একজন নদীর উদ্দেশে

একজন নদীর ভেতরকার নদী
আমার সুদূর ছেলেবেলা,
প্রখর যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের ধূসরিম ভেজা
মাটি ছুঁয়ে ছেনে
কাহিনীকাতার হয় খুব। আমি তার গল্প শুনি
কোনও কোনও ভোরবেলা, দুপুরে অথবা
গোধূলিবেলায় আর কখনও কখনও
সন্ধ্যারাত পেরিয়ে নিশীথ হয়ে যায়।

একজন নদীর ভেতরকার নদী
মেঘনা নামের অন্তরালে বয়ে যায়, রূপ যার
আমার বালক পিতা, যুবা পিতামহ, মাতামহ,
প্রবীণ প্রপিতামহ, তাঁহাদের পূর্বপুরুষেরা
দেখেছেন চোখ ভরে কতকাল, দেখবেন আরও
আমার দু’চোখ দিয়ে, যতদিন আমি বেঁচে আছি।

মাতামহ, পিতা নব্য জীবিকার টানে গ্রাম বাংলার ছোট
পাড়াতলী ছেড়ে, থই থই ধানশোভা,
মেঘনার তটভূমি, তরঙ্গে তরঙ্গে রৌদ্র-চাঁদিনীর ব্যালে
অনেক পেছনে রেখে ইট পাথরের
বেগানা শহরে ডেরা বাঁধলেন। শর্ষেখেতময় প্রজাপতি, ঘুঘু,
মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গীত রক্তে দিয়েছে অদম্য কত দোলা।

কখনও দুপুরবেলা ভৈরবের বিস্তীর্ণ কিনার থেকে আর
কখনওবা আমার আপন গ্রাম পাড়াতলীর ঘনিষ্ঠ কাছাকাছি
আলুঘাটা থেকে মেঘনার মন-নাচানো রূপের
ইন্দ্রজাল বিমুগ্ধ দেখেছি বাল্যকালে আর তুমুল যৌবনে।

একজন নদীর ভেতরকার নদী মেঘনাকে
বারবার দেখেছি তন্ময় হয়ে, এখনও তো দেখি,
যেন সে রূপসী নারী। কখনও কখনও রূপ তার
এমনই মধুর প্রতারক যে হাজার হাজার হীরার
ঝলসানি দ্বিপ্রহরে অথবা জ্যোৎস্নার বর্ষা গহন রাত্তিরে
অবিকল একই মনে হয় ইচ্ছে জাগে ওকে
পৌরুষ উজাড় করে বাঁধি আলিঙ্গনে।
মেঘনা আমার প্রিয়া কেন এমন ব্যাকুল ডাকো বারবার?
মেঘনা আমার শৈশবের, যৌবনের কতদিন করেছ হরণ
অনায়াসে, আমার ভেতরে
জাগিয়েছ কী বিপুল অগণিত ঢেউ,
আজও এই আমার নবীন বার্ধক্যের নানান প্রহরে,
ঝলসে উঠছ তুমি, কখনও কখনও
তোমার নিকট যাই, ছুঁই
তোমার শরীর গাঢ় অনুরাগে, জানি
মৃত্যুর পরেও আমি দেখব তোমাকে ভাবীকালে
যুগ যুগান্তরে বংশধরদের উৎসুক দৃষ্টিতে!
৪.১১.৯৯