য, বিজয়ী কণ্ঠটা বলে চলল, ‘আমি আপনাদের মত লোকদের খুব ভাল করেই চিনি। আপনারা সহযোগিতা করতে চাইলে আমি চাই আপনারা আগে আমাকে জানুন!’

গ্যাগারিন আর পটোম্যাকের মুখে এখনও রা ফুটল না।

‘ঠিক আছে,’ মসৃণ কণ্ঠে বলল ডিলাক। ‘আমরা বরং আমাদের অরিজিনাল অ্যারেঞ্জমেন্টটা শুরু করি।’ কণ্ঠস্বরটা কঠোর হলো। ‘নাকি আমরা সবাই মাটির নীচে আরও হাজার বছরের জন্যে ঢুকে যাব?’