অদ্বৈতপ্রকাশ – ১৬

ষোড়শ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ-রাম ভক্তগণ সাথ।।
এক দিন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ভক্তগণে।
বৃন্দাবনে যাঙ বলি কহে সংগোপনে।।
ভক্তগণ কহে এই হয় বর্ষাকাল।
এবে ব্রজধামে যাওয়া নাহি দেখি ভাল।।
সাধু বৈষ্ণবের বাক্য মহাবেদ হয়।
তাহার লঙ্ঘনে সর্ব্ব শুভ করে ক্ষয়।।
এত কহি গৌর ভক্ত-বাক্য স্বীকারিলা।
নিজ গণ লঞা গৌর দেশেরে চলিলা।।
শান্তিপুরে আচার্য্যের ঘরে উত্তরিলা।
গৌর দেখি প্রভু প্রেমে বিহ্বল হইলা।।
হুঙ্কার করয়ে ক্ষীণ উদ্দণ্ড নৰ্ত্তন।
অদ্য কি সৌভাগ্য মোর কহে অনুক্ষণ।।
সীতামাতার প্রেমের কথা কহনে না যায়।
নেত্র গঙ্গাজলে গোরার সর্ব্বাঙ্গ ধোয়ায়।।
সীতার নন্দনগণ মহা তেজীয়ান।
তার মধ্যে ভক্তিযোগে এ তিন প্রধান।
শ্রীঅচ্যূত কৃষ্ণমিশ্র শ্রীগোপাল দাস।
এই তিনের সুচরিত্রে প্রভুর উল্লাস।।
ইহা সভার হয় নিত্য গৌর-গত-প্রাণ।
গৌরাঙ্গে দেখিয়া প্রেমামৃতে কৈলা স্নান।।
উচ্চ স্বরে নাম গায় গন্ধৰ্ব্ব জিনিয়া।
কভু প্রেমে মত্ত হঞা বুলেন গৰ্জ্জিয়া।।
বাহু পসারিয়া নাচে গৌর নিত্যানন্দ।
মহাসংকীৰ্ত্তন করে যত ভক্তবৃন্দ।।
সুদর্শন গঙ্গামৃতে মুঞি স্নান কৈলোঁ।
কোটি ভাগ্যোদয়ে সেবা-কাৰ্য্যে ব্ৰতী হৈল।।
সীতামাতা পাক কৈলা অমৃত নিছিয়া।
তিন ঠাকুর সেবা কৈলা ভক্তগণ লৈয়া।।
কি আনন্দ হৈল তাহা কহনে না যায়।
যার মহাভাগ্য সেই মহাপ্রসাদ পায়।।
শ্রীগৌরাঙ্গের আগমন শুভ বাৰ্ত্তা পাঞা।
শান্তিপুরে শচীমাতা আইলা হৰ্ষ হঞা।।
মাতার দর্শনে গোরা দন্ডবৎ কৈলা।
স্নেহভরে শচীদেবী তানে কোলে লৈলা।।
যৈছে কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ যশোদার কোলে।
সেই ভাদোম হৈল ভক্ত হৃৎকমলে।।
হেন লীলা দেখি কেবা স্থির হৈতে পারে।
সৰ্ব্ব-চিত্ত আকর্ষিলা প্রেম সিন্ধুনীরে।।
তবে শচী বিবিধ ব্যঞ্জন কৈলা পাক।
শ্রীগৌরাঙ্গের প্রিয় যত আর বাতুয়া শাক।
লাউন কলকী আর পায়স পিঠাপানা।
অমৃত নিছিয়া সভ নাহিক উপমা।।
ভোজনে বসিলা তবে শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য।
দক্ষিণে নিতাই বামে শ্রীঅদ্বৈত ধন্য।।
মহাপ্রভু কহে শাক সৰ্ব্বোত্তম হয়।
আর কিছু পাইলে ভাল নিত্যানন্দ কয়।।
মোর প্রভু হাসি কহে প্ৰভু নিত্যানন্দে।
গঙ্গা সম তুয়া প্রীতি হয় নীচ বৃন্দে।।
নিত্যানন্দ কহে তব শির ঊর্দ্ধ মুখে।
ঊর্দ্ধ বস্তু বিনা কৈছে নীচ বস্তু দেখে।।
তবে তিন ঠাকুরের হইল উচ্চ হাস।
মহা ভাগ্যবন্তে সমঝিলা তদাভাস।।
ক্রমেঞি বাঢ়ায় মাতা সেবার সৌষ্ঠব।
প্রতিদিনে প্রভুর ঘরে হৈল মহোৎসব।।
দিন কত পরে শ্রীচৈতন্য মহেশ্বর।
ব্রজে যাইবাঙ বুলি চলিলা সত্বর।।
ক্রমে রামকেলি গ্রামে করিলা গমন।
রূপ সনাতন সহ হইল মিলন।।
শ্রীরূপ আর সনাতন সৰ্ব্ব বিদ্যানিধি।
রাজমন্ত্রী ছিলা বৃহস্পতি সম বুদ্ধি।।
মহাপ্রভু দোঁহার প্রতি বড় কৃপা কৈলা।
বিষয়-সুখ ছাড়ি দোঁহে নিন্মৎসর হৈলা।।
শ্রীচৈতন্য কহে যাইবাঙ বৃন্দাবন।
নিভৃতে নিষেধ করে রূপ সনাতন।।
দোঁহে কহে শুন দয়াসিন্ধু মহাপ্রভু।
বহু জন সঙ্গে লঞা না যাইবা কভু।।
ভক্ত বাক্যে শ্রীগৌরাঙ্গ চলিলা দক্ষিণে।
শান্তিপুরে উপনীত হৈলা কত দিনে।।
গৌর সমাগমে প্রেমানন্দ উখলিল।
মোর প্রভু সংকীর্ত্তন মহোৎসব কৈল।।
তহি গোরা শচীমাতার দরশন পাঞা।
দক্ষিণে চলিলা ব্রজে যাওয়ার আজ্ঞা লঞা।।
পথে রঘুনাথ দাস সহ সম্মিলন।
যাহার ভজনে চমৎকার সাধুগণ।।
গৌর-চন্দন কর-বৃক্ষের সান্ধ হিল্লোলে।
যার বিষয়-বিষ ক্ষয় হৈল অবহেলে।।
যাহার বৈরাগ্যে মহাপ্রভু প্রশংসিল।
সে তত্ত্ব বর্ণিতে ক্ষম মোহর নহিল।।
এক দিন শ্রীচৈতন্য ক্ষেত্র ধামে গেলা।
জগন্নাথে দেখি প্রেম রসার্দ্র হইলা।।
গৌরে দেখি ভক্তগণ আনন্দে মাতিলা।
নাম সংকীৰ্ত্তন মহা মহোৎসব কৈলা।।
দিন কত পরে শ্রীমান গৌর-বিশ্বম্ভর।
বৃন্দাবন যাইতে দৃঢ় করিলা অন্তর।।
এক দিন গূঢ় ভাবে রজনীর শেষে।
ব্রজধামে চলে গোরা মহা ভাবাবেগে।।
সুপ্রশস্ত পথ ছাড়ি উপপথে যায়।
ঝারিখন্ডের পথে চলে লোকের বিস্ময়।।
উচ্চ করি হরিনাম সংকীৰ্ত্তন করে।
গৌরে দেখি পশুগণের হিংসা গেল দূরে।।
মহাপ্রভু কহে অরে বনপশুগণ।
কৃষ্ণ বলি কান্দ সভার ছিন্ডিবে বন্ধন।।
স্বয়ং ভগবানের আজ্ঞা অমোঘ নিশ্চয়।
প্রেমে পশুগণ কৃষ্ণ বলিয়া কান্দয়।।
নিবিড় কাননে হৈল হইল মহা মহোৎসব।
নাম-বলে মুক্ত হৈলা পশু পক্ষী সব।।
কি কহব শ্রীচৈতন্যের দয়ার মহত্ব।
হরিনামে স্থাবরাদি হৈলা জীবন্মুক্ত।।
শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্যের লীলা মহারত্নাকর।
চতুর্মুখ আদি অন্ত না পায় ইহার।
মুঞি ক্ষুদ্রতম জীব কিছুই না জানি।
মনের আনন্দে ক্ষুদ্র সূত্ৰ মাত্ৰ গণি।।
অজ্ঞের বিশ্বাস ইথে না হয় কিঞ্চিত।
বিজ্ঞের গোচর ইহা জানিহ নিশ্চিত।।
স্বয়ং ভগবানের লীলা কথা বহু দূরে।
ভক্তের দিব্য-শক্তি ভাগ্য প্রত্যক্ষে নেহারে।।
ক্রমে মহাপ্রভু চলে নাম প্রচারিয়া।
পথে বহু বৈষ্ণব কৈল শক্তি সঞ্চারিয়া।।
দিন কত পরে গৌর কাশীধামে গেলা।
মণিকর্ণিকার ঘাটে গঙ্গাস্নান কৈলা।।
তাহাঞি তপনমিশ্র দেখি শ্রীগৌরাঙ্গে।
মহানন্দী হঞা প্রণমিল অষ্ট অঙ্গে।।
নিজ গৃহে লৈয়া গেলা করিয়া মিনতি।
তহি গৌরচন্দ্র দিন কত কৈলা স্থিতি।।
তবে গোরা বিন্দুমাধব দর্শন করিয়া।
মনোহর নৃত্য করে উর্দ্ধবাহু হঞা।।
প্রেম সম্বরিয়া করে দন্ডবৎ প্রণতি।
অনন্ত সমানে করে বহুবিধা স্তুতি।।
বিশ্বেশ্বর দেখি গোরার প্রেম উথলিল।
মুখে মাত্র হরি হর হরি হর বোল।।
প্রণমিয়া শিবে কৈলা দিব্য স্তুতি পাঠ।
ব্রহ্মা যৈছে চতুর্মুখে করে বেদ পাঠ।।
অলৌকিক প্রেম গোরার অলৌকিক মূর্ত্তি।
দেখি সবে কহে এই সাধক চক্রবর্ত্তী।।
তবে শ্রীচৈতন্য অন্নপূর্ণারে দেখিয়া।
পৌর্ণমাসী বুলি ডাকে প্রেমেতে মাতিয়া।।[১]
ক্ষণে হাসে ক্ষণে কান্দে ক্ষণে মূৰ্চ্ছা যায়।
ক্ষণে বা হুঙ্কার করি নাচিয়া বেড়ায়।।
দেখি কাশীবাসীর মনে লাগে চমৎকার।
কেহ কেহ কহে ইহো দেব অবতার।।
তবে মিশ্র আপনার ঘরে লঞা গেলা।
নানা উপহারে মহাপ্রভুর ভোগ দিলা।।
সবান্ধবে মহাপ্রসাদ করিলা ভোজন।
তহি গৌরাসহ চন্দ্রশেখর মিলন।।
তবে শ্রীগৌরাঙ্গ আদিকেশব বিগ্রহ।
দরশন করি শুদ্ধপ্রেমে হৈলা মোহ।।
হেন মতে কাশীধামে মহোৎসব করি।
তাঁহা হৈতে শ্ৰীপ্ৰয়াগে গেলা গৌরহরি।।
ত্রিবেণী দেখিয়া হৈলা প্রেমেতে বিহ্বল।
কলিন্দ-নন্দিনী বুলি ডাকয়ে কেবল।।
অহো ভাগ্য যমুনার পাইনু দর্শন।
হাহাকার করি জলে হৈল উৎপতন।।
দিন ব্যাপী গোরা যমুনায় ডুবি রৈলা।
দয়া করি সন্ধ্যাকালে ভাসিয়া উঠিলা।।
নৌকায় উঠাইলা তাঁরে কৈবর্ত্তের গণ।
নায়ে বসি গোরা করে হরি-সংকীর্ত্তন।।
সেই সুমধুর রবে সভে মোহ গেলা।
অতি হষধিতে গোরা তটেতে আইলা।।
আরাত্রিক কালেতে তবে শচীর নন্দন।
মাধব দেখিয়া প্রেমে করয়ে ক্রন্দন।।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা গোরা ছাড়য়ে হুঙ্কার।
ভক্তিং দেহি ভক্তিং দেহি বোলে বার বার।।
করয়ে অদ্ভূত নৃত্য লোক অগোচর।
গৌরাঙ্গ প্রেমবৈচিত্র্যে কান্দে চরাচর।।
বহুক্ষণে গোরা প্রেম কৈলা সম্বরণ।
ভীমগদা দেখি হৈল কৌতুকোদ্দীপন।।
তবে শ্রীপ্রয়াগ হৈতে চলে বৃন্দাবন।
পথে জীব নিস্তারিলা দিয়া প্রেম-ধন।।
ক্রমে গৌর মথুরা মণ্ডলে উত্তরিলা।
গোপী-ভাবাবেশে আত্ম বিস্মরণ হৈলা।।
কাঁহা কানু কাঁহা কানু কাঁহা তারে পাঙ।
বিচ্ছেদ অনলে পোড়া পরাণ জুড়াঙ।।
এই পদ গাইতে গাইতে বাক্য স্তম্ভ হৈল।
কাঁহা কাঁহা বুলি মাত্র কান্দিতে লাগিল।।
এই ভাবে গেল গোরার দ্বিতীয় প্রহর।
শেষে গড়াগড়ি যায় লোক ভয়ঙ্কর।।
কতক্ষণ পরে আত্মলীলা ভাবাবেশে।
ইতি উতি বুলে গোরা কংসের উদ্দেশে।।
সিংহনাদ করে আর বাহু আস্ফালন।
লাফ দিয়া উঠে ঊর্দ্ধে কে জানে তার মন।।
হেন মতে নানা ভাবের হৈল উদ্দীপন।
দিবস রজনী গেল যৈছে একক্ষণ।।
তবে ধ্রুব ঘাটে গেলা শচীর নন্দন।
ধ্রুবের চরিত্র স্মরি করয়ে ক্রন্দন।।
লোকের সংঘট্ট দেখি প্রেম সঙ্কোচিলা।
স্নান করি শ্রীবিগ্রহ দরশন কৈলা।।
তবে গেলা মহাপ্রভু শ্রীধাম বৃন্দাবনে।
ব্রজ-প্রাপ্তি মাত্র প্রেমে হৈলা অচেতনে।।
বহুক্ষণে শ্রীগৌরাঙ্গ পাইয়া চেতন।
এই এই বুলি হৈল বাক্যের স্তম্ভন।।
চিন্ময় রঙ্গে গড়াগড়ি করে অবিশ্রান্ত।
মহাভাবে ডাকে গোরা কাঁহা মোর কান্ত।।
কাঁহা কানু কাঁহা কানু ডাকে বনে বন।।
দিবস রজনী করে কৃষ্ণ অন্বেষণ।।
অবিশ্রান্ত প্রেমধারা বহে দু’নয়নে।
কভু উচ্চৈঃস্বরে কান্দি বুলে বনে বনে।।
কভু উচ্চ হাস্য করে প্রহর পর্য্যন্ত।
কভু সিংহনাদ করে কে বুঝে তার অন্ত।।
মহাপ্রভুর মহাভাব দেব অগোচর।
সেই ভাব বর্ণিতে শকতি আছে কার।।
ব্রজের পথে পথে গোরা করয়ে ভ্রমণ।
কৃষ্ণ বোল কৃষ্ণ বোল কহে অনুক্ষণ।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের আজ্ঞায় স্থাবর জঙ্গম।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ রব করে অনন্তের সম।।
হেনকালে গৌরে ঘিরি গাভী-বৎসগণ।
কৃষ্ণগন্ধে গৌরঅঙ্গ করয়ে লেহন।।
গৌরাঙ্গ অমৃত-গঙ্গা করি আস্বাদন।
মহা প্রেমাবেশে গো-কুল করয়ে ক্রন্দন।।
দেখি গোরা কহে ব্ৰজের অবিচিন্ত গুণ।
ব্রজবাসী জনে স্বাভাবিক কৃষ্ণ প্রেম।।
এত কহি কর-পদ্ম দিলা সভার গায়।
গো-কুল করয়ে নৃত্য ব্রজ-গোপী প্রায়।।
গো-বৎসের নৃত্যে গোরার প্রেম উথলিল।
হী হী ধ্বনি করি নাচে যৈছে মাতোয়াল।।
হেথা শ্রীঅচ্যুতানন্দ অদ্বৈতনন্দন।
গোরা চাহি বুলে যৈছে উন্মাদ লক্ষণ।।
ক্ষণে কাঁহা গোরা বুলি ছাড়য়ে হুঙ্কার।
শ্রীগৌরাঙ্গ বুলি কভু কান্দে অনিবার।।
ক্ষণে কহে কাঁহা মোর প্রাণ গোরাচাঁদ।
গৌরাঙ্গ জানিলা প্রিয়-ভক্তের বিষাদ।।
আয় আয় আয় বুলি গোরা কৈলা আকর্ষণ।
যোগী সম তাঁহা আইলা সীতার নন্দন।।
শান্তিপুর-হৈতে ব্রজ বহু দিনের পথে।
অচ্যূত আইলা গোরার আজ্ঞা-পুষ্পরথে।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণভক্তের অচিন্ত্য-শক্তি হয়।
সকলি সম্ভবে ইথে নাহিক বিস্ময়।।
গৌরাঙ্গে দেখি অচ্যূত কহে উচ্চ ভাষে।
অরে গোরা প্রাণ লঞা আইলি দূরদেশে।।
ভক্তি-ব্রজ ছাড়ি আইলি গোপী-ব্রজধামে।
ভক্তি-ব্রজে যাবি কি না মজবি গোপী-প্রেমে।
যদ্যপি শ্রীগোপী-ব্রজ নিত্যানন্দময়।
তার উত্তমাঙ্গ সেই ভক্তি-ব্রজ হয়।।
তুয়া লাগি শ্রীযশোদা আদি ব্ৰজ-জন।
ভক্তি-ব্রজ নবদ্বীপে হৈলা প্রকটন।।
শূন্য গোপী-ব্রজে আইলি কিবা ভাবাবেশে।
তাহা জানিবারে মুঞি আইনু তোর পাশে।।
শ্রীগৌরাঙ্গ কহে তুহুঁ ভাগবতোত্তম।
সৰ্ব্বজীবে হয় তোমা শ্রীকৃষ্ণ স্ফূরণ।।
প্রেমাবেশে কহ কত বাতুলের সনে।
শূন্য কহ রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলা স্থানে।।
শ্রীঅচ্যূত কহে রাধাকৃষ্ণ দুয়ে মিলি।
কিবা বাঞ্ছা লাগি এবে এক অঙ্গ হৈলি।।
অনন্তাদি না দেখিলা যেই দিব্যমুৰ্ত্তি।
কোটি ভাগ্যে সেই রূপ মোর আগে স্ফূর্ত্তি।।
তথাপি কহিনু মুঞি শূন্য বৃন্দাবনে।
মহা অপরাধ কৈলোঁ ক্ষম নিজ গুণে।।
গোরা কহে কৃষ্ণের নিত্য সিদ্ধভক্ত যেই।
রাধাকৃষ্ণের শ্রীমূর্ত্তি সৰ্ব্বত্র দেখে সেই।।
কৃষ্ণ তারে প্রাণ-প্রিয়তম করি মানে।
তার অপরাধ কভু না করে গ্রহণে।।
তুহুঁ কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ভক্ত সনাতন।
তোমা সঙ্গে মোর হৈল প্রেম উদ্দীপন।
শ্রীঅচ্যূত কহে তুয়া আজ্ঞা মহাবেদ।
তব সুনিৰ্ম্মল কৃপায় নাহি জীব ভেদ।।
তোমার কৃপাতে তোমায় করায় দৈন্য ভক্তি।
তোহার মহিমা জানে যার শুদ্ধ-ভক্তি।
মুঞি ক্ষুদ্র বস্তুতত্ত্ব কিছুই না জানি।
তব পদাশ্রয়ে মাত্র মহাভাগ্য মানি।।
গোরা কহে কৃষ্ণে তোর গাঢ় অনুরাগ।
তব অঙ্গ স্পর্শি জীব হয় মহাভাগ।।
এত কহি শ্ৰীচৈতন্য অচ্যুতেরে ধরি।
দৃঢ় আলিঙ্গিয়া প্রেমে বলে হরি হরি।।
শ্রীঅচ্যূত গৌর-প্রেমে হইয়া বিহ্বল।
সখী ভাবে নাচে গায় যৈছে মাতোয়াল।।
তাহে শ্রীচৈতন্যের হৈল রাধাকুণ্ড স্মৃতি।
প্রেমাবশে সভে পুছে রাধাকুণ্ড কতি।।
ব্ৰজ জনে কহে তাহা কেহ নাহি জানে।
শুনি গোরা মূৰ্চ্ছা হঞা পড়ে সেই স্থানে।।
অচ্যূত গৌরাঙ্গের সেই মহাভাব দেখি।
রাধাকৃষ্ণ নাম ডাকে ঝরে দুই আঁখি।।
রাধা নাম শুনি গোরা গর্জিয়া উঠিলা।
কাঁহা রাধাকুণ্ড বলি কান্দিতে লাগিলা।।
শ্রীঅচ্যূত কহে ওহে শ্ৰীকৃষ্ণ চৈতন্য।
রাধাকুণ্ডের গূঢ় তত্ত্ব মোর স্থানে শুন।।
গোরা কহে তুহুঁ কৃষ্ণের নিত্য সহচর।
চিন্ময় তীর্থ ক্ষেত্রাদিতে তোহার গোচর।।
শ্রীঅচ্যূত কহে তব দয়ারে প্রণাম।
সৰ্ব্বদা বাড়ায় নিজ ভক্তের সম্মান।।
দুই মহাতীর্থ প্রচারিতে কৈলা মনে।
আর নিজ ভক্তের সর্ব্বজ্ঞত্ব বিজ্ঞাপনে।।
কুণ্ডেশ্বরী কুণ্ডের অচিন্ত্য-শক্তি হয়।
তার সম শক্তি শ্যামকুন্ডের নিশ্চয়।।
অনন্তাদি দেবে দোঁহার অন্ত নাহি পায়।
মুঞি ছার কৈছে জানো তার পরিচয়।।
কাষ্ঠের পুত্তলীসম জানিহ মোহরে।
সেই মত নাচো যেই তব ইচ্ছা স্ফূরে।।
মোর উপদেষ্টা তব প্রিয় গদাধর।
পন্ডিত গোস্বামী যিহ প্রেমের ভান্ডার।।
মোর পিতা কহে যাঁরে শ্রীরাধিকার অঙ্গ।
কৃষ্ণ ভক্তি লভ্য হয় পাইলে যার সঙ্গ।।
তিহোঁ মোরে দয়া করি কহিলা সে বাণী।
তাহা মুঞি কহোঁ ভাল মন্দ নাহি জানি।।
যাঁহা কুণ্ডেশ্বরী রাধার নিত্য অধিষ্ঠান।
তাহাঞি শ্রীরাধাকুন্ড প্রত্যক্ষ প্রমাণ।।
শ্রীরাধাকুন্ড মাহাত্মা কেবা জানে শেষ।
সর্ব্ব তীর্থের অধিষ্ঠাতৃ রূপ নির্ব্বিশেষ।।
সৰ্ব্বতীর্থ পাপীর পাপ করিয়া ক্ষালন।
নিজে সেই পাপপুঞ্জ করয়ে বহন।।
সাধু সমাগমে সেই পাপ হয় ক্ষয়।
তীর্থের তীর্থত্ব লভ্য শ্রুতিগণে কয়।।
কৃষ্ণের চিচ্ছক্তি রূপ রাধাকুণ্ড হয়।
নিত্য সিদ্ধ বস্তু সৰ্ব্ব শক্তি সমাশ্রয়।।
শ্রীরাধাকুণ্ড স্মরণে সৰ্ব্ব পাপ নাশ।
কথনে হয় সনাতন ধর্ম্মেতে বিশ্বাস।।
শ্রীকুণ্ড দর্শনে ভক্তির অঙ্কুর উপজয়।
স্পর্শ মাত্র হয় প্রেম ভক্তির উদয়।।
কুণ্ড জলে স্নানে কৃষ্ণ প্রাপ্তি সুনিশ্চয়।
তীরে দেহ ত্যাগ হৈলে কৃষ্ণ দাস্য পায়।।
শ্রীকুণ্ডের অসংখ্য গুণ কে কহিতে পারে।
আনুষঙ্গিক গুণ কিছু শুন অতঃপরে।।
কুণ্ড তীরে বৈসে যত সিদ্ধ জীবগণ।
রাধাকৃষ্ণ নাম শুনি করয়ে ক্রন্দন।।
শ্রীকুণ্ড দর্শনমাত্র তাপ হয় নাশ।
সংসার বিস্মৃতি মনের বাঢ়য়ে উল্লাস।।
স্বতঃ সেই জল মধুর ঔষধির সমে।
আয়ু বৃদ্ধি রোগ ক্ষয় স্নান আর পানে।।
শ্রীকুণ্ড সংশ্লিষ্ট শ্রীমান শ্যাম-কুণ্ড হয়।
রাধাকুণ্ড সম কৃষ্ণ প্রিয় সে চিন্ময়।।
তাঁহা শ্রীনন্দ-নন্দনের নিত্য-রূপে স্থিতি।
তাহার দর্শনে কৃষ্ণ রূপ হয় স্ফূর্ত্তি।।
তাহার মহিমা শ্রীঅনন্ত নাহি জানে।
রাধাকৃষ্ণ প্রাপ্তি হয় স্নান আর পানে।।
এত কহি শ্রীঅচ্যুত গৌরে প্রণমিলা।
প্রেমাবেশে গোরা তারে গাঢ় আলিঙ্গিলা।।
গোরা কহে শ্রীকুণ্ড-মাহাত্ম্য আজি শুনি।
দেহ প্রাণ মন মোর ধন্য করি মানি।।
এত কহি চলে মহাভাবের আবেশে।
উত্তরিলা লুপ্তপ্রায় রাধাকুণ্ড পাশে।।
শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য কহে আচাৰ্য্য নন্দনে।
এই রাধাকুণ্ড হয় দেখহ লক্ষণে।।
যদ্যপি এই মহাতীর্থ হইল লুপ্তপ্রায়।
তথাপি দেখিয়া মনস্তাপ গেল ক্ষয়।।
সহসা পরমোল্লাস কেনে বা বাঢ়িল।
এত কহি রাধা বলি হুঙ্কার করিল।।
রাধা নাম শুনি যত পশু বিহঙ্গম।
প্রেমাবেশে কান্দে যৈছে কৃষ্ণ-ভক্তোত্তম।।
একে রাধা নাম নিত্য আনন্দজনক।
তাহে গৌর মুখ চ্যূত সৎপ্রেম পূরক।।
সেই ধ্বনি শুনি কাহে প্রেম নাহি স্ফুলে।
প্রেমানন্দ স্থাবর জঙ্গমের অশ্রু ঝুরে।।
শ্রীগৌরাঙ্গ কহে দেখ আচাৰ্য্য-তনয়।
রাধা নামে জীব মাত্রের হৈল প্রেমোদয়।।
এই সত্য রাধাকুন্ড নাহিক সংশয়।
ইহার সংস্লিষ্ট খাদ শ্যামকুন্ড হয়।।
অহো ভাগ্য শ্রীকুন্ড মুই পাইনু দৰ্শন।
সাধু সঙ্গের হয় এই দিব্যচিন্ত্য গুণ।।
এত কহি প্রেমামৃতে হইয়া বিভোর।
ঝাঁপ দিয়া পড়ে জলে সৰ্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর।।
রাধাকুণ্ডে ডুব দিয়া শ্যামকুণ্ডে আইলা।
শ্যামকুণ্ডে স্নান করি রাধাকুণ্ডে আইলা।।
স্নান সমপিয়া কুণ্ডের মৃত্তিকা লইয়া।
সৰ্ব্বাঙ্গে লেপয়ে গোরা প্রেমাবিষ্ট হঞা।।
গাঢ় অনুরাগে শত দন্ডবৎ করি।
কুণ্ডে বহুবিধা স্তব কৈলা গৌরহরি।।
তাহা দেখি শ্রীঅচ্যুত প্রেমেতে মাতিয়া।
এই চিন্ময় কুণ্ড বুলি ফিরয়ে গর্জিয়া।।
তবে মহাপ্রভু কুণ্ডেশ্বরী রাধা ভাবে।
কাঁহা প্রাণনাথ বলি কান্দে উচ্চ-রবে।।
ক্ষণে স্তম্ভ ক্ষণে কম্প ক্ষণে উচ্চ-হাস।
ক্ষণে হুঙ্কার ক্ষণে নৃত্য ক্ষণে দৈন্যভাষ।।
ক্রমে মহা প্রেমাদ্ধি তরঙ্গ বাঢ়িল।
মূৰ্চ্ছা হঞা শ্রীচৈতন্য ভূমিতে পড়িল।।
নিষ্পন্দ গৌরাঙ্গ অঙ্গ দেখি শ্রীঅচ্যুত।
হা হা প্রাণ গৌর বুলি কান্দে অবিরত।।
কত ক্ষণে সীতাসুত হঞা কিছু স্থির।
হরি হরি বলি রব করয়ে গভীর।।
তৃতীয় প্রহরে গোরা পাইয়া চেতন।
রাধাকুণ্ড পাইনু বলি করয়ে নৰ্ত্তন।।
যে দু-এর কুণ্ড দুই সেই দুই মেলি।
দয়া করি প্রকটিলা দেখি ঘোর কলি।।
তবে গৌরচন্দ্র অচ্যুতের হাতে ধরি।
কুণ্ড প্রদক্ষিণ কৈলা মহামন্ত্ৰ পড়ি।।
পুন পুন অষ্ট অঙ্গ কৈলা শত শত।
প্রেমাবেশে কুণ্ডে স্নান করে শ্রীঅচ্যুত।।
তাহান আগ্রহ ভক্তি দৈন্যোক্তি শুনিয়া।
বৃক্ষ মূলে বৈসে গোরা কিছু সুস্থ হঞা।।
গৌরাঙ্গ কহে অচ্যূত তোর সঙ্গ গুণে।
দয়া করি রাধাকুণ্ড হৈলা প্রকটনে।।
অচ্যূত কহয়ে কেনে কর অপরাধী।
তুয়া পদাশ্রিত মুঞি হঙ নিরবধি।।
যুগে যুগে কর তুহুঁ অলৌকিক লীলা।
জীব উদ্ধারিতে গুপ্ত তীর্থ প্রকাশিলা।।
গুপ্ত-প্রেম গুপ্ত-কুণ্ড ছিলা চির দিনে।
দয়া করি রাধাকুণ্ড হৈলা প্রকটনে।।
শুনি মহাপ্রভু কহে এই অতি স্মৃতি।
এই তার পিতৃধর্ম্মে নাহি মোর প্রীতি।।
একে কৃষ্ণ সর্বেশ্বর আর সব দাস।
জীবেতে ঈশ্বর বুদ্ধ্যে হয় সৰ্ব্বনাশ।।
শ্রীঅচ্যূত কহে তব লীলার ধরমে।
দৈন্য উক্তি কর আত্ম-তত্ত্ব আচ্ছাদনে।।
যৈছে লুকাইতে নারে মেঘেতে তপন।
তৈছে প্রকট লীলাতে কৃষ্ণের গোপন।।
এত কহি শ্রীঅচ্যূত করে হরি ধ্বনি।
গোরা কহে নাম সত্য ছাড় অন্য বাণী।।
শ্রীঅচ্যূত কহে নামি পাইনু কোটি ভাগ্যে।
এত বুলি কান্দে গোরার ধরি পাদযুগে।।
তবে দয়াসিন্ধু গোরা দয়া প্রকাশিলা।
নিজ স্নিগ্ধ-মূৰ্ত্তি-যুগ তারে দেখাইলা।।
রসরাজ পূর্ণতম শ্রীকৃষ্ণের মূর্ত্তি।
তার বামে মহাভাব রাধারূপ স্ফূর্ত্তি।।
এই দুই নিত্য বস্তু দেখি শ্রীঅচ্যূত।
প্রেমেতে বিহ্বল হঞা কৈলা দন্ডবৎ।।
বহু বিধা স্তুতি কৈলা পদ্য বিরচিয়া।
গোরা কহে মোর স্তব কর কি লাগিয়া।।
পুন শ্রীঅচ্যুত গৌরে দেখি ন্যাসী রূপ।
কহে রাধা অঙ্গে লুকাইল নিজ রূপ।।
ভালি তব সেবাতে যুগল-সেবা সিদ্ধ।
এত কহি শিরে ধরে গৌর-পাদপদ্ম।।
গোরা কহে তুহুঁ কৃষ্ণ-প্রেম চক্রবর্ত্তী।
যাহাঁ তাহাঁ হয় তব রাধা-কৃষ্ণ স্ফূর্ত্তি।।
এত কহি শ্ৰীচৈতন্য তারে আলিঙ্গিল।
প্রেমানন্দে শ্রীঅচ্যূত নাচিতে লাগিলা।।[২]
সৰ্ব্বলোকে জ্ঞাত হঞা কুণ্ড-বিবরণে।
পবিত্র হইলা স্নান পান দরশনে।।
তবে মহাপ্রভু গেলা গিরি গোবর্দ্ধনে।
লীলা-শৈল দেখি প্ৰেমে হৈলা অগেয়ানে।।
চৈতন্য পাইয়া কহে ওহে গিরিবর।
কৃষ্ণ বিনা হৈলা বুঝি শীর্ণ কলেবর।।
পুন কহে কিবাশ্চৰ্য্য দেখি হায় হায়।
কৃষ্ণ অঙ্গ গন্ধ লাগি রৈল তুয়া গায়।।
আইস আলিঙ্গিয়া পোড়া পরাণ জুড়াঙ।
তবে চল যাঙ যদি প্ৰাণকান্ত পাঙ।।
ইহা কহি শ্রীচৈতন্য বাহু পসারিয়া।
গিরিগোবর্দ্ধনে আলিঙ্গিতে চলে ধাঞা।।
ক্ষণে পড়ে ক্ষণে উঠে নাহি স্থানাস্থান।
প্রদক্ষিণ করে কভু গাহি হরিনাম।।
অলৌকিক প্রেম গোরার অবিচিন্ত্য লীলা।
দয়ামৃত বিতরিয়া জীব নিস্তারিলা।।
শ্রীঅচূত্যানন্দ প্রেমে হইয়া বিভোর।
কভু কান্দে কভু নাচে কভু দেয় লোড়।।
তবে সৰ্ব্ব বন তীর্থ ভ্রমিলা গৌরাঙ্গ।
রাসস্থলী দেখি উথলিল প্রেমোত্তুঙ্গ।।
মহাভাবে কৃষ্ণ অন্তৰ্দ্ধান আরোপিয়া।
গোপী গীতা পড়ি গোরা বুলেন কান্দিয়া।।
ক্ষণে করে রাধা-কৃষ্ণের লীলানুকরণ।
ক্ষণে গীত গায় ক্ষণে করয়ে নর্তন।।
গৌরাঙ্গের প্রেম মহাসাগর নিচয়।
তাহা বর্ণিবারে শ্রীঅনন্ত না পারয়।।
মুঞি মূর্খ ক্ষুদ্র কীট নাহি কিছু জানে।
সূত্র মাত্র গণি সাধু বৈষ্ণব বচনে।।
যদ্যপি ছাড়িতে ব্রজ গৌরের ইচ্ছা নহে।
ভক্ত ইচ্ছায় ব্রজ ছাড়ে অশ্রুধারা বহে।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্রকাশে ষোড়শোঽধ্যায়ঃ।

১. মহাপ্রভুর যাত্রাপথ ও দর্শন ইতোপূর্বে অদ্বৈতের পথানুগমনের অনুসারী

২. অচ্যুতের বিবরেণ কুণ্ড প্রদক্ষিণ, স্নানাদি আণুপূর্বক বিধৃত। এই অংশের বিশদ বিবরণ যত মনোগ্রাহী ততখানিই তথ্যনিষ্ঠ। অচ্যুতের মুখে ঈশানের অবগতি স্বাভাবিক মনে হয়।