ভয়-ভুতুড়ে – ৮

আট

তিন বন্ধু যার যার বাইকে বসা, সিম্পসনকে দেখছে। বুড়ো মানুষটির সাদা চুল ঘামে ভিজে লেপ্টে রয়েছে কপালের সঙ্গে। দু’বাহু গ্রিজে মাখামাখি। অন্যান্য মেকানিকরা তার সঙ্গে যখন কথা বলল, গম্ভীর মুখে জবাব দিল সে। চারধারে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে সিম্পসন, ঝুঁকছে, টুলবক্স বদলাচ্ছে-ভ্রূ কুঁচকে রেখে।

‘ওঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে দেখি,’ বলল মুসা। বাইক থেকে নেমে হেঁটে ঢুকে পড়ল গ্যারেজের ভিতরে।

অন্য মেকানিক দু’জন মুসাকে দেখে কাজ থামিয়ে ঘুরে চাইল।

একটা গাড়ির হুডের নীচে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল সিম্পসন। মুসা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

‘মিস্টার ব্র্যাণ্ড?’

বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে চাইল সিম্পসন, তার পর সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে ন্যাকড়ায় হাত দুটো মুছে নিল।

‘কী ব্যাপার?’ ঘাউ করে উঠল। দৃষ্টি তখনও এঞ্জিনটার উপরে স্থির।

‘আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই,’ বলল মুসা।

‘রিসেপশনিস্টের সাথে কথা বলোগে যাও,’ গজ-গজ করে বলে, হুডের নীচে ঝুঁকে পড়ল সিম্পসন।

‘আমি গাড়ির ব্যাপারে কথা বলতে আসিনি,’ বলল মুসা। সিম্পসন ওকে উপেক্ষা করল। মুসা অন্য মেকানিক দু’জনের দিকে চাইল। নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে দেখছে তারা। সিম্পসনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল মুসা। লোকটির হাতে তখন বড়সড় এক রেঞ্চ।

‘আমি বেসবল নিয়ে কথা বলতে চাই,’ শান্ত কণ্ঠে বলল মুসা।

ড্যানি সিম্পসন এই প্রথমবার ওর দিকে চাইল। চোখের দৃষ্টি শীতল। সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

‘আপনি কখনও বেসবল খেলেছেন?’ প্রশ্ন করল মুসা। বুক ধড়াস- ধড়াস করছে ওর।

বুড়ো মানুষটির চোখের দৃষ্টি পাল্টাল না। তার ঠাণ্ডা দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গেল মুসা।

‘কে তুমি?’ দীর্ঘ নীরবতার পর জানতে চাইল ড্যানি সিম্পসন। ‘কী চাও আমার কাছে?’

সিম্পসন এক পা এগোতেই, মুসা পিছু হটল। রাগে বিকৃত দেখাচ্ছে বৃদ্ধের মুখের চেহারা।

‘কে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে?’ গর্জে উঠল সিম্পসন। দরজার দিকে পিছিয়ে নিয়ে চলেছে মুসাকে। ‘তোমরা আমাকে বিরক্ত করছ কেন?’ হাতের রেঞ্চটা অস্ত্রের মত উঁচিয়ে ধরল।

বড় এক রোলিং টুল চেস্টে ধাক্কা খেল মুসা, হেলে গেল এক পাশে। এবার গ্যারেজ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল ও। কিশোর আর · রবিন ইতোমধ্যেই বাইকে চেপে সাঁ-সাঁ করে ড্রাইভওয়ে ধরে ছুটে চলেছে। কাঁধের উপর দিয়ে চাইল মুসা। বৃদ্ধ তখনও এগিয়ে আসছে। তার হলদে দাঁতগুলো খিঁচানো। হাতের তালুতে রেঞ্চটা বাড়ি দিচ্ছে। মুসা এক লাফে বাইকে চড়ে বন্ধুদের পিছু নিল।

.

কিশোর সে রাতে মুসাকে নিজের কামরায় শুতে বলল।

‘ক্লজিটে একটা স্লীপিং ব্যাগ দেখেছি,’ বলল ও। ‘তুমি ফ্লোরে ঘুমোতে পারো। কাল রাতে তুমি আমার সাথে ছিলে বলে বিল ফাস্ট আসেনি।’

মিনা,’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল মুসা। ‘ওর সাথে আমার কথা বলার চেষ্টা করা দরকার। তাকে বলতে হবে আমি আমার সাধ্যমত করছি। ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি জানলে হয়তো মন নরম হবে ওর।

ভোর তিনটার সময়, পাশে ফ্ল্যাশ লাইট নিয়ে বিছানায় বসে ছিল মুসা, জেগে থাকতে চেষ্টা করছে। চিবুকের নীচে হাঁটুজোড়া রেখেছে। হলওয়ের শেষ প্রান্তে, ওর দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর। পায়ের শব্দ কিশোরের কামরা পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। মুসা শ্বাস চেপে রেখে দরজার দিকে চেয়ে রইল। ক্যাচ করে একটা শব্দ। নব ঘুরছে টের পেল ও। কাঁপা একটা হাত দিয়ে মুখ ঢাকল মুসা।

দরজাটা ককিয়ে উঠে ফাঁক হলো। ঠাণ্ডা এক ঝলক বাতাস অনুভব করল মুসা, জানালা যদিও বন্ধ। কথা বলতে চায় ও, ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোন শব্দ বেরোল না। দোরগোড়ায় একটা দেহ-কাঠামো দেখতে পেল।

‘বিল ফাস্ট, তুমি এসেছ?’ কোনমতে ফিসফিস করে আওড়াল মুসা।

দেহটা নড়ল না।

‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি,’ বলল মুসা। ‘আমি ড্যানি সিম্পসনকে খুঁজে পেয়েছি। কথা বলতে পারিনি, কিন্তু সে কোথায় আছে জানি। তুমি কি তার জন্যেই অপেক্ষা করছ?’

দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দেহটা এক পা আগে বাড়ল। মুসা সেঁটে গেল দেয়ালে। অবয়বটার বাঁ হাতে একটা বেসবল দস্তানা।

‘আমাকে নিয়ে যেয়ো না,’ অনুনয় করল মুসা। ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি। আমি তাকে ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজছি।’

বিল ফাস্ট স্থির দাঁড়িয়ে, ওর দিকে চেয়ে।

‘আমি জানি তুমি কতখানি হতাশ,’ বলল মুসা। মুখ শুকনো ওর, কথা বলা শক্ত। ‘আমি জানি তুমি বেসবল কতটা ভালবাস আর সেদিনের খেলাটা দেখার তোমার কতটা আগ্রহ ছিল।’

বিল ফাস্ট আরেক পা এগিয়ে বিছানার উপর ঝুঁকে পড়ল। দেয়ালের সঙ্গে আরও শক্তভাবে সেঁটে গেল মুসা। ভূতটা মুসার কবজি চেপে ধরে এক টানে দাঁড় করিয়ে দিল।

মুক্ত হাতে মুসা কবজি থেকে ঠাণ্ডা আঙুলগুলো খসানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আঙুলগুলো যেন জমাট বাঁধা বরফের দড়ির কুণ্ডলি।

‘সোমবার,’ হড়বড় করে বলল মুসা। ‘পরের সোমবার কোন খেলা নেই। আমি সিম্পসনকে ওখানে নিয়ে যাব। তুমি বলপার্কে অপেক্ষা, কোরো, কেমন? আমি কথা দিচ্ছি।’

মুসার চোখের দিকে জ্বলন্ত চোখে চাইল বিল ফাস্ট। ভূতটা মুসাকে ছেড়ে দিয়ে আচমকা মুঠো পাকাল। মুসা টলতে টলতে বিছানায় ফিরে গিয়ে দু’বাহু দিয়ে মাথা ঢাকল। এই বুঝি ঘুষি পড়বে। বিল ফাস্ট মুঠো দিয়ে দস্তানায় তিনবার আঘাত করল, ক্যাচের জন্য তৈরি হচ্ছে যেন। মুসা ওর পাশে রাখা ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালার জন্য হাতড়াল। সুইচ অন করে দিল। ঘরের চারধারে আলো বোলাল, কিন্তু বিল ফাস্ট নেই।