বেঁচে থাকতে চাই

আমার দেহঘরে ধেড়ে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ছে
নানা ব্যাধি, দৃষ্টিহীন বাদুড়ের
ডানার সৃষ্টিছাড়া ছায়া ঘনাচ্ছে আমার দু’চোখ।
অস্তিত্বের তন্তুজালে মাঝে-মধ্যে যে-উৎসব
জ্বলজ্বল করে তার স্থায়িত্বের সীমা ক্রমশ সঙ্কুচিত,
মাথার ভেতরকার দুঃস্বপ্নের দাঁত-নখের
ভয়ানক আঁচড় আমাকে বারবার দাঁড় কারিয়ে দেয়
খাদের কিনারে, তবু বেঁচে থাকতে চাই।

শক্ররা তূণ থেকে একের পর এক শর নিক্ষেপ করছে
আমার দিকে, আমাকে সুনামের
শিখর থেকে ধুলোয় ফেলে পদদলিত করার অভিলাষে
মত্ত কিছু ধর্মান্ধ, কুসংস্কার-পসারী,
আমার প্রাণ হরণের জন্যে ওদের জিভ লকলক করছে
নেকড়ের মতো, যাতে আমার
মুক্ত কণ্ঠস্বর বিজন হাওয়ায় হারিয়ে যায়, সে জন্যে ওদের
ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই; তবু আমার বাঁচার সাধ সতেজ।
যে পাখিটি এইমাত্র রেলিঙ-এ উড়ে এসে বসল তার জন্যে,
বাগানের ফুলগুলোর জন্যে,
যে গাছের ছায়া আমার বারান্দায় নমিত প্রার্থনার মতো,
তার জন্যে, বাঁশবাগানের বৃষ্টির গন্ধ, গরুর মাথানের
সদ্যোজাত বাছুরের ঘ্রাণ আর দীঘির ঘাটে তরুণীর
ভাসমান কলসের জন্যে, ধানের ক্ষেতে কৃষকের
রৌদ্রঝলসিত কাস্তের জন্যে, গাঁয়ের বাড়ির বৈঠকখানায় দুপুরে
খাটে শুয়ে ঘুঘুর ডাকে ডুব দেওয়ার জন্যে, গহীন গাঙে
পালতোলা নাওয়ের জন্যে, রঙিলা নায়ের মাঝির
গানের জন্যে, সর্ষে ক্ষেতের প্রজাপতির জন্যে বাঁচতে চাই।

আমার মায়ের মুখের প্রসন্নতার জন্যে,
আমার জীবনসঙ্গিনী, সন্তান-সন্ততি, আমার সকল
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্যে,
আমার চার বছরের পৌত্রী নয়নার কালো চোখের চাওয়া
আর ফুটফুটে হাসির জন্যে,
যাকে ভালোবাসি, তার জীবনের রৌদ্রজ্যোৎস্না
অনুভব করার জন্যে, তাকে আরো বেশি দেখার জন্যে
বেশ কিছুকাল বাঁচার আনন্দ পেতে চাই।

শীতের দুপুরে আকাশে চিলের চক্করের জন্যে,
ফুটপাতের পাশে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে,
ঘরেতে ভ্রমরের গুঞ্জনের জন্যে, নিশুত রাতে
কালপুরুষের উপস্থিতির জন্যে,
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্যে, লালন গীতিকার জন্যে আর
আমার এখনো লিখতে না-পারা কবিতার জন্যে,
বাংলা কবিতার নতুন বাঁকে দাঁড়ানোর জন্যে,
আমার বেঁচে থাকার স্পৃহা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

প্রতিবাদী মিছিল থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে-আসা
ছোট ভাইয়ের মাথায় বড় আপার
হাত বুলিয়ে দেওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্যে,
কারাগার থেকে জনগণনন্দিত রাজবন্দির মুক্তির জন্যে,
সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ বন্ধ হয়েছে,
স্বদেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই সংবাদ
শোনার জন্যে, দেশ ধুরন্ধর ফতোয়াবাজদের
দন্তনখর থেকে মুক্ত হয়েছে, ঘাতকদের অস্ত্রময় ডেরা
বিলুপ্ত হয়েছে জানার জন্যে, মানবতার বিজয়োৎসব দেখার জন্যে
ফিনিক্‌স পাখির মতো বারবার বেঁচে উঠতে চাই।