অদ্বৈতপ্রকাশ – ৪

চতুর্থ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ সাধ।।
পিতৃ মাতৃ সেবায় প্রভু নিযুক্ত হইলা।
আঞা অনুসারে কার্য্য করিতে লাগিলা।।
হেন মতে এক বৎসর হইল অতীত।
প্রভুর সেবাতে দোঁহে হৈলা আনন্দিত।।
একদিন কমলাক্ষে কুবের কহিলা।
পিতৃমাতৃ সেবা তুহুঁ যথেষ্ট করিলা।।
আয়ুঃ বৃদ্ধি ধন বৃদ্ধি যশোবৃদ্ধি হয়।
যেই জন মাতাপিতায় ভক্তিতে সেবয়।।
আর এক শুন বাছা নিগূঢ় বৃত্তান্ত।
নব্বই বছর মোর হৈল অতিক্রান্ত।।
তুয়া জননীর বয়ঃ এই পরিমাণ।
তুরিতে আসিবে এক পুষ্পক বিমান।।
এ সংসারে মো দোঁহার হৈলে অদর্শন।
গদাধর পদে পিন্ড করিহ অর্পণ।।
তাহে চড়ি গেলা দোঁহে বৈকুণ্ঠভুবনে।
হরিধ্বনি করে প্রভু গভীর গর্জ্জনে।।
লোকাচারে শ্রীঅদ্বৈত খেদ প্রকাশিলা।
যথাবিধি ক্রিয়া কলাপ সমাপ্ত করিলা।
তবে পিতৃবাক্য সঙরিয়া লাভা পুত্র।।
গয়াধামে গেলা যাহা হয় বিষ্ণুক্ষেত্র।।
গদাধরের পাদপদ্মে পিন্ডদান কৈলা।
দিনকত পিতৃকাৰ্য্যে তাঁহা গোঙাইলা।।
তবে প্রভু ভাবে এবে যামু নাভি গয়া।
যদি শ্রীপুরুষোত্তম করে মোরে দয়া।।
তবে শ্রীপুরোষাত্তমে প্রভুর গমন।
রেমুণাথে গোপীনাথে কৈলা দরশন।।
শ্রীমূর্ত্তির মাধুর্য্য দেখি প্রেমে হৈলা ভোর।
ক্ষণে হাসে কান্দে নাচে কভু দেয় নোড়।।
বহুক্ষণ পরে প্রভুর বাহ্য স্ফূৰ্ত্তি হৈলা।
গোপীনাথে প্রণমিয়া স্তবন করিলা।।
তবে চলি নাভিগয়াতে আইলা।
পিতৃপিন্ড দিয়া প্রভু কৃতাৰ্থ মানিলা।।
তবে চলি গেলা শ্রীপুরীর অভ্যন্তরে।
যাঁহা জগন্নাথ রাম সুভদ্রা বিহরে।।
সাষ্টাঙ্গে প্রণমি বহু করিলা স্তবন।
জগন্নাথে কৃষ্ণমূৰ্ত্তি হইল স্ফুরণ।।
দেখিতে দেখিতে প্রভুর প্রেম উথলিল।
হায় প্রাণনাথ বলি মুচ্ছিত হইল।।
কতক্ষণে শ্রীঅদ্বৈত চেতন পাইলা।
কৃষ্ণধন পাইলু বলি হুহুঙ্কার কৈলা।।
উদ্দন্ড করয়ে নৃত্য না যায় কথন।
ক্ষণে হাসে ক্ষণে উচ্চ করয়ে ক্রন্দন।।
মহাভাবাবেশে প্রভুর দিবারাত্র গেল।
অরুণোদয়েতে তাঁর বাহ্য স্ফূর্ত্তি হৈল।।
তবে প্রভু তীর্থরাজে করি স্নান কেলি।
মহাপ্রসাদান্ন পাঞা হৈলা কুতুহলী।।
ক্ষেত্রধামে যাঁহা যাঁহা তীর্থ দেবালয়।
তাঁহা তাঁহা ভ্রমে প্রভু প্রেম পূর্ণ-কায়।।
হেন মতে দিন কত তাঁহাহি রহিলা।
তবু প্রভু সেতুবন্ধ তীর্থেরে চলিলা।।
পথে বহু তীর্থক্ষেত্র করিয়া ভ্রমণ।
গোদাবরী স্নান করি করিলা গমন।।
কভু বা দক্ষিণে চলে কভু চলে বামে।
প্রেমে মাতোয়ারা তাঁর নাহি কোন ক্রমে।।
কত তীর্থ ভ্ৰমে প্রভু না যায় কথন।
শিবকাঞ্চী বিষ্ণুকাঞ্চী কৈলা দরশন।।
কাবেরীতে স্নান পাপনাশনে গমণ।
দক্ষিণে মথুরা আদি করিলা ভ্রমণ।।
তবে প্রভু গেলা মহাতীর্থ সেতুবন্ধ।
ধনুতীর্থে স্নান করি পাইলা আনন্দ।।
রামেশ্বরশিব দেখি করিয়া প্রণতি। [১]
ভক্তিভাবে পূজি কৈলা বহুবিধ স্তুতি।।
রাম ইহার ঈশ্বর, ইহঁ রামদাস।
কহিতেই হৈল মহা প্রেমের উল্লাস।।
উর্দ্ধবাহু হঞা প্রভু করয়ে নর্তন।
ক্ষণে হাসে ক্ষণে কান্দে ক্ষণে অচেতন।।
ক্ষণে কহে কাঁহা রাম মোর প্রাণধন।
গাল বাদ্য করবাদ্য করে মনে মন।।
কতক্ষণ পরে প্রভু প্রেম সম্বরিলা।
রামায়ণ পাঠে সেই নিশি গোঙাইলা।।
ক্রমে বহু তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণ করিলা।
তবে মাধবাচার্য্য স্থানে প্রভু উত্তরিলা।।
মধ্বাচার্য্য সম্প্রদায়ী বহু সাধুগণ। [২]
তাঁহা রহি করে ভক্তিরস আস্বাদন।।
শান্ডিল্য সূত্রে আর শ্রীনারদ সূত্রে।
ভক্তির ব্যাখ্যান করে প্রেমপূর্ণ চিত্তে।।
তাহা শুনি প্রভুর হৈল প্রেম উদ্দীপন।
ভক্তিদেবি দয়া কর বলে মনে মন।।
অদ্ভূত করয়ে নৃত্য ঊর্দ্ধবাহু হঞা।
ক্ষণে ইতি উতি ধায় ক্রন্দন করিয়া।।
প্রেম-সিন্ধুর ঢেউ ক্রমে বাড়িয়া চলিল।
মুৰ্চ্ছিত হইয়া প্ৰভু ভূমিতে পড়িল।।
তাহা দেখি মহোপাধ্যায় মাধ্যবেন্দ্রপুরী।
কহে ইহ ভক্তিধর্ম্মের উত্তমাধিকারী।।
সামান্য জীবেতে না হয় শুদ্ধ প্রেমভক্তি।
চিন্ময় আধারে হয় নিত্য তার স্থিতি।।
শুদ্ধ প্রেমাসব হঁহো করিয়াছে পান।
অন্তর্নিত্যানন্দ ইঁহার নাহি বাহ্যজ্ঞান।।
ইহার শরীরে মহাপুরুষ লক্ষণ।
জগতে তারিতে বুঝো হৈলা প্রকটন।।
তবে সেই সাধুগণ প্রভুরে বেঢ়িয়া।
হরি হরি ধ্বনি করে আনন্দিত হঞা।।
হরিনাম মহৌষধি কর্ণদ্বারে পিয়া।
ভক্তি দেহ বলি প্রভু বলেন গৰ্জ্জিয়া।।
প্রেম বন্যায় সাধু সব ভাসিতে লাগিলা।
প্রেমোল্লাসে কত ভাব প্রভু প্রকাশিলা।।
তবে কতক্ষণে তিহোঁ মনস্থির কৈলা।
ভক্তি কল্পবৃক্ষ পুরীরাজে প্রণমিলা।।
মাধবেন্দ্র প্রেমাবিষ্টে তাঁরে আলিঙ্গিয়া।
কহে কিবা নাম ধাম কহ বিবরিয়া।।
তুহুঁ নিত্য সিদ্ধ শুদ্ধপ্রেমের ভাণ্ডার।
তব দরশনে বহু ভাগ্য মো সবার।।
প্রভু কহে কমলাক্ষাচার্য্য মোর নাম।
ভাগীরথীতীরে শান্তিপুর গ্রামে ধাম।।
তুহুঁ ভক্তি শাস্ত্রাচার্য্য পরম উদাস।
ভক্তিতত্ত্ব কহি মোরে কর নিজ দাস।।
শুনি পুরীরাজ মহাআনন্দিত হৈলা।
প্রভুকে আগ্রহ করি তাহাঞি রাখিলা।।
শ্রীমদ্ভাগবত মাধ্বাচার্য্য-ভাষ্য আর।
প্রভুকে শুনায় পুরী করিয়া বিস্তার।।
শুনিমাত্র প্রভু সব কণ্ঠস্থ করিলা।
তাহা দেখি সাধুগণ বিস্ময় মানিলা।।
একদিন প্রভু কহে পুরীরাজ স্থানে।
কলিকাল শক্ত্যে জীব ধৰ্ম্ম নাহি মানে।
যাঁহা যাঁহা যাঙ তাঁহা দেখোঁ ম্লেচ্ছাচার।
হরেকৃষ্ণ নাম নাহি শুন একবার।।
কৈছে জীবোদ্ধার হৈব নাপাঙ সন্ধান।
সদুপায় কহি জীবের করহ কল্যাণ।।
পুরী করে কমলাক্ষ তুমি দয়ানিধি।
জগতের হিত লাগি ভাব নিরবধি।।
হেন বুদ্ধি সাধারণ জীবে না হয় স্ফুর্ত্তি।
তাহে প্রকটিত হয় যাহে ঐশী শক্তি।।
এবে সাক্ষাৎ পরব্রহ্মের আবির্ভাব বিনে।
অন্যদ্বারে জীবোদ্ধার নাহিক সুগমে।।
ধর্ম সংস্থাপন হৈতু এই কলিযুগে।
স্বয়ং ভগবান প্রকট হইবেন অগ্রে।।
অনন্ত সংহিতা তার সাক্ষী শ্রেষ্ঠতম।
মধ্যস্থ শ্রীভাগবত ভারত আগম।।
প্রভু কহে অনন্তসংহিতা কাঁহা রয়।
তাহা দেখিবারে মোর গাঢ় ইচ্ছা হয়।।
শুনি পুরী অনন্তসংহিতা দেখাইলা।
তাহা পড়ি প্রভু মহা আনন্দিত হৈলা।।
প্রভু কহে নন্দসুত ষড়ৈশ্বর্য পূর্ণ।
গৌররূপে নবদ্বীপে হৈব অবতীর্ণ।। [৩]
হরিনাম প্রেম দিয়া জগত তারিবে।
মো অধমের বাঞ্চা তবে অবশ্য পুরিবে।।
কহিতেই হৈল প্রভুর প্রেম উদ্দীপন।
প্রহরেক গৌরনামে করে সংকীর্ত্তন।।
“গৌর মোর প্রাণপতি যাহা তারে পাঙ।
বেদধৰ্ম্ম লঙ্ঘি মুই তাহা চলি যাঙ”।।
এই পদ গাঞা প্রভু করয়ে নৰ্ত্তন।
তাঁর সঙ্গে নাচে গায় যত সাধুগণ।।
ক্রমে শুষ্ক-প্রেম-গঙ্গার তরঙ্গ বাড়িল।
হা গৌরাঙ্গ বলি বহু ক্রন্দন করিল।।
গৌর পাইনু বলি প্রভু ইতি উতি ধায়।
ক্ষণে ক্ষণে মূৰ্চ্ছা হঞা ধূলায় লোটায়।।
কতক্ষণ পরে প্রভু প্রেম সম্বরিলা।
অনন্ত সংহিতা গ্রন্থ লিখিয়া লইলা।।
একদিন শ্রীঅদ্বৈত উঠিয়া প্রভাতে।
পুরীরাজে প্রণমিয়া চলিলা তুরিতে।।
পথে কত শত তীর্থ করিয়া ভ্রমণে।
দণ্ডকারণ্যেতে প্রভু গেলা কতদিনে।।
নাসিকাদি তীর্থক্ষেত্র করি দরশন।
শ্রীদ্বারকাধামে তবে করিলা গমন।।
লক্ষ্মী আদি বাসুদেব প্রণাম করিয়া।
বহুবিধ স্তুতি কৈলা প্রেমাবিষ্ট হঞা।।
তবে গেলা প্রভাস পুষ্কর আদি তীর্থে।
ক্রমে চলি চলি প্রভু আইলা কুরুক্ষেত্রে।।
তবে হরিদ্বারে প্রভু করিলা গমন।
গঙ্গাস্নান করে কৈলা তীর্থপরিক্রম।।
তবে গেলা তীর্থোত্তম শ্রীবদ্রিকাশ্রমে।
নরনারায়ণ ব্যাস কৈলা দরশনে।।
প্রেমাবিষ্ট হৈঞা বহু করিলা নর্তন।
তাঁহা নমস্করি প্রভু করিলা গমন।।
কত দিনে আইলা পুণ্য গো-মুখী পৰ্ব্বতে।
তবে গেলা শ্রীগন্ডকী শালগ্রাম ক্ষেত্রে।।
তঁহি স্নান করি প্রভু করিলা বিশ্রাম।
হরি নারায়ণ নাম জপে অবিশ্রাম।।
দেখি এক শিলাচক্র সৰ্ব্বসুলক্ষণ।
ভক্তি করি তাহা লৈয়া করিলা গমন।
তবে শ্রীঅদ্বৈত প্রভু আইলা মিথিলায়।
সীতার জন্মস্থান দেখি ধূলায় লোটায়।।
প্রেমাবিষ্ট হঞা করে নর্ত্তন কীৰ্ত্তন।
হেনকালে শুন এক অপূৰ্ব্ব কখন।।
সুমধুর সুললিত কৃষ্ণগুণ গান।
শুনি প্রভু সেই দিকে করিলা পয়ান।।
বটবৃক্ষতলে দেখে এক দ্বিজরায়।
গন্ধর্ব্বের সম কৃষ্ণ গুণামৃত গায়।।
আশ্চর্য্য শুনিয়া কৃষ্ণরূপের বর্ণন।
প্রেমাবেশে প্রভু তাঁরে কৈলা আলিঙ্গন।
আলিঙ্গন ছলে প্রভু দয়া প্ৰকাশিয়া।
প্রেমদান কৈলা দ্বিজে শক্তি সঞ্চারিয়া।।
স্পর্শমণির স্পর্শে যৈছে লৌহ হয় স্বর্ণ।
তৈছে প্রভুর স্পর্শে দ্বিজ হৈলা প্ৰেমে পূৰ্ণ।।
প্রভুরে ঈশ্বরজ্ঞানে দ্বিজ প্ৰণমিলা।
শ্রীবিষ্ণু স্মরিয়া প্রভু তাঁহারে পুছিলা।।
দ্বিজ তব কিবা নাম শুনিতে মন হয়।
কাহার রচিত এই গীত সুধাময়।।
রচনায় মাধুর্য্য ঐছে নাহি শুনো আর।
তাহে তব স্বরালাপ অতি চমৎকার।।
এ হেন সঙ্গীত সুধা মোরে পিয়াইয়া।
মত্ত করি এস্থানে আনিলা আকর্ষিয়া।।
বিপ্র কহে মোর নাম দ্বিজ বিদ্যাপতি।
রাজান্ন ভোজনে মোর বিষয়েতে মতি।।
বাতুলতা করি মুঞি রচিনু এ গীত।
সারগ্রাহী সাধু তুহুঁ তেই ইথে প্রীত।।
তোমা আকর্ষিতে শক্তি ধরে কোন জনে।
নিজ গুণে কৈলা মোর উদ্ধার সাধনে।।
প্রভু কহে তোমার রচিত গীতামৃত।
জীব কোন ছার কৃষ্ণ হয় আকৰ্ষিত।।
ভাগ্যে মোর প্রতি কৃষ্ণ দয়া প্রকাশিল।
তেঁই পদকর্তা বিদ্যাপতির সঙ্গ হৈল।।
এত কহি প্রভু তারে আলিঙ্গন করি।
শ্রীআযোধ্যাধামে চলে স্মরিয়া শ্রীহরি।।
তাঁহা গিয়া দেখি শ্রীরামের জন্মস্থান।
পুলকিত হঞা প্রভু করিলা প্রণাম।।
অদ্ভূত রামের লীলা করিয়া স্মরণ।
প্রেমাবিষ্ট হঞা বহু করয়ে ক্রন্দন।।
ক্রমে প্রেম সুধাসিন্ধুর তরঙ্গ বাড়িল।
রাবণে বধহ বলি হুহুঙ্কার কৈল।।
ভাবাবেশে কৈলা রামের লীলানুকরণ।
কতক্ষণ পরে প্রভু সুস্থ কৈলা মন।।
তবে প্রভু সরযু গঙ্গায় করি স্নান।
রামলীলা স্নান দেখি করিলা পয়ান।।
চলি চলি আইলা প্রভু বারাণসী ধাম।
মণিকর্ণিকার ঘাটে কৈলা গঙ্গাস্নান।।
আদিকেশব দেখি করে সাষ্টাঙ্গ প্রণতি।
প্রেমাবেশে কৈলা তাঁরে বহুবিধ স্তুতি।।
তবে প্রভু করি বিন্দুমাধব দর্শন।
প্রেমাবিষ্ট হঞা করে নৰ্ত্তন কীৰ্ত্তন।।
প্রেমের উল্লাস ক্রমে বাঢ়িয়া চলিল।
পুন পুন প্রণমিয়া স্তবন করিল।।
করযোড়ে কহে শুন শ্রীমাধব হরি।
তোঁহার দয়ার মুঞি যাই বলিহারি।।
ভক্তবাঞ্ছা-কল্প-বৃক্ষ তব দিব্য মূৰ্ত্তি।
ইহঁ মৃত জীব মাত্রে দেহ নিত্যমুক্তি।।
তোমার মহিমা বিধি হর নাহি জানে।
মো ছারের সাধ্য কিবা আছয়ে বর্ণনে।।
তবে ভাবাবেশে গেলা বিশ্বেশ্বর স্থানে।
লোক শিক্ষাইতে প্রভু করিলা পূজনে।।
ভক্তি দেহ বুলি বহু করয়ে স্তবন।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা করেন নৰ্ত্তন কীৰ্ত্তন।।
তাঁহা প্রণমিয়া অন্নপূর্ণা গৃহে গেলা।
অন্নপূর্ণা দেখি বহু স্তবন করিলা।।
তাঁরে নমস্করি প্রভু করয়ে ভ্রমণ।
বহুতীর্থ শিব আদি কৈলা দরশন।।
যোগী নাসী অযাচক সাধুগণ স্থানে।
ভক্তির প্রাধান্য তিঁহো করেন ব্যাখ্যানে।।
শ্রীবিজয়পুরী মহাভাগবতোত্তম।
রাত্রে প্রভুসহ তাঁর হইল মিলন।।
কৃষ্ণকথালাপে দোঁহার হৈল প্রেমানন্দ।
ক্ষণে হাসে ক্ষণে কান্দে বলিয়া গোবিন্দ।
ক্ষণে গড়াগড়ি যায় ক্ষণে অচেতন।
ক্ষণে ভাবাবেগে দোঁহে করে আলিঙ্গন।
হেন মতে মঙ্গলরজনী হৈল ভোর।
অন্যোন্য বিচ্ছেদে দোঁহার দুঃখের নাহি ওর।।
তবে চলি চলি প্রভু প্রয়াগে আইলা।
কেশ মুণ্ডাইয়া ত্রিবেণীতে স্নান কৈলা।।
ভক্তিভাবে তাঁহা কঁরি পিতৃপিণ্ডদান।
বিধিমতে কাৰ্য্য সব কৈলা সমাধান।।
বেণীমাধব দেখি করে স্তুতি নমস্কার।
ভীমের গদা দেখি প্রশংসয়ে বারে বার।।
তবে চলি গেলা প্রভু মথুরা মন্ডল।
যাঁহা স্বয়ং ভগবানের নিত্য-লীলাস্থল।।
নিত্যসিদ্ধধাম প্রাপ্ত্যে হৈল প্রেমোগ্যার।
হা কৃষ্ণ বলিয়া প্রভু ছাড়য়ে হুঙ্কার।।
উছলিল প্রেম বন্যা মথুরা ভাসিল।
আবাল বৃদ্ধ যুবা গণে তাহে ডুবাইল।।
ভাবাবেশে শ্রীযমুনা করি দরশন।
বহুস্তুতি নতি কৈলা না যায় কথন।।
পূর্ব্বে হরিভক্ত এক ছিলা ধ্রুব নামে।
কৃষ্ণ আরাধনা তিঁহো কৈলা যেই স্থানে।।
সেই স্থল ধ্রুবঘাট বলিয়া বিখ্যাত।
তাঁহা পিণ্ডদানে শত গয়া ফল প্রাপ্ত।
শ্রীযমুনায় স্নান করি আচার্য্য গোসাঞি।।
ভক্তিভাবে পিতৃপিণ্ড দিলা সেই ঠাঞি।
তবে কৃষ্ণ শ্রীবিগ্রহ করি দরশন।
স্তব্ধ প্রেম রসে তেঁহো হইলা মগন।।
কৃষ্ণ লীলা স্থান সব করি পরিক্রমা।
কি আনন্দ পাইলা প্রভু নাহি তার সীমা।।
তবে চলি গেলা প্রভু শ্রীমদ্বজধামে।
চিন্ময়ভূমি স্পর্শমাত্র মোহ হৈলা প্রেমে।।
যদ্যপি চিন্ময় ভূমি মথুরাদি হয়।
প্রেমাধিক্য ব্রজে হয় গোপী ভাবোদয়।।
কতক্ষণে শ্রীঅদ্বৈত পাইলা চেতন।
কাঁহা প্রাণনাথ বলি করয়ে ক্রন্দন।।
মহাভাবাবেশে ক্ষণে ইতি উতি ধায়!
এই চিন্ময় রজ বুলি ধূলায় লোটায়।।
ক্ষণে হাসে ক্ষণে করে উদ্দণ্ড নর্তন।
কভু কৃষ্ণ বলি করে গভীর গর্জ্জন।।
স্বেদ কম্প স্তম্ভ আদি ধরে ক্ষণে ক্ষণে।
সেই ভাবে গেলা প্রভু গিরি গোবর্দ্ধনে।।
গোবর্দ্ধন দেখি প্রেম তরঙ্গ বাঢ়িল।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা প্ৰভু নাচিতে লাগিল।।
রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলা স্থানাদি দেখিয়া।
এক বটবৃক্ষতলে রহিল শুতিয়া।।
শেষরাত্রে নিদ্রাবেশে দেখয়ে স্বপন।
শ্রীনন্দনন্দন আসি দিল দরশন।।
নবীন নীরদ কান্তি ভুবন মোহন।
শিখি পুচ্ছ মৌলী নট সবংশী বদন।।
পীতাম্বরধারী পদে সোনার নূপুর।
নবনীত কলেবর রসামৃত পূর।।
অপরূপ রূপ দেখি মহানন্দ পাঞা।
মহানৃত্য করে প্রভু ঊর্দ্ধ বাহু হঞা।।
স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্ৰ কহে তুমি মোর অঙ্গ।
তোমার সহ্য পাইলে বাড়ে প্রেমের তরঙ্গ।।
গোপেশ্বর শিব তুহুঁ বড় দয়াময়।
জীবের মঙ্গল লাগি তোমার উদয়।।
লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার আর ভক্তি পরাজয়।
কৃষ্ণ নাম দিয়া কর জীবের নিস্তার।।
মোর এক দিব্য মূর্ত্তি মহামণিময়।
মদনমোহন নাম কুঞ্জমধ্যাৎ রয়।
দ্বাদশ আদিত্য তীর্থে যমুনার তীরে।
অল্প মৃত্তিকাতে আচ্ছাদিত কলেরবে।।
পূর্ব্বে এই মূৰ্ত্তি কুব্জা কৈলা সুসেবন।
দস্যুভয়ে শেষে মুই হৈনু সংগোপন।।
গ্রাম হৈতে লোক আন ফাঢ় ভালমতে।
সেবা প্রকাশিয়া কর জগতের হিতে।।
এক কহি কৃষ্ণচন্দ্ৰ হৈলা অন্তহিত।
প্রভু জাগি শুদ্ধ প্রেমে হইলা পূর্ণিত।।
তবে উচ্চ হরিনাম গাইতে গাইতে।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা চলে নাচিতে নাচিতে।।
গ্রামের ভিতরে প্রভু কৈলা আগমনে।
সাধু দেখি লোক সব আইলা সেই স্থানে।।
প্রভু কহে তুমি সব চলহ সত্বরে।
দ্বাদশ আদিত্য তীর্থে যমুনার তীরে।।
ছোট বড় যেবা আছে চল মোর সঙ্গে।
উঠাইমু কৃষ্ণমূৰ্ত্তি ললিত ত্ৰিভঙ্গে।।
তাহা শুনি লোক সব অতি হরষিতে।
কুঠারী কোদালী লঞা চলিল তুরিতে।।
বহু পরিশ্রমে সবে কাঢ়িল বিগ্রহ।
অত্যাশ্চর্য্যরূপে ব্রজবাসী হৈলা মোহ।।
তবে বটবৃক্ষতলে ঝুপার বান্ধিলা।
অভিষেক করি তঁহি ঠাকুর স্থাপিলা।।
একজন সদাচারী বৈষ্ণব-ব্রাহ্মণে।
নিযুক্ত করিয়া প্রভু বিগ্রহ সেবনে।।
বৃন্দাবন পরিক্রমায় করিলা গমন।
হেন কালে শুন এক দৈবের ঘটন।।
দৃষ্ট যবনেরা পাঞা ঠাকুরের তত্ত্ব।
ভাবে ঠাকুর ভাঙ্গি হিন্দুর নাশিমু মহত্ব।।
যুক্তি করি ম্লেচ্ছগণ হইয়া একত্ৰ।
অদ্বৈত বটেতে আইলা লঞা অস্ত্রশস্ত্র।।
মদনমোহন দুষ্ট ম্লেচ্ছভয় পাঞা।
পুষ্পতলে লুকাইলা গোপাল হইয়া।।
ম্লেচ্ছগণ প্রবেশিয়া শ্রীমন্দির দ্বারে।
ঠাকুর না দেখি গেলা দুঃখিত অন্তরে।।
সেবাইত দ্বিজ আইলা পূজিবার তরে।
ঠাকুর না দেখি ঘরে হাহাকার করে।।
তবে এক শিশুমুখে দ্বিজ পাইলা তত্ত্ব।
ম্লেচ্ছগণ দেবহগৃহে করিলা দৌরাত্ম্য।।
মনে ভাবে ঠাকুর লঞা ম্লেচ্ছগণ গেলা।
মোর প্রতি ভগবান নিৰ্দ্দয় হইলা।।
দুঃখিত হইয়া তিঁহো আহার না কৈলা।
সন্ধ্যাকালে শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু তাঁহা আইলা।।
দ্বিজবর মুখে প্রভু শুনি বিবরণ।
শূন্যগৃহ দেখি বহু করিলা রোদন।।
প্রভু কহে কৃষ্ণ স্বয়ং দয়া করি আইলা।
অপরাধ পাঞা বুঝি পুন লুকাইলা।।
মহাদুঃখী হঞা প্রভু জল না খাইলা।
রাত্রিতে সেই বৃক্ষমূলে শুতিয়া রহিলা।।
স্বপ্নে দেখা দিলা স্বয়ং মদনমোহন।
হাসিঞা আচার্য্যে কহে মধুর বচন।।
উঠহ অদ্বৈত মুঞি ম্লেচ্ছগণ ডরে।
গোপাল হইয়া লুকাইল পুষ্পান্তরে।।
ব্রহ্মাদ্যের নাহি এরূপ দর্শনের শক্তি।
তব ভক্তি চক্ষে মাত্র পাইবেক স্ফূৰ্ত্তি।।
ফিরি পূর্ব্ব সিদ্ধরূপে হইমু প্ৰকাশ।
লোক সব দেখি পাইব অনন্ত উল্লাস।।
স্বপ্ন দেখি প্রভু ঝাট শ্রীমন্দিরে গেলা।
পুষ্পতলে বিরাজিত গোপালে দেখিলা।।
নিখিল-মাধুর্য্য-পূর্ণ-রসামৃত মূর্ত্তি।
দেখি শুদ্ধ প্রেমে কান্দে বাহ্য নাহি স্ফূৰ্ত্তি।।
ক্ষণে স্তম্ভ ক্ষণে কম্প রোমাঞ্চিত কায়।
ক্ষণে হরি বুলি নাচে ক্ষণে মূৰ্চ্ছা যায়।।
কতক্ষণে শ্রীঅদ্বৈত বাহ্য প্রকাশিলা।
ফল জল শ্রীগোপালে ভোগ লাগাইলা।।
শ্রীমহাপ্রসাদ প্রভু করিয়া গ্রহণ।
অতুল্য কৃষ্ণের দয়া করিল চিন্তন।।
প্রভাতে উঠিয়া প্রভু প্রাতঃস্নানে গেলা।
শ্রীযমুনার তীরে সেই বিপ্রে দেখা পাইলা।।
প্রভু কহে বিপ্ৰ ঝাট যাহ শ্রীমন্দিরে।
ঠাকুর উঠাইয়া পূজা করহ সত্ত্বরে।।
মদনগোপাল নামে করিবা পূজন।
নিগুড় রহস্য শুনি নাহি প্রয়োজন।।
দ্বিজ কহে শ্রীবিগ্রহ নাহি মন্দিরে।
প্রভু করে ভক্তে কৃষ্ণ ছাড়িতে না পারে।।
আশ্চৰ্য্য মানিয়া বিপ্র করিলা গমন।
ঠাকুর দেখিলা দ্বার করি উদ্ঘাটন।।
প্রেমাবিষ্ট হঞা দ্বিজ বহু স্তুতি করে।
মদনগোপাল নামে পূজিলা ঠাকুরে।।
তদবধি শ্রীবিগ্রহ মদনমোহন।
মদনগোপাল নামে হৈলা প্রকটন।।
একদিন রাত্রে প্রভুর স্বপ্নাবেশে।
মদনগোপাল কহে সুমধুর ভাষে।।
অহে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য শুন এক কথা।
মথুরার চৌবে এক আসিবেক হেথা।।
ইঁহা দুষ্ট ম্লেচ্ছগণের অত্যাচার হয়।
চৌবে মোরে সমপিয়া হও অসংশয়।।
শ্রীঅদ্বৈত কহে শুন মদনগোপাল।
তুহুাঁ মোর প্রাণধন আত্মরাম বল।।
তোমা বিনু কৈছে মুঞি ধরিব জীবন।
জীবন বিহনে যৈছে মনের পতন।।
তাহা শুনি হাসি কহে মদনগোপাল।
তোর বশীভূত মুঞি হঙ চিরকাল।।
তো বিনা না হয় মোর লীলার পুষ্টিতা।
যাঁহা তুমি তাঁহা মোর হয় নিত্য সত্তা।।
মোর এই সিদ্ধমূর্ত্তি করি সমর্পণ।
দয়া করি কর ভক্তের অভীষ্ট পূরণ।।
পূরব বৃত্তান্ত এক করহ স্মরণে।
শ্রীবিশাখারূপে যাহা কৈলা নিরমাণে।।
সেই চিত্রপটে মোর অভিন্ন বিগ্রহ।
সেই রূপ দেখি শ্রীরাধিকা হৈল মোহ।।
নিত্যসিদ্ধ বস্তু সে নিকুঞ্জবনে রয়।।
তাঁহা চল অনায়াসে পাইলা নিশ্চয়।।
সেই চিত্রপট লঞা যাহ নিজ দেশে।
জীব নিস্তারহ সেবা করিয়া প্রকাশে।।
স্বপ্ন দেখি প্ৰভু হৈলা প্রেমেতে বিহ্বল।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা নাচে বলি হরিবোল।।
প্রহরেক পরে প্রভু সুস্থির হইলা।
হেন কালে মথুরায় চৌবে তাঁহা আইলা।।
প্রভুরে দেখিয়া চৌবে দন্তে তৃণ ধরি।
প্রণমিয়া কহে তাঁরে করযোড় করি।।
সৰ্ব্বজ্ঞ পুরুষ তুহুঁ দেব অবতার।
কুব্জা সেবিত মূর্ত্তি করিলা উদ্ধার।।
মদনগোপাল স্বপ্নে আদেশিলা মোরে।
মথুরাতে আনি মোহে স্থাপহ সত্বরে।।
তেঁই মুঞি আইনু প্রভু তোমার গোচরে।
শ্রীবিগ্রহ সমর্পিয়া ধন্য কর মোরে।।
তাহা শুনি চৌবে প্রভু ঠাকুর অর্পিয়া।
বিচ্ছেদে ব্যাকুল হঞা বেড়ায় কান্দিয়া।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে শ্রীনিকুঞ্জবনে গেলা।
চিত্রপট পাঞা প্রেম সিন্ধুতে ডুবিলা।।
নিত্য সিদ্ধ চিত্রপট লইয়া যতনে।
শান্তিপুরে আইলা প্রভু নিজ নিকেতনে।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত প্রকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত প্রকাশে চতুর্থোহধ্যায়ঃ।।

১. গয়া থেকে রামেশ্বর সেতুবন্ধ, মধ্যে নীলাচল – যাত্রাপথ দীর্ঘ। উত্তর থেকে দক্ষিণভারত মাত্র কয়েক পঙক্তিতে।

২. দু’টি পঙক্তিতে মাক্কাচার্য্য ও মধ্যাচার্য্য লিখার কারণ সম্পর্কে বিতর্ক বিদ্যমান। শুধু মুদ্রণ প্রমাদ! নাকি দুটি স্বতন্ত্র!

৩. গৌরের আবির্ভাবের বহু পূর্বে গৌরনাম উল্লেখিত। বানানৌচিত নয়। গ্রন্থের রচনাকাল বিবেচ্য।